শর্তসাপেক্ষে পর্ব-২৬

0
13

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৬( ১ম অংশ)
Sidratul Muntaz

সাদা পর্দায় আবৃত কাঁচের ঘরটায় বিকেলের ম্লান হলুদ আলো প্রবেশ করেছে, পশ্চিমাকাশে সূর্যের র’ক্তিম ছায়া, যেন একরাশ বিষাদ! চারদিকটা দুঃস্বপ্নের মতো ভ’য়ংকর লাগছে দিবার। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, বুকের ভেতর ঠকঠক শব্দ।

রাফিন বসে আছে ঠিক সামনেই, কাউচে। তার চেহারায় কেমন একটা নিগুঢ় নিয়ন্ত্রণশীল ভাব। বড্ড অচেনা লাগছে তার চোখ দু’টো। লালচে আর হিংস্র! ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে উঠেছে সে।

দিবা কাঁপা কণ্ঠে বলে,” কেন? কেন করছো এরকম?”

রাফিন পা নামিয়ে দুই হাঁটুর উপর হাত ঠেকিয়ে বসে। ঠান্ডা স্বরে বলে,” ভ’য় পেয়ো না। শুধু দেখবো তোমাকে। মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবো, প্রমিস। আরে এতো কাঁপছো কেন? ভ’য়ের কিছুই নেই। কিচ্ছু হয়নি!”

রাফিন উঠে এসে দিবার কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করতেই সে ছিটকে সরে যায় তীব্র ঘৃণা নিয়ে। চোখ-মুখ কুচকে বলে,” খবরদার রাফিন, আমি কিন্তু চিৎকার করব। তুমি ভাবতেও পারছো না এই দুঃসাহসের জন্য তোমার কি অবস্থা হবে!”

কথাগুলো বলে দিবা ঢোক গিলে, গলা শুকিয়ে গেছে একদম। রাফিন কতক্ষণ হতবাক চিত্তে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠে। অসুস্থ মানুষের মতো দেখায় তাকে। দিবা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। রাফিন খুব নরম স্বরে বলে,” ভুলেই গেছিলাম। এখন তোমার অনেক ক্ষমতা! চাইলেই অনেক কিছু করে ফেলতে পারো! তো আমার সাথে কি করবে শুনি? চাকরি কেড়ে নিবে? নাকি জেলে ভরবে? ওসব কোনোকিছুরই ভ’য় পাই না আমি। নিজেকে মেন্টালি প্রিপেয়ার করেই এসেছি। হয় এসপায় নয় ওসপার। কিছু একটা তো হবেই।”

” তুমি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছো রাফিন। ”

রাফিন হাসে আবারও। এগিয়ে এসে বলে,” ভ’য় দেখাচ্ছো? তোমার প্রভাবশালী হাজব্যান্ড কি করবে আমাকে? আচ্ছা সে কি জানে আমার কথা? মনে তো হয় না! জানলে নিশ্চয়ই তোমাকে এতো আদর-যত্নে করে সাজিয়ে রাখতো না।”

শেষ কথাটা বলতে বলতে দিবাকে আবারও আপাদমস্তক দেখে রাফিন। দিবা মাথা নিচু করে, গুটিয়ে যায়। বিছানা থেকে ওরনা নিয়ে নিজের গা ঢাকার চেষ্টা করে। রাফিন খুব রসিয়ে রসিয়ে আবার বলে,” যখন সে জানবে আমাদের কথা, যখন বুঝতে পারবে তোমার সাথে আমার কত ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল…”

” খবরদার মিথ্যা বলবে না, কিচ্ছু ছিল না আমাদের মধ্যে! ”

দিবার গর্জনেও রাফিন দমে যায় না। দ্বিগুণ উৎসাহে বলে,” তাই? অবশ্য তোমার দিক থেকে তো আসলেই কিছু ছিল না। ভালো তো একা আমি বেসেছিলাম৷ তোমাকে নিয়ে সিরিয়াস আমি হয়েছিলাম। আর তুমি শুধু আমাকে নিয়ে খেলেছো। সেজন্য নিজের গালেই নিজের চ’ড় মারতে ইচ্ছে করছে।”

দিবা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলে,” আমি জানি তুমি কি ভাবছো রাফিন। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি না, তোমার সাথে কোনো প্রতারণা করিনি। এটাই আমাদের ডেস্টিনি ছিল। আর এটাই ভালো হয়েছে। তুমি যদি ভেবে থাকো ঈশান তোমার ব্যাপারে কিছুই জানে না তাহলে ভুল। বিয়ের আগেই ওকে আমি সব জানিয়েছি।”

রাফিন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শোনে কথাগুলো, হঠাৎ উঠে বসে বলে,”তার মানে পুরোটাই প্ল্যান ছিল? আমাকে ধোঁকা দেওয়ার সব রকমের বন্দোবস্ত করেই মাঠে নেমেছো? তুমি তো পাক্কা খেলোয়াড় দিবা! ”

দিবা চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে বলে,” যা হওয়ার হয়েছে৷ আমাদের বিয়ে হলে আমরা কখনও সুখী হতে পারতাম না।”

এই পর্যায় রাফিন দিবার কানের কাছে এসে চেঁচিয়ে উঠে,” আমরা কথাটা বাদ দাও প্লিজ। তুমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছো। বলো আমার সাথে বিয়ে হলে তুমি নিজে সুখী হতে পারতে না! এমন কোটি কোটি টাকা আর বিলাসবহুল জীবন তো আমি তোমাকে দিতে পারতাম না। আর তোমার তো এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তাই না দিবা?”

দিবা দুইহাতে কান চেপে ধরে সরে যায়। রাফিন হিংস্র হয়ে জিজ্ঞেস করে,” তাহলে আমার সাথে প্রেম কেনো করেছিলি? আমার জীবন নিয়ে কেনো খেললি? বল কেনো করলি তুই এটা?”

দিবাও একই স্বরে গর্জে উঠে বলে,” কারণ তোর স্বভাবের জন্য৷ তুই জীবনে আমাকে বিয়ে করার জন্য সামান্য চেষ্টাও করিসনি। কখনও নিজের লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হোসনি। যদি আমি তোকে বিয়ে করতাম, তুই দুইমাসের মাথায় আমাকে ডিভোর্স দিতি। কারণ আমার অপূর্ণতা মেনে নেওয়ার হিম্মত তোর মধ্যে নেই।”

রাফিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বিহ্বলের মতো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,” কিসের অপূর্ণতা?”

” আমি ইনফেরটাইল। জীবনে কখনও সন্তান জন্ম দিতে পারবো না। এটাই আমার অপূর্ণতা। বল, মেনে নিতি তুই? এমনিই আমাকে বোঝা বানিয়ে দিয়েছিলি আর এই কথা জানার পর নিশ্চয়ই আবর্জনার মতো ট্রিট করতি!”

রাফিন নির্বাক হয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে স্তিমিত দৃষ্টিতে। দিবা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে,” যেকোনো জিনিস আমরা পেলে মূল্য দিতে জানি না। জিনিসটা হারিয়ে ফেলার পর আমাদের টনক নড়ে। আমরা সেই জিনিসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমি তোর জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিস রাফিন। যার মূল্য কখনোই তোর কাছে ছিল না৷ আর এখন তুই যেটা করছিস সেটাকে ভালোবাসা বলে না! বলে ঈর্ষা কিংবা হীনমন্যতা! হয়তো আমার সুখ দেখে তুই ঈর্ষান্বিত নয়তো নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছিস।”

রাফিন এগিয়ে এসে দিবার হাত টেনে তাকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা মেরে বলে,” কি বলছিস তুই এসব? আর ইউ সিরিয়াস? ”

দিবা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,” যদি বিয়ের পর জানতি, আমি কখনও সন্তান জন্ম দিতে পারব না তাহলে কি করতে তুই? আমাকে বিয়ে করার জন্য আফসোস করতি না? আমাদের কখনও একটা সুখী দাম্পত্য জীবন হতো?”

রাফিন এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে বুঝতে পারে না। তারপর হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,” তাহলে এইজন্য ওই ঈশান আহসানকে বিয়ে করেছিস? ”

” হ্যাঁ। শর্তসাপেক্ষে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু এখন আমি তাকে সত্যি ভালোবাসি। সে আমার জীবনে সেই সব সুখ এনে দিয়েছে যা তুই চাইলেই পারতি। কিন্তু কখনওই চেষ্টাই করিসনি। তুই আমাকেই কখনও চাসনি। এখন প্লিজ নাটক দেখাবি না।”

কথাটুকু বলে রাফিনকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় দিবা। তারপর দরজার লক খুলে দিয়ে শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,” চলে যাও রাফিন, প্লিজ। এখানে তোমার আর কোনো কাজ নেই। যদি অন্তত নিজের চাকরিটা বাঁচানোর ইচ্ছা থাকে, তাহলে চলে যাও। এখনও তোমার প্রতি আমার সিমপ্যাথি কাজ করছে। একটু পর হয়তো সেটাও আর থাকবে না। তাই প্লিজ! আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার আগে গেট লস্ট!”

রোজা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। দিবার উচ্চকণ্ঠের আওয়াজে সে ভ’য় পেয়ে পিছিয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পর্দা হাতের মুষ্টিতে নিয়ে। দিবা নিচু হয়ে রোজার গায়ে হাত বুলায়। তারপর গালে চুমু দিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। রাফিনের দিকে তাকিয়ে আবারও তাকে বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা করে দিবা।

রাফিন অনেকক্ষণ ঘোরগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বের হয়ে যায়। লিফটে উঠেও সে স্বাভাবিক হতে পারে না। চিন্তা করতে থাকে দিবার কথাগুলো। সত্যি কি সে কখনও দিবার অপূর্ণতা মানতে পারতো না? কিন্তু সে তো দিবাকে সত্যি ভালোবেসেছিল। তাহলে কেনো দিবা তাকে ভরসা করল না?

ঈশান মিজান সাহেবকে কল করে বলে,” হোয়ার ইজ রাফিন?”

“জ্বী স্যার? কোনো দরকার?”

” ও কনফারেন্স হল থেকে বের হলো কিভাবে? কোথায় ছিলেন আপনি? কি করছিলেন? সবার দিকে নজর রাখার দায়িত্ব কি আপনার ছিল না?”

তার মেঘের মতো বজ্র ধ্বনিতে মিজান সাহেব হকচকিয়ে যান। আমতা-আমতা শুরু করেন,” মানে স্যার, কিছু হয়েছে? মানে ও তো ছিল এখানেই ছিল। আমার জানা মতে…”

ঈশান ফোন কেটে দেয়। সাথে সাথেই কল করে দিবার ফোনে। রোজাকে পাশে নিয়ে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে ছিল দিবা। তখনও বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াস ধড়াস করছে! রোজা একটু উঠে দিবার চুল ঠিক করে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। যেন বুঝতে পারে দিবার অস্থিরতার কারণ৷ দিবা তার ছোট্ট আর নরম হাতে চুমু খেয়ে মৃদু হাসে। তখনি ফোনটা বেজে উঠে৷ ঈশানের নাম্বার দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করতে আগে এক গ্লাস খায় পানি খায় দিবা। তারপর ফোনটা রিসিভ করে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,” হ্যালো।”

ওইপাশ থেকে ঈশান জিজ্ঞেস করে,” কি করছো?”

“এইতো, রোজার সাথে ওর পেইন্টিং করা দেখছি। আর আপনার অপেক্ষা! কখন আসবেন আপনি?” বলেই একটু হাসার চেষ্টা করে দিবা।

রাফিনের ব্যাপারটা কি সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গেল মেয়েটা। ঈশান অবাক হয় খুব। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,” এইতো আর কিছুক্ষণ। ”

” দ্রুত আসুন প্লিজ। আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না। সব কেমন দমবন্ধকর আর অস্থির মনে হচ্ছে!”

” কি হয়েছে?”

দিবা নিঃশ্বাস থামিয়ে বলে,” তেমন কিছু না। দুপুরে ঘুমিয়ে গেছিলাম৷ হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তারপর থেকেই কেমন যেন লাগছে। আপনি একটু দ্রুত আসুন, প্লিজ।”

” হুম, আসছি।”

ফোন রেখে দিবা খুব বড় একটা শ্বাস নেয়। তারপর রোজার বড় বড় চোখের পুতুল মুখটার দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। তার কপালে একটা চুমু দিয়ে, তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,” শোনো বার্বী ডল, আজকে যেটা হলো তার কিচ্ছু তুমি বাবাকে একদম বলবে না ঠিকাছে? তাহলে তোমার বাবা খুব বকবে আমাকে।”

রোজা চুপ করে থাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ দিবার চোখ থেকে অশ্রু গড়ায় নিরবচ্ছিন্ন।

চলব,

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৬( ২য় অংশ)
Sidratul Muntaz

রাফিন তাদের কর্পোরেট সাইটে যাচ্ছে, তার উদ্দেশ্য চুপচাপ নিজের রুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকা৷ টিমের কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, শরীর খারাপের একটা অযূহাত বানিয়ে বলে দিবে। কিন্তু দিবা বলেছিল ঈশান আহসান তাদের ব্যাপারে সব জানে। সে নিশ্চয়ই কিছু একটা আঁচ করে ফেলবে। ভ’য় হচ্ছে রাফিনের। হঠাৎ করেই তীব্র একটা ভ’য় জেঁকে ধরেছে। তখন রাগের মাথায় কিছু পরোয়া করেনি, তবে এই মুহূর্তে দিবার কথাগুলো শুনে তার খুব অদ্ভুত লাগছে। রাগ পড়ে গেছে, অশান্ত মন এখন বিষণ্ণ!অসহ্য একটা বিষব্যথা কাঁটার মতো বিঁধে আছে গলার কাছে।

লিফটের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন কালো ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি গার্ড রাফিনকে ঘিরে ধরে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খায় রাফিন। একজন তার ফোন কেড়ে নিচ্ছে। অন্যজন পেছনে এসে তার দুইহাত চেপে ধরেছে। রাফিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,” হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম মি?”

পেছনের জন চাপা স্বরে বলে,” নাথিং, জাস্ট কাম উইদ আস। ঈশান আহসান এক্সপেক্টিং ইউ।”

ভ’য়ে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে আসে রাফিনের। এতো দ্রুত ঈশান কিভাবে খবর পেল? মাথায় জ্বলে উঠে একটাই নাম- দিবা। ও ছাড়া আর কে বলবে? অথচ একটু আগেই বলছিল রাফিনের জন্য তার সিম্প্যাথি কাজ করছে। সেই সিম্প্যাথির জোরেই বুঝি স্বামীর কাছে অভিযোগ করে রাফিনকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করেছে! হুহ! বেইমান! আবারও বেইমানি করেছে।

যদি এটাই তার উদ্দেশ্য হতো তাহলে কেন তখন নাটক করল? কেন এতো সুন্দর করে রাফিনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল? ওখানেই আটকে রেখে পুলিশ ডাকতো। রাফিনকে ধরিয়ে দিতো। কেন তখন এতো নাটক করল তাহলে? অবশ্য এটাই তো ওর স্বভাব! প্রথমে ভালোবাসার নাটক আর এখন সিম্প্যাথি দেখানোর নাটক! নাটকবাজ দিবা রহমান, ছলনাময়ী!

অথচ রাফিনের উদ্দেশ্য কখনোই দিবার ক্ষতি করা ছিল না। করলে সেটা অনেক আগেই করতে পারতো। অনেক সুযোগ এসেছিল তার কাছে। কিন্তু সে কখনও সুযোগের অপব্যবহার করেনি। আর আজ তো শুধু কথা বলতে চেয়েছিল৷ তবু দিবা এটা কেনো করল? সে কি নিজের ক্ষমতা দেখাতে চায়? কিভাবে তার প্রভাবশালী স্বামী রাফিনের জীবন এক চুটকিতে বরবাদ করতে পারে সেই নোংরা ক্ষমতা!

ঈশান কনভেনশন হল থেকে বের হয়ে যায় বিকাল চারটার মধ্যে। টিমের বাকিরা এখনও ভেতরে। সন্ধ্যা সাতটার আগে ঈশানের নির্দেশনা ছাড়া তারা বের হবে না। আসিফ রাফিনের খোঁজ জানতে চেয়েছিল। ঈশান বলেছে,” রিজ কার্ল্টনে ফিরে গেছে ও। অসুস্থবোধ করছিল। আমি পারমিশেন দিয়েছি কারণ ওর এমনিতেও এখানে কোনো কাজ নেই।”

আসিফ আর তৌহিদ আর কিছু বলে না এই ব্যাপারে।ঈশান মনে মনে একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে যেন সাপও ম’রে আর লাঠিও না ভাঙে! অফিসের কেউ যাতে ঘুণাক্ষরেও এই বিষয়ে কিছু আঁচ না করে। রাফিনের মতো একটা উদাসীন, দায়িত্ব জ্ঞানহীন ট্রেইনির সাথে ঈশান আহসানের বউয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে বিষয়টা কত অসম্মানজনক হবে ঈশান সেটা কল্পনাতেও আনতে পারছে না।

রিজ কার্ল্টনের জেনারেল ম্যানেজার পুলিশ ইনফর্ম করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঈশান বলেছে,” নো পুলিশ, নো প্রেস, আই ওয়ান্ট টু হ্যান্ডেল ইট পারসোনালি।”

আপাতত রাফিনকে আটকে রাখা হয়েছে ট্যারেসের একটি প্রাইভেট সিকিউরিটি চেম্বারে। পুরো জায়গাটা কাঁচে ঘেরা, চারপাশে শীতল বাতাস বইছে, ওপরে নীল আকাশ, অথচ ঘরের ভেতর গভীর অন্ধকার! এটা সাধারণত হোটেলের রুফটপ ভিআইপি লাউঞ্জ, কিন্তু এই মুহূর্তে জায়গাটা একান্তে সিল করে রাখা হয়েছে শুধুই রাফিনের জন্য। ঈশানের নির্দেশ! একটা কালো চেয়ারে তার হাত-পা বাঁধা। ঈশান না আসা পর্যন্ত সে এভাবেই থাকবে।

হোটেলে নিয়োজিত ট্রেইনড প্রফেশনাল সিকিউরিটি স্টাফ দু’জন বাইরে পাহারা দিচ্ছে। তাদের আলোচনার বিষয়-বস্তু সামান্য রাফিনের কানে আসে। যদিও সে পুরোপুরি বুঝতে পারছে না তাদের কথা। আর বোঝার চেষ্টাও করছে না।

আপাতত বিপদে পড়ে বাস্তবতা টের পেয়েছে। এই চাকরিটা তার আর থাকবে না এটা তো নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু এখন তার সাথে কি হবে? তাকে কি জেলে দেওয়া হবে? সে তো জানে না আমেরিকার সেলগুলো কেমন। তাকে কতদিন বন্দী থাকতে হবে? তার ভিসা ব্লক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

আর যদি কোনোভাবে বেঁচে দেশে ফিরতে পারে, তাহলে মা আর রায়ার সাথে দেখা হবে। কিন্তু যদি না পারে? রিতু আপার তো বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সংসারে সে ভালোই থাকবে। কিন্তু রাফিন তো তার মা আর বোনের মাথার উপরের একমাত্র ছায়া। তার কিছু হয়ে গেলে কি হবে তাদের? পথে বসবে তারা। গগন ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয় রাফিনের। আবারও দিবাকে ছলনাময়ী বলে গালা-গাল দেয়। কেনো করল সে এটা? সে তো জানতো রাফিনের অবস্থা। তবুও কেনো তাকে এভাবে বিপদে ঠেলে দিল? সে তো চাইলেই পারতো সব ঠিক করতে। কিন্তু করবে না। ওই মেয়ে পাষাণ, বেইমান, নিষ্ঠুরতম রমণী!

ঈশান রুফটপে প্রবেশ করে মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই।গায়ে ক্যাজুয়াল টি-শার্ট, স্বাভাবিক চাল-চলন, গম্ভীর ওই মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার ভেতরে কি চলছে!

রুফটপের মাঝামাঝি ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে দাঁড়ানো দু’জন ইউনিফর্ম পরা হোটেল সিকিউরিটি স্টাফ ঈশানকে দেখা মাত্রই দ্রুত এগিয়ে আসে। একজন মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলে,” স্যার, দ্যা বয় ইজ সিকিউরড বাই দ্যা অথোর৷ ইউর কমান্ডস হ্যাভ বিন ফলোয়েড এক্সাক্টলি হোয়াট ইউ সেইড। নো প্রেস এন্ড পুলিস।”

ঈশান কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ে। তার চোখ গিয়ে আটকায় ভিতরে বাঁধা কালো চেয়ারে বসে থাকা রাফিনের দিকে। শরীর গুটিয়ে আছে। যেন মৃ’ত লাশ। চোখ দুটো দেখেই বোঝা যায় হতাশা আর ভীতিতে কেমন অসহায় বোধ করছে।

ঈশান চুপচাপ কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।তারপর নিঃশব্দে আবার দরজাটা বন্ধও করে দেয়। রাফিন মুখ তুলে একবার দেখে ঈশানকে। এই লোকটা কেনো তার সামনে এসেছে? এখন নিশ্চয়ই কিছু অপমানজনক কথা বলবে। রাফিন সেসব শুনতে একটুও আগ্রহবোধ করছে না। তার বিরক্ত লাগছে। সে জানে তার শেষ পরিণতি কি! তাই শুধু অপেক্ষায় আছে শেষটুকু দেখার।

ঈশান কোনো কথা বলে না। সে খুব শান্তভাবে রাফিনের গা থেকে বাঁধন খুলতে থাকে। প্রথমে হাত ছাড়িয়ে দেয়, তারপর পা। নিজেকে মুক্ত আবিষ্কার করে রাফিন কিছুটা বিস্মিত হয়। অবাক চোখে ঈশানের দিকে তাকাতেই দুম করে তেড়ে আসে একটা ঘুঁষি, ঠিক তার চোয়াল বরাবর। দুনিয়া অন্ধকার মনে হয়।

ভেতর থেকে চেয়ার পড়ে যাওয়ার উদ্ভট শব্দে কেঁপে উঠে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি স্টাফ। অবাক হয়ে তারা কাঁচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঈশান রাফিনকে নিচ থেকে তুলে পেটাচ্ছে, বেরধক পেটাচ্ছে! তারা এরকম কিছু আশা করেনি। ভেবেছিল হয়তো কোনোভাবে ছেলেটাকে ভ’য় দেখাবে, থ্রেট করবে, কিন্তু এমন ডিরেক্ট একশনে চলে যাবে এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল।

স্টাফ দু’জন ভ’য় পায় কারণ রাফিনের কিছু হয়ে গেলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে খুব। পুরো হোটেল ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব পড়বে। প্রোটোকল অনুযায়ী তারা কোনো ভিআইপি গেস্ট এমনকি ঈশান আহসানকেও এইরকম সহিংস আচরণ করতে দিতে পারে না।

একজন কাঁচের দরজায় আঘাত করে বলে,” ড্যাম ইট! উই কান্ট লেট হিম কিল দ্য গাই!”

অন্যজন সতর্কভাবে বলে,”স্টে কাম, লেটস ওয়াচ থার্টি সেকেন্ডস মোর। ইফ ইট গেটস রিয়েল ব্যাড, উই শ্যুড কল দ্যা ম্যানেজার।”

প্রায় আড়াইমিনিট পর ঈশান কিছুটা ধাতস্থ হয়। এতোদিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত ক্রোধ, ঈর্ষা, ক্ষোভ যেন মিটিয়ে নিয়েছে। লম্বা শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে শান্ত হয়ে। রাফিন তখন মেঝেতে পড়ে আছে, কানের পাশ থেকে রক্তের সরু রেখা গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কেটে গেছে আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে খুব কষ্টে।

একটু পর ঈশান ঝুঁকে এসে বলে,” আমি কোনো জুলুম করিনি রাফিন হোসেন। তোমার হাতের বাঁধন খোলাই ছিল। চাইলেই আমাকে পাল্টা আঘাত করতে পারতে। কিন্তু তুমি পারোনি। আর এটাই তোমার দূর্বলতা। যা তুমি মানতে পারছো না৷ ডন্ট বাইট অফ মোর দ্যান ইউ ক্যান চিউ।”

বের হয়ে ঈশান স্টাফ দু’জনকে কাছে ডাকে। তারা তটস্থ ভঙ্গিতে ছুটে এসে কিছু বলতে নেয়৷ তার আগেই ঈশান তার পকেট থেকে কিছু নোট বের করে তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,” ছেলেটাকে হসপিটালাইজড করার ব্যবস্থা নাও। ঘটনা এমনভাবে সাজাবে যেন মনে হয় রোড এক্সিডেন্ট। এটাই সবাই জানবে। কোনো ভুল যাতে না হয়।”

স্টাফ দু’জন একে-অন্যের দিকে তাকায় একবার। তারপর বাধ্যের মতো মাথা নাড়ে।

পুরো ঘর জুড়ে কেমন শ্বাস রুদ্ধকর নীরবতা! রোজা ঘুমিয়ে পড়েছে। দিবা তার ঘরের বিছানায় মেয়েটাকে শুয়িয়ে রেখে নিজে চুপচাপ বসে আছে তার পাশে। এই ঘটনায় দিবার থেকেও বেশি আ’তঙ্কিত হয়েছে রোজা। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক এই অনভিপ্রেত ঘটনাপ্রবাহ মেনে নিতে পারেনি। অবশেষে তাকে শান্ত করে ঘুম পাড়ানো গেছে। দিবা খুব দোয়া করছে যেন ঘুম থেকে ওঠার পর রোজার কিছুই মনে না থাকে। নয়তো ঈশান মেয়ের চোখ-মুখ দেখলেই সব বুঝে ফেলবে!

দিবার বড্ড ভয় লাগছে। আচ্ছা ঈশান যদি কোনোভাবে এই ঘটনা জেনে ফেলে তখন কি করবে সে? নিশ্চয়ই খুব হিংস্র হয়ে উঠবে, রাফিনকে শিক্ষা দিতে চাইবে। আর তাকে সামলানো খুব মুশকিল হবে তখন। দিবার কোনো কথাই সে শুনবে না৷ তাছাড়া দিবাও রাফিনের পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে পারবে না ঈশানকে। এতে হিতে বিপরীত হবে। ঈশানের মেজাজ আরও চড়ে যাবে, দিবাকেও সন্দেহ করবে। ভাববে এখনও বুঝি দিবার অনুভূতি আছে ওই ছেলের জন্য। উফ! কল্পনা করেই সে শিউরে উঠছে।

রাফিন তার কোনো ক্ষতি করেনি, তাই দিবাও চায় না রাফিনের বড় কোনো ক্ষতি হোক। ঈশান ফিরলে দিবা ইনিয়েবিনিয়ে তাকে বলবে যেন রাফিনকে চাকরি থেকে ছাটাই করা হয়। ব্যস, তাহলেই হয়ে গেল। রাফিন তার জীবন থেকে সরে যাবে৷ তারপর আর কখনও কোনো ঝামেলা হবে না।

পেন্টহাউজের দরজায় লক খোলার শব্দ পেয়েই সামান্য চমকে উঠে দিবা। তারপর দ্রুত উঠে যায় লাউঞ্জের কাছে। ঈশান ভেতরে প্রবেশ করছে, দিবা ছুটে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে। এতে দিবার পা ভূমি থেকে উপরে উঠে যায়।

” এতো দ্রুত আসার জন্য থ্যাংকস। খুব মিস করছিলাম আপনাকে।”

অস্থিরতা মেশানো কণ্ঠে একথা বলেই খুব তৃষ্ণা নিয়ে ঈশানের ডানগালে চুমু দেয় দিবা। ঈশান কিছু বলে না, খুব শান্ত তার চোখ-মুখ।

চলবে।