শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-২১

0
16

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২১

প্রবাহমান সময় নিজের গতিতে এগিয়ে চলে। জীবন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য থেমে থাকে না কেবল মস্তিষ্কে রেখে যায় স্মৃতির ছাপ। সময়কাল প্রায় রাত দশটা। বহুকষ্টে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা টেনে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রিমা। বমি করতে করতে বেচারির কাহিল দশা হয়েছে। শুভ্র টাওয়েলে ভেজা মুখটা মুছে ধীর পায়ে বিছানার কাছাকাছি এসে ধপাস করে বসে পড়ে সে। মাথাটা চক্রের মতো ঘূর্ণি দিচ্ছে তার।

বেডসাইড ল্যাম্পটা কোনোমতে বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। চোখবুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ফোনের বিকট শব্দে তার ধ্যান ভাঙে। বিছানা হাতড়ে ফোনটা খুঁজে পেতেই কলটা রিসিভ করে কানে ধরে। অপর পাশ থেকে ফারজানা বিবশ কন্ঠে শুধায়,

–” লাড্ডু? ভালো আছিস সোনা? ”

প্রিমা ভাঙা গলায় উত্তর দেয়,

–” আমি ভালো আছি বুবু। তোমার কী অবস্থা? ”

ফারজানা চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,

–” গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেনো তোর? আবার কেঁদেছিস? ”

প্রিমা চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল,

–” একটু আগে বমি হয়েছে তাই গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে। আমি কাঁদতে যাবো কেনো? মানুষটাই যেখানে অন্য কারও সেখানে আমার শোক পালন করা মানায়? ”

ফারজানা বুঝলো প্রিমা মেজাজ হারাচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টে সে ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” আমি এখনো জীবিত আছি লাড্ডু এরপরও তুই ওই বাড়িতে পড়ে আছিস কেনো? ”

প্রিমা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

–” জন্মের পর মেয়েদের ঠিকানা হয় তার বাবার বাসায় আর বিয়ের পর স্বামীর বাসায়। সেই হিসেবে দেখতে গেলে আমি তোমার কাছে পরগাছা উপরন্তু আমার চাকরিটাও নাই। আমাদের যে ফিনানশিয়াল কন্ডিশন তাতে একজনেরই ভরণপোষণ সামলাতে কষ্ট হয়ে যায়। এবার বলো দুজনের এক্সপেন্স কিভাবে বহন করবে তুমি ? ”

ফারজানা থমথমে মুখে বলল,

–” এর আগেও অর্থ সংকটে না খেয়ে দিন পার করেছি। তাই বলে ক্ষুধার তাড়নায় সম্মান বিকিয়ে দেয়নি। তোর মস্তিষ্কে কী চলছে সত্যি করে বল।”

প্রিমা স্মিত হাসলো। পুরো দুনিয়া যেখানে তাকে ভুল বুঝতে ব্যস্ত সেখানে ক’জন মানুষকে হাজার চেষ্টা করেও তাদের ভুলভাল বোঝাতে পারছেনা বেচারি। শেষমেশ না পারতে ভনিতা ছেড়ে স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

–” আট বছর আগে বিনা দোষে অপরাধের দায়ভার মাথায় নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। ইতিহাস পুনরায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। এবার আমি পালাতে চইনা বুবু। শেষ অব্দি নিয়তি আমার সাথে কতটা অন্যায় করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রাখতে চাই। ”

এতটুকু বলতেই যেনো হাঁপিয়ে উঠল প্রিমা। বুক ভরে শ্বাস টেনে পুনরায় বলল,

–” আমি চাই এবার অন্তত সত্যিটা সামনে আসুক। যদি আবারও আমি অভিযুক্ত প্রমাণিত হই তবে মৃত্যু আসুক।ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কেবল পরিণতির জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য অবশিষ্ট রয়েছে।বাদবাকি সমস্ত অনুভূতি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে নির্মম ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে বুবু ।

প্রিমার অনুভূতিহীন কথায় ফারজানার বুক ভার হয়ে আসে। সে আমতা আমতা করে বলে,

–” আমার কাছে থাকা মানে পালিয়ে যাওয়া নয় লাড্ডু। তুই…

ফারজানাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে প্রিমা ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

–” যে বাড়িটায় সম্মানের সাথে প্রবেশ করেছিলাম সেখান থেকে মিথ্যা কলঙ্ক নিয়ে বেরোতে চাইনি। তাছাড়াও আরভিদ ওঁৎ পেতে আছে। আমার সামান্য একটা ভুলের জন্য তোমার কিংবা আমার প্রাণ সংকটে ফেলতে চাইনা আমি। একটু বোঝার চেষ্টা করো ব্যপারটা। ”

এবার যেনো ফারজানার মস্তিষ্কের জট খুললো। সে হতবাক হয়ে বলল,

–” আমি ভেবেছিলাম তুই বিবেকহীনের মতো আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়ে সংসার বাঁচানোর চেষ্টায় আছিস। আমি বুঝতেই পারিনি তুই ঠান্ডা মাথায় এতসব কিছু প্ল্যান করে বসে আছিস।”

প্রিমা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

–” বিপদের সময় বুদ্ধিহীনের মতো সিধান্ত নেওয়াটা কখনো আত্মসম্মানের পরিচয় বহন করেনা বরং ধৈর্য রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করাটা বিবেকবান মানুষের কাজ। এসবের পাশাপাশি যে দুইটা মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে মাথায় করে রেখেছে তাদের আবদারটাও ফেলতে পারিনি বিধায় এতবড় সিধান্ত নিয়েছি। আর রইল কথা সংসারের? সেটা কখনোই একতরফা হয় না। ”

ফারজানার বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। কথা বলতে বলতেই প্রিমার চোখদুটোতে ঘুম পরি এসে ভর করলো।প্রিমার ভারিক্কি শ্বাসের শব্দ পেয়ে ফারজানা নৈঃশব্দ্যে কল কেটে দিলো। নিজেও ফোন রেখে ঘুমাতে যাবে এমন সময় দেখলো তার ফোনের স্ক্রিনে ইশতিরাজের দেওয়া একটা মেসেজ ভেসে আছে। সেটা ওপেন করতেই দেখলো তাতে লিখা,

–“এই যে লাড্ডুর মাদার…..মিস তেরেসা রাণী। আপনার লাড্ডুর জীবন-মরণ প্রশ্ন অথচ আপনার ফোন ওয়েটিংয়ে। ফ্রী হয়ে জলদিই কল করেন। ”

ফারজানার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। ইশতিরাজ কে ডিটারজেন্ট বিহীন আচ্ছামত ধোলাই দিতে তৎক্ষনাৎ কল দিলো।

_

খাবারের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকতেই আফিয়া চৌধুরী দেখলেন প্রিমা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। উনার পাশে দাঁড়ানো আরিয়ান চৌধুরী খানিকটা অবাক হয়ে শুধালেন,

–” আফি? কী হয়েছে আমার প্রিন্সেসের? ”

আফিয়া চৌধুরী মুখটা অন্ধকার করে ফিসফিসিয়ে বললেন,

–” বিকালে দুবার বমি করেছে। সন্ধ্যার পর থেকে শরীরটা একটু গরম লাগছিল এরপর কাজের ব্যস্ততায় আর খোঁজ নিতে পারিনি। ”

আরিয়ান চৌধুরী কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

–” বাসায় কাজের লোকের অভাব পড়েছে? আমার অসুস্থ বাচ্চাকে একা ফেলে তুমি কাজ করতে গেছো কেনো? কী আশ্চর্য! বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমার কমনসেন্স কমে যাচ্ছে নাকি?”

আফিয়া চৌধুরী স্বামীর রাগ দেখে থতমত খেয়ে বললেন,

–” আপনার মেয়ে ঘুমাচ্ছিল তাই বেরিয়েছিলাম আমি।আপনাদের বাপবেটির অত্যাচারের কারণেই আমার কমনসেন্স লাপাত্তা হয়ে গেছে। ”

শেষের কথাটা খানিকটা আক্ষেপের সুরে বললেন আফিয়া চৌধুরী। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীর হাত থেকে খাবার ভর্তি ট্রেটা নিয়ে পাশের ওয়ারড্রব এর উপর রাখলেন এরপর এক হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

–” স্যরি আফি। ”

আফিয়া চৌধুরী আলতো করে সরে এসে ধীর কন্ঠে বললেন,

–” প্রিমাকে ঘিরে আপনার চিন্তাটা আমি বুঝি। মেয়েটা ভীষণ সাফার করছে। ওর দিকে তাকালে আমার নিজেকে অপরাধী লাগে। আমাদের বুদ্ধিমান ছেলেটা এত বড় বোকামি কীভাবে করে ফেললো?”

আরিয়ান চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” মাঝেমধ্যে আবেগ মানুষকে জঘন্য ভাবে কন্ট্রোল করে। মানুষ বেকুবের মতো সিধান্ত নেয় অতঃপর ভুল করে। আমাদের ছেলেটা কম কষ্ট পাচ্ছেনা কিন্তু তার মাত্রাতিরিক্ত জেদ তাকে বাস্তবতা গ্রহণ করতে দিচ্ছেনা। সত্য মিথ্যার চরম এক গোলকধাঁধায় আঁটকে আছে সে। নিজে থেকে না চাইলে আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে বের করতে পারবোনা। ”

আফিয়া চৌধুরী নিরবে শুনলেন স্বামীর গম্ভীর কথা। বুকটা কেঁপে উঠল উনার। চোখে জমলো ব্যর্থতার জল। প্রিমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাতেই বুক ফেটে কান্না আসলো উনার কিন্তু পরিস্থিতির কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিলেন। বিগত দিনগুলো এই বাচ্চা মেয়েটা কতটা স্ট্রাগল করেছে সেটা উনি স্বচক্ষে দেখেছেন। উনার বুকে লেপ্টে থেকে নিরবে কেঁদে কতগুলো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে প্রিমা সেই হিসেবটাও উনি রেখেছেন। মাঝেমধ্যে আরশিয়ানের উপর রাগ হয় পরক্ষণেই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেকে সামলে নেন।

মাত্র কয়টা দিনেই মেয়েটা একদম আপন হয়ে উঠেছে উনাদের কাছে। আফিয়া চৌধুরীর মনে হয় সময়টা সেই ত্রিশ বছর পিছিয়ে গিয়েছে। অনুভূত হয় সদ্য একটা সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। আরিয়ান চৌধুরীর আদুরে কাজকর্ম গুলো দেখলে মনে হয় তিনিও প্রথম বারের মতো বাবা হয়েছেন। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিমাকে ব্রেকফাস্ট করানোর দায়িত্বটা আরিয়ান চৌধুরী পালন করেন। দুপুর এবং সন্ধ্যার দায়িত্ব আফিয়া চৌধুরীর।

অফিস থেকে বাসায় ফিরে রাতের বেলা পুনরায় ডিনার নিয়ে প্রিমার কাছে হাজির হোন আরিয়ান চৌধুরী। প্রায় ঘন্টা খানেক নানান কথাবার্তা বলে খুনসুটির মাধ্যমে তাদের তিনজনের সময় কাটে। প্রতি সপ্তাহে প্রিমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হোন উনারা। এতকিছুর পরেও ভয়াবহ বিষন্নতার কবল থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারেননি। এই ব্যর্থতা উনাদের কতটা কষ্ট দেয় সেটা বর্ণনাতীত।

বিছানার একদম মাঝখানে ঘুমিয়ে আছে প্রিমা। আরিয়ান চৌধুরী এবং আফিয়া চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে প্রিমার মাথার কাছের ফাঁকা জায়গাটায় বসেন। ভীষণ আলতো করে প্রিমার কপালে হাত রেখে জ্বরের মাত্রা পরখ করেন আরিয়ান চৌধুরী। এরপর চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

–” জ্বর নেই কিন্তু ওকে দেখে ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে। কতটা শুকিয়ে গেছে খেয়াল করেছ? চোখ গুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। কাল পরীক্ষা আছে ওর ? ”

আফিয়া চৌধুরী প্রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

–” কালকে পরীক্ষা আছে। এটা হলেই এক্সাম শেষ এরপর ওকে একটা ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ”

আরিয়ান চৌধুরী চিন্তিত স্বরে পুনরায় বললেন,

–” পরীক্ষা দিতে কালকে আমি নিয়ে যাবো আমার মেয়েকে। এক্সাম শেষ হলে আবার আমিই নিয়ে আসবো। কাল সন্ধ্যায় ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি? ”

আফিয়া চৌধুরী চোখের কোণে জমা অশ্রু মুছে বললেন,

–” আচ্ছা। ”

আরিয়ান চৌধুরী স্ত্রীর দিকে থমথমে মুখে চেয়ে বললেন,

–” কাঁদছো কেনো আফি? ”

আফিয়া চৌধুরী প্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রন্দনরত গলায় ফুঁপিয়ে উঠে বললেন,

–” আমার বাচ্চাটা আর কত কষ্ট পাবে? মনের দিক দিয়ে শান্তি নাই। জীবনে সুখ নাই। শরীরটাও এখন সঙ্গ ছেড়ে দিচ্ছে। আমার যে আর ধৈর্যে কুলাচ্ছেনা।মা হয়ে সন্তানের ধ্বংস দেখবো কীভাবে? ”

আরিয়ান চৌধুরী নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” আমি শুধু প্রমাণের অপেক্ষায় আছি আফি। একবার এই ঝামেলা সমাধান হলে আমরা ওকে নিয়ে দেশের বাহিরে শিফট হবো। আপাতত ওকে একটা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিলে কেমন হয়? ”

আফিয়া চৌধুরী কান্না চেপে কোনোমতে বললেন,

–” যেটা ভালো হয় করেন। আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ সবল দেখতে চাই। অতীত পরিবর্তন করতে পারবোনা কিন্তু ওর বর্তমানটা রঙিন করতে হবে আমাদের। ”

আরিয়ান চৌধুরী আর কিছু বলতে নিবেন তার আগে ঘুমঘুম চোখে প্রিমা চোখ মেলে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে ডাকল,

–” বাবাই? ”

আরিয়ান চৌধুরী স্মিত হেসে সাড়া দিয়ে বললেন,

–” জ্বী আম্মা? কিছু খাবেন? ”

প্রিমা পিটপিটিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আফিয়া চৌধুরীর মুখটা অবলোকন করে ধীরেসুস্থে উঠে বসলো। এরপর ভাঙা গলায় শুধাল,

–” তুমি কাঁদছো কেনো আম্মু? ”

আফিয়া চৌধুরীর কী হলো কে জানে। তিনি প্রিমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে সজোরে কেঁদে উঠলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললেন,

–” সুস্থ হয়ে যা মা। এইকয়দিনেই আমার চোখের মনি হয়ে গেছিস। তুই সামান্য আঘাত পেলে আমার কলিজায় ব্যথা লাগে। ”

আরিয়ান চৌধুরী স্ত্রীকে ইশারা করে বললেন নিজেকে সামলাতে অতঃপর প্রিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–” তোমার আম্মুর বয়স হয়ে যাচ্ছে আম্মা। এজন্যই ভুলভাল বকছে। আমি খাবার নিয়ে আসি। বাপবেটি মিলে মজা করে ডিনার করবো। ”

প্রিমা প্রত্যুত্তর করলো না কেবল নিরবে দেখল তাদের। এই সাপোর্টিভ মানুষ দুটোর জন্যই হয়তো আজ এতটা সিকিউরড এবং সুন্দর জীবন যাপন করছে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে রাতের ডিনারটা শেষ হলো।গল্প শেষে মা মেয়েকে রেখে আরিয়ান চৌধুরী গেলেন নিজের শয়নকক্ষের দিকে।

_

সময়কাল তখন রাত বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। চৌধুরী বাড়ির মেইন গেট খুলে প্রবেশ করল তাজরিয়ান এবং আরশিয়ান। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে উপরে যাওয়ার সময় তাজরিয়ান বলল,

–” কাজ কতদূর? ”

আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” কেবল কালকের অপেক্ষা অতঃপর সবটা প্রমাণিত হবে।”

তাজরিয়ান আর কথা বাড়ালো না। ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিজের ঘরের দিকে চললো। বিগত কতগুলো দিন একটু প্রশান্তির ঘুম হচ্ছেনা তার ইয়ত্তা নেই। অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে বাড়িতে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টার বেশি সময় দিতে পারেনি। সেই আদিকালের কথায় এখনও বউ রেগে আছে অথচ অভিমান ভাঙানোর ফুরসত মিলেনি।

হাজারটা ভাবনার মাঝে ঘরে প্রবেশ করল তাজরিয়ান। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো মেহরিমা পড়াশোনায় ব্যস্ত। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে চুপচাপ ওয়াশরুমে গেলো। শাওয়ার শেষে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে মেহরিমার টেবিলের সামনে গিয়ে শান্ত কন্ঠে ডাকল,

–” বউজান? ”

মেহরিমা মাথা তুলে নিরব চোখে চেয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

–” জ্বী? ”

বউয়ের অভিমান বুঝে তাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে বিছানার কাছে এনে দাঁড় করালো। ধপ করে বেডে বসে মেহরিমার হাতে একটা টাওয়েল ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” একটু পতিসেবা করতো বউজান। ”

মেহরিমা নিশ্চুপ ভঙ্গিতে টাওয়েলটা নিয়ে তাজরিয়ানের ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে থাকলো। তাজরিয়ার দুষ্টুমির ছলে তার উদরে মুখ গুঁজে লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,

–” আমার পারফিউম ইউজ করেছিস? ”

তাজরিয়ানের আকস্মিক আচরণে মেহরিমা একটু কুঁকড়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,

–” ওই একটু আরকি…

তাজরিয়ান দুষ্টু হেসে বলল,

–” আমাকে মিস করছিলি সেটা সরাসরি বললেই তো হয়। ”

মেহরিমার মুখটা রক্তিম হয়ে উঠল। সেটা ভালোমতো পরখ করে দুষ্টু কন্ঠে তাজরিয়ান বলল,

–” তুই দেখি নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছিস। আমি সদ্য বিবাহিত বরের মতো কিছু-মিছু করবো নাকি এখন ? ”

মেহরিমা টাওয়েলটা তাজরিয়ানের হাতে দিয়ে বলল,

–” আপনি ভীষণ রকমের খারাপ। ”

তাজরিয়ান উচ্চশব্দে হেসে বলল,

–” তাহলে বায়োলজির ভাষায় ভালো হওয়ার পদ্ধতিটা শিখিয়ে দে। ”

মেহরিমা লজ্জারুণ কন্ঠে বলল,

–” ধ্যাত্ সরুন তো। ”

তাজরিয়ান হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,

–” তোর দিকে সরতে বলছিস? বাব্বাহ আমার সাথে থেকে তোর দেখি ভালোই উন্নতি হয়েছে বউজান।”

মেহরিমা লজ্জায় নতজানু হয়ে চুপ রইল। লাজহীন মানুষের সাথে কথা বাড়ানো মানেই বিপদ। দুষ্টুমির সমাপ্তি ঘটিয়ে তাজরিয়ান মেহরিমাকে কাছে টেনে পাশে বসিয়ে বলল,

–” কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনিস ঠিকাছে? ”

মেহরিমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। তাজরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” আমার যখন রাগ উঠে তখন আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ি। সামনের জনকে কথার আঘাতে কিংবা শরীরের আঘাতে কাবু করতে না পারলে মন তৃপ্ত হয়না। আমি জানি এটা একধরনের মানসিক রোগ কিন্তু আমি এর নিরাময় চাইনা। আমি চাই আমি যেমন তুই আমাকে সেভাবেই গ্রহণ কর। তোর কোনো আপত্তি আছে? ”

মেহরিমা বিবশ কন্ঠে বলল,

–” কথার আঘাত ভীষণ ভয়ংকর হয় তাজ। সাত বছর আগের ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আপনি কয়েকদিন পূর্বে যে অভিযোগটা তুলেছিলেন সেটা কিছুটা যৌক্তিক ছিলো। সর্বোপরি বলতে গেলে আই ডিজার্ভ মোর পানিশমেন্ট। ”

বিচক্ষণ তাজরিয়ান ঢের বুঝলো বউয়ের অনুতাপ। মেহরিমার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলল,

–” অতীতের অনুতাপে যথেষ্ট পুড়েছিস। আমিও ভুগেছি কিন্তু এসব অর্থহীন অনুভূতির সাপেক্ষে জীবনটা পার করে দিতে চাইনা আমি। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। অতীতে যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে বর্তমান নষ্ট করার পক্ষে আমি নেই। দুঃখের লেলিহান শিখায় পুড়ার চেয়ে অতীত ভুলে সুখের সাগরে অবগাহন করাটা উত্তম। ”

মেহরিমা অশ্রুভেজা চোখজোড়া তুলে ধীর কন্ঠে বলল,

–” আম স্যরি। ”

তাজরিয়ান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল,

–” ইট’স ওকে বউজান। এবার আমি স্যরি বলার মতো একটা কাজ করি? ”

মেহরিমা চোখ বড়সড় করে বলল,

–” একদমই না। কালকে আমার বান্ধবীর গায়ে হলুদ। চোখে ডার্ক সার্কেল নিয়ে যাওয়া যাবে না। আপ…

মেহরিমা কথা শেষ হওয়ার আগে তাজরিয়ান ওর কাঁধে মুখ গুঁজে ঘোর আছন্ন স্বরে বলল,

–” স্রেফ ডার্ক সার্কেল নিয়ে যেতে হবে না বউজান ওটার সঙ্গে কিছু-মিছু পার্পল মার্ক ও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ”

মেহরিমা কাঁদো কাঁদো চোখে তাকাল তাজরিয়ানের দিকে। তাজরিয়া থোড়াই না ওসব পরোয়া করে। আরও একটি রাত তাদের পূর্ণতার সাক্ষী রইল।

_

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের অন্তিম প্রহর।গাড়ির ভেতরে অবস্থানরত ইশতিরাজ আচানক মাথার যন্ত্রণায় ব্যথাতুর শব্দ করে উঠল। রক্তিম ঘোলাটে দৃষ্টি তাক করে ড্রাইভিং সিটে বসা আরশিয়ান কে বলল,

–” ওরে পাপী..আমারে জলদি এক কাপ কড়াআআ করে রঙ চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর নয়তো সকল প্রমাণ সমেত আমি ডাইরেক্ট স্বর্গে ল্যান্ড করবো। ”

আরশিয়ান বিরক্ত মুখে বলল,

–” এই ভার্সিটি এরিয়ায় কোথায় রেস্টুরেন্ট পাবো?তোকে নিয়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো? গাধার মতো কথা বলিস কেনো? ”

ইশতিরাজ মাথার যন্ত্রণায় কাতর কন্ঠে বলল,

–” এই হতচ্ছাড়া তুই এত জোরে কথা বলিস কোন সুখে? আমার এভারেস্ট ছুঁই ছুঁই বেদনা কী তোর চোখে পড়ছেনা? ”

আরশিয়ান কথা বাড়ালো না। বেচারা আসলেই কষ্টে আছে। গাড়িটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির গেট থেকে সামান্য দূরে দাঁড় করিয়ে রাস্তায় বসে থাকা একজন চা ওয়ালার দিকে একটা মিনি ফ্লাক্স এগিয়ে দিয়ে আরশিয়ান বলল,

–” মামা.. ফ্লাক্সটা ভর্তি করে দেন। ”

ইশতিরাজ তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে তাকিয়ে ধৈর্যহীন কন্ঠে বলল,

–” এই হারামির ফ্লাক্সে চা দেওয়ার আগে এই মাসুম বাচ্চার দিকে একটা চা ভর্তি কাপ এগিয়ে দেন মামা। বিলটা ওই দিবে নো টেনশন। ”

চা ওয়ালা হাসলেন ওদের ভাবমূর্তি দেখে। দ্রুত অন টাইম কাপে চা ঢেলে ইশতিরাজের দিকে এগিয়ে দিলেন। বেচারা তাড়াহুড়ো করে কাপটা হাতে নিতেই দেখলো ওটা দুধ চা।সে আফসোসের সহিত একটা লম্বা চুমুক বসিয়ে বলল,

–” বেদনার কমানোর জন্য বিষ পান করিতেছি। আমারে তো মহাপুরুষের খেতাব দেওয়া উচিত। ”

আরশিয়ান কান দিলো না ওসব উদ্ভট কথায়। একটু খোলা হাওয়া খেতে গাড়ির উইন্ডো শিল্ডটা নামিয়ে বাহিরের প্রকৃতি অবলোকন করতে লাগলো। হুট করে দেখলো তার বাবা ভীষণ যত্নের সহিত কাউকে আগলে রেখে ভীড় ঠেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির গেট থেকে বেরুচ্ছেন।

কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে হালকা রোদ থেকে বাঁচাতে মাথার উপর একটা ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগ ধরে রেখেছেন। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পড়লো প্রিমা এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। সেই ঘটনার পর একটা দিনও চোখের সামনে পড়েনি মেয়েটা। বিষয়টা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই সে আরেকটু তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মেয়েটার পরনে রয়েছে একটা বেবিপিংক কালারের গাউন এবং সাথে ম্যাচিং করা লেগিংস।

আরশিয়ান লক্ষ্য করলো বেশ পরিবর্তন এসেছে প্রিমার মাঝে। এ-ই কদিনে অনেকটা শুকিয়েছে বেচারি । মুখটা স্পষ্ট না দেখতে পেলেও ওড়নায় ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসা লম্বা চুলের বিনুনিটা ঠিক খেয়াল করল। চুলের ঘনত্ব বেশ কমে এসেছে। এইটা দেখে আরশিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়লো। অহেতুক মেজাজটা বিগড়ে গেলো তার।প্রিমার দুর্বল পদযুগল লক্ষ্য করে বিড়বিড়িয়ে বলল,

–” চৌধুরী বাড়িতে খাবারের অভাব পড়েছে নাকি? কেউ একজন মানুষ থেকে কংকালে পরিণত হচ্ছে সে খেয়াল আছে কারো? দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ যতসব। ”

ইশতিরাজ বেশ ক্ষুরধার দৃষ্টিতে পরখ করছিল আরশিয়ানকে। পুরো দৃশ্যটা দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে সে বলে উঠল,

–” কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি তোকে? ”

আরশিয়ান সল্প বাক্যে বলল,

–” বল। ”

ইশতিরাজ জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

–” তোর কাছে সম্পর্কটা কেবল ঘাড়ে চেপে বসা একটা দায়িত্ব ছিলো? ”

আরশিয়ান একটু সময় নিয়ে বলল,

–” শুরুতে তেমনটাই ছিলো। সময় পরিবর্তনের সাথে আমাদের সম্পর্কের সমীকরণে বেশকিছু পরিবর্তন আসে। যার ফলস্বরূপ সম্পর্কটা আমার কাছে দায়িত্বের চাইতেও বেশি কিছু হিসেবে আখ্যা পায়। ”

ইশতিরাজ খানিকটা ভেবে পুনরায় শুধাল,

–” সেদিন ড্রাঙ্ক অবস্থায় তুই উনাকে নীহা ভেবে কাছে টেনেছিলি?

আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” আমি কেবল নিজের জৈবিক চাহিদার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলাম… হুঁশ হারায়নি। উনাকে উনি হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম আমি কিন্তু পরবর্তী সকাল….।

ইশতিরাজ বেশ শক্ত কন্ঠে শুধায়,

–” তোর মনে হয় না সেদিন রাতের জন্য উনাকে ব্লেইম করাটা তোর নিকৃষ্টতম ভুল ছিলো? ”

আরশিয়ান অনুতপ্ত কন্ঠে বলে,

–” রাগ মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। বিবেচনা করার সক্ষমতা হারিয়ে যায়। মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভুল ভাল কাজ করে বসে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের ওই অবস্থা দেখে আমি রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। গতদিন আরভিদের বলা কথাগুলো আমার উপর বেশি ইফেক্ট ফেলে। আমি ভাবতে থাকি সত্যতা সামনে আসায় জাস্ট আমাকে আঁটকে রাখার জন্য উনি সুযোগ নিয়েছেন। মুহূর্তটা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা একদম যৌক্তিক মনে হবে।”

সামান্য থেমে আরশিয়ান আবারও বলে উঠল,

–” সেদিন বেরিয়ে যাওয়ার পর পরবর্তীতে আমি যখন বিষয়টা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসি তখন লজ্জায় নিজেকেই সপাটে দু’টো চড় মারতে মন চাইছিল। না চাইতেও আমি নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করেছি। তার প্রাপ্য অধিকার দেওয়ার বদলে তাকে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। এই একটা রিজনের জন্য আমি উনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ”

ইশতিরাজ পুনরায় ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” তুই উনাকে খুনি হিসেবে এক্যিউজ করেছিস সেক্ষেত্রে? ”

আরশিয়ান সহজ গলায় বলল,

–” আমার কাছে যথেষ্ট কারণ ছিলো। প্রথমত প্রিমা এবং মিস ফারজানার সাথে আরভিদের সম্পর্কটা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন ছিলো। আমি যখনই মিসেস প্রিমাকে উনার অতীত সংক্রান্ত প্রশ্ন করেছি তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সেটা এড়িয়ে গিয়েছেন। সেদিন যখন আরভিদ আমাকে কথাগুলো বলে আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। অপেক্ষা করেছি তার প্রমাণের। প্রমাণ হাতে আসার পর সেটাও ক্রসচেক করিয়েছি এরপরেও যদি সত্যতা প্রমাণিত হয় তাহলে আমি কেনো বিশ্বাস করবোনা? ”

ইশতিরাজ পাল্টা প্রশ্ন করল,

–” তুই উনার সাথে এতদিন ধরে সংসার করছিস এরপরও তোর মনে হয় উনি এমন কাজ করতে পারে? ”

আরশিয়ান লম্বা একটা শ্বাস টেনে শান্ত কন্ঠে বলল,

–” উনি বর্তমানে কেমন সেটা নাহয় আমি জানি কিন্তু অতীতের প্রিমার অস্তিত্ব আমার নিকট কতটুকু পরিচিত? আমার সন্দেহ সবথেকে বেশি বেড়েছে উনার আচরণের কারণে। অতীত সংক্রান্ত প্রশ্ন আসলেই তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেন। এতোসব কিছু কী ইঙ্গিত করে তুই বল? ”

ইশতিরাজ প্রসঙ্গ পাল্টে শুধাল,

–” উনি যদি দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে কী করবি? ”

আরশিয়ান থমথমে কন্ঠে বলল,

–” নিজ কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে উনাকে আইনের হাতে তুলে দিবো। ”

ইশতিরাজ পুনরায় শুধায়,

–” যদি নির্দোষ হয় তখন কী করবি? ”

আরশিয়ান কঠোর গলায় বলল,

–” আমি চাইবো উনি যেনো আমৃত্যু আমাকে ক্ষমা না করেন।

ইশতিরাজ কৌতূহলী কন্ঠে শুধাল,

–” সংসারের কী হবে? ”

আরশিয়ান বাঁকা হেসে বলে,

–” চৌধুরী বাড়ির বউয়েরা মৃত্যুর পূর্বে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গমনের অনুমতি পায় না এমনকি স্বয়ং স্বামী মরলেও না। ”

ইশতিরাজ হতভম্ব চোখে দেখে আরশিয়ানকে। হুঁশ ফিরতেই ফোনের রেকর্ডিংটা খুব সন্তপর্ণে বন্ধ করল।কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে নিজের ফোনটা আরশিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে অতঃপর থমথমে কন্ঠে বলে,

–” যাবতীয় ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা আছে। পড়ে শেষ অব্দি সুস্থ থাকিস। আমি গাড়ি চালানোর পরিস্থিতিতে নেই। তুই আমার শেষ ভরসা। ”

আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে ফোনটা হাতে নিলো। কাঙ্ক্ষিত ফেজটা ওপেন করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু ডকুমেন্ট। সে ধীরস্থির ভাবে পড়তে শুরু করল।

চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির পূর্বে পুরো দেশজুড়ে ওয়াসীত্ব লিমিটেডের নামডাক ছিলো।ওয়াসীত্বেরা তিন ভাই তন্মধ্যে দুজন কোম্পানি পরিচালনা করতেন এবং অন্যজন স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের মধ্যে বড় জনের নাম ছিলো মাশরাফি ওয়াসীত্ব। দ্বিতীয় জনের নাম আশরাফ ওয়াসীত্ব এবং তৃতীয় জনের নাম ছিলো রওশান ওয়াসীত্ব।

মাশরাফি ওয়াসীত্ব বিয়ে করেছিলেন নাহার নামের এক অতন্ত্য সুন্দরী এবং এতিম রমনীকে। নীহারিকা ওয়াসীত্ব নামে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান ছিলো তাদের। আশরাফ ওয়াসীত্ব ও বিবাহিত ছিলেন এবং আরভিদ ওয়াসীত্ব নামে একটি ছেলে সন্তান ছিলো উনার। রওশান ওয়াসীত্বের সংসার ছিলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়ে রাদিয়াহ্ ওয়াসীত্ব প্রিমাকে নিয়ে।

লোকদেখানো বাণিজ্যের আড়ালে ওয়াসীত্ব লিমিটেডের অপকর্ম বেশ ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু চৌধুরীদের সাথে টেক্কা নেওয়ায় যেনো কাল হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য। ড্রাগসের বিষয়টা সামনে আসতেই রাতারাতি কোম্পানির অবস্থান তলানিতে এসে ঠেকল। ফ্যাক্টরি গুলো তালাবদ্ধ হলো। ঋণের দায়ে বাড়ি জব্দ হয়ে পড়ায় তাদের আশ্রয় নিতে হয় গ্রামের বাড়িতে।

মূলত রওশান ওয়াসীত্ব একজন স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করতেন। এজন্যই এই ঘটনার আঁচ তাদের উপর পড়েনি তবে গ্রামে পালিয়ে গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি মাশরাফি ওয়াসীত্বের। এই ঘটনার পর ক্রেতার মালের হিসেব বুঝিয়ে দিতে না পারায় বিদেশি ড্রাগ ডিলারের হাতে অকালে প্রাণ হারাতে হয় মাশরাফি ওয়াসীত্ব কে। এতে করে পুরো পরিবার আরও ভেঙে পড়ে।

আশরাফ ওয়াসীত্ব ছিলেন ভীষণ ধুরন্ধর এবং লোভী প্রকৃতির লোক। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব আশরাফের নজর পড়েছিল রওশান ওয়াসীত্বের ব্যবসায়। সেটার উপর নিজের অধিপত্য বিস্তার করার জন্য মনে মনে ছক কষতে থাকেন তিনি।

প্রথমে নিজেদের অবস্থানের কথা উল্লেখ করে রওশন ওয়াসীত্ব কে বাধ্য করেন নাহার এবং নীহারিকা ওয়াসীত্বের দায়িত্ব নিতে এবং শেষপর্যায়ে নিজেও দুঃখের গান শুনিয়ে তার কোম্পানির একটা পোস্টে সংযুক্ত হোন। সময় পার হতে থাকে তবে রওশান ওয়াসীত্বকে মাত দিয়ে কোনোভাবেই কোম্পানি দখলে আনতে পারছিলেন না আশরাফ ওয়াসীত্ব।

এরমাঝে শোনা যায় রওশন ওয়াসীত্বের স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এটা জানার পর বিরাট এক ফাঁদ পাতেন আশরাফ ওয়াসীত্ব। সেই ফাঁদে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেন নাহার ওয়াসীত্বকে। তিনি জানতেন নাহার ভীষণ উচ্চাভিলাষী মহিলা।এজন্যই তিনি নাহারের সাথে মিলে একটি জঘন্য পরিকল্পনা সাজান।

দীর্ঘ কয়েকমাস স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকা রওশান ওয়াসীত্বকে উত্তেজক নেশাদ্রব্য দিয়ে নাহার ওয়াসীত্বের কাছে পাঠানো হয়। পরিশেষে যা ঘটার তাই ঘটে। নাহার ওয়াসীত্বের সাথে অপকর্মে জড়িয়ে যান রওশান ওয়াসীত্ব। পরবর্তী সকালে নিজের পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। নাহার ওয়াসীত্ব লাস্যময়ী ভঙ্গিতে তাকে বুঝিয়ে বলেন,

–” কাম অন রওশান। আমি বিধবা আর তুমি বউ থকতেও ভুখা।আমাদের চেয়ে বেস্ট কম্বিনেশন আর হতে পারে? তোমার সংসার নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমার শুধু লাক্সারিয়াস লাইফ চাই মাঝেমধ্যে তোমার সান্নিধ্য পেলে মন্দ হয়না অবশ্য। ”

রওশান ওয়াসীত্ব ভীষণ রকমের রেগে যান। জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে বলে উঠেন,

–” আমার স্ত্রী ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছে। আমার একটা মেয়ে আছে। আমি কীভাবে এসব..

নাহার ওয়াসীত্ব তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,

–” ওসব ফিল্মি ডায়ালগ সিনেমাতেই মানায়। তোমার অসুস্থ স্ত্রীর মুখ চেয়ে আর ক’দিন নিজেকে আঁটকে রাখবে? তুমি কী এই হেল লাইফ ডিজার্ভ করো? কীসের কমতি আছে তোমার? রুপ, সৌন্দর্য, টাকাপয়সা নাকি ক্ষমতায়? সামান্য একটা মেয়ে যে কিনা তোমার চাহিদা পূরণে অক্ষম তার জন্য জীবন নষ্ট করবে তুমি? ”

রওশান ওয়াসীত্বের ধৈর্য হারায়। তিনি সপাটে নাহরের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বললেন,

–” একদম মুখ বন্ধ রাখবি। ”

নাহার ভীষণ ক্ষুব্ধ হোন। ফোনটা হাতে একটা প্রাইভেট ভিডিও ওপেন করে রওশান ওয়াসীত্বের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন,

–” আজকে থেকে আমাকে সঙ্গ না দিলে কিংবা আমার বিলাসিতার সম্পূর্ণ খরচ বহন না করলে আমি তোমাকে ধ্বংস করে দিবো রওশান। বড্ড অহংবোধ নিয়ে চলো তাইনা? এই ভিডিও ফাঁস হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে তো ? ”

গতরাত্রের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওটা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন রওশান ওয়াসীত্ব। তিনি কিছু বলার পূর্বে নাহার বলেন,

–” ঝটপট সিদ্ধান্ত নাও। সুখী হতে চাও নাকি জীবনটা শেষ করে দিতে চাও। ”

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বুঝে রওশন ওয়াসীত্ব সম্মতি প্রকাশ করেন নাহার ওয়াসীত্বের নোংরা প্রস্তাবে। প্রথম দিকে অপরাধে ভুগলেও পরবর্তীতে এসব নরমাল হয়ে পড়ে। শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে অপকর্মে জড়ালে খোদা হেদায়েত দেওয়া বন্ধ করে দেন কথাটা সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় রওশন ওয়াসীত্বের সাথে।

অসুস্থ স্ত্রীকে একা ফেলে তিনি বিজনেস ট্রিপের নামে দেশবিদেশে নাহার ওয়াসীত্বের সাথে একান্তে সময় কাটাতেন। দিনশেষে শুধু একাউন্টে টাকা জমা করেই তিনি নিজ দায়িত্ব পালন করতেন। অসুস্থ মাকে নিয়ে প্রিমা রাত-বিরেতে ছুটে যেতো হসপিটালে অথচ বারো বছর বয়সী অসহায় প্রিমাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ ছিলোনা। প্রিমা এসব নিয়ে রওশান ওয়াসীত্বের কাছে অভিযোগ জানালে তিনি নির্বিকার স্বরে বলতেন,

–” আমি কাজ না করলে তোমার আম্মুর ট্রিটমেন্টের টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবো? ”

ব্যস এই একটা কথা প্রিমাকে চুপ করিয়ে দিতো কিন্তু আদ্রিতা ইসলাম বেশ বুঝেছিলেন প্রিয় পুরুষের অবহেলা। একদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে ভীষণ আকুতি মিশিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

–” মানুষের বয়স বাড়লে বুঝি ভালোবাসা ফিকে পড়ে যায়? দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমায় চেয়েছিলাম। খোদা মঞ্জুর করেছে আমার আর্জি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমায় পেয়েও আমি পাইনি। আমার মধ্যে হাজারটা কমতি আছে কিন্তু তুমিতো বলেছিলে এই কমতিটাই তোমার স্বস্তি। তাহলে আজ কেনো পাল্টে গেলে রওশান? ”

রওশান ওয়াসীত্ব প্রত্যুত্তর করতে পারেননি। আদ্রিতা ইসলাম ও আর কথা বাড়াননি। এসবের মাঝে নতুন অতিথি হিসেবে নিযুক্ত হয় ফারজানা। ভীষণ অসহায় হয়ে ছুটে আসে আদ্রিতা ইসলামের দ্বারপ্রান্তে। তিনি ফিরিয়ে দেননি তাকে বরং সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। সময় যেতে থাকে। প্রায় বছর তিনেক চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর সুস্থ হয়ে উঠেন আদ্রিতা ইসলাম। বিশাল আয়োজন করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাসায় কিন্তু এই সুসংবাদ নাহারের কাছে বিষের মতো লাগে।

ততদিনে রওশান ওয়াসীত্বের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছিলেন নাহার ওয়াসীত্ব। আদ্রিতার সুস্থ হয়ে উঠার খবরটা হজম করতে কষ্ট হয়। তিনি পাগলামিতে মত্ত হোন। রওশান ওয়াসীত্বকে কিছুতেই বাসায় যেতে দিতে চান না। রওশান ওয়াসীত্ব অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় ফেরেন।

স্বাভাবিকভাবে বাসায় ফিরে স্ত্রী সন্তানের সাথে সময় কাটিয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন রওশান ওয়াসীত্ব। বন্ধ ফোনে আসা হাজারটা কল এসএমএস উনার নজরে আসেনি। পরবর্তী সকালে ঘুম ভেঙে উঠতেই দেখেন আদ্রিতা ইসলাম উনার ফোন হাতে ধরে মূর্তির মতো বসে আছেন। অজানা ভয়ে তিনি হকচকিয়ে উঠেন। আদ্রিতার হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ধমকে উঠেন রওশন ওয়াসীত্ব। আদ্রিতা ইসলাম কেবল শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

–” জৈবিক চাহিদা যৌবনের প্রেমকেও ছাপিয়ে যায়? ভালোবাসা তো মনের খোরাক এসবের মাঝে শরীর শব্দটা সংযুক্ত হলো কীভাবে? আমায় কেনো ঠকালে রওশান?”

রওশান ওয়াসীত্ব প্রত্যুত্তর করতে পারেননি। আদ্রিতা ইসলাম উঠে এসে উনার কলার ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করেন,

–” এই শরীরে আমি ব্যতীত আর কত নারীর স্পর্শ আছে রওশান? আর ক’জনকে ওই হৃদয়ের অভ্যন্তরে জায়গা দিয়েছো? ওই পতিতার কাছে শরীরের সাথে সাথে আমার নামের ভালোবাসাটুকুও বিলিয়েছো বুঝি?”

চোখের ধোঁকা মানুষকে কতটা নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে সেটার প্রমাণ রওশান ওয়াসীত্ব। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করার বদলে আদ্রিতা ওয়াসীত্বের উপর চড়াও হোন তিনি। একপর্যায়ে মারধোর শুরু হয় এবং রওশন ওয়াসীত্ব গুরুতর ভাবে আহত করে ফেলেন নিজের স্ত্রীকে। হুঁশে আসতেই ঘর ছেড়ে বেরোতে নিলে দেখেন দরজার কাছে রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিমা।

তিনি মেয়েকে বোঝাতে এগিয়ে গেলে প্রিমা জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। রওশান ওয়াসীত্ব মেয়েকে থামাতে পারেন নি। প্রিমা ছুটে যায় মায়ের কাছে। মেয়ের আহাজারিতে টিকতে না পেরে আদ্রিতা ইসলামকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন রওশান ওয়াসীত্ব এরপর নাহার ওয়াসীত্বের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বদরাগী প্রিমা ঠিক কী কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে।

অসুস্থ মা’কে হসপিটালে রেখে অতিমাত্রায় রেগে থাকা প্রিমা সোজা হাজির হয় নাহার ওয়াসীত্বের বাড়িতে। বাবামায়ের ঝগড়ার মাঝে খুব ভালোমত এই নামটা শুনেছিল প্রিমা। ক্ষণে ক্ষণে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠে তার৷ বাসার ভেতর প্রবেশ করতেই গার্ডস বলে নাহার নেই কেবল নীহারিকা বাসায় আছে। জবাব চাওয়ার প্রেক্ষিতে সে হুঁশ হারিয়ে ছুটে যায় উপরে। ছাদের দরজার কাছে আসতেই তার কানে বাজে কিছু কথা। নীহারিকা ক্রন্দনরত স্বরে কাউকে বলছে,

–” নিকোলাস আমি প্রেগন্যান্ট। আমার প্রেজেন্ট হাসবেন্ড জানে এটা তার বাচ্চা। তুমি প্লিজ ঝামেলা পাকাইয়ো না। পাপার বদলা নিতে আমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ওর সাথে সম্পর্কে জড়ালেও সত্যিকার অর্থে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। আমাকে রেহাই দাও তোমরা প্লিজ…

সবটা শুনে গা গুলিয়ে উঠে প্রিমার। কথায় আছে বৃক্ষ পরিচয় তার ফলে মিলে। এদের মা মেয়ের অবস্থাও হয়েছে সেম। প্রিমা খুব ভালোমতো জানতো তার চাচি কিংবা চাচাতো বোনের চরিত্র খুব একটা সুবিধার নয় বিধায় তাদের সাথে কোনোরূপ সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনবোধ করেনি সে। দুই ঈদে ক্ষণিকের জন্য সকলেই সমবেত হয় গ্রামের বাড়িতে।অতটুকুন পরিচয় কেবল ছিলো কিন্তু এই সামান্য পরিচয় তার বাবা মায়ের সম্পর্কে এতবড় বিচ্ছেদ ডেকে আনবে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি বেচারি।

রাগের মাথায় সে ধুপধাপ পা ফেলে নীহারিকার কাছে গিয়ে বলে,

–” লজ্জা করেনা তোমাদের? এত নোংরা মনমানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হয় সেটা তোমাদের না দেখলে জানতাম না। ”

অসময়ে প্রিমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে নীহারিকা বলে,

–” তু..তুই এখানে? ”

প্রিমা চড়া গলায় বলে,

–” এসে অসুবিধা করে ফেললাম? সব শুনে ফেলেছি আমি। এবার সত্যটা রিভিল করবো।”

নীহারিকা অসহায় কন্ঠে বলে,

–” প্লিজ এসব বলিস না। মানছি আমি খারাপ ছিলাম কিন্তু বিশ্বাস কর শানের ভালোবাসা আমায় পাল্টে দিয়েছে। ”

প্রিমা কন্ঠে একরাশ ঘৃণা মিশিয়ে বলল,

–” তোদের মতো চিরত্রহীনকে আর যাইহোক বিশ্বাস করা যায় না৷ আমার আব্বু আম্মুর সংসারটা কেনো নষ্ট করেছিস তোরা? ”

এভাবেই চলতে থাকে তাদের প্রশ্ন এবং উত্তরের লড়াই। একপর্যায়ে দোষ ঢাকতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে নীহারিকা। প্রিমাও আক্রোশে ফেটে পড়ে পাল্টা আক্রমণ করে বসে ফলস্বরূপ ছাদ থেকে সোজা নিচের সুইমিংপুলে গিয়ে পড়ে নীহারিকা। প্রিমা হতভম্ব হয়ে নিচে যাওয়ার জন্য ছুট লাগায় কিন্তু মেইন ডোরের কাছে আসতেই থমকে যায় তার পদযুগল।

দুইতলা বিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে প্রায় পনেরো মিনিট সময় লেগেছে প্রিমার কিন্তু এরমাঝে এতবড় দূর্ঘটনা ঘটে যাবে সেটা পরিকল্পনাও করেনি সে। গেটের কাছে আসতেই দেখে আশরাফ ওয়াসীত্ব এবং আরভিদ সহ তাদের পার্সোনাল দু’জন গার্ডস নীহারিকাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের সামনে দাঁড়ানো গার্ডসরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে।

উপর থেকে পুলে পড়ায় নীহারিকার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। সামান্য পানি খেয়েছে শ্রেফ কিন্তু অর্ধ অচেতন মেয়েটাকে হাত পা বেঁধে উপুড় করে শুইয়ে রাখার লজিকটা প্রিমার বোধগাম্য হলো না। সে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভয়াল এক দৃশ্য দেখে থমকে গেলো প্রিমা।

নীহারিকার মাথার কাছে বসে আশরাফ ওয়াসীত্ব বলছিলেন,

–” শান কে বরবাদ করতে পাঠিয়েছিলাম তোমায় কিন্তু তুমি দেখি নিজেই বরবাদ হয়ে গেছো। একদম মায়ের চরিত্র পেয়েছো। এজন্যই আমাদের বদনাম রটানোর আগে তোমায় দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়াটা বেস্ট অপশন মনে হলো আমার। ”

অতঃপর কোনো কথা না বলে নীহারিকার মাথায় সজোরে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিতে থাকলেন আশরাফ ওয়াসীত্ব। মেয়েটা যতক্ষণ না ছটফটিয়ে শান্ত হলো তার আগপর্যন্ত অনবরত মারতে থাকলেন।

মার্ডারকে এক্সিডেন্টাল ইস্যু সাজাতে বেশি বেগ পেতে হবে না উনার কারণ একটু আগেই নীহারিকা মাথা ঘুরিয়ে উপর থেকে পড়ে গিয়েছিল। সবাই ভাববে পড়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছে নীহারিকা ওয়াসীত্ব। বলা বাহুল্য আশরাফ চৌধুরী জানতেন না প্রিমার উপস্থিতি। ওদিকে প্রিমা এই দৃশ্য দেখে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সাবধানী পায়ে ছুটে যায় পেছনের এক্সিট এন্ট্রান্সের দিকে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নিয়তি তাকে ছাড় দেয়নি।

একজন দক্ষ হ্যাকার ভিডিও ডিলিট করার সময় ছাদের ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যটা আশরাফ ওয়াসীত্বকে দেখালে তিনি বাঁকা হেসে আরেকটা চমৎকার প্ল্যান সাজান। দেখাসাক্ষাৎ শেষে নাহার এবং রওশান ওয়াসীত্ব যখন বাড়ি ফিরেন তখন গেটের সামনে তিনটা লাশ দেখেন। মেয়ের মৃতদেহ দেখে নাহার ওয়াসীত্ব কান্নায় ভেঙে পড়েন। কী থেকে কী হয়ে গেলো কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তাদের কান্নাকাটি দেখে ভেতর থেকে দীপ্ত পায়ে বেরিয়ে আসে আশরাফ চৌধুরী। আফসোসের কন্ঠে বলেন,

–” আহারে। কাঁদছো কেনো তোমরা? কর্মফলের শাস্তি পাচ্ছো সেটা বুঝনা? ”

রওশান ওয়াসীত্ব মুখ তুলে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,

–” কী বলছো ভাইয়া..

আশরাফ চৌধুরী ভাবলেশহীন কন্ঠে বললেন,

–” তোমাদের পরকীয়া ধরা পড়ায় রাগের বশে প্রিমা এসে নীহারিকাকে মেরে ফেলেছে। বিশ্বাস না হলে প্রমাণ দেখো। ”

কথাটুকু বলেই হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন তাদের দিকে। নাহার এবং রওশান ওয়াসীত্ব ভিডিওটা দেখে থমকে গেলেন। আশরাফ ওয়াসীত্ব ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললেন,

–” বহুত নাটক দেখেছি। প্রচুর অপেক্ষা করেছি। আর পসিবল হচ্ছেনা এবার আসি কাজের কথায়। সবে মেয়ে হারিয়েছ কিন্তু এরপর সম্মান, সম্পদ সবকিছু হারাবে। আর যদি আমার কথা শোনো তবে বেঁচে যাবে। ”

নাহার যেনো হতবিহ্বল হয়ে গেছেন। রওশান ওয়াসীত্ব হতভম্ব কন্ঠে শুধান,

–” এসব কী বলছো ভাইয়া? ”

আশরাফ ওয়াসীত্ব সাসপেন্স না রেখে বললেন,

–” তোর কোম্পানির দিকে বহুদিন ধরে নজর ছিলো আমার তাই নাহারকে তোর পিছনে লাগিয়েছিলাম। এই জোচ্চর মহিলা তোকে পেয়ে আমাদের ডিল ভুলে গেছে তাই উপায়ন্তর না পেয়ে আমাকেই মাঠে নামতে হলো। তোদের সুখী মুহূর্তের খুব চমৎকার একটা ভিডিও আমার কাছে আছে। তোর কোম্পানি সহ যাবতীয় সম্পত্তি আমার নামে হস্তান্তর না করলে খুব সুন্দরমতো সেসব ভাইরাল করা হবে। ”

রওশান ওয়াসীত্ব বিহ্বল চোখে চাইলেন মেজো ভাইয়ের দিকে। মেয়ের লাশ বুকে চেপে রাখা নাহার ওয়াসীত্ব গর্জন করে বললেন,

–” গিরগিটির বাচ্চা। কী ভেবেছিস তুই? তোকে আমি চিনি না? তোর এই লোভী মনমানসিকতা আগে থেকে জানা ছিলো আমার। ভুলে যাস কেনো? একান্ত মুহূর্ত একসময় আমরাও কাটিয়েছি। সেসব এর সাথে আমাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনার সমস্ত ভিডিও আমার কাছে আছে। আমি বরবাদ হলে তুইও বাঁচবি না কথাটা মাথায় রাখিস। ”

নাহার ওয়াসীত্বের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন আশরাফ ওয়াসীত্ব। তার ড্রাগসের ব্যবসা বেশ ভালো চলছে।বেশি লাভ করতে গিয়ে অর্জিত সম্পদ তিনি হারাতে চাননা। ওদের দিকে শেষ বারের মতো একবার তাকিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে গার্ডের লাশ দুটো নিয়ে তিনি প্রস্থান করেন।

সকলের কথা শুনে রওশান ওয়াসীত্বের মাথা আউলিয়া যায়। তিনি কতবড় মোহে ডুবে ছিলেন সেটা পরিশেষে টের পান। নিজের করা অন্যায় গুলো অজান্তেই মস্তিষ্কে ভেসে উঠে কিন্তু ততক্ষণে বহু দেরি হয়ে গেছে। নাহার ওয়াসীত্ব মেয়ের লাশ বুকে চেপে ধরে রওশানের উদ্দেশ্যে বলেন,

–” তোমার মেয়ের জন্য আমার কোল খালি হয়েছে। ওকে আমি ছাড়বো না। নিজের হাতে খুন করবো ওকেএএএএ। ”

রওশান ওয়াসীত্ব চোখমুখ শক্ত করে কিছু একটা ভাবেন। নীহারিকার লাশটা ছিটকে ফেলে নাহারের বাহু টেনে ধরে কঠোর গলায় বলেন,

–” তোমার মেয়ের মৃত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট ভেবে ভুলে যাও বিনিময়ে আমার স্ত্রীর খেতাব পাবে তুমি। আমার অর্থ সম্পত্তি সব তোমার নামে করে দিবো আমি। আমার উপর এবং আমার সম্পত্তির উপর কেবল তোমার রাজত্ব থাকবে। যদি আমার শর্ত না মানো তবে পুরো দেশবাসীর কাছে আমি স্বীকারোক্তি দিবো যে আমাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলাই তোমার মেয়েকে আমি মেরে ফেলেছি। সবাই জেনে যাবে মাশরাফি ওয়াসীত্বের সতীসাবিত্রী স্ত্রীর নোংরা রুপ। ভেবে দেখো কী করবা। ”

নাহার চিন্তায় পড়ে যায়। সবে পলেটিক্সে প্রবেশ করেছে সে। এখনই এতবড় স্ক্যান্ডেল তার ক্যারিয়ার ডুবিয়ে ছাড়বে। নীহারিকার প্রতি তেমন একটা টান তার কোনোকালেই ছিলোনা। নিজের লাইফ নিয়েই আজীবন ব্যস্ত থেকেছে সে। সবটা ভেবেচিন্তে স্বার্থপর নাহার ওয়াসীত্ব মেনে নিলো সবটা।

এরপর সময়ের সাথে সবটা পরিবর্তন হয়ে যায়। রওশান ওয়াসীত্ব দেনমোহরের বিশ লক্ষ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে হসপিটালের কেবিনে দাঁড়িয়ে আদ্রিতা ইসলামকে ইসলামি শরীয়ত মতে ডিভোর্স দেন। এর প্রেক্ষিতে আদ্রিতা ইসলাম কিচ্ছু বলেননি। একজন চরিত্রহীন লোকোর সাথে সংসার করা তার পক্ষেও অসম্ভব ছিলো। বিধ্বস্ত প্রিমা কেবল অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে নিজের নির্মম পরিণতি। ফারজানা শত চেষ্টা করেও তাকে সামলাতে পারেনি। রওশান ওয়াসীত্বের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিল,

–” একটা খুনের গুনাহ যদি মাফ করা হতো তাহলে ভিক্টিম তুমি হতে আর লোকসমাজ বাবার হত্যাকারী আসামি হিসেবে আমাকে চিনতো। ”

প্রিমার কথা শুনে রওশান ওয়াসীত্বের পাশে দাঁড়ানো নাহার চিল্লিয়ে বলেছিল,

–” তুই একটা খুনি। এটা আবার নতুন ভাবে জানার কী আছে। ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলেছিস তুই। ”

নাহারের কথার প্রেক্ষিতে আদ্রিতা ইসলাম চিল্লিয়ে বলেন,

–” একদম অহেতুক অপবাদ দিবেন না। আমার মেয়ে কিচ্ছু করেনি। ”

নাহার ওয়াসীত্ব দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলে,

–” আমি নাহার স্পষ্ট ভাবে সত্য বলার ক্ষমতা রাখি। তোদের মতো অপরাধ লুকানো আমার স্বভাবে নেই।”

কথাটা বলেই একটা ফোন এগিয়ে দেন আদ্রিতা ইসলামের হাতে। ফোনের ভিডিওটা দেখে স্তব্ধ আদ্রিতা ইসলাম মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন,

–” এটা সত্যি? ”

প্রিমা ভয়ে জড়সড় হয়ে বলে,

–” না আম্মি। বিশ্বাস কর…

আর কিছু বলার পূর্বে সজোরে একটা থাপ্পড় পড়ে প্রিমার গালে। আদ্রিতা ইসলাম ক্ষুব্ধ স্বরে চেঁচিয়ে বলেন,

–” বাপের মতো মিথ্যে বলা শিখেছো? আমিও কাকে কী প্রশ্ন করছি। যে বংশের রক্ত বয়ে যাচ্ছে তোমার শিরায় তাদের মতো স্বভাব আচরণ হবে না তা কী করে হয়। ”

প্রিমা অবাক চোখে তাকিয়েছিলো মায়ের দিকে। আদ্রিতা ইসলাম তোয়াক্কা করেননি। তিনি নিজের রাগ মেটাতে যা তা বলতে থাকেন মেয়েকে। প্রিমা কেবল ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে রওশান ওয়াসীত্ব কে। তিনি দ্বিরুক্তি করেননি।নিরবে সয়ে নিয়েছিলেন মেয়ের ঘৃণাটুকু। একটু সুস্থ হতেই আদ্রিতা ইসলাম মেয়েদের নিয়ে পাড়ি জমান অন্য একটি শহরে। সময় পেরোতে থাকে কিন্তু তাদের মা মেয়ের সমীকরণ পরিবর্তন হয়নি।

আদ্রিতা ইসলাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন উনার মেয়ে কেবল উনার জন্য খুন করে এসেছে। নিজের প্রিয় মানুষটার থেকে ধোঁকা পাওয়া আদ্রিতা ইসলাম ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। মানসিক ট্রমার মধ্যে যাচ্ছিলেন বিধায় নানান সময় প্রিমার সাথে নানান ধরনের উদ্ভট আচরণ করতেন। ছোট্ট প্রিমার মনটা এতে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। একসময় নিজেকে ডিফেন্ড করলেও একটা পর্যায়ে সে ভীষণ রকমের শান্ত হয়ে পড়ে। হাজারটা অভিযোগ করেও তার মুখ থেকে টু শব্দ বের করা যেতোনা।

বহমান সময় তার নিজ গতিতে এগিয়ে যায়। প্রিমা যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন আচমকা তার ফোনে প্রাইভেট নম্বর থেকে একটা ভিডিও এবং হুমকি আসে। সেই এক অভিশপ্ত ভিডিও প্রিমার পিছু ছাড়েনি দেখে ভীষণ ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়ে প্রিমা। শেয়ার করার মতো সাহস ছিলোনা বলে একা একা গুমরে মরতে থাকে। ওপর পাশ থেকে মসেজে বলা হয়েছিল,

–” স্কুলের পেছনে কনস্ট্রাকশন সাইটের নির্জন ভবনে একান্তে দেখা না করলে এই ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়া হবে। ”

প্রিমা ভীষণ ভেঙে পড়ে। তার অবস্থা অবলোকন করে ফারজানা এগিয়ে আসে তাকে জোর কন্ঠে শুধায় সমস্যার ব্যপারে। প্রিমা বাধ্য হয়ে সবটা খুলে বলে ফারজানাকে। সবটা শুনে ফারজানা নিজেও ভীত হয়ে পড়ে। এসবের একটা কথাও যদি আদ্রিতা ইসলামের কানে যায় তবে রক্ষে থাকবেনা। সারারাত ভেবে ভেবে এক চমৎকার পরিকল্পনা সাজায় সে। নিজের খুব বিশ্বস্ত ক’জন মানুষ কে জানিয়ে অতঃপর সকালবেলা প্রিমাকে নিজের সমস্ত প্ল্যান বুঝিয়ে বলে।

দুরুদুরু বুকে সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছায় প্রিমা। তাকে আসতে দেখে আরভিদ সহ তার তিন বন্ধু এগিয়ে আসে। প্রিমা কাঁপা কন্ঠে বলে,

–” কেনো এসব করছিস তুই? আমি যে খুনটা করিনি তা তো তুই জানিস। তাহলে কেনো ফাঁসাচ্ছিস আমাকে? ”

নেশাগ্রস্ত আরভিদ এগিয়ে এসে বলে,

–” তোর এই মাখনের মতো শরীরটার ভাগ আমার চায়। যেকোনো মূল্যে তোকে একবার কিংবা এক রাতের জন্য হলেও পেতে চাই আমি। এজন্যই এত আয়োজন। আমার রাণী হয়ে যা একদম আদরে, সোহাগে এবং আভিজাত্যে পরিপূর্ণ করে দিবো তোর জীবন। ”

প্রিমা সরে আসে। কথার তোপে আরভিদের আসল উদ্দেশ্য বের করে যেটা বিল্ডিংয়ের পিলারের পেছনে লুকিয়ে থাকা ফারজানা খুব সতর্কতার সাথে ভিডিও করে এরপর আটজনের একটা দল বেরিয়ে এসে আরভিদ সহ ওর বাকি সাঙ্গপাঙ্গদের বেশ ভালো খাতিরযত্ন করে। মার খেয়ে ওরা জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থায় আসলে ফারজানা তার ফ্রেন্ড’দের সরপ আসতে বলে এবং আরভিদের দিকে ঝুঁকে ওর বুকের উপর পা রেখে বজ্রকন্ঠে বলে,

–” আমি ফারজানা যতদিন জীবিত আছি ততদিন আমার বোনের দিকে কোনো জানোয়ারের দৃষ্টি পড়তে দিবো না। যে অশুভ হাত তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করবে তার সমগ্র দেহাবয়ব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে দ্বিতীয়বার ভাববো না আমি।বাসায় গিয়ে নিজের প্রাইভেট নম্বরটা চেক করিস। তোর সন্দেশ খাওয়ার ভিডিওটা বিস্তারিত বর্ণনাসহ খুব সুন্দর মতো শুট করে পাঠিয়েছি। ”

কথাগুলো শেষ করে প্রিমাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ফারজানা। ভেবেছিল তাদের কষ্টের দিন এখানেই শেষ। আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাদের জীবনে ঝড় তুলতে পারবেনা কিন্তু সুখ কী আর দুঃখিনীর কপালে ধরা দেয়? বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখে অসংখ্য মানুষ জড় হয়ে আছে তাদের বিল্ডিংয়ের নিচে। কম্পমান বুকে ভিড় ঠেলে নিজেদের ঘরে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে ড্রয়িংরুমের ফ্যানের সাথে লটকে আছে আদ্রিতা ইসলামের মরদেহ। প্রিমা ভীষণ বড় ধাক্কা খায় দৃশ্যটা দেখে। ফারজানা সাথেসাথে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

বাঙালি মানুষ তামাশা দেখতে ওস্তাদ। কতক্ষণ যাবত তারা দেখছে অথচ লাশটা নিচে নামানোর প্রয়োজনবোধ করেনি কেউ। ফারজানা ছুটে যেতে নিলে কিছু মহিলা তাদের আঁটকে বলে,

–” পুলিশ না আসলে লা শে হাত দেওয়া যাইবো না।”

ফারজানা আর এগোতে পারে না। থম মেরে একদৃষ্টিতে লাশের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রিমাকে ঝাঁকিয়ে বলে,

–” পাথরের মতো বসে আছিস কেনো? কাঁদছিস কেনো? কী হলো তোর? দোহাই লাগে আল্লাহর আমাকে এতিম করে তুইও চলে যাস না। ”

প্রিমার বোধহয় এবার টনক নড়ে। সে অস্ফুটস্বরে বলে,

–” আম্মির চোখে আমি দোষী রয়ে গেলাম বুবু। সে জানলো না তার মেয়ে খুনি নয়। সে ভুয়া প্রমাণ দেখে আমাকে অবিশ্বাস করে গেলো কিন্তু সঠিক তথ্য জেনে আমায় বুকে টেনে নিলো না। মায়েরা এতটাও নিষ্ঠুর হয় বুবু? ”

প্রত্যুত্তর দিতে পারেনি ফারজানা। ঘন্টাখানেক পর পুলিশ আসে। লাশ নামানো হয়। ঘর তল্লাশি করতেই বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। আদ্রিতা ইসলাম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও মেডিসিন এবং থেরাপি না নেওয়ায় পুনরায় ক্যান্সার তার শরীরে বাসা বাঁধে। ট্রিটমেন্টের টাকা এবং যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে মুক্তি পেতে চরম পর্যায়ের ডিপ্রেশনে ভোগা আদ্রিতা ইসলাম আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। শেষ চিরকুটে লিখে গিয়েছেন,

–” এক বিষাক্ত ধোঁকা আমার সমস্ত অনুভূতি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। কত চেষ্টা করেছি কিন্তু রুক্ষ আচরণের বদলে একটুখানি স্নেহ মাখিয়ে কথা বলতে পারিনি। শত প্রচেষ্টার পরও তোমাদের অল্প একটু ভালোবাসা দিতে পারিনি। বড্ড কষ্ট দিয়েছি তাইনা? ভুলে যেওনা ওসব। রোজ আমায় অভিশাপ দিও। বুকে একরাশ আক্ষেপ জমিয়ে রেখো। আমার নামটা স্মরণে আসতেই যেনো মস্তিষ্কে হাজারটা অভিযোগ জমে এতটা অভিমান পুষে রেখো। আমার শেষোক্ত কর্ম মনে পড়লেই যেনো বিরক্তিতে মনটা তেঁতো হয়ে উঠে এতটা ঘৃণা কইরো তবুও আমায় ভালোবেসো না কেমন? খারাপ মানুষ হিসেবে বদদোয়া দিলাম দুঃখের অন্তিমে অজস্র সুখের পায়রা তোমাদের ঘরে ঘাঁটি গেড়ে বসুক। হাজার অবহেলা কিংবা অবজ্ঞাতেও কেবল তোমাদের কাছেই নিজের সুখ খুঁজুক। ~ নিষ্ঠুরতম মানবী

চিরকুটটা পড়ে আরও থমথমে হয়ে উঠে প্রিমার মুখাবয়ব। আদ্রিতা ইসলামের লাশ নামিয়ে শেষ গোসল দেওয়া হয় কিন্তু শেষকৃত্যের জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। আত্মহত্যার লাশের জানাজা পড়াতে সরাসরি নাকচ করে দেন মসজিদের ইমাম সাহেব। প্রায় দশ ঘন্টা লাশ নিয়ে বসে থাকার পর পরিশেষে এতিমখানায় খবর দেওয়া হলে সেখান থেকে ক’জন পুরুষ এসে নিজ দায়িত্বে দাফনের কাজ শেষ করে। প্রিমা অনুভূতিহীনের মতো দেখতে থাকে পুরোটা দৃশ্য। সময় পেরোনোর সাথে সাথে তার হুঁশ ফিরে। মাটির আস্তরণের নিচে তার মমতাময়ীর শেষ অস্তিত্ব রয়েছে কথাটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে প্রিমা।

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কখনো জীবন থেমে থাকেনা। সেই ঘটনার পরদিনই সেই বাসাটা ছেড়ে অন্যত্র বাসা নেয় ফারজানা। নতুন বাড়িতে নতুন আঙ্গিকে শুরু হয় তাদের স্ট্রাগল। সময় পেরোনোর সাথে সাথে নিজের নিয়তি আবার কখনো পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে টিকিয়ে রাখে নিজের অস্তিত্ব।

_

ডকুমেন্টের সাথে এটাচড্ যাবতীয় প্রমাণ গুলো দেখতেই বুকটা কেঁপে উঠল আরশিয়ানের। দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করল। ইশতিরাজ তার অবস্থা দেখে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

–” কী হয়েছে? ”

আরশিয়ান আর্তনাদ করে বলল,

–” নারীরা এত নিখুঁত ছলনাময়ী কেনো? আমার গোটা একটা জীবন তাকে ভালোবেসে উৎসর্গ করেছি অথচ আজ তার মৃত্যুর এতগুলো বছর পর জানতে পারছি তার সন্তানের পিতা আমি নই বরং অন্য পুরুষ ছিলো। ”

ইশতিরাজের কাছে স্বান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা নেই। সে কেবল ধীর কন্ঠে বলল,

–” নিজেকে সামলানোর চেষ্টা কর। অতীত বদলানোর সক্ষমতা আমাদের নেই শান। বর্তমান নিয়ে ভাব। পিচ্চির অবস্থা দেখেছিস? মেয়েটার শেষ ভরসা তুই। এভাবে ভেঙে পড়িস না। আগে বাসায় গিয়ে এই সুসংবাদটা সবাইকে দে। জীবনের কলুষিত অধ্যায় যত উন্মুক্ত করবি তত দুর্গন্ধ ছড়াবে। প্লিজ ভাই আর সময় নষ্ট করিস না। ”

আরশিয়ান শুনলো। কীয়ৎকাল নিশ্চুপ থেকে নিজেকে বোঝাল অনেক কিছু অতঃপর কোনো কথা ছাড়াই গাড়ি টান দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। চৌধুরী বাড়ির মূল ফটকে পৌঁছে গাড়ি পার্ক না করেই ভিতরে প্রবেশ করল। পিছনে ইশতিরাজ ও এসেছে।

আরশিয়ান ভেতরে ঢুকে দেখল ডাইনিং টেবিলে বিকেলের হালকা নাস্তার আসর জমেছে। এই মুহূর্তটাই ঠিক মনে হলো আরশিয়ানের। সরাসরি আরিয়ান চৌধুরীর সামনে বসে বলল,

–” আব্বু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার। ”

আরিয়ান চৌধুরী থমথমে কন্ঠে বললেন,

–” আপাতত শোনার ইচ্ছে নেই আমার। যা বলার রাতে..

আরিয়ান চৌধুরীকে মাঝপথে থামিয়ে আরশিয়ান চিন্তিত কন্ঠে শুধাল,

–” কী হয়েছে আব্বু? ”

আরিয়ান চৌধুরী না চাইতেও বিবশ কন্ঠে বললেন,

–” প্রিমা ভীষণ অসুস্থ। ”

আরশিয়ান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধাল,

–” কী হয়েছে উনার? অসুস্থ হলে বাসায় নিয়ে বসে আছো কেনো? হসপিটালে…

আরশিয়ান কথা শেষ করার পূর্বেই আফিয়া চৌধুরীর গগনবিদারী চিৎকারে থমকে যায় উপস্থিত প্রত্যেকে। সকলের কানে বাজে এক মমতাময়ীর নির্মম আহাজারি,

–” আল্লাহ গো.. কী হয়ে গেলো আমার বাচ্চার। চোখ খুলো মা। কত রক্ত আল্লাহ্…..

চলবে?