শান্তিসুধা পর্ব-১৭

0
341

#শান্তিসুধা
১৭.
গ্রামে কাজে এসেছে নুবাইদ। তাই সম্পূর্ণ মনোযোগ তার কাজেই রয়েছে। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতায় ভুগছে শান্তি। নিজেকে বোঝাতে পারছে না কিছুতেই। রাগ হচ্ছে ভীষণ। কেন নাফের বুঝতে পারছে না তাকে? সেই যে বেরিয়ে গেল মানুষটা। আর ফেরার নাম করল না। সারাদিনের কাঠফাটা রোদ, তীব্র গরমের পর প্রকৃতি এখন শীতল। খুব তাড়াহুড়ো নিয়ে সন্ধ্যা নামল যেন। প্রকৃতির শীতল বাতাস ছুটোছুটি করতে লাগল বাংলোর ভেতর। ছুঁয়ে দিল শান্তির কিশোরী শরীরটুকুতেও। বিষণ্ন মন হালকা হলো এতে। উঠে গিয়ে দরজা খুলল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মেঘেরা গর্জন দিতে শুরু করল। মন কেমন করে উঠল শান্তির। নাফের কোথায়? রাত নামছে। ফাঁকা বাংলোতে একাকী সে। এমনিতে খুব একটা ভীতু নয় শান্তি। তবুও অচেনা জায়গায় একা একা গলা শুঁকিয়ে উঠল। এক ছুটে ভেতরে গিয়ে কল করল নুবাইদকে। রিসিভ হতেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

” মিটিংয়ে আছি শান্তি। ফিরতে আরো একঘন্টা লেট হবে। বাদিকের ঘরে গিয়ে দেখো বুকশেলফ আছে। ওখান থেকে একটা বই পড়ে সময় কাটাও। বই পড়তে ইচ্ছে না করলে অনলাইনে সময় কাটাও। ফিরে এসে একসঙ্গে ডিনার করব। ”

নিজের বক্তব্য শেষ করে কল কেটে দিল নুবাইদ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শান্তি। বই পড়ার অভ্যেস তার নেই। তাই ইচ্ছে করল না বই পড়তে৷ ফেসবুক, ইউটিউব কিছুতেই সময় ব্যয় করতে মন চাইল না। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। আচমকা দখিনা হাওয়া এসে আলিঙ্গন করল তাকে। ডাকল খুব সংগোপনে। এক মুহুর্ত স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন হলো মেয়েটার। চুপচাপ লাগেজ থেকে সবুজ রঙের একটি পাতলা ফিনফিনে শাড়ি বের করল। কী ভেবে যেন এই একটা শাড়িই উঠিয়েছিল। কে জানত এই শাড়িটা পরেই আজ বৃষ্টিমুখর ঘন সন্ধ্যায় ভিজতে ইচ্ছে করবে? ভাগ্যিস বিয়ের পর শাশুড়ি মায়ের থেকে শাড়ি পরা শিখে নিয়েছিল।

শাড়ি পরতে পরতে বৃষ্টির বেগ বাড়ল। উথাল-পাতাল বাতাস আর ভারি বর্ষণ। আর দেরি করল না শান্তি। একছুটে বেরিয়ে এলো বাগানের ফাঁকা জায়গাটায়। নিমেষে ভিজে একাকার হয়ে শরীরে শাড়ি লেপ্টে গেল। দু-হাত দুদিকে মেলে মাথা উপরের দিক তুলল সে। চোখ বুজে, বুক ভরে শ্বাস নিল। মন, শরীর সব ঠান্ডা। চমৎকার অনুভূতি হলো সর্বস্ব জুড়ে। খালি পায়ে কিছু সময় হাঁটল। তারপর গিয়ে বসল ভিজতে থাকা সবুজ, সতেজ ঘাসের উপর। হাঁটুর উপর দুহাত রেখে তার ওপর গাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে ভিজতে থাকল অবিশ্রান্ত হয়ে। শীত লাগছে, শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে। তবুও উঠতে ইচ্ছে করছে না।

আধঘন্টা পর। বৃষ্টি মাথায় ছাতা নিয়ে ফিরল নুবাইদ। আশ্চর্য হয়ে গেল বাংলোর প্রধান দরজা খোলা দেখে। ভেতরে গিয়ে যখন শান্তিকে পেল না ধক করে উঠল বুকের মধ্যিখানে। তার শান্তি কোথায়? গলা শুঁকিয়ে গেল। একা রেখে যাওয়াতে পুরোনো শান্তির রূপ ফিরে আসেনি তো? ক্ষেপে উঠে চলে যায়নি তো শহরে? নানারকম চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়ল নুবাইদ। হাসফাস চিত্তে এদিকসেদিক পা চালাতেই নজর পড়ল শান্তির মোবাইল ফোন, আর খুলে রাখা সেলোয়ার-কামিজে। যেটা পরা দেখেছিল। হতবুদ্ধি হয়ে গেল নুবাইদ। এই জামা তো পরা ছিল শান্তি৷ তাহলে এটা ছাড়ল কেন? সত্যি সত্যিই চলে গেল মেয়েটা? দিকবিদিকশুন্য হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। ভুলে গেল বৃষ্টির কথা৷ ছাতা নিল না৷ অবচেতনে বারকয়েক ডেকে ফেলল,

” শান্তি, শান্তি। ”

ওপাশ থেকে ডাক শুনে কাঁপা, কাঁপা শরীরে উঠে এলো শান্তি। সামনে দাঁড়াল নুবাইদের। অকস্মাৎ থমকে গেল নুবাইদ। সবুজ রঙের শাড়িটা বৃষ্টির পানিতে ভেজার ফলে গাঢ় সবুজে পরিণত হয়েছে। শান্তির ধবধবে ফর্সা ত্বকে চকচক করছে সবুজ, ফিনফিনে শাড়ি। বয়স অল্প। তবুও মেয়েটার শরীরের গঠন যুবতীর ন্যায়। ভেজা শাড়িটা আঁটোসাঁটো হয়ে আছে দেহে। সম্পূর্ণ শরীর বৃষ্টিস্নাত। সিক্ত ঠোঁটজোড়া টকটকে লাল। নুবাইদের হৃদয়ের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু জোড়াও যেন কেঁপে উঠল। এক মুহুর্তে হৃদয় থমকাল, চোখ দুটো ধাঁধিয়ে উঠল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে কান দিয়ে বেরুতে লাগল উষ্ণ, উষ্ণ হাওয়া। এতক্ষণ কারেন্ট থাকলেও আচমকা বীভৎস এক বজ্রপাত ঘটায় কারেন্ট চলে গেল। ত্বরিত কয়েক পা এগিয়ে নুবাইদের সামনে এসে দাঁড়াল শান্তি। চারিদিক ঘন অন্ধকার। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই চমক আলোতে নুবাইদ স্তম্ভিত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। মাটির উপর সবুজ ঘাস বৃষ্টির পানিতে যেমন সতেজ হয়। মাটিতে তৈরি শান্তির সুশ্রী দেহখানিতে ভেজা সবুজ শাড়িটাও বেশ সতেজ সতেজ লাগছে। কী অপূর্ব দেখতে শান্তি! কী অপূর্বা লাগছে এই ভেজা শাড়িতে! হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠল। চুম্বকের মতো টানতে শুরু করল সামনে দাঁড়ানো সুশ্রী রমণীটি।

শান্তি খেয়াল করল নুবাইদ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দৃষ্টিজোড়া তার দিকে স্থির রেখেছে। অপলকভাবে তাকিয়ে আছে মানুষটা। তবে কী মুগ্ধ হয়ে গেছে শাড়িতে এভাবে দেখে? সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল সে। আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে আবেদনময়ী কণ্ঠে বলল,

” বৃষ্টিতে ভিজবেন নাফের? চলুন না একসঙ্গে ভিজি। ”

বলেই চট করে হাত চেপে ধরল। এরপর টেনে নিয়ে গেল বাগানের দিকে। নুবাইদের হুঁশ ফিরল সেই মুহুর্তে। উদ্যত হলো ধমক দিয়ে ভেতরে চলে যেতে। কিন্তু শান্তির উচ্ছ্বাস তাকে বোবা বানিয়ে দিল। গায়ে গা ঘেঁষে বৃষ্টিতে ভিজল দুজন৷ ভয়ংকর মুগ্ধতা নিয়ে আলোআঁধারিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কিশোরী বধূকে।

বৃষ্টি কমে এলে নুবাইদ গভীর গলায় বলল,

” ভেতরে চলো। তোমার শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ”

শান্তি ফুলগাছ গুলোকে খুশি মনে আলিঙ্গন করছিল। হঠাৎ নুবাইদের এহেন কোথায় উঠে দাঁড়াল। সত্যি এবার ঘরে ফেরা উচিত। আর দেরি করল না। ছুটন্ত পায়ে চলে এলো ভেতরে। শরীর থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে নুবাইদও এলো। শুকনো জামা নিয়ে শান্তি চটজলদি বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ঠিক কয়েক মুহুর্ত পরেই বাথরুম থেকে আর্তনাদ শুনতে পেল নুবাইদ। বীভৎস এক চিৎকার দিয়েছে শান্তি।

” অহ, নাফের মরে গেলাম! ”

সবেই গা থেকে ভেজা শার্ট, গেঞ্জি খুলেছে নুবাইদ। ভেবেছিল শান্তি বেরুলেই গোসল করে নিবে। এরমধ্যে এমন আর্তনাদ শুনতে পেয়ে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। ছুটে গেল বাথরুমের সামনে। দরজায় টোকা দিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলল,

” কী হয়েছে শান্তি? দরজা খোলো। ”

হুহু করে কাঁদছে শান্তি। নুবাইদ অধৈর্য গলায় বলল,

” ওপেন দ্য ডোর শান্তি। ”

একটুক্ষণ পরই দরজা খুলল শান্তি। নুবাইদ ভেতরে ঢুকতেই আঁতকে উঠল। শরীরে শাড়ি নেই শুধু ব্লাউজ, পেটিকোট। শান্তি এক কোণে বসে বুকের ডানপাশে হাত চেপে ধরে ছটফট করছে। ধাতস্থ হলো নুবাইদ। মস্তিষ্ক সচল হলো নিমেষে। ছুটে এসে হাত চেপে ধরল শান্তির। কণ্ঠে ভয় উপচে পড়ল,

” শান্তি, কী হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বলো। ”

বলতে বলতেই হাত সরাল। আঁতকে উঠল তৎক্ষনাৎ। রক্ত! কিন্তু কীভাবে? ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শরীর ছেড়ে দিল শান্তি। নুবাইদ হতভম্ব হয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। শান্তির যন্ত্রণা, ছটফটানি বাড়ল বই কমল না। চোখের সামনে এই করুণ অবস্থা সহনশীল হলো না। কী হয়েছে, কীভাবে ঘটেছে? বুঝতে হবে, জানতে হবে। অবস্থা বেগতিক! শান্তি বার বার বুকে চেপে ধরছে। খেয়াল করে আচমকা নুবাইদ ওর ব্লাউজ খুলতে উদ্যত হয়৷ অসহ্য ব্যথায় নেতিয়ে পড়া শান্তি চমকে উঠে। নুবাইদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। ত্বরিত ব্লাউজ খুলে ফেলে। অধোবস্ত্র পরনে থাকলেও স্পষ্ট দেখতে পায় ওর ডান পাশের বুকের নরম অংশে একটা জোঁক কামড়ে ধরে আছে। রক্তপাত ঘটছে তবুও নোংরা, ভয়ংকর প্রাণীটা সরছে না। শান্তি আতঙ্কিত হয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিল। চোখমুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে হাত বাড়াল নুবাইদ। পাঁচ আঙুলে শক্ত করে জোঁক মাথা চেপে ধরে তুলে আনল। এরপর ছুটে গিয়ে ওটা বাইরে ফেলে পা পিষে মেরে দিয়ে এলো। শান্তি প্রায় জ্ঞান হারা অবস্থা। নুবাইদ ওকে সাহস দিল, ঝরনা ছেড়ে দিয়ে গা ভেজাল। রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে কিন্তু ব্যথা কমছে না। সেটা শান্তির মুখ দেখেই বুঝতে পারল। কী ভাগ্য! শালার জোঁকটা আর কোনো মানুষ, আর কোনো জায়গা পেল না? যতপ্রকার বিশ্রী গালি ছিল মনে মনে জোঁকটাকে দিয়ে দিল নুবাইদ।

~চলমান~
®জান্নাতুল নাঈমা

রিচেক করিনি।