শর্তসাপেক্ষে পর্ব-২৯

0
1

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ২৯
Sidratul Muntaz

পাহাড় ঘেরা লস অ্যাঞ্জেলস শহরের বুকে বিশাল গ্রিফিথ পার্ক যেন এক টুকরো স্বর্গীয় উদ্যান। সিমি রোজার ছোট হাতটা ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে, দু’পাশে ছড়ানো সোনালি ঘাসের ঢাল আর ছেয়ে থাকা উঁচু উঁচু ইউক্যালিপটাস ও ওক গাছ।

দূরে পাহাড়ের গায়ে ‘HOLLYWOOD’ লেখাটুকু যেন বিশেষভাবে নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। রোজা চারপাশটা দেখছে খুব আগ্রহ নিয়ে, তার বড় বড় চোখে খুশির ঝিলিক। চারপাশে শোনা যায় পাখির ডাক, ঝোপ থেকে লাফিয়ে ওঠে একটা সাদা খরগোশ। তাই দেখে রোজা হঠাৎই সিমির হাত ছেড়ে খরগোশের পেছনে ধাওয়া করতে যায়।

সিমিও দৌড় লাগায় রোজার পিছু। সাপের মতো পেঁচিয়ে যাওয়া পথ ধরে ছোট্ট রোজা দৌড়াচ্ছে। সিমি অনেক কষ্টে গিয়ে তাকে ধরে। আদুরে কণ্ঠে বলে,” মামণি, আমার হাত ছেড়ে একদম এভাবে দৌড়াবে না৷ কোথাও হারিয়ে যাবে!”

রোজা খরগোশ ধরতে না পেরে ছটফট করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বার-বার। সিমি হেসে ফেলে বলে,” তুমি এটাকে ধরতে পারবে না মামণি। লাফিয়ে লাফিয়ে কোথায় চলে গেছে! এসো আমরা এখানে বসি ”

রোজাকে নিয়ে একটা নিরিবিলি টিলার কাছে বসে পড়ে সিমি। মৃদু বাতাসে সূর্যের রোদটা বেশ মিষ্টি লাগছে। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। তামান্না ম্যাডামের কল দেখে সিমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে।

” হ্যালো, ম্যাডাম!”

ওই পাশ থেকে তামান্না উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” সিমি, কোথায় আছো?”

” এইতো, মামণিকে নিয়ে গ্রীফিথ পার্কে এসেছি, আমরা ঘুরছি।”

” আর ঘোরার দরকার নেই। দ্রুত ক্যালিফোর্নিয়া মেডিকেলে সেন্টারে আসো। আমরা সবাই ওখানেই যাচ্ছি।”

” কেন? আবার কেউ এক্সিডেন্ট করেছে নাকি?”

” এক্সিডেন্ট না, এরচেয়েও ডেঞ্জারাস। স্যারের ওয়াইফ সুইসাইড এটেম্পট করেছে!”

কথাটা শোনা মাত্র সিমির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় সে। কিছুক্ষণ প্রস্তুরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,” কিভাবে হলো এসব?”

ওই পাশ থেকে তামান্না দাঁতে দাঁত পিষে বলে,” সেটা তো তোমার জানার কথা। সকালে তো তুমিই ছিলে ওদের সাথে। ম্যামের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেছো? আর তাকে একা ফেলে তুমি কেনো চলে গেলে? স্যার না বলেছিল দু’জনের খেয়াল রাখতে?”

সিমির চোখ-মুখ ভ’য়ে শুকিয়ে যায়। কোনমতে ঢোক গিলে আর্দ্র কণ্ঠে বলে,” আমি কি করবো ম্যাডাম? দিবা ম্যামই আমাকে বললেন তিনি কিছুক্ষণ একা থাকতে চান। এমন কিছু হয়ে যাবে সেটা কি আমি জানতাম?”

” সে একা থাকতে চাইল কেন? তার কি মুড অফ ছিল?”

ভ’য়ে সিমির হৃৎপিন্ড থরথর করে কাঁপছে। কিভাবে এই অঘটন ঘটল সেটা তো সে বুঝতেই পারছে। কিন্তু এমন কিছু যে হবে তা সে ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করেনি। কি মুশকিল! এখন চাকরিটা কোনোমতে বাঁচানো গেলেই হয়।

” আমি কিছু জানি না ম্যাডাম।”

ওই পাশ থেকে তামান্না কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,” ঠিকাছে, স্যারের মেয়ে কোথায়? বাচ্চাটাকে নিয়ে দ্রুত হসপিটালে এসো৷ তারপর দেখছি।”

” কোন হসপিটাল যেন ম্যাডাম?” সিমি তার মনের উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে পারছে না৷ তার কণ্ঠ বদলে গেছে ইতোমধ্যে। কথার ধরণ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ভ’য়ে কতটা চুপসে আছে সে।

তামান্না বলে,” ক্যালিফোর্নিয়া মেডিকেল সেন্টার।”

” ওকে। আমি আসছি।”

সারারাস্তা সিমি শুধু দোয়া করতে থাকে যেন এই ঘটনায় তার কোনো বিপদ না হয়। রোজা উৎসুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সিমি শুকনো হেসে রোজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” কিচ্ছু হয়নি মামনি। এইতো আমরা এখন তোমার বাবার কাছে যাচ্ছি।”

এটুকু বলে সিমি আবারও দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ঈশান স্যার যদি তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, সে কি জবাব দিবে?

টিমের সবাই ক্যালিফোর্নিয়া মেডিকেল সেন্টারে এসে জড়ো হয়েছে। দিবা এখন ক্রিটিকাল ইউনিটের রেডজোনে। তার চেতনা নেই, হাত-পা পুরোপুরি ঠান্ডা, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। শ্বাস আছে কি নেই তা এখনও বোঝা যায়নি। পালস চেক করেও ডাক্তার কোনো রেসপন্স পাচ্ছেন না।

ঈশান থমথমে মুখে বলে,” আমার ওয়াইফকে আমি যেকোনো মূল্যে ফেরত চাই।”

মধ্যবয়সী ডক্টর সামান্থা লুইস ধীরে ধীরে বলেন,” মিস্টার আহসান, ধৈর্য্য রাখুন। আমরা চেষ্টা করছি পেশেন্টকে স্ট্যাবিলাইজ করতে। কিন্তু সত্যিটা হলো, পালস পাচ্ছি না, রেসপিরেশনও নেই, পিউপিলারি রিফ্লেক্স নেগেটিভ। সন্দেহ হচ্ছে, হৃৎপিন্ড বন্ধ হয়ে গেছে পাঁচ-সাতমিনিট আগেই।”

ঈশান লাথি মেরে সামনে থাকা একটা চেয়ার ফেলে দেয়। আসিফ ভয়ে তটস্থ হয়ে বলে,” স্যার, ধৈর্য্য রাখুন। কিছু একটা হবে।”

রাগে উন্মত্ত হয়ে ঈশান আসিফের কলার চেপে ধরে বলে,” ওর কোনো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না, আর তুমি আমাকে ধৈর্য্য ধরা শেখাচ্ছো?”

আসিফ শ্বাস নিতে না পেরে হাসফাঁস শুরু করে। তৌহিদ আর মিজান সাহেব এসে তাকে ছাড়ায়। ঈশান ডাক্তার কিংবা নার্সকে অবজ্ঞা করে দিবার কেবিনে ঢুকে যায়। মিজান সাহেব উদাস কণ্ঠে বলেন,” স্যারের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমার তো ভয় হচ্ছে, মেয়েটা সত্যি সত্যি ম’রে গেলে কি হবে?”

তৌহিদ হতাশ কণ্ঠে বলে,” কি আর হবে? আমাদের সবার চাকরি যাবে।”

” আশ্চর্য, আমাদের কেনো চাকরি যাবে? আমরা কি ম্যাডামকে মেরেছি?”

” জানি না, কিন্তু স্যার যে পরিমাণ এগ্রেসিভ হয়ে উঠেছে। আমি কোনো ভরসা পাচ্ছি না। সবাই দোয়া করো ম্যাডামের জন্য। আপাতত দোয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।”

তৌহিদ সত্যি সত্যি দুইহাত তুলে মোনাজাত ধরে। তার দেখাদেখি বাকিরাও তাই করে। ঈশান দিবার বেডের কাছে এসে শক্তমুখে বসে আছে চুপচাপ। সে নিজেও শ্বাস নিতে পারছে না৷ বুকের কাছে বিদ্ধ হয়ে আছে ভারী পাহাড়। মাথায় ঘুরছে কিছু অসহ্য, এলোমেলো চিন্তা। দিবার জীবনটা কি এখানেই থেমে যাবে? ঈশান কিছুই করতে পারবে না? যদি আয়ু রূপান্তর করার ব্যবস্থা থাকতো। সে অবশ্যই, এই মুহূর্তে নিজের আয়ু দিয়ে দিবাকে বাঁচিয়ে নিতো। উফ, ঈশান তার বুকে ভ’য়াবহ চাপ অনুভব করছে। দিবার কণ্ঠস্বর না শোনা অবধি এই যন্ত্রণা কমবে না!

সিমি উপস্থিত হতেই মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে। লিজা রোজাকে কোলে নেয়। তামান্না কটমটিয়ে জিজ্ঞেস করে,” তোমার সাথে ম্যাডামের লাস্ট কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল? সত্যি করে বলবে সিমি। তুমি নিশ্চয়ই আগে থেকে কিছু আঁচ করতে পেরেছো? খবরদার, মিথ্যা বললে কিন্তু আমি বুঝে ফেলবো৷ তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু লুকাচ্ছো।”

তামান্না ম্যাডামের বড় বড় চোখের সামনে অসহায় হয়ে সিমি গড়গড় করে সত্যিটা বলে দেয়। তাছাড়া এখন লুকিয়েও লাভ নেই। দিবা ম্যামের জ্ঞান ফিরলে সবাই তো এমনিও সব জানবে! তার কথা শুনে তামান্না মাথায় হাত দিয়ে বলে,” ও মাই গড! এতোবড় একটা ঘটনা ঘটিয়েও তুমি নিশ্চিন্তে বসে আছো? আমার তো এখন তোমাকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। স্টুপিড!”

সিমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,” আমি কি করব ম্যাডাম? বুঝিনি যে আমার সামান্য কথায় উনি এরকম একটা স্টেপ নিবে।”

লিজা বলে,” তোমার বোঝা উচিৎ ছিল সিমি। মেয়েরা এই বিষয়ে খুব সেন্সিটিভ হয়৷ যদিও দিবা ম্যাম যেটা করেছেন সেটা খুবই ভুল কাজ। উনার জায়গায় আমি হলে ঠিক উল্টোটা করতাম। নিজের কোনো ক্ষতি করতাম না। বরং হাজব্যান্ডকে শ্যুট করতাম। কারণ প্রতারণা সে করেছে, আর শাস্তি তার প্রাপ্য!”

টিনা আলতো হেসে বলে,” কিন্তু দিবা ম্যামের অবস্থাটাও বুঝতে হবে। বেচারীর হাজব্যান্ড তার থেকে অনেক পাওয়ারফুল। সে চাইলেও ঈশান স্যারকে শ্যুট করতে পারতো না। তাই নিজেই সুইসাইড করেছে। যেটা সবচেয়ে ইজি ছিল তার জন্য।”

তামান্না রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে,” শাটআপ গার্লস, তোমরা তোমাদের ফালতু আলাপ বন্ধ করবে?”

লিজা আর টিনা দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। সিমি ভ’য়ে ভ’য়ে জিজ্ঞেস করে,” আমার এখন কি হবে ম্যাম?”

তামান্না ঝাঁঝ মাখা কণ্ঠে বলে,” কি আর হবে? বোকামি যখন করেছো, তার ফলও ভোগ করো। আক্কেল নেই কোনো! কিভাবে এমন একটা কথা তুমি ম্যাডামকে বললে? স্যার যদি কোনো হুকারের সাথে হুকাপ করেও থাকে, সেটা তার পারসোনাল ব্যাপার। তুমি এই বিষয়ে বলার কে?”

সিমি মাথা নিচু করে ধমক শোনে। তামান্না বড় শ্বাস ফেলে বলে,” এখন শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেনো সব ঠিক হয়ে যায়। জুনিয়র হিসেবে আমি তোমাকে পছন্দ করি। যথেষ্ট দায়িত্বশীল তুমি৷ তাই তোমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হোক সেটা চাইবো না। কিন্তু ঈশান স্যারের কানে কথাটা গেলে তোমাকে কি করবে আল্লাহ মা’বুদ জানে। তখন আমার হাতে আর কিছু থাকবে না।”

সিপিআর চলছে, দিবার হার্ট রেসপন্স শুরু করেছে, ডক্টর সামান্থা আশান্বিত কণ্ঠে বলেন, “ইয়েস, শী ইজ রেসপন্ডিং। হার হার্ট জাস্ট রিস্টার্টেড। লেটস স্ট্যাবিলাইজ হার নাউ।”

ঈশান এতোক্ষণ নিথর হয়ে বসেছিল দিবার মাথার কাছে, তার শীতল হাতটি চেপে ধরে। এই কথা শোনা মাত্র তার বুকের আটকে থাকা ভারটা নামে, বড় করে শ্বাস নিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় সে। মনে হচ্ছে নতুন করে জীবন শুরু হয়েছে তার! মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার শুকরিয়া জানিয়ে দিবার কোমল হাতটা নিয়ে চুমু খায়। কৃতজ্ঞতার তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে।

দিবাকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে কাঁচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঈশান দেখে নিস্পন্দ চোখে। পেছনে এসে দাঁড়ায় মিজান সাহেব। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,” স্যার, আল্লাহ রহম করেছে। ম্যামের হার্ট রেসপন্স শুরু হয়েছে৷ এবার সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

ঈশান ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,” আপনারা এখনও এখানে কি করছেন?”

” কি বলছেন স্যার? এতোবড় বিপদে আমরা আপনার পাশে থাকবো না?”

ঈশান একহাতে চোখে একটু মালিশ করে বলে,” দরকার নেই। সবাইকে ফিরে যেতে বলুন। আপনিও যান৷ রেস্ট নিন হোটেলে গিয়ে। আপাতত সবকিছু বন্ধ। ”

তারপর ঈশান একটু আশেপাশে তাকিয়ে রোজাকে খোঁজার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটাকে দেখছে না। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ওর ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই! তামান্না এগিয়ে এসে বলে,” স্যার মামণি আমার কাছে আছে, ওকে আমি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

ঈশান স্বস্তিভরা কণ্ঠে বলে,” থ্যাংকস তামান্না।”

” ওকে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি স্যার। এইখানে ওর থাকার প্রয়োজন নেই। ”

” ঠিকাছে, নিয়ে যাও।”

তামান্না একটু থেমে বলে,” স্যার আপনিও চলুন না, আপনাকে খুব টায়ার্ড লাগছে। একটু খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট নিয়ে নিবেন।”

ঈশান কঠিন চোখে তাকাতেই সে থতমত খেয়ে বলে,” স্যরি স্যার, আপনি ম্যাডামকে ফেলে কিভাবে যাবেন? ঠিকাছে আমি মামণিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

ঈশান শক্তমুখে বলে,” বের হোন সবাই।”

সবাই চলে যাওয়ার পর করিডোর সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়। ঈশান আইসিউ’র সামনে একইভাবে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। অপেক্ষার অবসান হয় না। ঈশান চেয়ে থাকে ঘুমহীন আর নিঃসাড় দৃষ্টিতে। ভোরের দিকে তার একটু চোখ লেগে আসে। মনে হয় দিবা এসে পাশে বসেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ঈশান ইচ্ছে করেই চোখ তুলে তাকায় না। সে জানে সে ভ্রমে আছে। চোখ খুললেই ভ্রমটা ভেঙে যাবে। সে মনে মনে দিবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে।

” কেনো করলে তুমি এটা?”

” আপনি ভ’য় পেয়েছেন?”

” ভ’য় মানে? আরেকটু হলে আমি তো ম’রেই যাচ্ছিলাম। ডাক্তার যখন বলল তোমার পালস পাচ্ছে না, আমার তখন কি অবস্থা হয়েছিল জানো?”

দিবা হাসতে থাকে খিলখিল করে। ঈশান তৃষ্ণাভরা দৃষ্টিতে দেখে।

” এক্সকিউজ মি মিস্টার আহসান, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”

ডক্টর সামান্থা ঈশানের বাহু ধরে ঝাঁকাচ্ছেন। তন্দ্রা ভেঙে জেগে ওঠে ঈশান। মাথা নেড়ে সাড়া দেয়,” জ্বী?”

ডক্টর সামান্থা হাসিমুখে বলেন,” কংগ্রাচুলেশন,আপনার স্ত্রী নিউরোলজিকালি রেসপন্স শুরু করেছেন৷ এটা একটা ভালো সাইন।”

ঈশান উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে,” আমি কি দেখা করতে পারি?”

” নিশ্চয়ই, যান। ভেতরে কেউ নেই এখন।”

ঈশান উদ্বেগ নিয়ে দিবার বেডের কাছে যায়। নিস্পন্দ শুয়ে আছে দিবা, নাকের দুইপাশে ন্যাসাল ক্যানুলা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। উজ্জ্বল আলোর সামনে চোখের পাতা হালকা কাঁপছে। ঈশান গিয়ে ওর হাতের মুঠোয় নিজের আঙুলটা রাখে। সঙ্গে সঙ্গে সেই আঙুল চেপে ধরে দিবা। ঈশান হেসে সেই হাতে চুমু দেয় অজস্র।

গোটা আটচল্লিশ ঘণ্টা তাকে অবজারভেশনে রাখার পর নির্দিষ্ট কেবিনে শিফট করা হয়। টিমের সবাই এসে ঈশানকে অভিনন্দন জানাতে থাকে। এই দুইদিন কেউ তার মুখে হাসি দেখেনি, তাকে ঘুমাতে দেখেনি, সারাক্ষণ আইসিউ কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

দিবা দূর্বল শরীর নিয়ে বসে আছে বিছানায়। তার মুখ ফ্যাকাশে৷ একজন নার্স এসে তাকে ঔষধ খাওয়াতে নেয়। দিবা মুখ সরিয়ে বলে,” খাবো না। ভালো লাগছে না।”

” এমন কেনো করছেন ম্যাডাম? প্লিজ খেয়ে নিন। নাহলে আপনি সুস্থ হবেন না।”

” আমি সুস্থ হতে চাইও না।”

নার্স অবাক হয়ে বলে,” কিন্তু কেন? আপনার হাজব্যান্ডকে দুইদিন ধরে দেখছি কি পরিমাণ পেরেশানিতে আছেন। সারাক্ষণ আপনার আইসিউর সামনে চাতক পাখির মতো ঘুরঘুর করেছেন। এমন হাজব্যান্ড পেয়েও কেউ সুইসাইড এটেম্পট করে?”

দিবা র’ক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকে, কোনো জবাব দেয় না। নার্স অনুরোধ করে,” প্লিজ খেয়ে নিন ম্যাডাম৷ স্যার খুব টেনশনে আছেন আপনাকে নিয়ে।”

” থাকতে দিন ওকে টেনশনে ”

ঠিক সেই মুহূর্তে কেবিনে ঢোকে ঈশান। চোখ-মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। নার্স ক্ষীণ গলায় বলে,” অনেক চেষ্টা করেছি স্যার। কিছুতেই খাওয়াতে পারছি না।”

ঈশান শান্ত স্বরে বলে,”যান আপনি, আমি দেখছি।”

দিবা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ঈশান একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসে। ঔষধ আর খাবারের প্লেট হাতে নেয়। আদেশের মতো বলে,” হা করো। আগে ঔষধ খেতে হবে।”

দিবা নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলে,” খাবো না।”

” তাকাও আমার দিকে। ”

” তাকাবো না ”

ঈশান ধৈর্য্য হারিয়ে শব্দ করে প্লেটটা টেবিলের উপর রাখে। ভ’য় পেয়ে হালকা কেঁপে উঠে দিবা। ঈশান তীক্ষ্ণ মেজাজে জিজ্ঞেস করে ” সেদিন সকালে কি এমন হয়েছিল যে তুমি বিশটা ডাইহাইড্রোফেন একসাথে খেয়ে নিলে?”

” বেশ করেছি খেয়ে।”

” একটা থাপ্পড় দিবো।”

দিবা থতমত খেয়ে পিছিয়ে যায়। তার হাত স্বয়ংক্রিয় নিজের গালে চলে যায়। ভাবে ঈশান সত্যিই চ’ড় মারবে তাকে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলায় ঈশান৷ তারপর জিজ্ঞেস করে,” কেনো করলে এটা?”

” আপনার সাথে আর থাকতে চাই না তাই করেছি।” স্পষ্ট গলায় কথাটা বলে দিবা। তার চোখ-মুখ শক্ত।

ঈশান বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,” ডিভোর্স চাও তাহলে?”

দিবা স্বাভাবিক স্বরে বলে,” দিয়ে দিন ডিভোর্স।”

চলবে