শান্তি সমাবেশ পর্ব-৩২

0
764

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩২

পূর্ণ’র প্রচারণা বেশ জমকালো ভাবেই চলছে। উপরন্তু তার ভালো হচ্ছে কারণ তার উপর রয়েছে বড় বড় নেতাদের হাত। সাথে জনগণ তাকে চায়। সব মিলিয়ে পূর্ণ এবার টিকে যেতেও পারে। ভাসা ভাসা খবর ভেসে আছে কানে। শোয়েব মির্জা শুধু রাগে ফুঁসছেন। টাকা ঢেলে এই পর্যন্ত অনেক করেছেন কিন্তু না, বিশ্বাস পাচ্ছেন না তিনি। আদৌও কি টিকতে পারবেন কি না বুঝা যাচ্ছে না। আজ অবশ্য তাদের এক বিপক্ষ প্রতিনিধি’কে তিনি বসিয়ে দিবেন। এই লোক আবার আগে কখনো নির্বাচনে দাঁড়ায় নি। সরকারি কলেজের ভিসি। লোভে পড়েই মূলত তিনি নির্বাচন করছেন। শোয়েব মির্জা তাকে বসাতেই টাকা ঢালছেন। না জানি তার পক্ষের ভোট না আবার ঐ ভিসি’র পক্ষে পড়ে। এমনিতেই পূর্ণ তার ঘাড়ে চড়ে আছে তারমধ্য ভিসি যেন মরার উপর খাড়া! রাগে দপদপিয়ে উঠে শোয়েব মির্জা। মাহিন মিয়া শুধু তার স্যার’কে দেখেন। লোকটার মাথার চুল আসলেই রোদে সাদা হয় নি। পান খাওয়া দাঁত বের করে মাহিন মিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। সাহস জুগিয়ে উগলে দিলেন,

— স্যার ভিসিকে টাকা পাঠানোর কথা ছিলো আজ।

শোয়েব মির্জা একঝলক তাকালেন মাহিন মিয়া’র দিকে। পরপর মাথাটা ইজি চেয়ারটাতে এলিয়ে দিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,

— সাফারাত টা হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

— ছোট বাবা তো এখন অনেকটাই স্বাভাবিক স্যার।

— ওর এই স্বাভাবিক ভাবটাই আমি নিতে পারছি না মাহিন। ভয় হয় আমার। এই রাজনীতিতে আমি আমার জীবন দিয়েছি। শেষ বয়সে এসে সুযোগ খোয়াতে চাইছি না।

— ভিসি টাকা’র জন্যই দাঁড়িয়েছে স্যার। জানে আপনি নয়তো অন্য পার্টি তাকে বসাতে সুপারি ছাড়বে।

— আজ রাতেই টাকা পাঠানো হবে। ভিসি’কে পথ থেকে সরাও।

— জ্বি স্যার।

মাহিন মিয়া চলে গেলেন। মেলা কাজ এখন। রাতের আঁধারে টাকা পাচার হলো ভিসি’র অফিসে। ছয়টি সাবানের কেস ভর্তি টাকা পাঠানো হলো লোকচক্ষু’র সামনে সাথে এক মুন মিষ্টির বাক্স। শোয়েব মির্জা জানেন ঠিক সকালেই খবর পাওয়া যাবে যে ভিসি নির্বাচন থেকে পিছিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তবুও সমস্যা যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা। পূর্ণ নামক সমস্যা।
.
বাবা’র বুকে মাথা ঠেকিয়ে সোফায় পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে মৃত্তিকা। মাত্র গত দিনই বাবা’র কাছে আসতে পারে নি সে। এতেই তার রাজ্যের দুঃখ। পূর্ণ’র নামে বিচার দিলো বাবা’কে,

— উনি আমাকে গতকাল নিয়ে আসে নি আব্বু। আমি আজ যাব না৷ ওনাকে কল দিয়ে বলো যাতে আমাকে নিতে না আসে।

— আচ্ছা দিব।

— না না এখনি দাও। নাহলে আবার নিতে আসবে।

— এখন তো প্রচারণায় ব্যাস্ত আম্মা। একটু পর দেই?

— আচ্ছা।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মৃত্তিকা বাবা’র বুক থেকে মুখটা তুললো। চোখ পিটপিট করে বললো,

— বিরিয়ানি খাব।

চমৎকার হাসির দেখা মিললো মৃন্ময় হাওলাদারের মুখে। মেয়ের কোঁকড়ানো চুলে চুমু খেয়ে বললেন,

— চলুন। এখনই বানাব।

মৃত্তিকা উঠতে উঠতে চুলে হাত খোঁপা বেঁধে নিলো। একসাথে বাবা মেয়ে রান্না বসালো। সময়টা তাদের বেশ কাটলো। মৃত্তিকা যেন ভুলেই বসলো পূর্ণ নামের কেউ যে আছে তার জীবনে।

রান্না হতেই মৃন্ময় হাওলাদার চা বসালেন। বাবা-মে একসাথে বারান্দায় খাবে। পাশেই অন্য চুলায় মৃত্তিকা পাকোড়া ভাঁজছে। মৃন্ময় হাওলাদার মৃত্তিকা’কে ফ্রেশ হতে পাঠাতেই পেয়ালাতে তেল গরম দিলেন। মেয়েটা তার তেল দেখতেই পারে না। কত সুন্দর কোঁকড়ানো চুল গুলোতে তেল লাগাতে দিবে না। আজ একদম বেশি করে তেল লাগাবেন তিনি এতে যদি তেঁতে উঠে তো উঠবে। মেয়ের এই কোঁকড়ানো চুলগুলো তার বড্ড সখের।

বাবা’র হাতে চায়ের ট্রে দেখেই মৃত্তিকা আগে আগে বারান্দায় চলে গেল। এটা তার বাবা’র রুমের বারান্দা। অবশ্য অন্যান্য পরিবারের ন্যায় মৃত্তিকা’র পরিবার না। প্রায় সময় মৃত্তিকা এসে বাবা’র রুমে শুয়ে বসে থাকে। বাবা’র আলমারি খুললেও দেখা যাবে দুই একটা মৃত্তিকা’র কাপড় বা ড্রেসিং টেবিলে তার ক্লিপ পড়ে আছে। চা খেতেও বাবা’কে শান্তি দিবে না মৃত্তিকা। মৃন্ময় হাওলাদার বরাবরই একটু লিকার বেশি পছন্দ করেন। মৃত্তিকা নিজের টা তো খাবেই সাথে বাবা’র কাপে ও তার একচুমুক দিতেই হবে। নাহলে শান্তি নেই।
চা শেষ হতেই মৃন্ময় হাওলাদার মেয়েকে জোড় করে বসালেন। মৃত্তিকা আগেই বলেছে তেল অল্প দিতে। কিন্তু না মৃন্ময় হাওলাদার আজ মানেন নি। কথায় কথায় চুল ভর্তি তেল দিলো। ততক্ষণে মিঠি এসেছে। আসন পেতে বসেছে মৃত্তিকা’র বরাবর বারান্দার ফ্লোরে। এশারের আজান পড়তেই মৃন্ময় হাওলাদার মেয়েকে নিয়ে উঠলেন। চুলে একটা বেণী করে দিয়েছেন।
বাবা’র হাতেই আজ মৃত্তিকা খেয়েছে। গল্প করতে করতে একসময় বাবা’র আদরের কন্যা বাবা’র বুকে ঘুমিয়ে গেলো। কলিং বেলের শব্দ শুনে মিঠি বললো,

— আমি দেখে আসি মামা।

বলেই দৌড়ে গেলো। পূর্ণ দাঁড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে। বউ নিতে এসেছে সে। মিঠি চওড়া হেসে সালাম জানিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকাতেই পূর্ণ বললো,

— মৃত্ত কোথায়?

— মামা’র রুমে।

— ওহ।

বলেই পূর্ণ মৃন্ময় হাওলাদারের রুমের কাছে এলো। মৃন্ময় হাওলাদার ওকে আসতে দেখেই বুক থেকে মেয়েকে বালিশে রাখলেন সযত্নে। আলতো হাতে। কাঁচের পুতুল এটা তার যদি আঁচ লেগে যায়?
পূর্ণ অলস ভঙ্গিতে সোফায় বসতেই সালাম জানিয়ে বললো,

— আজ দেড়ী হলো বাবা।

— আগে ফ্রেশ হও। পরে কথা হবে।

পূর্ণ ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো মৃন্ময় হাওলাদার খাবার হাতে দাঁড়িয়ে। অল্প হেসে পুণরায় সোফায় বসলো ও। মৃন্ময় হাওলাদার নিজে সার্ভ করতে করতে বললেন,

— নিশ্চিত ক্লান্ত। ডাইনিং পর্যন্ত যেতে হবে না।

— মৃত্ত খেয়েছেন?

— হ্যাঁ। তার ফরমাইশেই বিরিয়ানির আয়োজন।

পূর্ণ মুখে দিয়েই প্রশংসা করলো। মৃন্ময় হাওলাদার জানালেন তার মেয়েও সাহায্য করেছে। পূর্ণ খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলো,

— বিচার দেয় নি আমার নামে?

— দিলো তো। শুনলাম।

— বিচার করবেন না?

— ছেড়ে দিতাম না আমার আম্মা’র বিচরটা নিছক না হলে।

— জানি। ঘুমালো যে?

— যাবেন না আজ। আমাকে বলেছিলো তোমাকে জানাতে। ব্যাস্ত ভেবে কল দেই নি।

— ওনার জন্য আমি কখনোই ব্যাস্ত না আব্বু। ইউ ক্যান কল মি এ্যাট এনি টাইম।

— আগামীর এমপি এই কথা বলছো।

— ভালো কথা আব্বু। কিছু কথা ছিলো।

অতঃপর তাদের রাজনৈতিক আলাপ হলো। মাঝে খাওয়া শেষ হতেই মিঠি’র মা সব নিয়ে গেলেন। মিঠি এগিয়ে কফি দিয়ে গেলো পূর্ণ’কে। এটা অবশ্য মৃন্ময় হাওলাদার ই বলেছিলেন। কথা পূর্ণ’র সাথে বললেও হাত তার অনবরত চলছে মৃত্তিকা’র চুলে। পূর্ণ শশুড় থেকে রাজনীতি’র জ্ঞান নেয়। তার পরামর্শ কাজে লাগে তার। এককথায় চমৎকার ভাবে তিনি ওকে উপদেশ দেন। যদিও আগে পূর্ণ বিভিন্ন ভাবে নিজের ক্ষতি করে বিভিন্ন কাজ হাশিল করেছে তবে মৃন্ময় হাওলাদার তাকে ভিন্ন পথ শিখিয়েন।
তাদের আলাপ শেষ হতে হতে রাত ১২ টার উপর বেজে গেলো। পূর্ণ মৃন্ময় হাওলাদারের দিকে তাকিয়ে বললো,

— বউ নিয়ে যাই তাহলে।

হাসলেন মৃন্ময় হাওলাদার। অনুমতি দিলেন চোখের পলক ফেলে। একবার তার মনটা বললো যাতে বলেন পূর্ণ ও যাতে থেকে যায় কিন্তু তা করলেন না তিনি। ঘুমন্ত রাজকন্যা কোলে তুলে নিজের পাজা করে। গাড়ির ভেতরে ঠিক পূর্ণ’র কোলে মাথাটা দিয়ে পা দুটো সিটে গুছিয়ে রেখে বললেন,

— মাথাটা ধরো। আর কাল চুল ধুয়ে নিতে বলো। রেগে ছিলো এত তেল দিয়েছি বলে।

সম্মতি জানিয়ে পূর্ণ বিদায় নিলো। রোজ আসা হয় মৃত্তিকা’র এখানে তবুও প্রতিবার মৃন্ময় হাওলাদারের চোখে কাতরতা দেখে পূর্ণ। মধ্যবয়স্ক শক্ত পুরুষটা অশ্রু লুকাতে প্রতিবারই মাথা নামাবে অথবা এমন ভাব ধরবে যেন চোখে কিছু পড়েছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পূর্ণ তাকালো তার মৃত্ত’র দিকে। আলগোছে চুমু খেয়ে নিলো তার নাকে। নিশ্চিত ঘুম থেকে উঠলেই তার রাগ হবে। তখন মিষ্টি মিষ্টি আদরে পূর্ণ্যময়ীর অভিমান ভাঙাবে পূর্ণ।

#চলবে…