#শর্তসাপেক্ষে
পর্ব অন্তিম পর্ব ( ১ম ভাগ)
Sidratul Muntaz
জ্যামের কারণে বাড়ি ফিরতে প্রায় দেড়ঘণ্টার মতো লেগে যায়। যেখানে টিএসসি থেকে বসুন্ধরার রাস্তা মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের! দারোয়ান মেইন গেইট খুলে দিবাকে সালাম দেয়। সে সালামের উত্তর দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে এলিভেটরে উঠে যায়। বেল চাপতেই ঈশান দরজা খুলে হাসিমুখে তাকায়।
দিবা চট করে তার গলা জড়িয়ে ধরে, পা দু’টো ভূমি থেকে প্রায় দশ ইঞ্চি উপরে উঠে যায়। ঈশান হালকা হেসে বলে,” উপরে চলো। একটা জিনিস দেখাবো।”
” কি জিনিস? রোজা ঘুমাচ্ছে?”
” হুম৷ ওকে শুয়িয়ে এসেছি।”
” আমি আগে ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে আসি?”
” আপাতত কাউচে রাখো। পরে।”
এই কথা বলেই দিবাকে পাজাকোলায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলিভেটরে উঠে যায় ঈশান। দিবা মুখ টিপে হেসে বলে,” কোলে করেই নিয়ে যেতে হবে?”
” হ্যাঁ হবে। এখন চোখ বন্ধ করো।”
ইলোরা তখন ডাইনিংরুমেই ছিলেন। টেবিলে বসে ফল খাচ্ছিলেন। এই অবস্থা দেখে রোকসানাকে জিজ্ঞেস করে,” কি হয়েছে এদের? কোথায় যায়?”
রোকসানা মুখ বাঁকা করে বলে,” ছাদে!”
দিবাদের ছাদটা অনেক সুন্দর! মেঝে উচ্চমানের ফ্লোর টাইলসে মোড়ানো। পাশে ঝুঁকি রোধ করার জন্য গ্লাস রেলিং লাগানো। শহরের ব্যস্ততম সড়ক আর গাড়ির নিরবচ্ছিন্ন ছুটে চলা স্পষ্ট নজরে পড়ে। ছাদের একপাশে ছোট্ট রুফটপ গার্ডেন। পটারিতে ল্যাভেন্ডার, ক্যাকটাস, মিন্ট আর তুলসী। কিছু গাছের পেছনে এলইডি লাইট বসানো যা সন্ধ্যার পর জ্বলে উঠে নরম আলোয়। এই জায়গাটা যেন একটুকরো স্বস্তি!
ছাদের ভেতরেই আরেকটি কাঁচঘেরা ঘর আছে যেখানে ঈশান খুব যত্ন করে কেমিস্ট্রি ল্যাব সাজিয়েছে দিবার জন্য! দিবা সেখানে প্রবেশ করে খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। এখান থেকেই রাতের আকাশ খুব সুন্দর নজরে পড়ে৷ উপরে ফেইরি লাইটস, ঝুলন্ত ফ্লাস্ক আর টিউব সাজানো। যেনো কোনো রূপকথার পরিবেশ।
ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর একটা স্টেইনলেস স্টিলের ল্যাব টেবিল যার উপর দিবার নামের একটা মেটাল প্লেট বসানো,” Diva’s Dream Lab.”
দিবা হেসে উঠে শব্দ করে। চঞ্চল পায়ে পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। ঈশান হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণেই। সে চায় দিবা ব্যস্ত থাকুক, যেকোনো কাজে সবসময় নিজেকে ডুবিয়ে রাখুক৷ এতে অন্তত তার মাথায় আজে-বাজে চিন্তাগুলো আর আসবে না। কিন্তু ঈশান? সে কিভাবে মুক্তি পাবে ওই ভ’য়ানক স্বপ্ন থেকে? রাত হলেই মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে আসে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে কল্পনার সেই নৃশংস দৃশ্য!
” এই, আপনি এগুলো কোথায় পেয়েছেন? কবে করেছেন এইসব? বলুন না!”
দিবার ডাকে ঘোর কাটে ঈশানের। হেসে বলে,” ম্যাজিক!”
দিবা কাছে গিয়ে ঈশানের গাল দু’টো টেনে দেয়। হৃষ্টচিত্তে বলে,” আ’ম সো হ্যাপি। আপনি একটা কিউটেস্ট। আই লভ ইউ।”
ইশান দিবার কোমর চেপে ধরে ভারী গম্ভীর স্বরে আওড়ায়,” শুধু লভ ইউ?”
দিবা লাজুক হেসে বলে,” বাকিটা রাতে।”
ঈশান আরও তীব্র ভাবে চেপে ধরে বলে,” রাতে কেন? এখানে তো কেউ নেই।”
” উফ, আপনি না একটা যা-তা! আমি কেবল ভার্সিটি থেকে এসেছি। টায়ার্ড অনেক।”
ঈশান দিবাকে ঘুরিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে বলে,” এখনি দূর করে দিচ্ছি টায়ার্ডনেস।”
দিবা শক্ত মুষ্টিতে চেপে ধরে ঈশানের টি-শার্ট। চোখ বুজে আসে প্রগাঢ় অনুভূতির জোয়ারে।
শেষমেষ বাসা ছাড়তে হয়নি রাফিনদের। কিভাবে যেনো সে আরেকটা চাকরি যোগাড় করে ফেলেছে। কিন্তু এই বিষয়ে বাসায় কিছুই জানায়নি। ঘর ভাড়ার টাকা সে নিজেই বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে দিয়ে এসেছে। কাল সন্ধ্যায় হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ফিরেছে। শাহনাজ বেগমের মাসে কম হলেও পাঁচহাজার টাকার ঔষধ লাগে। সব নিয়ে এসেছে রাফিন। রায়াকে একহাজার টাকা হাতখরচও দিয়েছে। সে তো ভীষণ খুশি।
আজ সকালেই রায়া এবং শাহনাজ বেগম রিতুর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে কিংবা সকালেও ফিরতে পারেন। অন্তরা এসে হাজির হয় বিকাল চারটায়। রাফিন তখন বাসায় একা, ঘুমাচ্ছিল। দরজা খুলে অন্তরাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়েই একটা হাই তুলে সে।
রাফিনের গা সম্পূর্ণ উদোম৷ শুধু নিচে একটা কালো জিন্স প্যান্ট। লজ্জায় আড়ষ্ট অন্তরা মাথা নিচু করে বলে,” কেমন আছেন স্যার?”
“ভালো।”
রাফিন অন্তরাকে ভেতরে প্রবেশের জন্য ইশারা করে রান্নাঘরে চলে আসে। ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে খেতে খেতে দায়সারা ভঙ্গিতে বলে,” রায়া তো বাসায় নেই। কেনো এসেছো?”
অন্তরা চারদিকে চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,” বাসায় কেউ নেই?”
রাফিন শান্ত চোখে তাকিয়ে জবাব দেয়,” না।”
অন্তরা কাঁধ থেকে ভারী ব্যাগটা নামিয়ে বলে,” সামনে এডমিশন টেস্ট। আমি ইন্টিগ্রেশনের কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার হেল্প লাগতো।”
” রুমে গিয়ে বসো। আমি আসছি।”
অন্তরা হাসিমুখে রাফিনের রুমে চলে আসে। চুপচাপ বিছানায় বসে৷ কিছুক্ষণ পর রাফিন ঢুকলে সে ব্যাগ থেকে বই-খাতা বের করতে করতে আঁড়চোখে তাকিয়ে শুধায়,” রায়া আর আন্টি কোথায় গেছে? কখন আসবে ওরা?”
” রিতু আপার শ্বশুরবাড়ি। মনে হয় আজ ফিরবে না।”
” ও, ঠিকাছে সমস্যা নেই। আমি তো আপনার কাছেই এসেছিলাম।”
রাফিন রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিতেই মৃদু চমকায় অন্তরা। বুকের ভেতর দামামা বাজতে থাকে। ঢোক গিলে হালকা আওয়াজে বলে,” স্যার, বাসায় তো কেউ নেই। তাহলে দরজা কেনো বন্ধ করলেন?”
রাফিন বিছানায় বসতে বসতে খুব রূঢ় স্বরে বলে,” এখনও আমাকে স্যার বলে কেনো ডাকছো? আমাদের সম্পর্ক অনেক দূর চলে গেছে। এখন না আমি তোমার টিচার, আর না তুমি আমার স্টুডেন্ট! কথা বোঝা গেছে?”
বলেই অন্তরার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে দুইবার আঙুল দিয়ে টোকা দেয় রাফিন। অন্তরার নিশ্বাস থেমে আসে। মাথা নুইয়ে ফেলে বলে,” আপনি তো আমার স্যার ছিলেন। এখন হঠাৎ করে নাম ধরে ডাকতে অস্বস্তি হয়।”
রাফিন আলতো করে অন্তরার হাতটা ধরে দুইহাতে মালিশ করতে করতে বলে,” নাম ধরে ডাকতে কে বলেছে? অন্যকিছু ডাকবে! জান, সোনা, বাবু, কতকিছুই তো বলা যায়।”
অন্তরা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, রাফিন স্যার এসব কথা বলছে? তিনি তো আগে এমন ছিলেন না। তাহলে হঠাৎ কি হলো? তাকে এমন ফ্যাল ফ্যাল করে বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসে রাফিন। আলতো করে তার নাকের ডগায় স্পর্শ করে বলে,” কি ভাবছো? আমার কথা শুনে লজ্জা লাগছে? এখন থেকে এসবই হবে। বিকজ ইউ আর মাই গার্লফ্রেন্ড নাউ।”
অন্তরার হৃৎপিন্ডটা কাঁপতে কাঁপতে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে এক্ষুণি। এইটুকু বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই রাফিন তাকে ঠেলে শুইয়ে দেয় বিছানায়। অন্তরা প্রায় ছটফট করে বলে,” আমার ভ’য় লাগছে!”
রাফিন তার ঠোঁটে আঙুল দাবিয়ে বলে,” শশশ! ভ’য়ের কি আছে? তুমি ভার্সিটিতে উঠলেই আমরা বিয়ে করব। সো চিল! জাস্ট কো-অপারেট।”
অন্তরা আর কিছু বলতে পারে না, তাকে থামিয়ে দেওয়া হয় খুব কৌশলে। তারপরের ঘটনাগুলো ঘটে খুব দ্রুত হয়। অন্তরা বাধা দেওয়ার সুযোগটুকুও পায় না, সে কিছু বুঝে উঠার আগেই সব হারিয়ে ফেলে।
সাইনবোর্ডে লাস্যময়ী রমণীর একটি ছবি। পাশে জ্বলজ্বল করছে বড় অক্ষরের ইংরেজিতে লেখা,”Hercanvas By Rodela.”
দিবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। গুলশানের এই এলাকাতেও যে রোদেলার শো-রুম আছে এটা সে জানতো না। এখানে সে এসেছিল নিজের একটা জরুরী কাজে। মেয়েদের জন্য কমদামী সানস্কিন বানানোর একটা এক্সপেরিমেন্ট করছে দিবা। সেজন্য তার লাগবে জিংক অক্সাইড আর কিছু এসেনশিয়াল ওয়েল। অনলাইনে একটা পেইজ দেখে সেই ঠিকানা অনুযায়ী এখানে এসেছে।
আজকে রোদেলার এই নতুন শো-রুমে গ্র্যান্ড ওপেনিং। সে বেশ জমকালো সাজ দিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। গায়ে সাদা-সোনালী অ্যাসিমেট্রিক সিল্ক গাউন, একপাশের কাঁধখোলা, ঝকঝকে চামড়া ঝিলিক দিচ্ছে রোদের আলোয়। কোমরে চিকন সোনালী বেল্ট যাতে ‘Hercanvas’ লেখাটির নিজস্ব সিগনেচার লোগো বসানো।
ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, মুখে ভারী মেকাপ। কানে ঝুলছে ডায়মন্ড রিং। শপিং শেষ করে বের হওয়ার সময় এই দৃশ্য দেখে আচম্বিত থমকে যায় দিবা। সবিস্ময়ে হা করে চেয়ে থেকে চিন্তা করে, রোদেলা আসলে ভীষণ সুন্দরী! মুহূর্তেই তার পুরো শরীরে একটা ঈর্ষার আগুন ধরে যায়।
” আরে, দিবা আপু? কেমন আছো?”
পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ স্বর শুনে চমকে তাকায় দিবা। অন্তরা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। গায়ে সবুজ টপস, কালো জিন্স। লম্বা চুলগুলো কাঁধের বিনুনী হয়ে দুলছে। গলায় স্লিং ব্যাগ।
দিবা হাসার চেষ্টা করে বলে,” ভালো, ভালো আছি! তোমার কি অবস্থা অন্তরা? আজ-কাল কি করছো?”
” এইতো ভালো! সেকেন্ড টাইম এডমিশন টেস্ট দিচ্ছি। পাবলিকে কোথাও না হলে প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে যাবো। দোয়া কোর আমার জন্য। তোমার কি অবস্থা বলো। নতুন সংসার কেমন কাটছে?”
” খুব, খুবই ভালো। একদিন এসো আমার বাসায়। আমি বসুন্ধরাতে থাকি। গল্প করব দু’জন মিলে।”
” নিশ্চয়ই আসবো আপু৷ তোমাকে এতোদিন পর দেখে অনেক ভালো লাগছে। তুমি অনেক সুন্দর হয়ে গেছো আগের চেয়ে।”
দিবা লজ্জা পেয়ে হেসে দেয়। তারপর একটু কৌতুহল নিয়ে বলে,” সেদিন আমি ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তোমাকে দেখলাম৷ রমনার সামনে। ভেবেছিলাম ডাকবো। কিন্তু তোমার সাথে কেউ ছিল।”
অন্তরা প্রথমে মনে করতে পারে না, কিন্তু যখন বুঝে, প্রচুর লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বলে,” হ্যাঁ রাফিন স্যার ছিল৷ অবশ্য এখন আর উনি আমার স্যার নেই। বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেছে! উনাকে আমি কত পছন্দ করতাম তুমি তো সেটা জানোই।”
দিবা আলতো করে অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” ওটা তোমার অল্পবয়সের আবেগ ছিল অন্তরা। অবশ্য এখনও তুমি ছোটোই আছো। তাই বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ো। তুমি অনেক ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। রাফিনের থেকেও অনেক ভালো ছেলে আসবে তোমার জীবনে।”
অন্তরার হাস্যোজ্জ্বল মুখ মলিনতায় ছেয়ে যায়। সে একটু অবাক হয়ে বলে,” তুমি এভাবে কেনো বলছো? রাফিন স্যার কি খারাপ?”
দিবা ঠোঁট উল্টে বলে,” খারাপ সেটা বলিনি। তবে খুব ভালোও না। তোমাকে আমি ছোটবোনের মতো দেখি, তাই একটু সতর্ক করলাম। ঠিকাছে, অল দ্যা বেস্ট। ভালো থেকো পিচ্চি। আসি।”
দিবা শপিংমল থেকে বের হয়ে যায়। অন্তরা দাঁড়িয়ে থাকে নিঃসঙ্গের মতো। মুহূর্তেই তার মনটা খুব বিষণ্ণ অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
দিবা যখন শপিংব্যাগ গুলো ডিকিতে রেখে গাড়িতে উঠবে, তখনি পেছন থেকে একটা মেয়ে এসে বলে,” এক্সকিউজ মি, আপনি কি দিবা ম্যাডাম?”
দিবা ভ্রু কুঁচকে বলে,” জ্বী?”
” আপনাকে রোদেলা ম্যাডাম ডাকছে।”
দিবা মেয়েটির ইশারাকৃত স্থানে তাকাতেই দেখে রুফটপে হাসিমুখে বসে আছে রোদেলা। তার আশেপাশে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। হাত নাড়িয়ে দিবাকে কাছে আসার ইশারা করে সে। দিবা একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে ড্রাইভারকে বলে,” হোসেন ভাই, একটু থাকুন। আমি আসছি।”
পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রোদেলা, এক পা পুরোপুরি দৃশ্যমান। এমন আপত্তিকর পোশাকে তাকে দেখে দিবার নিজেরই কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে। তাহলে ছেলেদের কি অবস্থা হয়? ভেবেই হতাশার শ্বাস ছাড়ে সে। রোদেলা মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলে,” বসো না দিবা। কেমন আছো বলো৷ তোমার আমেরিকার ট্রিপ কেমন কাটল? শুনলাম নাকি সুইসাইড এটেম্পট করেছিলে?”
মেয়েগুলো সব আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। ছাদে সবুজ কার্পেট বিছানো। মাঝে একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে রোদেলা। পাশেই আরেকটা আর্মচেয়ারে দিবাকে বসতে দেওয়া হয়েছে। সে রোদেলার এমন কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে চুপচাপ আর্ম চেয়ারটিতে বসে। তারপর চেহারায় মৃদু হাসির ঝলক নিয়ে বলে,” আমার ব্যাপারে সব খোঁজ-খবরই রাখো দেখছি৷ নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে।”
রোদেলা হেসে পাশের মেয়েটিকে ইশারা করে বলে,” ম্যাডামের জন্য ঠান্ডা জুস নিয়ে এসো৷ গরমে একদম ঘেমে গেছো। চব্বিশ ঘণ্টা এমন হিজাব মাথায় বেঁধে থাকো কিভাবে? অস্বস্তি হয় না?”
দিবা নিজের হিজাব হাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে বলে,” একদমই না। বরং আমি এতেই কমফোর্টেবল।”
” বিয়ের আগে তো তুমি হিজাব পরতে না৷ এখন ঈশানের জোরাজুরিতে পরো। কি আশ্চর্য, নিজের মতো ড্রেস চুজ করার স্বাধীনতাও নেই তোমার। খুব মায়া হয় দেখে।”
” আমার জন্য তোমার মায়া হয় শুনে ভালো লাগল। কিন্তু ড্রেসাপের মতো এমন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমি একটুও বদারড না বিশ্বাস করো। বদারড হওয়ার জন্য আরও অনেক বিষয় আছে দুনিয়াতে।”
একটা মেয়ে এসে দুই গ্লাস ঠান্ডা কোল্ড কফি রেখে যায়। রোদেলা একটা গ্লাসে স্ট্র ডুবিয়ে চুমুক দিয়ে বলে,” হুম। শুনলাম তো তোমার ঘটনা। কখনও মা হতে পারবে না। ইশ, কি আফসোসের বিষয়! শুনে আমি খুব খুব কষ্ট পেয়েছি ডিয়ার।”
দিবার মুখ থেকে আত্মবিশ্বাসের ছাপটা বিলীন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেখানে প্রবেশ করে একরাশ অস্বস্তি। বিব্রত চোখে আশেপাশে একবার তাকায় সে৷ না, কেউ তাদের কথা শুনছে না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। দিবা মাথা নিচু করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। রোদেলা এই বিষয়টা কিভাবে জানল? সে আর ঈশান ছাড়া তো এটা কারো জানার কথা নয়। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে, রাফিন?
আচমকা দিবার হাতের উপর নিজের হাতটা রাখে রোদেলা। ঝুঁকে এসে বলে,” ডন্ট বি আপসেট। আমি জানি এটা খুব সেন্সিটিভ ইস্যু। আমি একদমই তোমাকে হার্ট করার জন্য কথাটা বলিনি।”
দিবা ধাতস্থ হয়ে বলে,” এতো অল্পতে আমি হার্ট হই না। ডন্ট ওরি।”
তারপর একটা মসৃণভাবে হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলে সে। রোদেলা টিপ্পনী কাটতে বলে,” কিন্তু তোমার থেকেও আমার ঈশানের জন্য বেশি আফসোস হচ্ছে। রোজার জন্মের পর ওর খুব শখ ছিল একটা ছেলে বাচ্চার। আমি আমার ক্যারিয়ারের জন্য সেকেন্ড বেবি নিতে রাজি ছিলাম না৷ কিন্তু ঈশান খুব চাইতো। প্রায়ই আমাকে বলতো বাচ্চাদের ফুটবল টিম বানাবে। হি ওয়াজ সো অবসেসড উইদ চাইল্ড। অথচ দেখো, তার ভাগ্যেই তোমার মতো একজন…”
দিবা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” আমি যাচ্ছি।”
” আরে, বসো প্লিজ। তুমি মাইন্ড করলে নাকি? দেখো আমি কিন্তু কথাগুলো তোমাকে বোঝানোর জন্য বলছি। তোমাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদ্দেশ্য না৷ ট্রাস্ট মি! তুমি একবার জেনুইনলি চিন্তা করে দেখো দিবা! এখন হয়তো ঈশান তোমার রূপের মোহে আটকে আছে। নতুন নতুন সবকিছুই ভালো লাগে। কিন্তু চার-পাঁচবছর পর কি হবে? আস্তে আস্তে ও কি বোরড হয়ে যাবে না? তখন যে তোমাকে ছেড়ে অন্যকারো প্রতি এট্রাকশন ফীল করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? পুরুষ মানুষের মন বলে কথা!”
দিবা আর্মচেয়ার থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা তুলেই চুপচাপ বের হয়ে যায়। ইচ্ছে করলেই সে রোদেলার বলা প্রতিটি কথার দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারতো৷ কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? রোদেলা যা বলছে তার কিছুই তো মিথ্যে নয়। এই একটা ভ’য় নিয়েই তো প্রতি মুহূর্তে ধুঁকে ধুঁকে ম’রে সে। সেই গভীর ক্ষততেই যেন রোদেলা আজ শুধু নূন ছিটিয়ে দিয়েছে।
সময়টা সন্ধ্যা, একটি গুমোট সস্তা আবাসিক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। হোটেল ব্লু রিভার। নামটা শুনে মোটামুটি সম্মানজনক মনে হলেও ভিতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, জায়গাটা কেমন ছাপোষা। দেয়ালের রঙ ধূসর, করিডোরে হালকা আলো জ্বলছে-নিভছে। ঘরের দরজাগুলোর রঙ যেন প্রায় খসে পড়েছে। বেশিরভাগই অস্থায়ী দম্পতিরা গোপন রাত্রিযাপনের জন্য ভাড়া নেয় এই হোটেল।
রাফিন একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দেয়। অন্তরা একটু পিছিয়ে আসে। রাফিন বলে,” কি ব্যাপার? তুমি আসবে না?”
অন্তরা কাঁপা কণ্ঠে বলে,” আমার ভ’য় লাগছে।”
রাফিন খুব বিরক্ত স্বরে বলে,” কথায় কথায় এতো ভ’য় পাওয়ার কি আছে বুঝি না বা’ল। চলো ভেতরে চলো।”
একপ্রকার টেনেই অন্তরাকে ভেতরে প্রবেশ করায় রাফিন। সে দরজা বন্ধ করতেই অন্তরা কান্না মাখা স্বরে বলে,” এটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি। এগুলো অন্যায়।”
রাফিন তার দিকে এগিয়ে গালে হাত রাখে। সপ্রতিভ স্বরে বলে,” অন্যায়ের কি আছে? বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে? হবে তো! তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
অন্তরার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে অনুরোধ করে বলে,” রাফিন প্লিজ, আমার এগুলো ভালো লাগছে না!”
” আস্তে আস্তে ভালো লাগবে। আমি ভালো লাগাবো।”
তার চোখের জলের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই তাকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রাফিন। একহাতে নিজের শার্ট খুলতে খুলতে এগিয়ে আসে। অন্তরার শরীর কাঁপছে থরথর করে। সে বাধা দিতে চাইলেও পারে না বেশিক্ষণ। দানবীয় স্পর্শের কাছে হার মানতে হয় শেষমেষ। তার শুধু মনে পড়ে দিবার কথাগুলো। সে নিশ্চয়ই ভুল করছে এভাবে রাফিনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে৷ সাংঘাতিক ভুল করছে!
গায়ে চাদর জড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন কাঁদতে থাকে অন্তরা। একটু আগের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি তার মন। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল ও গলা বেয়ে। একটু দূরেই রাফিন খালিগায়ে বিছানার প্রান্তে বসে সিগারেট টানছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। হঠাৎ সে বিরক্ত গলায় বলে,” ধূর, ফ্যাচফ্যাচ বন্ধ করো প্লিজ। ড্রেস পরো চুপচাপ। তোমাকে তোমার বাসায় রেখে আসবো।”
অন্তরা কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করে,” তার আগে বলো আমাদের বিয়ে কবে হবে?”
” বিয়ে মানে?”
” তুমি না বলেছো ভার্সিটি উঠলেই আমাকে বিয়ে করব? আমি অপেক্ষা করতে পারব না। এই সপ্তাহেই বিয়ে করতে চাই।”
রাফিন একহাতে দুই চোখ চুলকে নিয়ে বলে,” এই সপ্তাহে সম্ভব না।”
” কেন? কি সমস্যা? তুমি তো চাকরি করছোই। আর আন্টিও তোমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে। আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে বলো। বাবা-মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।”
রাফিন কটমট করে বলে,” বেশি বুঝো না? আমি বলেছি এখন সম্ভব না মানে সম্ভব না। আর একটাও কথা শুনতে চাই না। আমি বাইরে যাচ্ছি, তুমি রেডি হয়ে আসো চুপচাপ।”
অন্তরা উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করে,” তোমার সমস্যাটা কি? তুমি কি আদৌ আমাকে বিয়ে করতে চাও নাকি চাও না?ডিরেক্ট বলে দাও সেটা!”
রাফিন কোনো জবাব না দিয়েই রুম থেকে বের হয়ে যায়। একটু পর অন্তরা পোশাক পরে বের হতেই রাফিন একটা উবার ডেকে তাকে গাড়িতে তুলে দেয়। জানালার কাছে এসে নিষ্ঠুর গলায় ফিসফিস করে বলে,” ভুলে যাও সব। এটাই আমাদের লাস্ট মিটিং ছিল। আর কখনোই আমাকে দেখবে না। চাকরি সূত্রে কানাডা চলে যাচ্ছি আমি।”
অন্তরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। রাফিন আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ রিকশায় উঠে যায়। তারপর, তারপর আর কখনোই সে অন্তরার সাথে যোগাযোগ করে না।
ঘড়িতে রাত আটটা বাজে৷ একটু পরেই ঈশান চলে আসবে৷ দিবা রান্না করছে, কিন্তু রান্নায় তার মনোযোগ নেই। সে ভাবছে অন্যকিছু। রোদেলার কথাগুলো এখনও মাথায় ঘূর্পাক খাচ্ছে। সে বলেছিল ঈশান বাচ্চাদের প্রতি অবসেসড। কিন্তু ঈশান তো বলেছে সে শুধু রোজাকে নিয়েই সন্তুষ্ট। আর কোনো বাচ্চা চাই না তার। কথাটা কি শুধুই দিবাকে খুশি করার জন্য?
এসব চিন্তা তাকে পাগল করে তুলছে। তাছাড়া আজ-কাল ঈশানের আচরণেও কেমন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে, মনে হয় যেনো দিবার থেকে কিছু লুকাচ্ছে!
” ভাবী, কি করেন? তরকারী তো পুইড়া যাইতাছে!”
হাফসার তীব্র কণ্ঠের আওয়াজে ঘোর কাটে দিবার। দ্রুত খুন্তি দিয়ে সবজি নেড়ে দেয়। বাটারে সবজি সর্টে করছিল সে। ঈশান রাতে খুবই হালকা খাবার খায়। শুধু ভেজিটেবল আর সিদ্ধ করা চিকেন ব্রেস্ট। দিবা তার খাবারটা তৈরী করে একপাশে রেখেই ফ্রেশ হতে যায়। তখন দেখে ঈশান ইতোমধ্যে ঘরে চলে এসেছে। ফ্রেশও হয়েছে, চুল থেকে টপটপ পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ গায়ে কালো ট্রাউজার- টিশার্ট। ইজিচেয়ারে বসে ল্যাপটপে খুব মনোযোগের সাথে কি যেন করছে।
দিবা একটু গলা খাকারি দিতেই চোখ তুলে তাকায় ঈশান, একটু মুচকি হাসে।
” আপনি কখন এলেন?”
” এইতো, হাফ এন আওয়ার!”
” আমি জানিই না।”
” ইলোরা আন্টি বলল তুমি রান্নাঘরে কাজ করছো। তাই আর ডাকিনি।”
দিবা আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ এগিয়ে যায় ক্লজেটের কাছে। আগে ঈশান অফিস থেকে ফিরেই সবার আগে দিবার খোঁজ করতো। আর এখন, ঘরে এসে কি সুন্দর বসে আছে! একবার ডাকেনি পর্যন্ত। ভালোবাসা এতো দ্রুত কমে যাচ্ছে? অবশ্য এটাই তো হওয়ার ছিল। আরও কমবে। ধীরে ধীরে দিবাকে এসবেই অভ্যস্ত হতে হবে। সে জামা-কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকছিল গোসলের উদ্দেশ্যে। ঈশান তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,” কি হয়েছে তোমার? মনখারাপ?”
দিবা গম্ভীর স্বরে বলে,” কিছু হয়নি। ছাড়ুন, গোসলে যাবো।”
ঈশান তার গালে হাত রেখে বলে,” আরে দাঁড়াও একটু। তোমার সাথে দেখা করতে যাইনি বলে রাগ করেছো? রান্নাঘরে হাফসা আর রোকসানা ছিল, পাশেই ডাইনিংটেবিলে বাবা ডিনার করছিল। ওই অবস্থায় তোমাকে ডাকলে সবাই কি ভাবতো?”
দিবা কিছু না বলে চুপ থাকে। ঈশান তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। দিবা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,” একটা প্রশ্ন করব?”
” করো!”
” যদি বিয়ের আগে আমি আপনাকে আমার সত্যিটা জানাতাম, তাহলে কি হতো? আমাকে বিয়ে করতেন? বি অনেস্ট, একদম সত্যি কথা বলবেন।”
ঈশান হকচকিয়ে যায় একটু। হাসার চেষ্টা করে বলে,” এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”
” উত্তর দিন!”
” আমি জানি না।”
ঈশান ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারপর দিবাকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই দিবা তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়েই বাথরুমে ঢুকে যায়। শাওয়ার ছেড়ে টাইলসের মেঝেতে বসে কাঁদতে শুরু করে মাথায় হাত চেপে।
মাঝরাত। ঘরজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিবা বিছানা হাতড়েও ঈশানকে কোথাও খুঁজে পায় না। সাবধানে সাইড টেবিলের ল্যাম্পলাইটটা জ্বেলে চারপাশে তাকায়। ঈশান কোথাও নেই! হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেছে দিবার। ঈশানকে পাশে না পেয়ে বিচলিত হয়ে ওঠে মন। সে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে খোঁজে, সেখানে নেই ঈশান। এবার বারান্দায় যেতেই দেখে একটু কোণায় রকিং চেয়ারে বসে কফি হাতে ল্যাপটপে কি যেন করছে। গভীর মনোযোগে। সে কি প্রতিদিন এমন করে নাকি আজকেই প্রথম? এতোরাতে ল্যাপ্টপে কি করছে? যদি অফিসের কোনো জরুরী কাজ হয় তাহলে রুমে বসেই করতে পারতো। বারান্দায় কেনো আসবে?
দিবার ভগ্নহৃদয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। ধীরপায়ে ঈশানের দিকে এগিয়ে যায় সে।
” এখানে কি করছেন?” ঠান্ডা গলায় প্রশ্নটা করে দিবা।
ঈশান চমকে তাকায়। তারপর তড়িঘড়ি করে ল্যাপটপ গুটিয়ে ফেলে। সে আবিদ সাইফুলের প্রোফাইল চেক করছিল। লোকটির ব্যাপারে সমস্ত ইনফরমেশন যোগাড় হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই ঈশান তাকে নিজের অফিসে ডাকবে। কিন্তু দিবাকে এসবের কিছু জানানো যাবে না৷ ঈশান চায় না সে নিজের অতীতের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে কষ্ট পাক। তার শুকিয়ে যাওয়া ঘা পুনরায় জীবন্ত হোক।
তাই ল্যাপটপের স্ক্রিন বন্ধ করে সে একটু হাসার চেষ্টা করে। শান্ত গলায় বলে,”তেমন কিছু না। অফিসের কয়েকটা জরুরী ফাইল চেক করছিলাম।”
দিবার মনে তখন ঘোর সন্দেহ। ঈশানের তড়িঘড়ি করে ল্যাপটপ গুটিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। সে ফট করে ঈশানের কোলে বসে ল্যাপটপ খোলার চেষ্টা করে বলে,” দেখি তো আপনার জরুরী ফাইল।”
ঈশান তাকে থামানোর জন্য শক্ত হাতে কোমর চেপে ধরে। ঝট করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গলায় মুখ গুজে দেয়। নেশাক্ত কণ্ঠে বলে,” আই লভ দিস স্মেল। আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না৷ চলো রুমে যাই প্লিজ।”
” আমি যাবো না। আমি দেখব আপনি কি করছিলেন।”
” এটা দেখার কি আছে দিবা? অযথা জেদ করছো।”
” ও, এখন আমার জেদ আপনার অযথা মনে হচ্ছে? কয়দিন পরে তো আমার সবকিছুই অযথা মনে হবে। একসময় হয়তো বলবেন, তোমাকে অযথা বিয়ে না করলেই ভালো হতো।”
ঈশান হতবাক হয়ে যায় তার এমন কথায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,” তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি? দেখি!”
দিবার কপালে, গলায় হাত রেখে জ্বর মাপার চেষ্টা করে ঈশান। দিবা আরও বিরক্ত হয়ে বলে,” উফ ছাড়ুন।”
সে উঠে আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ভেতরে চলে যায়। ঈশান ল্যাপটপ গুছিয়ে নিজেও যায় রুমে। বিছানার এক প্রান্তে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে দিবা। ঈশান তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। দিবা সরিয়ে দেয়। ঈশান তার অভিমান ভাঙাতে শক্ত করে টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। উষ্ণ চুমুর স্পর্শে ভরিয়ে দেয় সারা শরীর। দিবা রেগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,” উফ, আমার অসহ্য লাগছে! ছাড়ুন।”
ঈশান অবাক হয়ে বলে,” হোয়াটস রং উইদ ইউ?”
” আপনি ল্যাপটপে কি করছিলেন সেটা আগে বলুন। কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট?”
ঈশান নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,” ছি দিবা! আর ইউ আউট অফ মাইন্ড?”
দিবা উঠে বসে বলে,” ঠিকই তো বলছি। আমাকে কি আপনার এতো অবুঝ মনে হয়? অফিসের জরুরী কাজ হলে ঘরে বসেই করতে পারতেন। বারান্দায় কেনো গিয়েছেন? আবার আমাকে দেখামাত্র এমন রিয়েকশন দিলেন, যেনো চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে!”
ঈশান চোয়াল শক্ত করে তাকায়। মুখ গম্ভীর করে বলে,” তুমি আমাকে এতো সন্দেহ কেনো করো আমি সত্যি জানি না। তোমার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো ক্যারেক্টারলেস! লস এঞ্জেলসেও এই সেইম কারণে তুমি সুইসাইড পর্যন্ত করতে গেছিলে। অথচ তখনও আমি কিছুই করিনি। তুমি নিজের মনেই এসব ভেবে নিয়েছিলে। বার-বার কিন্তু আমি তোমার এসব ছেলেমানুষী সহ্য করব না দিবা। ইনাফ ইজ ইনাফ! সবকিছুর একটা লিমিট আছে।”
” তাহলে কি করবেন? ডিভোর্স দিবেন আমাকে? এটাই তো চাইছেন আপনি! তাহলে দেরি কেনো এখনি দিন!”
ঈশান প্রচন্ড রাগে সাইড টেবিল থেকে ল্যাম্পটা টেনে ফেলে দেয়। ভয়ে কেঁপে উঠে দিবা। ঈশান হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আর দিবা হাঁটুতে মুখ গুজে কাঁদতে শুরু করে।
চলবে
#শর্তসাপেক্ষে
অন্তিম পর্ব ( শেষভাগ)
Sidratul Muntaz
তখন দুপুর তিনটা। বনানীর অভিজাত এক বিল্ডিংয়ে রোদেলার শোরুমের পেছনে তার ব্যক্তিগত কাচঘেরা অফিস। ঘরে ছড়িয়ে আছে জামা-কাপড়। টেবিলে সাজানো কসমেটিক্স। সাদা সিল্ক টপস গায়ে বসে আছে রোদেলা। মুখে মেকাপের প্রলেপ, ঠোঁটে চকচকে লিপগ্লস। একহাতে ফোন, অন্যহাতে কফির মগ।
হঠাৎ দরজা নড়ে ওঠে, ধীরে ধীরে টোকা পড়ে। রোদেলা একটু বিরক্ত স্বরে বলে,” কে? ভেতরে এসো।”
দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে ঈশান। গায়ে কফি রঙের শার্ট, গলার কাছে সানগ্লাস ঝুলছে। চোখে স্পষ্ট ক্রোধের আগুন।
রোদেলা চমকে উঠে। পরপর হেসে উঠে বলে,” আরে ঈশান, তুমি এখানে? কি সৌভাগ্য! প্লিজ বসো।”
ঈশান সামনের চেয়ারটা টেনে বসে। খুব মেপে মেপে বলে,” মাত্র দশমিনিট সময় চাই। পসিবল?”
রোদেলা হেসে উঠে বলে, “তোমার জন্য তো ঘন্টাও দিতে পারি। বসো, কফি আনাবো নাকি চা?”
ঈশান শান্ত এবং গম্ভীর কণ্ঠে বলে,” কিছু দরকার নেই। আমি আজ শুধু একটা জিনিস বোঝাতে এসেছি, ম্যানার্স। যেটা তুমি হারিয়ে ফেলেছো।”
রোদেলা থেমে যায়। চোখ সরু করে তাকায় ঈশানের দিকে। তারপর হালকা হেসে বলে,” বুঝলাম তুমি কেনো এসেছো। কিন্তু ওইদিন আমি দিবাকে ডাকিনি। ওটা জাস্ট একটা কো-ইন্সিডেন্ট মিটিং ছিল।”
ঈশান আঙুল তুলে ঠান্ডা দৃষ্টিতে বলে,” নেক্সট টাইম আর কখনও যদি তোমাকে ওর আশেপাশেও দেখি, আমি কিন্তু চুপ থাকব না।”
রোদেলা সিরিয়াস হয়ে ভ্রু কুঁচকায় এবার। জিজ্ঞেস করে শক্ত মুখে,”তুমি কি হুমকি দিচ্ছো আমাকে?”
ঈশান সরাসরি রোদেলার চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। ধীর কণ্ঠে বলে,”না রোদেলা, আমি হুমকি দিচ্ছি না। আ’ম ভেরি সিরিয়াস দিজ টাইম। তুমি লিমিট ক্রস করেছো। আর সেটা কেউ করলে আমি তাকে খুব ভদ্রভাবে থামাতে জানি।”
রোদেলা হাসে। ব্যঙ্গ করে বলে,”ওহ, মাই গড! আ’ম স্কেয়ার্ড।”
“স্কেয়ার্ড হওয়ার এখনই দরকার নেই। কিন্তু প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ তোমার ক্যারিয়ারে একটা টার্নিং পয়েন্ট আমি আনতে পারি, যদি তুমি নিজেকে এখনি না সামলাও।”
রোদেলা হাত ভাঁজ করে তাকায়। মুখে আগের মতোই ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে বলে,” আচ্ছা? তা কি করবে তুমি শুনি?”
ঈশান টেবিলের উপরে একটু ঝুঁকে ধীর গলায় বলে,” মিডিয়ায় তো তুমি খুব পরিচিত মুখ। তোমার থ্রু-তে আমাকেও সবাই ভালো করেই চেনে। কেমন হয় যদি আমাদের ডিভোর্সের আসল কারণটা সবার সামনে চলে আসে?”
রোদেলার মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। ঝুপ করে সেখানে নেমে আসে কালো অন্ধকারের ছায়া, শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত হয় শীতল স্রোত।
ঈশান বলে,” সবাই তো জানে আমাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স। কিন্তু আসল কারণটা এখনও কেউ জানে না। আমার এসিস্ট্যান্ট হোসেনের কাছে তোমার আর তোমার ওই এক্সের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি এখনও আছে। আমি চাইলেই সেগুলো ফ্ল্যাশ করতে পারি।”
রোদেলার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। সে কঠিন মুখে বলে,” তুমি এরকম কিছু করবে না ঈশান৷ তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে।”
ঈশান পিছিয়ে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। সহজ-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,” আমি তো আমার কথা রাখতে চাই রোদেলা। কিন্তু তুমিই আমাকে হার্ড হতে ফোর্স করছো। হোয়াট শুড আই ডু একচুয়েলি?”
রোদেলা মাথা নিচু করে কোনমতে বলে,” কি চাও তুমি? আমি দিবার কাছে ক্ষমা চাইবো?”
” প্রয়োজন নেই। আমি শুধু চাই তুমি আমার স্ত্রীর নাম মুখে না নাও। আর যদি একবারও ওর কানে তোমার এই বিষাক্ত কণ্ঠ পৌঁছায়, আই সয়্যার আমি তোমার সবচেয়ে দামী জিনিসটা কেড়ে নিবো। তোমার ইমেজ। মাইন্ড ইট।”
দশমিনিট শেষ হয়ে গেছে। ঈশান উঠে দাঁড়ায়, যাওয়ার আগে একবার পেছনে ঘুরে বলে,” আর হ্যাঁ, আমাদের বেডরুমের সব খবর যে ইলোরা আন্টির মাধ্যমে তোমার কানে আসে, সেটা আমি জানি! তার সঙ্গে সখ্যতা কমাও। নাহলে বিপদ বাড়বে।”
ঈশান দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। রোদেলার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিল। এতোক্ষণ পরে সে বড় করে শ্বাস নিতে পারে।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অন্তরা রাফিনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। এদিকে রাফিনের বাসায় যাওয়ার সাহসও হয় না তার। যদি সবার সামনে অপমান করে! সে কিভাবে সহ্য করবে? নিজের মনের এই দ্বিধাভরা যন্ত্রণার কথা ফেসবুকের একটা গ্রুপে লিখে পোস্ট করে সে। গ্রুপটা শুধু মেয়েদের। আর অন্তরা নিজের পরিচয় গোপন রেখে পোস্টটা করেছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায় সেই পোস্ট! বেশিরভাগ মেয়ে অন্তরাকে পরামর্শ দেয় যেন সে নিজের বাসায় এই কথা জানায়।
কিন্তু এটা অন্তরা কোনোভাবেই করতে পারবে না৷ মা তাকে জানে মেরে ফেলবে! অন্তরার বাবা ব্যাংক ম্যানেজার। খুব সম্মানীয় ব্যক্তি। তিনি এসব জানলে লজ্জায় তার পরিবারের কাছে মাথা কাটা যাবে। তবে কয়েকজন তাকে পরামর্শ দেয় রাফিনের বাসায় গিয়ে বিষয়টা জানানোর। অন্তরা ঠিক করে সেটাই করবে। কিন্তু পরদিনই ঘটে আসল অঘটন।
অন্তরার মা সাবিহা হঠাৎ সবকিছু জেনে যায়। সারারাত না ঘুমানোর কারণে তার মুখের অবস্থা বেহাল ছিল। সাবিহা এই অবস্থা দেখে কঠিন হয়ে প্রশ্ন করতেই সে নরম হয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে সব বলে দেয়। সাবিহা খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। সেদিন বিকেলেই অন্তরাকে নিয়ে রাফিনদের বাসায় যান তিনি। শাহনাজ বেগমের সাথে সরাসরি কথা বলেন।
কিন্তু নিজের ছেলের ব্যাপারে এতোবড় অভিযোগ তিনি মানতে নারাজ। কথা কাটাকাটি শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে। এখানে অন্তরা যেন নীরব দর্শক। ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে পড়েছে সে। এখন আর কিছুই করার নেই। তবে সাবিহা খুব হুমকি দেন যে পুলিশ কেস করবেন। শাহনাজ বলেন,” যা খুশি করেন গিয়ে। আমার ছেলের কিছুই হবে না। সম্মান গেলে আপনাদের যাবে।”
রায়া এতোক্ষণ ভেতরের ঘর থেকে সব শুনছিল। এবার সে বেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে বলে,” সাবিহা আন্টি যা বলছে সব সত্যি মা। আমি নিজে দেখেছি ভাইয়া অন্তরাকে জো’র করে টাচ করেছিল।”
শাহনাজ নিজের মেয়ের এমন স্বীকারোক্তিতে হতবাক হয়ে যান। সাবিহা হাসি মুখে বলেন,” ধন্যবাদ তোমাকে সত্যিটা বলার জন্য।”
এবার তিনি কড়া চোখে বলেন,” আপনার কুলাঙ্গার ছেলের কি ব্যবস্থা করবেন করুন। সে আমার মেয়ের সরলতা নিয়ে যেভাবে খেলেছে, শাস্তি ওকে পেতেই হবে। এতো সহজে আমি ছাড় দেবো না। চলে আসো অন্তরা।”
সেদিন রাতেই রাফিন বাড়ি ফিরে প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে। শাহনাজ বেগম ছেলের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেন। অন্তরার ব্যাপারে সত্যি-মিথ্যা জানতে চান। এদিকে রাফিন পুরোপুরি ভেঙে গেছে ভেতর থেকে। আজ অফিসে একটা ভ’য়ংকর ঝামেলা হয়ে গেছে৷ কথায় আছে অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়। তার হয়েছে সেই দশা। দূর্ভাগ্য মনে হয় কখনোই তার পিছু ছাড়বে না!
কিছুদিন আগে রাফিন ইন্টারভিউ দিয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্পোরেট কমিউনিকেশন বিভাগে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে জয়েন করেছিল। মূলত আগের চাকরির ছয়মাসের অভিজ্ঞতাই তাকে এই চাকরিটা পেতে সাহায্য করেছে৷ এই চাকরিতে সে সত্যিই মনোযোগ দেয়। ভেবে নেয় এটা তার জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ। নিয়মিত ড্রেসআপ করে যায়, কাজ শেখে, রিপোর্ট তৈরি করে, প্রেজেন্টেশন দেয়।
একদিন ব্যাংকের একটি বড় ক্লায়েন্টের রিপোর্ট ভুলে ভরা থাকায় বড় ক্ষতি হয়। সেই টিমে রাফিন থাকলেও, ভুলটা তার নয়। কিন্তু টিমের জুনিয়র হিসেবে দোষ এসে পড়ে তার ঘাড়েই। ম্যানেজমেন্ট থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে তাকে সাসপেন্ড করা হবে।
কোম্পানির ইমেজ বাঁচাতে একরকম চাপ দিয়ে তাকে বলা হচ্ছে চাকরি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য। নয়তো তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রাফিন ভেঙে পড়েছে। পুরো সংসারের খরচ তার ওপর। এখন চাকরি চলে গেলে কোথাও ঠাঁই হবে না। অন্তরার থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য সে বলেছিল কানাডা চলে যাবে। সব কি ওই মেয়ের অভিশাপ?
শাহনাজ ছেলের বিপদের কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। রায়া এসে বলে,” ভাইয়া, আমার কাছে একটা সমাধান আছে। তুমি অন্তরার বাবার কাছে যেতে পারো। উনি তো প্রাইম ব্যাংকের ম্যানেজার। কিছু একটা করবে।”
শাহনাজ চোখ রাঙিয়ে বলেন,” তুই পাগল হয়েছিস? অন্তরার মায়ের যে দেমাগ, ওরা কখনও রাফিনকে সাহায্য করবে?”
” করতেও পারে। এখন ভাইয়া যেহেতু এমন একটা বিপদে পড়েছে আমাদের হাতে তো কিছু নেই তাই না?”
রায়া প্রথমে অন্তরার সাথে এই বিষয়ে কথা বলে। পরে অন্তরা নিজেই তার বাবাকে সবকিছু জানায়। আব্দুল হাকিম সাহেব অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেন। যখন বুঝতে পারেন রাফিন আসলেই নির্দোষ, তখন তিনি নিজের পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংকের হেড অফিসে যোগাযোগ করেন।
পরদিন রাফিন অফিস গিয়ে জানতে পারে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টে তার নাম ক্লিয়ার হয়ে গেছে। অফিস বুঝতে পেরেছে সে কেবল একজন জুনিয়র সদস্য ছিল। রাফিন চাকরিতে বহাল আছে, এমনকি কলিগরা তার প্রশংসাও করে।
এই ঘটনার পর অপরাধবোধে পিষ্ট হয়ে রাফিন সিদ্ধান্ত নেয় অন্তরার কাছে ক্ষমা চাওয়ার। যথারীতি সে অন্তরার বাসায় বিয়ের প্রস্তাবও পাঠায়।
সাবিহা এবং হাকিম সাহেব খুশি হয়ে যান। কিন্তু অন্তরা বেঁকে বসে। সে এখন ম’রে গেলেও রাফিনকে বিয়ে করবে না!
আজ ভার্সিটিতে দিবার একটাই ক্লাস। তাও সেটা বিকেলে। বন্ধুদের নিয়ে পরিকল্পনা করেছে একসাথে পিকনিক করবে। সবাই সমান সমান টাকা দিয়েছে। শাম্মির বাসা পুরো ফাঁকা। তার বাবা-মা, ভাই, গ্রামের বাড়ি গেছে। তাই বিকালের ক্লাস শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যে সেখানেই জড়ো হবে সবাই৷ সারারাত আড্ডা চলবে। সকালে সবাই একসাথে ক্লাসে যাবে৷ এই হলো পরিকল্পনা।
রোজার সমস্ত দায়িত্ব বেবি সিটার তৃষাকে বুঝিয়ে দিবা পরিপাটি সেজে বের হচ্ছিল। হঠাৎ রান্নাঘরে হাফসাকে দেখেই বলে,” শোন হাফসা, তোর ভাইয়া ফিরলে বলিস যে আমি ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি। আজরাতে ফিরবো না। কাল ক্লাস করে সকালে ফিরবো।”
হাফসা চোখ বড় করে বলে,” মাগো! এতোবড় খবর আমি ভাইজানের কানে দিতে পারুম না। হুদাই ধমক খামু। আপনের কথা আপনে কন।”
” আমি ওর সাথে দুইদিন ধরে কথা বলি না।”
শান্ত কণ্ঠে এটুকু বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় দিবা। আসলেই ঈশানের সাথে বিগত দুইদিন ধরে কোনো কথা হচ্ছে না। ঈশান নিজেও ভাব নিয়ে বসে আছে। দিবা রোজার ঘরে এসে ঘুমায়। ঈশান তাকে ডাকে পর্যন্ত না! থাকুক সে নিজের মতো। দিবাও কথা বলবে না। দেখা যাক কতদিন এভাবে চলতে পারে!
ল্যাব ক্লাসে আজ সবাই খুব নিশ্চুপ। দিবাও নীরবে কাজ করছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। অন্যান্য সময় তো হাসির কথা বলে পরিবেশ মাতিয়ে রাখে। মণি ফিসফিস করে শুধায়,” তোর কি হয়েছে রে? মুখ এমন ভার কেন? ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস?”
দিবা বিরক্ত গলায় বলে,”আজাইরা বকবক না করে কাজ কর।”
শাম্মি মুখ টিপে হেসে বলে,”আবহাওয়া সুবিধার লাগছে না। চুপ থাক মণি। নয়তো আবার একটা ঝারি খাবি।”
সবাই দিবাকে নিয়ে খুব হাসি- ঠাট্টা করে। কিন্তু দিবা কাউকে কিছু বলে না নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে৷ ল্যাব ক্লাস শেষ করে সবাই ক্লান্ত। বন্ধুরা মিলে একসাথে ফুচকা আর মোমো খায়। তারপর টিএসসির মোড়ে আসে রিকশা নেওয়ার উদ্দেশ্যে। দিবা শাম্মির বাড়িতে যাচ্ছে শুধু একটা কারণেই। ঈশানের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে। তারপর কি করবে? ভাবতে ভ’য় লাগলেও দিবা নিজেকে সামলায়। সে আজকে এই সাহসটা দেখাবেই।
ঘড়িতে রাত আটটা। বন্ধুরা সবাই একসাথে ছাদে বার-বি-কিউ পার্টির আয়োজনে ব্যস্ত। এমন সময় বেজে উঠে দিবার ফোন৷ রেখা দুষ্টমি করে বলে,” নিশ্চয়ই ভাইয়া? আমি শিওর।”
দিবারও হার্টবিট বেড়ে যায়। খুব আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে সে। কিন্তু সমস্ত আশার সেগুড়ে বালি! ঈশান নয়, ফোন করেছে রেবা আপা। দিবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন রিসিভ করে।
মণি ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,” কে? ভাইয়া না?”
দিবা মুখ ভেংচি কেটে বলে,” উহুম। রেবা আপা।”
শাম্মি ঠোঁট উল্টে বলে,” ধূর, আমি ভাবলাম ভাইয়া।”
মণি সন্দেহগ্রস্ত হয়ে বলে,” ভাইয়া আজ ফোন দিচ্ছে না কেনো বলতো? নিশ্চিত ঝগড়া করে এসেছে!”
এদের এতো বকবকানিতে দিবা কিছুই শুনতে পাবে না৷ তাই কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
” হ্যালো আপা,বলো।”
ওই পাশ থেকে রেবা শাসনপূর্ণ কণ্ঠে বলে,” দিবা, কোথায় তুই?”
” এইতো শাম্মির বাসায় এসেছি আমরা সবাই মিলে। পার্টি করছি!”
” বাহ, কি সুন্দর করে বললি! পার্টি করছি! ঈশানকে বলে এসেছিস?”
” না।”
” মানে? তোর আক্কেলটা কি?”
” বুঝেছি, সে আমার নামে তোমার কাছে নালিশ করেছে! ভালো! ”
রেবা রাগত স্বরে বলে,”তুই দিন দিন এতো লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিস কিভাবে দিবা? প্রতি কথায় ঈশানের সাথে রাগ দেখাচ্ছিস৷ ওকে রীতিমতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিস। এভাবে কেউ নিজের সংসারে অশান্তি ডেকে আনে? আগে তো তুই এরকম ছিলি না।কেউ দু’টো থাপ্পড় মারলেও তোর চোখ থেকে জল বের হতো না। তোর মতো সহ্য ক্ষমতা আমি আর কারো দেখিনি। অথচ এখন আহ্লাদীপনা শিখলি কোথথেকে?”
দিবা বোনকে মাঝপথে থামিয়ে বলে,”আগে তো আমার জীবনে কোনো ঈশান আহসান ছিল না আপা। তাই সহ্য ক্ষমতা ছিল। এখন সে আছে, আমাকে ইচ্ছেমতো বিগড়েছে, অথচ নিজেই এখন সামলাতে পারছে না৷ এটা কি আমার দোষ বলো?”
” কি বলতে চাস তুই? তুই বার-বার ছেলেমানুষী করবি আর ও তোকে সামলাবে?”
” অবশ্যই সামলাবে। এটা ওর দায়িত্ব। আর ছেলেমানুষী করা আমার স্ত্রীগত অধিকার!”
” তোর সাথে কথায় আমি পারব না। রাখছি।”
” আচ্ছা, শোনো। উনি কি বাসায় ফিরেছে? কখন কথা হয়েছে তোমাদের?” আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে দিবা জিজ্ঞেস করেই ফেলে।
রেবা হাসি চেপে বলে,” জানি না আমি কিছু। তোর এতো জানতে ইচ্ছে হলে নিজেই ফোন করে জিজ্ঞেস কর।”
এটুকু বলে রেবা ফোন রেখে দেয়। দিবা উদাস মুখে দাঁড়িয়ে থাকে ছাদের কার্নিশে। দমকা বাতাস এসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। রাত নয়টা বাজতে যাচ্ছে৷ এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ঈশান ডিনার করে নিয়েছে। দশটার মধ্যে তার শুয়ে পড়ার অভ্যাস। লোকটা তো ভ’য়ানক নিষ্ঠুর! একটাবার ফোন পর্যন্ত করল না। থাক, তাতে কি হয়েছে? দিবাও করবে না।
ধীরপায়ে হেঁটে সে বন্ধুদের আড্ডায় শামিল হতেই যাচ্ছিল, তখনি আবার বেজে উঠে ফোন৷ দিবা ভাবে আবারও রেবা আপা ফোন করেছে। কিন্তু ভেসে ওঠা স্ক্রিনে ” Beloved ” নামটি দেখা মাত্র প্রসারিত হয় তার ঠোঁট। পেটের মধ্যে গুলগুলিয়ে উঠে একরাশ প্রজাপতি। দিবা দূরে এসে কাঁপা কাঁপা বুকে ফোন রিসিভ করে। কিন্তু নিজের ঠাঁট বজায় রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,” হ্যালো, কি চাই?”
ওই পাশ থেকে শোনা যায় ঈশানের নিয়ন্ত্রণশীল দৃঢ় কণ্ঠ, ” বাসার নিচে ওয়েট করছি আমি। ফাইভ মিনিটসের মধ্যে নিচে নামবে।”
” যদি না নামি?” দিবা একটু ত্যাড়ামি করে।
ঈশান স্পষ্ট গলায় হুমকি দেয়,” আমি উপরে গিয়ে তোমাকে তুলে আনবো।”
দিবা হেসে ফেলে,কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলে,” নামছি। অপেক্ষা করুন।”
বন্ধুদের কাছে গিয়ে সে খুব দুঃখিত হয়ে বলে,” স্যরি ফ্রেন্ডস! আমাকে ফিরতে হবে। আমার হাজব্যান্ড নিচে ওয়েট করছে।”
শাম্মি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,” মানে? ভাইয়াকেও উপরে আসতে বল।”
” অসম্ভব। উনি আসবে না। আমাকেই যেতে হবে। তোরা ইঞ্জয় কর। বাই৷ কাল সকালে ভার্সিটিতে দেখা হবে।”
সব বন্ধুদের একবার করে আলিঙ্গন করে দিবা বিদায় নেয়। তারা শুধু হা করে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলার থাকে না।
রাতের অন্ধকারে ছেয়ে আছে রাস্তাটা। গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়ানো ঈশানের লম্বা অবয়ব নজরে পড়তেই দিবা এগিয়ে যায়। হৃৎস্পন্দন তুমুলে। সে কাছে যেতেই ঈশান আদেশের ভঙ্গিতে বলে,” গাড়িতে ওঠো।”
দিবা শান্ত গলায় বলে,” আপনি কি আমাকে ফোর্স করতে এখানে এসেছেন? যাবো না আমি আপনার সাথে!”
সে ফিরে যেতে উদ্যত হলেই ঈশান হাত টেনে ধরে। চট করে তাকে ফিরিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তারপর ধীর গলায় বলে,” আ’ম স্যরি। সেদিন রাতে বেশিই রুড হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে হার্ট করেছি। এক্সট্রিমলি স্যরি।”
দিবার মন শান্ত-শীতল অনুভূতিতে উদ্বেলিত হয়। চোখে জমে আবেগী অশ্রু। দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত এই ছোট্ট জীবনে কখনও অবহেলা কিংবা অনাদরে তার কান্না পায়নি। কান্না পেয়েছে ভালোবাসায়, যত্নে, কোমলতায়। যেটা শুধুই ঈশান তাকে দিয়েছে। তাই তার সমস্ত অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম ঈশান। পৃথিবীর সবার কাছে দিবা শক্ত খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখতে পারলেও কেবল এই একটা মানুষের কাছে এসেই সে চূড়ান্ত অবুঝ হয়ে পড়ে। মেনে নিতে পারে না সামান্য অবহেলাও, মন বিদ্রোহ করে ওঠে।
ঈশান দিবাকে পাজাকোলায় করে গাড়িতে তোলে। দিবা তখনও কাঁদছে। মুষ্টিতে চেপে ধরে আছে ঈশানের পোলো শার্টের কলার। ঈশান হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে বলে,” পানিশ মি। তবু এইভাবে কেঁদো না প্লিজ।”
দিবা বলে,” এটাই আপনার পানিশমেন্ট। বসে বসে আমার কান্না শুনবেন। বাবা-মার মৃ’ত্যুর পর পৃথিবীর আর কোনো দুঃখই আমার চোখে অশ্রু এনে দিতে পারেনি। আমি কখনও কাঁদিনি। কিন্তু আপনি… আমাকে শুধু কাঁদাচ্ছেন আর কাঁদাচ্ছেন। এতো ভালোবাসা কেনো দিলেন বলুন? আমি সারাজীবন এভাবে কাঁদতে চাই ঈশান।”
দিবা হেলে পড়ে ঈশানের বুকে। তাকে এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেই রাতের নীরব রাস্তায় ড্রাইভ করতে থাকে ঈশান। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজতে থাকে দিবার কান্নার করুণ সুর। ঈশান তাকে থামতে বলে না, মাথা পেতে গ্রহণ করে পানিশমেন্ট!
বাড়ি ফিরে তাকে পাজাকোলায় নিয়েই ঈশান ঘরে প্রবেশ করে। দিবা গলায় হাত বেঁধে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রোজা বিছানায় ঘুমাচ্ছে আরামে। ঈশান তার পাশে দিবাকে শুয়িয়ে দেয়। কপালে চুমু দিয়ে উঠে যেতে নিলেই দিবা তার কলার চেপে ধরে বলে,” যাবেন না। বসুন।”
” আসছি, একটা জরুরী কাজ সেরে।”
ঈশান ওয়াশরুমের দিকে ইশারা করে। দিবা হেসে ফেলে। ঈশান চলে যাওয়ার পর রোজার দিকে ফিরে তার গালে, কপালে চুমু দেয় দিবা। তার ফোনটা আবার বেজে ওঠে।
” হ্যালো আপি।”
” বাসায় ফিরেছিস?”
” হুম, এইযে মাত্র ফিরলাম। আর টেনশন কোর না। ঘুমাও তো।”
রেবা আক্রোশে গলা উঁচু করে বলে,” দিন দিন যে যন্ত্রণা দিচ্ছিস তুই, আর কিভাবে টেনশন না করে থাকব? আচ্ছা ঈশানকে কি মেন্টাল টর্চার করে তুই পাগল বানাতে চাস? এমনিতেও ছেলেটা ঝামেলায় আছে!”
” ঝামেলা মানে? কি ধরণের ঝামেলা?”
রেবা ফিসফিস করে বলে,” তোর রেপের ঘটনাটা আমি ওকে জানিয়েছি। এইটা নিয়েই গত কয়েকদিন ধরে পেরেশানিতে আছে। তোকে বললাম যেন আর সন্দেহ না করিস। ওইদিন রাতে ল্যাপটপে ও কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট করছিল না, বরং আবিদ সাইফুলের প্রোফাইল ঘাটছিল।”
দিবার মুখ ছাইবর্ণ ধারণ করে। গম্ভীর স্বরে সে বলে,” তুমি এটা কি করলে আপা? ওকে এসব কেনো জানালে?”
” খারাপ কি করেছি? আমার থেকে না জেনে যদি অন্যকারো থেকে জানতো? সেটা আরও বেশি খারাপ হতো না? সেজন্য আমিই জানিয়েছি। তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ঈশান এই নিয়ে তোকে কখনোই কিছু বলবে না। ও এমন মানুষ না।”
দিবা অস্থির গলায় বলে,” তুমি ঠিক করোনি আপা। আমাকে না জানিয়ে এতোবড় একটা কথা তোমার ঈশানকে বলাই উচিৎ হয়নি!”
রাগ করে দিবা ফোন রেখে দেয়। অস্বস্তিতে শরীর গাঁট হয়ে এসেছে। অতীতের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে বিচরণ শুরু করে। কেমন গা কাটা দেয়! এবার দিবা বুঝতে পারছে ঈশানের এতোদিন অন্যমনস্ক হয়ে থাকার রহস্য। মাঝরাতে যে সে খারাপ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে, সেটাও কি এই কারণে?
খট করে বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হয়, ঈশান বের হয়েছে। তোয়ালে মুখ-হাত মুছতে মুছতে মৃদু হেসে দিবার দিকে তাকায় সে। দিবাও হাসার চেষ্টা করে। ঈশান বলে,” চলো আমাদের রুমে যাই।”
” শুনুন, একটা কথা বলবো।”
” যেতে যেতে শুনি। বলতে থাকো।”
দিবাকে আবারও পাজাকোলায় নেয় ঈশান। দিবার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। সে ইতস্তত করতে থাকে। রুমে আসার পর ঈশান জিজ্ঞেস করে,” কই? কি যেন বলবে?”
দিবা ঢোক গিলে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে,” আমি রেপড হইনি।”
ঈশান থমকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে বলে,” মানে?”
” মানে আমি রেপড হইনি ঈশান। আপনি শুধু শুধু এতো প্রেশার নিচ্ছেন। যে সত্যিটা আপনাকে জানানো হয়েছে সেটা আংশিক সত্যি। পুরো সত্যি আমার কাছে শুনুন!”
ঈশান তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে। দিবা বলতে শুরু করে,” তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। বড়খালার বাসায় একা একাই থাকতাম। আমার সমবয়সী কেউ ছিল না। বেশিরভাগ সময় আমার মনখারাপ থাকতো।একটা লোক ছিল, সম্পর্কে বড়খালার দেবর। অনেক বার ব্যাড টাচ করেছে আমাকে। আমি রেবা আপাকে সব বলতাম। কিন্তু আপা আমার কথা পাত্তাই দিতো না।
একদিন ঝড়ের রাতে, সবাই গেল বিয়ে বাড়ি। আমাকে একা ফেলে। ওই লোকটা মাঝপথ থেকে ফিরে এলো। দরজা ধাক্কাচ্ছিল। আর আমিও বোকার মতো না বুঝেই দরজা খুলে দিলাম। দুঃস্বপ্নের মতো ভ’য়ংকর লাগে সেই রাতটা এখনও৷ সে কতটা হিংস্র হয়ে উঠেছিল আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না।
বড়খালাদের বাসাটা কেমন ছিল আমি বলি। মাঝখানে উপরে উঠার সিঁড়ি। তারপর দুইতলার করিডোর। রেইলিং ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা ছিল। দূর্ঘটনাবশত যে কেউ ওখান থেকে পড়ে যেতে পারে।
আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে পেছনে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। তার ওই নেশাগ্রস্ত ভয়ংকর চোখ আমি কখনও ভুলবো না। আর মুখে ওই বিকৃত হাসি! আমি পেছাতে পেছাতে হঠাৎ রেইলিং ক্রস করে নিচে পড়ে গেলাম। আঘাতটা সবচেয়ে লেগেছিল কোমরে। এক মুহূর্তের জন্য পুরো দুনিয়া অন্ধকার মনে হয়। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। তখনি আমার জ’রায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্লিডিং শুরু হয়। সবাই ওটা দেখেই ভেবে নেয় আমি রেপড হয়েছি। কিন্তু এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল।”
ঈশান দিবাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আছে, দিবা থরথর করে কাঁপছে। চোখের জল মুছে বলে,”আমার অপারেশন যে ডাক্তার আন্টি করেছিলেন, তিনি জানতেন সত্যিটা। কিন্তু ইচ্ছে করেই কাউকে বলেননি। কারণ আমি যদি উপর থেকে পড়ে না যেতাম, ওই পিশাচটা ঠিকই আমাকে রেইপ করতো। তাই তিনি পুলিশের রিপোর্টে যৌন নির্যাতনের ব্যাপারটাই লিখেছিলেন। যাতে ওই লোকের শাস্তি হয়। কিন্তু কিছুই হয়নি। মাত্র তিনমাসের মধ্যে জেল থেকে বের হয়ে গেছিল।
আমার জীবনের এই ঘটনা, আমি আর ওই ডাক্তার আন্টি ছাড়া অন্যকেউ জানে না। আমি ইচ্ছে করেই কাউকে বলিনি। কারণ আমি চাই ওই লোকটাকে সবাই ঘৃণা করুক। সে যেন অন্যকোনো মেয়ের সাথে এসব করার আগে এই ঘটনা মনে রাখে।
আজ আপনাকে এসব বলছি, কারণ আমার ব্যাপারে সবকিছুই আপনার জানা উচিৎ। অর্ধেকটা কেনো জানবেন? জানলে পুরোটাই জানুন।”
ঈশানের এই মুহূর্তে ভীষণ স্বস্তি লাগছে। এতোদিনের জমে থাকা বিষাদ পাহাড় যেন নেমে গেছে বুক থেকে। অনেকটা হালকা অনুভব হচ্ছে। দিবার সাথে ওই জঘন্য ঘটনাটা ঘটেনি, এর থেকে শান্তির বিষয় আর কি হতে পারে? সে দিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” যা হওয়ার হয়ে গেছে দিবা। এখন এসব ভুলে যাও। শুধু ভালো স্মৃতি মনে রাখবে। খারাপ স্মৃতি আর না।”
দিবা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে বলে,” কিন্তু ওই জঘন্য লোকটার জন্যই আমার এতোবড় সর্বনাশ হলো, এই কথা তো মিথ্যে না। এটা কিভাবে ভুলবো বলুন?”
ঈশান কি বলবে ভেবে পায় না। দিবা আবার তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। ঈশানকে সত্যিগুলো বলতে পেরে তারও হালকা লাগছে ভীষণ।
” এবার বলুন তো, আপনি ওই লোকটির খোঁজ কেনো করছেন? কি করবেন তাকে? শাস্তি দেবেন?”
” প্রসেস অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।” অকপটে বলে ঈশান।
দিবা মাথা তুলে, বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলে,” মানে?”
ঈশান হাসে সামান্য।
দুইদিন আগে-
সন্ধ্যা ছয়টা। পুরো ফ্লোরটা নিস্তব্ধ। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। এক কাপ কফি হাতে সেক্রেটারি এক ভদ্রলোককে কাচঘেরা কনফারেন্স রুমে নিয়ে আসে।ভদ্রলোকের নাম আবিদ সাইফুল। বয়স পয়ঁত্রিশ। পরিপাটি পোশাক, মুখে সৌজন্যময় ভঙ্গি। এখনও অবিবাহিত ঈশান ঢোকে ঘরে। তার গায়ে কালো ব্লেজার, চোখের দৃষ্টি শীতল। সে সোজা এসে বসে যায় লোকটির সামনে।
” শুভ সন্ধ্যা, মিস্টার সাইফুল। আপনাকে কষ্ট করে আসতে বলার জন্য দুঃখিত। আমাদের সংস্থায় কর্পোরেট কমিউনিকেশনে আপনার কাজ ও পরিচিতি নিয়ে পজিটিভ ফিডব্যাক পেয়েছি।”
আবিদ নরম হেসে বলেন,” না না, বরং আমি সম্মানিত বোধ করছি। বলুন, কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?”
ঈশান টেবিলে একটি মোটা ফাইল রাখে। ধীরে ফাইলটি খুলে একটি ছবি এগিয়ে দেয়। ছবিতে কিশোরী দিবার অপারেশন রিপোর্ট, সেই রাতে পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত নোট এবং একটি ডাক্তারের লিখিত স্টেটমেন্ট।
ঈশান ধীর কণ্ঠে বলে,” দেখুন, আপনি চিনতে পারছেন তো এই মেয়েটিকে? আপনার বড়ভাইয়ের বাসায় থাকতো, তখন বয়স মাত্র নয়। আর আপনি তখন প্রায় তেইশ বছরের যুবক। মনে পড়ে কিছু?”
আবিদ একটু ঘেমে ওঠে। হাসি মিলিয়ে যায় মুখ থেকে। কিঞ্চিৎ কপালে তিরিক্ষি ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে বলে,” দেখুন, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন..”
ঈশান এবার আরও ছবি ও স্ক্রিনশট সামনে রাখে।
“এই টেক্সট মেসেজ, আপনার পুরনো ফেসবুক প্রোফাইল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমার সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এক বন্ধু হেল্প করেছে। এছাড়াও কিছু ঘরোয়া ভিডিও ফুটেজ আছে, যা আমরা পুলিশে দিতে পারি। আপনার সমস্ত বেআইনি কাজের রিপোর্ট যোগাড় করা হয়েছে।”
আবিদ এবার ভয়ে কেঁপে ওঠে। স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করে,” আপনি কী চান? হঠাৎ কেনো আমার পেছনে লেগেছেন? প্লিজ স্যার, কিছু তো বোঝান!”
ঈশান একটু ঝুঁকে ঠাণ্ডা গলায় বলে,” আমি চাই, আপনি আজই আপনার পদত্যাগপত্র জমা দেবেন এবং ঢাকায় সমস্ত কর্পোরেট সংযোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। আর যদি এক সপ্তাহের মধ্যে আপনি শহর না ছেড়েছেন, তো মিডিয়া, পুলিশ আর আপনার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সবাইকে একসাথে সত্যিটা জানিয়ে দেবো।”
আবিদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
ঈশান উঠে দাঁড়ায়,” আপনার প্রোফাইলের টেকনিক্যাল ব্যাকআপ আমি রেখেছি। ভুলে যাবেন না। আপনি ফেঁসে গেছেন।
ঈশান বেরিয়ে যায়। কনফারেন্স রুমে হতভম্ব, ঘামঝরা মুখ নিয়ে বসে থাকে আবিদ সাইফুল।
এটুকু শুনেই দিবা মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে,” এবার? কি করবেন আপনি লোকটির সাথে?”
” ইচ্ছে তো ছিল সে শহর ছেড়ে পালানোর সময় পুলিশে ধরিয়ে দিবো। কিন্তু আপাতত বিচারের ভার তোমার হাতে দিলাম৷ তুমি বলো, তুমি কি চাও।”
” ছেড়ে দিন। বাদ দিয়ে দিন। তার বিচারের ভার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন।”
ঈশান অবাক হয়ে বলে,” আর ইউ শিওর?”
” হুম৷ শিওর। আমি চাই না আপনি আমার জন্য এসব বিপজ্জনক কাজে আর নিজেকে জড়ান। আমি এমনিতেই যথেষ্ট সুখে আছি ঈশান। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই।”
কথা শেষ করে দিবা নিজ উদ্যোগে ঈশানের ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে। তার এই নিঃসংকোচ আগ্রহ ঈশানের মনে ঝড় তুলে দেয়। সে সহজেই ছাড়ে না দিবাকে। একটা ঐশ্বরিক মুহূর্ত অতিবাহিত হয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা দু’জন হারিয়ে যায় কোমল সুখের মায়াময় অনুভূতির স্রোতে।
পরিশিষ্ট
দিবা এখন প্রতিষ্ঠিত এক কেমিস্ট এবং উদ্যোক্তা। তার নিজের হাতে তৈরি করা স্কিন কেয়ার ও হেলদি কসমেটিক্স প্রোডাক্ট ধীরে ধীরে দেশজুড়ে সমাদৃত হয়ে উঠছে। এমনকি তার বানানো সানস্ক্রিন বিদেশেও রপ্তানি হয়। বনানীতে সে তার বিশাল এক অফিস শো-রুম খুলে বসেছে। যার দেয়ালে সাদা সাইনবোর্ডে লেখা,” Gorgeous Diva.”
একদিন একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের ইন্টারভিউয়ার আসে তার অফিসে। ভদ্রমহিলা দিবার চকচকে ত্বক, অত্যাশ্চর্য সুন্দর মুখ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। কিন্তু তাকে ক্যামেরা বন্ধ করে ভেতরে আসতে হয়। দিবা কখনোই ক্যামেরার সামনে যায় না।
ইন্টারিভিউয়ার মিস লিমা খুব বিনয়ী স্বরে বলেন,” ম্যাডাম, আপনি এতো সুন্দর দেখতে। কিন্তু কখনও ক্যামেরার সামনে আসেন না৷ এরকমটা কেনো? এখন তো ভিউজের যুগ। আপনি মডেল হয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিলেই হৈহৈ করে সেল বাড়তে থাকবে। পুরো বিশ্বের কাছে আপনার পরিচিতি তৈরী হবে। এটা কি আপনি চান না?”
দিবা মৃদু হেসে বলে,” জীবনে আমি যতটুকু পেয়েছি, যা পেয়েছি তাই নিয়েই অনেক সন্তুষ্ট। এর বেশি কিছু আমার চাওয়ার নেই। তাছাড়া আমি এসব লাইমলাইটে থাকা পছন্দ করি না।”
তার সহজ সাবলীল উত্তরে মিস লিমা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইন্টারভিউ শেষ হলে দিবার সেক্রেটারি অন্তরা গেস্টকে এগিয়ে দেয়। মিস লিমা বলেন,” ম্যাডামের কি কোনো পারসোনাল প্রবলেম আছে? তিনি কেনো ক্যামেরার সামনে আসতে চান না?”
অন্তরা মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,” কারণ ম্যামের হাজব্যান্ড এটা একদম পছন্দ করেন না। আর ম্যামও নিজের হাজব্যান্ডকে খুব রেসপেক্ট করেন।”
মিস লিমা অবাক হয়ে মুখ-চোখ কুঁচকে বলে,” উনার মতো এতো আত্মনির্ভরশীল মহিলার এমন ডমিনেটিং হাজব্যান্ড? মাই গড! আনবিলিভেবল!”
অন্তরা সাথে সাথে কড়া কণ্ঠে সতর্ক করে,” খবরদার, যা বলার বলেছেন। আর কিছু বলবেন না এই বিষয়ে। ম্যাম নিজের হাজব্যান্ড সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ওয়ার্ডও সহ্য করেন না। তাদের সম্পর্কটা একদম অন্যরকম। দে বোথ আর অবসেসড উইদ ইচ আদার।”
ইন্টারভিউয়ার লিমা থতমত খেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে। অন্তরা এখন ফার্মাসি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। পাশাপাশি পার্ট-টাইম জব করে দিবার অফিসে। সে এখন দিবার ডানহাত।
হঠাৎ একদিন, রোদঝরা দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। আবার মুখোমুখি হয় রাফিনের সাথে।রাফিন এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে তার চেহারা, চাল-চলন।
” কেমন আছো অন্তরা?” চোখে-মুখে একটা সুক্ষ্ম অপরাধবোধ ধরা পড়ে।
অন্তরা সহজ হেসে বলে,” ভালো, খুব ভালো! আপনার কি খবর?”
রাফিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” এইতো, আমিও আছি ভালো। কোথায় যাচ্ছো? এসো তোমাকে পৌঁছে দেই।”
অন্তরা আঁড়চোখে দেখে রাফিনের ইশারাকৃত, রাস্তার বিপরীতে পার্ক করা ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়িটা। এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,” গাড়ি কবে কিনলেন?”
রাফিন হেসে বলে,” কিনিনি। অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে।”
” বাহ ভালো। আপনার অফিসের গাড়িতে আপনিই চড়ুন। আমার জন্য বাসই ঠিকাছে।”
রাফিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। অন্তরা প্রাণপণে তার উপস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যেন তাদের মধ্যে কখনোই কিছু ছিল না। হঠাৎ রাফিন জিজ্ঞেস করে,” আচ্ছা তুমি কি এখনও আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি অন্তরা?”
অন্তরা তাচ্ছিল্য হাসে। শান্ত গলায় বলে,” আমি আপনাকে ক্ষমা অনেক আগেই করে দিয়েছি।”
রাফিন তার কণ্ঠে একটা উদ্যমী ভাব নিয়ে বলে,” তাহলে আমরা চাইলেই সবকিছু আবার নতুন ভাবে শুরু হতে পারে৷ আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায়?”
অন্তরা কঠিন মুখে বলে,” ক্ষমা করতে পেরেছি, এটা ঠিক। কিন্তু কিছু ভুলতে পারিনি এখনও। মাত্র একমাসের সম্পর্কে আপনি আমাকে যে পরিমাণে কাঁদিয়েছেন, সারাজীবন তা আমার জন্য ট্রমা হয়ে থাকবে। স্যরি, আর কখনও আপনাকে ভরসা করতে পারব না রাফিন। এটা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
অন্তরা তার কথা শেষ করে দ্রুত হেঁটে চলে যায়৷ রাস্তা পার হয়ে একটা রিকশা নেয়। সামনের স্টপেজ থেকে বাসে উঠবে। তবু এখানে রাফিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না!
সেদিন বিকেলে অফিসে ফিরে অন্তরা এই ঘটনাটি দিবাকে জানায়। দিবা কফির মগ হাতে নিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। খুব মনোযোগের সাথে সবকিছু শুনে সে হালকা হেসে বলে,” মানুষের মন মানে মানে বদলায় অন্তরা। এই মন কখন কী চায়, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি না। তাই যাই করো, সেটা যেন মন থেকে হয়। ভয় কিংবা দয়া থেকে না। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”
অন্তরা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দিবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,” তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ আপু। তুমি না থাকলে আমি কবেই ভেঙে শেষ হয়ে যেতাম। আমাকে মাটির পুতুলের মতো নিজের হাতে গড়েছো তুমি। আমি কখনও তোমার প্রতি এই কৃতজ্ঞতার শোধ দিতে পারব না।”
দিবা অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মিষ্টি করে হেসে বলে,” ধূর পাগলি, আমি কিছুই করিনি। সবটা তোমার ক্রেডিট। তুমি নিজেই নিজেকে গড়েছো। একসময় আমিও তোমার মতোই ভঙ্গুর হৃদয়ের ছিলাম। আমার এই আত্মবিশ্বাস আর সফলতার পেছনে একমাত্র কার অবদান জানো?”
অন্তরা জানে, খুব ভালো করেই জানে। মুখস্তের মতো বলে,” রোজার বাবা, ঈশান ভাইয়া।”
দিবা মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। রোজা এখন ক্লাস টু-তে পড়ে। বুদ্ধিমতী, দারুণ ক্রিয়েটিভ, অথচ বাবার মতোই সংবেদনশীল। সে ইন্ট্রোভার্ট হলেও পছন্দের মানুষদের সাথে সুন্দর মিশে যায়। অন্তরার সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
ঈশান প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় দিবার পছন্দের কোনো জিনিস নিয়ে। আজকেও এনেছে বেলীফুল আর চকলেট। দিবা তার গা থেকে যত্ন করে ব্লেজারটা খুলে দেয়। ঈশান হঠাৎ আয়নার সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলে,” ডিভা কুইন, ইউ আর দ্যা হোমপেজ অফ মাই লাইফ। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে শুধু এখানে ফিরেই শান্তি খুঁজে পাই।”
দিবা দুষ্টমি করে বলে,” তাই? তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে করিডোরে হাঁটুন।”
ঈশান হাসে, ভালোবাসায় পাগল হয়ে যায়, ঠিক যেমনটা প্রথমদিনে ছিল। চার বছর পেরিয়ে গেছে তাদের সংসারের। কিন্তু অনুভূতি গুলো এখনও প্রথমদিনের মতোই তরতাজা, জীবন্ত। দিবার অবুঝ, আদুরে বায়নাগুলো একটুও বদলায়নি।
ঈশান সত্যি সত্যি তাকে কোলে নিয়ে করিডোরে হেঁটে বেড়ায়। দিবা বলে,” হয়েছে ছাড়ুন, আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন। আমার ওজন আগের চেয়ে বেড়েছে।”
ঈশান ফিসফিস করে বলে,” তাতে কি? এজন্য তোমাকে কোলে নিবো না? একটা মাত্র বউ আমার, তাও আবার অবুঝ। তার কোনো শখ আমি অপূর্ণ রাখি না…
দিবা হেসে উঠে খিলখিল করে। এই আনন্দঘন জীবনে সৃষ্টিকর্তার কাছে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।
সমাপ্ত।