শিউলি তোমার জন্য পর্ব-০১

0
29

#শিউলি_তোমার_জন্য
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০১

(১)
শিউলি প্রতিদিন সকাল সাতটায় বের হয়। সে যখন তড়িঘড়ি করে ভার্সিটির বাস ধরার জন্য রওনা করে আমি তখন জগিং শেষ করে ঘরে ফিরি। আমাদের প্রায় দিন সিঁড়ির ধাপে দেখা হয়। দুই তলা বা তিনতলার সিঁড়িতে! আমাকে দেখে শিউলি কখনো কখনো বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একপলক দেখে চোখ নামিয়ে নেয়। দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। তাকে পাশ কাটানোর সময়টা আমি খুব ধীরপায়ে হাঁটি। তখন আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে। গলার কাছটায় শুকনো শুকনো লাগে। কেমন যেন ভয় হয়। বার বার মনে হয় এই বুঝি শিউলির কাছে ধরা পড়ে যাব। সে বুঝে ফেলবে যে তাকে একপলক দেখার জন্য রোজ আমি এই সময় জগিং শেষ করে ঘরে ফিরি।

প্রতিবার শিউলির কাছাকাছি আসতে আমি ফুলের গন্ধ পাই। স্নিগ্ধ, আবেশিত, শরতের শিউলির মতোই তার পারফিউমের গন্ধ। আমার ঘোর লাগে। মনে হয় এই পারফিউমশুদ্ধ মানুষটাকে বুকের মাঝে পিষে ফেলি।

দুই ধাপ উঠে আমি পেছন ঘুরে তাকাই। স্বপ্নাবিষ্টের মতো তার পানে চেয়ে থাকি অপলক। সে সিঁড়ির বাঁকে আড়াল হলে আমি ছুটে নিজের রুমে চলে আসি। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দ্বিতীয়বার তাকে দেখি। গলি দিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যায়। আমি বিড়বিড় করে বলি, আরেকটু আস্তে পা ফেলো প্লিজ! আরো কয়েকটা সেকেন্ড তোমায় বেশি দেখি।

শিউলি শুনতে পায় না। অবলীলায় হেঁটে যায়! ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে তার চুল উড়ে। ওড়নার আঁচল উড়ে। আমি দূর থেকে মুগ্ধ নয়নে তার পানে চেয়ে থাকি। চোখের তৃষ্ণা মেটাই।

শিউলি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে। আমাদের মিরপুরের বাসায় সে ভাড়া থাকে। একা নয়; তার সাথে আরো ছয়জন মেয়ে আছে। তারা আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটের উত্তর দিকের ইউনিটে থাকে। আর আমরা থাকি পাঁচ তলায়। এত কাছাকাছি তবুও যেন বহুদূর!

শিউলিকে আমি ভালোবাসি। একটু নয়, অনেক বেশি। এতটা বেশি যে তার জন্য আমি নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে পারি। এই যে দেড় বছর হলো শিউলিকে আমি এমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে চলেছি। গোপনে গোপনে ভালোবেসে চলেছি শিউলি তার কিছুই জানে না। কয়েকবার তাকে বলতে গিয়ে সাহস করে উঠতে পারিনি। ভয় হয়। পাছে যদি রাজি না হয়? দুনিয়ার সব নিয়ম মানতে পারব। শুধু শিউলির প্রত্যাখ্যান মানতে পারব না। কিছুতেই না!

মা ইদানীং বিয়ের কথা বলছেন। এইতো গতকাল নাস্তার টেবিলে মা বললেন,

‘বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কী ভাবলি, মাসুদ? বয়স তো আর কম হলো না। তোর বাবা মেয়ে দেখার কথা বলেছে।’

আমার তখন মাথাভর্তি শুধু শিউলি আর শিউলি। মায়ের কথায় ঘোর কাটে। সত্যি তো! তিন বছর আগে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছি। বাবার ব্যবসা দেখছি। এখন তো বিয়ে করা উচিৎ। কিন্তু মাকে শিউলির কথা বলব কী করে? তাছাড়া শিউলির পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। সে কি এখন রাজি হবে বিয়ে করতে? নিশ্চয়ই হবে না!

মনে নানাবিধ চিন্তা ভর করে। তবে বিয়ের কথা শুনে বুকের ভেতরের পুরোনো তৃষ্ণা জেগে উঠে। আশা, আকাঙ্খা তরতাজা হয়। শিউলিকে কাছে চাওয়ার, আপন করে পাওয়ার তৃষ্ণা। যে মানুষটাকে এতগুলো দিন হলো বুকের মাঝে লালন করে চলেছি, তাকে চিরদিনের জন্য আমার করে পাওয়ার জন্য মন ছটফট করে উঠে।

(২)

শিউলিকে আমি প্রথম দেখি এক শুক্রবারের সকালে। তখন বেলা নয়টা বাজে বোধ হয়। থেমে থেমে বাসার ডোরবেল বাজছে। মা রান্না ঘরে। বাবা মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেছেন ভেবে আমি দরজা খুলতে যাই। কিন্তু দরজা খুলে ভারি অবাক হই। ওপাশে অপরিচিত এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ জড়সড় হয়ে। চেহারা মায়াবী, লাজুক লতার মতো। যেন ছুঁয়ে দিলে এক্ষুণি নিজেকে গুটিয়ে নেবে। আমার দুচোখে মুগ্ধতা ভর করে।

মেয়েটা আমাকে প্রত্যাশা করেনি হয়তো। আমার চোখে চোখ পড়তে বেশ ঘাবড়ে যায়। কোনরকমে সালাম দেয়। বলে,

‘আন্টি আছেন?’

মেয়েটার কিন্নর কন্ঠ। সমুদ্রের জলরাশির মতো তার ধারা। চোখমুখে আলাদা এক ধরনের সারল্যতা। ভয়ার্ত, নিষ্পাপ চাহনি। যেন ধমক দিলে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। দেখে আমার ভালো লাগে। পুলকিত হই। তাকে নিয়ে মনে কৌতূহল জাগে। আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি,

‘কে আপনি?’

‘আমি শিউলি। চারতলার ফ্ল্যাটে থাকি। আন্টি আছেন? সকাল থেকে আমাদের ফ্ল্যাটে পানি নেই। একটু দেখতে বলবেন?’

‘বলছি।’

‘আচ্ছা। আমি তাহলে যাই?’

‘যাবেন কেন? ভেতরে এসে বসুন না!’

শিউলি অসম্মতি জানায়। মাথা নেড়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিচে নামে। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। সহজে ঘোর কাটে না। মা হঠাৎ রান্নাঘর থেকে প্রশ্ন করেন,

‘কে এসেছে?’

আমি দরজা বন্ধ করে মায়ের কাছে যাই। চারতলার ফ্ল্যাটে পানি নেই কেন সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। খুব দ্রুত পানি সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু শিউলি নামের মেয়েটা আমার মনের ভেতরে যে সমস্যার সৃষ্টি করে রেখে যায়, সেটার সমাধান হয় না। বরং সময়ের সাথে সাথে সেটা শিকড় গেড়ে যায়। শুরু হয় ভালো লাগা আর ভালোবাসার নতুন অধ্যায়।

(৩)

আজ রবিবার। শিউলির ভার্সিটি খোলা। কিন্তু সকাল থেকে অপেক্ষা করে তার দেখা পাইনি। সে আজ ক্লাসে যায়নি। কিন্তু কেন? কোনো বিপদ আপদ হয়েছে কি? মনটা আনচান করছে।

শিউলির নাম্বার আমার কাছে আছে। ‘ভোরের শিউলি’ লিখে সেভ করে রেখেছি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমি নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কল করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কখনো সাহস হয়ে উঠে না। কল করে কী বলব? কী পরিচয় দিব? শিউলি নিশ্চয়ই বখাটে ভাববে আমাকে।

সারাটা দিন শিউলির চিন্তায় গেল। এক সেকেন্ডের জন্য তাকে মন থেকে দূর করতে পারলাম না। বেশ কয়েকবার চার তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করলাম। গেটের কাছে বার কয়েক গেলাম। কিন্তু শিউলির দেখা মিলল না।

রাত তখন গভীর। বারোটা-একটা বাজবে বোধ হয়। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। আমার ঘুম পাতলা। শব্দ কানে যেতে এক লাফে উঠে পড়লাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমাকে দেখে বললেন,

‘এত রাতে কে এলো?’

আমাদের বাসার সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভালো। নিচ তলায় সার্বক্ষণিক একজন পাহারাদার থাকে। তাই অপরিচিত কেউ ভেতরে প্রবেশের কোনো সম্ভাবনা নেই। মা নির্ভয়ে দরজা খুললেন। দেখি, ওপাশে দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখমুখ। তাদের একপলক দেখে বুঝলাম, চার তলার ফ্ল্যাটের। মেসের মেয়েরা। মা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে লিমা? তোমরা এতরাতে?’

লিমা নামের মেয়েটা ঝটপট উত্তর দিল,

‘আন্টি আমাদের সাথে একটু আসুন। গতকাল থেকে শিউলির জ্বর। হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। কিছুতেই কমছে না। ও সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’

শিউলি নামটা শুনতেই আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।

(চলবে)