#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৭
বৃষ্টি তখনও পড়ে নি। অপেক্ষমান সে সঠিক সময়ের জন্য। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ডেকে যাচ্ছে আকাশ। সেদিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা। সন্ধ্যা হলো বলে। দেখা নেই তখনও পূর্ণ’র। সেই সকালে বের হলো। মৃত্তিকা’কে ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে নিজে কোন এক দলীয় কাজে গিয়েছে। মৃত্তিকা শুধু জানে মনোনয়ন পেয়েছে পূর্ণ।
কারো গলার স্বর কানে যেতেই মৃত্তিকা রুম থেকে বের হলো। ড্রয়িং রুমে টেবিলটাতে কিছু রাখছেন পূর্ণ’র বাবা। উনিই ডেকেছেন মৃত্তিকা’কে। মৃত্তিকা শাড়ীর আঁচলটা ঠিক করে কাঁধে তুলে এগিয়ে গেলো। শাড়ী অবশ্য পূর্ণ’র জন্য ই পড়া হচ্ছে। লোকটার রোজ সকালের আবদার যাতে মৃত্তিকা শাড়ী পড়ে। মৃত্তিকা ও ফেলতে পারে না সেই আবদার। মূলত ফেলতে চায় না। তার ভালো লাগে পূর্ণ’র জন্য সাজতে। নিজেকে প্রস্তুত করতে।
মৃত্তিকা’কে দেখেই চওড়া হাসলেন পূর্ণ’র বাবা। টেবিলে’র উপর কিছু গোছাতে গোছাতে বললেন,
— এদিকে আয় মা। এককাজ কর চা করে নিয়ে আয়। তোর শাশুড়ী আসছে।
হেসে কিচেনে গেলো মৃত্তিকা। শশুর, শাশুড়ী’র সাথে তার দারুন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের আদুরে খরগোশ ছানা মৃত্তিকা। যাকে খুব যত্নে তারা লালন পালন করে। ফুটন্ত পানিতে চা পাতা ছাড়তেই পানিটা রং ধারণ করলো। ফ্রীজ থেকে দুধ বের করতেই দেখলো ওর শাশুড়ী এসেছে এদিকে। শশুর’কে একঝাঁক ঝেড়েছেন ইতিমধ্যে। কারণ হিসেবে রয়েছে কেন মৃত্তিকা’কে এখন রান্না ঘরে পাঠালো।
শশুর’কে বাঁচাতে মৃত্তিকা কিচেন থেকে ডাকলো,
— আম্মু দেখো তো চিনি কতটুকু দিব।
ব্যাস শাশুড়ী থেমেছে। এগিয়ে এসে দুধ,চিনি দিতে দিতে রাগী কন্ঠে বললো,
— তোমার আব্বু বললো আর তুমি কিচেনে হাজির? আর জানি না দেখি।
মৃত্তিকা হেসে শাশুড়ী’র হাত ধরে কিচেন থেকে বাইর করতে করতে বললো,
— আই লাভ টু ডু ইট আম্মু। যাও আসছি আমি।
অল্প হেসে স্বামী’র পাশে গেলেন তিনি। মৃত্তিকা তিনটা চায়ের কাপ হাতে একটু বাদই এগিয়ে গেলো। একদম শাশুড়ী’র গা ঘেঁষে বসে পরলো সোফায় পা তুলে। ঠিক যেমন একটা বিড়াল ছানা তার মালিকের নিকট আদরের আশায় বসে। পূর্ণ’র মা ও চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশংসা করলেন। এটা অবশ্য প্রথম না। প্রায় সময়ই রান্না করে মৃত্তিকা। পূর্ণ’র বাবা প্লেটে থাকা ভাজাপোনা গুলো এগিয়ে দিলো তার পুত্রবধুর নিকট। মৃত্তিকা একগাল হেসে হাতে নিয়ে কামড় বসালো।
কপাল গুনে এমন শশুর বাড়ী পেয়েছে সে। নতুন ভাবে নতুন একজন আব্বু পেয়েছে। আম্মু পেয়েছে সাথে আছে পূর্ণ যে তার ষোলকলা পূর্ণ করে।
মৃত্তিকা’র মনে পরলো কিছুদিন আগের কথা। কতটাই না উদাস মনে এই বাড়ী ফিরেছিলো পূর্ণ’র সাথে। ও জানতো বাবা’র কাছে যাবে অথচ পূর্ণ তাকে এখানে নিয়ে এলো। মন খারাপের সাথে সাথে অভিমানি মৃত্তিকা মনের গহীনে জমায়ি ফেলে একঝাঁক অভিমান। যা ভাঙতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে পূর্ণ’কে। বউ তার সহজে মানে নি। বাবা’কে ফোন দিয়ে নিজের স্বরে কেঁদেছিলো পর্যন্ত যা পূর্ণ তার পূর্ণ্যময়ীর চেহারা দেখেই বুঝেছিলো। সারাটা রাত বুকে নিয়ে কথা বলেছে। মান ভাঙিয়েছে। মৃত্তিকা ও মেনেছে। বুঝেছে। তার বাবা ও তাকে বুঝিয়েছে। সবটুকু মেনে এগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে মৃত্তিকা। সমস্যা একটাই দিন শেষে তার যে বাবা পাওয়া হচ্ছে না। এই তো গতকাল দেখেছিলো অথচ আজ দেখা হয় নি। হাজার কথা হলেও সেই একদেখা’র অদম্য ইচ্ছাটা পূরণ না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। আজও তাই পূর্ণের অপেক্ষায় আছে। সে আসলেই বলবে বাবা’র সাথে দেখা করিয়ে আনতে।
হঠাৎ কন্ঠে মৃত্তিকা চমকালো। মূলত ওর শশুর কিছু বলছিলেন ওকে অন্যমনস্ক দেখে। মৃত্তিকা চমকাতেই ওর শাশুড়ী ধমকে উঠলেন শশুর’কে,
— মেয়েটা ভয় পেয়ে গেলো আমার। এভাবে ষাঁড়ের মতো চিল্লাও কেন?
— স্বামী’কে ষাঁড় ডাকে কেউ?
— আমি ডেকেছি, কি করবা তুমি?
— আসুক আমার ছেলে বিচার হবে আজ। সম্মান দাও না আমাকে।
মৃত্তিকা হতভম্ব হয়ে গেল। পুরোদমে দুইজন ঝগরা করে যাচ্ছ। মনে হচ্ছে যেই কোন মুহূর্তে মাথা ফাটাফাটি লেগে যাবে। একবার শাশুড়ী তো একবার শশুর’কে থামাতে চাইলো মৃত্তিকা। কেউ ই থামার পাত্র নয়। হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্তিকা উঠে দাঁড়ালো। শশুরের সামনে গিয়ে থামাতে চাইলেই পূর্ণ’র বাবা ওর হাত ধরে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মৃত্তিকা ভাবলো ওর শাশুড়ী হয়তো থামাবে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ওর শাশুড়ী মুখে পাকড়া গুজে টিভিতে নজর দিলেন।
________________
গাড়িটা নিজের বাসার সামনে থামতে দেখে মৃত্তিকা অবাকই হলো। শশুরের দিকে তাকাতেই দেখলো তার মুখ জুড়ে হাসি৷ মৃত্তিকা টলমলে চোখে নিজে ও হাসছে। পূর্ণ’র বাবা ওর চোখের কোণে থাকা পানিটুকু মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
— কেমন ঠপটা দিলাম তোর শাশুড়ী’কে?
মৃত্তিকা এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। দুইজন বেরিয়ে বাড়ীতে ঢুকতেই দেখলো মৃন্ময় হাওলাদার সোফায় বসা। মিঠি ওকে দেখেই আপা বলে দৌড়ে এলো। মিঠি’র মা কেমন মৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটাকে নিজের হাতে ছোট থেকে বড় করেছেন। তার বুকেও যে ব্যাথা হয় মৃত্তিকা নামক মেয়েটার জন্য। সে কি জানে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা? যেদিন জানবে কিভাবে সামলাবে নিজেকে? পরক্ষণেই ভাবলেন, সামলানো তো দূর মৃত্তিকা নামক অস্তিত্বটাই হয়তো ঐদিন মিটে যাবে।
বাবা’র বুকে ঢুকে একদম গুটিয়ে গেলো মৃত্তিকা। মৃন্ময় হাওলাদার যতটুকু জানেন পূর্ণ বলেছিলো আজ আনবে না। ভাগ্য ভালো থাকায় বেঁচে গিয়েছেন। সময়টা উনিশ বিশ হলেই আজ খারাপ কিছু ঘটে যেত। মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বুকে চেপে রাখলেন তিনি।
পূর্ণ’র বাবা ও হেসে এগিয়ে বরাবর বসলেন। কথা হলো বেশ সময়। মৃন্ময় হাওলাদারের জোড়াজুড়িতে রাতে খেতে বাধ্য হলেন তারা। মৃত্তিকা বুঝলো না কিভাবে কিন্তু ঠিক খাওয়ার আগ মুহূর্তে পূর্ণ হাজির সেখানে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের বাবা’কে দেখে বললো,
— আমার বউ নিয়ে তুমি রাত বিরাতে রাস্তায় ঘুরো কেন আব্বু? আজ বাসায় চল দেখো কি করি। না নিজে বউ নিয়ে শান্তিতে থাক না আমাকে বউ নিয়ে শান্তিতে থাকতে দাও। যত জ্বালা আমার।
মৃন্ময় হাওলাদার তখন পাশে ছিলেন না। মৃত্তিকা অবশ্য টুকটাক ইদানীং এমন সব পূর্ণ’র উদ্ভব কথা হজম করা শিখেছে। মৃন্ময় হাওলাদার পূর্ণ’কে দেখে মুচকি হাসলেন বিনিময়ে পূর্ণ জড়িয়ে ধরলো তাকে।
রাতের খাবার খেয়ে বাবা’কে আবারও একবুক কষ্ট নিয়ে বিদায় জানিয়ে মৃত্তিকা ফিরে এলো পূর্ণ’র হাত ধরে।
মৃন্ময় হাওলাদার মেয়ে’র যাওয়া দেখলেন। কেউ না দেখলেও তার চোখে একদিকে যেমন মেয়ে’র সুখ স্পষ্ট ঠিক তেমনই তার রাজকন্যা’র বেদনাটাও স্পষ্ট। তাকে ছাড়া হাজার ভালো থাকার মধ্যে ও ভালো নেই তার রাজকন্যা। অথচ তিনি যেন আজ কাঙ্গাল। চেয়েও তার হাত আজ রিক্ত। অতীত কাউকে ছাড়ে না। তাকেও ছাড়বে না। সময় থাকতে সবটা গুছাতে চান তিনি। যেতে হবে তাকে। মনের বিরুদ্ধে, খুব অন্তরালে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি যা বাস্তবায়ন তাকে করতেই হবে। লোভ সবার ই থাকে। কারো টাকার, কারো ক্ষমতা’র, কারো বেঁচে থাকার তো কারো ভালেথাকার।
মৃন্ময় হাওলাদার ও ভালো থাকতে চান। তার রাজকন্যা’কে নিয়ে সুখে থাকার চাওয়াটা নিশ্চিত খুব বড় চাওয়া নয় অথচ আজ মনে হচ্ছে না চাওয়াটা খুব বড়। ভীষণ দামি। নয়তু এটতা কেন ভুগছেন তিনি?
________________
বিছানা গুছিয়ে মৃত্তিকা নিজের বইগুলো গুছিয়ে রাখলো। বাইরে তখন ঝড়ো হাওয়া বহমান। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় কোন এক ঝড় উঠেছে তারই রেশ ঢাকা শহর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। এমনিতেই নভেম্বর মাস। শীত আসবে আসবে ভাব। এখনও আসে নি। মৃত্তিকা শীত প্রেমি মানুষ। তার ভীষণ পছন্দের এই আবহাওয়া। আলগোছে বারান্দার দরজাটা খুলে মৃদু আলোতে থাকা বারান্দায় গেলো। ওমনিই ঠান্ডা এক ঝাপটা লাগলো সারাদেহে। শীতলতা বয়ে গেলো অঙ্গজুড়ে। নরম হাতটা বাড়িয়ে দিলো বাইরে ওমনিই টুপটাপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি হাতে পরলো। অতি ঠান্ডা এই কণা গুলো শিহরণ বহালো মৃত্তিকা’র বদনে। এটা বুঝি কম পড়লো?
নিজের হাতের নিচে বড় একটা হাতের অস্তিত্ব টের পেলো মৃত্তিকা। পেছনে ঘুরতেই ধাক্কা খেলো তার পুরুষটার উষ্ণ বুকে। পূর্ণ সরলো না বরং চাপলো একটু। যতটুকু কাছে আসা যায় সবটুকু আসলো সে। মৃত্তিকা নিজের হাতে থাকা বৃষ্টি’র পানিটুকু ছিটিয়ে দিলো পূর্ণ’র মুখে। হঠাৎ এহেন কান্ডে পূর্ণ মুখ কুঁচকে নিলো। মৃত্তিকা’র কিটকিয়ে হাসা হাসিটা যেন এমন আবহাওয়ায় পূর্ণ’র নিকট বেশ লাগলো। ঝিমঝিমিয়ে উঠলো তার দেহ। নিজের ঠান্ডা হাতে’র স্থান দিলো মৃত্তিকা’র কোমড়ে। টেনে একদম কাছে এনে নিজেও পানি ঝিটালো মৃত্তিকা’র মুখে। মৃত্তিকা মুখ সরিয়ে তখনও হেসে যাচ্ছে। পূর্ণ’র আদুরে লাগে এই নারীকে। যেমনটা কোন তুলতুলে বিড়াল ছানা। মৃত্তিকা’কে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো পূর্ণ। থমকে যাওয়া গলায় জানালো,
— আপনি আমার নভেম্বরের বৃষ্টি মৃত্ত। আপনি আমার সেই বৃষ্টি যে শীতলতা আনে। যে তীব্র গরমকে ঠান্ডা করার ক্ষমতা রাখে। যে নিজের সবটুকু দিয়ে তার প্রেমিক’কে আগলে রাখে।
— আপনি তো প্রেমিক না। ভুলে গেলেন?
— উহু ভুলি নি। আপনার সাথে সম্পৃক্ত কিছুই ভুলার নয় আমার।
— সত্যি?
— একদম।
বলেই কোলে তুলে সোজা রুমে চলে গেল পূর্ণ। মৃত্তিকা দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে আর্জি জানালো,
— আইসক্রিম খাব।
— একদমই না মৃত্ত। প্রয়োজনে আমাকে খাবেন তবুও আইসক্রিম না।
— নামান আমাকে। খারাপ লোক।
পূর্ণ’র ঠোঁটে বাঁকা হাসি। বিছানা থেকে মৃত্তিকা নামতে নিলেই পূর্ণ আটকে নিলো। টেনে বুকে নিতেই মৃত্তিকা বললো,
— আম্মু রাগ করেছে আব্বু’র সাথে। দেখে আসি।
— কোন দরকার নেই। গেলেই দেখবেন দুইজন দুইজনকে বিড়ালের মতো ঘঁষাঘঁষি করছে।
— ছিঃ চুপ থাকুন।
— আজব আমি কি বললাম?
— আপনি একটা লাগামহীন ঘোড়া।
— এই যে আম্মু’র সাথে থাকার সাইড ইফেক্ট এটা। আব্বু’কে ষাঁড় ডাকে আপনি শিখলেন কি না ঘোড়া ডাক?
— ঘুমান আপনি।
— আপনাকে লাগবে।
বলেই টেনে নিলো নিজের কাছে। কানে ঠোঁট লাগিয়ে কিছু বলতেই মৃত্তিকা মুখ লুকালো পূর্ণ’র কাঁধে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
— পঁচা লোক।
— আপনারই তো।
— কথা নেই।
— দরকার নেই।
পূর্ণ’র দুষ্টামি শুরু হলো। মৃত্তিকা হার মানলো তার সামনে। কখন, কিভাবে, কেন জানা নেই কিন্তু মৃত্তিকা আটকে গিয়েছে এই পুরুষে। সম্পূর্ণ ডুবেছে এই সুদর্শন পুরুষে। তাকে ছাড়া যেন শ্বাসটাও মৃত্তিকা’র আসতে চায় না। বাবা’র পর একদম নিজের বলতে মৃত্তিকা তার জীবনে এই পুরুষটাকে ভীষণ ভালোবাসে।
#চলবে…