#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬
ক্লাস শেষ হতেই মৃত্তিকা দৌড় লাগালো। আজ টিচার ঢুকেছে দেড়ীতে। এখন সময় পূর্ণ’র সাথে দেখা করার। সারা দিনে এই এক বারই তো সময় হয়। এরপর মৃত্তিকা শুধু চোখের দেখা দেখে দুই একবার কচিতে। পূর্ণ পড়াশোনা আর রাজনীতি দুটোতেই চর্চিত। মেধাবী একজন ছাত্র এই ভার্সিটির। সব ডিপার্টমেন্টেই তার সুনাম রয়েছে। মৃত্তিকা যদিও এখনও প্রচুর ভয় পেয়ে চলে ওকে কিন্তু মনের কুঠুরির কোন এক কোণায় নিজের অবস্থান ঠিক করে নিয়েছে পূর্ণ। একদম জোড়ালো ভাবে। এই যে আধ ঘন্টা দেড়ী হওয়াতেই কেমন দৌড়ে যাচ্ছে মৃত্তিকা। একটু দেড়ীও যেন সহ্য হয় না অথচ এমনও দিন যায় যে মৃত্তিকা ঘন্টা’র পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। দূর থেকেই মৃত্তিকা খেয়াল করলো হালকা রঙের কটন পাঞ্জাবি পড়ে সুপুরুষ দাঁড়িয়ে আছে বট গাছে হেলান দিয়ে। আশে পাশে কয়েকজন ছেলে পেলে। মৃত্তিকা’কে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখেই গম্ভীর মুখে পূর্ণ সবাই’কে বিদায় জানালো। ওরা যেতেই হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মৃত্তিকা দৌড়ে এসেই হাঁপিয়ে উঠলো। হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছে মৃত্তিকা সেটা দেখেই ভ্রু কুচকে তাকালো পূর্ণ। নিজের হাতে থাকা কোকাকোলার আধ খাওয়া বোতলটা নিয়ে এগিয়ে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো মৃত্তিকা। পূর্ণ গম্ভীর কণ্ঠে কিছুটা রাগ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এভাবে দৌড়ে আসার মানে কি মৃত্ত?
কথাটা রাগী ভাবে বললেও বোতলটা মৃত্তিকা’র হাতে তুলে দিলো। মৃত্তিকা হাতে নিয়ে এক ঢোক খেয়েই বললো,
— কোকাকেলা খাই না আমি। জুস ভালো লাগে।
— আমি জিজ্ঞেস করেছি?
পূর্ণ’র এহেন কথার প্রেক্ষিতে বেশ অপমানিত বোধ করে মৃত্তিকা। এভাবে কথার পৃষ্ঠায় কথাটা বলেছে মৃত্তিকা তাই বলে অপমানটা কি না করলে হতো না? সবসময় কেন এভাবে কথা বলে পূর্ণ ভাই? মৃত্তিকা’র মাটির ন্যায় হৃদয়ে যে আঘাত লাগে সেটা কি পূর্ণ ভাই বুঝে? পূর্ণ আবারও ধমকে জিজ্ঞেস করলো,
— এভাবে দৌড়ানোর মানে কি মৃত্ত? যদি পড়ে যেতেন?
মৃত্তিকা পায়ে দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বললো,
— ক্লাস দেড়ীতে শেষ হলো। আপনি অপেক্ষা করছিলেন তাই…
মৃত্তিকা’র কথাটা এক প্রকার কেঁড়ে নিয়ে পূর্ণ বলে উঠলো,
— তাই বলে এভাবে দৌড়াবেন আপনি? আশে পাশে তাকানো উচিত ছিলো আপনার। এরপর আর…
পূর্ণ’র বাকি কথাগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল মৃত্তিকা’র কান্ডে। মৃত্তিকা হাতে’র আধ খাওয়া বোতলটা সজোরে আঁছড়ে মে’রে কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
— কি হয়েছে দৌড়ে আসাতে? এখন কি দৌড়াতেও পারব না আপনার জন্য?
মৃত্তিকা নিজের কাজে নিজেও হতবাক হয়ে গেল। কার সামনে কি বললো। তা ও কি না এভাবে রেগে গিয়ে। ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখলো পূর্ণ চোখ লাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঢোক গিললো মৃত্তিকা। চোখে পানি চলে এলো। ও মোটেও এভাবে বলতে চায় নি। ন্যাচারাল ভাবেই এমনটা হয়েছে কিন্তু সেটা কি পূর্ণ ভাই বুঝবে? হঠাৎ চাপা গলায় শান্ত বাণী শুনা গেলো,
— উচ্চবাক্য তাও আমার সাথে একদমই পছন্দ নয় আমার মৃত্ত। আজ প্রথম বলে ছেড়ে দিলাম এরপর কি করব সেটা আশা করি বলে বুঝাতে হবে না।
কথা গুলো একদম মৃত্তিকা’র কাণের গোড়ায় এসে বললো। পূর্ণ’র প্রত্যেকটা গরম নিঃশ্বাস গিয়ে পড়লো মৃত্তিকা’র ঘাড়ে। কাঁপন ধরলো তার অঙ্গে। সরে দাঁড়ালো পূর্ণ। ছোট্ট করে বললো,
— এখানে বসুন।
মৃত্তিকা’র নড়চড় হলো না। পূর্ণ এবার রাশভারি গলায় বলে উঠলো,
— হা করুন মৃত্ত। আপনার কলিজাটা কত বড় সেটা দেখব আমি।
মৃত্তিকা ভীতু দৃষ্টিতে চোখ ভরা পানি নিয়ে মাথা তুলতেই পূর্ণ ফিচেল গলায় বললো,
— এতটুকুতেই এই অবস্থা আবার আমার সামনে তেঁজ দেখান? এই তেঁজ আমার সামনে যাতে আর না দেখি মৃত্ত। একদম কলিজা ছিড়ে নিব।
মৃত্তিকা’র চোখে আর পানিগুলো আটকে রইলো না। টপাটপ তা বর্ষিত হচ্ছে। কি এমন করেছে মৃত্তিকা যে তাকে এভাবে বলা হচ্ছে?
পা ফেলে পূর্ণ’র দেখানো জায়গায় একদম গুটিয়ে বসলো সে। পূর্ণ ও বসলো তবে দূরত্ব রেখে। টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করতেই মৃত্তিকা কান্না আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালো কিন্তু হায় এই বেহায়া চোখ অশ্রু ঝরাতে এতই পছন্দ করে যে থামতে চাইলো না। কোনমতে পূর্ণ’র প্রশ্নের উত্তরে মৃত্তিকা হু হা করলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূর্ণ নরম গলায় ডাকলো,
— মৃত্ত?
মৃত্তিকা চমকালো। এত মাসে আজ দ্বিতীয় বার পূর্ণ এতটা নরম কন্ঠে কথা বললো। মৃত্তিকা একবার তাকিয়ে মাথা নামালো। পূর্ণ যথেষ্ট ঠান্ডা ও শান্ত মেজাজে বললো,
— অভিমান করে লাভ নেই মৃত্ত। আপনার এই অভিমান ভাঙানোর মতো সম্পর্ক তো আমাদের নেই তাই নিজেকে ঠিক করুণ। এত সস্তা চোখের পানি যে ঝরাতেই থাকেন।
মৃত্তিকা হাতের কুনুইয়ের দিকে চোখ ঢলে মুছলো। শ্যামলা মুখটা যথেষ্ট গড়ে রচে আছে। পূর্ণ এক ধ্যানে সেখানে তাকিয়ে রইলো। অপেক্ষা জিনিসটা ভয়ংকর। বেশিই ভয়ংকর। জ্বালাময়ী ভয়ংকর। এখন এত এত বাঁধা না থাকলে সে তার মৃত্ত’কে একটু ছুঁয়ে দিত। কপালে ঘামে লেপ্টে যাওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো। এতটা কান্না করানোর পর একটা ছোট্ট আদুরে চুমুও দিতো।
_____________
উজ্জ্বল বেশ জোড়েই একটা থাপ্পড় মারলো হিমুর পিঠে। চিকন শরীরে এহেন বড় সড় থাবা পড়ায় কিছুটা ছিটকে সরলো হিমু। ছেলেটা রাগে না। পাতলা ঠোঁটে হাসি এনে বললো,
— শ্যালা এখন আমি মা’রি?
— মার। তোর ওই দুই ছটাক শরীরে’র আঘাতে আমার কি হবে উল্টো নিজে ব্যাথা পাবি।
হিমু তবুও একটা কিল মারলো। ব্যাথাটা নিজেই পেলো হাতে। ওর কান্ডে সবাই হাসলো একদফা। ছেলেটা এমনই। কিছু মানুষই থাকে এমন। হিমুর চরিত্রের। এদের যতই খোঁচাও। কটু কথা বলো। মজা নাও। এরা মন খারাপ করবে না বরং তোমার সাথে নিজের উপর নিজেই হাসবে। হিমু’র চরিত্রটা ও ঠিক তেমনই। নরম মনের এক সৎ ছেলে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য সুদূর পাড়ি জমিয়ে এসেছে ঢাকায়। ওদের আড্ডার মাঝেই রুপা হাজির হলো। এসআই দেখলে যেমন হাবিলদার এক পায়ে দাঁড়িয়ে সালাম দেয় ঠিক তেমন ভাবেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল হিমু। রুপা বেশ চওড়া গলায় বললো,
— নোট হয়েছে?
— কি? নোট? ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
কিছুটা এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলে ব্যাগ হাতড়ালো হিমু। সুন্দর ফাইলে করে সেটে এনেছে সে। এগিয়ে দিতেই হাসি মুখে কিছু বলতে নিলো হিমু কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রুপা ফাইলটা নিয়েই চলে গেল। একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না।উজ্জ্বল চটে যাওয়া গলায় বললো,
–শালী ঢংগী। ছেড়াটাকে কু*ত্তা খাটান খাটিয়ে একটা ধন্যবাদ ও দিলো না।
“শালী” সম্মধোনটা পছন্দ হলো না হিমু’র। নিশ্চিত রুপা ব্যাস্ত। তাই রাগী কন্ঠে বললো,
— ওনার নামে এভাবে বলবি না উজ্জ্বল। আমার ভালো লাগে না।
হিমু বেশ সিরিয়াস ভাবেই বলেছে। শান্তি প্রিয় মানুষ রাগলে ভয়ংকর। ব্যাপারটা সামাল দিতে ইমাদ ছেলেটা বলে উঠলো,
— আরে চিল। উজ্জ্বল তো এমনিতেই বললো। রুপা আপুর বড় বোনকে বিয়ে করবে ও। তাই তাকে শালী ডাকলো।
উজ্জ্বল ত্যাঁড়া কন্ঠে বললো,
— আমারে তো পাগলা কু*ত্তায় কাঁমড়াইসে।
বলেই চলে গেল। এই রুপা হিমু থেকে শুধু স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে অথচ হাঁদারাম হিমু সেটা বঝতেই পারছে না। সারাদিন পা চেটে বেড়ায় রুপার। হিমু’র অনুভূতি গুলো স্বচ্ছ অথচ রুপা যে ওকে নিয়ে খেলছে সেটা সবাই বুঝলেও হিমু মানতে নারাজ।
______________
মৃত্তিকা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বাবা তো বলেছে আজ নিতে আসবে। ফোন দিলেও ধরছে না। ওর পাশেই উজ্জ্বল, হিমু আর ইমাদ দাঁড়িয়ে। সাথে ক্লাসের বেশ কয়েকজন মেয়ে। ওরা একই বাসে যায়। হঠাৎ সোজা পথে যাওয়া একটা প্রাইভেট কার সাইড কেটে একদম সামনে এসে মৃত্তিকা’কে ধাক্কা মে’রে গেলো। ঘটনা এতটাই দ্রুত ঘটলো যে কেউ কিছু বুঝলো না। মৃত্তিকা’র কপাল লাগলো একটা আধ ভাঙা ইটে। মৃত্তিকা সেটা হাতে তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারতেই সেটা একদম গাড়িটার ব্যাক গ্লাসে লাগলো। কাঁচ না ভাঙলেও ফাটলো ধরলো কিছুটা। পূর্ণ কোথা থেকে দৌড়ে আসতেই বাকিরাও তারাতাড়ি ওকে ধরে উঠালো। রাগে পূর্ণ’র চোখ টলমল করছে। ওর সামনেই কি না কেউ ওর মৃত্ত’কে এভাবে আঘাত করার সাহস পায়। মৃত্তিকা কপালে পেয়েছে ব্যাথাটা সাথে হাত ছিলে গিয়ে হয়তো পায়ে কিছুটা পেয়েছে। ওকে ধরে পাশে বসাতেই পূর্ণ নিজের রুমাল বের করে পানিতে ভিজিয়ে মৃত্তিকা’র কপালে চেপে ধরে র*ক্ত পরিষ্কার করলো। না বেশি কাটে নি। মৃত্তিকা কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে রইলো। এই লোক আজ এতটা শান্ত কেন? মৃত্তিকা’র এই অবস্থায় তার এমন শান্ত আচরণ সত্যিই ভাবার বিষয়। ভয়ংকর বিষয়। মৃত্তিকার বাবা মেয়েকে রাস্তায় এভাবে দেখে গাড়ি থেকে নেমে হুরতার করে নামলো। মেয়ে’র সামনে গিয়ে একপাশে ধরে আতঙ্ক জনিত কণ্ঠে বললো,
— মা আমার কিভাবে হলো এটা? কপালে কি হয়েছে? কাটলো কিভাবে?
ছোট্ট বাচ্চার মতো মৃত্তিকা নিজের ছিলে যাওয়া হাত, পা দেখালো। ওর বাবা যেন পাগল হয়ে উঠলো। তার কলিজারটুকরো এই মেয়ে। ড্রাইভার’কে ডাক দিতেই পূর্ণ বলে উঠলো,
— বেশি কাটে নি। এনটিসেপটিক ক্রিম লাগালেই হবে।
ততক্ষণে একটা ছেলে ক্রিম নিয়ে ও এলো। পূর্ণ আস্তে করে তা লাগিয়ে দিলো। মৃত্তিকা আদুরে বাচ্চার ন্যায় বাবা’র বুকে ঢুকে আছে। পূর্ণ কিছুটা অবাক হয়ে দেখলো। বুঝলো। তার মৃত্ত একটা আদুরে বাচ্চা। বিড়াল ছানা। ছোট্ট চড়ুই কিভাবে তার বাবা’র বুকে ঢুকে আছে। ভদ্রলোক পূর্ণ’কে ধন্যবাদ জানিয়ে মৃত্তিকা’কে কোলে তুলতে নিলেই মৃত্তিকা জানালো সে হাটতে পারবে। পূর্ণ শুধু পাশ থেকে মৃত্তিকা’র কানে বললো,
— তান্ডব আমি ঘটাব মৃত্ত। সব জ্বালাব।
মৃত্তিকা’র কানে সেই কথাটাই বাজতে লাগলো। পূর্ণ যে ভয়ংকর কিছু করবে সেটা ভাবতেই ওর মাথা ঘুরায়। এই মারামারি কোন কালেই পছন্দ না মৃত্তিকা’র। ওর চিন্তার মাঝেই ওর বাবা ওকে পাজা কোলে তুলে নিলো। ভদ্রলোক লোক সুপুরুষ। নিশ্চিত তাহলে মৃত্তিকা মায়ের রুপ পেয়েছে। কথাটা ভেবেই পূর্ণ মনে মনে হাসলো। রহস্যময় সেই হাসি। যার পেছনে রয়েছে অতি ভয়ংকর কিছু।
#চলবে…..