#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২২
হাসপাতালের করিডোর জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। আইসিইউর বাহিরে বসে আছে আরশিয়ান এবং চৌধুরী বাড়ির বাকি সদস্যরা। আরশিয়ানের মুখে লেপ্টে রয়েছে একরাশ আতংক এবং উৎকন্ঠা। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ধৈর্য ধারণের বৃথা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অনবরত । চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিছুক্ষণ আগের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্ত।
আফিয়া চৌধুরীর চিৎকার শুনে প্রিমার ঘরের সামনে যাওয়ার পর ভেতরকার দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায় আরশিয়ান। আফিয়া চৌধুরী কোলের মধ্যে প্রিমার নিস্তেজ শরীরটা আঁকড়ে ধরে আহাজারি করছিলেন। উনার বাম হাতটা মেখে ছিলো রক্তিম তরলে। আরশিয়ান হতভম্ব হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে প্রিমার পালকের ন্যায় শরীরটা নিজের আওতায় নিয়ে কাঁপা কন্ঠে শুধায়,
–” উনার কী হয়েছে আম্মু? এত রক্ত কোত্থেকে আসলো? ”
আফিয়া চৌধুরী হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,
–” ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ও ফ্লোরে পড়ে আছে। মাথায় শক্ত একটা কাঁকড়া দেওয়া ছিলো। জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ায় মাথায় জখম হয়েছে । রক্তপাতের উৎস সেটাই কিন্তু ওর শরীরটা একদম ঠান্ডা হয়ে আসছে আব্বু…
কান্নার তোড়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না আফিয়া চৌধুরী। ততক্ষণে বাকিরাও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। আরিয়ান চৌধুরী প্রিমার পায়ের কাছে বসে বলেন,
–” আম্মা? ও আম্মা? ভয় দেখাচ্ছেন আমাদের? আপনার বাবাই ভীষণ ভয় পেয়েছে আম্মা। এবার চোখ খুলুন তো। ”
প্রিমার অবস্থা দেখে সকলেই হকচকিয়ে উঠেছে তন্মধ্যে ইশতিরাজ ভীড় ঠেলে সামান্য সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–” কী হয়েছে দেখি। ”
আরশিয়ান হতবিহ্বল। প্রিমার মাথা থেকে নিঃসৃত রক্তিম তরল তার হোয়াইট কালার শার্টের বাহুতে নিখুঁত ভাবে নিজের ছাপ ফেলে যাচ্ছে অথচ সেদিকে আরশিয়ানের খেয়াল নেই। সে কেবল নিরবে দেখে যাচ্ছে প্রিমার চেতনাশূন্য মুখশ্রী। যেনো আজন্মের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
প্রিমার প্রাথমিক চেকআপ করে ইশতিরাজ ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বলল,
–” দেরি করিস না ভাই। দ্রুত হসপিটালে না নিলে আমরা উনাকে বাঁচাতে পারবোনা। জলদিই বেরিয়ে পড়। আমি ইমার্জেন্সি টিমকে রেডি থাকতে বলছি।”
ইশতিরাজের কথায় আরশিয়ানের হুঁশ ফিরে। প্রিমাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সে বেরিয়ে যায়। তার পেছনে ছুটে যায় ক্রন্দনরত আফিয়া চৌধুরী এবং বাকিরা। ইশতিরাজ ছুটে চলে নিজ গন্তব্যের দিকে।
_
আইসিইউর দরজা ঠেলে ডক্টরকে বেরোতে দেখে সকলে নিজ অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়াল। ডক্টর সবার উৎকন্ঠা দেখে বললেন,
–” পেশেন্টের কন্ডিশন আপাতত স্ট্যাবল কিন্তু উনাকে পরবর্তী বাহাত্তর ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হবে।”
আরিয়ান চৌধুরী আতঙ্কিত স্বরে শুধালেন,
–” কী হয়েছে আমার মেয়ের? ”
ডক্টর স্মিত হেসে বললেন,
–” আপনার মেয়ে আর ছোট্টোটি নেই আংকেল। আপনাদের জন্য বিরাট খুশির সংবাদ নিয়ে এসেছি। মিসেস প্রিমা প্রেগন্যান্ট এবং আরও বেশি খুশির সংবাদ হলো শী ইজ গোয়িং টু বি আ মাদার অব থ্রী চাইল্ড। ইট’স আ ট্রিপলেট প্রেগন্যান্সি৷ ”
ডক্টরের কথাটা বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানলো। উপস্থিত সকলে হতভম্ব চোখে একবার ডক্টর এবং আরেকবার আরশিয়ানের দিকে তাকাল। আরশিয়ান নিজেও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে। ডক্টর সবার রিয়াকশন দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
–” পেশেন্টের হাসবেন্ডকে কাইন্ডলি আমার কেবিনে পাঠিয়ে দিন। পেশেন্ট সংক্রান্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার আছে। ”
কথাটা বলেই ডক্টর প্রস্থান করেন। আরশিয়ান হতভম্ব মুখে ডক্টরের কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। সত্যটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়ে অতঃপর বাসর এখন আবার প্রেগন্যান্সি। তার জীবনে স্বাভাবিকভাবে কিছু আদৌ ঘটবে? নিজেকে গালি দিয়ে আরশিয়ান বিড়বিড়িয়ে বলল,
–” স্বাভাবিক ভাবে হওয়ার মতো আর কিছু বাকি আছে? জীবনের তিনটা গুরুত্বপূর্ণ কাজই কমপ্লিট।”
ডক্টরের কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে আরশিয়ান বুক ভরে শ্বাস টানে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। এরকম আগে কখনো হয়নি। একদিকে চিন্তা কাজ করছে অন্যদিকে অনাবিল আনন্দে বক্ষপট আন্দোলিত হচ্ছে। নিজেকে সামলে সে ডক্টরের কেবিনে প্রবেশ করল। ডক্টর একপলক তার দিকে তাকিয়ে বসতে বলে গম্ভীর মুখে বললেন,
–” আপনি মিসেসর প্রিমার হাসবেন্ড? ”
আরশিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” জ্বী। ”
ডক্টর রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” ইশতিরাজ স্যার আমাকে আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন আমি যেনো ইন্সট্যান্ট কোনো ব্যাড নিউজ আপনার ফ্যামিলিকে না দিই। সেই কথা রাখতে গিয়ে বাহিরে কেবল পজিটিভ কথাগুলোই আমি শেয়ার করেছি তবে আসল রিপোর্টটা এখন আপনকে জানাতে যাচ্ছি।”
আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
–” জ্বী বলুন। ”
ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” আপনার ওয়াইফের প্রেগ্ন্যাসিটা নরমাল নয়। মেডিকেলর ভাষায় বলতে গেলে এটা একটা হাই রিস্কি প্রেগন্যান্সি। উনি একসাথে ট্রিপলেট বহন করছেন কিন্তু তাদের কারোরই অবস্থা ভালো না। ”
সামান্য থেমে ডক্টর আবারও বললেন,
–” আপনার ওয়াইফ মেন্টালি এবং ফিজিক্যালি ভীষণ উইক যার ফলস্বরূপ বাচ্চাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দু’জন মোটামুটি রেসপন্স করলেও আরেকটা ফিটাস একদম দুর্বল। আর কিছু সময় এভাবে পেরোলে হয়তো মিসক্যারেজে ওদের চারজনকে হারাতে হতো আপনাদের। ”
আরশিয়ান আঁতকে উঠে। সে হড়বড়িয়ে বলে,
–” হোয়াট? ”
আরশিয়ানের হতভম্ব অবস্থা দেখে ডক্টর বললেন,
–” শান্ত হোন। আমি কেবল ফ্যাক্ট গুলো বলেছি।”
আরশিয়ান নিজেকে সামলে শীতল কন্ঠে বলল,
–” ফুল প্রেগন্যান্সি জার্নিতে কোন বিষয়গুলো ফলো করলে উনার কন্ডিশন বেটার হবে? ”
ডক্টর ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
–” উনার সকল টেস্টের রিপোর্ট এখনো আমাদের হাতে আসেনি তবে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি উনার আরও কিছু শারিরীক জটিলতা রয়েছে। তাছাড়াও ভয়াবহ ডিপ্রেশনের রোগী তিনি। আপাতত উনাকে মেন্টাল স্ট্রেস থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে বাকিটা রিপোর্ট আসার পর আমি জানিয়ে দিবো। ”
আরশিয়ান আরও কিছুক্ষণ কথা বলে শেষে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–” আমি কী উনার সাথে একবার দেখা করতে পারি? ”
ডক্টর হতাশ কন্ঠে বললেন,
–” দুঃখিত এটা পসিবল নয়।”
আরশিয়ান কথা বাড়ালো না কেবল মলিন মুখে বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে। লম্বা করিডর পেরিয়ে আইসিইউ রুমের সামনে যেতেই দেখতে পায় ফারজানা আফিয়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইশতিরাজ ক্লান্ত চোখে পরখ করছে তার প্রিয়তমার ক্রন্দনরত মুখশ্রী।
আরশিয়ান সামান্য এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে ইশতিরাজের পাশে। আরশিয়ানকে লক্ষ্য করে আরিয়ান চৌধুরী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,
–” কী বললো ডক্টর? ”
আরশিয়ান বিরস কন্ঠে বলল,
–” বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে উনার। রিপোর্ট আসলে সবটা সুস্পষ্ট ভাবে জানা যাবে। ”
আরশিয়ানের কথা শুনে ফারজানা কান্না থামিয়ে এদিকে তাকিয়েছে। ইশতিরাজ মনে মনে আরশিয়ান কে শ’খানেক গালি দিয়ে অসহায় চোখে ফারজানার ফোলা মুখশ্রীর দিকে তাকাল। ফরজানা সেসব তোয়াক্কা না করে ঝাঁঝাল স্বরে বলল,
–” ওর জানটা ভিক্ষা দেন এবার। প্রিমার কথা অমান্য করে স্টেটমেন্ট এবং যাবতীয় প্রমাণ তো আমি দিয়েই দিয়েছি। আর কী চাই আপনাদের? ”
আরশিয়ান চোখ তুলে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
–” মিসেস প্রিমাকে হ্যান্ডওভার করার বিনিময়ে আপনার থেকে প্রমাণ চাওয়া হয়েছে? ”
দীর্ঘদিন খোঁজ করার পরও কোনো কাঙ্ক্ষিত তথ্য না পেয়ে পরিশেষে সকলে ফারজানার স্টেটমেন্ট নেওয়ার সিধান্ত নেয়। প্ল্যান অনুযায়ী সেদিন রাতে ম্যানিপুলেটিভ ইশতিরাজ খুব সহজে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছ থেকে তথ্য হাতিয়ে নেয়। ফারজানা কটমটে দৃষ্টিতে ইশতিরাজের দিকে তাকিয়ে আরশিয়ানকে বলে,
–” আজ থেকে প্রায় দুই মাস আগে আপনিই তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। প্রিমা জোরপূর্বক থেকে গিয়েছিল নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার তাগিদে। আজ যখন সবটা পরিষ্কার তাহলে আমার বোন ওখানে থাকবে কেনো? ”
আরশিয়ান খানিকটা ব্যথিত হলেও গম্ভীর স্বরে বলল,
–” ভুল বোঝাবোঝি সব সম্পর্কেই হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। আমি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত কিন্তু অতিমাত্রায় ভালোমানুষি দেখিয়ে উনাকে মুক্তি দিতে না পারার জন্য আমি দুঃখিত। ”
আরশিয়ানের স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড কথায় ফারজানার মেজাজ খারাপ হলো। খানিকটা মেজাজ দেখিয়ে সে বলে উঠল,
–” প্রিমাকে আপনার অনুভূতিহীন পুতুল মনে হয়? যখন মন চায় ছুঁড়ে ফেলবেন আবার যখন মন চায় বুকে টেনে নিবেন। ফাজলামি করছেন? ”
আরশিয়ান ধৈর্য রেখে কঠোর গলায় বলল,
–” অনুভূতিহীন পুতুল মনে হতে যাবে কেনো? উনি তো আমার অনাগত পুতুলদের আম্মা। বৈবাহিক সম্পর্কে রাগ অভিমান স্বাভাবিক ব্যপার। উনার অনুভূতি প্রকাশের অধিকার আমি ছিনিয়ে নেয়নি। ফাজলামি করছি না কেবল নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছি। ”
ফারজানা যেনো রাগে মেজাজ হারিয়ে ফেললো। সে চিল্লিয়ে উঠে বলল,
–” এত নির্বিকার আচরণ? আমার বোনটা আপনার ভুলের জন্য আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে অথচ আপনার ভাবভঙ্গি দেখে আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি। আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি প্রিমাকে আবার ওই নরকে পাঠাবো তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। ”
আরশিয়ান ত্যাড়া কন্ঠে বলে উঠল,
–” আপনি যদি ভেবে থাকেন মহানুভবতা দেখিয়ে আমার বউকে আমি যেতে দিবো তাহলে আপনিও ভুল ভাবছেন। ভুল যেহেতু করেছি সেহেতু উনার দেওয়া শাস্তি ও গ্রহণ করবো কিন্তু এসব বিচ্ছেদের প্রসঙ্গ কোনোভাবেই একসেপ্টেবল না। ”
তাদের চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে একজন ডক্টর এসে বললেন,
–” এটা হসপিটাল। কাইন্ডলি আপনারা নিরবতা বজায় রাখুন। ”
এতক্ষণ কপালে হাত ঠেকিয়ে তাদের ঝগড়া শুনছিল ইশতিরাজ। ডক্টরের ওয়ার্নিং শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে থাকা ফারজানাকে টেনে নিজের ব্যক্তিগত কেবিনে নিয়ে গেলো ইশতিরাজ। ফারজানা বাঁধা দিলেও ইশতিরাজ সেটা গ্রাহ্য করেনি।
মূলত এই হসপিটালটা ইশতিরাজের মরহুম পিতার তৈরী করা। উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তমান মালিকানায় রয়েছে ইশতিরাজ। ফারজানাকে কেবিনে এনে সেটা লক করে দিয়ে ইশতিরাজ তাকে টেনে বেডে বসায়। তার পাশাপাশি খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে ধীর কন্ঠে বলে,
–” রাগে হুঁশ হারিয়ে কী যা-তা বলছেন সে খেয়াল আছে? ”
ইশতিরাজের ঘোলাটে দৃষ্টি অবলোকন করে ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–” সঠিক কথা বললে গায়ে ফোস্কা পড়ে তাইনা? বন্ধুর পক্ষ নিচ্ছেন? সত্য হজম করতে কষ্ট হচ্ছে? ”
ইশতিরাজ চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে দুর্বল কন্ঠে বলল,
–” বন্ধুর পক্ষে থাকলে আপনাকে মিসেস লাড্ডুর অসুস্থতার কথা জানাতাম? ”
ফারজানা চুপ হয়ে যায়। ঘন্টা কয়েক আগে ইশতিরাজ তার বাসার নিচে গিয়ে আকস্মিক তাকে ফোন করে। ফারজানা প্রথমে না ধরলেও ননস্টপ কল দেখে ধরতে বাধ্য হয়। ইশতিরাজ তাকে নিচে যেতে বললো ফারজানা ঘাড়ত্যাড়ামি শুরু করে। বাধ্য হয়ে ইশতিরাজ জানায় প্রিমার অবস্থা। হতবিহ্বল ফারজানা যবুথবু হয়ে ছুটে আসে নিচে। ইশতিরাজ পুরোটা রাস্তা তাকে নানান কথায় ভুলিয়ে রেখেছিল যেনো তার প্যানিক আট্যাক না হয়। সত্যি বলতে ইশতিরাজের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। ফারজানা খানিকটা শান্ত হয়ে বলল,
–” ধন্যবাদ আপনাকে কিন্তু মিস্টার আরশিয়ানের কথা আমি মানবো না। আপনি যদি উনার পক্ষ টেনে কথা বলেন তাহলে সমস্ত কৃতজ্ঞতা ভুলে যেতে বাধ্য হবো আমি। ”
ইশতিরাজ চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলে,
–” ঠিকাছে। ওসব নিয়ে পরে কথা হবে এখন কৃতজ্ঞতার বদলে একটা উপকার করুন। ”
ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বলে,
–” কী উপকার? ”
ইশতিরাজ রক্তিম চোখজোড়া ফারজানার সন্দিহান দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে বলে,
–” বিছানায় পা তুলে কম্ফোর্টেবলি বসুন আগে। “.
ফারজানা বোকার মতো তার কথা অনুসরণ করে পা ভাঁজ করে বসলো। ইশতিরাজ তড়িৎ গতিতে তার কোলে একটা বালিশ রেখে সেখানে মাথা এলিয়ে দিয়ে ধপ করে বেডে শুয়ে পড়ল। ফারজানা হকচকিয়ে উঠে তাকে সরিয়ে দিতে গেলে ইশতিরাজ কন্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলল,
–” মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে আমার। একটু চুলগুলো টেনে দিবেন? বেশি না.. ঘন্টা দুয়েক ঘুমাবো জাস্ট। ”
ফারজানা সরে আসতে গিয়েও থমকে গেলো। ইশতিরাজ তার জন্য যা-কিছু করেছে তার কাছে এটা অতি নগন্য একটা কাজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইশতিরাজের মাথায় হাত রাখলো। কপালের দিকটায় হাত রাখতেই সে চমকে উঠল। অবাক গলায় বলল,
–” আপনার তো জ্বর এসেছে । ”
ইশতিরাজ ঘুম ঘুম কন্ঠে হতাশা মিশিয়ে বলল,
–” মেডিসিন নিয়েছি সেরে যাবে তবে বিয়ের পর কিন্তু মেডিসিন নিতে পারবো না। আমার যাবতীয় অসুখ বিসুখ সামলে নেওয়ার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। ”
ইশতিরাজের কথার মিনিংটা বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ফারজানা। ইশতিরাজ তার মৃদু কম্পন অনুভব করে বাঁকা হেসে মৃদুস্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল,
–” শুধু একটাবার এই সম্পর্কে বৈধতার নেম ট্যাগ জুড়ে যাক অতঃপর আমার জ্বরতপ্ত শরীরের উষ্ণতা আপনাকে প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দিবে যন্ত্রণা নিরাময়ের জন্য আমার আপনাকে কতটা দরকার। ”
ফারজানা শুনলনা সেই ভয়ংকর উক্তি কেবল দায়বদ্ধতা থেকে ইশতিরাজের শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
_
সন্ধ্যালোকের আগমন ঘটেছে ধরণীতে। হসপিটালের করিডর সম্পূর্ণ ফাঁকা। বলা বাহুল্য একপ্রকার জোর করে আরশিয়ান সবাইকে পাঠিয়েছে। সকলে বাধ্য হয়ে হসপিটাল ত্যাগ করে আপাতত বাসায় অবস্থান করছেন।
আইসিইউ থেকে প্রিমাকে ভিআইপি কেবিনে শিফট করা হয়েছে। প্রিমা তখনও জ্ঞানহীন। স্বচ্ছ কাঁচের দরজার বাহিরে থেকে প্রিমার শুকনো মুখশ্রী দেখে আরশিয়ানের বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হয়। অশ্রু সজল চোখজোড়া তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে প্রিমার রুগ্ন অবয়ব। তীব্র অপরাধবোধে জর্জরিত আরশিয়ান অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
–” মাফ করতে হবে না আমায় কিন্তু আক্ষেপের বশে অভিমান নিয়ে এই একলা মানুষটাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। আমার আপনাদেরকে ভীষণ দরকার। ”
অনুমতি থাকা সত্ত্বেও ভেতরে যাওয়ার সাহস পায়নি আরশিয়ান। কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের
অপরাধের স্বীকারোক্তি দিচ্ছিল। এরমাঝে আচমকা তার ফোনটা বেজে উঠে। কলটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে তাজরিয়ান বলে উঠে,
–” সুদূর ডুবাই থেকে তোমার প্রিয় ফুটবল নিয়ে এসেছি ভাইয়া। জলদিই প্লে গ্রাউন্ডে আসো। ”
তাজরিয়ানের কথা আরশিয়ানের ঠোঁটে কোণে একটা হিংস্র হাসি ফুটে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
–” আমি আসা অব্দি ঠিকঠাক মতো পাহাড়া দে। এবার যেনো বাংলাদেশ থেকে গড়িয়ে ডুবাই যেতে সক্ষম না হয় সেদিকটায় লক্ষ্য রাখিস। ”
অপর পাশ থেকে তাজরিয়ান সম্মতি জ্ঞাপন করে কল রেখে দিলো। আরশিয়ান দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যের দিকে। প্রায় এক ঘন্টা ড্রাইভ করে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে নির্দিষ্ট একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো আরশিয়ান। ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো আরভিদকে অর্ধ উলঙ্গ করে আংটার সাহায্য দেয়ালের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
বেচারার শরীরে রয়েছে অসংখ্য মারের দাগ। বেশ ভালোই খাতিরযত্ন করা হয়েছে তার। আরভিদ নিভু নিভু চোখে দেখছে আরশিয়ানকে। সেটা দেখে বাঁকা হাসে আরশিয়ান। ট্রে থেকে একটা ধারালো ছুরি উঠিয়ে নিয়ে আরভিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
–” সাধারণত রক্তারক্তি খুব একটা পছন্দ নয় আমার তবে তুই আমাকে যথেষ্ট কারণ দিয়েছিস এই পথটা বেছে নিতে। ”
আরভিদ দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–” মা..ফা করে দা..
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই একদম পাকস্থলী বরাবর দুই সেন্টিমিটার পুরু করে একটা লম্বা টান বসিয়ে দিলো আরশিয়ান। ব্যথার চোটে আরভিদ চিল্লিয়ে উঠল। আরশিয়ান নিজের ইচ্ছে মতো পরপর কয়েকটা টান বসিয়ে আমুদে কন্ঠে বলল,
–” তোকে বারবিকিউ এর রেসিপি ফলো করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে তবে দুর্ভাগ্যবশত তোর ঠিকনা সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে নয় বরং একটা ভয়ানক কুমিরের পেটে হবে। আমি টেনশনে আছি। বেচারা কুমির তোর মতো নোংরা প্রাণী আদৌ হজম করতে পারবে কিনা।”
যন্ত্রণায় তড়পাতে থাকা আরভিদ পাগলের মতো জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগলো কিন্তু আরশিয়ানের মন গলেনি। তার উপর যেনো অশরীরী কোনো আত্মা ভর করেছে। একপর্যায়ে আরভিদ আর সহ্য করতে না পেরে বলে,
–” যা বলবেন তাই করবো। আজীবন আপনার পালিত সার্ভেট হয়ে থাকবো তবুও আমায় ছেড়ে দিন। ”
আরশিয়ান বাঁকা হেসে বলল,
–” আমি গিরগিটিদের বিশ্বাস করিনা। তবে যন্ত্রণা কমাতে চাইলে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দে। ”
আরভিদ অপ্রকৃতস্থের মতো বলে,
–” বলবো সব বলবো। ”
আরশিয়ান সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
–” সেদিন বারে তোরা আমার সাথে কী করতে চেয়েছিলি? ”
আরভিদ যন্ত্রণা গিলে ধীর কন্ঠে বলে,
–” আপনাকে কড়া ধাঁচের ড্রাগস দেওয়া হয়েছিল। আমাদের প্ল্যান ছিলো আপনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্লাটের সাথে অন্তরঙ্গ হলে সেটার ফুটেজ আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিবো। এতে আপনার জনপ্রিয়তা কমে যাবে এবং ওয়াসীত্ব লিমিটেডের মতো চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি ও ধুলোয় মিশে যাবে কিন্তু আনফরচুনেটলি সেটা হয়নি।”
আরশিয়ান তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধায়,
–” সেই ছাদের ফুটেজটা ক’জনের কাছে আছে?”
আরভিদ মাথা নাড়িয়ে বলে,
–” আমার ফ্রেন্ড সায়নের কাছে আছে শুধু। ”
আরশিয়ান পুনরায় শুধায়,
–” তোর বাপের এত সাকসেসের পেছনে কার হাত আছে? বর্তমানে কোন কোন জায়গায় কয়টা করে ড্রাগসের ফ্যক্টরি আছে? ”
আরভিদ কাতর কন্ঠে বলে,
–” ইটালির মোস্ট পপুলার মাফিয়া মেহরাব শিকদার আছেন। বর্তমানে ঢাকায় নয়টা ফ্যাক্টরি আছে। সবগুলোর ডিটেইলস আমার ল্যাপটপে আছে। ”
আরশিয়ান ছুরিটা আরভিদের চোখ বরাবর ধরে জিজ্ঞেস করে,
–” ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড? ”
আরভিদ কাঁপা কন্ঠে বলে,
–” CRR…..190925B3।”
তাজরিয়ান পাসওয়ার্ড নোট করে ফেলে। আরশিয়ান পুনরায় শুধায়,
–” মিস্টার রওশান ওয়াসীত্ব এবং নাহার ওয়াসীত্বের যাবতীয় ভিডিওস কোথায় আছে? ”
আরভিদ ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
–” ওগুলো বাবার পার্সোনাল সেক্রেটারির কাছে আছে। ”
আরশিয়ান বাঁকা হেসে বলে,
–” অতীতে ওয়াসীত্ব লিমিটেড ধ্বংস হয়েছিল এবার ওয়াসীত্ব ফ্যামিলির পালা। বড্ড জ্বালিয়েছে শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এপর্যায়ে তাদের একটু জামাইয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া উচিত। ”
আরভিদের কানে ওসব গেলো না। সে কেবল যন্ত্রণায় ছটফট করছে। শরীরটা ক্রমশ রক্তশূণ্য হয়ে পড়ছে তার। নিজের অবনতি টের পেয়ে কাতর কন্ঠে আরভিদ বলল,
–” এবার আমায় মুক্তি দিন প্লিজ। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। ”
আরশিয়ান বাঁকা হেসে খানিকটা দূরে গিয়ে বলল,
–” কালেমা পড়ে নে কারণ আমার আস্তানা নয় বরং পৃথিবী থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে যাচ্ছিস তুই। ”
আরভিদ গুঙিয়ে উঠে ছটফট করতে শুরু করে কিন্তু কেউ তোয়াক্কা করেনি। তাজরিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা রড হাতে নিয়ে সজোরে আঘাত করে আরভিদের মাথায়। এতে বেচারা হুঁশ হারিয়ে ফেলে। আরশিয়ান নাকমুখ কুঁচকে বলে,
–” এত কষ্ট করতে হবে না। কেরোসিন এনে জ্বালিয়ে দে ওটাকে। ”
আরশিয়ানের কন্ঠে থাকা অবজ্ঞা তাজরিয়ানকে অবাক করল। সাধারণত আরশিয়ান কাউকে অতটা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেয়না। কেসটা প্রিমা সংক্রান্ত বলেই কী এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছে আরশিয়ান?
তাজরিয়ান প্রশ্ন বিহীন আরশিয়ানের বলা প্রতিটা পদক্ষেপ অনুসরণ করল। পুরো শরীরে কেরোসিন ছিটিয়ে একটা অগ্নি যুক্ত শলাকা ছুঁড়ে মারলো আরভিদের দিকে। শরীরটা বার কয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে পুরেটা স্থির হয়ে গেলো। চামড়ার আস্তরণ ঝলসে আস্তে আস্তে মাংসপিণ্ড গলে কালচে বর্ণ ধারণ করে হাড্ডির সাথে মিশে যেতে লাগলো।
লাশ পোড়ার উটকো গন্ধে কামরা ভরে উঠল। তাজরিয়ান চোখমুখ কুঁচকে সরে আসলেও আরশিয়ান ভীষণ শান্তি ভঙ্গিতে দু-হাত পকেটে গুঁজে সেই দৃশ্য দেখে চলেছে। তাজরিয়ান ভীষণ রকম বিস্মিত হয়। অবাক কন্ঠে শুধায়,
–” ভাইয়া? তুৃমি ওকে এতটা নিষ্ঠুর মৃত্যু দিলে কেনো?”
আরশিয়ান শান্ত কন্ঠে বলল,
–” ওর জন্য আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটা বেঁচে থাকতেও মৃত্যুসম যন্ত্রণা অনুভব করেছে তাই ওকে ভয়ংকর এক মৃত্যু দিয়ে সেটা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করলাম মাত্র। ”
তাজরিয়ান বিস্মিত হয়। এতদিন কেবল নিজেকে পাগল ভাবতো আজ বুঝলো আরশিয়ান ও সেই দলেরই অন্তর্ভুক্ত। সে ফাঁকা ঢোক গিলে আরকিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বে আচানক আরশিয়ানের ফোন বেজে উঠল। আরশিয়ান সেটা রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে ইশতিরাজ আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,
–” জলদিই হসপিটালে আয় ভাই। তোর বউ…
আরকিছু শোনার পূর্বেই অপর পাশ থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসলো। তৎক্ষণাৎ কলটাও ডিসকানেকট হয়ে গেলো।
চলবে?