#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ১৮
প্রবাহমান সময় তার নিজেস্ব গতিতে এগিয়ে যায়। ইতিমধ্যে প্রায় মাস তিনেক সময় পেরিয়েছে।এখন সময়টা গ্রীষ্মকাল। সকালের নবাগত সূর্যের তেজ দীপ্ত আলোকছটা মুখে এসে পড়তেই ঘুমন্ত প্রিমা সামান্য নড়েচড়ে উঠলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিল আরশিয়ান। বিরাট কাঁচের খন্ডে প্রিমার স্থির প্রতিকৃতি দেখে দৃঢ় স্বরে বলে উঠে,
–” মিসেস প্রিমা? জলদিই উঠুন। উই আর গেটিং লেট। ”
প্রিমা ঘুমের ঘরে হু হা করে আবারও গভীর ঘুমে মগ্ন হলো। আরশিয়ান স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার ভারিক্কি শ্বাস। ইদানীং প্রিমাটা বড্ড ঘুমকাতুরে হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য আরশিয়ানের অতিরিক্ত আহ্লাদ দেওয়ার কুফল এসব। আরশিয়ান পুনরায় শান্ত কন্ঠে বলল,
–” আপনি কী চাকরিটা হারাতে চাইছেন? আজ প্রেজেন্টেশনে গড়বড় হলে আপনার চাকরি এমনিতেও নট হয়ে যাবে। ”
এবার কাজ হলো। প্রিমা টেনেটুনে চোখজোড়া খুলে পিটপিটিয়ে তাকাল আয়নার সামনে দাঁড়ানো আরশিয়ানের দিকে। বিগত কয়েক মাসে রেগুলার জিমে যাওয়ার ফলস্বরূপ আরশিয়ানের বলিষ্ঠ হাতজোড়া আরেকটু পুরুষ্টু হয়েছে। বডি শেইপে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বয়সের সংখ্যা সাথে বাহ্যিক গঠনের সৌন্দর্য যেনো তরতরিয়ে বাড়ছে। প্রিমার বড্ড হিংসা হয় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না।
প্রিমাকে অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরশিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে। এলোমেলো হয়ে থাকা ওভার সাইজ টিশার্টটা ঠিকঠাক করে দিয়ে দু’হাতে সামান্য বল প্রয়োগ করে প্রিমাকে কোলে তুলে মেঝেতে দাঁড় করায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিমা ভারসাম্য হারিয়ে তার বাহুতে ধাক্কা খায়। আরশিয়ান আলতো হেসে তার পাখির ন্যায় হালকা দেহটা নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণ। আরশিয়ানের বাহুতে মুখ ডলে প্রিমা ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠে,
–” আমি সত্যি সত্যি এবার চাকরিটা ছেড়ে দিবো। আমার উপর কাজের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আপনি জিমে এবং অন্যত্রে সময় দিচ্ছেন। সারারাত খেটেখুটে একটুখানি ঘুমিয়েছি মাত্র। তন্মধ্যে আপনি আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বদৌলতে শক্তি খাটিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে জোরজবরদস্তি করছেন। ”
আরশিয়ান ঠোঁট টিপে হাসলো। আসলেই বেচারির উপর ইদানীং অতিরিক্ত কাজের প্রেশার পড়েছে । যার দরুন প্রিমার চড়ুইপাখির মতো শরীরটা পাখির পালকের ন্যায় হালকা ঠেকছে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়েছে। চেহারার লাবণ্যতা কমেছে। আরশিয়ান প্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
–” এই সপ্তাহটা যাক এরপর ঘুমানোর জন্য পুরো তিনদিন ছুটি দেওয়া হবে আপনাকে। চলবে? ”
প্রিমা প্রত্যুত্তর করল না কেবল তার বুকের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে রইল। আরশিয়ান আরও কিছুক্ষণ তাকে জড়িয়ে রেখে অতঃপর তাড়া দিয়ে বলে,
–” আজকে মিস ফারজানার অফিস জয়েন করার কথা। ভুলে গেছেন? ”
সেই ঘটনার পর ফারজানা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তাকে দুই মাসেরও অধিক সময় হসপিটালে কাটাতে হয়। বলা বাহুল্য এই দু মাসেরও বেশি সময়টা ইশতিরাজ এবং ফারজানার সম্পর্কে আমূল-পরিবর্তন এনেছে। পরিশেষে আজ সমস্ত ঝামেলার পাট চুকিয়ে ফারজানা পুনরায় ডিউটিতে জয়েন করছে।
প্রিমা চকিতে চোখ মেলে তাকাল। কাজের চাপে ভুলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত তথ্যটা কানে আসতেই দ্রুত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এক দৌড়ে ছুটে যায় ওয়াশরুমে। আরশিয়ান বাহির থেকে চিল্লিয়ে বলে,
–” অল্প সময়ে চুল শুকাবে না সুতরাং জাস্ট ফ্রেস হয়ে আসেন। গোসল দেওয়ার দরকার নেই একদমই। ”
_
পড়ার টেবিলে বসে বসে ঝিমাচ্ছে মেহরিমা। ভার্সিটি থেকে এক্সামের ডেট দেওয়া হয়েছে। নাওয়াখাওয়া ভুলে বেচারি ডুবে আছে পড়ায়। তাজরিয়ানের অফিস টাইম টুকু তার পড়ার টাইম কেননা বান্দা বাসায় থাকলে টেবিলের আশেপাশে ও ঘেঁষতে মন চায় না ওর।
কাল থেকে বাসায় ফেরেনি তাজরিয়ান। ইদানীং বড্ড বেশি কাজে ব্যস্ত থাকে সে। বাংলাদেশে অফিসের নতুন শাখা ওপেন করার কাজ চলছে বিধায় এত ব্যস্ততা মহাশয়ের। আকাশকুসুম ভাবনার মাঝে আচমকা গম্ভীর একটা স্বর কানে আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বেচারি। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখে তাজরিয়ান আলমারি থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বের করতে করতে তাকে বলছে,
–” কী ব্যপার? রাতভর প্রেমিক ঘুৃৃমাতে দেয়নি বুঝি?”
বিকৃত কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে যায় মেহরিমা। অবাক কন্ঠে শুধায়,
–” কী বললেন? ”
তাজরিয়ান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
–” ভুল বললাম কিছু ? ”
মেহরিমা হকচকিয়ে উঠে বলে,
–” কী আশ্চর্য! এসব কেমন ধরনের কথা? আমার প্রেমিক থাকতে যাবে কেনো? আমি তো বিবাহিত। ”
তাজরিয়ান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় মেহরিমার দিকে। ধীর কদমে এগিয়ে এসে ওর মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
–” এক্সকে নম্বর দেওয়ার সময় ছিলো না তুই বিবাহিত? আমি উচিত কথা বলেছি বলে পাপ হয়ে গেছে? ”
মেহরিমা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। গতকাল ভার্সিটি শেষ মাইন্ড রিফ্রেশ করতে একটুখানি দূরে একটা নিউ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল তাদের সিগনেচার রেসিপি গুলো ট্রাই করতে। খেয়েদেয়ে বিল দেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ জানায় তাদের ক্যাশে পেমেন্ট করতে হবে। কার্ড কিংবা বিকাশে পেমেন্ট গ্রহণযোগ্য নয়। মেহরিমার কাছে লিকুইড মানি না থাকায় বেচারি পড়েছিল বিপাকে ঠিক তখনই দেবদূতের মতো সেখানে হাজির হয় আরভিদ।
মেহরিমা ওকে দেখে ছিটকে সরে আসতে নিলে আরভিদ সৌজন্য মূলক কথাবার্তা বলে অতীতের প্রসঙ্গ টেনে মাফ চায়। ঝামেলা হওয়ার ভয়ে মেহরিমা কথা বাড়ায়নি। সল্প উত্তরে ব্যপারটা সমাধান করে কিন্তু আরভিদ আরেক ধাপ এগিয়ে তার বিল পে করে দেয়। মেহরিমার ইগো তে লাগে বিষয়টা। সে-ও জোরপূর্বক বিকাশে আরভিদের টাকাটা পে ব্যাক করে দেয়। এতে ভুলবশত তার নম্বরটা আরভিদের কাছে চলে যায়। গতকাল রাতে সে নম্বর থেকে প্রায় তিন চারবার কল আসে। প্রথমে মেহরিমা ধরতে না চাইলোও শেষে ফোন ধরে ওয়ার্নিং দিয়ে কলটা কেটে দেয়। সাইকোপ্যাথ তাজরিয়ান কে সেটা বুঝাবে কীভাবে ?
মেহরিমা আমতা আমতা করে বলে উঠে,
–” ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো তাজ। হুট করে..
তাজরিয়ান মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠল,
–” অতীতের একটা এক্সিডেন্টের জন্য আমি আমার সব থেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়েছি। সেটার কারণ ছিলি কেবল তুই আর দায়ী ছিলো তোর কর্ম। এরপরেও শুধরাইতে মন চাইনা তোর? ”
মেহরিমা থমকে গেলো। বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। কার সাথে সংসার করছে? যে মানুষটা তাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনা, সম্মান করেনা উল্টো তার জন্য ক্ষোভ পুষে রেখেছে তার সাথে সংসার সাজানোর সপ্ন দেখছে? মেহরিমা কে নিরুত্তর দেখে টেবিলে একটা ঘুষি বসিয়ে হনহনিয়ে বাহিরে চলে গেলো তাজরিয়ান। মেহরিমা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে ধীর পয়ে বিছানার কাছে আসলো।কম্পনরত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই অভিমানী অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। নিজেকে সামলাতে না পেরে বালিশে মুখ চেপে কেঁদে ফেললো শব্দ করে। মানসপটে ভেসে উঠলো অতীতের ঝলক।
চৌধুরী বাড়ির সবথেকে চঞ্চল, ডানপিটে এবং প্রাণোচ্ছল সদস্য এবং একই সাথে তৌকির চৌধুরীর মরহুমা স্ত্রী তাসফিয়া চৌধুরীর চোখের মনি ছিলো তাজরিয়ান। ছোটোবেলা থেকেই মাত্রাতিরিক্ত রাগী এবং জেদি ছিলো সে। তাসফিয়া চৌধুরীর জন্য তাকে শাসন ও করা যেতোনা সেভাবে। এই শাসনের অভাবটা তাকে আরও বেশি বিগড়ে দেয়। দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠে তাজরিয়ান।
মাহিরা চৌধুরী এবং মেহমেত চৌধুরী নিঃসন্তান দম্পত্তি হওয়ায় তাজরিয়ান কে নিজের সন্তানের চাইতেও বেশি আদর করতেন উনারা। তাজরিয়ান ছিলো ছোটো মায়ের নেওটা। দীর্ঘ কয়েক বছর পর তাদের জীবনে সুখের আগমন ঘটে। মাহিরা চৌধুরী সন্তানসম্ভবা হোন। প্রেগ্ন্যাসিতে বেশকিছু জটিলতা থাকায় তাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হতো। এতে করে তাজরিয়ানের সাথে তার সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়ন সৃষ্টি হয়। বেচারা তাজরিয়ান ছোট মায়ের সাথে ক্রিকেট খেলার জন্য ঘুরঘুর করলেও তিনি বাবুর ক্ষতির কথা বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে চলতেন।
এই ব্যপারটাই তাজরিয়ান কে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। সব দোষ গিয়ে পড়ে মেহরিমার উপর। তাজরিয়ান মনে মনে ক্ষোভ পুষে রাখে মেহরিমার জন্য। তার মন খারাপ দেখে একদিন তাসফিয়া চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন,
–” কী অইছে আমার নাতিডার? ”
তাজরিয়ান কন্ঠে ক্ষোভ ঢেলে বলে,
–” ছোটমা আমাকে একটুও সময় দেয়না। সব দোষ ওই পিচ্চির। যখন থেকে ছোট মায়ের পেটে এসেছে তখন থেকে আমার ভালোবাসা, আদর, সময় সবকিছুতেই ভাগ বসাচ্ছে। ”
তাসফিয়া চৌধুরী একগাল হেসে কৌতুকের স্বরে বলেন,
–” ভাগ বসাইতাছে কারণ হেই মাইয়া বড় হইয়া তোমার বউ অইবো তাজ মিয়া।”
তাজরিয়ান কৌতূহলী কন্ঠে শুধায়,
–” বউ মানে কী? ”
তাসফিয়া চৌধুরী আবারও মিটমিটিয়ে হেসে বলেন,
–” বউ মানে অইলো অর্ধাঙ্গিনী। তোমার সবকিছুর ভিত্রে তার অর্ধেক অর্ধেক ভাগ রইছে। ”
তাজরিয়ানের ছোট্ট মনে বিষয়টা গেঁথে যায় তবুও হিংসা ভাবটা দূর হয় না। সে মনে মনে ঠিক করে তার বউ যখন পৃথিবীতে আসবে তখন অর্ধেকের কথা বলে ওর সব টয় সেট নিজের করে নিবে। ওকে দিয়ে নিজের কাজ করাবে, পঁচা ডোবা থেকে বল তুলাবে। সবটা ভেবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ খুশি হয় তাজরিয়ান।
দেখতে দেখতে কাঙ্ক্ষিত সময় চলে আসে। চৌধুরী বাড়িতে নামে খুশির ঢল। মাহিরা চৌধুরী এবং মেহমেত চৌধুরীর কোলজুড়ে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। প্রি ম্যাচিউরড বেবি হওয়ায় বেচারি ভীষণ দুর্বল ছিলো। ছোট্ট গোলগাল আকৃতির ধপধপে সাদা পুতুল রুপী মেহরিমাকে দেখার পর তাজরিয়ান হতভম্ব হয়ে চেয়েছিল কিছুক্ষণ। অতটুকু বাচ্চাকে দিয়ে কাজ করাতে না পারার আফসোসে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। বসায় ফিরে সেই কী মেজাজ তার। তাসফিয়া চৌধুরীর কোলে শুয়ে অভিযোগ করে বলেছিল,
–” ওই পুতুল তো কোনো কাজেরই না। ওর সব কাজ তো আমারই করা লাগবে তাহলে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ হইলো কেমনে? হিসেবে তো আমাকেই বেশি কাজ করতে হবে। ”
তাসফিয়া চৌধুরী স্মিত হেসে বলেছিলাম,
–” তুমি এহন একতরফা কাম করতেছো কিন্তু তুমি যখন বড় হইবা তহন তোমার সব কাম তোমার বউ কইরা দিবো। আমি যেমন তোমার দাদাজান রে সবকিছু কইরা দেয় ঠিক ওমনেই। বুঝলা তাজ মিয়া? ”
তাজরিয়ান বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ায়। দেখতে দেখতে সময় পার হয়। নবজাতক মেহরিমা সময় পেরোনোর সাথে সাথে কিশোরীতে রুপান্তর হয়। তাজরিয়ানের সাথে তার বয়সের পার্থক্য ছিলো প্রায় নয় বছরের বিধায় তাদের মধ্যে কখনোই কাজিন টাইপের খুনসুটি মূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। ধমক খাওয়ার ভয়ে রাগী তাজরিয়ানের ছায়াও মাড়াতো না মেহরিমা। তবুও শেষ রক্ষে হতো না। বাহিরে কোনো কান্ড করে আসলে সেটা ঠিক পৌঁছে যেতো তাজরিয়ানের কানে। সে-ও বাসায় ফিরে মেহমেত চৌধুরীর কাছে পাই টু পাই নালিশ জানাতো। মেহরিমার কাছে পুরোদস্তুর একটা আতংকের নাম ছিলো তাজরিয়ান।
বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ রয়েছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস এবং অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। স্কুলের বেশকিছু পাকনা বান্ধবীর খপ্পরে পড়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া আরভিদ কে পছন্দ করতে শুরু করে মেহরিমা।প্রস্তাবটা অবশ্য আরভিদের কাছ থেকেই এসেছিল। কলেজের সব থেকে সুদর্শন ছেলেটা তার জন্য মরিয়া ব্যপারটা মেহরিমার কিশোরী মনে ঝড় তুলে। উপরন্তু বান্ধবীরা তো ছিলোই বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য। নিরবে নিভৃতে বান্ধবীদের মারফতে খুব গোপনে চলতে থাকে আরভিদ এবং মেহরিমার টুকটাক কথোপকথন। আরভিদ হাজার চেষ্টা করেও মেহরিমাকে সম্পর্কে আনতে পারেনি। পূরণ করতে পারেনি নিজের প্রতিশোধ।
চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি এবং ওয়াসীত্ব লিমিটেড পরস্পরের রাইভাল কোম্পানি। দুটোই দেশের নামকরা কোম্পানি তবে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে আরশিয়ান সংযুক্ত হওয়ার পর তাদের অবস্থান আরও কিছুটা শক্তপোক্ত হয়ে উঠে। ওয়াসীত্ব লিমিটেড কোনোভাবেই প্রথম পজিশন দখল করতে পারছিলনা উপরন্তু কূটকৌশল অবলম্বন করে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির নাম খারাপ করতে চাইলে আরশিয়ান নিজ দায়িত্বে তাদের সব কয়টা ড্রাগসের ফ্যাক্টরি লোকসমক্ষে নিয়ে আসে। ভীষণ রকমের ফেস লস হয় ওয়াসীত্ব ফ্যামিলির। এই কাহিনীর বদলা নিতে আরভিদ টার্গেট করে মেহরিমাকে।
বিদায় অনুষ্ঠানের দিন একপ্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আরভিদ মেহরিমাকে নিয়ে যায় শহর থেকে একটু দূরে। সাথে অবশ্য তাদের বন্ধুবান্ধব ও ছিলো। আরভিদ বলেছিল, ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার পর তার বাবা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিবে হায়ার স্টাডির জন্য। তখন চাইলেও আরভিদ মেহরিমার সাথে সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ করতে পারবেনা। যেহেতু মেহরিমার ফ্যামিলি স্ট্রিক্ট তাই অন্যদিন দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আজ যেহেতু সুযোগ মিলেছে সেহেতু মেহরিমা যেনো দ্বিমত পোষণ না করে৷
অগত্যা রাজি হয় মেহরিমা। সায় জানিয়ে এগিয়ে যায় নিজের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মেহরিমাকে অন্য ছেলের হাত ধরে গাড়িতে উঠতে দেখে তাজরিয়ানের একজন বন্ধু তাকে কল দিয়ে বিষয়টা জানায়। সবটা শুনে তাজরিয়ান দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
মেহরিমারা এসেছিল একটা নদীর ধারে। আশেপাশে ঘন জঙ্গল ছাড়া কিছুই ছিলোনা সেখানে। প্রকৃতি প্রেমী মেহরিমা বেশ উচ্ছ্বাসিত হয় দৃশ্যটা দেখে। তার খুশির রেশ আরও বাড়িয়ে দিতে আরভিদ হাঁটু গেড়ে বসে তাকে প্রপোজ করে। এসব দেখে বাকি বন্ধু-বান্ধবীরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে। মেহরিমা লজ্জারুণ হয়ে সম্মতি জানায় আরভিদের প্রস্তাবে। তা দেখে বাঁকা হাসে আরভিদ।
আরভিদের ইশারায় তাদের স্পেস দেওয়ার নাম করে বাকিরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। মেহরিমা সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করলে আরভিদ উত্তর দেয়,
–” নিউ কাপলদের একান্তে সময় কাটানো জরুরি। এতে সম্পর্ক মজবুত হয়। মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করা যাক। স্মৃতি হিসেবে স্মরণীয় করে রাখা যাবে।”
মেহরিমা ইতস্তত করলেও আরভিদের কথার জালে ফেঁসে যায়। ছবি তোলার বাহানায় সে অযাচিত ভাবে স্পর্শ করে মেহরিমাকে। বেচারি মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তাকে বারণ করলে আরভিদ বলে উঠে,
–” কাম অন মেহরিমা। রিলেশনে এসব খুবই স্বাভাবিক। খ্যাতের মতো আচরণ করোনা তো।”
মেহরিমার মনটা ছোটো হয়। নিজের অপারগতা বোঝাতে না পারার ব্যর্থতায় অশ্রু জমে চোখে। এদিকে আরভিদ অপেক্ষা করতে থাকে কাঙ্ক্ষিত লোকের কিন্তু তার বদলে দলবল সহ রণমুর্তি রুপে তাজরিয়ান কে এগিয়ে আসতে দেখে ভড়কে যায় বেচারা। মেহরিমা ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে যায়।
তাজরিয়ান এগিয়ে এসে বিনাবাক্যে কষিয়ে এক থাপ্পড় বসায় মেহরিমার গালে। ভয়ের চোটে কাঁদতে ও ভুলে যায় সে। আরভিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে মারতে মারতে বলে,
–” ইয়্যু ব্লাডি বাস্টার্ড… কার সম্পত্তির দিকে হাত বাড়িয়েছিস? ”
আরভিদ উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায় না। মারের চোটে রীতিমতো নাকমুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। মেহরিমা এই দৃশ্য দেখে তাজরিয়াকে আটকাতে গেলে নিজেও দু’চারটা চড় থাপ্পড় খায়। শেষমেশ আরভিদকে আড়াল করতে গেলে তাজরিয়ান থাবা দিয়ে মেহরিমার জামা ধরে তাকে ছুঁড়ে মারে অদূরে।
একপর্যায়ে আরভিদের মরা মরা অবস্থা হলে তাজরিয়ানের বন্ধুরা এগিয়ে এসে বলে,
–” ছেড়ে দে ভাই। বাকি খাতিরযত্ন আমরা করে নেবো। তুই ভাবিকে নিয়ে বাসায় যা। যথেষ্ট মেরেছিস আর শাসন করিস না। অল্প বয়স বিধায় ভুল করে বসেছে । মাথা ঠান্ডা করে বাসায় নিয়ে গিয়ে ভালোমতো বুঝিয়ে বলিস। ”
বন্ধুর কথায় তাজরিয়ানের মেজাজের পারদ বাড়তে থাকে। মেহরিমা আরভিদের মাথার কাছে বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। তাজরিয়ান এক ঝটকায় ওর হাত টেনে ধরে একপ্রকার ছুঁড়ে মারে গাড়ির ভেতর। গাড়িতে বসে শব্দ করে কাঁদার জন্য বার কয়েক জোরালো ধমক এবং তীক্ষ্ণ কথার বাণী শুনতে হয় মেহরিমাকে। এতে করে বিষিয়ে উঠে তার অন্তর, মস্তিষ্কে চাপে ভয়ানক রাগ।
বাসায় পৌঁছে মেহরিমাকে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে তাজরিয়ান হুংকার ছেড়ে বলে,
–” বেলেল্লাপনা করতে কম্বাইন্ড স্কুলে এডমিট করিয়েছিলে না? অভিনন্দন তোমাদের। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে রাস্তায় তার প্রেমিকের সাথে প্রেমময় ভালোবাসা বিনিময় করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। ”
তাজরিয়ানের চিৎকারে সকলে সমবেত হয় ডাইনিং রুমে। মেহরিমার অবস্থা দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে যান। আফিয়া চৌধুরী একটা চাদর এনে জড়িয়ে দেন মেহরিমার শরীরে। মাহিরা চৌধুরী বুকে আগলে নেন ক্ষত-বিক্ষত মেহরিমাকে। মেয়েটা শব্দ করে কাঁদছিল। বিভ্রান্ত মেহমেত চৌধুরী তাজরিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করেন,
–” আমার মেয়ে কী করেছে বাবা? ”
তাজরিয়ান রাগে হুঁশ হারিয়ে বলে,
–” নষ্টামি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে তোমার মেয়ে। ”
কথাটা কানে বাজে মেহরিমার। এবার নিজেকে বাঁচাতে রাগে খেই হারিয়ে সে বলে উঠে,
–” আমি কেবল আমার বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। মানছি আমার ভুল হয়েছে কিন্তু তাজ ভাই কোনো কথা না শুনে আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমাকে হ্যারাস করেছে। আম.. আমার সাথে জোরজবরদস্তি করেছে। আরও বলেছে আমি নাকি কেবল তার সম্পত্তি। ”
মেহরিমার বলা কথাগুলো বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানে সবার কানে। তাজরিয়ান নিজেও হতভম্ব হয়ে যায়। কী বলছে এই মেয়ে? সে তড়িৎ গতিতে মেহরিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
–” রাগের মাথায় কী যা তা বলছিস তুই? আমি তোর ইজ্জতভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেছি? ”
মেহরিমা তখনও ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। মাথায় কাজ করছে কেবল নিজের ইমেজ বাঁচানোর চিন্তা। সম্পর্কের কথা বাসায় ফাঁস হয়ে গেলে তার বাবা মা’কে নত হতে হবে। সবাই ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। নিজের দোষ ঢাকতে বদমেজাজী তাজরিয়ানের কাঁধে দোষ ঠেলে দিতে তৎপর হয়ে উঠে সে। তাজরিয়ানের কথা শুনে মাহিরা চৌধুরীর বুকের সাথে মিশে গিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলে,
–” মাম্ম…ম। ”
মেয়ের অবস্থা দেখে বুক ভেঙে আসে মাহিরা চৌধুরীর। তাজরিয়ানের স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত তিনি। মাথা খারাপ ছেলেটার হিংস্রতা সম্পর্কে ঢের জানা আছে উনার। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সজোরে তাজরিয়ানের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলেন,
–” লজ্জা করেনা তোমার? এতটা নিচে কীভাবে নেমে গেলে?
একের পর এক ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খায় সকলে। ছেলের গায়ে হাত তুলতে দেখে তারান্নুম চৌধুরী এগিয়ে এসে ক্রন্দনরত স্বরে বলেন,
–” আমার ছেলেটার রাগ বেশি। হুটহাট মেজাজ হারিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে কিন্তু সে চরিত্রহীন নয়। এতবড় অপবাদ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবো না। ”
মাহিরা চৌধুরী দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বললেন,
–” আপনার ছেলে একটা সাইকো আপা। সত্য হজম করতে আপনার কষ্ট হলেও আমি বাধ্য হচ্ছি এটা বলতে। আমার মেয়ের অবস্থা দেখেছেন? কে দিয়েছে ওকে শাসন করার অধিকার? শাসনের আড়ালে নোংরামি করার সাহস কীভাবে হয় ওর? ”
তাজরিয়ান অবিশ্বাস্য নজরে দেখছিল মেহরিমাকে। এতক্ষণ ভীষণ শান্ত চোখে ধৈর্য নিয়ে সবকিছু অবলোকন করছিলেন তাজরিয়ানের বাবা তাজওয়ার চৌধুরী। পেশায় তিনি একজন ডক্টর। ভীষণ শান্ত মেজাজের মানুষ উনি। ছোটোবেলা থেকে তাজরিয়ানের নামে হাজারটা অভিযোগ আসলেও ছেলেকে আজীবন ঠান্ডা মাথায় সবটা বুঝাতেন। কালেভদ্রে হয়তো দু’চারটা ধমক দিয়েছেন তবে ইহজীবনে ছেলের গায়ে কখনো হাত তোলেননি তিনি। সেদিন প্রথম মেয়েলি বিষয়ে অভিযোগ শুনে হাতে একটা রড নিয়ে এগিয়ে এসে ভীষণ শান্ত কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন,
–” মেহরিমার গায়ে হাত তুলেছো তুমি? ওর জামাকাপড়ের এলোমেলো অবস্থার পেছনে তুমি দায়ী? ও যা বলছে তা কী ঠিক? ”
তাজরিয়ান বিহ্বল কন্ঠে বলে,
–” হ্যাঁ কিন্তু…
আর একটাও কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করেননি তাজওয়ার চৌধুরী। রাগে হুঁশ খুইয়ে বেধড়ক ভাবে মারতে থাকে তাজরিয়ানকে। ছেলের বেহাল দশা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তারান্নুম চৌধুরী। তাজরিয়ান তখনও নিজের হয়ে সাফাই দিচ্ছিল। আফিয়া চৌধুরী এবং তারান্নুম চৌধুরী এসে থামাতে চাইলে তাজওয়ার চৌধুরী বলে উঠেন,
–” আজীবন ওর নামে আসা অভিযোগ নজর আন্দাজ করেছি। কখনো গায়ে হাত তুলে শাসন করিনি। এজন্যই এত বেয়াড়া হওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। শেষপর্যন্ত ধর্ষক তকমা অর্জন করেছে।ওর মতো চরিত্রহীনের মরে যাওয়ায় উচিত। ”
প্রথমদিকে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলেও অনাকাঙ্ক্ষিত কথাগুলো শুনে থমকে যায় তার হাত। গায়ে অসংখ্য জখম হলেও টু শব্দ বের হয়না তার মুখ দিয়ে। বুকে অভিমান চেপে মনে মনে বলে,
–” কবুল হোক তোমার আর্জি। মনজুর করা হোক আমার শাস্তি। অপবাদের কলঙ্ক আমার পরিশুদ্ধ মনটাকে কলুষিত করার আগে মৃত্যু হোক আমার।”
অসুস্থতার ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধ তাসফিয়া চৌধুরী নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। মেডিসিনের জন্য দিনভর চোখদুটোতে ঘুম এঁটে বসে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে বাহিরে চেচামেচির শব্দ শুনে পরিশেষে অসুস্থ শরীরটা নিয়ে বাহিরে আসেন। ডাইনিং রুমে আসতেই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় উনার। নিজের প্রিয় নাতিকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে আর্তনাদ করে উঠেন তিনি। এগিয়ে এসে থামাতে চাইলে তাজওয়ার চৌধুরী হুংকার দিয়ে উঠেন। উনাকে দায়ী করে বলেন,
–” সবকিছু তোমার জন্য হয়েছে আম্মা। এই বেয়াদবটাকে শুরু থেকে শাসন করলে আজ এই দিন দেখা লাগতোনা। মানুষের অবয়বে পশু জন্ম দিয়েছি আমি। ভাবতেই ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ”
বৃদ্ধা ক্রন্দনরত স্বরে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
–” কী করেছে আমার তাজ মিয়া? ”
তাজওয়ার চৌধুরী দ্বিগুণ রাগে ফেটে পড়ে চিল্লিয়ে বলে উঠেন,
–” তোমার চরিত্রহীন নাতি মেয়েদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলেতে শিখেছে। ওর নোংরামির শিকার হতে হয়েছে আমাদের মেহু কে। রাস্তার ছেলেদের মতো বীর ধর্ষকে উপনীত হয়েছে সে। ”
কথাগুলো শুনে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকেন তাসফিয়া চৌধুরী। ব্যপারটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না উনার। তাজওয়ার চৌধুরী কে থামিয়ে জ্ঞান শূন্য রক্তাক্ত তাজরিয়াকে হসপিটালে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে মেহরিমার কাছে এগিয়ে যান তিনি। অশ্রু সজল চোখে কাঁপা কন্ঠে শুধান,
–” তাজ মিয়া তোর লগে খারাপ কিছু করবার চেষ্টা করসে বু’জান? ”
মেহরিমাকে আদর করে বু’জান বলে ডাকতেন তাসফিয়া চৌধুরী। দাদীর কথার প্রত্যুত্তর করতে পারেনা মেহরিমা। ঘটনাগুলো ক্রমশ এতবেশী জটিল হয়ে উঠছে। তার দুর্বল হৃদয় এত প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করতে পারলোনা। ভয়ে, আতঙ্কে নেতিয়ে পড়ল মায়ের বুকে।
বিভীষিকাময় দিনটা খুব সময় নিয়ে কাটে। তাজরিয়ান হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিলো। মেহরিমা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়। সামান্য একটা মিথ্যা এরকম বিধ্বংসী ঝড় ডেকে আনবে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। রাগ সামলাতে না পেরে ওসব বলেছিল মেহরিমা। তার অসৎ উদ্দেশ্য ছিলোনা তবুও কথাগুলো এতটা প্রভাব বিস্তার করবে বেচারি বুঝেনি।
বাড়ির পরিস্থিতি থমথমে। মোটামুটি সপ্তাহখানেক সময় পেরিয়ে অবশেষে তাজরিয়ানের আগমনের সময় হয়েছে। তৌকির চৌধুরী সবটা শুনে সিধান্ত নিয়েছেন তাজরিয়ান এবং মেহরিমার বিয়ে দেওয়া হবে। এই সিধান্তে মাহিরা চৌধুরী অমত পোষণ করে বলেন,
–” একটা চরিত্রহীন লম্পটের কাছে আমি আমার মেয়েকে তুলে দেবোনা। আপনারা যদি জোরাজোরি করেন তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এক কাপড়ে এই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করবো। ”
মেহমেত চৌধুরী ও স্ত্রীর কথায় সম্মতি দেন। তৌকির চৌধুরী অবাক চোখে দেখেন পরিবারের ভাঙন।শেষ বয়সে এসে এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হবে সেটা কল্পনাতেও ভাবেননি তিনি। পুরো বিষয়টা সব থেকে বেশি আঘাত করে তাসফিয়া চৌধুরী কে। সেদিন সারাটা রাত স্বামীর বুকে মাথা রেখে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি। তৌকির চৌধুরী ও বড্ড নাখোশ হয়েছিলেন সকলের আচরণে। তিনি স্পষ্ট অবলোকন করছিলেন ছেলেদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের অধঃপতন। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। তাসফিয়া চৌধুরী বুকে অভিমান চেপে বলেছিলেন,
–” আমার তাজ মিয়া এমুন করতে পারে না জমিদার সাহেব। আমি হের চোক্ষে বু’জানের লাইগা মোহাব্বত দেখসি। আপনি দেইখেন একদিন হেরা নিজেদের ভুল বুজবো। ”
প্রিয়তমা স্ত্রীর কথায় নিরবে সম্মতি প্রদান করেছিলেন তিনি। তবে বুঝতে পারেননি সেটাই ছিলো তাসফিয়া চৌধুরীর শেষ মন্তব্য। পরেরদিন সকালে তরতাজা মানুষটাকে মৃত হিসেবে আবিষ্কার করে সবাই। শোকাচ্ছন্ন বাড়িটাতে কান্নার গুমোট শব্দে ভরে উঠে। দাদীকে শেষ বিদায় জানাতে হসপিটাল থেকে ছুটে আসে তাজরিয়ান। অধিক শোকে পাথরে রুপান্তর হয়েছিল চটপটে ছেলেটা।
কেউ লক্ষ্য করেনি তার গভীর শোক। সকলে ব্যস্ত ছিলো তিক্ত কথার বাণী শোনাতে। ঝটপট কথার প্রত্যুত্তর দেওয়া ছেলেটা সেদিন হাজারো বদদোয়া বিনাবাক্যে হজম করে নিয়েছিল। তবুও কারও বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি। তাসফিয়া চৌধুরীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি তাজরিয়ান কে। নিশ্চুপে সেটাও মেনে নিয়েছিল সে। চটজলদি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কোনোভাবেই হজম করতে পারছিল না বেচারা। যখন উপলব্ধি হয় তখন বহু দেরি হয়ে গেছে।
সময় তার নিজেস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। তাজরিয়ান নিজেকে পুরোপুরি ঘরবন্দী করে ফেলে। বাড়ির সকলেই সেটা নির্লিপ্ত ভাবে মেনে নিয়েছিল। সারাদিনে দুএকবার খাবার খেতে নিচে আসতে দেখা যেতো তাজরিয়ান কে। তার উষ্কখুষ্ক চুল, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি, চোখের নিচে জমা কালির দাগ সবটা মেহরিমাকে বড্ড পোড়াতো। আফসোস হতো নিজের করা ভুলের জন্য কিন্তু ভয় কাটিয়ে কারও সামনে স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনি বেচারি।
তাজরিয়ান একদমই ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। সারাদিন ঘরে পড়ে থাকলেও অসময়ে নিচে নেমে দুমুঠো খেয়ে উপরে চলে যেতো নৈঃশব্দ্যে। সারাদিন ঘরবন্দী থাকার পর সেদিন রাতে খাওয়ার সময়ে টেবিলে উপস্থিত হয় সে। খাওয়ার জন্য চেয়ার টেনে টেবিলে বসতেই মাহিরা চৌধুরী নিজের খাবার ছেড়ে উঠে চলে যান। তাজরিয়ান নিশ্চুপে সেটা দেখেও না দেখার ভান ধরে একটা লোকমা মাখিয়ে মুখে তুলে। মায়ের পিছু পিছু মেহরিমা ও ছুটে যায়। তা দেখে মেহমেত চৌধুরীর খাবারের রুচি চলে যায় বিধায় তিনিও না খেয়ে উঠে পড়েন। সবটা দেখে তাজওয়ার চৌধুরী নির্বিকার কন্ঠে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠেন,
–” কাল থেকে তোমার গুনধর পুত্রের খাবারটা তার ঘরে দিয়ে এসো। কী আর করার জন্ম যখন দিয়েছি তখন না খাইয়ে তো আর মারতে পারবোনা। সন্তান অজাতকুজাত হলেও বাপ মায়ের সাধ্যি নেই তাকে ফেলে দেওয়ার। ”
তাজরিয়ান থমকে যায়। পেটের ভেতর মুচড়ে ওঠা ক্ষুধাটা কোথায় যেনো গায়েব হয়ে যায়। আধখাওয়া ভাতের প্লেটটা ওভাবেই রেখে চলে আসে ঘরে।তারান্নুম চৌধুরী কেঁদেকুটে ছেলেকে ডিফেন্ড করতে চাইলে তাজওয়ার চৌধুরী বলেন,
–” ছেলে বিষয়ক কোনো মামলায় সামান্য অভিমত দিলে এই সংসারের মায়া তোমায় ত্যাগ করতে হবে তারা। ”
স্বামীর কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান তারান্নুম চৌধুরী। কথার বিপরীতে কেবল বলেন,
–” দোয়া করি এই অপবাদটা যেনো সত্য হয়। এই অপবাদ যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয় তবে আমার ছেলেটার উপর হওয়া নির্মম অত্যাচারের আফসোস আমৃত্যু আপনাদের গ্লানিবোধে জর্জরিত করে রাখবে। ইহজীবনে মাফ করতে পারবেন না নিজেকে। ”
তাজওয়ার চৌধুরী প্রত্যুত্তর করেননি। ওমন ভাবে বলায় ভেতরে ভেতরে বেজায় আফসোস করেন তিনি। ছেলের প্লেটের দিকে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠে উনার। নিজেও খাবারের প্লেটটা ঠেলে উঠে দাঁড়ান।
তাজরিয়ান ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। প্রথমবারের মতো তার কঠিন চোখদুটোতে অশ্রু জমে। হৃদয়ের হাহাকার আর্তনাদ রুপে বেরিয়ে আসে। মস্তিষ্কে ধরা দেয় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা। অযাচিত অনুভূতি সামলাতে না পেরে বিছানার চাদর উঠিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে এটাচড্ করে কিন্তু মায়ের অসহায় মুখটা মনে পড়তেই পুনরায় হাঁটু মুড়ে বসে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠে তাজরিয়ান। সাউন্ড প্রুফ রুমটা থেকে একফোঁটা শব্দ ও বাহিরে পৌঁছায় না।
একাকীত্বের ভয়ানক চাদর তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। একদিকে মৃত্যু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে অন্যদিকে মমতার বন্ধন তাকে বাঁধা দিচ্ছে। তাজরিয়ান দোটানায় পড়ে পাগলের মতো চুলগুলো মুঠো পাকিয়ে খামচে ধরে। তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো এদিকওদিক চেয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে। ফোনের ব্যাটারি ডেড। তাড়াহুড়ো করে চার্জে দিয়ে ফোনটা অন করে। আসন্ন সব মেসেজ ঠেলে কল দেয় কাঙ্ক্ষিত নম্বরে। তিনবারের বেলায় কলটা রিসিভ হতেই তাজরিয়ান ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। অপর পাশ থেকে আরশিয়ান তাকে বলে,
–” আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করা উচিত নয় কখনো। পাছে লোকে অনেক কিছুই বলবে। তুমি যদি নির্দোষ হও তবে মুখের উপর উচিত জবাব দাও। বন্ধ ঘরে তোমার আর্তনাদ শুনতে কেউ বসে নেই কিন্তু পাবলিক প্লেসে তোমাকে অপমান করার জন্য হাজারটা লোক অপেক্ষায় আছে। তুমি যদি সঠিক হও তবে সত্যতা প্রমাণ করো। ”
তাজরিয়ান নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে। হারিয়ে ফেলা মনোভাব ফিরে আসে। বুকে অগাধ সাহস জন্মে। কিছুটা সময় নিয়ে সবকিছু খুলে বলে আরশিয়ানকে। দু’জনে মিলে রাতভর প্ল্যান সাজায়।পরদিন সকাল ভোরে তাজরিয়ান কে পুরোদস্তুর তৈরী হয়ে নিচে নামতে দেখে সকলে চমকে তাকায়। তাদের তোয়াক্কা না করে তাজরিয়ান বেরিয়ে পড়ে। দিনশেষে রাত নামে ধরনীর বুকে কিন্তু তাজরিয়ান বাসায় ফেরেনা। কথাটা তাজওয়ার চৌধুরী কে বললে তিনিও চিন্তিত হোন। সকলের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে মোটামুটি রাত দশটার দিকে গাড়ি বহর ভর্তি পুলিশ এবং আসামি নিয়ে বাসায় ফিরে তাজরিয়ান।
চৌধুরী বাড়ির সকলেই উপস্থিত হোন ডাইনিং রুমে। আরভিদের কলার মুঠো করে ধরে রাখা তাজরিয়ান কে দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে যান।মেহরিমা আতঙ্কে রীতিমতো আঁতকে উঠে। তাজরিয়ান সেদিকে তোয়াক্কা না করে আরভিদের গালে চপেটাঘাত বসিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে,
–” তুই স্বীকার করবি নাকি নাকি আরও খাতিরযত্ন করবো? ”
বাধ্য হয়ে আরভিদ সবটা খুলে বলে। মেহরিমাকে নিয়ে সেদিন একজন স্মাগলারের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল সেটাও বলে। মাহিরা চৌধুরী বিশ্বাস করতে না চাইলে ফোনে তোলা ছবিগুলো দেখানো হয়। মাহিরা চৌধুরী মেয়েকে জেরা করলে নিরুপায় হয়ে সবটা স্বীকার করে মেহরিমা। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় মেহমেত চৌধুরীর। মেয়ের করা ভুলে ভীষণ ভাবে লজ্জিত হোন তিনি। তাজরিয়ানের কাছে ক্ষমা চাইলেও সে নির্বিকার থাকে।
তার অশান্ত মস্তিষ্কে বাজতে থাকে কিছু কথা। তার সাথে বিয়ে দেওয়া নিয়ে অসম্মতি প্রকাশ করায় অভিমান করে তার দাদী অদূরে প্রস্থান করেছে এমনটাই ধারণা তাজরিয়ানের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের।
কারও কথার তোয়াক্কা না করে আরভিদকে এক থাপ্পড়ে মেঝেতে বসিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে তাজরিয়ান বলে উঠে,
–” বিগত কয়েকটা দিন যেসব আচরণ আমি সহ্য করেছি সেটা কোনোভাবেই ক্ষমার উপযোগী নয় উপরন্তু এসবের জন্য বাড়িতে এবং সমাজে আমার মানহানি হয়েছে। হাজার হোক আপনারা আমার পরিবারের লোক। যদিও হাস্যকর শোনায় কথাটা তবুও সত্য তো আর অস্বীকার করা যায় না। ”
তাজরিয়ানের কথায় লুকিয়ে থাকা গভীর যন্ত্রণা ঠিকই উপলব্ধি করেন তাজওয়ার চৌধুরী। আত্মগ্লানিতে মুখটা ছোটো হয়ে যায় উনার। ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয় না। তাজরিয়ান সামান্য থেমে আবারও বলে উঠে,
–” আপনাদের কাছে দু’টো অপশন আছে। হয় মানহানীর দায়ে মেহরিমা চৌধুরী বেশ লম্বা সময় জেলে সময় কাটাবেন নয়তো মামলা থেকে বাঁচতে আজ এই আসরে উনি আমাকে বর হিসেবে গ্রহণ করবেন। অপশন জানিয়েছি এখন বাকি সিধান্ত আপনাদের হাতে। ”
উপস্থিত সকলে রীতিমতো আঁতকে উঠে। সকলে হাজার চেষ্টা করেও টলাতে পারে না তাজরিয়ানের সিধান্ত। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে সকলে সম্মতি প্রকাশ করে বিয়ের সিধান্তে। তাজরিয়ান ফোন দিয়ে তার বন্ধুদের কাজি সমেত ভেতরে আসতে বলে। বৈরী পরিস্থিতির মাঝেই পবিত্র বন্ধনে আঁটকা পড়ে দু’টো মানুষ। কবুল বলার সময় আরভিদের ক্ষুব্ধ চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বাঁকা হেসে তিন কবুল বলে তাজরিয়ান৷
বিয়ে শেষ হতেই এক লাফে সোফা থেকে উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙে সকলের উদ্দেশ্যে তাজরিয়ান বলে,
–” মরজান আইরিন চৌধুরী আজ থেকে আমার বিবাহিত স্ত্রী। সকলে ওর সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ বজায় রাখবেন।
যা অন্যায় করার আমার সাথে করেছে সুতরাং সেই হিসেব নিকেশ আমি বুঝে নিবো। আগ বাড়িয়ে বাড়ির একটা সদস্য ও যদি পিন্ডিতি করতে যান তবে বউ সমেত বাড়ি থেকে ফুড়ুৎ হয়ে যাবো এরপর আফসোস কইরেন। ”
মাহিরা চৌধুরীর নীমিলিত দৃষ্টি দেখে তার পানে চেয়ে পুনরায় তাজরিয়ান ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,
–” ভয়ের কিছু নেই ছোটমা। আপাতত সংসার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমার ক্যারিয়ার এলইডি লাইটের মতো উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত তোমার মেয়ে তোমার জিম্মায় থাকবে। ফেরার পর আমার বউয়ের দায়িত্ব আমি বুঝে নিবো। সাবধান! আমানত রেখে যাচ্ছি আমি তোমরা আবার অধিকার ভেবে নিয়ো না কেমন? ”
সকলে অবাক হয়ে শোনে তাজরিয়ানের কথা। সবার দিকে একবার তাকিয়ে তাজওয়ার চৌধুরীর সামনে দাঁড়ায় তাজরিয়ান। স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেলে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,
–” আমি তাজরিয়ান জাওয়াদ চৌধুরী সজ্ঞানে এবং স্ব-ইচ্ছায় চৌধুরী বাড়ি হতে প্রাপ্য অংশীদারিত্ব ত্যাজ্য ঘোষণা করলাম। আপনার অতি কষ্টে অর্জিত অন্ন আপনাকেই মোবারক। আমি তাজরিয়ান আর কখনো আপনার অর্জিত অর্থে কেনা অন্ন মুখে তুলবো না। এতদিন আমার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ এবং ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ”
তাজওয়ার চৌধুরী ব্যথিত চোখে তাকান ছেলেদের দিকে কিন্তু তাজরিয়ান সেসবের তোয়াক্কা না করে বন্ধুবান্ধব সমেত বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে কেবল তারান্নুম চৌধুরীর সাথে ঠিকঠাক মতো কথা বলে। সেই ঘটনার পর হাজার চেষ্টা করেও তাজরিয়ান কে বাড়ি ফেরানো যায়নি উপরন্তু এক মাসের মাথায় কাউকে না জানিয়ে সুদূর লন্ডনে উড়াল দেয় সে। প্রথমদিকে বাড়ির কারও সাথে যোগাযোগ রাখেনি কিন্তু তাজওয়ার চৌধুরী হার্ট এট্যাক করাই বাধ্য হয়ে অভিমান ভুলে সকলের সাথে কথা বলে তাজরিয়ান।
আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকা মেহরিমা মাফ চেয়ে হাজারটা মিনতিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়েছিল কিন্তু অপর পাশ থেকে ওসব সিন হলেও রিপ্লাই মেলেনি কখনো। টানা একবছর যাবত মেসেজ করেও যখন অপরপক্ষ নির্বিকার থেকেছে তখন মেহরিমাও আর চেষ্টা করেনি। হাল ছেড়ে কেবল তার ফেরার অপেক্ষা করছে।
_
শহর থেকে দূরে একটা রঙচটা গোডাউনের সামনে এসে থামে তাজরিয়ানের বি এম ডব্লিউ গাড়িটা। ভেতর থেকে একে একে নেমে আসে তাজরিয়ান, ইশতিরাজ এবং তাজরিয়ান। ভেতরে প্রবেশ করে আরশিয়ান ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
–” সিকিউরিটি টাইট আছে? ”
প্রত্যুত্তরে ইশতিরাজ বলে উঠে,
–” একেবারে ঝাকানাকা লেভেলের টাইট আছে। ”
আরশিয়ান কথা বাড়ায় না। দ্রুতগতিতে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। কাঙ্ক্ষিত রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখ হয়েছে আরভিদকে। তার হাতদুটোর দশটা আঙুলের মাথা স্বতন্ত্র ভাবে পেরেক দিয়ে টেবিলের সাথে গেঁথে রাখা হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে বাঁকা হাসলো তাজরিয়ান। মূলত তার আদেশেই গার্ডস’রা এই কাজ করেছে। আরভিদের ব্যথাতুর মুখটা দেখে নিমিষেই মেজাজটা ভালো হয়ে গেলো ওর।
এগিয়ে গিয়ে আরভিদের চুলের মুঠি ধরে মুখটা উপরে তুলে মিছে আফসোস দেখানোর ভান ধরে বলল,
–” অন্যের সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ালে এমন ছোটোখাটো শাস্তি পেতেই হয় বুঝলি শত্রুর ছাও। ”
আরভিদ গুঙিয়ে উঠল কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না। ইশতিরাজ এগিয়ে এসে একটা ধারাল ছুরি হাতে তুলে নিয়ে আরভিদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
–” শত্রুর ছাও এখনো গুলি চালানোর মজা টের পায়নি তাজ। সরে দাঁড়াও। ব্যাটাকে ব্রেস্ট পিস কিউব করা শেখায় একটু। ”
আরভিদ গুঙিয়ে উঠে দু’পাশে মাথা নাড়ে কিন্তু হৃদয়হীনা ইশতিরাজ ওসবে মাথা ঘামায় না। ফারজানার গুলি লাগা জায়গাটার মাপঝোঁক হিসেবে আরভিদের বক্ষ হতে তিন টুকরা মাংস ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট ডিজাইনে কাটে। অতিরিক্ত যন্ত্রণায় আরভিদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। আরশিয়ান বিরক্ত হয়ে পিস্তল হাতে এগিয়ে এসে বলে,
–” নাটক বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। ট্রিগার টেনে কাহিনির রফাদফা কর। আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”
আরভিদ মরণ ভয়ে ছটফটিয়ে উঠে বলে,
–” আমার উপর অহেতুক জুলুম কেনো করছেন। আমি তো কিছুই করিনি। ”
আরশিয়ান শান্ত চোখে ওকে পরখ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
–” আমার গাড়ির ব্রেক ফেইল করিয়েছ তুমি।আমার আত্মীয়ের উপর আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছ । বলা বাহুল্য, আমার স্ত্রীর দিকেও নজর পড়েছে তোমার। এই রিজন গুলো এনাফ নয়? ”
আরভিদ করুন কন্ঠে বলল,
–” রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছি। এবারের মতো মাফ করে দিন। আমি শুধরে যাবো। ”
আরশিয়ান ভাবলেশহীন গলায় বলল,
–” সেই সুযোগ তুমি হারিয়েছো। ”
আরশিয়ান নির্লিপ্ত ভাবে পিস্তলটা আরভিদের দিকে তাক করতেই প্রাণের ভয়ে আরভিদ হাঁপানো কন্ঠে বলে উঠে,
–” আপনার প্রথম স্ত্রীর খুনীর জীবনবৃত্তান্ত এবং বর্তমান ঠিকানা আমি জানি।”
আরশিয়ান থামলো। ইশতিরাজ এবং তাজরিয়ানের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। আরশিয়ান সামান্য নড়েচড়ে উঠে বলল,
–” তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছো। ”
আরভিদ ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে বলল,
–” যমদূত কে সামনে রেখে মিথ্যা বলার মতো সাহস আমার নেই। আপনি যদি আমার জীবন ভিক্ষা দেন তবে আমি আপনাকে সেই আগন্তুকের খোঁজ দিবো।আমি জানি চৌধুরীরা কখনো কথার বরখেলাপ করে না।”
আরশিয়ান কপালে পিস্তল ঠকিয়ে লম্বা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” দিলাম তোমার জীবন ভিক্ষা। এবার বলো সত্যিটা। সাবধান, যদি ইনভেস্টিগেট করে এর সত্যতা যাচাই করে কোনো কপটতা ধরা পড়ে তবে নিকৃষ্টতম মৃত্যু হবে তোমার। ”
আরভিদ ফাঁকা ঢোক গিলে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠে,
–” আপনার স্ত্রীকে খুন করেছে রওশান ওয়াসীত্বের মেয়ে রাদিয়াহ ওয়াসীত্ব। বর্তমানে নামধাম পাল্টে সে অন্য পরিচয়ে নিষ্পাপ মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ”
যন্ত্রণার তোড়ে কথা আঁটকে আসে আরভিদের। আরশিয়ান বিচলিত কন্ঠে শুধায়,
–” তার বর্তমান পরিচয় কী? কোথা…
আরভিদ তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
–” সে আর কেউ নয় বরং আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী অধরা ইসলাম প্রিমা।”
চলবে?