#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০১
.
.
.
–” শুন ছেমড়ি , বেডা মাইনসের ওমন একটু আকটু স্বভাবের দোষ থাকেই। তুই তো মেলা সুন্দরী তাই আমার পোলা লোভ সামলাইতে পারে নাই। এহন এইডা নিয়া পাড়া জানাজানি করার দরকার নাই । সমাজে আমাগো একখান সম্মান আছে। তুই বরং ক্ষতিপূরণ হিসেবে বড় বউয়ের থাইকা হাজার দুয়েক ট্যাকা বেশি নিয়া নিস।
সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধ মহিলার তাচ্ছিল্য ভরা কথাগুলো শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো প্রিমা’র। রাগে সারা শরীর জ্বলে উঠলো। অপমানসূচক কথাগুলো শুনে ভেতরটায় কাঁপুনি ধরে গেলো।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অধরা ইসলাম প্রিমা। এই কংক্রিটের শহরে এতিম মেয়েটার আপন বলতে কেউ নেই। নিজের খরচ বহন করতে চারটা টিউশনি করায় সে। নবম শ্রেণিতে পড়া রিক্তা তার পুরোনো স্টুডেন্ট। আজ প্রায় বছরখানেক সময় ধরে পড়াচ্ছে তাকে। যৌথ পরিবার হওয়ায় বাসায় ছেলে টিচার রাখা নিষিদ্ধ। শেষ অব্দিই রিক্তার মা রুমানা বেগম প্রিমার খোঁজ পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হোন। তবে তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এরকম কোনো বীভৎস ঘটনা ঘটে যাবে।
যথারীতি সময় মতো প্রিমা আসে রিক্তাকে পড়াতে। ঈদের আগে আজকেই পড়ানোর শেষ দিন ছিলো। যেহেতু ঈদের আগমুহূর্ত তাই বাসায় লোকসমাগম নেহাত কম নয়। বিগত তিন দিন যাবত প্রিমা খেয়াল করছে রিক্তার চাচা নেহাল হোসেনের হাবভাব খুব একটা সুবিধার নয়। মেয়েটা সংযতচিত্তে যথাসম্ভব শালীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও হায়নার থাবা থেকে মুক্তি মেলেনি।
পড়ার ফাঁকে রিক্তা ওয়াশরুমে গেলে রিক্তার ঘরে ঢোকে নেহাল। প্রিমা হকচকিয়ে কিছু বলার পূর্বে চোরের মতো একটা কার্ড প্রিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–” আমি জানি তুমি এতিম। ঢাকা শহরে কেবল টিউশনি করে টিকে থাকা কোয়াইট টাফ। সো, তুমি চাইলে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারি বিনিময়ে আমাকে একটুখানি সময় দিলেই চলবে। কল মি লেটার ডার্লিং। ”
নেহালের নোংরা কথাবার্তা শুনে প্রিমা তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগান্বিত স্বরে বলে,
— ” স্টে ইন ইয়্যোর লিমিট বাস্টার্ড। তোর মতো কুলাঙ্গারের দরকার নেই আমার। তুই বরং তোর চরিত্র সামলে রাখ নয়তো জুতোপেটা করে…
বাকি কথা শেষ করতে পারেনি প্রিমা এর আগেই নেহাল ক্ষিপ্ত মেজাজে ওর কোমল হাতর কব্জি চেপে ধরে রুমের বাহিরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
–” আজ তোর হচ্ছে। স্লাট হয়ে মুখ দিয় এত বড় বড় কথা বের হয় কীভাবে? ”
নিজেকে বাঁচতে প্রিমা যারপরনাই চিল্লিয়ে উঠে। রাগে খেই হারিয়ে ফেলা নেহাল সেসবের তোয়াক্কা করেনা। সেসময় বাসায় উপস্থিত ছিলেন রুমানা বেগম, তার বৃদ্ধ শাশুড়ি এবং রিক্তা। প্রিমার চিৎকারে সকলেই ছুটে আসে। সবার উপস্থিতি নেহালের উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।
পরিস্থিতি বুঝে রুমানা বেগম একপ্রকার জোর করে প্রিমা কে ছাড়িয়ে নেন। বেচারি প্রিমা ছাড়া পেতেই কাঁপা গলায় সব ঘটনার বর্ণনা দেয়। বৃদ্ধা ছেলের দোষ ঢাকতে উল্টো প্রিমা কে মানিয়ে নিতে বলেন। প্রিমা হতভম্ব মুখে তাকায় বৃদ্ধার দিকে। তার সম্মান এতোই সস্তা? সম্মানের মূল্য হয় বুঝি? একমনে এসব ভেবে চলছে প্রিমা। প্রিমা কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বৃদ্ধা পুনরায় আমতা আমতা করে বলেন ,
–” শুন ছেমড়ি, মাইয়াগো জীবনে এমন দুই/ চাইরডা ঘটনা অহরহ ঘটে। বেডা মাইনসের কলঙ্ক থাহেনা কিন্তু মাইয়া মানুষ নির্দুষ অইলেও সমাজের চোক্ষে খারাপ অইয়া যায়। তুই এডি ভুইলা যা কাউরে কিছু কওনের দরকার নাই। ঈদে কী কিনবি ক আমারে.. আমি লইয়া দিমুনি। ”
বৃদ্ধার কথায় ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো প্রিমার। মানুষের মনমানসিকতা কতটা নিকৃষ্ট সেটা নতুন করে অনুধাবন করল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সংযত করে উঁচু গলায় প্রিমা বলল,
— ” আপনার এক পা কবরে আরেক পা উপরে কথাটা ভুলে যাবেন না আন্টি। নিজের সন্তানের দোষ ঢাকতে অপরাধ কে নরমালাইজ করা বন্ধ করুন। আমি আপনার নাতনির শিক্ষক। আমি কোনো যৌন কর্মী নয় যাকে আপনার ছেলে টাকার বিনিময়ে অবাধে স্পর্শ করবে। ”
বৃদ্ধ নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললেন,
–” মাইয়া মাইনসের এত ত্যাজ থাকা শোভা পায় না। মাথা গরম বেডা মানুষ নাহয় কইরা ফেলসে একখান ভুল তাই বইলা এহন ওরে ফাঁসি দিমু নাকি?”
প্রিমা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–” আপনার আদরের পুত্র কোনো সুপুরুষ নয়। সে একজন কাপুরুষ। যে কি-না একান্তে মেয়েদের সুযোগ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। আর আপনি হলেন ব্যর্থ মা যে তার নিজের সন্তানকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারে নাই ঠিকই কিন্তু দোষ ঢাকতে ওস্তাদ।
প্রিমার করা অপমান নেহাল সহ্য করতে পারলো না। প্রিমার দিকে সবেগে তেড়ে আসলো। কাছাকাছি এসে প্রিমার চুলের মুঠি ধরার আগে তার নিম্নাঙ্গ বরাবর সজোরে লাথি বসায় প্রিমা। উপস্থিত সকলেই খানিকটা হকচকিয়ে যায়। বৃদ্ধা হায় হায় করে উঠেন। প্রিমার মার খেয়ে নেহাল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রিমা ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখের কাছটায় সজোরে আরেকটা লাথি বসিয়ে বলে,
–” তোর নোংরা প্রস্তাবের স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড উত্তর ছিলো এটা। মন ভরেছে নাকি আরও দুয়েকটা দিবো? ”
তীব্র বেগে লাথিটা পড়ায় মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে এসেছে নেহালের। বৃদ্ধা তড়িঘড়ি করে ছেলের পাশে বসে বিলাপ করতে থাকেন। অদূরে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রুমানা বেগমের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় প্রিমা বলে,
–” আপনার ঘরেও একটা মেয়ে আছে বিষয়টা মাথায় রাখবেন। আমাদের পথচলা এই পর্যন্তই ছিলো। রিক্তার জন্য অন্য টিচার খুঁজে নিবেন ধন্যবাদ। ”
কথাগুলো বলে এলোমেলো পা ফেলে রিক্তাদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসলো প্রিমা। সন্ধ্যালগ্ন প্রহর হওয়ায় চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। এতক্ষণ সাহসীকতার পরিচয় দিলেও এবার যেনো বুকের ভেতর কান্নার স্রোত উথলে উঠলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল সে। গলির মোড় থেকে একটা রিকশায় চেপে বসে কাঁপা কন্ঠে চালক কে বলল,
–” মানিকনগর স্টেডিয়ামের তিন নম্বর গেইটে চলেন মামা। ”
রিকশাওয়ালা মাথা নাড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কোনোকিছু না ভেবে প্রিমা দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে। শরীরে লেগে থাকা বিশ্রী ছোঁয়া গুলো তাকে কতটা পীড়া দিচ্ছে তা বর্ণনাতী। আচ্ছা, মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে বলেই কী পরপুরুষের থাবার শিকার হতে হবে? মেয়ে বলেই সবসময় মুখ বুঁজে অন্যায় সহ্য করে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতে হবে? উত্তর মিললো না। এক পর্যায়ে প্রিমার চোখের পানি ফুরিয়ে এলো।
রিকশা বাজারে প্রবেশ করতেই প্রিমার খেয়াল হলো তার মাসিক বাজার শেষ। গত সপ্তাহে শেষ হয়েছিল তবে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে এই সপ্তাহটা পার করে দিয়েছে সে। ভার্সিটির এক্সাম ফী দিতে গিয়ে বাকি তিনটা টিউশনির টাকা ফুরিয়ে গেছে। ভেবেছিলো আজ রিক্তার মায়ের দেওয়া বেতন থেকে বাজার-সদাই করবে কিন্তু তার নিয়তি যে বড়োই অপ্রসন্ন। প্রিমা তাচ্ছিল্য হেসে শূন্য নীলাম্বরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” তুমি বিহীন দুনিয়াটা ভীষণ কঠিন লাগে আম্মি। এই দুনিয়ায় অর্ধেক মায়াজাল বাকিটা হায়েনার দল। এই মায়াজালের প্রকৃত সত্য হলো, এই পৃথিবীতে ধনীদের জন্য রয়েছে স্বর্ণমুকুট আর গরিবদের জন্য বাস্তবতার লাথি। যা আমৃত্যু সকলকে মুখ বুঁজে সয়ে যেতে হবে। ”
__
চৌধুরী নিবাসের বিশাল গেইট পেরিয়ে প্রবেশ করল একটা টয়োটা করোলা। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো চৌধুরী বাড়ির একমাত্র আদুরে এবং কনিষ্ঠ কন্যা মারজান আইরিন চৌধুরী। সবাই ভালোবেসে তাকে মেহরিমা ডাকে। উনিশ বছর বয়সী মেহরিমা স্বভাবে ভীষণ চঞ্চল এবং প্রাণোচ্ছল ধাঁচের রমণী। বাড়ির সকলেই তাকে দুষ্টমির শিরোমণি হিসেবে চিনে।
আজ মেহরিমার ভার্সিটিতে নবীন বরণ ছিলো। সকাল সকাল সাজুগুজু করে এক ঝাঁক বান্ধবীদের নিয়ে ছুটেছিল ভার্সিটির প্রাঙ্গণে। সারাদিন লম্ফঝম্প করে মেহরিমা ভীষণ ক্লান্ত তার উপর ভারিক্কি শাড়ি অর্নামেন্টসের যন্ত্রণা আর কোনোভাবেই আর সহ্য করতে পারছেনা বেচারি। সদর দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকতেই মেহরিমার চোখে পড়ে তার বড় চাচি, মেজ চাচি আর মা একসাথে বসে গল্প করছে। মেহরিমা ভেতরে ঢুকে সোজা বড় চাচি তথা আফিয়া চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে আমুদে গলায় বলল,
–” বড় মা … ও বড় মা শুনো? ”
মেহরিমার কান্ডে উপস্থিত সকলেই হেসে উঠেন। মেহরিমার মা মাহিরা চৌধুরী চোখ পাকিয়ে তাকান। আফিয়া চৌধুরী সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলেন,
–” হ্যাঁ মিঠু বুড়ি বল? ”
মেহরিমা কন্ঠে আহ্লাদ ঢেলে বলে,
–” আমাকে একটু লাজানিয়া বনিয়ে দাও না। আমার ছোট্ট পেটটা লাজানিয়ার টেস্টি স্লাইস খাওয়ার জন্য বিগত এক সপ্তাহ থেকে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। কখন জানি আন্দোলনে নেমে যায় তার ঠিক নেই। তুমি বানিয়ে দিবে না ? ”
আফিয়া চৌধুরী ভীষণ আন্তরিক মহিলা। মেহরিমার আদুরে আহ্লাদে সায় জানিয়ে বললেন,
–” হ্যাঁ মা আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তুই উপরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। ”
মেহরিমা আহ্লাদে গলে গিয়ে আফিয়া চৌধুরীর গালে টপাটপ কয়েকটা চুমু দিয়ে বলে,
–” আমার বেস্ট বড় মা। ”
মাহিরা চৌধুরী মিছে রাগ দেখিয়ে বলেন,
–” সব আবদার মেনে ওকে বিগড়ে দিয়েন না আপা। খুব সাহস বেড়েছে তার এবার লাগাম টেনে ধরতে হবে। ”
মাহিরা চৌধুরীর কথা শুনে চৌধুরী বাড়ির মেজো বউ তথা তাজকিয়া তারান্নুম চৌধুরী থমথমে কন্ঠে বললেন,
–” আরও সাত বছর আগে ব্যপারটা অনুধাবন করলে আমার বুকের মানিক অত দূরে ভিন্ন একটা দেশে পড়ে থাকতোনা মাহিরা । এখন এসব উপলব্ধি করে লাভ আছে? আমার সর্বনাশ তো হয়েই গেছে।”
মুহূর্তে পরিবেশটা নিরব হয়ে গেলো। সকলের মুখ থেকে হাসি সরে গিয়ে জায়গা করে নিলো একরাশ বিষন্নতা। কিছুক্ষণ পর প্রাণোচ্ছল মেহরিমা নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত সুরে বলল,
–” আমি ভীষণ টায়ার্ড বড় মা। চেঞ্জ করে একটু ঘুমাবো তুমি বরং পরে ওটা বনিয়ো। ”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো মেহরিমা। আফিয়া চৌধুরী বিরক্ত হয়ে মেজো জা কে বললেন,
–” তারা, এরকম করে কেউ কথা বলে? মেয়েটা আজ আর কিচ্ছুটি মুখে তুলবেনা সারাদিন। তুই বুঝেও অবুঝ কেনো হচ্ছিস? ”
তারান্নুম চৌধুরী রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
–” আমার ছেলেটা আজ সাতটা বছর ধরে কী খাচ্ছে না খাচ্ছে সেটা একমাত্র খোদা জানে। আদৌ কোনোদিন ওকে নিজ হাতে তুলে খাওয়াতে পারবো কি-না সন্দেহ হয় মাঝেমধ্যে । আমার ছেলেটাকে নিয়ে তোমাদের কোনো মাথাব্যথায় নেই অথচ কেউ একবেলা না খেয়ে থাকলে তোমাদের দুশ্চিন্তা তরতরিয়ে বাড়ে। ”
কথা শেষ করে তিনিও জায়গা ত্যাগ করেন। মাহিরা চৌধুরী চোখের কার্ণিশে জমা পানিটুকু মুছে ফেলতে ফেলতে বলেন,
–” একটা ভুলের জন্য আর কত শাস্তি পাবে আমার ছোট্ট মেয়েটা? আমার ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে আপা। ”
আফিয়া চৌধুরী সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না। বুক চিরে বেরিয়ে আসলো এক বৃহৎ দীর্ঘশ্বাস।
__
অর্ধনগ্ন শরীরে চেঞ্জিং রুমের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিমা। ফর্সাটে কলার বোনের সেনসিটিভ ত্বকে বিদ্যমান ছোপ ছোপ লালচে দাগগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ফ্লোরে পড়ে থাকা ভারী শাড়িটা দেখে একরাশ বিরক্তি এসে জমা হলো তার সুশ্রী মুখশ্রীতে। দীর্ঘক্ষণ ভারী পোশাক জড়িয়ে রাখার ফলে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। শরীরের বাকি পরিচ্ছদ অনাবৃত করে উন্মুক্ত নতজানু দেহখানা বাথটাবের উষ্ণ জলে ছেড়ে দিয়ে আরামে চোখ বুজল মেহরিমা।
এতক্ষণ লাইভ ফুটেজে মেহরিমার সমস্ত কর্মকান্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করছিল তাজরিয়ান। পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যটুকু অবলোকন হতেই ঠাস করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে সেটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেললো । পুরো বিষয়টা স্মৃতিপটে ভেসে উঠতেই অবিরাম ধারায় স্বেদজল গড়িয়ে পড়লো তার কপাল বেয়ে। জিভ দ্বারা শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে হিসহিসিয়ে বলল ,
–” সুদূর লন্ডনে থাকা সত্ত্বেও তোর মোহনীয় রুপের অগ্নিশিখা আমায় জ্বালিয়ে মারছে। অতীতে অপবাদ দিয়ে বিতাড়িত করেছিস এখন বুঝি নতুন করে বদনাম করার উপায় খুঁজছিস? ছলনাময়ী নারী কোথাকার।”
জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল তাজরিয়ান । মস্তিষ্ক থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত স্মৃতি গুলো মুছে ফেলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। নিজেকে শক্তপোক্ত কয়েকটা গালি কোষে বিগড়ানো মেজাজে কল করল বহুল কাঙ্ক্ষিত নম্বরে। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই তাজরিয়ান একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠল,
–” অতি শীঘ্রই আমি দেশে ফিরছি তুরাব। তোর অবাধ্য স্বভাবের বেয়াদব বোনকে সামলে রাখিস। আমার সম্মুখে পড়লে এক থাপ্পড়ে সকল ভীমরতি ছুটিয়ে দিবো একদম । ”
সদ্য আসা ঘুমটা আলগা হয়ে আসলো তুরাবের। ধাতস্থ হয়ে কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই তাজরিয়ান কল কেটে দিলো। রাগ সামলাতে না পেরে সজোরে ঘুষি বসালো কংক্রিটের দেওয়ালে। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা কন্ঠে বলল,
–” আমার ব্যক্তিগত নারী হওয়া সত্ত্বেও অন্য পুরুষের সামনে নিজেকে সিঙ্গেল দাবী করার সাহস কোত্থেকে আসে? অন্য পুরুষের চোখের তৃষ্ণা মেটানোর সাহস কী করে হয় তোর? তোর অস্তিত্বে নিজের নামের বৈধ সিলমোহর মেরে অতঃপর দেশ ছেড়েছি আমি। এরপরও সাতটা বছর ধরে আমাকে ইগনোর করার দুঃসাহস কী করে হয় ? জবাব রেডি রাখিস কেননা তাজরিয়ান জাওয়াদ চৌধুরী ফিরছে তোকে শায়েস্তা করতে। ”
দাঁত কিড়মিড়িয়ে প্রয়োজনীয় পোশাকাদি নিয়ে তাজরিয়ান ত্রস্ত পায়ে ছুটলো শাওয়ার নিতে। এই মুহূর্তে বিগড়ানো মেজাজ ঠান্ডা করাটা অতীব জরুরি।
দীর্ঘ দু’ঘন্টা শাওয়ার নিলেও বিগড়ানো মেজাজ কোনোভাবেই ঠান্ডা করতে পারলোনা তাজরিয়ান। মিনিট কয়েক কিছু একটা ভেবে দ্রুত শরীরের ভেজা পোশাক পাল্টে ছুটলো পাশ্ববর্তী ফ্ল্যাটে। কলিংবেল দিতেই ওপাশ থেকে একজন মেইড দরজা খুলে দিলো। তাজরিয়ান কাট কাট স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–” ভাই বাসায় আছে? ”
সার্ভেন্ট খাঁটি ইংরেজিতে মিষ্টি হেসে জবাব দিলো,
–” স্যার বেলকনিতে বসে অফিসের জরুরি কাজ করছেন। ”
তাজরিয়ান ওসব তোয়াক্কা না করে গটগট আওয়াজ তুলে সেদিক এগিয়ে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে নক করে বলল,
–” ভাই আসবো?”
শব্দের উৎস খুঁজতে দীর্ঘদেহী লম্বা একজন পুরুষ চোখ তুলে তাকালো। তাজরিয়ান কে দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” কাম ইন। ”
তাজরিয়ান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অস্থির চিত্তে বলল,
–” খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে এসেছি ভাইয়া। ”
সেই সুদর্শন যুবক ল্যাপটপ টা একপাশে সরিয়ে রেখে ক্ষীণ স্বরে বলল,
–” কী কথা তাজ? ”
তাজরিয়ান সোজা বড় ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে অশান্ত স্বরে বলল,
–” আমরা কালকেই বাংলাদেশে ফিরছি ভাইয়া। ”
সেই পুরুষের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়। কিছু একটা ভেবে থমথমে কন্ঠে বলে,
–” কালকে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। কতগুলো ডিল ফাইনাল করা বাকি। এভাবে হুট করে যাওয়া যাবে না তাজ।”
তাজরিয়ান ক্ষোভান্বিত হয়ে মাথা উঁচিয়ে সেই সুদর্শন পুরুষের চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
— ” ডিলস আর মোর ইম্পোর্ট্যান্ট দ্যান মি মিস্টার আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী? ”
তাজরিয়ানের বাচ্চামি কথাবার্তায় আরশিয়ান হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল ,
–” মেহরিমা আবার কিছু করেছে? ”
শান্ত হয়ে আসা রাগটা আবারও ধপ করে জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে তাজরিয়ান বলল,
–” আমার বউ আমি ব্যতীত দুনিয়ার সবার সাথে হা হা হি হি করতে ব্যস্ত আর আমি লন্ডনে বসে বসে পিতৃ আজ্ঞা পালন করছি। আমার বাপের ভয়ংকর ষড়যন্ত্র একদিন আমাকে অনুপম বানিয়ে ছাড়বে আর আমার অবুঝ বউটা কল্যাণীর ল্যাদা ভার্সন হয়ে আরেক বেডার আজ্ঞা পালন করবে। আই কান্ট ইমাজিন ভাইয়া। ইনাফ ইজ ইনাফ। আমরা কালকেই দেশে ফিরছি এবং এটাই ফাইনাল। ”
তাজরিয়ানের বাচ্চামি মূলক কথায় আরশিয়ান পুনরায় হেসে ফেললো। দেশে ফেরার কথা শুনে স্মৃতিপটে খুব প্রিয় একজনের কাফনে মোড়ানো বিকৃত মুখশ্রীর ঝলক ভেসে উঠলো। লম্বা শ্বাস টেনে বুকে চলমান ঝড়টা থামানোর প্রয়াস করে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” আমরা কালকেই বাংলাদেশে ফিরবো তাজ।”
চলবে?