শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব-২৩+২৪

0
624

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৩)

শালুক নিজের ফাইলপত্র সব শক্ত করে ধরে কোনো দিকে না তাকিয়ে হাটতে লাগলো সামনের দিকে।কিছুটা সামনে এগুতেই আদনান পিছু নিলো তার।

শালুক দ্রুত পায়ে হাটতে লাগলো কিন্তু আদনানের সাথে পেরে উঠলো না।
আদনান এগিয়ে এসে শালুকের পাশাপাশি হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস?”

শালুক জবাব দিলো না। আদনান আবারও জিজ্ঞেস করলো কেমন আছিস।

শালুক হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।আদনানের এবার রাগ উঠে গেলো। শালুকের হাত টেনে ধরে বললো, “ভাব দেখাচ্ছিস আমাকে?কথা বলছি কানে যাচ্ছে না? ”

শালুক টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “কি সমস্যা আপনার? রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে কি মাথা ঠিক থাকে না?ইভটিজিং করতে চলে আসেন?”

আদনানের ভীষণ হাসি পেলো। হেসে দিয়ে বললো, আমাকে তুই চিনতে পারছিস না মনে হয়? এরকম করছিস কেনো?আমার উপর রেগে আছিস?”

শালুক বললো, “আপনি আমার কেউ হন?আপনাকে আমি চিনি?আপনার উপর রাগ করার প্রশ্ন আসছে কেনো তাহলে? ”

আদনান শালুককে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো, “আমার ভুল হয়ে গেছে শালুক,এরকম কিছু হবে আমি কখনো ভাবি নি।আমি তোকে কিছুতেই হারাতে চাই নি শালুক।কেউ না জানুক আমার মন জানে আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। ”

শালুকের ভীষণ ঘেন্না লাগলো শুনে।কেমন সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠেছে ওর আদনানের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে।
রাস্তার উপর একদলা থুথু ছুঁড়ে ফেলে বললো, “আপনি আর ভালোবাসা! দুটোই বিপরীতমুখী। আপনার সাথে অন্তত ভালোবাসা শব্দ যায় না।আপনি একটা মারাত্মক লেভেলের অসভ্য,ইতর স্বভাবের লোক।”

আদনান ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বললো, “সবাই আমাকে ভুল বুঝুক আমার কোনো কষ্ট নেই তাতে কিন্তু তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।আমার কথাটা শোন আগে।তারপর বুঝবি আমি কেনো এরকম করতে বাধ্য হয়েছি।”

শালুকের বিরক্ত লাগলো। ভেবেছে বাড়িতে গিয়ে ধ্রুবকে কল দিয়েই জানাবে তার পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে কিন্তু এখন আদনান যা শুরু করেছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাবার উপায় নেই।

আদনান শালুকের হাত টেনে ধরে বললো, “তোর এই হাতটা আমার হাতে রাখতে চেয়েছি আজীবন আমি।কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না।তোকে আমি কতটা চাই শালুক তুই জানিস না।কেউ বুঝবে না সেটা। ”

শালুক হাটা শুরু করলো।

আদনান মন খারাপ করে শালুকের পিছু নিলো। সুযোগ খুঁজে রাস্তায় কাউকে না পেয়ে শালুকের হাত টেনে ধরে পিছনে ফিরিয়ে কোমর চেপে ধরে বললো, “একটা বার আমার কথা শোন শালুক,তারপর আমার সাথে এরকম রাগ করিস।ধ্রুবর কারণেই আমাকে এসব করতে হয়েছে। আমি বাধ্য হয়ে এরকম কাজ করেছি।”

শালুকের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেলো আদনানের এই অসভ্যতা দেখে।কষে একটা থা/প্পড় বসালো আদনানের বাম গালে।তারপর ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো, “আর কোনো দিন আমার সামনে আসার ও চেষ্টা করবি না তুই।আমার চরিত্রে তুই দাগ লাগানোর চেষ্টা করেছিস।আমাকে সবার কাছে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিস।আল্লাহ সহায় ছিলো বলে আমার আল্লাহ আমার সম্মান রক্ষা করেছে।কোনো দিন যদি আবারও আমার সাথে কথা বলার ও চেষ্টা করিস,আজ এক গালে থা/প্পড় মে/রেছি আমি,পরের বার আর আমার হাতের থাপ্পড় না।তোকে শায়েস্তা করার জন্য আমার হাজব্যান্ড ধ্রুবই যথেষ্ট। তোর মতো নর্দমার কীট কে সে খুব ভালো করে শায়েস্তা করতে জানে।আর ধ্রুবর নামে একটা কথা ও বলার চেষ্টা করবি না।ওর নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতা ও তোর নেই।”

শালুক আর থামলো না। দৌড়ে বাড়ির দিকে গেলো। আদনান ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে হতবিহ্বল হয়ে। শালুক তাকে থাপ্পড় দিয়েছে?
তাকে তুই করে কথা বলেছে?
সব কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে আদনানের কাছে।

এই কি সেই শালুক!
নরম,কোমলপ্রাণ সেই শালুক কোথায় আজ?এ তো স্বয়ং বিধ্বংসী নারী।এই কোমল হাত কাউকে এভাবে আঘাত করতে পারে তা কখনো ভেবেছে আদনান?
ধ্রুবর জন্য আজ শালুকের হাতে থাপ্পড় ও খেতে হলো আদনানের।
মাথা ভোঁভোঁ করে ঘুরতে লাগলো আদনানের।

শালুক বাড়িতে এসে হাঁপাতে লাগলো। বাকিটা পথ আর সে দৌড় বন্ধ করে নি।আদিবা বেগম এক গ্লাস পানি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে তোর,এতো হাঁপাচ্ছিস কেনো?”

শালুক পানি খেয়ে বললো, “কিছু না চাচী।দ্রুত পায়ে হেটে এসেছি তো তাই।”

আদিবা বেগম আর কিছু না জিজ্ঞেস করে বললেন,”যা কাপড় পালটে আয় আমি ভাত বাড়ছি।”

শালুক নিজের রুমে চলে গেলো। ড্রেস চেঞ্জ করে গোসল করে নিলো।গোসল করতে গিয়ে শালুকের মনে হলো তার সারা শরীর আদনানের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে গেছে যেনো।
বাথরুমের ঝর্ণার পানির সাথে গড়িয়ে পড়লো শালুকের চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল।
শালুক জানে সারা পৃথিবীর সাবান দিয়ে ধুয়ে ও এই ছোঁয়া মুছতে পারবে না।ধ্রুবর ভালোবাসার ছোঁয়া পেলেই এই অপবিত্র ছোঁয়া বিলীন হয়ে যাবে দেহ থেকে।

হঠাৎ করেই শালুকের মন খারাপ হয়ে গেলো। ধ্রুবকে ভীষণ মনে পড়তে লাগলো। কি করছে এখন ধ্রুব?শালুকের কথা কি তার মনে পড়ছে?
সে ও কি শালুকের মতো বিরহে পুড়ছে?

গোসল করে শালুক একটা হলুদ জামা পরে নিলো। ধ্রুব গতকাল নামাজ পড়তে বের হয়ে শালুকের জন্য অনেক কিছু কিনে দিয়েছে।শালুক এখনো সবগুলো ব্যগ খুলেও দেখে নি।জামাকাপড়ের ব্যাগ খুলতেই দেখলো উপরে এই জামাট।শালুক জানে এটাও ধ্রুব গতকাল কিনে এনেছে। ব্যাগ দুটো খুললে আরো অনেক কিছু দেখা যাবে।শালুক ঠিক করলো এগুলো এখন খুলবে না।রাতে একা একা সব খুলে দেখবে।

হলুদ সাদা জামা পরে শালুক নিচে নামতেই আদনানের মুখোমুখি হলো।পাশ কাটিয়ে শালুক চলে গেলো। আদনান পিছনে ফিরে তাকালো আবারও শালুকের দিকে।শালুক আগের চাইতে বেশ সুন্দরী হয়েছে। গায়ের রঙ আরো উজ্জ্বল হয়েছে।
ভেজা চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ছে।কি সুন্দর সেই দৃশ্য!

ধ্রুবর কপালের কথা ভেবে আদনানের আরো ঈর্ষা হলো। প্রতিদিন ধ্রুব শালুকের এই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে।জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় নিশ্চয় ধ্রুব তখন।আদনান নিজেই তো এই সামান্য একটুতে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ধ্রুব কি করে!

শালুক তো তার স্ত্রী। পরমুহূর্তে লজ্জা পেলো আদনান। নিজেকে নিজে সামলে নিজের রুমে চলে গেলো।

খেতে বসে শালুক ধ্রুবকে কল দিলো।ধ্রুব ও তখন খেতে বসেছে। শালুক জিজ্ঞেস করলো, “কি দিয়ে খাচ্ছেন আপনি? ”

ধ্রুব সামনে রাখা ডাল আর সবজির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার প্রিয় তরকারি দিয়েই খাচ্ছি শালুক।তুমি? ”

শালুক বললো, ” ইলিশ মাছের ডিম, কষা মাংস,ডাল।আপনার কথা ভীষণ মনে পড়ছে।কষা মাংস না আপনার ভীষণ প্রিয়। এই খাবারটা আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আপনাকে ছাড়া। ”

ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর হাসির শব্দ হয় না।ঠোঁট টিপে কি সুন্দর করে হাসে সে।তবুও শালুক বুঝতে পারলো ধ্রুব হাসছে।
ধ্রুব বললো, “তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী না শালুক। আমার ৫০% তুমি।তুমি খেলেই আমার মন ভরে যাবে।সব কিছুতে পেট ভরতে হয় না।মন ভরলেই মানুষ যে সুখ পায় সেই সুখ পেট ভরে খেলেও পাওয়া যায় না।এই যে তুমি আমার কথা ভাবছো,খেতে গিয়ে আমাকে মনে করছো এর চাইতে সুখের কথা আমার জন্য দ্বিতীয় কিছু নেই শালুক।”

শালুক মলিন হাসলো। তারপর বললো, “আমার পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে জানেন।একটা ওয়ার্ড ও কারো থেকে দেখে লিখতে হয় নি।সবই কমন এসেছে। ”

ধ্রুব খুশি হয়ে গেলো শুনে।শুকরিয়া আদায় করে বললো,”আল্লাহ চায় তো,যেনো তোর সব পরীক্ষা এরকম ভালো হয়।”

শালুক বলল,”আপনি যে হঠাৎ করেই আমাকে তুমি করে বলছেন বুঝতে পারছেন?”

ধ্রুব হেসে ফেললো। সে ইচ্ছে করেই শালুককে তুমি করে বলছে।রাতে সবার সামনে শালুককে তুই করে বললে সবাই ভাবতো হয়তো ওরা এখনো কেউ কাউকে ওভাবে মেনে নেয় নি।একবার তুমি বলার পর আর তুই বলতে ইচ্ছে করছে না।

ধ্রুব কল কেটে দিলো। শালুক খেয়ে শাপলার কাছে গেলো। তারপর শাপলার কাছে আদনানের ব্যাপারটা শেয়ার করলো।

শাপলা অবাক হলো আদনানের এই বহুরূপ দেখে।এই লোকটা কি পাগল না-কি?
এই আশাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে আবার শালুককে বলছে ভালোবাসে।
মাথা কি এলোমেলো হয়ে গেলো না-কি আশাকে হারিয়ে?

শাপলা ঠিক করলো এসব ধ্রুব ভাইকে জানাবে সে শালুকের অজান্তে। নয়তো আদনান পরে যদি আরো সমস্যা করে!

চলবে….

রাজিয়া রহমান

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৪)

ধ্রুবর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।একটু আগে শাপলা কল দিয়েছে শালুকের ফোন থেকে।আদনান যা যা করেছে সব বলেছে শাপলা ধ্রুবকে।
তারপর থেকে ধ্রুবর মন মেজাজ বিগড়ে আছে।রাগ উঠেছে সপ্তমে।অযথাই মাথা গরম হচ্ছে।

এই শীতের দিনেও ধ্রুবর শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে। যা নিয়ে ধ্রুব চিন্তায় ছিলো তাই হচ্ছে।

নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো ধ্রুব।এরকম অযথাই রাগে ফোঁসফোঁস করার স্বভাব ধ্রুবর নেই।ধ্রুব মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করার মানুষ।
এই মুহুর্তের অতিরিক্ত রাগ ধ্রুবকে ভাবিয়ে তুলছে।সে কি নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হচ্ছে!

ধ্রুবর দাদী বলতেন, অতিরিক্ত রাগ হলে যাতে মাটির দিকে থাকে তাহলে রাগ মাটি হয়ে যাবে।আর নয়তো পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে তাতে রাগ পানি হয়ে যাবে।
এই বিশাল শপিং মলের দুই তলার এই শো-রুমের চৌহদ্দিতে কোনো মাটি নেই আর না আছে ওভাবে দেখার মতো কোনো পানি।বোতলের পানির দিকে তাকিয়ে রাগ কমানোর কোনো উপায় পেলো না।

ফ্লোরে শুয়ে ধ্রুব ১০০ থেকে উল্টো দিকে কাউন্ট করতে শুরু করলো। ২৩ এ এসে ধ্রুব অনুভব করতে পারলো তার রাগ কমেছে। তবুও খানিকটা মনোকষ্ট রয়ে গেলো।
শালুক কেনো তার কাছে এই ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে এই ভেবে।
বুঝতে পারলো না ধ্রুব শালুকের এই ব্যাপারটা।

শো-রুম থেকে বের হয়ে ধ্রুব টিউশনিতে গেলো। দুইটা টিউশনি শেষ করে শেষ টিউশনিতে যাবার সময় ধ্রুবর কেমন ইতঃস্তত বোধ হলো। এই টিউশনিটা ধ্রুবর কাছে কেমন যেনো লাগে।ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া একটা মেয়েকে পড়ায় ধ্রুব।ফিন্যান্স আর একাউন্টিং। দুই সাবজেক্ট। সপ্তাহে ৩ দিন ফিন্যান্স তিন দিন একাউন্টিং।মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন। কিন্তু ছাত্রীর আচার ব্যবহার কিছুদিন ধরে ধ্রুবর কাছে সুবিধাজনক লাগছে না।
ধ্রুব বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো।তারপর মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য এনে বাসায় প্রবেশ করলো।
তার ছাত্রী চেয়ারেই বসে ছিলো। যেনো ধ্রুবর প্রতীক্ষা করছে বসে বসে।
ধ্রুব বসতে বসতে আড়চোখে তাকালো।

মোটা করে চোখে কাজল দিয়েছে মেয়েটা,ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক। কানে নীল দুল পরেছে নীল জামার সাথে ম্যাচিং করে।
ধ্রুব একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটার হাবভাব সুবিধাজনক লাগছে না বলে ধ্রুব প্রথমেই বলে দিয়েছিল সে বিবাহিত। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে তার জন্য ভ্রুক্ষেপ নেই।

ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো, “গতকাল যে আর্থিক অবস্থার বিবরণী করতে দিয়েছিলাম আগে ওটা দেখাও।”

ধ্রুবর ছাত্রীর নাম নিশা।নিশা খাতা বের করে বললো, “স্যার, আমার দিকে তাকান।”

ধ্রুব খাতার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার দিকে তাকানোর কি আছে?তোমার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য তো আমাকে মাস শেষে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয় না।টাকা দেওয়া হয় তোমার লেখাপড়ার দিকে তাকানোর জন্য।তাই,নিজের সাজগোজ বন্ধ করে মন দিয়ে নিজের মেধাকে সাজাও।পড়ালেখায় মন দাও।”

নিশা ফিসফিস করে বললো, “মন তো স্যার আমার কাছে থাকে না।আপনার কাছে থাকে।”

ধ্রুব শুনতে পেলো কথাটা। কিন্তু জবাব দিলো না। না শোনার ভান করে রইলো। নিশা আবারও বললো,”আমার দিকে তাকালে আজকে আপনি একটা মজার জিনিস দেখতে পাবেন।আজকে আমাকে অন্যরকম লাগছে সেটা দেখতে পাবেন।”

ধ্রুব না তাকিয়ে বললো, “কেনো,তোমার কি আজকে মাথায় শিং গজিয়েছে নাকি?বাজে কথা বন্ধ করো।তোমার অংক মিলে নি।কোনটা কোথায় বসবে তুমি সেটাই এখনো বুঝতে পারছো না।আয়,ব্যয় সব গুলিয়ে ফেলেছ।”

নিশা করুণ সুরে বললো, “আমার মাথাটাই তো গুলিয়ে গেছে স্যার।অংক মিলবে কিভাবে?”

ধ্রুব আবারও খাতায় আর্থিক অবস্থার বিবরণীর ঘর আকলো।তারপর নিশার দিকে খাতা এগিয়ে দিয়ে বললো, “শুরু করো আবার। যেই এন্ট্রি বুঝবে না আমাকে জিজ্ঞেস করবে।”

নিশা ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, “আগে এটা বুঝান কিভাবে কারো মনে এন্ট্রি নেওয়া যায়?”

ধ্রুব ভীষণ রাগ হলো। ধমকে বললো, “ফাজলামি করতে বসেছ তুমি?আমাকে জোকার মনে হয় তোমার? নাকি তামাশা করতে ভালো লাগছে?নেক্সট টাইম যদি তোমার এরকম ব্যবহার দেখি তবে আমি তোমার আম্মুকে বলে যাবো আমার পক্ষে তোমাকে পড়ানো সম্ভব না। অন্য টিচার রাখতে।বেয়াদব স্টুডেন্ট আমার চাই না।”

নিশার কলিজায়ভাবে লাগলো ধ্রুবর এই কথাগুলো। ধ্রুব কেনো বুঝতে পারছে না নিশা তাকে ভালোবাসে!শুধুমাত্র ধ্রুবর জন্যই তো নিশা পড়ানোর টাইম হবার আগেই টেবিলে এসে বসে থাকে।নিজেকে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে।আর ধ্রুব কি-না নিশার থেকে নিস্তার পেতে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করছে?
নিশা ভেবে পায় না সে দেখতে কি এতোই খারাপ!

নিশাকে অংক করতে দিয়ে ধ্রুব শালুককে কল দিলো। শালুক তখন বাংলা দ্বিতীয় পত্র বই নিয়ে বসেছে।ধ্রুবর কল পেয়ে অবাক হলো। এই সময়ে ধ্রুব তো কখনো কল দেয় না।আজ কি হলো হঠাৎ!
তড়িঘড়ি করে শালুক কল রিসিভ করলো। ধ্রুব যথাসম্ভব মধুর স্বরে বললো, “কি করছো?খেয়েছ তুমি? ”

শালুক জবাব দিলো পড়া শেষ করে খাবে তারপর জিজ্ঞেস করলো, “এই সময় তো কল দেন না।আজকে হঠাৎ কি হলো?”

ধ্রুব নিশাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, “এই সময় তো আমার বউটা আমার কাছে থাকতো বাসায়।তাই কল দিতাম না।কারণ বাসায় গেলে তোমাকে দেখবো।আজকে তো তুমি নেই,তাই খুব মিস করছিলাম।এজন্য কল দিয়েছি।আজ তো বাসায় গেলে দেখবো বাসা ফাঁকা।”

শালুকের কেমন যেনো ভালো লাগলো ধ্রুবর এই কথাগুলো। কেমন হৃদয় প্রশান্ত করে দিচ্ছিলো। ধ্রুব কল রেখে দিলো।নিশা কান পেতে শুনলো সবটা।তবুও ওর বিশ্বাস হলো না। নিশার মনে হলো এই সব ধ্রুবর প্ল্যান।কাউকে আগেই বলে রেখেছিলো হয়তো। তাই নিশাকে সরানোর জন্য এরকম করছে ধ্রুব।
চুপচাপ নিশা অংক করে গেলো। ধ্রুবকে একটা এন্ট্রি ও জিজ্ঞেস করলো না।
অংক দেখতে গিয়ে ধ্রুব টের পেলো নিশা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর মজার ব্যাপার হলো, অংক এবার ঠিকঠাক মিলে গেছে।

ধ্রুব ভেবে পেলো না নিশার এই কান্নার কারণ কি।তবে এটুকু বুঝতে পারলো এই টিউশনি ছেড়ে দতে হবে খুব শীঘ্রই। এসব কেলেংকারীতে ধ্রুব কিছুতেই জড়াতে চায় না।আর এই ষোড়শীকে বুঝানোর সাধ্য তার নেই।
নিজের বউয়ের চিন্তা করবে না কি অন্য মেয়েকে নিয়ে ভাববে সে।

বাকি সময়ে ধ্রুব আরো দুটো অংক করালো।নিশা একটা কথা ও বললো না ধ্রুবর সাথে। নিশা ভেবেছিলো ধ্রুব একটা বার হলেও জিজ্ঞেস করবে নিশাকে কেনো চুপ করে আছে।
কিন্তু নিশার ভাবনা ভুল করে দিয়ে ধ্রুব ও প্রশ্ন করে নি।সময় শেষ হতেই ধ্রুব উঠে চলে গেলো।

পড়ার টেবিলেই নিশা কান্নায় ভেঙে পড়লো। নাকের জল,চোখের জল একাকার হয়ে গেলো নিশার।
বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নিশা।যা চেয়েছে তাই পেয়েছে।এজন্য সব কিছুতে জিতে যাওয়ার একটা মানসিকতা নিশার মধ্যে প্রবল। সব সময় আত্মীয় স্বজন, কাজিনদের মধ্যে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নিশার।কেননা নিশার বাবা অনেক টাকার মালিক।তার একমাত্র উত্তরাধীকারি নিশা।
তার উপর নিশা বেশ সুন্দরী। সবদিক মিলিয়ে সবখানে নিশা দেখেছে সবাই তাকে খুব প্রাধান্য দেয়।
কিন্তু এই একটা জায়গায়, একজন মানুষের কাছে নিশা হেরে যাবে তা নিশার ভাবনাতে ছিলো না কখনো।

ক্লাস সেভেন থেকে বেশ কয়েকজন প্রাইভেট টিচার চেঞ্জ করেছে নিশা।পড়াতে পড়াতে সবাই নিশাকে ভালোবেসে ফেলতো।এর থেকে নিশার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ জন্ম নিলো।
সে ভেবেই নিলো এরকমটাই হতে হবে।কিন্তু ধ্রুব অন্যদের চাইতে অন্যরকম হওয়ায় নিশার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে নিশা যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, মেধাবী,শ্যামলা,লম্বা ছেলে পছন্দ করে ধ্রুবর মধ্যে তার সবটাই আছে।
নিশা কিছুতেই ধ্রুবর নেশা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারছে না।
উল্টো ধ্রুবর এই কাটখোট্টা ব্যবহারে নিশা আরো প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। অথচ এই মানুষটা কিছুতেই বুঝতে চায় না ওকে।

ধ্রুব বাসায় ফিরে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। আজ আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না।একা একা খেতে ইচ্ছে করে না। পুরো বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একটা মানুষের অনুপস্থিতে এই বাসাটা ও বুঝে গেছে। ধ্রুবর বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালাপোড়া অনুভূতি টের পাচ্ছে ধ্রুব।
কেনো এতো অন্তর পুড়ে যাচ্ছে?
কেনো শালুক এভাবে হৃদয়ে আসন গেড়ে বসেছে।আজ যে শালুক কাছে নেই অথচ ধ্রুব এই সামান্য বিরহ সহ্য করতে পারছে না।

শালুক পড়া শেষ করে খেতে গেলো। আদনান অপেক্ষা করে ছিলো কখন শালুক খেতে যাবে।শালুক খেতে বসে দু লোকমা খেয়েছে সেই সময় আদনান গেলো ভাত খেতে। মা’কে ডেকে ভাত দিতে বললো।
শালুক বুঝতে পারলো আদনান ইচ্ছে করে এই সময় এসেছে।ভাতের প্লেট নিয়ে শালুক দাদার রুমে চলে গেলো।
আদনান বুক ভরা ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শালুক কেমন করে তাকে ইগনোর করে যাচ্ছে। এতো ভাব কিভসবে হলো শালুকের?
না-কি ধ্রুবর সাথে থাকতে থাকতে শালুক ও এরকম হয়ে গেছে।

খাওয়ার পর দাদীর রুমে বসে সবাই মিকে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো।
রাতে শালুক ঠিক করলো আজকে নিজের রুমে ঘুমাবে। ধ্রুব কি কি রেখেছে ব্যাগে এসব দেখবে।
রুমে গিয়ে শালুক ধ্রুবকে কল দিলো। ধ্রুব ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। গতরাত জার্নি শেষ করে বাসায় এসে দু ঘন্টা ও ঘুমাতে পারে নি।বের হয়ে যেতে হয়েছিলো জীবিকার তাগিদে। সারাদিন খাটাখাটুনি শেষে আজ বিছানায় পিঠ দিয়ে শালুককে ভাবতে ভাবতেই ধ্রুব ঘুমিয়ে পড়লো।
শালুক যখন ধ্রুবকে কল দিয়েছে তখন রাত ১২.১৫ মিনিট।

শালুক ফোন রেখে দিয়ে সবেমাত্র ব্যাগ খুলেছে এই সময় দরজায় টোকা পড়লো। শাপলা ভেবে শালুক দরজা খুলতেই দেখলো আদনান দাঁড়িয়ে আছে। শালুককে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আদনান মুখ চেপে ধরে দরজা বন্ধ করে দিলো।

চলবে……

রাজিয়া রহমান