#শিউলি_তোমার_জন্য
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০৩ (শেষ)
বাসর ঘরে শিউলিকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে এল। ফুলসজ্জিত বিছানার মাঝখানে বসে আছে আরেকটি ফুল। আমার অনেক সাধনার ফুল, ঘুম হারাম করা ফুল।
শিউলির পরনে লাল বেনারসি। মাথায় জরির ওড়না। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা। আমি ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে তাকে ডাকলাম।
‘শিউলি।’
সে ডাকে ঘোমটার আড়ালে থাকা রমণী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। কিয়ৎক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। ইতিউতি করে একসময় বিছানার একপাশে বসলাম। শিউলি মাথানিচু করে বসে আছে। ঘোমটার একপ্রান্ত মৃদু বাতাসে উড়ছে। কম্পিত হাতে আমি তার ঘোমটা সরিয়ে দিলাম। চোখের সামনে শিউলির চাঁদ মুখটা ভেসে উঠল।
তাকে বিয়ের সাজে দেখে আমার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হলো। গলা শুকিয়ে এলো। আমি নিঃশব্দে ঢোক গিললাম। শিউলির শরীর থেকে মিষ্টি মধুর গন্ধ ভেসে আসছে। মাতাল করা গন্ধ। মেয়েটা আমার এতো কাছে! সামান্য একটু হাত বাড়ালে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। বুকের মধ্যিখানে লুকিয়ে ফেলা যায়। এসব ভাবতে সমস্ত দেহে শিহরণ বয়ে গেল।
শিউলি ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। আমি ক্রমশ ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। শিউলিতে ডুবে যাচ্ছি। তাকে অনুনয়ের সুরে বললাম,
‘আমার দিকে তাকাও প্লিজ।’
শিউলি আমার ডাকে সাড়া দিল। কাজলকালো আঁখিপল্লব মেলে আমার পানে তাকাল। তার চোখে আমি নিজের ধ্বংস দেখতে পেলাম। মনের গহীনে প্রশ্ন জাগল। এই চোখের মায়া কি কখনো কাটিয়ে উঠতে পারব? না!
শিউলির মেহেদি রাঙা হাত মুঠোবন্দি করে নিলাম। ডান হাতের তালুতে আমার নামটা জ্বলজ্বল করছে। সে লেখায় আঙুল দিয়ে ছুঁইয়ে দিলাম। শিউলি কেঁপে উঠল। হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। আমি ছাড়লাম না। প্রগাঢ় স্বরে বললাম,
‘তোমাকে আমি ভালোবাসি শিউলি। ভালোবাসি, ভালোবাসি , ভালোবাসি। তুমি বিয়েতে রাজি নাহলে মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় ছিল না আমার।’
‘আমার ছিল বুঝি?’
শিউলি অবশেষে মুখ খুলল। তার কম্পিত মিহি সুর কানে বাজতে অবাক হয়ে গেলাম। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘মানে?’
‘আপনার জন্যই তো এই মনে অন্য কাউকে জায়গা দেইনি। কতগুলো দিন হলো আমি আপনার অপেক্ষায়। আমার কাছ অবধি পৌঁছাতে আপনার এতো সময় লাগল কেন?’
শিউলির অভিমানি কন্ঠস্বর। দুচোখ ভরা অভিযোগ। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার পানে চেয়ে রইলাম। অবশেষে সব খোলাসা হলো। রোজ নিয়ম করে সিঁড়িতে শিউলির দেখা পাওয়া, আমাকে দেখে তার লজ্জামিশ্রিত অস্বস্তি হওয়া – সব পরিষ্কার হলো। শিউলিও যে আমার মতো অপেক্ষায় থাকত। কখন আমাদের দেখা হবে। সাক্ষাৎ হবে!
আমার বুকের ভেতর সুখপাখিরা দাপাদাপি শুরু করল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে। শিউলি আমায় পছন্দ করে? আমায় ভালোবাসে? এ যে আমার জন্য কতবড় পাওয়া! শিউলির হাতদুটো বুকের কাছে নিয়ে বললাম,
‘তুমি আমায় ভালোবাসো শিউলি?’
সে ফের লজ্জায় মাথা নিচু করল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল,
‘বাসি তো।’
‘কী?’
‘ভালোবাসি আপনাকে।’
আমাকে আর কে পায়। খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
‘শিউলি আমায় ভালোবাসে। আমার শিউলি আমায় ভালোবাসে।’
আমার সে চিৎকারে শিউলি চমকে উঠল। হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘এসব কি করছেন? বাইরে থেকে যদি শোনা যায়, সবাই কী ভাববে?’
শিউলি আমায় টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। আমি ফিক করে হেসে দিলাম। ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। সেই সাথে আমাদের গল্প এগিয়ে চলল। আমাদের জমানো কত কত কথা! কত কত অনুভূতি। নিঃস্তব্ধ রাত্রিতে আমরা একে অপরের কাছে নিজেদের মেলে ধরলাম। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসার গল্প চলতে থাকল।
একফাঁকে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। টেবিল থেকে একটা ডায়েরি এনে শিউলির হাতে দিলাম। ধূসর বর্ণের ডায়েরি। যার প্রথম পাতায় বড় করে লেখা ‘শিউলি তোমার জন্য’।
মোটাসোটা এই ডায়েরি জুড়ে শুধু শিউলির গল্প। শিউলির গল্প আর শিউলির গল্প। আমাদের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে ছোট্ট ছোট্ট সব মুহূর্ত। আমি লিখে রেখেছি। শিউলি তার কয়েক পাতা পড়ে বেশ অবাক হলো। একসময় ঝাপসা চোখে বলল,
‘এতো অনুভূতি নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলেন কীভাবে? আপনার কষ্ট হয়নি?’
‘হয়েছে তো। এখানটাতে।’
আমি চোখের ইশারায় বুকের বা পাশটা নির্দেশ করলাম। শিউলি সেখানটাতে হাত রাখল। আমি ওকে দুহাতে আগলে নিলাম। বুকের মাঝে, নিজের খুব কাছে। সময় বয়ে চলল। আমি শিউলির মাঝে ভালোবাসাময় এক অপার্থিব সুখের সন্ধান পেলাম।
ক্রমশ রাত বাড়ছে। শিউলি ফোঁটা একটা ভোর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। আমি উৎসুক হয়ে সেই ভোরের অপেক্ষায় রইলাম। জনম জনমের অপেক্ষা!
(সমাপ্ত)