শান্তি সমাবেশ পর্ব-৩৮

0
666

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮

“বিপুল ভোটে এই বার এমপি পদে আসন্ন হয়েছেন রওনাফ ওয়াহাজ পূর্ণ।”
হ্যাঁ টিভির পর্দায় এই শিরোনামটাই দেখা যাচ্ছে। একে একে ব্যাস্ত আঙুল চালিয়ে চ্যানেল পাল্টায় মৃত্তিকা। সব জায়গায় একই খবর। খুশিতে হঠাৎ শ্যামা কন্যাটা কেঁদে ফেললো। পাশ থেকে একজন গর্বিত মা জড়িয়ে ধরে ওকে। মৃত্তিকা তার কাঁধে মাথা রাখে। খুশি হলেও তার ভেতর ছটফট করে যাচ্ছে। পূর্ণ’টার বুকে ঢুকতে পারলে হয়তো উল্লাসটা আরেকটু বৃদ্ধি পেত। টিভির পর্দায় তখন দলের মধ্যে থেকে দেখা যাচ্ছে পূর্ণ’কে। মাথা উঁচু করে ঠাই দাঁড়িয়ে সদ্য হওয়া এমপি মহাশয়। তাকে ডাকা হলো জনসমাগমে ভাষন দিতে। পূর্ণ আস্তে ধীরে হেটে এলো মাইকের সামনে। শুরুতেই সালাম জানিয়ে বলা গা ঝাড়া দিয়ে গম্ভীর অথচ বলিষ্ঠ গলায় বলা শুরু করলো,

–” আমার উপর আপনারা ভরসা করে যেই পদটায় আজ আমাকে দাঁড় করালেন সেই পদটার মর্যাদা এবং আপনাদের বিশ্বাস ধরে রাখার আমৃত্যু চেষ্টা করে যাবে।”

জনগন হৈ হুল্লোড় করে উঠলো। কড়া তালির শব্দ শুনা গেলো। এমন একটা ভাষন শুনা যায় না আজ কাল। কেউ জনগনকে স্মরণে রাখে না। সবাই এই তাগড়া যুবকের কন্ঠে সন্তুষ্ট। পূর্ণ পুণরায় বলা শুরু করলো,

–” আজ রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ আমার উপর হামলা হয়। পেছন থেকে কাপুরুষের মতো গুলি ছুঁড়া হয়েছিলো যা আল্লাহর রহমতে আমার অতি নিকট একজন মানুষের দায় আমাকে ততটা ক্ষতি করতে পারি নি। তবে আমি আহত। আমার কাঁধ ছুঁয়ে গিয়েছে সেটা আর বাহুতে লেগেছে যে আমাকে বাঁচালো। এর দোষীর শাস্তি ও আমি জনসম্মুখে দিব। কাপুরুষের ন্যায় সে হয়তো আমাকে পেছন থেকে আক্রমণ করেছে তবে তার শাস্তি আমি লুকিয়ে না বরং আইনের সাহায্য সকলের সামনে দিব।”

অতঃপর সালাম জানিয়ে স্টেজ ত্যাগ করে পূর্ণ। জনগন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেউ কেউ গালি ছুঁড়ছেন কে আক্রমণটা করলো। শাজাহান খান ততক্ষণে পুলিশ অফিসারদের ঠাঁটের উপর রেখেছেন। তদন্ত চলছে।
এদিকে মৃত্তিকা’কে আটকে রাখা যাচ্ছে না। পূর্ণ’র মা একা ধরে রাখতেও পারলো না। মেয়েটা দেখলো ছেলেটা ততটা আহত নয় তবে গুলি লেগেছে এটা শুনেই সে পাগলপ্রায়। ওর মা কোনমতে ড্রাইভার ডেকে গাড়ি নিয়ে বের হলেন। পথিমধ্যে স্বামী’কে কল দিয়ে জানলেন পূর্ণ’কে ড্রেসিং করতে তারা আবার হসপিটালে গিয়েছেন। গাড়িটা হসপিটালের উদ্দ্যেশেই বের হলো।
পৌঁছাতেই মৃত্তিকা দৌড়ে বের হলো। রিসিপশনের সামনেই পূর্ণ’র বাবা দাঁড়িয়ে। পাগলের মতো মেয়েটাকে ছুটে আসতে দেখেই নিজে আগলে নিলেন। হাপড়ের ন্যায় কাপা কন্ঠনালী ভেদ করে আর মৃত্তিকা’র শব্দ বের হলো না। উনার বলার অবশ্য প্রয়োজন ও পড়লো না। উনি ধরে ওকে পূর্ণ’র ড্রেসিং করা কেবিনে নিয়ে এলেন। মাত্র ই ড্রেসিং শেষ হওয়াতে গায়ে পাঞ্জাবি জড়ানোর সময় পেলো না পূর্ণ। দমকা হাওয়ার ন্যায় একটা শীতল স্পর্শ তাকে ছুঁয়ে গেলো যখনই দেখলো শুধু মাত্র তার জন্য কেউ এমন পাগল হয়ে ছুটে এসেছে। পূর্ণ’র কাঁধে সাদা ব্যান্ডেজটা দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মৃত্তিকা। ওর এহেন কান্না আজ পর্যন্ত হয়তো পূর্ণ দেখেনি। পূর্ণ তো দূর মৃন্ময় হাওলাদার নিজেই হয়তো বড় হওয়ার পর মেয়ের এমন কান্না দেখেন নি। রেখেছেন যাকে বুকে ভরে তার এরুপ কান্না আসবেই বা কোথা থেকে?
পূর্ণ আশ্চর্য হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলো। হঠাৎ খেয়াল হলো ওর বুকের বা পাশটায় ছুড়িঘাতের ন্যায় ব্যাথা হচ্ছে। কেন কাঁদে তার পূর্ণ্যময়ী এভাবে? পূর্ণ’র জন্য? এই এতটুকু আঘাতের জন্য একজন তার জন্য এভাবে কাঁদে?
মৃত্তিকা’র কান্না শুনে পাশের কেবিন থেকে মৃন্ময় হাওলাদার বেরিয়ে এলেন। পূর্ণ থেকে গুরুতর অবস্থা তার। আঘাত হওয়ার সময় তিনিই পূর্ণ’কে টেনে সরাতে যান যার দরুন বু*লে*টটা পূর্ণ’র কাঁধ ঘেঁষে লাগে একদম তার বাহুতে লাগে। জখম ততটা না আবার কমও না।
দূর্বল শরীরে ই মেয়ের এইরুপ কান্না শুনে টিকতে পারেননি। এসেই যেই না উনি মৃত্তিকা ধরেন ওমনিই ও খেয়াল করলো বাবা’র হাতে ব্যান্ডেজ। অশান্ত ভাবে বাবা’র দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ংকাল। কান্না থেমেছে। অস্পষ্ট স্বরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস ডাকলো,

— বাবা।

— হ্যাঁ আব্বু। কাঁদে না। পূর্ণ ঠিক হয়ে যাবে।

— হাতে? তোমার…

লুকাতে চান মৃন্ময় হাওলাদার। অল্প হেসে বলেন,

— কিছু না আম্মা। একটু লেগেছে…

আর বলা হয় না। ঢলে পড়ে মৃত্তিকা বাবা’র বুকে। অস্থির হয়ে উঠেন তিনি। ভালো হাতটা দিয়ে বুকে চেপে ধরেন মেয়েকে। ছটফট করা তার হৃদয় অথচ নিজেকে বাইরে রেখেছেন শান্ত। এদিকে ততক্ষণে বেড থেকে পূর্ণ নামে। অস্থির হয়ে ডাকে,

— মৃত্ত? মৃত্ত!!

সাড়া আসে না। পূর্ণ’র বেডেই ওকে শুয়ানো হলো। ডক্টর চেক করে জানায়, অতিরিক্ত চিন্তায় বা শক পেয়ে এমনটা হয়েছে। মৃন্ময় হাওলাদার বা পূর্ণ কারোই বুঝতে বাকি নেই কি হয়েছে। বাবা’কে দেখেই মেয়েটা সহ্য করতে পারে নি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। জ্ঞান ফিরতে প্রায় মিনিট বিশ এক সময় লাগাতে পূর্ণ যেন পাগল হয়ে উঠে। এত সময় কেন লাগবে ওর মৃত্ত’র জাগতে? মৃন্ময় হাওলাদার মেয়েকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। মেয়েটা তো তার এতটুকু কষ্ট ই সহ্য করতে পারে না যখন ভয়াবহ সেই সত্যিটা জানবে তখন কি হবে? কিভাবে সামাল দিবে মৃন্ময় হাওলাদার?
______________

রাস্তায় যেমন মাঝেমধ্যে পাগল কুকুর দেখা মিলে আজ ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে শোয়েব মির্জা’কে। কাকে কামড়ে উঠে বলা মুশকিল। এই প্রথম তার সকল চাল বৃথা গেলো। মাহিন মিয়া চুপচাপ তার স্যার’কে দেখে যাচ্ছে। তার বাবা ছিলেন শোয়েব মির্জা’র বাবা’র সেবায়, তিনি আছেন শোয়েব মির্জা’র। মিয়া বাড়ীর সকলেই মির্জা বাড়ীর লোক হিসেবে খেটে গিয়েছে। শোয়েব মির্জা’র বউ থাকতে এই মির্জা বাড়ী ছিলো রমরমা। বেশ হাসিখুশি একজন নেতার বউ এক সুঠাম পুরুষের মা ছিলেন তিনি। এই পুরোটা সংসার একহাতে সামলেছেন। শোয়েব মির্জা’র মা মারা যান তার বিয়ের বছর গড়াতেই। কে সামলালো এউ সংসার? সাফারাতের মা ই তো। নারীটা ছেলের শোক মানতে না পেরে দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন। প্রায় বছর খানিক সদর দরজাটা ধরে বসে ছিলেন কবে আসবে তার রাত। সেই অপেক্ষা তার ফুড়ালো কবরে গিয়ে। বেঁচে থাকতে আর নিজের সোনার টুকরো ছেলেকে দেখা হয় নি তার। যখন মারা যান সেদিন শোয়েব মির্জা কেঁদেছিলেন। একাকৃত্ব কাকে বলে তা টের পেয়েছিলেন। চেয়েও তখন সাফারাত’কে মায়ের কাছে আনা যায় নি। সম্ভব ই হয় নি। কিভাবে হবে? একজন মানুষিক রুগী কি বুঝে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা, তার মা যে ঐ দিন রাতে দুনিয়া ত্যাগ করেছিলো তারই অপেক্ষায়।

দোতলা থেকে হাসি হাসি মুখে বাবা’র পাগলামি দেখে সাফারাত। এখানেই শেষ নয় বরং খেলা মাত্র শুরু। কিভাবে রাগ ঝাড়ছে। এই বুঝি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেই ফেলেন। সন্তান হিসেবে মায়া হয় না সাফারাতের। একটুও না। বরং পৌচাশিক আনন্দ আজ তার অন্দরমহলে। একটা বার যদি তার বার্ড’কে ব্যাপারটা জানানো যেত। কতই না খুশি হতো তার রুহা। হ্যাঁ, হতোই তো। সাফারাত হঠাৎ ভাবনায় ডুবে,

~ বাবা তাকে ডাকিয়ে দেশে আনার পরপরই সাফারাতের ফোনটা সবার আগে কেঁড়ে নেয়া হয়। জানানো হয় শাজাহান খান এর বড় মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক। যেই সেই ঠিক না একদম মুখে মুখে ডেট ও ফিক্সড। সাফারাত ছুট লাগায় মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ছেলেটা। মা ভরসা দেন কথা বলবে বাবা’র সাথে। শোয়েব মির্জা’কে হাজার বলে কয়েও লাভ হলো না। ক্ষমতার নেশায় বুদ তখন তার মন মস্তিষ্ক। সেই মন ভালোবাসা চিনে না। বুঝে না বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন। শেষ উপায় হয় না কিছুই। সাফারাত খাওয়া ত্যাগ করে। শরীর যখন তার অসুস্থ সারাদিন তখন ঘড়ের মেঝেতে তার স্থান। ছেলের এহেন অবস্থান ওর মা সহ্য করতে পারে নি। স্বামী’র পায়ে পরে যান। হাজার হোক শোয়েব মির্জা ভালোবাসেন তার স্ত্রী’কে। এই স্ত্রী, সন্তান দুইজন মানুষ একান্ত তার। মন মানলেও মানে না তার মস্তিষ্ক। সেদিন যখন সাফারাতের র*ক্ত বমি হলো তখন ওর মা নিজের কসম দিয়ে ওর চিকিৎসা করান। কিছুটা খাওয়ান। লাভ হয় না। সাফারাত কেঁদে কেঁদে মায়ের বুকে অভিযোগ জানায়,

— আম্মু আমাকে রুহা এনে দাও। ও আমার স্ত্রী আম্মু। বিয়ে করে ফেলেছি আমি। আমার কলিজাটা জ্বলছে আম্মু। ওর ভেতর আমার জানটা আছে। ওকে এনে দাও। আমাকে যেতে দাও। ও নিশ্চিত এতদিন না পেয়ে কাঁদছে। ও পারবে না আমাকে ছাড়া থাকতে।

ছেলের ব্যাথায় ওর মা দিশেহারা। কিন্তু এদিকে তার স্বামী ও নাছোরবান্দা। সাফারাত’কে আগলে নিয়ে শুধু বলেন,

— পালাতে পারবি রাত?

— আগামী কাল বিয়ে আম্মু। আব্বু’র লোক চারদিকে।

— আমি ব্যাবস্থা করব। তুই পালাবি শুধু। পারবি না?

— পারব।

ওর মায়ের বুক তখন ভয়ে কুঁকড়ে। না জানি কোন বিধ্বংস রচনার রাত ছিলো সেটা।

#চলবে…..