শর্তসাপেক্ষে পর্ব-৩০

0
1

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ৩০
Sidratul Muntaz

দিবার উত্তর শুনে ঈশান বিহ্বল হয়ে যায়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চেয়ে থেকে মেজাজ সামলে নিয়ে বলে,” ঠিকাছে, দিবো তোমাকে ডিভোর্স। তার আগে আমাকে একটা ভ্যালিড রিজন বলো। কেনো চাইছো ডিভোর্স?”

” কারণটা আপনি ভালো করেই জানেন। আমি স্পষ্ট করে বলেছিও।”

ঈশান বড় শ্বাস ছেড়ে বলে,” ঠিকাছে, তুমি যা চাও তাই হবে। এখন খেয়ে নাও।”

” কখন হবে? আগে বলুন কখন?”

প্রশ্নটা করে ফেলার পর ঈশানের বিধ্বংসী দৃষ্টি দেখে দিবা থমকে যায়। ঢোক গিলে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে,” আমি এই পাতলা পাতলা স্যুপ খাবো না, ছি! খুব বাজে টেস্ট।”

” এটাই এখন তোমার জন্য উপযুক্ত। ভারী খাবার খাওয়া যাবে না এটলিস্ট চব্বিশ ঘণ্টা।”

দিবা চোখ-মুখ কুঁচকে খাবারের প্লেট হাতে নেয়। খুব অনাগ্রহের সাথে খেতে থাকে। যদিও তার একদম ক্ষিদে অনুভব হচ্ছে না। ডাইফেনহাইড্রামিনের ওভারডোজের কারণে হজমতন্ত্র একদম দূর্বল হয়ে গেছে। তাছাড়া পেট ওয়াশ করা হয়েছে, ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। মুখে তিতকুটে অনুভব হচ্ছে।

” রোজা কোথায়?” খেতে খেতে প্রশ্ন করে দিবা।

” তোমার রোজাকে কি দরকার?”

” এমনি দেখতে ইচ্ছে করছে। ”

” দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। ও ওর মতো ভালো আছে। তুমি নিজের চিন্তা করো।”

দিবা মুখ গোজ করে শান্ত থাকে। একটা কথাও আর বলে না। এমনিতেও ঈশানের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। ঈশান তাকে ঔষধটা খাইয়েই রুম থেকে বের হয়ে যায়। দিবা বিছানায় গা এলিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। তার বেডের ঠিক ডানেই বড় কাঁচঘেরা জানালা। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে শহরের একাংশ। ওইযে আলো ঝলমলে স্বপ্নের মতো সুন্দর রিজ কার্ল্টন দেখা যাচ্ছে। দিবা একটা বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

পাশেই একটা ভাইটাল মনিটর, তার হৃৎস্পন্দন, র’ক্তচাপ আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন পর্যবেক্ষণের জন্য। এছাড়াও আছে অক্সিজেন মাস্ক। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আবার এটা পরতে হবে। কেবিনটার পরিবেশ ভালো, চারপাশে একটা কৃত্রিম গন্ধ ছড়িয়ে আছে। দিবা যেই বেডে শুয়ে আছে সেটা ইলেকট্রনিক আইসিউ গ্রেড এডজাস্টেবল। মাথা ও পা ওঠা-নামা করানো যায়। এই আবদ্ধ ঘরে বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগছে না।

রোজার কথাও খুব মনে পড়ছে। মেয়েটা কোথায়? ওই ঈশান আহসান কি ইচ্ছে করেই রোজাকে এখানে পাঠাচ্ছে না?একটু পরেই নার্স ভেতরে আসে। দিবাকে সে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করবে এখন। দিবা নরম কণ্ঠে বলে,” সিস্টার, বাইরে কে কে আছে?”

” আপনার হাজব্যান্ড, ডক্টর ম্যামের সাথে কথা বলছেন।”

” আর আমার মেয়ে?”

” কি জানি? কোনো বাচ্চাকে তো দেখলাম না।”

দিবা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়৷ রোজা কি হোটেলে একা আছে? তার খেয়াল কে রাখছে?

” আচ্ছা আমাকে কবে ছাড়া হবে?”

” এখনও আপনার শরীর স্ট্যাবল না। কমপক্ষে দুই-তিনদিন তো লাগবেই।”

নার্স ইঞ্জেকশন পুশ করে চলে যাওয়ার পর দিবা উদাস মুখে বসে থাকে। বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে চিন্তা করে, কেনো বাঁচল সে? ম’রে গেলেই তো ভালো ছিল। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। পর মুহূর্তেই আবার মনে হয়, সে ম’রলে কার কি হতো? কারো কি টনক নড়তো? ঈশান আহসান নিশ্চয়ই আরেকটা বিয়ে করে নিতো। আরেক মেয়ের কপাল পুড়তো। এসব ভাবতে ভাবতে দিবা অসহ্য হয়ে উঠে। মাথায় ব্যথা শুরু হয়।

হঠাৎ দরজায় নক করে কেউ। দিবা ঘাড় ঘুরিয়ে দূর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” কে?”

” ম্যাম, আমি সিমি। আসবো?”

দিবা একটা উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু মাথা কেমন ঘুরে আসছে। চারদিক অন্ধকার লাগে। কোনমতে বলে,” হ্যাঁ, এসো।”

সিমি মাথা নিচু করে প্রবেশ করে কেবিনের ভেতর। তার সাথে রোজা, মুখ জুড়ে মিষ্টি হাসি নিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে দিবার কাছে আসে। দিবা আনন্দিত কণ্ঠে বলে,” বার্বী ডল, এসো! কেমন আছো মা? আই মিসড ইউ সো মাচ।”

মেয়েকে বুকের মধ্যে একদম জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ঠিকমতো তাকে আগলাতেও পারে না। হাতে সেই জোর নেই। রোজা নিজেই বিছানায় উঠে দিবার কোলে বসে। সিমি বলে,” মামনি, ব্যথা দিও না। তোমার মা এখনও সুস্থ হয়নি।”

দিবা হেসে বলে,” কোনো সমস্যা নেই। তুমি ওই চেয়ারটায় বসো সিমি। তারপর বলো কি খবর? এই দুইদিন রোজার খেয়াল তুমি রেখেছো?”

” না, ও তো বেশিরভাগ সময় তামান্না ম্যামের কাছেই ছিল। খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তাদের। খুব মিশুক বাচ্চা। সবার সাথে সুন্দর মিশে যায়।”

দিবা মলিন হেসে রোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। হ্যাঁ ঈশান ঠিকই বলেছিল, রোজাকে সামলাতে দিবার কোনো প্রয়োজন নেই। এই দুনিয়ায় দিবা সর্বদা অপ্রয়োজনীয় আর উপেক্ষিত হয়েই রইল। এসব চিন্তা করে হঠাৎই খুব অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। সিমি উশখুশ করে বলে, ” ম্যাম, একটা কথা বলবো?”

” বলো সিমি।” ছোট্ট একটা হতাশ শ্বাস নেয় দিবা। আলতো হাতে চোখের কোণ মুছে।

সিমি মাথা নত করে অপরাধী ভঙ্গিতে বলে,” আমি একটা বাড়াবাড়ি করেছি।”

দিবা তার কথার অর্থ বুঝে ফেলে খুব সহজেই। সামান্য হেসে বলে,” কিচ্ছু বাড়াবাড়ি করোনি তুমি। সত্যিটা আমার জানার প্রয়োজন ছিল৷ বরং তোমাকে ধন্যবাদ, আমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্য। খুব বোকা আমি, জীবনে অনেক ধরণের বোকামি করেছি। আমার এই কাজটাও একটা বোকামি ছিল।”

সিমি অশ্রুসজল দৃষ্টিতে বলে,” ম্যাম প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আমি একটা ভুল করেছি। আর সেই ভুলের মাশুল আপনাদের দিতে হয়েছে। আমি না জেনে ভুল বলেছিলাম। স্যার সারারাত ওই পার্টিতে ছিল না। উনি অনেক আগেই বের হয়ে গেছিলেন। কিন্তু আমি সেটা জানতাম না।”

দিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সিমির অনুতাপে লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে। তারপর বিষণ্ণ স্বরে বলে,” এখন আর মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই সিমি৷ আমি জানি সে তোমাকে দিয়ে এগুলো বলাচ্ছে। নিজের অপরাধ এইভাবে ঢাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি আর এসবে ভুলবো না। ওর আসল রূপ আমার জানা হয়ে গেছে। এতোদিন আমি বোকার স্বর্গে বাস করেছি। ভেবেছি সে সত্যি আমাকে ভালোবাসে! কিন্তু এখন বুঝলাম এই দুনিয়ায় ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। সে কেনো আমার মতো মেয়েকে ভালোবাসবে? আমার তো কোনো…”

দিবা থেমে যায়। সে কি বলছে এসব? মেয়েটা ঈশানের অফিসের এমপ্লয়ি। তার সাথে এতোটাও ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়ে যায়নি যে দিবা এসব ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপ করবে। আসলে শরীরের সাথে সাথে তার মাথাটাও বোধহয় খুব খারাপ হয়ে গেছে।

সিমি উতলা কণ্ঠে বলে,” বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, স্যার আমাকে কিছু শিখিয়ে দেয়নি। ইন ফ্যাক্ট স্যার এই ব্যাপারটা জানেনই না৷ জানলে এতোক্ষণে আমার চাকরি চলে যেতো। আমি এখানে আপনার সামনে বসে থাকতে পারতাম না। বরং আমি তো উল্টো আপনাকে রিকয়েস্ট করতে এসেছি যেন স্যার এই কথাটা জানতে না পারে।”

দিবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। খানিকটা অবাক হয়ে বলে,” মানে?”

” মানে স্যার এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমি আপনাকে ভুল তথ্য দিয়েছিলাম৷ তাই নিজের ভুল শুধরাতে এসেছি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।”

” তুমি ভুল তথ্য কেনো দিবে? এতে তোমার কি লাভ?”

সিমি বিপর্যস্ত গলায় বলে,” আমি বুঝতে পারিনি,স্যরি। আমি তো ভেবেছিলাম কর্পোরেট অফিসের বসরা এমনই হয়। আসলে আমি এই বছরই জয়েন করেছি অফিসে। ঈশান স্যার সম্পর্কে তেমন ভালো করে জানিও না।জানলে এই কথা বলার আগে হাজারবার ভাবতাম। আমার ভুল হয়ে গেছে।”

দিবা চোখ-মুখ কঠিন করে বলে,” তাহলে সেদিন রাতে তোমার স্যার কোথায় ছিল বলো? সে যদি আগেই পার্টি থেকে বের হয়ে থাকে, তাহলে হোটেলে ফিরে আসেনি কেন?”

সিমি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে,” আমি যতদূর শুনেছি তখন স্যার ওখান থেকে বের হয়ে এলএপিডিতে গিয়েছিলেন।”

” এলএপিডি মানে?”

” থানা, পুলিশ স্টেশন।”

দিবা চমকানো কণ্ঠে বলে,” সে ওখানে কি করছিল?”

সিমি দুইপাশে মাথা নেড়ে বলে,” এটা আমি জানি না। এমনিতেও আমার অতিরিক্ত কথায় যথেষ্ট ঝামেলা হয়ে গেছে। আমি আন্দাজে বলে আর কোনো ঝামেলা বাড়াতে চাই না৷ আমাকে মাফ করবেন। শুধু আপনার কাছে অনুরোধ করছি, এই ব্যাপারটা স্যারকে বলবেন না। তাহলে সত্যি আমার চাকরি চলে যাবে। চাকরিটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।”

তার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে চেয়ে থেকে দিবা সুক্ষ্মদৃষ্টিতে হঠাৎ বলে,” আমার তাহলে একটা শর্ত আছে।”

সিমি তাকায় কৌতুহল পূর্ণ চোখে। দিবা বলে,” এখন থেকে তুমি তাহলে আমার প্রতি লয়্যাল থাকবে। তোমার স্যার কি করে, কোথায় যায়, কাদের সাথে মিশে, সবকিছুর খবরা-খবর আমাকে এনে দিবে। পারবে এটা করতে?”

সিমি হতবাক হয়ে যায়, মুখটা ফ্যাকাশে দেখায় খুব। দিবা চোখ বড় করে বলে,” জবাব দাও। নাহলে কিন্তু সত্যি তোমার চাকরি খাবো আমি।”

সিমি তড়িঘড়ি করে বলে,” না ম্যাম, এতো নিষ্ঠুর হবেন না। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব, প্রমিস!”

দিবা আলতো করে রোজার কপালে চুমু দিয়ে বলে,” দ্যাটস গুড। এখন তুমি যাও। রোজা আমার কাছেই থাকবে।”

” থ্যাঙ্কিউ ম্যাম, আপনি খুব ভালো মানুষ। আমি আপনার উপকার কখনও ভুলবো না।”

” উপকারের প্রতিদান যেনো পাই।”

” হুম। নিশ্চয়ই পাবেন।”

দিবা মৃদু হাসে। সিমি কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। দিবা বুঝতে পারছে না সে কি করবে? একটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। ঈশান পুলিশ স্টেশনে কেনো যাবে? আর সিমি যে এখন সত্যি বলেছে তার নিশ্চয়তা কি? উফ, মাথাটা এমন ধরে আসছে না!

রোজা তার আইপ্যাডে গেমস খেলছে, একটা বার্বী ডল সুন্দর করে সাজিয়ে দিবাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখায় সে। দিবা মিষ্টি করে হাসে।

দিবাকে আজকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। সবকিছু গুছানো হয়েছে। ডাক্তার সামান্থার সাথে কথা শেষ করে ঈশান ভেতরে প্রবেশ করে। দিবা জানতে চায়,” কখন বের হচ্ছি আমরা?”

” এইতো একটু পর। ডাক্তার আসছে তোমাকে চেকাপ করতে। তারপর।” ঈশানের কণ্ঠ গম্ভীর।

আশেপাশে কেউ নেই। দিবা এই সুযোগে জিজ্ঞেস করে,” একটা প্রশ্ন করব?”

” কি?” ঈশান তাকায় সরাসরি।

দিবা আমতা-আমতা করে বলে,” সেদিনরাতে আপনি কোথায় ছিলেন?”

” কোন রাতে?” ভ্রু কুঁচকে ঈশান।

দিবা স্পষ্ট করে বলে,” যেদিন সকালে আমার এই এক্সিডেন্টটা হলো তার আগের দিন রাতের কথা বলছি!”

ঈশান একটু সময় চুপ থেকে সরাসরি সত্যিটাই বলে,” পুলিশ স্টেশন।”

সিমির কথার সাথে ঈশানের উত্তর মিলে যাওয়ায় দিবা একটু স্বস্তি পায়। অবশ্য সিমির চোখ-মুখ দেখে একদমই মনে হয়নি যে মেয়েটা মিথ্যা বলছে। তারপর আবার সে জিজ্ঞেস করে,” ওখানে কেন?”

” একটা জরুরী কাজ ছিল।”

” কি সেই জরুরী কাজ? আমাকে বলা যায়?”

” রাফিনের এক্সিডেন্টের খবরটা নিশ্চয়ই শুনেছো? ওইটা নিয়েই একটা হেসেল হয়েছিল।”

দিবা আৎকে উঠে বলে,” রাফিনের এক্সিডেন্ট? আমি তো এরকম কিছু শুনিনি। কোথায় ও? কোন ওয়ার্ডে? আর এখন কেমন আছে?”

উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে এতোগুলো প্রশ্ন করে ফেলে দিবা। ঈশান এক ভ্রু উঁচু করে তাকায়। ফোড়ন কাটতে বলে,” দেখতে যাবে নাকি? ট্রলি আনবো একটা? ”

দিবা মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,” উফ, আমি এমনিই জিজ্ঞেস করছি। একটা মানুষ এক্সিডেন্ট করেছে শুনলে খোঁজ নিবো না? কিভাবে করল এক্সিডেন্ট?”

ঈশান রুক্ষ গলায় আওড়ায়, ” কোনো এক্সিডেন্ট করেনি। আমি মেরেছি ওকে। তারপর নিজেই হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু এখানে না, অন্য হসপিটালে। এসব নিয়েই পুলিশি ঝামেলা হচ্ছিল। এখন অবশ্য ও সুস্থই আছে। আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছে।”

দিবা আশ্চর্য কণ্ঠে বলে,” আপনি ওকে কেনো মারলেন?”

” কেনো মেরেছি সেটা তোমার জানার কথা। সিসিটিবির বিষয়টা তো জানো। কেউ আমার ভাড়া করা পেন্টহাউজে ঢুকে আমার স্ত্রীর হাত ধরে টেনে দরজা আটকে দিবে, আর আমি সেটা সহ্য করব? এতোটা সহ্যশক্তি এখনও হয়নি। আমি যে ওকে খু’ন করে ফেলিনি এটাই ওর ভাগ্য।”

দিবা চোরা চোখে অন্যদিকে তাকায়। তটস্থ হয়ে বলে,” আমি জানতাম আপনি এরকম কিছু করবেন। সেজন্যই আপনাকে সত্যিটা বলিনি। এখন মনে হচ্ছে না বলেই ভালো করেছিলাম। কিন্তু আপনি তো ছুপা রুস্তম। ঠিকই অঘটন একটা ঘটালেন।”

” রাফিনের জন্য খুব মায়া হচ্ছে মনে হয়? আজরাতেই ওকে ফ্লাইটে তুলে দিবো। বাংলাদেশে ফিরে যাবে। চাকরি থেকেও বরখাস্ত করেছি। চাইলে তুমিও ওর সাথে চলে যেতে পারো। যাবে নাকি? ইচ্ছে থাকলে বলো, ব্যবস্থা করছি।”

দিবা হতভম্ব কণ্ঠে বলে,”কি আশ্চর্য, আমি কেনো ওর সাথে যেতে চাইবো? ”

এমন সময় ডাক্তার সামান্থা হাসিমুখে প্রবেশ করেন কেবিনে। রিনরিনে কণ্ঠে বলেন,” রোগীর কি অবস্থা?”

দিবা আর ঈশানের ঝগড়া থেমে যায়। ঈশান গম্ভীর মুখে দিবার ঔষধপত্র আর ফাইল ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত হয়। ডাক্তার সামান্থা পেশাদার ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে স্টেথোস্কোপ বের করেন। দিবার মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলেন,” ডিভা, কেমন লাগছে এখন? মাথা ঘোরে? বমি ভাব বা শ্বাসকষ্ট?”

দিবা মৃদু স্বরে বলে,” না সেরকম কিছু নেই। এখন একটু ভালো লাগছে, তবে শরীরটা খুব দুর্বল। মাথায় মাঝে মাঝে ব্যথা করে।”

সামান্থা ওর পালস, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করেন। চোখের পাপড়ি টেনে চেক করেন রেসপন্স। বুকের ওপর স্টেথোস্কোপ রেখে শুনে নেন হার্ট আর ফুসফুসের শব্দ। তারপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলেন,”ওভারঅল তোমার ভায়টালস এখন স্ট্যাবল। যেহেতু তুমি গত ২৪ ঘণ্টায় ঠিকঠাক সাড়া দিয়েছো, আমরা তোমাকে ছাড়তে পারি। তবে বাড়ি যাওয়ার পরেও একটা মেডিক্যাল প্ল্যান ফলো করতে হবে কিন্তু খাবারের নিয়ম, ওষুধ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, আর কিছু মানসিক সাপোর্ট।”

এটুকু বলেই তিনি ঈশানের দিকে তাকান, “মিস্টার আহসান, বিশেষ করে রাতের ঘুম, ওষুধ, খাওয়া…এসব যেন নিয়মিত হয়।”

ঈশান ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি খেয়াল রাখব।”

সামান্থা একটু থেমে বলেন,” ওর শরীরটা এখনও দুর্বল। নিজের পায়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

তারপর নার্সকে ইন্টারকমে ডেকে বলেন,”দয়া করে ৩১২ নাম্বার কেবিনে একটা হুইলচেয়ার পাঠিয়ে দিন। রোগী ডিসচার্জ হচ্ছে।”

ঈশান বাধা দিয়ে বলে,” হুইলচেয়ারের প্রয়োজন নেই।”

” তাহলে ও যাবে কিভাবে?”

” আমি নিয়ে যাবো।”

দিবা চোখ তুলে তাকায়। সামান্থা অবাক হয়ে বলেন,” আপনি নিয়ে যাবেন মানে? কোলে উঠিয়ে?”

ঈশান কিছু না বলে দিবার কাছে এসে তাকে সত্যি কোলে উঠিয়ে নেয়। তার এই কান্ডে দিবা হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ডাক্তার সামান্থা মুচকি হেসে বলেন,” ভালো থেকো ডিভা। গড ব্লেস ইউ।”

রিয়ার ভিউ মিররে রোজাকে দেখা যাচ্ছে। আইপ্যাডে গেইমস খেলায় মহাব্যস্ত সে। ভ্রু কুঁচকে এমনভাবে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে, যেন কত জরুরী কাজ! পাশে ঈশান ড্রাইভ করছে গম্ভীর মুখে। দিবা তাদের দু’জনকেই ঘুরে ঘুরে দেখছে। একটু পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আ’ম স্যরি।”

” স্যরি কিসের জন্য?” ঈশান যেন প্রশ্ন করেনি, উল্টো ধমক দিয়েছে।

দিবা সহজ গলায় বলে,” আপনাকে অবিশ্বাস করেছি তাই।”

” মানে? কি নিয়ে অবিশ্বাস?”

” আমি ভেবেছিলাম, ওইদিন রাতে মনে হয় আপনি কোনো হুকারের সাথে..”

প্রচন্ড জোরে গাড়িটা ব্রেক হয়। দিবা থেমে যায়, ভয়ে জুবুথুবু হয়। রোজার হাত থেকে আইপ্যাড পড়ে গেছে। দিবার গায়ে সিটবেল্ট ছিল বিধায় সে সামনে ঝুঁকে যায়নি। নয়তো একটা ব্যথা পেতো। ঈশান পেছনে ঘুরে দেখে মেয়ে ঠিকাছে কি-না! রোজা নিচ থেকে আইপ্যাডটা তুলে আবার সিটে বসেছ। নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে দেখছে বাবাকে। ঈশান স্টেয়ারিং-এ একহাত ঠেকিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,” হঠাৎ এইরকম দারুণ একটা চিন্তা আপনার মাথায় কিভাবে এলো দিবা রহমান?”

” জানি না, হঠাৎ মনে হয়েছে।”

দিবা সিমির বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চায়। ঈশান ধারালো এবং বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,” তুমি আমাকে এতোটা অবিশ্বাস করো, আমি ভাবতেও পারিনি।”

” আপনিও তো আমাকে অবিশ্বাস করেন। নাহলে ওইভাবে ঘরে সিসিটিবি লাগাতেন না ”

ঈশান কটমট করে বলে,” আমি সিসিটিবি লাগিয়েছি সেফটি পারপাসে। শুধু তোমার ঘরেই না, রোজার খেলার জায়গাতেও সিসিটিবি ছিল। কিন্তু তুমি এটা কিভাবে ভাবলে? যেখানে আমি স্ট্রিট ফুড পর্যন্ত খাই না সেখানে স্ট্রিট গার্ল? ছি! একটা ব্যাসিক কমনসেন্স থাকা উচিৎ। বাই দ্যা ওয়ে, এইসব ভেবেই কি তুমি এই জঘন্য কাজটা করেছো?”

” বয়েই গেছে আমার আপনার জন্য এটা করতে। আমার মাথা ধরেছিল। মনে হলো অনেকগুলো ঔষধ একসাথে খেলে ঘুম চলে আসবে আর মাথাব্যথা ঠিক হয়ে যাবে। ব্যস!”

ঈশান তাচ্ছিল্য হেসে বলে,” তুমি একটা আজব চীজ দিবা। কি মনে করে যে বিয়েটা করেছিলাম। মনে হচ্ছে সারাজীবন পস্তাতে হবে। ওহ স্যরি, তোমার তো এখন আবার ডিভোর্সও চাই।”

দিবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ঈশান কি ডিভোর্সের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিল নাকি মজা করছে? সে বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করার সাহসও হয় না।

রিজ কার্লটনে নেমে ঈশান আগে রোজাকে বের করে দেয়। নিজের আইপ্যাড ব্যাগপ্যাকে ঢুকিয়ে রোজা হাঁটতে থাকে ছোট ছোট পায়ে। ঈশান এবার সামনে এসে দিবাকে কোলে নিতে উদ্যত হলেই দিবা নিচু স্বরে বলে,” থাক লাগবে না, আমি হাঁটতে পারবো।”

ঈশান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,” প্রয়োজন নেই। তোমাকে আমি এভাবেই নিয়ে যাবো।”

তারপর আর কিছু বলে না সে। চুপচাপ ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। লবিতে টিমের সব সদস্যরা অপেক্ষায় ছিল। দিবাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসে তারা। ঈশান সবাইকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে দিবাকে নিয়ে লিফটের কাছে চলে আসে। দিবা দূর থেকে রাফিনকেও দেখতে পায়। তার আত্মা ছলাৎ করে উঠে। ঈশান বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে ঝটপট।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। কাঁচের জানালায় উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে দিবা৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর ঝলকানিতে পুরো শহরটাকে মনে হচ্ছে নক্ষত্রকুঞ্জ। দিবা একটা বিষয় নিয়ে এখনও গভীরভাবে ভাবছে। তখন সিমির কথাগুলো শুনে এতোবড় পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ হয়নি তার।

কিন্তু সে এটা করেছিল শুধুই নিজের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। তখন বোধশক্তি ব্যাপারটা একদমই কাজ করেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, নিজের ভেতর সে একটা হীনমন্যতা টের পেয়েছিল। যা ছোট থেকেই হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছিল, সে বুঝি ঈশানের যোগ্যই হতে পারেনি কখনও৷ আর সেজন্যই ঈশান তাকে ছেড়ে অন্য নারীর কাছে গেছে৷ এটাই হবে সবসময়। আর এটাই হওয়ার ছিল। তার মতো অপূর্ণ নারীর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ওসব চিন্তা করে আবারও দমবন্ধ লাগে দিবার।

হঠাৎ পেছন থেকে ঈশান ডাকে,” শোনো, ভেতরে এসো।”

দিবা ঘুরে দেখে ঈশান দাঁড়িয়ে আছে। রুমের দিকে হেঁটে যায় সে। ঈশান তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। কিছুক্ষণের থমথমে নীরবতা। হঠাৎ সে পকেট থেকে একটা খাম বের করে থমথমে কণ্ঠে বলে,” তোমার চাওয়া তো ডিভোর্স, না? সাইন করো এখানে।”

দিবা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। অবাক দৃষ্টিতে একবার ঈশানকে দেখে, আরেকবার দেখে তার বাড়িয়ে দেওয়া খাম। বিস্ময়ে ঠোঁটজোড়া কাঁপতে থাকে। ঈশান শান্ত-স্বাভাবিক স্বরে বলে,” যাকে বিশ্বাস করতে পারোনি, তার সাথে থাকারও কোনো মানে হয় না। যাও মুক্তি দিলাম তোমাকে। এটাই তো চেয়েছিলে তুমি। নাও ধরো!”

ঈশানের ভারী গর্জনে মৃদু কেঁপে উঠে দিবা। কাঁপা হাতেই খামটা ধরে। মুহূর্তেই তার চোখের অশ্রুতে ভিজে যেতে থাকে কাগজটা। সে হঠাৎ ওরনাতে মুখ চেপে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে যায় খামটা ফেলে রেখেই।

চলবে

#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব ৩০( অতিরিক্ত)
Sidratul Muntaz

দিবা কাঁদতে কাঁদতে বারান্দায় চলে যাওয়ার পর ঈশান কিছুক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে৷ তারপর মেঝে থেকে খামটা তুলে নেয় হাতে। রোজা গেইমস কর্ণারে যেতে বায়না করছে। ঈশান একঝলক বারান্দায় তাকায়। তারপর মেয়ের হাত ধরে চলে যায়। বিশমিনিট পর সে রুমে এসে দেখে দিবা এখনও বারান্দা থেকে বের হয়নি৷ নিজেই বলেছিল ডিভোর্সের কথা, তাহলে এখন এতো দুঃখবিলাস কেন? ঈশান বারান্দায় গিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়।

দিবা উল্টে পড়ে আছে মেঝেতে। সম্ভবত মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। শিট, ওর শরীর আগে থেকেই দূর্বল। তার উপর মানসিক চাপে এই অবস্থা… ঈশান কেন খেয়াল করেনি? নিজের গালেই চ’ড় মারতে ইচ্ছে হয়। দিবাকে পাজাকোলায় তুলে দ্রুত নিয়ে আসে রুমে।

হৃৎপিন্ড কাঁপছে ঈশানের, বুক জুড়ে সুক্ষ্ম ব্যথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। সে দিবার হাতের পালস চেক করে, নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখে নিঃশ্বাস আছে কি-না তারপর মাথায় চেক করে দেখে কোনো আঘাত লেগেছে কি-না!

দ্রুত বেডসাইড টেবিল থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে একটা তোয়ালেতে ভিজিয়ে দিবার কপালে ছোয়ায়। গালে পানি ছিটাতে ছিটাতে বলে,” দিবা, প্লিজ চোখ খোলো। আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং!”

দিবার হাত ধরে মালিশ করতে থাকে সে। তারপর হঠাৎ উঠে মোবাইল নিয়ে রিসিপশনে কল করে,” মাই ওয়াইফ জাস্ট ফেইন্টেড। আই নিড আ ডক্টর ইমিডিয়েটলি ইন পেন্টহাউজ ফিফটি বি!”

দিবা চোখ খুলে দেখতে পায় তার সামনে একজন মহিলা ডাক্তার বসে আছে। পাশেই সটান দাঁড়িয়ে ঈশান, তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি দিবার মুখে নিবদ্ধ। সে ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করে, ডাক্তার লিলি আলতো করে দিবার হাত ধরে বলেন,” রিল্যাক্স, তোমার শরীর এখনও অনেক দূর্বল। শুয়ে থাকো।”

দিবার একটু আগের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে ঈশানের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ডক্টর লিলি মৃদু হেসে বলেন,” চিন্তার কিছু নেই মিস্টার ঈশান, শী ইজ টোটালি ফাইন।”

ঈশান স্বস্তিভরা কণ্ঠে বলে,” থ্যাংক গড, ওর দূর্বলতা কাটাতে কোনো মেডিসিন সাজেশন আছে কিংবা খাবারে কোনো পরিবর্তন?”

ডক্টর লিলির ঠোঁট দু’টো প্রসারিত হয় হাসি। মিষ্টি করে তিনি একবার দিবার দিকে তাকিয়ে বলেন,” আপাতত ও যা খেতে চায়, সেটাই এনে দিন। এমন সময় বার-বার আসে না।”

ঈশান আর দিবা দু’জনেই ডাক্তারের কথার শুনে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ঈশান কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,” মানে?”

” মানে আমি ধারণা করছি, শী ইজ প্রেগন্যান্ট!”

দিবার চোখ দু’টো বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। ঈশান প্রায় হতবিহ্বল। দিবা আহত দৃষ্টিতে একবার ঈশানকে তো আরেকবার ডক্টর লিলিকে দেখতে থাকে। ঈশান ক্ষীপ্ত মেজাজে বলে,” কি আজে-বাজে কথা বলছেন?”

ডক্টর শ্রাগ করে বলেন,” আজে-বাজে কথা কেন হবে? সিম্পটমস দেখে তো আমার তাই মনে হচ্ছে। মাথা ঘোরা, শরীর দূর্বল, বমি বমি ভাব! এসব লক্ষণ দেখে স্বাভাবিকভাবে এটাই মনে হচ্ছে। কেনো আপনারা কি খুশি হোননি?”

ঈশান আঁড়চোখে দিবার আড়ষ্ট মুখটা দেখে। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে আছে সে। মুখটা রক্তশূন্য। ঈশান রুক্ষ গলায় বলে,” উঠুন আপনি, বাকিটা আমি বুঝে নিবো। আপনাকে আর প্রয়োজন নেই।”

” আরে, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন মিস্টার আহসান? একবার টেস্ট করে নিলেই তো ডাউট ক্লিয়ার হয়ে যায়। আমার কাছে প্রেগন্যান্সি কীট আছে। সত্যি হোক আর না হোক, টেস্ট করাতে নিশ্চয়ই কোনো প্রবলেম নেই।”

দিবার ঠোঁট দু’টো কাঁপছে। একহাতে চোখ ঢেকে ফেলে সে। ঈশান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,” আমি টেস্ট করাবো না। আপনি উঠুন। গেট আউট।”

সে রূঢ় ভঙ্গিতে ডক্টর লিলিকে ঠেলে বের করে দেয় পেন্টহাউজ থেকে। তাদের এমন অনভিপ্রেত আচরণে লিলি যারপরনাই বিব্রত হোন। ঈশান ডোর লক করে এসে রুমে ঢুকে দেখে দিবা দুইহাত মুখে চেপে ফুপিয়ে কাঁদছে। তার ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া পিঠটা কাঁপছে তিরতির করে। ঈশানের কানে বড্ড করুণ শোনায় সেই কান্নার শব্দ।

সে অপরাধ ভরা স্বরে বলে,” আ’ম স্যরি।”

দিবা কান্না মাখা গলায় বলে,” আপনি কেনো স্যরি বলছেন? স্যরি তো আমার বলার কথা ঈশান! আমি কখনও আপনাকে গুডনিউজ দিতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমার নেই। আ’ম স্যরি, স্যরি, স্যরি…”

এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলতে থাকে দিবা। ঈশান বিছানার কাছে গিয়ে তার পাশে বসে। তার মাথাটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে, ছোট্ট চুমু দিয়ে বলে,” কিচ্ছু হয়নি। আমার লাগবে না কোনো গুডনিউজ।”

” আমার এই জীবন ব্যর্থ! কখনও আপনাকে একটা সন্তান দিতে পারব না। আমার খুব আফসোস হয় ঈশান।আপনার সন্তান গর্ভে নিতে না পারার এই আফসোস আমার আজন্মে মিটবে না!”

দিবা শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। ঈশান তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরে বলে,” চুপ, চুপ, কামডাউন! যেখানে আমার এই নিয়ে কোনো আফসোস নেই সেখানে তুমি কেনো করছো? এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। ”

দিবা অশ্রুভরা র’ক্তিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,” এক কাজ করুন, আপনি আমাকে ডিভোর্সই দিয়ে দিন প্লিজ। নয়তো একদিন আপনারও এই আফসোস হবে। আর আমি সেটা চাই না। আপনার চোখে নিজের অবহেলা আমি সহ্য করতে পারব না।”

ঈশান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে খুব কষ্টে সংবরণ করে বলে,” উইল ইউ স্টপ টকিং ননসেন্স? দিবা আমার পেশেন্স হারিয়ে গেলে কিন্তু সত্যি খুব খারাপ হবে। ”

দিবা চোখের জল মুছে নিশ্চুপ হয়ে যায়। ঈশান এবার বেডসাইডের টেবিল থেকে খামটা নিয়ে দিবার দিকে বাড়িয়ে বলে,” এটা নাও, খুলে দেখো একবার। কথায় কথায় আমাকে ভুল বোঝা তো তোমার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে দিন দিন।”

দিবা হাত বাড়িয়ে খামটা ধরে। এখনও এই কাগজে তার চোখের অশ্রু মিশে আছে। খামটা খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা সোনালী সুতোর কাজ করা প্রিন্টেড গোল্ডেন ইনভাইটেশন কার্ড। তাতে ঈশান আর দিবার নাম লেখা, তাদের বিয়ের তারিখ দেওয়া। ডেস্টিনেশন- প্যারিস। দ্যা সিটি অফ লভ। প্রিপেয়ার টু ফল ইন লভ এগেইন। মাঝে একটা আইফেল টাওয়ারের সিলুয়েট।

দিবা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,” কি এটা?”

ঈশান মুচকি হেসে দিবার হাতটা টেনে চুমু খেয়ে বলে,” সামনে আমাদের ম্যারেজ ডে। এইতো আর পাঁচমাস পঁচিশ দিন পর। প্যারিসে সেলিব্রেট হবে৷ ”

” হঠাৎ এসব কেনো?” দিবার চোখগুলো এতোবড় হয়ে যায়।

ঈশান বলে,” সেদিন না তুমিই বললে, তোমার এলাকার কোন প্রতিবেশীর তিনদিন তিনরাত ধরে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। তাই তোমারও স্বপ্ন খুব বড়-সড় আয়োজন করে বিয়ে করা? আমাদের বিয়েটা তো একটু বেশিই সাদামাটা হয়ে গেছিল….তাই ভাবছি একই দিনে আবার বিয়ে করব, নতুনভাবে, সবকিছু তোমার পছন্দে। যেভাবে তুমি চাও।”

দিবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে,” এসবের কি দরকার ছিল?”

ঈশান দৃঢ় গলায় বলে,” অবশ্যই দরকার ছিল। আমার একটা মাত্র বউ, তাও আবার অবুঝ। তার কোনো শখ আমি অপূর্ণ রাখি না!”

দিবার চোখ আবার ভিজে আসে। ঈশান বলে,” কান্না না, এখন থেকে শুধু হাসি। আর কি কি অপূর্ণ শখ আছে বলো। সবকিছু পূরণ করার দায়িত্ব ঈশান আহসানের।”

দিবা চট করে ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সে ভাঙা কণ্ঠে বলে,” আমাকে এতো ভালোবাসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ঈশান আহসান।”

ঈশান তাকে দুইহাতে আগলে নিয়ে গভীর স্বরে বলে,” আমার জীবনে আসার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ দিবা রহমান।”

দিবা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার চোখের তপ্ত অশ্রুতে ঈশানের টি-শার্ট ভিজে যেতে থাকে। তারা এভাবেই একে-অপরকে ধরে বসে থেকে অনেকটা সময় পার করে দেয়। হঠাৎ দিবা বলে,” একটা প্রশ্ন করব?”

” করো।”

” আগে বলুন রাগ করবেন না।”

” গ্যারান্টি দিতে পারছি না। শুনি আগে!”

দিবা ইতস্তত করে জানতে চায়,” আপনি শুধু শুধু রাফিনকে মেরে ওভাবে এক্সিডেন্টের নাটকটা কেনো সাজালেন? মানে এসবের তো কোনো দরকার ছিল না। ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেই শিক্ষা হয়ে যেতো।”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আমি ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করিনি ডিভা কুইন। আমার মনের শান্তির জন্য করেছি। এতোদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ মেটানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ, লোভ সামলাতে পারিনি।”

দিবা চোখ তুলে তাকায় অবাক হয়ে। সে ভাবতে পারছে না, ঈশান রাফিনকে এতো জেলাস করতো! জেলাসি ব্যাপারটা তাহলে শুধু মেয়েদের জন্য না! ছেলেদের মধ্যেও আছে। দিবা ভ্রু কুঁচকে বলে,” আপনি না হয় রাফিনকে মেরে রাগ মিটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমি কি করব বলুন? রোদেলা আপুকে তো মা’রতেও পারব না। বয়সে আমার এতোবড় হয়।”

ঈশান শব্দ করে হেসে উঠে দিবার কথা শুনে। দিবাও হেসে পুনরায় ঈশানের বুকে মুখ গোজে। একটা অসীম স্বস্তিতে ভরা মিষ্টিরাত কেটে যায় তাদের। ভোরে দিবা ঘুম ভেঙে দেখে, সামনে রোজা! তার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। শেষরাতে সে নিজেই রোজাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। আর ঈশান, ঠিক তার পেছনে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মুখ গুজে ঘুমাচ্ছে। দুইপাশ থেকে বাবা-মেয়ের এমন আগ্রাসী চাপে সে একটু নড়তেও পারছে না। বুক ভরে একটা লম্বা শ্বাস নেয় দিবা। নিজের অপূর্ণ নারীত্বের এই জীবনটা খুব পরিপূর্ণ মনে হয়।

চলবে