#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৭
Sidratul Muntaz
( সংবেদনশীল মনের পাঠকরা সাবধানে পড়বেন এই পর্ব)
দিবা ঈশানের দিকে তাকায় একরাশ আনন্দ মাখা হাসি নিয়ে। পরমুহূর্তেই তার গম্ভীর মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,” কি হয়েছে আপনার?”
” কিছু না, টায়ার্ড লাগছে জাস্ট। রোজা কোথায়?” চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ঈশান।
” মাত্র ঘুমিয়েছে, আমার রুমে। ডাকবো ওকে?”
” দরকার নেই। ঘুমাক।”
ঈশান এগিয়ে যায় তার প্রাইভেট সুইটে। দিবা তাকিয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। মনোক্ষুণ্ণ হয়। ভেতর থেকে একটা ভ’য় জেঁকে ধরে। ঈশান কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে? নাহলে যত টায়ার্ডই হোক সে দিবার সাথে এমন দায়সারা হয়ে থাকে না। অন্তত কপালে হলেও একটা চুমু খেতো।কিংবা জড়িয়ে ধরতো। দিবা তো বলেছে ওর অস্থির লাগছে। তবু ঈশান এতো ঠান্ডা কেন?
দিবার বুকটা খুব কাঁপছে। উফ, এই অস্থিরতা যেন তার গলা টিপে ধরবে। হঠাৎ ঈশান ভেতর থেকে আওয়াজ দেয়,” দিবা, শোনো।”
দিবা প্রায় দৌড়ে যায়,” জ্বী বলুন?”
” রাতে আমাদের ডিনারে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনে হয় না যেতে পারব। তুমি তো দেখি আগে থেকেই রেডি হয়ে বসে আছো। তাই বললাম, কাল যাই? আজ থাকুক।”
দিবা মাথা নিচু করে রাখে। ঈশান প্রশ্ন করে,” কি ব্যাপার? বাইরে যাচ্ছি না বলে কি মনখারাপ করেছো?”
দিবা মাথা নাড়ে দুইপাশে। একটু পর খুব উশখুশ করে বলে,” এতো সুন্দর করে সেজেছি, কিন্তু আপনি একবার বললেনও না যে আমাকে কেমন লাগছে।”
মলিন মুখে অভিযোগ ছুঁড়ে দেয় সে। তারপর চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ঈশান তাকেই দেখছে একদৃষ্টে। দিবা আবার মাথা নিচু করে। ঈশান বলে,” সুন্দর লাগছে। কিন্তু বাইরে যাওয়ার সময় এতো সুন্দর করে সাজা নিষেধ তোমার জন্য। ”
” আমি তো বাইরে যাওয়ার জন্য সাজিনি!”
” তাহলে?”
দিবা এগিয়ে এসে ইশানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি আপনার জন্য সেজেছিলাম। কিন্তু আপনি তো ফিরেও তাকাচ্ছেন না।”
ঈশান দিবার চিবুক স্পর্শ করে বলে,” ভালো করে ফিরে তাকালে আর রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাবে না।”
দিবার মুখ আরক্ত হয়ে যায়। ঈশান যেমন গম্ভীরভাবে কথাটা বলেছে, তেমন গম্ভীরভাবেই ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
ওয়াশরুমের ভেতরে গোসল করছে সে। বাইরে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে দিবা, প্রয়োজন নেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার। চলে গেলেই হয়। তবু সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনটা এখনও অস্থির লাগছে খুব। আসলে ঈশানের কাছে এতোবড় একটা কথা লুকিয়ে সে শান্তি পাচ্ছে না। কাঁচের দরজায় অজস্র পানির ফোঁটা লেপ্টে যাচ্ছে। ফ্রস্টেড গ্লাস দিয়ে ঈশানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তবু দিবা তাকিয়ে আছে। ঈশান ভেতর থেকে ওয়াটারপ্রুফ পর্দাটা টেনে দিচ্ছে না। অর্থাৎ সে জানে দিবা দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তাকাচ্ছে না কেন?
সে মাথায় শ্যাম্পু মাখতে নিলেই দিবা জিজ্ঞেস করে,” আমি হেল্প করব?”
ঈশান থামে, কিছু বলে না। দিবার দিকে শ্যাম্পুর বোতল এগিয়ে দেয়। তার এটুকু ইশারাতেই মুখে হাসি ফোটে দিবার। সে এগিয়ে যায়। ভেতরে এসে ঈশানের হাত থেকে শ্যাম্পুর বোতল নেয়। ঈশান বসে পরে টুলে। যাতে দিবার সুবিধা হয়। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঈশানের মাথায় শ্যাম্পু মেখে ম্যাসাজ করে দিতে থাকে। ঈশান চুপ করে আছে, অন্যসময় হলে নিশ্চয়ই দিবার গালে শ্যাম্পু মেখে দেওয়ার চেষ্টা করতো। কিংবা অন্যকোনো মজা করতো। এখন সে কিছুই করছে না।
” একটা কথা বলব?” দিবা প্রশ্ন করে শান্ত স্বরে।
ঈশান শুধু বলে,”হুম। ”
দিবা নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিয়ে বলে,” আপনি রাফিনকে জব থেকে বের করে দিন।”
” হঠাৎ এই কথা কেন? তোমার সুপারিশেই তো ওকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।”
দিবা ইতস্তত করে বলে,” হ্যাঁ কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে এতেই আমাদের সবার ভালো ”
” সবার ভালো বলতে?”ঈশান চোখ তুলে তাকায় প্রশ্নটা করে, তাকিয়ে থাকে সূক্ষ্মদৃষ্টে।
দিবা বড় শ্বাস নিয়ে বলে,” আজকে দুপুর মেবি তিনটার সময় রাফিন এখানে এসেছিল।”
ঈশান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,” তারপর?”
” আমার সাথে কথা বলতে চাইল।”
” তুমি কি করলে? আমাকে ফোন করোনি কেন?”
দিবা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকায়। আসলে ঈশানকে ফোন করার ব্যাপারটা তার মাথায়ও আসেনি। আমতা-আমতা করে বলে,” ও বেশিক্ষণ থাকেনি। শুধু কিছু কথা বলার জন্য এসেছিল তারপরই চলে গেছে। তাই আপনাকে ফোন দেওয়ার ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।”
দিবা কথা ঘুরিয়ে ফেলে খুব দ্রুত। রাফিন এখানে এসে কি কি করেছে সেটা বললে এখন ঈশান নিশ্চিত ওকে ধরে পেটাতে যাবে৷
” কি বলতে এসেছিল ও?”
দিবা ওদের মধ্যে যা কথোপকথন হয়েছিল সবই পুঙ্খানুপঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করে। কিছুই বাদ দেয় না।
” কিন্তু তুমি এই কথা আমার কাছে গোপন করলে কেন? এতোক্ষণ কেনো বলোনি?” ঈশানের প্রশ্নটা ধারালো তবে গলা শান্ত।
দিবা ঘাবড়ে যাওয়া স্বরে বলে,” আমি গোপন করলাম কখন? শুধু একটু সময় নিচ্ছিলাম।”
ঈশান মাথা নেড়ে বলে,” হুম। ও যে এসেছিল সেটা আমি জানি। ভেন্যুতে ওকে খুঁজে না পেয়েই সন্দেহ হয়েছিল।”
দিবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ সে যা ধারণা করেছে তাই। ঈশান তাহলে জানতো রাফিনের ব্যাপারটা। অবশ্য জানবেই তো। এজন্যই এতোক্ষণ ধরে গম্ভীর হয়ে ছিল। দিবা তাহলে বলে ভালোই করেছে। কিন্তু রাফিনের হঠাৎ এগ্রেসিভ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আর সে বলবে না। শুধু শুধু এসব বলে ঈশানকে রাগিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া ঘরের ভেতরে কি হয়েছে সেটাও ঈশানের পক্ষে জানা সম্ভব না। সে নিশ্চয়ই দেয়ালে দেয়ালে সিসিটিবি ফিট করে রাখেনি!
দিবার এবার অনেকটা প্রশান্তি লাগছে। সে হেসে ঈশানের মাথায় শাওয়ার ছেড়ে দেয়। সে নিজেও ভিজে যাচ্ছে, সরে যেতে নিলেও ঈশান তাকে ধরে রাখে চেপে। দিবা বলে,” আমার ড্রেস… ভিজে যাচ্ছে।”
” তাহলে খুলে ফেলো। আর ভিজবে না।”
দিবার বক্ষস্থল কাঁপতে থাকে তিরতির করে। ঈশানের মুখ একদম দিবার কানের কাছে। তারা দু’জন দীর্ঘসময় ধরে ভিজতে থাকে শাওয়ারের হিমশীতল পানিতে।
গভীর ঘুম ভেঙে দিবা আবিষ্কার করে ঈশান পাশে নেই৷ সে শুয়ে আছে ঈশানের প্রাইভেট সুইটেই, তার পাশে রোজা। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা। এতোরাতে ঈশান কোথায় গেল? তার শ্যাম্পুর ঘ্রাণ এখনও দিবার গায়ে আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে কিন্তু সে কোথাও নেই! ভেতর থেকে আবারও একটা ভ’য় জেঁকে ধরে৷ তার কেন যেনো মনে হচ্ছে ঈশানকে আর দেখবে না সে। এমন কেনো মনে হচ্ছে? কি আশ্চর্য! মনের এই অশান্তি দমাতে দিবা উঠে ফোন হাতে নেয় ঝটপট। ঈশানকে ফোন করে।
” হ্যালো, আপনি কোথায়?” ব্যগ্র হয়ে জানতে চায় দিবা।
ওই পাশ থেকে ঈশান তাকে আশ্বস্ত করে বলে,” আছি একটা জায়গায়। জরুরী কাজে৷ তুমি টেনশন কোর না। খেয়ে নিও। রোজা উঠেছে?”
“না, এখনও ঘুম। আপনি কখন ফিরবেন? আবার কোথায় গেছেন?”
” বললাম তো জরুরী কাজে এসেছি। রোজাকে উঠিয়ে ডিনার করে নাও তোমরা। আর আমার ফিরতে দেরি হবে। তুমি অপেক্ষা কোর না। ঘুমিয়ে যেও। ওকে বেবি? রাখছি, বায়।”
ঈশান এতো মিষ্টি করে বায় বলেছে যে দিবা আর কিছুই বলতে পারে না। তবে সে বুঝতেও পারে না৷ এই রাতের বেলা আবার তার কি কাজ থাকবে? তাছাড়া সারারাত একা কাটাতে হবে ভেবেও কেমন ভ’য় লাগে দিবার৷ যদি রাফিন চলে আসে? তার এতো সাহস হবে বলে মনে হয় না। তবে সে যদি এমন দুঃসাহস দ্বিতীয়বার দেখায়, তাহলে দিবা নিশ্চয়ই ঈশানকে ফোন করে সব জানাবে এবার। তারপর যা হওয়ার হবে! আর সে মায়া করবে না। অনেক বেশি মায়া দেখিয়ে ফেলেছে রাফিনের প্রতি।
মাঝরাতে আবারও ঘুম ভাঙে। চারদিক নিস্তব্ধ, নীরব। রোজা কি নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে! ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখতে এতো মিষ্টি লাগে! দিবা কিছুক্ষণ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গালে চুমু দেয়। ঈশান এখনও ফেরেনি কেনো? সে কোথায় গেছে? এবার সত্যিই মন কু ডাকছে। কিছুতেই স্থির হতে পারে না দিবা। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে খায়। তারপর মোবাইল নিয়ে ঈশানকে ভিডিওকল দেয়।
অনলাইনে পাওয়া যায় না তাকে। দিবা নাম্বারে কল দেয়। যেহেতু তাদের দু’জনের বাংলাদেশী সিমকার্ড, তাই কলটা রোমিং দিয়ে লোকালি কানেক্ট হয়। কিন্তু ঈশান ফোন ধরছে না। দিবা কয়েকবার চেষ্টা করে, কোনো খোঁজ নেই। কি আশ্চর্য! একবার ইচ্ছে হয় বাইরে গিয়ে দেখে আসতে। কিন্তু সে যাবে কোথায় খুঁজতে? ঘরময় শুধু পায়চারী করতে থাকে। এভাবে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক কেটে যায়। দিবা ফজরের নামায আদায় করে। আল্লাহর কাছে অতীতের সব ভুলের জন্য খুব ক্ষমা চায়। প্রার্থনা করে যেন বাকি জীবনটা রোজা ও তার বাবার সাথে সুস্থ- সুন্দরভাবে কাটাতে পারে।
এতে মন কিছুটা স্থির হয়। নামায শেষ হতেই দিবা অনুভব করে তার মাথাটা খুব ধরেছে। প্রতিটি রুমের একটা নির্দিষ্ট লকারে ঔষধ, ফার্স্ট এইড, সবকিছু রাখা থাকে। দিবা সেখান থেকে একটা টাইলিনলের পাতা তুলে নেয়। তারপর হঠাৎ উপরে চোখ যেতেই বুক কেঁপে উঠে তার। দেয়ালের কোণায় সিসিটিবি আটকানো। কিন্তু বেডরুমে সিসিটিবি কেনো থাকবে? বুকে ধুকপুক শুরু হয়, সে এই রুমে কতবার ড্রেস চেঞ্জ করেছে, কতকিছু করেছে! তার হঠাৎ মনে হয়, এটা নিশ্চয়ই হোটেল কর্তৃপক্ষ লাগায়নি।বরং এটা তার সন্দেহপ্রবণ স্বামীর কাজ হতে পারে।
দিবার মাথাব্যথা পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে ইতোমধ্যে৷ সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তীব্র বুকব্যথা, শ্বাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছে। একটা যন্ত্রণাময় অনুভূতি গলা টিপে ধরে। ঈশান তাহলে সব জানতো, সব! সে এই কাজটা কেনো করেছে? দিবার ঘরে কেনো সে সিসিটিবি লাগিয়েছে? সে পেন্টহাউজের অন্যঘর গুলোও খুঁজে দেখে। হ্যাঁ, সবখানে ঝুলছে সিসিটিবি। বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়ে দিবা।
সকাল সকাল সিমি এসে হাজির হয় দিবাদের খোঁজ নিতে। রোজা ঘুম থেকে ওঠার পর দিবা তাকে ব্রেকফাস্ট করিয়েছে। এখন সে বারান্দায় ডল হাউজ নিয়ে খেলছে। রুমের বিছানায় বসে রোজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দিবা। তার পাশেই সিমি, হাসিমুখে বলে,” ও খুব শান্ত তাই না ম্যাডাম? একদমই বিরক্ত করে না৷ ওর বয়সী বাচ্চারা যে কত দুষ্টমি করে! মাথা খারাপ করে দেয় একদম।”
দিবা বিষণ্ণ হেসে বলে,” কথা বলতে জানলে নিশ্চয়ই আমার মেয়েটাও মাথা খারাপ করে দিতো।”
” একদমই না ম্যাম। ওর মিষ্টি কণ্ঠের বকবক শুনতে আমার কখনও মাথা খারাপ লাগতো না। তবে ওকে কিন্তু আমার বেশ লাগে। একদম শান্ত আর মিষ্টি একটা বাচ্চা!”
দিবা জরুরী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,” তোমাদের স্যার কোথায় আছে জানো? কখন আসবে?”
” সেটা তো আমি বলতে পারব না ম্যাডাম। টিমের সবাই হাসপাতালে গেছে। আর আমি এখানে আপনাদের দেখতে এসেছি। স্যার আমাকে মেসেজ করে বললেন যেন আপনাদের খেয়াল রাখি। ”
দিবা কি যেন ভাবছে। সিমি বলে,” আপনার এতো দুশ্চিন্তা হলে স্যারকে আপনি ফোন করে জেনে নিন না ম্যাম।”
দিবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আমার ফোন সে ধরছে না।”
“আমার মনে হয় কি ম্যাম, স্যার নেটওয়ার্কিং ইভনিং থেকে এখনও ফেরেনি।”
” নেটওয়ার্কিং ইভনিং মানে?”
” স্যার গতকাল মিস্টার ডেভিডের সাথে… মানে আমাদের ডিলের মেইন ইনভেস্টর। উনার সাথে একটা নাইট পার্টিতে গেছিলেন।”
দিবা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে ” নাইট পার্টি মানে? কেমন পার্টি এটা?”
সিমি ইতস্তত করে বলে,” ম্যাম আপনি জানেন না বিজনেসম্যানদের নেটওয়ার্কিং ইভনিং নাইট পার্টির ব্যাপারে?”
” না আমি জানি না। আমাকে তুমি বুঝিয়ে বলো।” দিবার কণ্ঠ মুহূর্তেই ক্রোধপূর্ণ হয়ে উঠে।
সিমি আড়ষ্ট হয়ে বলে,” এখানে বিভিন্ন ক্লায়েন্ট, ইনভেস্টর, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা একত্রিত হয়। সারারাত আড্ডা দেয়, মিটিং করে, অনেকটা ইনফরমাল মিটিংই বলা যায়। তারা ড্রিংক করে, কেউ আবার হুকারদের সাথে রাত কাটায়।”
” হুকার মানে?”
সিমি বিব্রত কণ্ঠে বলে,” হুকার মানে সুন্দরী মেয়ে। যারা নাচ-গান করে গেস্টদের আনন্দ দেয়।”
” শুধু নাচ-গান করেই আনন্দ দেয় নাকি…”
দিবার কণ্ঠ থেমে আসে। সিমি মাথা নিচু করে হলে,” হ্যাঁ আপনি যা ভাবছেন সেটাও।”
ইতোমধ্যে কান গরম হয়ে উঠেছে দিবার। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। রাগে আর ঘৃণায় মাথার পেছনদিকটা যেন জ্বলে যাচ্ছে। কোনোমতে গলা পরিষ্কার করে সে বলে,” তুমি এখন চলে যাও। এইখানে তোমার কোনো কাজ নেই।”
” ম্যাম আমি তো ভেবেছিলাম আপনাদের নিয়ে গ্রীফিথ পার্কে ঘুরতে যাবো। মামণি খুব মজা পেতো। ওখানে বাচ্চাদের জন্য রেলওয়ে রাইড, চিড়িয়াখানা আছে।”
” তাহলে তুমি রোজাকে নিয়ে যেতে পারো। আমি যাবো না”
“ম্যাম আপনি কি আমার কথা শুনে মনখারাপ করেছেন?”
দিবা কঠিন চোখে তাকাতেই সিমি দ্রুত রোজার কাছে গিয়ে তাকে কোলে নেয়। যেহেতু সিমিকে রোজা অনেকবার দেখেছে, তাই তার সাথে যেতে কোনো আপত্তি করে না৷ দিবাও তাদের বাধা দেয় না। এই মুহূর্তে তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে।
ঈশান সারারাত বাড়ি ফেরেনি, আবার দিবার ফোনও ধরেনি। কি কাজে রাতে বাইরে ছিল সেসব কিছুই জানায়নি। সে কি আসলেই কোনো হুকারের সাথে ছিল? ভাবতেই গা গুলিয়ে বমি পায়। গতকাল সন্ধ্যায়ই সে দিবাকে স্পর্শ করেছে আবার সেই একই রাতে অন্যমেয়েকে… ছি, এতোটা রুচিহীন ঈশান? দিবা ভাবতে পারছে না।
ঈশান তার উপর নজরদারি করার জন্য বেডরুমে সিসিটিবি লাগিয়ে রেখেছে, অথচ নিজে সারারাত বাইরে মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে! এটাই বুঝি তার নৈতিকতা? ফাঁকা পেন্টহাউজের মেঝেতে বসে দিবা এক গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে। নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় তার। বুকের ভেতরটা এমনভাবে জ্বলছে যা খুব অসহনীয় ঠেকে। এই বিষাদসিক্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ফার্স্ট এইডের লকার খুলে কতগুলো ট্যাবলেট হাতে নেয় দিবা।সে জানে না এসব কিসের ঔষধ। শুধু এক গ্লাস পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে নেয়। যতগুলো খেলে আর বাঁচার আশা থাকবে না, ঠিক ততগুলোই খায় সে। তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে রেবাকে ফোন করে।
” হ্যালো আপা, শুনতে পাচ্ছো?”
বাংলাদেশে তখন রাত ১০টা বাজে। রেবা ডিনারের আয়োজন করছিল। দিবার ফোন পেয়ে একটু বারান্দায় আসে। তার ভেজা কণ্ঠ শুনে বিচলিত হয়ে শুধায়,”দিবা, কি হয়েছে বোন?”
” জানি না আপা, আমার হঠাৎ খুব বাবা-মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, আমি যদি তাদের কাছে চলে যেতে পারতাম!”
এটুকু বলেই হু হু করে কেঁদে উঠে সে। কাঁদতেই থাকে। রেবা হকচকিয়ে বলে,” দিবা তোর কি হয়েছে? আমাকে বলবি তো আগে! ঈশান কিছু বলেছে? সে কি এখনও ওই বিষয়টা নিয়ে তোকে কথা শোনাচ্ছে?”
দিবা ঢোক গিলে খুব অভিমান নিয়ে বলে,” এই জীবনে কিছুই আমার না। না ভালোবাসা, না সম্মান, না মর্যাদা।তাহলে আমি কিসের আশায় বাঁচবো আপা, বলতে পারো?”
” প্লিজ লক্ষী বোন, এরকম করিস না। আমার খুব ভ’য় লাগছে। তুই কোথায় এখন? ঈশান কোথায়? ওকে একটু ফোনটা দে। আমি কথা বলব।”
” না, তুমি ওর সাথে কোনো কথা বলবে না। আর ওর সাথে আমিও আর কখনও কথা বলতে চাই না। ওকে নিজের মুখও দেখাতে চাই না। রাখছি আপা। তুমি ভালো থেকো। আর আমাকে মাফ করে দিও।”
দিবা ফোন রেখে দেয়। রেবা আবার চেষ্টা করে কিন্তু দিবাকে রিচ করতে পারে না। বাধ্য হয়ে ঈশানের নাম্বারে কল দেয়।
ঈশান তখন মাত্র এলএপিডি থেকে বের হয়েছে। রাফিনের এক্সিডেন্টের বিষয়টা নিয়ে পুলিশ খুব ঝামেলা করছে। এসব সামলাতেই সারারাত এখানে কেটে গেছে। এখন সে হোটেলে ফিরছে। ফোনটা পকেটেই সাইলেন্ট অবস্থায় ছিল। বের করতেই রেবার নামটা ভেসে উঠে,” আফরোজা রেবা রহমান।” একটু অবাক হয় ঈশান। ফোনটা রিসিভ করতেই ওই পাশ থেকে রেবার অস্থির কণ্ঠ ছুটে আসে।
” হ্যালো, হ্যালো, ঈশান বলছো?”
” জ্বী আপু, আসসালামু আলাইকুম। ”
রেবা সালামের উত্তর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” তুমি এখন কোথায়? দিবার আশেপাশে নাকি দূরে?”
” আমি একটু বাইরে আছি, তবে হোটেলেই ফিরছি। কেনো কি হয়েছে?”
রেবা খুব অনুনয়ের স্বরে বলে,” তুমি প্লিজ আমার বোনটাকে এভাবে কষ্ট দিও না। ও খুবই সেন্সিটিভ মাইন্ডের। কখন কি করে বসবে! দেখো আমি জানি তোমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। দিবা তোমার কাছে এতোবড় কথা লুকিয়ে ঠিক করেনি। কিন্তু এটা লুকানোর পেছনেও একটা কারণ ছিল। ওর সাথে কতবড় এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা ধারণা করাও তোমার পক্ষে সম্ভব না।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যায় রেবা। তার কণ্ঠ কেমন ভেঙে ভেঙে আসছে। ঈশান অবাক হয়ে শোনে, এক পর্যায় জিজ্ঞেস করে,” কেমন এক্সিডেন্ট? আমি কি জানতে পারি?”
রেবা করুণ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,” মাত্র নয়বছর বয়সে ও রেপড হয়েছিল। তারপর থেকেই এই অবস্থা…”
রেবা হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে কথাটুকু বলেই। এই পাশে ঈশানের মাথায় যেন ভারী বজ্রপাত হয়, বুকের কাছে কাটার মতো কিছু একটা বিধে আসে খট করে৷ সম্পূর্ণ দমবন্ধ লাগে!
চলবে
#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৮
Sidratul Muntaz
এলএপিডি থেকে বের হয়ে ঈশান মেইনরোডের মোড়ের সামনে ঝকঝকে পরিষ্কার কংক্রিটের ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। বেখেয়ালে চারপাশের পরিবেশটা দেখে। দু’জন সুশৃঙ্খল অফিসার ডিউটিতে ঢুকছে। একজনের হাতে কফির কাপ, অন্যজন কথা বলছে ফোনে। সামনের রাস্তা দিয়ে একের পর এক গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, সামনে কতগুলো মেটাল বেঞ্চ। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়ছে তবে খুব তীক্ষ্ণ নয়। সকালের তাপমাত্রা চব্বিশ থেকে পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে।
ফোনের ওই পাশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে রেবা বলছে” তখন দিবা বড় খালার বাসায় থাকতো। বাবা-মাকে হারিয়ে ও খুব চুপচাপ আর শান্ত হয়ে গেছিল। আমি নিজের সংসার নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে ওর খোঁজ নেওয়ার সুযোগ পাইনি। যৌথ পরিবারে থাকতাম তখন আমি আর তুহিন। তুহিন খুব অল্প বেতনের চাকরি করতো বলে শ্বশুরবাড়িতে আমাকে খুব সমঝে চলতে হতো। তাই দিবাকে প্রথমে আমার কাছে আনিনি।
নয়তো কখনও নিজের ছোট্ট বোনটাকে ওইভাবে অবহেলায় ফেলে রাখতাম না ওখানে। আর ওর সাথে এতোবড় দূর্ঘটনাটাও ঘটতো না। দিবা আমাকে প্রথম থেকেই বলতো, আপা এই বাড়ির একটা লম্বা লোক একা পেলেই আমার হাত, কাঁধ চেপে ধরে। আমার খুব জঘন্য লাগে।
আমি ওর কথা তখন পাত্তা দেইনি কারণ লোকটাকে আমি চিনতাম। বড়খালার দেবর হয় ছেলেটা। বড়খালাদের সাথে থাকতোও না। চাকরির জন্য শহরে থাকতো। কিন্তু মাঝে মাঝে আসতো। তখনি দিবা ভ’য়ে চুপসে যেতো একদম। ঘন ঘন আমাকে ফোন করতো। তারপর একদিন খালারা বাসায় দিবাকে একা রেখে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছিল। হঠাৎ কেউ দরজায় নক করে, দিবা খুলে দেখে ওই লোকটা।
আর তারপর, যা সর্বনাশ হওয়ার হয়। রাত বারোটায় আমার কাছে খবর আসে, দিবাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। ওকে নাকি, ড্রয়িংরুমের নিচতলায় র’ক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছিল। আমি এই ঘটনা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানায় সবচেয়ে দুঃখজনক আর অভিশপ্ত খবরটা। জরায়ু ড্রিস্ট্রয় হয়ে গেছে মেয়েটার। কেটে না ফেললে অনেক বড় বিপদ হতে পারে। ওই অবস্থায় তাকে বাঁচানোটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আমরা ডাক্তারকে রিকয়েস্ট করি যেভাবেই হোক মেয়েটাকে যেন অন্তত বাঁচানো হয়।
এইতো, আমার বোনের দূর্ভাগ্য তখন থেকেই শুরু। রেপের কথাটা সবাই ভুলে গেছে ঠিক। কিন্তু সারাজীবনের কলঙ্ক তার গায়ে লেগে গেছে। ঈশান, দিবাকে আমি প্রথমবার এতো খুশি দেখেছি। তোমার কাছে আমার বোনটা তার দুঃখের জীবনের সব সুখ পেয়েছিল। ও যে তোমাকে কত ভালোবাসে সেটা তুমি ধারণাও করতে পারবে না।
প্লিজ তুমিও এখন ওর প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে যেয়ো না। দুনিয়ায় একমাত্র তোমাকেই ও পেয়েছে, যার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। যাকে আশ্রয় করে ও একটু সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়। প্লিজ ওকে বোঝার চেষ্টা করো। ওকে মাফ করে দাও।”
রেবা কাঁদছে তো কাঁদছেই। ঈশানের গলা ভেঙে এসেছে। সে কথা বলতে নিয়ে দেখে শব্দ আসছে না। গলার কাছে ভারী কিছু একটা আটকে থাকার মতো অনুভূতি। বেশ কিছুক্ষণ পর সে ঢোক গিলে বলে,” আমি রাখছি আপু। আপনার সাথে পরে কথা বলবো।”
ফোনটা কোনমতে পকেটে রেখেই ঈশান গাড়িতে উঠে বসে। তার হাত মনে হয় মৃদু কাঁপছে, শরীরের র’ক্তকণিকা গুলো জমাট বেঁধে গেছে। সামান্য আঙুল নাড়াতেও কি কষ্ট! ঈশান ভাবলেশহীন মুখে ড্রাইভ করতে থাকে। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে আজ থেকে প্রায় আট দশদিন আগের ঘটনাটা। সেদিন গাড়িতে বসে দিবাকে এই জন্য কত অপমান করেছিল সে। তার বলা প্রতিটি কথা মস্তিষ্কে নিউরনের মতো ছুটছে আর আঘাত করছে হৃদয়ে। সে কতটা অমানবিক আচরণ করেছিল মেয়েটার সাথে। ভেবেই নিজের উপর বিরক্তিতে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। সামনে দেয়াল থাকলে সে অবশ্যই আঘাত করতো৷ তাতে যদি এই যন্ত্রণার ভার কিছুটা লাঘব করা যেতো।
একবারও সে দিবার এক্সিডেন্টের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সে ভাবতেই পারেনি এতোটা নির্মম হবে সবকিছু। এখন রেবার কথাগুলো মস্তিষ্কে যন্ত্রণাদায়ক সুরে বাজছে। ঈশানের সত্যি খুব দমবন্ধ লাগছে। দিবাকে না দেখা পর্যন্ত এই অস্থিরতা কাটবে না। সে শুধু একবার শক্ত করে নিজের দিবাকে জড়িয়ে ধরবে, তারপর আর কখনও ছাড়বে না। প্রয়োজনে কান্না, কষ্ট, দুঃখ, সবকিছু পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিবে, শুধুমাত্র দিবার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্য!
রাফিন শুয়ে আছে নিউরো অবজারভেশন ইউনিটে। মাথায় মোটামুটি গুরুতর আঘাত পাওয়ায় সে পুরো রাত অর্ধচেতন অবস্থায় ছিল। এখন কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে, চোখ মেলে সে চারপাশ দেখে। ঝকঝকে আলো, সাদা পর্দায় পার্টিশন দেওয়া একটা কেবিনে শুয়ে আছে। পাশে মনিটরের বিপ বিপ শব্দ। দূর থেকে তামান্না, আসিফ স্যারের কথা ভেসে আসে। তারা এখানেই আছে! কিন্তু তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
রাফিন উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না৷ শরীর দূর্বল এখনও। খুব ভোরে তার সাথে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা সত্যি নাকি ভ্রম এখনও সে বুঝতে পারছে না৷ সত্যি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি৷ ঈশান আহসান এসেছিল তার কেবিনে। রুক্ষ চোখ-মুখে রাফিনকে পরখ করে বলল,” এখন কি অবস্থা?”
রাফিন কোনো জবাব দেয়নি তখন। ঈশান একটা চেয়ার টেনে বসে ছোট্ট শ্বাস টেনে বলেছিল,” যা হওয়ার হয়ে গেছে। সবটা ভুলে যাও৷ আমিও ভুলতে চাই।”
রাফিন অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলে। ঈশান চোয়াল শক্ত করে বলল,” তোমাকে জব থেকে ফায়ার করলেও তোমার পরিবারের দায়িত্ব নিবো৷ তাই চিন্তার কিছু নেই। শুধু পুলিস যখন জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবে, তখন বলবে এটা এক্সিডেন্ট। বিনিময়ে পাবে একটা ব্ল্যাংক চেক, আর নিশ্চিন্তে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা। যেটা তোমার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার।”
রাগে রাফিনের দূর্বল হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু শরীরে সেই বল নেই। ব্যর্থ হয়ে মৃদু শ্বাস নেয় সে। এইরকম একটা জঘন্য লোক দিবার স্বামী ভেবেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। গায়ে র’ক্ত টগবগ করতে থাকে। অবশ্য দিবাও তো কোনো ধোঁয়া তুলসী পাতা না। তার জন্য এই বদমাইশই ঠিকাছে। খোদা জুটি মিলিয়েছে ভালো! রাফিন আসলেই দিবার মতো মেয়ের সাথে সংসার করতে পারতো না। ওই দিবা তার যোগ্যই নয়৷ অসুস্থ আর দূর্বল শরীর নিয়ে এসবই ভাবছিল রাফিন।
ঈশান ভারী কণ্ঠে বলল,” এনসার মি, রাফিন হোসেন,কোনটা করবে তুমি? নীরবে হার মেনে বাংলাদেশে ফিরে যাবে আর বাকিজীবন আরামে কাটাবে নাকি পুলিসের কাছে সব সত্যি বলে আমার বিরুদ্ধে লড়বে? সেকেন্ড অপশনটা কিন্তু তোমার জন্য খুব বেশি বিপজ্জনক হবে।”
রাফিন তাচ্ছিল্য করে জবাব দিল,” আপনার মতো অহংকারী লোকের দয়ায় বাকিজীবন কাটানোর চেয়ে আমার কাছে ম’রে যাওয়াটাই বেটার অপশন মনে হয়।”
ঈশান এক ভ্রু উঁচু করে তাকাল। রাফিন বলল,” আমি পুলিসের কাছে কিছু বলবো না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার কোনো শখ নেই আপনার মতো কুকুরের পেছনে লাগার। আমি এই বিষয়টাকে এক্সিডেন্ট ভেবেই ভুলে যাবো।”
রাফিন রাগের মাথায় এলোমেলো মস্তিষ্কে আরও অনেক কিছু বলেছিল, সেসব মনে নেই এখন। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে যে এতোদিন ঈশানকে যেসব কথা সে মনে মনে বলতো, আজ মুখের উপর বলার সাহস করতে পেরেছে। কিন্তু ঈশান তাকে কিছুই করল না? ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। তাই রাফিন বুঝতে পারছে না যে সকালে সত্যিই ঈশান আহসান এসেছিল নাকি পুরোটা তার কল্পনা?
” কি অবস্থা রাফিন সাহেব? এখন কেমন বোধ করছেন?” মিজান সাহেব খোশমেজাজে বেডের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। পেছনে আসিফ আর তৌহিদও।
আসিফ বলে,” কি একটা কান্ড ঘটালেন বলুন তো? এইভাবে কেউ এক্সিডেন্ট করে? আপনার শরীর এতো খারাপ ছিল সেটা জানাবেন না আমাদের? তাছাড়া কনভেনশন হল থেকে বেরোনোর সময়ও একবার দেখা করতে পারতেন। আমাদের মধ্যে কাউকে আপনার সাথে পাঠিয়ে দিতাম। তাহলেই আর গাড়ি থেকে নামার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে এই সিরিয়াস এক্সিডেন্টটা হতো না।”
রাফিন কথাটা শুনে কুচকায়। ঈশান আহসান তাহলে এইভাবে সবাইকে মিথ্যাটা বুঝিয়েছে? রাফিন গাড়ি থেকে নামার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল! ইবলিশও ওই লোকের শয়তানী বুদ্ধির কাছে হার মানবে।
তৌহিদ বলে,” আচ্ছা, উনি বোধহয় আমাদের উপস্থিতিতে বিরক্ত হচ্ছেন। দেখছেন না কোনো জবাব দিচ্ছে না? চলুন আমরা চলে যাই৷ গেট ওয়েল সুন ভাই।”
মিজান সাহেব বলেন,” হ্যাঁ, হ্যাঁ, গেট ওয়েল সুন। শুধু আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।”
রাফিন মাথা নেড়ে দূর্বল কণ্ঠে বলে,” আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।”
লস এঞ্জেলসের এলএপিডি থেকে রিজ কার্ল্টনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাছাড়া ঈশান খুব দ্রুত ড্রাইভ করছিল, সে পৌঁছে যায় মাত্র দশমিনিটেই। গাড়িটা পার্ক করেই নেমে পড়ে। গেটম্যান এগিয়ে এলেও সে কোনো কথা না বলে সোজা লবিতে ঢুকে যায়। ঝকঝকে মার্বেল পাথরের উপর ভারী জুতোর ছাপ ফেলে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। তার এলোমেলো কদম দেখে যে কেউ বুঝবে সে এই মুহূর্তে কতটা ডেস্পারেট।
ফিংগারপ্রিন্ট আর কার্ড এক্সেস দিয়ে ঈশান লিফট ডাকে। পঞ্চাশতলায় পৌঁছাতে যতটুকু সময় লাগবে সেটুকু অপেক্ষা করারও যেন ধৈর্য্য নেই। দিবাকে একনজর দেখার জন্য কাতর হয়ে আছে ভেতরটা। সে লিফটে ওঠার পর ঝকঝকে আয়না বাঁধানো দরজায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে থমকায়। ভীষণ রাগ হয় নিজের প্রতি। নিজেকে শাসাতে মন চায়। কেনো করেছিল দিবার প্রতি এতো অবিচার? এই মুহূর্তে সে নিজেকেই মাফ করতে পারছে না তাহলে দিবা তাকে কিভাবে মাফ করবে?
লিফট খোলা মাত্র ঈশান এক নিঃশ্বাসে ঢুকে পড়ে পেন্টহাউজে। লাউঞ্জরুমটা একদম নীরব, আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না। সিমির তো এখানে থাকার কথা ছিল। ওরা কি তাহলে ঘুরতে বের হয়েছে? ভেবেই একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ঈশান। সে নিজেই তো সিমিকে পাঠিয়েছিল দিবা আর রোজাকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য৷ একবার ডোর লক করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু হঠাৎ কিছু অনুভব করে থামে সে। দিবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় ধীরপায়ে। যা ভেবেছিল তাই! দিবা ভেতরেই আছে!
ঈশান রুমে প্রবেশ করে মৃদু আওয়াজে ডাকে,” দিবা, মাই লভ!”
একহাতে বিছানার চাদর মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে আছে দিবা। তার চুলগুলো এলোমেলো, মুখটা ফ্যাকাশে। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় একবার। ঈশান আরও কাছে যায়। দিবা সরে গিয়ে বলে,” আসবেন না।”
ঈশান চমকে তাকায়। দিবা কান্নাভেজা জড়ানো কণ্ঠে বলে,” আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন? সত্যি করে বলবেন।”
ঈশান কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। দিবার মুখটা আজলায় নিয়ে ভাঙা ভাঙা কাতর স্বরে বলে,” আ’ম স্যরি, এই পর্যন্ত যা যা করেছি সবকিছুর জন্য স্যরি। আমি খুব খারাপ, খুব জঘন্য একটা মানুষ। তুমি আমাকে ক্ষমা করো দিবা। আর কখনও করব না এমন। প্রমিস! ”
দিবা ভাবে ঈশান গতরাতের ওই নোংরা কৃতকর্মের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। কারণ ওই মুহূর্তে তার মাথায় শুধু ওটাই ঘুরছে। সে মুখ কুঁচকে বলে,” এভাবে মাফ চাইলেই পেয়ে যাবেন? কি ভেবেছেন আপনি? আমি অসহায় হতে পারি কিন্তু সস্তা না৷ আমি কখনও এর জন্য আপনাকে মাফ করতে পারব না ঈশান আহসান।”
দিবার কথাগুলো ঈশানের বুকে ছু’রির মতো আঘাত করে। র’ক্তক্ষরণ শুরু হয় হৃদয়ে। দিবা আঙুলের ইশারায় কোণার ওই দেয়াল দেখিয়ে বলে,” ওখানে সিসিটিবি আপনি লাগিয়েছেন তাই না? নিজে সারাক্ষণ আমাকে মনিটরিং করেন, একটুও বিশ্বাস করেন না। অথচ আমি কখনও আপনাকে ঠকানোর কথা চিন্তাও করিনি। তবু আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। এদিকে আমি, অন্ধের মতো আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। বিনিময়ে কি পেলাম বলুন? এতোবড় নোংরা প্রতারণা?
ঈশান সিসিটিবির দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলে,” আ’ম স্যরি, আমি এটা ঠিক করিনি জানি। তুমি কষ্ট পেয়েছো এজন্য? আমি এখনি খুলে দিচ্ছি। ”
সে উঠতে নিলে দিবা পড়ে যেতে নেয়, ঈশান আবার বসে পড়ে। বুকে আগলে ধরে তাকে। দিবা জড়ানো কণ্ঠে ফিসফিস করে,” আমাকে ছাড়ুন ঈশান আহসান। আপনার স্পর্শ আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি ঠকিয়েছেন আমাকে। খুব জঘন্যভাবে ঠকিয়েছেন।”
ঈশান বেচাল হয়ে জিজ্ঞেস করে,” আমি কিভাবে তোমাকে ঠকালাম? এটাও কি সম্ভব? আমি মানছি আমি খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যা না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি বিশ্বাস করো। তুমি আমার জান! আমার অবুঝ বউ। আমি কিভাবে তোমাকে ঠকাবো?”
কথাগুলো বলতে বলতে সে দিবার দূর্বল শরীরটা আগলে নেয়। কি ঠান্ডা হয়ে আছে মেয়েটার হাত-পা। এই অবস্থা কেন? ঈশান অনবরত দিবার কপালে, গালে চুমু দেয়। খুব অনুরোধ করে বলে,” ক্ষমা করো আমাকে দিবা, প্লিজ ক্ষমা করো।”
কিন্তু দিবার থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। ঈশান তার মুখটা তুলে দেখে, মেয়েটা নিথর হয়ে গেছে। ফরসা মুখ পুরোপুরি লালচে। ঠোঁটের একপাশ থেকে গড়িয়ে পড়ে সাদা ফেনা। ঈশান হতভম্ব হয়ে সশব্দে চিৎকার করে উঠে।
চলবে