#শিউলি_তোমার_জন্য
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০২
লিমা নামের মেয়েটা ঝটপট উত্তর দিল,
‘আন্টি আমাদের সাথে একটু আসুন। গতকাল থেকে শিউলির জ্বর। হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। কিছুতেই কমছে না। ও সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’
শিউলি নামটা শুনতেই আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। মা চিন্তিত গলায় বললেন,
‘সে কি! আমাকে আগে থেকে বলো নি কেন?’
‘ভেবেছি সামান্য জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এত বেড়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এখন এই রাতেরবেলা আমরা মেয়ে মানুষ নিয়ে যেতে পারব না। এজন্য আপনাকে জানাতে এলাম।’
মা আমায় উদ্দেশ করে বললেন,
‘আমি নিচে যাচ্ছি, মাসুদ। তুই তোর বাবাকে বলে তাড়াতাড়ি আয়। গাড়িটা বের করতে হবে। আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে যাই।’
মা তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলেন। আমি বাবাকে ডেকে তুললাম। তাকে বলে মানিব্যাগটা নিয়ে বের হলাম। নিজেকে কেমন বোধশূন্য লাগছে। শিউলির সবটুকু ব্যথা, যন্ত্রণা যেন আমায় গ্রাস করেছে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে শিউলিকে দেখে ভেতরটা ভেঙ্গে এলো। এতটা অসুস্থ মেয়েটা? চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। দাঁতে দাঁত আটকে আসছে। মা শিউলির মাথায় কয়েক মিনিট পানি ঢাললেন। ভেজা চুলগুলো মুছে দিলেন। তারপর শিউলিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। সাথে মা আর শিউলির মেসের একজন মেয়ে গেল।
(৪)
শিউলির জ্ঞান ফেরার পর আমি তাকে দেখতে গেলাম। আমাকে দেখে সে লজ্জা পেল। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া খানিক প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করল।
‘এখন কেমন লাগছে?’
আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। শিউলি ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,
‘একটু ভালো লাগছে।’
দুদিনের জ্বরে ওর কাহিল অবস্থা। চোখমুখ শুকিয়ে পান্ডুর মতো হয়ে গেছে। দূর্বল শরীর। রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, খুব নাকি খাবারের অনিয়ম করে।
শিউলির অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। এক ধরনের অপরাধবোধ হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, আমার কাছে থাকলে শিউলি ভালো থাকত। আমি ওর যত্ন নিতে পারতাম। দেখাশোনা করতে পারতাম। আদর আর ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতাম।
মা ওয়াশরুম থেকে এখনো ফেরেননি। শিউলির হাতে ক্যানোলা লাগানো। ধীরগতিতে স্যালাইন চলছে। প্রেসক্রিপশনের কাগজটা নাড়াচাড়া করছিলাম। শিউলি গায়ে কাঁথা টেনে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ওকে শুধালাম,
‘শীত করছে এখনো? জ্বর আছে?’
শিউলির উত্তরের অপেক্ষা না করে খানিক ঝুঁকে ওর কপালে হাত রাখলাম। ও অবাক হয়ে তাকাল। চেহারায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। আমিও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে হাতটা সরিয়ে নিলাম। খানিক পিছিয়ে এসে বললাম,
‘জ্বর নেই।’
শিউলি কিছু বলল না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফের জিজ্ঞেস করলাম,
‘খাবারের এত অনিয়ম করা হয় কেন?
সে তার যথোপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেল না হয়ত। লাজুক হাসল। বলল,
‘আর করব না।’
আমি মনে মনে বললাম, আর করতে দিব না। এই খাবার অনিয়ম করার শাস্তিস্বরূপ খুব শীঘ্রই তোমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।
লিমা এতক্ষণ ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। সে আসতে আমি ফোনটা কানে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম।
(৫)
দুদিন পর শিউলিকে রিলিজ করা হলো। মায়ের মুখে শুনলাম, ওর বড়ভাই মেসে দিয়ে গেছে। বাড়ি যায় নি। পরের সপ্তাহ থেকে নাকি টার্ম পরীক্ষা। তাছাড়া এই দূর্বল শরীরে দীর্ঘপথের জার্নি করা ঠিক হবে না বিধায় যায় নি।
শিউলিকে দেখেছি দুদিন আগে। অসুস্থতার পরেরদিন খবর পেয়ে তার ভাই এসেছে। আমার দায়িত্ব শেষ। ইচ্ছে থাকলেও আর কিছু করার ছিল না। শিউলিকে দেখার সুযোগ ছিল না। মা অবশ্য দেখতে গেছেন। কয়েকবার রান্না করা খাবার দিয়ে এসেছেন। খোঁজ খবর নিয়েছেন। শিউলিকে দেখার কোনো অধিকার শুধু আমার নেই।
রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। শিউলির সাথে কথা বলতে মন চাইছে। এখন কেমন আছে, কী করছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ সামনে কোনো পথ খোলা নেই। অনেক ভেবেচিন্তে আজকে কল করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাত্রি এগোরটার কাছাকাছি। ব্যালকনিতে বসে কল করলাম। একবার রিং হতে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শিউলির দূর্বল গলার সালাম ভেসে এলো। ওর কন্ঠ শুনে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য কথা হারিয়ে ফেললাম। শিউলি নিজে থেকে প্রশ্ন করল,
‘কে বলছেন?’
‘আমি মাসুদ! চিনতে পেরেছ?’
কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর উত্তর এলো,
‘জি। চিনতে পেরেছি।’
‘মা কল দিয়ে তোমার ব্যাপারে জানতে বললেন। তাই কল করা। কেমন আছ এখন?’
‘জ্বর নেই। ঠিক আছি এখন।’
‘রাতে খেয়েছ?’
‘হুঁ। আপনি?’
‘খেয়েছি। তুমি কি ঘুমাবে এখন? ফোন রেখে দিব?’
‘খানিক আগে ঘুম থেকে উঠেছি। এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না। আপনি বলুন।’
মনটা পুলকে ভরে গেল। শিউলিকে আমার কতকিছু বলার আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব! অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলাম। ক্রমশ রাত বাড়তে লাগল। এপাশে আমাদের কথোপকথন এগিয়ে চলল।
শিউলিকে আমি চাই। তাকে দেখার অধিকার চাই। ছোঁয়ার অধিকার চাই। নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখার অধিকার চাই। তার থেকে এই দূরত্ব আর সইতে পারছি না।
অনেক ভেবেচিন্তে পরেররাতে তাকে মেসেজ করলাম,
“শিউলি! আমার শিউলি! তোমাকে আমি ভালবাসি। আমার এই ভালোবাসা ভালোবাসা রোগের বয়স একদিন নয়, দুদিন নয়। দেড় বছর! যতদিন যাচ্ছে আমি ততই তোমাতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। আমার দিন যায় না। রাত কাটে না। সারাক্ষণ তোমায় মনে পড়ে। তোমাকে বুঝাতে পারছি না হয়তো। আমার তোমাকে লাগবে। লাগবেই লাগবে।”
মেসেজটা পাঠিয়ে আমি মায়ের রুমে গেলাম। মা মশারি টানাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এলাম। বললাম,
‘মা, সেদিন বিয়ের কথা বলছিলে না? আমার একটা মেয়েকে ভীষণ পছন্দ। ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।’
মা বিস্মিত গলায় বললেন,
‘বলিস কি! মেয়েটা কে?’
‘শিউলি।’
‘শিউলি?’
‘হুঁ, শিউলি। যতদ্রুত সম্ভব আমি ওকে বিয়ে করতে চাই! তুমি প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’
আমার অনুরোধ মা রাখলেন। খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন। শিউলির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেন। দেখা করে বিয়ের দিন তারিখ পর্যন্ত ঠিক করলেন।
শিউলিকে নিয়ে ভয় ছিল। রাজি হবে না বোধ হয়। না! আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে শিউলি রাজি হয়ে গেল। তারপর শুক্রবারের এক সন্ধ্যায় শিউলির সাথে আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। শিউলি চিরদিনের জন্য আমার হয়ে গেল।
(চলবে)