শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-১১

0
21

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১১

প্রকৃতি প্রলয়ঙ্কারী তান্ডবলীলায় ব্যস্ত। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। ভারী বর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ মহাশয় বিদায় নিয়েছেন। অন্ধকারে ডুবে আছে চিলেকোঠার ঘরটা। ফারজানা চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। সেই বিকাল থেকে অনবরত কল করছে প্রিমাকে অথচ তার ফোনটা বন্ধ বলছে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফারজানা নিজেকে বুঝ দিতে বলল,

–” হয়তো ব্যস্ত আছে। আমি অযথা টেনশন করছি। যদিও ঢাকার বাহিরে গিয়ে মেয়েটা বড্ড কেয়ারলেস হয়ে গেছে। একটাবার ফিরুক এরপর জোরেশোরে বকুনি দিবো।”

টেনশনের ঠেলায় বিকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি বেচারির। ক্ষুধায় পেট মোচড় দিয়ে উঠলে প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে বিছানায় বসলো সে। এক হাতে ভাত মাখাতে মাখাতে অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করতে শুরু করল। একটা লোকমা মাখিয়ে মুখে নিতেই ফারাজানার চোখ আটকালো সম্প্রতি সম্প্রচার হওয়া একটা নিউজে। মনোযোগ দিয়ে শিরোনাম টা পড়তেই আঁতকে উঠল সে। শিরোনামে লেখা আছে,

–” চট্রগ্রাম থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার গুরুতর ভাবে আহত এবং নিখোঁজ আরও দু’জন তবে সম্প্রতি মিস্টার আরিয়ান চৌধুরির সাথে কথা বলে জানা গেছে বাকি দু’জনের খোঁজ উনারা পেয়েছেন এবং তারা সহিসালামত আছে……”

কথাটুকু শুনে ফারাজানার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। তব্দা খেয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল নিউজে দেখানো উদ্ধারকৃত দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কালো গাড়িটার দিকে। ডিলের জন্য চট্টগ্রামে গিয়েছিল আরশিয়ান, প্রিমা এবং ম্যানেজার সাহেব। নিখোঁজ দু’জনের মধ্যে একজন প্রিমা কথাটা মস্তিষ্কে আসতেই তার হৃৎপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় মুখে থাকা ভাত গিলতেও ভুলে গেছে বেচারি। হুঁশ ফিরতেই পানি পান করে কোনোমতে ভাতটুকু গিলে ফেলল সে। প্রিমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছে মস্তিষ্কে। বুকের ভেতরটায় রীতিমতো তান্ডব চলছে।

কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে শক্ত হাতে বিছানা খামচে ধরলো ফারজানা। ভয়ের চোটে দুচোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ চোখদুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিজেকে সামলাতে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

–” শী ইজ অলরাইট..

অস্থির মনটা সাহস পায় না। নিউজের কথাগুলো মাথায় আসতেই ফোনটা হাতে নিয়ে আরিয়ান চৌধুরীর নম্বর খুঁজল। অফিশিয়াল নম্বর হওয়ায় কল দিয়ে তাকে পাওয়া গেলোনা। উপয়ান্তর না পেয়ে দ্রুত নিজের ব্যাগে এক্সট্রা কিছু টাকা, ফার্স্ট এইড কীট এবং একসেট জামাকাপড় নিয়ে ছুটলো চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে। গতবারের পার্টিটা এটেন্ড করায় চৌধুরী বাড়িতে ঠিকানা তার জানা আছে।

ঝড়-বৃষ্টির রাতে গাড়ি পাওয়া মুশকিল হলেও উপরওয়ালার দয়ায় ফারজানা একটা সিএনজি পেয়ে গেলো। ডাবল ভাড়া গুনতে হলেও সে দ্বিরুক্তি করল না। সিএনজি চৌধুরী বাড়ির গেটে এসে পৌঁছাতেই সে সিএনজি ওয়ালাকে বলল,

–” মামা দশমিনিট দাঁড়ান এখানে। ভেতরে একটুখানি কাজ আছে আমার। আমি জাস্ট যাবো আর আসবো। এরপর আপনি আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়েন। আমি আপনাকে তিন ডাবল ভাড়া দিবো প্রয়োজনে। ”

ঝড়ো হাওয়া বইলেও বৃষ্টি নেই এজন্যই বৃদ্ধ সিএনজি ওয়ালা তিন ডাবল ভাড়ার কথা শুনে আর অমত পোষণ করলেন না বরং সানন্দে রাজি হলেন। ফারজানা হুড়মুড়িয়ে সিএনজি থেকে নেমে চৌধুরী বাড়ির গেটে কড়া নাড়লে গার্ড তাকে আঁটকে দিয়ে প্রশ্ন করে,

–” কে আপনি? কাকে চাইছেন?”

ফারজানা ব্যাগ থেকে তার অফিশিয়াল কার্ডটা বের করে গার্ডদের দেখিয়ে বলল,

–” আমি চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির একজন এমপ্লয়ি। আরিয়ান স্যারের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার আমার। প্লিজ একটু ভেতরে যেতে দিন। ”

একজন গার্ড নির্বিকার স্বরে বলল,

–” বাসায় কেউই নেই। ছোটো ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে পড়ায় উনারা *** হসপিটালে আছেন। আপনি পরবর্তীতে অন্য কোনো সময়ে আসুন। ”

ফারজানা আশাহত হলো। কী করবে বুঝতে না পেরে গার্ডকে বলল,

–” আমাকে আরিয়ান স্যারের পার্সোনাল নম্বরটা একটু দিন প্লিজ। ”

গার্ড তৎক্ষনাৎ নাকচ করে বলল,

–” দুঃখিত। আমাদের সেই অনুমতি নেই। ”

ফারজানা কাকুতি মিনতি করেও তাদের মন গলাতে না পেরে অবশেষে বলল,

–” নম্বর দিতে হবে না এটলিস্ট আপনি একটাবার কল দিয়ে আমাকে কথা বলিয়ে দিন। বিশ্বাস করুন.. ভীষণ বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি আমি। ”

ফারাজানার অসহায় মুখশ্রী দেখে গার্ডের মায়া হলো ভীষণ। এক পর্যায়ে রাজি হয়ে সে কল করল আরিয়ান চৌধুরীকে। ছেলের চিন্তায় পাগলপারা আরিয়ান চৌধুরী বারংবার কল দিয়ে যাচ্ছেন ইমাম সাহেবের নম্বরে কিন্তু অপর পাশ থেকে ফোনটা বন্ধ বলছে। দুশ্চিন্তার মাঝে আচমকা বাড়ির দারওয়ানের কল পেয়ে আরিয়ান সাহেব তৎক্ষনাৎ তা রিসিভ করলেন। এপাশ থেকে গার্ড বলে উঠল,

–” আসসালামু আলাইকুম স্যার। হুট করে এত রাতে একজন এমপ্লয়ি এসে বারংবার আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইছে। আমি পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললেও তিনি বারবার অনুরোধ করছেন। আপনি কী উনার সাথে একবার কথা বলবেন স্যার?”

আরিয়ান চৌধুরীর মেজাজ বেশ বিগড়াল তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

–” দাও ডাফার। ”

মৃদু ধমক খেয়ে গার্ডটা ভোঁতা মুখে ফোনটা ফারজানার দিকে বাড়িয়ে দিলো৷ ফারজানা নিমিষেই তা ছিনিয়ে নিয়ে ভদ্রতাসূচক সালাম দিয়ে বলে উঠল,

–” আমি নিখোঁজ হওয়া এমপ্লয়ির বড় বোন ফারজানা বলছিলাম স্যার। নিউজে শুনলাম, আপনি নাকি তাদের খোঁজ জানেন। আমাকে এড্রেসটা দেওয়া যাবে? ”

ফারাজানার চিন্তিত স্বর শুনে আরিয়ান চৌধুরীর বুকটা কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে কোনোমতে বললেন,

–” মিডিয়ার আজগুবি রিপোর্ট থেকে বাঁচতে আমি তাদের মিথ্যা বলেছি মা। আরশিয়ানদের সাথে কথা হলেও তাদের এক্সাক্ট লোকেশন আমরা এখনও বের করতে পারিনি। তুমি বরং টেনশন ফ্রী হয়ে বাসায় ফিরে যাও। ভরসা আছে না আমার উপর? ইন শা আল্লাহ, আমি ওদের দ্রুত সহিসালামত খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। ”

বিপদের সময় ভরসা পেলে অজানা কারণে বুকটা ভার হয়ে আসে৷ ফারাজানার ক্ষেত্রেও তাই হলো। তবুও নিজের কথায় অনড় থেকে কোনোমতে বলল,

–” আমাকে আপনার সাথে নেওয়া যাবে না স্যার? আসলে আমি ব্যতীত ওর কেউ নেই…

এই একটা বাক্যে আরিয়ান চৌধুরী থমকে গেলেন। কোনোমতে বললেন,

–” আচ্ছা এসো। ”

মৃদু আশার আলো খুঁজে পাওয়ায় ফারজানা কিছুটা ধাতস্থ হলো। সিনএনজি ছুটে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে আরিয়ান সাহেব বুকে হাত চেপে হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলেন।

কথায় আছে, উপরওয়ালা বিপদ দিলে তিনিই আবার রক্ষা করেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে হেঁটে নিজের কেবিনে যাওয়ার সময় ইশতিরাজ খেয়াল করল আরিয়ান চৌধুরী কে। খানিকটা অবাকও হলো বটে। এগিয়ে গিয়ে ভদ্রতার সহিত বলল,

–” আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কী অবস্থা? আপনারা এখানে? বাড়ির কেউ অসুস্থ নাকি? ”

আরিয়ান চৌধুরী ইশতিরাজ কে দেখে যেনো আশার আলো খুঁজে পেলেন। উনি রাখঢাক না রেখে সরাসরি সবটা খুলে বললেন ইশতিরাজ কে। সবটা শুনে ইশতিরাজ নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে ইমাম সাহেবের নম্বরটা নিয়ে বলল,

–” ইন শা আল্লাহ আমরা ওদের সহিসালামত উদ্ধার করব। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাকে একটু সময় দেন শুধু। আপাতত বাসায় কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই বাকিটা আমি দেখছি।”

_

কিছুক্ষণ সময় পেরোতেই আচমকা মেয়েলি কন্ঠে দেওয়া সালামের ধ্বনিতে চোখ তুলে তাকালেন আরিয়ান চৌধুরী। তার পাশে থাকা মেহমেত চৌধুরী ও চকিতে ফিরে তাকালেন। ফারজানা তাদের অবাক দৃষ্টি দেখে বলল,

–” আমি প্রিমার বোন.. ফোনে কথা হয়েছিল যে..

আরিয়ান চৌধুরী সামান্য মাথা নাড়িয়ে বললেন,

–” বুঝেছি। বসো এপাশে। বৃষ্টিতে ভিজে গেছো তো। তুমি না আসলেও পারতে। তোমার বাবা মা চিন্তা করবে না? ”

গলার ভেতর কান্নারা দলাপাকিয়ে শব্দ রোধ করে ফেলল। বুঁজে আসা কন্ঠে কোনোমতে ফারজানা বলল,

–” আমাদের বাবা মা নেই। আমরা এতিম। ”

আরিয়ান এবং মেহমেত চৌধুরী ব্যথিত নয়নে তাকান তার দিকে। ফারজানার সাথে টুকিটাকি আলাপ করার মাঝে আচমকা ইশতিরাজ এসে উপস্থিত হলো। আরিয়ান চৌধুরীর পাশে ফারজানা কে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। অস্ফুটস্বরে বলল,

–” আপনি এখানে? ”

ফারজানা ও হকচকিয়ে উঠে বলল,

–” আপনি?

আরিয়ান চৌধুরী ফারজানার পরিচয় জানাতেই ইশতিরাজ চমকিত নয়নে তাকাল। বাড়তি কথা না বলে স্পষ্ট স্বরে জানাল,

–” ওদের লোকেশন ট্র্যাক করতে পেরেছি আমরা। আমি স্পেশাল ফোর্সদের খবর দিয়েছি। উনারা ইতিমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। আমাদের ও এখন যাওয়া উচিত। ”

তারা কেউই আর দেরি করল না। মেহমেত চৌধুরী সাথে আসতে চাইলে ইশতিরাজ নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলল,

–” মেহরিমার জ্ঞান ফিরলে আপনাকে খুঁজবে। তাছাড়া বাসার কেউ জানে না ব্যপারটা। একসাথে দু’জন গায়েব হলে তাদের সন্দেহ বাড়বে। ”

মেহমেত চৌধুরী আর কথা বাড়ালেন না। ইশতিরাজ, ফারজানা এবং আরিয়ান চৌধুরী এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে৷ গাড়ির ব্যাকসিটের দরজা খুলে ইশতিরাজ বলে উঠল,

–” আংকেল, আপাতত আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেন। যেতে যেতে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরবর্তীতে সমস্যা হবে। ”

আরিয়ান চৌধুরী দ্বিরুক্তি করলেন না। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ভীষণ মাথা ব্যথা করছে উনার৷ আরিয়ান চৌধুরীকে ব্যাকসিটে উঠে বসতে দেখে ফারজানা বাধ্য হয়ে সামনে বসলো। সেই দৃশ্য দেখে ইশতিরাজের মুখে ফুটে উঠল কুটিল হাসি।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে ইশতিরাজ দেখল ফারজানা বিরক্ত চোখে সিটবেল্টের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারজানা কে সিটবেল্টের সাথে লড়াই করতে দেখে দুষ্টু হেসে ইশতিরাজ বলল,

–” এই যে মিস পোল্ট্রি মুরগির প্রিমিয়াম ভার্সন। ওটা আমাকে দিন…

আচমকা উদ্ভট এক সম্বোধনে ফারজানা চকিতে ফিরে তাকাল। মস্তিষ্কে রাগ চেপে বসলেও তা প্রকাশ করতে পারলো না। সিল্টবেল্টা সজোরে ইশতিরাজের হাতে দিয়ে একই ভঙ্গিতে বলল,

–” এই যে মিস্টার শিয়ালের গর্দভ ভার্সন। ধরুন আপনার মস্তিষ্কের ন্যায় অকেজো সিটবেল্ট। ”

ইশতিরাজের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চুপসে গেলো। বিড়বিড়য়ে বলল,

–” পিচ্চি সাইজের নাগা মরিচ হলে কী হবে? ঘড়ত্যাড়ামিতে মাস্টার্স পাস এই মহিলা। ”

ফারজানার কানে এসেছে সেই কথা। প্রত্যুত্তরে দাঁতে দাঁত চেপে সে পুনরায় ধীর স্বরে বলে উঠল,

–” দানব সাইজের ইক্ষু হলে কী হবে? কাজের বেলায় আকাইম্মা এই বেডা। ”

ফারজানার ত্যাড়া উত্তরে উদাস মুখে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো ইশতিরাজ। এই নারীর সামনে মুখ খোলা আর ভরা বাজারে শর্টস খুলে ফেলা একই ব্যপার। মানসম্মান একটুও অক্ষত থাকে না।

_

ফজরের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। ইমাম সাহেব, তার বড় ছেলে এবং ছোটো ছেলে মিলে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাড়ির মেয়েরাও সজাগ হয়ে উঠেছে সেই মধুর ধ্বনিতে। ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী বলেন,

–” ওদের ডাকবো নাকি? নামাজ পড়তো না? ”

ইমাম সাহেব গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,

–” দরকার নেই। রাতে যে ঝড় বয়ে গেলো তা সামলাতে সময় দাও ওদের। ”

বাড়ির বড় বউ মুখ বাঁকাল শ্বশুরের কথা শুনে। তার ভাষ্যমতে, নষ্টামি করতে দোষ নাই অথচ হালাল সম্পর্কে যত সমস্যা। এসব ঢঙ্গি মেয়ে তার ঢের চেনা আছে। ঐ মেয়ের গালে চড় মেরে বেশ গর্ব অনুভব করছে সে। চাঁদের ন্যায় সুন্দর জামাই পাওয়ার পরও মেয়েটার নেকামি দেখে গা পিত্তি জ্বলে গেছিলো তার।

সকলের ভাবনার মাঝে আচমকা দরজায় জোরালো করাঘাতের শব্দ শোনা গেলো। ইমাম সাহেব এবং উনার ছেলেরা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল বাহিরে বেশ কিছু প্রশাসনের লোকজন এবং ভিক্টিমের পরিবার এসেছে। কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে আরিয়ান চৌধুরী হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে এসে বললেন,

–” আমার ছেলে কোথায়? ”

ইমাম সাহেব সবার দিকে একপলক তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে জবাব দেন,

–” নতুন দম্পতি তাদের ঘরে আছে। ”

এই একটা কথা শুনে উপস্থিত সকলের মাথায় যেনো বাজ পড়ে। কেবল আরিয়ান চৌধুরী এবং ইশতিরাজ স্বাভাবিক। ফারজানা হতভম্ব স্বরে জিজ্ঞেস করে,

–” নতুন দম্পত্তি মানে? ”

ইমাম সাহেবের বড় ছেলের বউ অজানা মেয়ের এমন দুঃসাহস দেখে চড়া গলায় বলল,

–” গতকাল রাইতে হেরা ধরা পড়ার পর শাস্তিস্বরূপ ওগো বিয়া দেওয়া হইছে। এই লাইগাই ওগরে নতুন দম্পত্তি কইছি।”

ফারজানা অতি বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না তার। ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে অজান্তেই দু’কদম পিছিয়ে যায় সে। আচমকা এমনটা হওয়াতে সোজা গিয়ে ধাক্কা খায় পেছনে থাকা ইশতিরাজের বলিষ্ঠ বুকে। ইশতিরাজ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

–” যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা সত্য পাল্টাতে পারবো না। ওরা সেইফ আছে সেটাই অনেক। সামলান নিজেকে। আপনার বোন কে সামলানোর জন্য আপনাকে স্ট্রং থাকতে হবে। ”

আরিয়ান চৌধুরী সকলের বাড়তি কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললেন,

–” আমার ছেলে কোথায়? ”

ইমাম সাহেবের বড় ছেলে তাদের কাঙ্ক্ষিত ঘর দেখিয়ে দিলে আরিয়ান চৌধুরী দুরুদুরু বুকে দরজায় কড়া নাড়েন। এতক্ষণের চেঁচামেচিতে ওদের বেরিয়ে আসার কথা অথচ তারা দরজাটাও খুলেনি। আরিয়ান চৌধুরীর মনের ভয় দূর করে দিয়ে ওপর পাশ থেকে আরশিয়ান দরজা খুলে দিল। ছেলেকে দেখা মাত্র তৎক্ষনাৎ তাকে বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরলেন আরিয়ান চৌধুরী। আরশিয়ান নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল কেবল ।

ফারজানা তাদের পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই থমকে গেলো। তার পিছু নিলো বাড়ির মেয়েরা কেননা বসার ঘরটা বাহিরের মানুষে ভর্তি। বিদ্যুৎ বিহীন অন্ধকার ঘরটা কেবল হারিকেনের আলোয় আলোকিত। সেই অল্প আলোয় দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরিহিত এক রমণী মাথা ঘোমটা টেনে বিছানার এক পাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ফারজানার বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে। এগিয়ে গিয়ে আলতো স্বরে প্রিমা বলে ডাকতেই মেয়েটা চমকে তাকায়। ফারজানা তাকে বুকে জড়িয়ে নিতেই প্রিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ফারজানা কেবল স্থবির দৃষ্টিতে অবলোকন করে তার আদরের বোনটার ভঙ্গুর অবস্থা।

এদিকে আবেগঘন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও অন্যদিকে গ্রামবাসী এবং ইমাম সাহেব পড়েছেন আরিয়ান চৌধুরির প্রশ্নবাণ এবং প্রশাসনের তোপের মুখে। আরশিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে সবটা পরখ করছে। ইশতিরাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরশিয়ানের একটা নরমাল চেকআপে করে দেখে সে মোটামুটি ঠিকঠাক আছে। তেমন কোনো ইনজুরি নেই। ইশতিরাজ হালকা কেশে জিজ্ঞেস করে,

–” পিচ্চিটা ঠিক আছে?”

আরশিয়ান চোখ তুলে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে সল্প শব্দে জবাব দেয়,

–” শী নিডস ট্রিটমেন্ট। ”

ইশতিরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে শুধায়,

–” ভেতরে যাবো? ”

আরশিয়ান পুনরায় বলে,

–” হুঁ। ”

ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে নিলে ভেতর থেকে বাড়ির বড় বউ চিৎকার করে বলে উঠে,

–” বিবেকহীন মানুষ কোথাকার। মেয়েদের ঘরে ঢুকছেন কোন লজ্জায়। ছিঃ”

ইশতিরাজ হতভম্ব হয়ে গেলো। আরশিয়ান রাগ সামলাতে না পেরে বলল,

–” আমার ওয়াইফের ট্রিটমেন্ট দরকার। আমি অনুমতি দিয়েছি তাকে। আপনি নিষেধাজ্ঞা জারি করার কে? পর পুরুষের ছায়া মাড়াতে না চাইলে নিজের ঘরে যান। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে আপনার অবস্থান করা কতটুকু যৌক্তিক? ”

আরশিয়ান রেগে যাচ্ছে। ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ গুলোর রাগ অত্যন্ত ভয়ানক হয়। ইশতিরাজ ফাঁকা ঢোক গিলে কারো কথার তোয়াক্কা না করে ভেতরে এগিয়ে গেলো। ফোনের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ঘরটা আরও খানিকটা আলোকিত হলো। আরশিয়ান স্থির চোখে একবার তার নববধূর পানে তাকাতেই দেখল সে ফারজানার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে ব্যস্ত। মাথার ঘোমটাটা সামান্য সরে গেছে যার ফলস্বরূপ হালকা ফর্সা রক্তিম গালটা দেখা যাচ্ছে।

আরশিয়ান দৃষ্টি ফেরালো না বরং ইশতিরাজের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” গো এহেড। ”

ইশতিরাজ অনুমতি পেয়ে ধীর স্বরে আমতা আমতা করে বলল,

–” মিসেস লাড্ডু?…

পরিস্থিতির চাপে পড়ে এমন বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে সেটা কল্পনাতেও ভাবেনি ইশতিরাজ। সে তৎক্ষনাৎ আতঙ্কিত চোখে তাকায় ফারজানার দিকে। কান্নায় ব্যস্ত প্রিমা সেসব কিছুই শোনেনি কিন্তু ফারজানা বিকট স্বরে ধমকে উঠে তাকে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে প্রিমার চেকআপ শেষ করে চিন্তিত চোখে তাকায় আরশিয়ানের দিকে। আরশিয়ান ও এদিকেই তাকিয়ে ছিলো। ইশতিরাজ তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

–” তোর বউ ভীষণ বাজে ভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে গেছে ভাই। ব্লাড প্রেশার অনেক হাই উপরন্তু হার্ট তীব্র গতিতে বিট করছে। ইমিডিয়েট উনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন দিতে হবে তার আগে এই দমবন্ধকর জায়গাটা ত্যাগ করা জরুরি।”

“তোর বউ ” কথাটা কানে বাজলো আরশিয়ানের। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন সাথে নেই? ”

ইশতিরাজ একপলক প্রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

–” আছে কিন্তু ওটা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই উনি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাবেন। গাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে রাখা। অত দূর অব্দিই হেঁটে যেতে পারবে না তাই..

আরশিয়ান মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিয়ে শুধাল,

–” গাড়িতে এনাফ স্পেস আছে? ”

ইশতিরাজ প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে বলল,

–” টয়োটা রুমিওন নিয়ে এসেছি। হোপফুলি স্পেস এর কমতি হবে না। ”

আরশিয়ান সবটা শুনে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” যাবতীয় যা মেডিসিন দেওয়া দরকার এখনই দিয়ে দে। মাথায়, পায়ে এবং হাতে হালকা চোট পেয়েছে। ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিস। ”

ইশতিরাজ অবাক চোখে তাকাল আরশিয়ানের পানে। ওর অস্বাভাবিক রুপটা ইশতিরাজ কে ঘাবড়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কথা না বাড়িয়ে আদেশ মোতাবেক কাজ করল ইশতিরাজ। হাত পায়ের ব্যান্ডেজ শেষে প্রিমা কে মাথা তুলতে অনুরোধ করলে সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফারজানার বুক থেকে মুখ উঠাল। আরশিয়ান ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো, আচমকা কান্নাভেজা রক্তিম মুখটা দেখে বেচারা থমকে গিয়ে অন্যদিকে তাকাল।

প্রথমে খেয়াল না করলেও ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় প্রিমার মুখের দিকে তাকাতেই রীতিমতো আঁতকে উঠল ফারজানা। ওর গালে আঙ্গুলের ছাপ দেখে হতভম্ব গলায় শুধাল,

–” লাড্ডু? কে মেরেছে তোকে? ”

এতক্ষণ সবার নাটক দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিল বড় বউ কিন্তু এবার ফারজানার বলা কথাটা তার গায়ে বিঁধল। সে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,

–” আমি মারসি আপনার ননীর পুতুল রে। নষ্টামি করতে গিয়ে ধরা খাইলে কী আদর করতাম নাকি ? ”

মেয়েটার বলা প্রতিটা শব্দ ফারজানার মস্তিষ্ক গরম করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আরশিয়ান নিজেও চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাতে চেষ্টা করে। তীক্ষ্ণ অপমানসূচক কথা প্রিমার শরীরে কম্পন সৃষ্টি করে। ইশতিরাজ তার হাবভাব দেখে বলে,

–” রিল্যাক্স পিচ্চি। মূর্খদের কথা গায়ে মাখতে নেই। যাদের সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান থাকে তারা কখনো অপর জন কে কটু কথা বলতে পারে না। ”

ফারজানা যথেষ্ট চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে। প্রিমা কে কাঙ্ক্ষিত ইনজেকশন দেওয়া শেষ হতেই মেয়েটা কিছুটা নিস্তেজ হয়ে ফারজানার উপর শরীর ছেড়ে দেয়। ইশতিরাজ ইশারায় বলে তাকে শুইয়ে দিতে। ফারজানা তার কথামতো প্রিমা কে রেখে পাশের র‍্যাকে থাকা একটা ঝাড়ু নিয়ে এগিয়ে যায় সেই মহিলার দিকে।

তার সামনে দাঁড়িয়ে সজোরে একটা থাপ্পড় বসাতেই মহিলা হুমড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে। ইমাম সাহেবের বউ তা দেখে হাহাকার করে উঠলেও ফারজানা পাত্তা দেয় না। ভয়ানক খুন চেপে বসেছে তার মস্তিষ্কে। ঝাড়ু দিয়ে ইচ্ছে মতো কিছুক্ষণ পেটাতেই ঘরের বাহিরে থেকে ক’জন লোক ছুটে আসলো। মহিলার স্বামী এগিয়ে এসে ফারজানার উপর চড়াও হতে নিলে আরশিয়ান এগিয়ে এসে বলল,

–” মেয়েলি ব্যপারে পুরুষদের কথা বলতে নেই। আপনার স্ত্রী অন্যায় ভাবে আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে নিয়তি তার বদলা নিয়েছে দ্যাটস ইট। ”

আরশিয়ান এগিয়ে এসে অর্ধ অচেতন প্রিমার সামনে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে,

–” নিজেকে এতটা নিষ্পাপ ভাবা উচিত নয় যতোটা ভাবলে অন্যকে কুটিল মনে হয়। এতটা জ্ঞান অর্জন ভালো নয় যাতে অন্যকে মূর্খ মনে হয়। নিজেকে এতটা ইমানদার ভাবা উচিত নয় যতোটা ভাবলে দুনিয়ার সকলকে পাপী মনে হয়। _ সংগৃহীত

সামান্য থেমে আবারো বলল,

–” আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এজন্যই কেইসের ঝামেলায় জড়ালাম না। অবশ্যই দোয়ায় রাখবেন আমাদের। আমরা যেনো নিজের দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেনো আমাদের জীবনে কাঙ্ক্ষিত সুখ হিসেবে ধরা দেয়। ধন্যবাদ। ”

কথাগুলো বলে প্রিমা কে পাজকোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো আরশিয়ান। তার পিছু পিছু ছুটলো বাকিরা।

_

মেঘাবৃত অপরাহ্ণ। হসপিটালের বেডে উদাস মুখে বসে আছে মেহরিমা। গতকাল রাতে তার অবস্থা সাংঘাতিক থাকলেও উন্নত চিকিৎসার ফলে সকালের দিকে কিছুটা বেটার হয়। এজন্যই তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। এখনও যথেষ্ট দুর্বল মেয়েটা তবে টুকটাক কথা বলতে পারছে।তার পাশে বসে আছেন মাহিরা চৌধুরী। মেহরিমাকে একটু খিচুড়ি খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন সেই কখন থেকে অথচ মেয়ে তার নির্লিপ্ত মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেবিনের সোফায় বসে থাকা তারান্নুম চৌধুরী বললেন,

–” থাক না ছোটো। হয়তো মেয়েটার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আর জোর….

কথা শেষ হওয়ার পূর্বে ঝড়ের গতিতে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ একজন পাগলাটে পুরুষ। উপস্থিত সকলে রীতিমতো চমকে তাকায়। বউয়ের সুইসাইডের খবর পেয়ে লন্ডন থেকে ছুটে এসেছে এই ছেলে ব্যপারটা মস্তিষ্কে আসতেই মাহিরা চৌধুরী হতভম্ব হয়ে যান। উপরন্তু ফ্যাশন দুরুস্ত ছেলেটার এলোমেলো রুপ তাদের ভীষণ আশ্চর্য করে। তাজরিয়ান এগিয়ে এসে মেহরিমার গাল ছুঁয়ে হাঁপানো স্বরে প্রশ্ন করে,

–” এরকম পাগলামি কেউ করে বউজান? ”

মেহরিমা তীব্র আক্রোশে তার হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে ক্রন্দনরত সুরে বলল,

–” এই চরিত্রহীন পুরুষ কে চলে যেতে বলো আম্মু।”

মাহিরা এবং তারান্নুম চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তাকান দুজনের দিকে। তাজরিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

–” আমার বেয়াড়া জ্বীনটা আজ বউয়ের মাথায় ভর করেছে মাতাগণ। আপাতত জ্বীনের তান্ডব দমনের জন্য আমার একান্ত সময় প্রয়োজন। আপনারা তাহা প্রদান করিয়া আমারে এবং জ্বীন মহারাণী কে বাধিত করুন। ”

মেহরিমা চেঁচিয়ে বলল,

–” আম্মু.. তুমি এখান থেকে এক পা ও নড়বে না। যদি উনার কথা শোনো তবে তোমার মেয়ের অস্তিত্ব ও খুঁজে পাবে না বলে দিচ্ছি। ”

তাজরিয়ান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” তোর অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে লুকায়িত বেয়াড়া জ্বীন কে বায়োলজির শানে নজুল শোনালে তবেই সেটা বিদায় নিবে। এসব থিওরি কী আর মানুষ জনের সামনে বলা সম্ভব… তুই বল? ”

তাজরিয়ানের লাগামহীন কথায় মেহরিমা বিকট স্বরে চেঁচিয়ে বলল,

–” আপনার চিপকু মায়া বেবির অস্তিত্বের আনাচে-কানাচেতে ওসব থিওরি এপ্লাই করেন গিয়ে। আমাকে শোনাতে আসলে আপনার থিওরির মাস্টারমাইন্ডে নিউক্লিয়ার বোমা নিক্ষেপ করবো আমি। ”

তাজরিয়ান নাকমুখ কুঁচকে প্রশ্ন করে,

–” চোরের নজর অলওয়েজ মূল সম্পত্তির দিকে থাকে ইহা আবারও প্রমাণিত। আমাদের চোদ্দগুষ্টি কে যে সুখবর দিতে হবে সে খেয়াল আছে তোর? ”

মাহিরা এবং তারান্নুম চৌধুরী এদের বেফাঁস কথাবার্তা আর নিতে পারলেন না। দু’জনেই সুযোগ বুঝে কেটে পড়লেন। তা দেখে বাঁকা হাসলো তাজরিয়ান। আড়মোড়া ভেঙে মেহরিমার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

–” তোর মাথায় উঠে নৃত্য করা বেয়াড়া জ্বীনটার তাজরিয়ানের স্পেশাল থিওরি’র ক্লাস দরকার। তুই এত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে বাঁধ সাধছিস কেনো বউজান?”

তাজরিয়ানের এসব লাজহীন কথাবার্তা মেহরিমার উপর একটুও প্রভাব ফেললো না উল্টো বুকের তার ভেতরকার অস্থিরতা বাড়িয়ে দিলো। তাজরিয়ান তার দিকে ঝুঁকে আসতে নিলে দুর্বল হাতে থাপ্পড় বসালো তার গালে। তাজরিয়ান হতভম্ব হয়ে সরে যাওয়ার আগে তার কলারের আস্তিন ধরে মেহরিমা উচ্চ স্বরে বলল,

–” কেনো এসেছিস? কী দেখতে এসেছিস? তোর ইগনোরেন্স কতটুকু পুড়িয়েছে আমাকে সেটা পরীক্ষা করতে এসেছিস? তোর বুকে অন্য মেয়ের আধিপত্য দেখে আমি কতটা উন্মাদ হয়েছি সেটা দেখতে এসেছিস? কী চাই তোর? আমার মৃত্যু? আমার কাফনে মোড়ানো লাশ দেখলে…..

মেহরিমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তাকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলো তাজরিয়ান। মেহরিমা ছুটোছুটি করলে তাজরিয়ান কাঁপা সুরে বলল,

–” আমার বাড়ন্ত হার্টবিট সাক্ষী তোর পাঠানো সেই নির্মম মেসেজটা আমার হৃদয়ে কতটা ভয়ানক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আমার কম্পনরত কন্ঠ এই বাক্যের স্পষ্ট বিবৃতি দিচ্ছে যে, তোকে হারানোর ভয়ে এই নির্ভীক সাইকোপ্যাথ প্রচন্ড রকমের ভীত হয়ে পড়েছিল। আমার অশ্রুভেজা চোখজোড়া আর্তনাদ করে বলতে চাইছে, তোকে চাক্ষুষে অবলোকন করার তৃষ্ণায় ওরা কতটা ছটফটিয়েছে। ”

মেহরিমা খানিকটা শান্ত হয়ে এলো কিন্তু পুনরায় সেই নারী সংক্রান্ত বিষয়টা মাথায় আসতেই সে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

–” আপনি অন্য নারীর সান্নিধ্যে গিয়েছেন… ওকে ছুঁয়েছেন… ও আপনাকে স্পর্শ করেছে.. আপনি..

তাজরিয়ান কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল,

–” বিশ্বাস কর, উনাকে আমি মায়ের চোখে দেখি। উনার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর। রাশিয়ান হওয়ায় উনার বয়সটা ঠিক আইডেন্টিফাই করা যায় না। উনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে উনার ছোটো ছেলের কারণে। বেচারা ব্লাড ক্যান্সারের রোগী উপরন্তু তার বাবা নেই। এজন্যই ওর চিকিৎসার দায়ভার সম্পূর্ণ আমি এবং ভাইয়া নিয়েছি। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় ওকে রক্ত দিতে হয়। আমি লন্ডনে উপস্থিত থাকায় প্রায় ওর সাথে হসপিটালে যেতাম। আমাদের ব্লাড গ্রুপ সেম হওয়ায় বার কয়েক রক্ত দিয়েছি। সেই থেকে উনার সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর সেই পোস্ট আমার করা নয়.. তুই তো জানিসই আমার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট আমার পিএ হ্যান্ডেল করে। মজার ছলে এমন একটা ক্যাপশন দিয়েছে নাথিং এলস বউজান।”

চলবে?