শান্তি সমাবেশ পর্ব-১৫

0
831

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৫

শাস্তি। শব্দটা দুই অক্ষরের হলেও পূর্ণ সেটাকে বেশ ভারী করে দিয়েছে। শুধু মুখেই বলে নি মৃত্তিকা’কে শাস্তি দিবে৷ সে শাস্তিটা বেশ ভালোই দিয়েছে। নরম মেয়েটার মন নিয়ে ফাঁকা হৃদয়ে ভয়ংকর শাস্তি দিয়েছে পূর্ণ। গত দুইটা সপ্তাহ ধরে মৃত্তিকা’র সাথে কথা বলে না। কথা তো দূর দেখেও যেন দেখে না। মৃত্তিকা যে পূর্ণ’তে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছে সেটা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো পূর্ণ তাই তো সর্বোত্তম পন্থাটাই অবলম্বন করলো। মৃত্তিকা থেকে নিজেকে আড়ালে রাখলো। মেয়েটা করুক ছটফট। বুঝুক শাস্তি কি জিনিস। কষ্ট কি পূর্ণ’র হয় না তার পূর্ণময়ী থেকে দূরে থাকতে? রাতভর কি পূর্ণ ডুবে থাকে সেই শ্যামা মুখটায়? হাজার ব্যাস্ততার মাঝেও তো পূর্ণ তাকে স্মরণ করে। ধৈর্যহীন তো পুরুষ হয়। যেখানে পূর্ণ ধৈর্য ধরে আছে সেখানে কেন মৃত্তিকা এতটা ধৈর্যহীন? নারী মানেই কি ধৈর্য মূর্তি নয়? এতটা আবেগ দিয়ে এই কঠর দুনিয়াতে কিভাবে থাকবে তার মৃত্ত? দুনিয়াটা যে বড্ড নিষ্ঠুর। সেখানে একটা পূর্ণময়ী টিকবে কি করে?

এক ধ্যানে সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা। এক ঘন্টা পর আরেকটা ক্লাস। নাহলে বাসায় চলে যেত। এখন আর ক্লাস শেষে কারো অপেক্ষা করতে হয় না। গত দশটা দিন ঘন্টার পর ঘন্টা এই রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করেছে সে। ছটফট করা হৃদয়টাকে সামাল দিতে ব্যার্থ সে। আজ পর্যন্ত তার দাবি কখনো সুবিশাল ছিলো না। সামর্থ্য থাকা সত্বেও কখনো তেমন কোন দাবি করে নি মৃত্তিকা। এই যে উজ্জ্বল, হিমু সহ ক্লাসের বাকিদের সাথে মিশে থাকে। সাধারণ পোশাক, সাধারণ বেশ ভুসায় নিজেকে রাখে। সাধারণ ভাবে প্রায় রিক্সায় চড়ে বাড়ি ফিরে। কই কখনো তো নিজেকে আলাদা করে রাখে নি। দম্ভ নিয়ে থাকে নি। গরীব ধনী ভিন্ন চোখে দেখে নি। বাবা কখনো ধনী গরিব মানুষের ভেদাভেদ তাকে বুঝতেই দেয় নি। শুদ্ধতম পুরুষ তার বাবা। কিন্তু জীবনের বড় একটা দাবি আছে এখন ওর। একটা পূর্ণ চাই। বললে ভুল হবে এভাবে। এই গম্ভীর, রাগী, হুমকি ধামকি দেয়া পূর্ণ নামক সিনিয়র ভাইকেই তার চাই।
সরল মানুষ গুলোর চাওয়া গুলো হয়তো এমনই। কখনো কোন আদর থেকে বঞ্চিত না হওয়া মেয়েটা এখন বাবা বাদেও অন্য পুরুষ চাইছে। তার সময় চাইছে। একটু আদর মেশানো কথা চাইছে। যা পাচ্ছে না সে। সামনের নিষ্ঠুরতম পুরুষটা দিচ্ছে না তাকে সেই ভালেবাসা।
এতটা অস্থির আগে কারো জন্য হয় নি মৃত্তিকা। গত চৌদ্দটা দিন শুধু বাবা বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছে বলে রাতে ঘুম হয়েছে নাহলে তো তাও হতো না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে ফ্রকটা ঝেড়ে নিলো। হাটা ধরলো ক্লাসের দিকে। ঘন্টা শেষ। অবসরে সেই পূর্ণ’তে ডুবে যাচ্ছে সে। তাহলে কি বাবা ঠিকই বললো? মৃত্তিকা কি পূর্ণ’তে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে?

___________________

দুই দলের একসাথে সমাবেশ আজ। সামনে নির্বাচন। সব দলই উঠে পড়ে লেগেছে। এখানে ছাত্রদল আসবে না। নয়াপল্টনে একদল আর পুরানা পল্টনে আরেকদল। মাঝখানে পুলিশের লোকজন। এখন কোনমতে দুই দল একসাথে হলেই লেগে যাবে সংঘর্ষ। পুলিশ সদা তৎপর ও সচেতন তাই। কখন কি লেগে যায় বলা মুশকিল। তাদের মুশকিল বাড়াতে সেখানে হাজির হলো ছাত্র দল। পুলিশের মাথায় হাত। যেখানে দুই দলই সামাল দেয়া যায় না সেখানে তিন দল? পূর্ণ’র লোকজন যখন স্লোগান দিচ্ছে। একদম সামনের দিকে পূর্ণ সহ তার ছেলেপুলে। দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। পূর্ণ’কে সালাম দিয়ে বলে উঠলেন,

— ভাই আজ আসাটা ঠিক হলো? ছাত্রসমাবেশ তো দুই দিন পর হওয়ার কথা। ঝামেলা বেঁধে যাবে।

বাঁকা হাসলো পূর্ণ। বেশ ঠান্ডা ও নরম স্বরে বললো,

— আমি তো ছাত্র সমাবেশ নিয়ে বের হই নি অফিসার। ব্যানার দেখেন নি নাকি?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লিখা “জনসমাবেশ”। তিনি পরলেন মহা বিপদের মুখে। এখন কিভাবে তাড়াবেন পূর্ণ’কে? একেতো এরা ছাত্র দল। এদের কিছু বলা যায় না তার মধ্যে আজ জনগণের হয়ে সমাবেশ বের করেছে। তাই পুলিশের বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। পূর্ণ শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— পথ ছাড়ুন। ছাত্র সমাবেশ না এটা জনসমাবেশ।

পুলিশ অফিসার ইশারা করতেই পথ ছাড়া হলো। পূর্ণ’র দলবল স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলো। যেদিকে বড় বড় দুই দল এখনও সমাবেশ শুধু করতে পারে নি সেখানে কি না একজন ছাত্রনেতা সমাবেশ চালিয়ে তাদের সামনে দিয়ে গেলো?

পরিস্থিতি আর ঠান্ডা রইলো না। দুটো বড় বড় দলের সামনে দুই দিনের ছেলে যায়? জনগনের নামে বেশ ভালোই বড় সড় মিছিল জমিয়েছে পূর্ণ। তার বরাবর সামনে পুলিশরা। প্রটেকশন দিচ্ছে তাদের। কখন কোন গন্ডগোল হয় বলা মুশকিল। বেশ শান্তিতেই চললো সমাবেশ। এককথায় শান্তি সমাবেশ। কিন্তু সেটা আর অব্যাহত রইলো না। হঠাৎ কিছু ছেলেপুলে দল বল নিয়ে হাজির হলো। এরা কোন দলের বুঝা গেলো না। এসেই কয়েকটা বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিলো৷ মা*রা হলো জিরো পয়েন্টে দুই তিনটা বো*ম। শান্তি সমাবেশ মুহূর্তেই অশান্তিতে পরিণত হলো। হাতাহাতি এক পর্যায়ে চূড়ান্তে পৌঁছালো। পুলিশ পুড়ো তখন বেকায়দায়। রাবার বুলেট ছুড়া হলো। লাভ হচ্ছে না। এখানে দুই দল তো আগেরই ছিলো সেই সাথে জনসমাবেশের লোকজন। এর মধ্যে কে বা কার দলের লোক হাতাহাতি শুরু করেছে বুঝা মুশকিল। পুলিশের ফোর্স বাড়ানো হলো। কাঁদানেগ্যাস ছাড়া হলো৷ এলোপাথাড়ি তখন মারামারি চলছে৷ নেতাদের পুলিশ’রা হাপড়ে ধরে সেফ করে নিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাতিক্রম হলো পূর্ণ’র বেলায়। পুলিশদের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে গেলো না ও। নিজের দল ছেড়ে সে সরবে না। কোথা থেকে হঠাৎ এক ইটের কোণা লাগতেই পূর্ণ’র কপাল বেয়ে র*ক্ত ঝরা শুরু হলো। দলের ছেলেদের ফুঁসানোর জন্য এটাই যথেষ্ট ছিলো৷ পুলিশের একজন তারাতাড়ি রুমাল চেপে ধরলো। পূর্ণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলো ওর দলের কেউ জানি হাতাহাতি না করে কিন্তু কেউ যদি আঘাত করে তাকে পাল্টা আঘাতের অনুমতি দিলো।
সাংবাদিকরা সবটা ধারণ করে যাচ্ছে। হেডলাইনে এই নিয়ে শিরোনাম দখল করলো পূর্ণ পরপর দুই বার। আগে দেখানো হলেও ফুটে উঠলো এবার। এমন জোয়ান, সাহসী নেতাই তো চাই। যে পালাবে না লেজ গুটিয়ে। বীরের মতো বুক পেতে দিবে জনগণের দুর্ভোগে। সাদা পাঞ্জাবি তখন পূর্ণ’র এক অংশ ভিজে লাল হয়ে আছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে বিকেল গড়ালো। বেধরক গ্রেফতার করা হলো দলের লোকজনকে। এদের মধ্যে পূর্ণ বা ওর দলের কেউ নেই৷ পুলিশ সহ সাংবাদিক এমনকি আম জনতা সাক্ষী পূর্ণ আঘাতের স্বীকার। তার দলের লোক কিছু আহত। তাদের উপর হামলা হয়েছে৷ এমনটাই পুলিশের জিটি খাতায় তুলা। সাংবাদিকরা যখন পূর্ণ’কে ঘিরে আছে পূর্ণ তখন শুধু বলেছে,
” আমরা জনগণের জন্য। জনসমাবেশ আমাদের। দলের হয়ে কিছু করিনি৷ যা হয়েছে আপনাদের চোখের সামনে হয়েছে। জানা কথা, দেখা জিনিস আমার মুখে শুনে কি মিথ্যা বা সত্যি হবে?”
ব্যাস ছড়িয়ে গেলো আবারও। এতটা খারাপ অবস্থায় এতটা দৃঢ় এবং আত্মবিশ্বাসী জবাব ই দরকার। এমন একজন বীরপুরুষ ই দরকার। জনগন মেতে উঠলো পুরোভাবে৷
মন্ত্রীদের নজরে পূর্ণ আগেই ছিলো। আজ এলো সাধারণ জনগণের নজরে।
কপালে চেপে ধরা রুমালটা ফেলে দিলো৷ র*ক্তে ভিজে চ্যাপচ্যাপা হয়ে আছে সেটা।

খবর সবই দেখেছে মৃত্তিকা। এতকিছুর মাঝে ওর চোখে ভাসছে পূর্ণ’র র*ক্তাক্ত মুখটা। ছটফটিয়ে উঠেছে তার ছোট্ট হৃদয়টা। লোকটাকে দেখে না আজ চৌদ্দ দিন৷ এখন ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে টিভির পর্দায়। কেমন শক্ত পুরুষ। মাথা দিয়ে র*ক্ত ঝরছে অথচ সে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। পাশেই মৃন্ময় হাওলাদার বসা। টিভি থেকে নজর সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। আলতো হাতে গুছিয়ে বুকে চেপে নিলেন মেয়ের মাথাটাকে।

#চলবে……