শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-১০

0
18

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১০

অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষ। বেলকনির কাঁচ আবৃত দরজাটা খোলা যার ফলস্বরূপ বেলাগাম বৃষ্টির ফোঁটা গুলো হাওয়ার দাপটে স্বাধীনভাবে নিজের তান্ডব চালাচ্ছে পুরো কক্ষ জুড়ে। কক্ষের মেঝেতে নিষ্প্রাণ প্রাণীর ন্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেহরিমা। শূন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কিছুক্ষণ পর আনমনে বিড়বিড়য়ে বলে উঠল,

–” তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, কী দোষ দিবি তাতে?
বন্ধু, তোরে খুঁজে বেড়াই সকাল-দুপুর-রাতে! ”

নিশ্চল স্বরে লাইন দু’টো বলতেই মেহরিমার সজল আঁখি জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রুকণা। তাজরিয়ানের দেশত্যাগ করার প্রায় সাতমাস পেরিয়েছে তবে এতদিনেও মেহরিমার জন্য সাতটা মিনিট সময় হয়নি সেই নিষ্ঠুর লোকের। বেহায়ার মতো মেহরিমা নিজেই কতশত কল করেছে, টেক্সট দিয়েছে, মেইল পাঠিয়েছে তবে কোনোকিছুতেই সেই কঠোর লোকের মন গলেনি।

সামান্য একটা কথার জন্য এত বড় শাস্তি? নাকি সাত বছর যাবত সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ রাখার শাস্তিস্বরূপ তাজরিয়ান ও সেই একই পন্থা অবলম্বন করছে? কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটায় অস্থিরতা সৃষ্টি হলো মেহরিমার। মায়া লাগিয়ে দূরত্ব বাড়ানো কোনো শাস্তি নয় বরং সাক্ষাৎ মৃত্যুদন্ড। মেহরিমা আবারও অভিমানী গলায় বলল,

–” এতকিছু বুঝলেন অথচ আপনাকে ঘিরে আমার হৃদয়ে থাকা শিরোনামহীন অনুভূতির গভীরতা কেনো বুঝলেন না? ভুল তো ঠিকই বুঝলেন কিন্তু একটাবার নিজেকে ক্ল্যারিফাই করার সুযোগ কেনো দিলেন না তাজ? ”

এই আহাজারি কেবল বদ্ধ ঘরটাতেই আঁটকে রয়। মেহরিমা আর্তনাদের সুরে কত-শত বুলি আওড়াল তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু শত শত মাইল দূরে অবস্থানরত সেই লৌহ মানবের নিকট অব্দিই তা আর পৌঁছাল না। মেহরিমা ম্লান হাসে। সে তাজরিয়ানের ভালোবাসা নয় বরং তার অপ্রকৃতস্থ মস্তিষ্কের চাহিদা ছিলো কেবল। হয়তো চাহিদা পরিবর্তন হয়েছে এজন্যই ব্যক্তিটা নির্বিকার অথচ অতীতে এই মানুষটার সর্বস্ব জুড়ে কেবল মেহরিমার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো।

অযাচিত ভাবনা গুলো মেয়েটার হৃদয়ে সর্বনাশা তান্ডব চালাল। এদিক-ওদিক হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজল মেহরিমা। একরাশ আগ্রহ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত একাউন্টের ইনবক্সে যেতেই দেখল শত-শত ইনগোরড কলস এবং মেসেজের চিত্র। মানুষটা অনলাইনে অথচ ইনবক্সে তার কোনো রেসপন্স নেই।

এতটা অবহেলা সহ্য হলো না মেহরিমার। না চাইতেও পাগলের মতো দুহাতে চুল খামচে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল বেচারি। তন্মধ্যে আচমকা নোটিফিকেশনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। তাজরিয়ান কিছু একটা পোস্ট করেছে তার ফেসবুক একাউন্টে। মেহরিমা তৎক্ষনাৎ চেক করতে গিয়ে অনুভব করল তার হৃদয়ে কেউ এসিড নিক্ষেপ করেছে। কাঁপতে থাকা হাতটা থেকে ফোনটা ঠাস করে পড়ে গেল। মেহরিমা অবাক চিত্তে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে শূন্যে তাকিয়ে রইল স্রেফ।

একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে ছবি তুলে ” প্রসঙ্গ যখন মায়ার তখন আমার কাছে তুমিই শ্রেষ্ঠ ” ক্যাপশন দিয়ে সেটা তার ভ্যারিফাইড ফেসবুক একাউন্টে আপলোড করেছে তাজরিয়ান। মেহরিমা থম মেরে মূর্তির ন্যায় বসে রইল কিছুক্ষণ। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক আগ্রাসী দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।

আচানক কী হলো কে জানে, সর্বদা নরম স্বরে কথা বলা মেয়েটা আকস্মিক গলা ফাটিয়ে জোরালো শব্দে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সর্বনাশা জেদ চেপেছে তার মাথায়। রেগেমেগে পুরো ঘরটা নিমিষেই তছনছ করে ফেলল সে। শেষমুহুর্তে রাগ সামলাতে না পেরে ফোনটা তুলে কাঙ্ক্ষিত একাউন্টে ঢুকে ঝটপট টাইপ করল,

–” আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত না হলে আপনি বিপত্নীক পুরুষ হিসেবে আখ্যা পাবেন মিস্টার তাজরিয়ান জাওয়াদ চৌধুরী।সিধান্ত আপনার হাতে, স্ত্রীর কাফনে মোড়ানো লাশ দেখবেন নাকি ইগো সাইডে রেখে দেশে ফিরবেন। গুডলাক। ”

মেসেজটা ডেলিভারড হতেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। বুকের ভেতর চলা বিধ্বংসী ঝড়টাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তাজরিয়ানের ফেলে যাওয়া ঘুমের ওষুধের পাতা থেকে পাঁচটা মেডিসিন নিয়ে দ্রুত সেগুলো সেবন করল। কিছুক্ষণ নিশ্চল ভঙ্গিতে বেডে হেলান দিয়ে বসে থাকলেও এক পর্যায়ে মেহরিমার শরীরটা নিঃসাড় হয়ে ঢলে পড়ল ফ্লোরে।

মাহিরা চৌধুরী মেয়ের জন্য স্যুপ বানাচ্ছিলেন। তাজরিয়ান যাওয়ার পর থেকে কেনো যেনো তার বাচ্চা মেয়েটা একেবারে মনমরা হয়ে গেছে। নিজের প্রতি অবহেলার ফলস্বরূপ ওজনের সংখ্যাটা সাতান্ন কেজি থেকে সোজা উনচল্লিশ কেজিতে এসে ঠেকেছে। মেয়েকে নিয়ে ইদানীং তিনি বড্ড দুশ্চিন্তায় থাকেন। মেহরিমার হাল সকলেই লক্ষ্য করেছে কিন্তু তারা যে নিরুপায় কেননা মেহরিমা নিজেই চাইনা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলাখুলি কোনো কথা বলতে। দেখতে দেখতে মেয়েটা কত বড় হয়ে গেলো কথাটা ভেবেই আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মাহিরা চৌধুরী।

স্যুপে সেদ্ধ মাংস দেওয়ার সময় আচমকা তার ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই দেখলেন কলটা তাজরিয়ানের। সাত মাসের মাথায় প্রথম তাজরিয়ানের কল পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন মাহিরা চৌধুরী। বুকে শঙ্কা চেপে কলটা রিসিভ করতেই তাজরিয়ান উৎকন্ঠিত স্বরে বলল,

–” মেহরিমা রাগের মাথায় না বুঝে হাই পাওয়ারের অনেক গুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলেছে ছোটমা। প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে তোমরা আর দেরি করো না। জলদিই মেডিকেলে নাও ওকে। ”

মাহিরা চৌধুরী কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে যান। উনাকে ভারসাম্য হারিয়ে নিচে বসে পড়তে দেখে ডাইনিং থেকে আফিয়া চৌধুরী এগিয়ে আসেন। মাহিরা চৌধুরী উনাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন,

–” আমার মেয়ে সুইসাইড করেছে.. ঘুমের ঔষধ খেয়েছে.. ওকে বাঁচান আপা। ”

বাসায় তৌকির চৌধুরি ব্যতীত কোনো পুরুষ মানুষ নেই। সকলেই ছুটেছে নিজ নিজ কর্মস্থলে। বাধ্য হয়ে উনারা তিন জা মিলে চেতনাশূন্য মেহরিমাকে হসপিটালে নিয়ে যান। মেহরিমার কথা শুনে তৌকির চৌধুরী আচানক অসুস্থ হয়ে পড়লে উনাকেও হসপিটালাইজড করা হয়। আফিয়া চৌধুরী না পারতে উদগ্রীব হয়ে খবর দেন আরশিয়ানকে। তিনি যদি জানতেন এই একটা কারণে সম্পর্ক নামক সমীকরণ গুলো এক নিমিষেই পাল্টে যাবে তাহলে হয়তো এই ভুলটা করতেন না।

_

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। ক্রমশ ভয়াল অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে পৃথিবী। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আলোকিত পিচ্ছিল রাস্তায় তুমুল গতিতে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরশিয়ানের কালো রঙের মার্সিডিজটা।

আরশিয়ানের নির্মল মুখশ্রীতে নেমেছে আঁধার, শান্ত মস্তিষ্কে চলছে ভয়াবহ দুশ্চিন্তা। পাশে বসে থাকা প্রিমা থেমে থেমে আড়চোখে অবলোকন করছে আরশিয়ানের চিন্তিত মুখাবয়ব। অন্যদিকে ম্যানেজার সাহেব বসে বসে দোয়া পড়ছেন। এই রাস্তায় গাড়ি যদি একবার স্লিপ করে তাহলে যমদূতের দুয়ারে পৌঁছাতে বিন্দুমাত্র সময় লাগবেনা কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে মুখ ফুটে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছেন না তিনি।

কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আচমকা গাড়ির স্পিড তুমুল গতিতে বাড়তে লাগলো। গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে আরশিয়ান টের পেলো গাড়িটা তার নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করার পর বুঝল গাড়ির ব্রেক ফেইল হয়ে গেছে। মুহূর্তেই এক নীরব আতঙ্ক ঘিরে ধরলো তাকে। চিন্তিত চোখে একবার প্রিমা এবং ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রলম্বিত একটা শ্বাস ছাড়লো আরশিয়ান।

সামনে থেকে ধেয়ে আসা বিরাট গাড়িগুলো কে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে গেলেও এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। উপায়ন্তর না পেয়ে নিরাপদ জায়গার খোঁজে পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে পাহাড় ঘেঁষা জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি ঘোরালো আরশিয়ান। উৎকন্ঠায় গা হিম হয়ে আসছে তার কিন্তু এই মুহূর্তে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়লে বাকি দু’জন কে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়বে। গাড়ির স্পিডোমিটার দেখে প্রিমা না চাইতেও বলল,

–” আপনার দুশ্চিন্তা যথাযথ তবে এভাবে পিচ্ছিল রাস্তায় ড্রাইভ করলে যেকোনো মুহূর্তে আমরা দুর্ঘটনার শিকার ….

প্রিমার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে আরশিয়ান শীতল কন্ঠে বলল,

–” গাড়িটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই মিস প্রিমা। গাড়ির ব্রেক ফেইল হয়ে গেছে। ডোন্ট বি স্কেয়ার্ড..

প্রিমা বিস্মিত গলায় বলল,

–” কীহ্? ”

ম্যানেজার সাহেবের ও ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আরশিয়ান তাদের নিশ্চিন্ত রাখতে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল,

–” আতঙ্কিত হবেন না। আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন প্লিজ। সামনে জঙ্গলের মতো জায়গাটায় গাড়ি পৌঁছাতেই আপনারা লাফ দিবেন। ছোটো খাটো চোট লাগলেও প্রাণনাশের আশঙ্কা নেই। ”

ম্যানেজার সাহেব আতঙ্কে কেঁদে ফেললেন। বুঁজে আসা কন্ঠে বললেন,

–” স্যার.. কীভাবে সম্ভব। গাড়ি তুমুল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু এদিকওদিক হলে আমরা সোজা পাহাড়ি খাদে গিয়ে পড়বো। ”

আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” এমন কিছুই হবে না। পজিটিভলি চিন্তা করুন। লক্ষ্য স্থির করে ঝাঁপ দিন। এটা আপনার জীবন মরণের প্রশ্ন সুতরাং বি এলার্ট ওকে? যত আতঙ্কিত হবেন তত বেশি অসফল হওয়ার চান্স বাড়বে। সময় কম আপনারা জলদিই প্রস্তুতি নেন। ”

প্রিমার আতঙ্কে সারা শরীর জমে যাচ্ছে। চোখের পাতায় ভেসে উঠছে মৃত মা এবং ফারজানার নিষ্পাপ মুখশ্রী। প্রিমা ধরে আসা গলায় বলল,

–” আমরা নাহয় বেরিয়ে যাব কিন্তু আপনি? ”

আরশিয়ান চকিতে ফিরে তাকাল প্রিমার দিকে। মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে টলমল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরশিয়ান ম্লান হেসে বলল,

–” আল্লাহ চাইলে আমিও সেইফলি বেঁচে ফেরার চেষ্টা করব। সময় অনেক কম। আপনারা দ্রুত প্রস্তুতি নেন। ”

উপায়ন্তর না পেরে তারা রাজি হলো। সমতল ভূমির কাছাকাছি আসতেই গাড়ির দরজা খুলে লাফ দিলেন ম্যানেজার সাহেব। প্রিমা লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও শেষমুহুর্তে সিটবেল্টটা গাদ্দারি করে বসলো। কোনোমতেই খুললো না ওটা। আরশিয়ান সেটা দেখে এবার নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। এক হাতে স্টিয়ারিং সামলে অন্য হাতে সিটবেল্ট ধরে টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। উপায়ন্তর না দেখে কিছু একটা ভেবে প্রিমাকে বলল,

–” ড্যাশবোর্ডে ফার্স্ট এইড কীট আছে। ওখানে সিজার থাকতে পারে। দ্রুত খুঁজে দেখেন। ”

ভাগ্য বোধহয় সদয় হলো কিছুটা। প্রিমা সামান্য খুঁজতেই পেয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত বস্তু। কাঁপা হাতে সিটবেল্টটা কাটতে লাগলো সে। শেষপর্যায়ে এসে আচমকা আরশিয়ানের আতঙ্কিত স্বরে থমকে গেলো প্রিমার হাত। সামনে তাকাতেই মরণ ভয় গ্রাস করল নিমিষেই।

সংকীর্ণ রাস্তাটায় পাশাপাশি দু’টো গাড়ির চলাচল অসম্ভব। সামনের দিক থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে একটা মালবাহী ট্রাক। যেকোনো সময় ট্রাকের জোরালো আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে গাড়িটা। বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারা মাত্রই সংঘর্ষের কয়েক সেকেন্ড পূর্বে প্রিমাকে একহাতে পেঁচিয়ে ধরে আরশিয়ান দ্রুত লাফ দিলো পাহাড় ঘেঁষে চলা খরস্রোতা নদীতে। ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড পর ট্রাকের জোরালো ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে সোজা খাদে গিয়ে পড়লো আরশিয়ানের সখের গাড়িটা।
_

আশেপাশের অস্পষ্ট শোরগোলের শব্দ কানে আসতেই বন্ধ চোখের পাতা নড়ে উঠলো আরশিয়ানের৷ শব্দের উৎস খুঁজতে জোরপূর্বক বন্ধ চোখজোড়া মেলে তাকাল। শুরুতে সবকিছু ঝাপসা লাগলেও কয়েক মুহূর্ত পর সবকিছু স্পষ্ট হয়ে আসলো। চোখ মেলতেই সে আবিষ্কার করল তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছে। দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে পুনরায় নিজের দিকে তাকাতেই দেখলো, বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে তার শরীরটাকে। কেবল মাথা এবং দু’টো বাহিরে রয়েছে। হতভম্ব চোখে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল প্রিমার অবস্থাও একই। আরশিয়ান কে চোখ খুলতে দেখে একজন উচ্চ স্বরে বলল,

–” পোলার জ্ঞান ফিরছে ইমাম সাহেব। ”

আরশিয়ান আশেপাশে তাকিয়ে কিছুই বুঝলোনা। তার সামনে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু লোকজন। তাদের পরিচ্ছদে গ্রামীণ ভাবটা স্পষ্ট পরিলক্ষিত। প্রিমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু মহিলা, যাদের পুরো শরীর কালো পরিচ্ছদে আবৃত। তাদের প্রত্যকের চোখেমুখে লেপ্টে থাকা তীব্র রাগটা আরশিয়ানের নিকট অদ্ভুত লাগলো।

যতদূর মনে পড়ে, গাড়ি থেকে লাফ দেওয়ার পর তারা একটা খরস্রোতা নদীতে আছড়ে পড়ে। প্রিমা এবং আরশিয়ান দু’জনেই মোটামুটি সজ্ঞানে ছিল। তীব্র স্রোতে অনেকটা দূর ভেসে যাওয়ার পর বহুত চেষ্টা করে কিছুটা সাঁতার কেটে নদীর অতল গভীরতা থেকে দূরে সরে আসে তারা। তীরে পৌঁছানোর পূর্বে প্রিমা অচেতন হয়ে পড়ে। আরশিয়ান কোনোমতে ওকে টেনে তীর অব্দিই আনার পর নিজেও হাল ছেড়ে দেয়। এরপর কী হয়েছে আর কিছুই মনে নেই তার৷

আরশিয়ানকে কিছুটা ধাতস্থ হতে দেখে একজন জুব্বা পরিহিত বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে আরশিয়ান কে শুধাল,

–” তোমরা কী স্বামী-স্ত্রী? ”

আরশিয়ান হকচকিয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল,
–” জ্বী না। আমরা দুজনেই অবিবাহিত। ”

বয়স্ক ইমাম সাহেব ভ্রু কুঁচকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

–” কোত্থেকে এসেছ তোমরা? এত রাতে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েলোকের সাথে নদীর পাড়ে কি করছিলে তুমি ?”

বিকৃত কথাগুলো শুনে আরশিয়ানের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো প্রিমা নিঃশব্দে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তার মুখখানা কেবল উন্মুক্ত তা ব্যতীত মাথাসহ বাকি অংশটুকুতে একটা কালো চাদর জড়িয়ে রাখা হয়েছে। মশালের হলুদাভ আলোয় মেয়েটার বিষাদে আছন্ন মুখখানা দেখে সহসা আরশিয়ানের বুকটা কেঁপে উঠল।

প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামবাসীরা আরশিয়ানের নিরুত্তর ভাবভঙ্গি দেখে আরও ক্ষেপে গেল। একজন লোক রুষ্ট স্বরে ইমাম সাহেবকে বলল,

–” হুজুর, হেরা যিনা করতে গিয়ে ধরা পড়সে। আপনি ওগরে সুযোগ দিলে আমাগো গেরামের মাইয়া পোলারা অন্যায় করার সাহস পাইয়া যাইবো। আমি বাঁইচা থাকতে এডি হইতে দিবার পারিনা। ”

অন্যরাও গলা মিলিয়ে সহমত পোষণ করল। ইমাম সাহেব হাত উঁচিয়ে সকলকে থামতে বলে পুনরায় আরশিয়ান কে বললেন,

–” সংরক্ষণশীল মুসলিম পরিবার নিয়ে গঠিত এই গ্রাম। যেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশা করাটাকে যিনা হিসেবে দেখা হয় সেখানে আমরা তোমাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। যিনার শাস্তি হলো পাথর নিক্ষেপ করে অন্যায়কারীকে হত্যা করা। তোমাদের সাথেও তেমনটাই করা হবে। মৃত্যুর পূর্বে কোনোকিছু বলার আছে তোমার? ”

পুরো বিষয়টা হজম করতে আরশিয়ানের মিনিট খানেক সময় লাগলো। তাদের ভুল ধারণা ভাঙাতে আরশিয়ান পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। গ্রামবাসীরা কিছুতেই সেটা বিশ্বাস না করে উল্টো আরও রেগে গেল। তাদের এতটা এগ্রেসিভ রুপ দেখে আরশিয়ান অসহায় কন্ঠে বলে উঠল,

–” আপনারা চাইলে আমার অভিভাবকের সাথে কথা বলতে পারেন। আমরা মিটিংয়ে এসে এই দূর্ঘটনার শিকার হয়েছি। আমাদের ভুল বুঝে অহেতুক এত নোংরা অপবাদ দিবেন না। ”

ইমাম সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। একদিকে গ্রামবাসীর অধৈর্য আচরণ অন্যদিকে আরশিয়ানের আত্মবিশ্বাসের সুরে বলতে থাকা সকল বক্তব্য। উনি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে হাত উঁচিয়ে সকলকে থামিয়ে বললেন,

–” আমি ন্যায়বিচার করার চেষ্টা করব।তোমরা শান্ত হও। কেউ একজন আমার মোবাইল ফোনটা নিয়ে আসো। ”

আদেশ পাওয়া মাত্রই একজন দৌড়ে একটা বাটন ফোন এনে ইমাম সাহেবের হাতে দিলেন। তিনি বলিষ্ঠ স্বরে আরশিয়ান কে বললেন,

–” তোমার বাবার নম্বরটা দাও। মনে রেখো, এটাই শেষ সুযোগ। তুমি যদি সত্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হও তাহলে তোমাদের শাস্তি হবে আরও ভয়ানক। ”

আরশিয়ানের চোখমুখে ভয়ের লেশমাত্র দেখা গেলোনা। ইমাম সাহেব প্রথমবার কল করলেন কিন্তু ওপর পাশ থেকে রিসিভ হলোনা। তা দেখে আরশিয়ান এবং প্রেমা দুজনেই আতঙ্কিত চোখে একে-অপরের দিকে তাকাল। ইমাম সাহেব পুনরায় কল দিলেন সেই একই নম্বরে।

হসপিটালের করিডরে বসে ছোটো ভাইকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত ছিলেন আরিয়ান চৌধুরী। হুট করে আননোন নম্বর থেকে কল আসায় তিনি কিছুটা বিরক্ত হোন। কল কেটে গেলেও তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করলেন না কিন্তু দ্বিতীয়বার কল আসায় রিসিভ করতে বাধ্য হলেন। কল রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর পাশের কথা শুনে থমকে গেলেন।ওপর পাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ শুধাল,

–” আরশিয়ান চৌধুরী সম্পর্কে আপনার কী হয়? ”

আরিয়ান চৌধুরী বিগড়ানো মেজাজে বললেন,

–” মশকরা করছেন আমার সাথে? নম্বর কোত্থেকে পেয়েছেন? ”

ইমাম সাহেব থতমত খেয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই আরিয়ান চৌধুরী ঘাবড়ানো কন্ঠে হড়বড়িয়ে বললেন,

–” আমার ছেলেটা ঠিক আছে? ওর কোথাও চোট লাগেনি তো? ”

ইমাম সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,

–” আপনার ছেলে ঠিক আছে। আপনার ছেলে হয়তোবা নির্দোষ কিন্তু আমরা তাদের যে অবস্থায় উদ্ধার করেছি সেটা গ্রামবাসীর কাছে অত্যন্ত জঘন্য একটা প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। আপনার ছেলেকে যদি জীবিত দেখতে চান তাহলে গ্রামবাসীর শর্ত আপনাদের মানতে হবে। ”

আরিয়ান সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন,

–” টাকা পয়সা যা লাগবে নেন। আপনাদের সমস্ত দাবিদাওয়া আমরা মানবো স্রেফ আমার ছেলে মেয়ে দু্টোকে সহিসালামত ফিরিয়ে দেন। ”

ইমাম সাহেব খানিকটা রুষ্ট কন্ঠে বললেন,

–” আমরা লোভী নয়। আমরা কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তৎপর। যাকগে আপনারা শহুরে মানুষ ওসব বুঝবেন না। মূল কথা হলো, যেহেতু ছেলেমেয়ে দু’জনেই অবিবাহিত এবং আমরা তাদের অসংলগ্ন অবস্থায় উদ্ধার করেছি তাই বিয়ের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কটাকে হালালে রুপান্তর করাটাই এই পাপ মোচনের একমাত্র মাধ্যম। আ….

কথা শেষ করার পূর্বে আরশিয়ান রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে জোরালো স্বরে বলে,

–” আমরা নির্দোষ সেটা প্রমাণ হওয়ার পরও আপনি আমাদের শাস্তি দিতে পারেন না। এটা অন্যায়। ”

ইমাম সাহেব কঠোর গলায় বললেন,

–” প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হওয়ার পরও একজন সাবালিকা নারীর সাথে অবাধে মেলামেশা করাটা হারাম। এর শাস্তি নিশ্চয়ই তোমাদের পাওয়া উচিত?”

আরশিয়ান চুপ হয়ে গেল। এর প্রত্যুত্তর তার জানা নেই। গ্রামবাসী উদগ্রীব হয়ে আছে তাদের শাস্তি দেখার জন্য। ওদিকে বুদ্ধিমান আরিয়ান সাহেব পরিস্থিতি বুঝে ইমাম সাহেব কে বললেন ফোনটা আরশিয়ানের সন্নিকটে নিতে। ইমাম সাহেব ফোনটা আরশিয়ানের নিকট আনতেই আরিয়ান সাহেব কাতর কন্ঠে ছেলেকে বললেন,

–” আব্বু শুনো? বাবার কলিজা তুমি। তোমার কিছু হলে আমরা মরে যাবো বাবা। এই বিয়েতে তুমি অমত পোষণ করো না আব্বা। মনে করো মৃত্যুর আগে এটাই আমার চাওয়া। তুমি ফিরিয়ে দিবে আমাকে? ”

বাবার কথায় বুকের ভেতরটা নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল আরশিয়ানের। আঁটকে আসা কন্ঠে বলল,

–” আমি বিপত্নীক পুরুষ আব্বু। আমার মরহুম স্ত্রীকে আমি কী জবাব দেবো? তোমরা এতটা পাষাণ হইয়ো না। সব শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত আমি। তবুও…..”

আরশিয়ানের কথা শেষ হওয়ার পূর্বে আচমকা চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফোনটা বন্ধ হয়ে যায়। ইমাম সাহেব এ পর্যায়ে কিছুটা কঠোর গলায় বললেন,

–” সামর্থ্য থাকলে স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় চার বিয়ের বিধান আছে। যেহেতু তোমার স্ত্রী মৃত তাই তোমার কথার বরখেলাপ হচ্ছে না। তুমি কাউকে ঠকাচ্ছ না বরং নিজের জন্য সঠিক সিধান্ত নিচ্ছো। অহেতুক আবেগ জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনে। ভালোবাসা ভালো তবে অন্ধ ভালোবাসা মানুষকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। ”

আরশিয়ানের মস্তিষ্কে সেসব কথা পৌঁছাল কিনা কে জানে। সে নিজের ভাবনায় মশগুল। এদিকে প্রিমার পাশে দাঁড়ান মেয়েলোক রাগ সামলাতে না পেরে আক্রমণ করে বসে প্রিমার উপর। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সজোরে থাপ্পড় বসায় প্রিমার গালে যার ফলস্বরূপ মাথার কাটা অংশে জমাট বাঁধা রক্ত বাধাহীনভাবে গড়িতে পড়তে থাকে। বেচারি আর্তনাদ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরেকজন মহিলা প্রিমার মাথার চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে টেনে বলে,

–” নোংরামি করে বেড়াচ্ছিস অথচ বিয়ে করতেই যত সমস্যা তাইনা ? তোর মতো মেয়েদের জন্য পুরুষলোক খারাপ হয়। মরিস না কেনো তোরা? ”

কথাগুলো শেষে পুনরায় প্রিমা কে আঘাত করতে নিলে আরশিয়ান গুরুগম্ভীর স্বরে বলল,

–” থামুন আপনারা। আমি র..রাজি এই বিয়েতে। ”

প্রায় অর্ধ অচেতন প্রিমা আঁটকে আসা কন্ঠে বলল,

–” আমার জন্য এত বড় স্যাক্রিফাইজ করতে হবে না স্যার। ওরা আমাকে আঁটকে রাখলেও আপনার কোনো ক্ষতি করবেনা। পিছুটান না রেখে সামনে এগিয়ে যান। আমার কোনো অভিযোগ থাকবেনা আপনার প্রতি। ”

আরশিয়ান স্পষ্ট সুরে সবার সামনে বলে,

–” পরিবার ব্যতীত বাস্তবিক অর্থে আমার কোনো পিছুটান নেই। যৌবনের শুরুতে যে-ই নারীর প্রেমে উন্মাদ হয়েছিলাম দিনশেষে তাকেই বৈধ রুপে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার এপথে পা বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। স্বয়ং মৃত্যু আসলেও আমি নিজের কথায় অটল থাকতাম। স্রেফ বাবার শেষ ইচ্ছে রাখতে আমি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে কবুল করতে রাজি হয়েছি। আপনার যদি এই বিয়ে নিয়ে কোনোরূপ আপত্তি থাকে তবে আমি আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি বিচ্ছেদের প্রসঙ্গে সম্মত হলে আমি তৎক্ষনাৎ তাতে সম্মতি প্রকাশ করতে বাধ্য থাকব । ”

প্রত্যুত্তরে বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলনা প্রিমা। বর্ণনাতীত যন্ত্রণা গুলো বুকে চেপে রেখে মেনে নিল নিয়তি। শুরু হলো বিয়ের তোড়জোড়। কাজি কবুল শব্দের স্বীকারোক্তি চাইলে দু’জনেই অশ্রুসজল চোখে ধীর গলায় পরপর তিনবার তা উচ্চারণ করল। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় প্রথমবার দু’টো অর্ধ কবরস্থ মানুষ একে-অপরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো।

চলবে?