শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব-১৪

0
204

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৪|
সাদিয়া মেহরুজ

শরিফের মৃ ত্যু তে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল কয়েকদিন। একজন এমপি কিভাবে এমন জ/ঘ/ন্যতম অপরাধ করতে পারে সরকারের এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলেছে দেশে। জুই এবং শরিফের করা কর্মকাণ্ড পুরো দেশের সামনে উঠে এসেছে। সবার সামনে এ তথ্য আনতে সাহায্য করেছে সারতাজ, শাকিব সাথে সাংবাদিকেরা। সারতাজ ভীষণ করে চাইত তার বাবার এই নি ষ্ঠু র, নি র্ম ম আচরণ সকলের সামনে উঠে আসুক। চিনুক সকলে শরিফের ভালো মানুষ রূপী চেহারার আড়ালের নি কৃ ষ্ট রূপটা! শরিফের মুখোশ উন্মোচন হওয়ার পর সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কারণ দেশের সকল মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল প্রতিটি জেলা থেকে শুরু করে মফস্বলে। সারতাজকেও ভালোই দৌড়াদৌড়ির ওপর থাকতে হয়েছে ক’দিন। তবে তা বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চূড়ান্ত শুনানি হয়েছিল দ্রুতই। শরিফের সাথে জড়িত অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আ ট ক করে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ছোটাছুটি থেকে মুক্তি মিলেছে সারতাজের। তবে অনিকের বিষয়টাতে তারও সাক্ষ্য প্রয়োজন। তাই পুনরায় এই আইনের দোরগোড়ায় তার উপস্থিতি।

সাবিনার সাথে কথা বলে মাত্রই ফোন কে টে ব্যাগে পুরলো মেহতিশা। এগোল সম্মুখে। সারতাজ বিরান পার্কটায় একাকী বসে বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে। কেন যেন মেহতিশার সারতাজের নিকট যেতে ইচ্ছে হলো না। লোকটার কাছে গেলেই শুধু তর্ক লাগে দু’জনের অযথাই। সারতাজ এমনই সব উটকো কথা বলে তাকে রাগিয়ে দেয় যে কথা না বলে থাকাই যায় না!

-” আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যে? ”

মেহতিশা পিছন ফিরে হকচকাল! লহমায় এই লোক ওখান থেকে এতোটা দূর এতো দ্রুত কি করে এসে পড়লো? আশ্চর্য!

-” কথা বলছেন না কেন মেয়ে? আমি আরো ওয়েট করছিলাম ওখানে বসে বসে আপনার জন্য। ” কিয়ৎ অধৈর্য শোনাল সারতাজের গলা।

মেহতিশা বলে উঠলো, ” অপেক্ষা করছিলেন কেন?”

-” অদ্ভুত প্রশ্ন! কোর্টে যেতে হবে না নাকি? ”
-” এখনি? আপনি না বললেন সাড়ে দশটায়? মাত্র তো ন’টা বাজল। ”
-” কোর্ট দূরে। আমাদের এখনি রওনা দিতে হবে। নয়ত পৌঁছাতে সময় লাগবে। ”

চটজলদি ঠিকানা মনে করলো মেহতিশা। পরক্ষণেই নিজের কপাল চাপড়াল সারতাজের অগোচরে। সে এতোটা বেখেয়ালি কবে হলো? এখানে তার জন্ম, পুরো চট্টগ্রাম তার চষে বেড়ানো অথচ সে ঠিকানা, স্থান ভুলে বসল মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে? অদ্ভুত!

-” স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়েই থাকবেন? আমি কি জজ কে এখানে বিচার করতে ডাকব মেয়ে? হু? ডাকব? ”

প্রতিত্তোর না করে হাঁটা ধরল মেহতিশা। বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো তার তপ্তশ্বাস। সবটা সময় ছেলেটার ত্যাড়া কথা!

গাড়ি নিয়ে শাকিব নিজেই উপস্থিত হলো মিনিট পাঁচেক বাদে। শাকিব এগিয়ে এলো তাদের কাছে। মিষ্টি হেঁসে মেহতিশাকে প্রশ্ন করলো,

-” ভালো আছো আপু? ”
-” জি ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন? ”
-” আলহামদুলিল্লাহ আছি। ”

শাকিব উত্তর দিয়ে সারতাজের পানে তাকাল। সে দেখল ভ্রুকুটি কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে সারতাজ। তার কাছে গিয়ে হাত টেনে শাকিব হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,

-” এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন সেন্টি? ”

সারতাজ একটু অদ্ভুত গলায় শুধাল, ” এতোটা ঢং করে রঙচঙ মেখে তো তুমি আমাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করলে না ‘ কেমন আছি? ‘। ”

শাকিব শব্দযোগে হাসল। সারতাজের পিঠে তার শক্ত হাতের চাপড় পড়ল।

-” তোকে আর কি জিজ্ঞেস করবো? তুই তো সেন্টি, তাই সবসময় সেন্টির মতোই মুখ বানিয়ে রাখিস। তোকে আলাদা করে কেন জিজ্ঞেস করবো কেমন আছিস? বিষয়টা ফর্মালিটি মেইনটেইন টাইপ হয়ে গেল না? ফর্মালিটি মেইনটেইন মানতে পারবা তুমি!”

মৌন রইল সারতাজ। শাকিব নানান কথা বলছিল। শাকিবের কথা আবছা আবছা কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়ে ঘন ঘন পিছন ফিরে তাকাচ্ছে সারতাজ। মেহতিশা তাদের পেছনে। বেশ আস্তে ধীরে হাঁটছে মেয়েটা। ললাটে চামড়ার সাড়ি সাড়ি ভাজ সৃষ্টি করে সারতাজ। মেহতিশা এতো ধীরে হাঁটছে কেন? আবারও ব্যা থা পেয়ে বসল কি? মেয়েটার তো নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই!

-” এতো পিছনে ঘুরে কাকে দেখছিস? ”
-” মেহতিশাকে। ”

শাকিব এ পর্যায়ে যারপরনাই অবাক হলো! বলল,

-” মেহতিশাকে! কেন? ”
-” কতোটা আস্তে হাঁটছে। আবারও আজকে ব্যা থা পেয়েছে কিনা কে জানে। ওনার নিজের প্রতি বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। ”

শাকিব বিস্মিত! নেত্রযুগল বড়সড় হলো তার।

-” তাতে তোর কি? ইদানীং খেয়াল করেছি তুই মেয়েটার ব্যাপারে একটু বেশিই কনসার্ন। কাহিনি কিন্তু ভালো ঠেকছে না। ”

শাকিবের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সারতাজ কেবল নির্লিপ্ত রইল। টু শব্দ অব্দি করলো না।

_

আদালতের কার্যক্রম শেষ হলো বেলা বারোটার দিকে।পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে সামনের মাসের আঠাশ তারিখ। কিছু বিষয় অস্পষ্ট ছিল বিধায় বিচারক সে বিষয়ে র‌্যাবকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।মেহতিশাকে একটু হতাশ দেখাল! তা লক্ষ্য করে শাকিব সাহস দিলো তাকে।

-” বি স্ট্রং মেহতিশা! হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে আপনি কি আর এতো সহজে মামলার রায় পেয়ে যাবেন? ভরসা রাখুন। সকল প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। কেসে আমরাই জিতবো। পরবর্তী শুনানির পর আশা করছি আর আপনাকে কোর্টে আসতে হবে না। ঐটাই হবে শেষ শুনানি। ”

মেহতিশা মাথা নাড়ল। সারতাজ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্রই। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে মেহতিশা বলল,

-” ভাইয়া একটা হেল্পের দরকার ছিলো। ”

শাকিব মেহতিশার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অভয় দিয়ে বলল,

-” বলো আপু। নির্দ্বিধায় বলো। যদি সম্ভব হয় তো হেল্প করার চেষ্টা করবো। ”
-” অনিকের সাথে আমার তালাকটা মুখে হয়েছিল। আমি ওকে তিন তালাক মুখে বলেছিলাম কিন্তু এখন চাচ্ছি ডিভোর্সটা যদি অফিশিয়ালি হয়ে যেত তাহলে ভালো হতো। একটু যদি হেল্প করতেন এই বিষয়ে। ”
-” আমি দেখছি ব্যাপারটা। চিন্তা করো না সবকিছু বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। ”

অনিককে সেই মূর্হতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জে লে। মেহতিশা তাকাল একবার। দেখল বি ধ্ব স্ত অনিককে। চোখের নিচে কালশিটে ভাব। শরীর ভেঙে গিয়েছে। সুদর্শন ভাবটা আর নেই ওর মাঝে। দূর থেকে অনিক চোখ দিয়ে শাসাচ্ছিলো তাকে। মেহতিশা তাচ্ছিল্যের হাসিঁ দিলো! জে লে গিয়ে, শত মা র খেয়েও অ/স/ভ্যটার শিক্ষা হয়নি। জনসম্মুখে কেমন চোখ রাঙাচ্ছে! সারতাজ অনিকের আচরণ দেখে ঠোঁট বাঁকাল। বলল,

-” মা/র – টার দাও না ভাই? এতো সাহস পায় কি করে? সবার সামনে কিভাবে তাকাচ্ছে। উল্টোপাল্টা কথা বলছে। ”

হু মকি দিচ্ছিল অনিক মেহতিশা আর সারতাজকে। শাকিব কঠোর চোখে তাকাল। দ্রুত ওকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলো। তারপর ভারী বিরক্তি নিয়ে শুধাল,

-” গন্ডারের চামড়া! মা/র/লে আ র্ত না দ অবদি করে না। হাসতে থাকে। একে আজ কড়া ডোজ দিতে হবে। ”

সারতাজ হাই তুলল, ” পারলে ভিডিও সেন্ড করে দিও। পপকর্ন খেতে খেতে লাইভ থ্রিল মুভি দেখব।”

শাকিব হাসল! সাথে যোগ দিল মেহতিশা। পাথরের মতোন মূর্তি রূপে থাকা তার অধরে বহুদিন পর হাসির রেখা যুক্ত হলো।
সারতাজ হটাৎ তাড়া দিয়ে উঠলো,

-” অনেকদিন খালামনির সাথে দেখা হয়না। রাতে তো চলে যাবো এখন চলো তোমার বাসায় যাই। তুমি এখন ফ্রী না ভাইয়া? ”
-” ফ্রী-ই আছি। চল যাই। আম্মু বারবার বলেছে তোকে সঙ্গে করে বাসায় ফিরতে। ”

তিনজন গাড়িতে চড়ল। মেহতিশার কিয়ৎ অস্বস্তি হচ্ছে। সারতাজের খালামনির বাসায় সে গিয়ে কি করবে? কথাটা সারতাজকে বলেছেও। কাজ হয়নি। এদিকে মাত্র বাজে বেলা বারোটা। রাতের ট্রেনে ফিরবে ঢাকা। এতক্ষণ থাকবেই বা কোথায়? তার কোনো আত্নীয়-স্বজন নেই। হোটেলে থাকার মতো টাকাও নেই। এদিকে হুট করে সারতাজের খালার বাসায় যেতেও অস্বস্তি হচ্ছে। কি মুশকিল!
শাকিবের বাসায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। মাত্র বিশ মিনিটের ব্যাবধানে পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

-” শাকিব! মেয়েটা কে? তুই আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে এনেছিস? ” ঝাঝাঁল নারী কন্ঠস্বর।

তারা পেছন তাকাল। শাকিবের মা দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টিতে যেন আ গু ন ঝড়ছে। হতভম্ব মেহতিশা বাকি দু’জনের দিকে তাকাল। শাকিব, সারতাজকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল অতঃপর সারতাজ মেহতিশার নিকট এসে চটজলদি শুধাল,

-” মেহতিশা চলুন আমরা বাহিরে যাই। ”

নির্লিপ্ত থেকে মেহতিশা তাই করল। বাহিরে এলো দু’জন। পরবর্তীতে মেহতিশার প্রশ্ন করার পূর্বে সারতাজ নিজেই তার কাঙ্ক্ষিত বার্তা পেশ করল,

-” বড় খালামনির একটু মানষিক সমস্যা আছে মেহতিশা। শাকিব ভাইয়ার বাবা মা রা যাওয়ার পরই তার এই হাল! আঙ্কেলের মৃ ত্যুটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার ওপর আম্মুর অবস্থা। খালার মানষিক অবস্থা উন্নতির থেকে অবনতি হয়েছে। তিনি বেশ সন্দেহপ্রবন, ভুলোমনা আর রগচটা হয়ে গেছেন। ”

মেহতিশা কিয়ৎক্ষণ চুপ রইল। প্রশ্ন করলো,

-” ডাক্তার দেখাননি? ”
-” দেখিয়েছি। চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার সাজেস্ট করেছিল রিহ্যাবে পাঠাতে কিন্তু ভাইয়া রাজি না। ”

ভেতর থেকে চেচামেচির শব্দ আসছে। মেহতিশা একবার সেদিকে তাকিয়ে সামনে চলল। শাকিবকে কতোটা প্রাণোচ্ছল দেখায় সর্বদা। অথচ ছেলেটা মনের ভিতর পুষে রেখেছে নিদারুণ য ন্ত্র ণা! সব মানুষের মাঝেই তবে বিষন্নতা লুকিয়ে থাকে? প্রকৃত সুখী কি কেও নয়?
অদূরে হাত নাড়াচ্ছে সারতাজ। বোধহয় মেহতিশা কে ডাকছে। মেহতিশা এগোল। ভাবল আদতে কি কেও পূর্ণ রূপে এই ত্রি-ভূবনে সুখী?

চলবে~