#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৪
#অংশঃ০১
সূর্যের দাপটে ঝলমল আলোয় আলোকিত ধরণী। জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা সূর্যের তেজস্বী আলো হসপিটালের ছোট্ট কেবিনের ফ্লোরে হুটোপুটি খাচ্ছে। চোখেমুখে আলোর মৃদু ছটা পড়তেই আস্তে-ধীরে চোখ মেলে তাকাল আরশিয়ান। মস্তিষ্ক সচল হতেই অনুভব করল তার বুকের মধ্যে কেউ একজন খুব সন্তর্পণে জায়গা দখল করে রেখেছে।
আরশিয়ান প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলো সেটা আর কেউ নয় বরং তার একমাত্র অভিমানিনী। আরশিয়ান মৃদু হাসলো। প্রিমার রেশমের ন্যায় নরম চুলগুলোতে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ মেখে দিলো।
বেচারি সারাটারাত ছটফট করেছে। বারংবার ভয়ে আঁতকে উঠে তার টিশার্ট খামচে ধরছিল। ফলস্বরূপ ক্যানোলা নড়ে যায়। সেলাইন অবশ্য শেষের দিকে ছিলো। আরশিয়ান তড়িঘড়ি করে ডক্টরকে জানায়। ডক্টর এসে ক্যানোলা খুলে দিয়ে প্রিমাকে আরেকটা ইনজেকশন দেন এরপর প্রিমা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আরশিয়ানও তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়। বহুদিন পর ভালো ঘুম হয়েছে। ফ্রেস হওয়ার জন্য সরে আসার সময় টিশার্ট খামচে ধরে রাখা প্রিমার হাতটা সরাতে নিলে আচমকা কিছু একটা তার হাতে বাঁধে।
আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে প্রিমার হাতটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই আঁতকে উঠে রীতিমতো। পুরো হাত জুড়ে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন। এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে করা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আরশিয়ান থম মেরে হাতটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল কেবল। একটা শব্দও বেরুলো না কন্ঠনালি হতে। বুঝদার মেয়েটা এমন একটা কাজ করবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি আরশিয়ানের। বুকের ভেতর জমাটবদ্ধ ব্যথাটা হু হু করে বাড়ল। বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। ধীর স্বরে বিড়বিড়য়ে বলল,
–” অভিমানের কারণ আমি ছিলাম তাহলে আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ নিজের উপর কেনো করলেন? ”
প্রায় ঘন্টাখানেক পেরোতেই ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখদুটো মেলে তাকাল প্রিমা। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো একজন ডক্টর এবং আরশিয়ান দাঁড়িয়ে কথা বলছে। প্রিমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে ডক্টর এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
–” এখন কেমন লাগছে আপনার? ”
প্রিমা ঘুম ঘুম স্বরে বলল,
–” ভালো। ”
ডক্টর পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
–” কোনো ধরনের সমস্যা কিংবা ব্যথা অনুভব করছেন? ”
প্রিমা চোখমুখ বিকৃত করে বলল,
–” মাথায় একটু ব্যথা করছে। ”
ডক্টর ধীর স্বরে বললেন,
–” মাথায় বেশ ভালো চোট পেয়েছেন আপনি। এটার জন্য খানিকটা কষ্ট পোহাতে হবে। তবে ইন্টার্নাল কোনো সমস্যা ফেস করলে অবশ্যই জানাবেন। ”
প্রিমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। শরীরটা দুর্বল লাগছে ভীষণ। কথা বলতে একটুও ইচ্ছা করছে না উপরন্তু প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে বিরক্তির শ্বাস ফেললো প্রিমা। ডক্টর নরমাল চেকআপ শেষে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” উনার কন্ডিশন অনেকটা বেটার। মেডিসিনের প্রভাবটা রয়ে গেছে। হয়তো আর কিছুক্ষণের মাঝে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়বেন। আপাতত উনাকে হালকা কিছু খাইয়ে দেন। ”
আরশিয়ান ধীর কন্ঠে শুধাল,
–” আর কোনো সেলাইন দেওয়া হবে ? ”
ডক্টর একবার প্রিমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” সেটা উনার কন্ডিশনের উপর ডিপেন্ড করছে। ”
ডক্টর টুকটাক আরও কিছু কথা বলে বেরিয়ে পড়লেন। আরশিয়ান ফোন দিয়ে কাউকে নাস্তা আনতে বলল। প্রিমা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সবটা শুনছিল। আরশিয়ানের মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই মিছে ঘুমের ভান ধরলো। প্রিমাকে পুনরায় চোখবুঁজে ফেলতে দেখে আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তার পাশে দাঁড়িয়ে ধীর স্বরে বলল,
–” ঘুম পাচ্ছে? একটু অপেক্ষা করতে পারবেন না? এমুহূর্তে আপনার নাস্তা করাটা ভীষণ জরুরি। ”
প্রিমা থমথমে কন্ঠে বলল,
–” ক্ষুধা নেই। ”
আরশিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” মিথ্যা বলাও শিখেছেন দেখছি। ”
প্রিমা চোখ খুলে নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–” এটাতো খুনিদের সহজাত প্রবৃত্তি। ”
আরশিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আপনি খুনি নন সেটা স্বীকার করলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? ”
প্রিমা বুঝলো আরশিয়ান জেনে গেছে আসল সত্য।অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর ফুরালো। নিয়তি তাকে ঠকায়নি। পরিশেষে মুক্তি মিলেছে অপবাদের হাত থেকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে প্রিমা বলে উঠল,
–” আপনিতো আমায় জিজ্ঞেস করেননি। সরাসরি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। আমি স্বীকার করলে সেটা বিশ্বাস করতেন? ”
আরশিয়ান প্রত্যুত্তর করতে পারলোনা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,
–” আমার থেকে অতীত কেনো লুকিয়েছিলেন? ”
প্রিমা শান্ত কন্ঠে বলল,
–” বিগত আটটা বছর যাবত সেই দুর্বিষহ অতীতকে কেবলই এক জঘন্য সপ্ন ভেবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। লুকানোর মতো কিছুই ছিলোনা শুধু মনটা বিষিয়ে দিতে চাইনি বলে অতীত সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কখনো আলোচনা করতে চাইনি। ”
আরশিয়ান নিরবে সবটা শুনে প্রিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে বেডের একপাশে বসলো। প্রিমা সরে যেতে চাইলে আরশিয়ান তার হাত টেনে ধরলো। হাতের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত গুলো দেখিয়ে বলল,
–” এসব কী? কেনো করেছেন? ”
প্রিমা হাতটা সরিয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করে বলল,
–” সেই কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আপনাকে দিবো না।”
আরশিয়ান প্রিমার দিকে দৃষ্টি অনঢ় রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–” অবশ্যই আপনি আমাকে কৈফিয়ত দিবেন কারণ আপনি মানুষটা আমার অধীনস্থ। আপনার সর্বাঙ্গ জুড়ে কেবল আমার অধিকার আছে। আপনিটা শুধু আপনার নয় বরং তারচেয়েও অধিক বেশি আমার সুতারাং এই শরীরটাই সামান্য একটা আঁচড় লাগলে সেটার জন্য আপনি আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ”
কথাগুলো শুনে প্রিমার চোখের কোণে অভিমানী অশ্রুর ভীড় জমে। সেদিনকার সেই অপমান গুলো স্পষ্ট চোখে ভেসে উঠে। মস্তিষ্কে চেপে বসে অসহ্য রাগ। নিজেকে সামলাতে না পেরে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
–” আমি কেবলই আপনার ঘাড়ে চেপে বসা দায়িত্ব যার সাথে দূর্ভাগ্যবশত একটা সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করা হয়েছে আপনাকে। আপনার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই আমার উপর। অহেতুক এসব থার্ড ক্লাস ফিল্মি ডায়ালগ আমায় শোনাবেন না।”
আরশিয়ান আহত কন্ঠে বলল,
–“রাগের মাথায় ভুলভাল বলে ফেলেছিলাম। বিশ্বাস করুন সেদিন আমি একদমই হুঁশে ছিলাম না। মাথায় চেপে বসা সর্বনাশা রাগ, নেশাদ্রব্যের প্রভাবে ক্ষয়ে যাওয়া কমন সেন্স এবং সেই ভুলবোঝাবুঝির ফলে ওসব বলেছিলাম। মাফ করতে হবে না কিন্তু ভুল বুঝবেন না প্লিজ। ”
প্রিমা ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে জোর গলায় বলল,
–” সবাইকে সঠিক বোঝার ঠেকা নিয়ে রাখিনি। ইন ফ্যাক্ট আমি কিছুই বুঝতে চাইছিনা। আমার বুবু কে ডেকে দেন। আমি এখুনি এমুহূর্তে বাড়ি যেতে চাই।”
আরশিয়ান টের পেলো প্রিমা ভীষণ রেগে গেছে। সে আরেকটু এগিয়ে প্রিমার হাতটা ধরতে চাইলে প্রিমা হাত সরিয়ে নিলো। আরশিয়ান জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
–” শান্ত হোন। এসময়ে এতটা অস্থির হওয়া উচিত নয়। মিস ফারজানা একটু আগেই ঘুমিয়েছেন। এখন ডেকে দিলে উনার শরীর খারাপ করবে তাইনা? ”
প্রিমা নিজে বেড থেকে নামতে নামতে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
–” ডাকতে হবে না কাউকে। আমি একাই ডিসচার্জ নিতে পারবো। ”
আরশিয়ান হতভম্ব হয়ে যায় প্রিমার রণমুর্তি রুপ দেখে। শান্ত মেয়েটা রেগে গেলে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠে জানা ছিলোনা তার। চটজলদি প্রিমাকে জড়িয়ে ধরে আঁটকায়। প্রিমা যেনো রাগে হুঁশ খুইয়ে বসেছে। সে ছটফটিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়াতে চায়। আরশিয়ানের শক্ত বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে সর্বোচ্চ জোর প্রয়োগ করে কিন্তু বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনী থেকে এক চুলও সরতে পারেনা। শেষপর্যন্ত মেজাজ হারিয়ে নখ বসায় আরশিয়ানের হাতে। কামড়ে ধরে তার গলার বাঁ পাশটা। আরশিয়ান চোখবুঁজে ব্যথাটা হজম করে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রিমার দ্বিমুখী আক্রমণে বেচারা আঁতকে উঠে তবুও টু শব্দ করে না। প্রিমার পিঠের দিকে হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
–” শান্ত হোন একটু। রেগেমেগে নিজের সাথে সাথে আমাদের বাচ্চাদেরও কষ্ট দিচ্ছেন আপনি। ”
প্রিমার চওড়া মেজাজ খানিকটা থিতু হয়। বাচ্চার কথাটা কানে আসতেই থমকে যায়। ব্যপারটা মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার। আরশিয়ান বিষয়টা জেনে যাবে সেটা কল্পনাতেও ভাবেনি প্রিমা। যাদের কথা ভেবে নিজেকে পুনরায় সামলে নিয়েছিল তারা শেষপর্যন্ত থাকবে তো? আরশিয়ান জীবনেও নিজের সন্তানদের দাবিদাওয়া ছাড়বেনা। তাহলে প্রিমার কী হবে? উদ্ভট চিন্তা মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে ফেলে। প্রিমা শান্ত হয়ে শুধু আরশিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে শূন্যে তাকিয়ে থাকে। চোখ বেয়ে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। আরশিয়ান আড়চোখে প্রিমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় শুধাল ,
–” কাঁদছেন কেনো? এটাতো সুখবর। আমাদের সন্তানেরা আসতে চলেছে। আমি অতি শীঘ্রই তিনটা ফুটফুটে সন্তানের বাবা হবো।আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি? ”
আরশিয়ানের কন্ঠে ছিলো অগাধ উচ্ছ্বাস। প্রিমা ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে বলল,
–” ওরা কেবলই আমার সন্তান এবং আপনার করা ভুলের ফসল। সত্যি বলতে ওরা আমার সুযোগ নেওয়ার ফল সুতারাং আপনার কোনো অধিকার নেই তাদের ওপর। ওরা কিচ্ছু বলে ডাকবে না আপনাকে। ওরা জানবেই না আপনার অস্তিত্বের কথা। ”
আরশিয়ান আহত দৃষ্টিতে তাকায়। প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারে না। প্রিমার বলা প্রত্যেকটা কথা তীক্ষ্ম তীরের ন্যায় বিঁধে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। আচমকা কিছু একটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই আরশিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক কন্ঠে শুধাল,
–” প্রেগন্যান্সির কথা আগে থেকেই জানতেন আপনি? ”
প্রিমা অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর স্বরে বলল,
–” হ্যাঁ। ”
আরশিয়ান গম্ভীর গলায় শুধাল,
–” আমাকে জানাননি কেনো? ”
মাস খানেক পর শরীরের অস্বাভাবিকতা টের পেয়ে প্রিমা খানিকটা অবাক হয়। প্রথমদিকে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রিমা ডক্টরের কাছে যায়। সকল টেস্ট করানোর পর জানতে পারে ট্রিপলেট প্রেগন্যান্সির বিষয়টা তবে পারিপার্শ্বিক কথা চিন্তা করে কাউকে কিছু বলেনি।আরশিয়ানের প্রশ্নটা শুনে প্রিমা ঝাঁঝাল স্বরে বলল,
–” বোনের স্বামীকে প্রেগন্যান্সির কথা জানাতে যাবো কোন দুঃখে? ”
আরশিয়ান হতভম্ব স্বরে বলল,
–” নীহা আমার এক্স ওয়াইফ। বর্তমানে আমি আপনার হাসবেন্ড। কী বলছেন এসব ? ”
প্রিমা তেজস্বী কন্ঠে বলে,
–” সেদিন তো আপনিই নিজেকে আমার বোনের হাসবেন্ড দাবি করেছিলেন। এসব আপনার ওয়ার্ডস আমায় নয়। ভুলে গেছেন? ”
আরশিয়ান থতমত খেয়ে বলে,
–” ভুল হয়ে গেছে। রাগের মাথায় যা-তা বলে বসেছি। আম রিয়েলি স্যরি ওয়াইফি। ”
প্রিমা চোখমুখ কুঁচকে বলল,
–” আপনার স্যরি আমার মান সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে? কী দোষ ছিলো আমার? মাতাল স্বামীর যৌক্তিক ইচ্ছেকে আশকারা দেওয়াটা অপরাধ আমার ছিলো? বাড়ির সকলের সামনে সুযোগ সন্ধানী খেতাব দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছিলেন?যাইহোক.. দূরত্ব চেয়েছিলেন আমি সেটাই দিয়েছি এখন এসব নাটকের মানে কী? ”
বুকটা হাহাকার করে উঠে আরশিয়ানের। সে অসহায় কন্ঠে বলে,
–” একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি…
প্রিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–” কিছু বুঝতে চাইছিনা আমি। এবার আপনার বোঝার পালা। আপনি বুঝুন এবং আমাকে মুক্তি দিন। বোনের স্বামীর সাথে সংসার করার অভিরুচি আমার নেই। তালাক দিয়ে আপনিও খুশি থাকুন এবং আমাকেও শান্তি দিন। ”
আরশিয়ানর বুকটা কেঁপে উঠে। প্রিমা ফোঁপাচ্ছে রীতিমতো। চোখমুখে লেপ্টে আছে একরাশ রাগ, ক্ষোভ এবং জেদ। নারীর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে তারা কতটা কঠোর হতে পারে সেটা প্রিমাকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। আরশিয়ান কীয়ৎকাল কিছু একটা ভাবলো। এভাবে প্রিমাকে কনভিন্স করা ইম্পসিবল। মেয়েটা মেন্টালি ভীষণ ডিস্টার্বড। এখন বোঝার মতো পরিস্থিতিতে একদমই নেই প্রিমা।
আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,
–” আমার করা কাজটা ভুল নয় বরং অন্যায় ছিলো। ওটাকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করা অনুচিত। নিজের কৃতকর্মের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। এটার জন্য অবশ্যই আমার শাস্তি পাওনা রয়েছে তবে দূরত্ব কোনো সমাধান হতে পারে না। ”
প্রিমা চোখ তুলে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–” আমারা কাছাকাছি কবে এসেছিলাম? ”
আরশিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
–” বহু আগেই শুধু অনুভব করার সময়টা পায়নি। শাস্তি হিসেবে আমৃত্যু ক্ষমা করতে না চাইলেও আমার কোনো অভিযোগ থাকবেনা তবে এই সংসারটা আমার চায়। আপনিসহ ওই বাচ্চাগুলোর সাথে বার্ধক্যের সময়টা পার করতে চাই। ”
প্রিমার চোখজোড়া ভিজে উঠে। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে ধরে আসা গলায় বলে,
–” যে পুরুষের মন মস্তিষ্কে অন্য নারীর বাস তার সঙ্গ আমার জন্য কেবলই এক ধ্বংসাত্মক সর্বনাশ। আমার পক্ষে আপনাকে মেনে নেওয়া অসম্ভব। ”
আরশিয়ান ম্লান হেসে বলল,
–” এই সর্বনাশা সত্যকে নিজের সর্বস্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে আপনাকে। আমি বিন্দুমাত্র কম্প্রোমাইজ করবোনা এক্ষেত্রে। এই অসম্ভব ব্যপারটাকে সম্ভাবে পরিণত করার চেষ্টা করুন বিকজ ইয়্যু ডোন্ট হ্যাভ এনাদার অপশন। ”
প্রিমা অপলক চেয়ে থেকে ভাবলেশহীন কন্ঠে শুধায়,
–” যদি অপশনটাকে আমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিই। ”
আরশিয়ান পকেটে হাত গুঁজে দু’কদম সামনে এগিয়ে গম্ভীর বলল,
–” এই অপশনটাই আপনার লাইফ। আপনার নিঃশ্বাস। আপনার ভালোবাসা পরিশেষে আপনার স্বামী এবং তিন সন্তানের একমাত্র পিতা৷ আপনার লাইফ থেকে আমি নামক অপশনটাকে এক্সিট করার কোনো স্পেসিফিক বাটন নেই ওয়াইফি। ”
প্রিমা চোখমুখ কুঁচকে বলল,
–” আপনার মতো ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষকে এমন সস্তা ফ্লার্ট মানায় না। কাইন্ডলি এসব বন্ধ করুন। আমি একটা সিরিয়াস টপিকে কথা বলছি। ”
আরশিয়ান চোখ ছোটো-ছোটো করে তাকিয়ে বলল,
–” আমি ডীপলি ফ্লার্ট করা স্টার্ট করলে আপনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। আমি চাইছিনা নেক্সট ইয়ারই আমার অনাগত বাচ্চাদের ভাইবোনকে প্রি বুকিং দিতে। আপনার জন্য ক্যারি করা কঠিন হয়ে যাবে। তাইনা? ”
প্রিমা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–” আপনার সাথে আমি আর একদণ্ড ও থাকবো না নির্লজ্জ পুরুষ। ”
আরশিয়ান বাঁকা হেসে শুধাল,
–” কোথায় যাবেন ওয়াইফি? ”
প্রিমা ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
–” আমার অন্তিম ঠিকানা.. আমার বুবুর কাছে। ”
আরশিয়ান কিছু একটা ভেবে প্রিমার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার সামনাসামনি এসে এক হাতে থুতনি ধরে বলল,
–” আপনার শেষ ঠিকানা হলো এই আরশিয়ান ইসফারের বক্ষপট। জীবনের সব পরিস্থিতিতেই এই প্রশস্ত হৃদকুঞ্জ আপনাকে সযত্নে আগলে নিবে। ঠিক এই জায়গাটায় লুটিয়ে পড়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবেন আপনি। ”
প্রিমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। সে বিরক্তিতে তেঁতে উঠে বলে,
–” ওই বক্ষপিঞ্জরে এখনো নীহা নামক বিষক্ত পাখির জন্য অগাধ অনুভূতি পুষে রেখেছেন আপনি। আমি প্রিমা আমৃত্যু সেখানটায় মাথা রাখবো না। ছল চাতুরী বন্ধ করুন। সন্তানের ভাগ চাই আপনার তাইনা? ”
আরশিয়ান ব্যর্থতার শ্বাস ফেলে বলে,
–” নীহা আমার জীবনে আসা প্রথম প্রেম তবে তার অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যটা জানার পর তার প্রতি থাকা শ্রদ্ধাটুকু এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। বুকে পুষে রাখ নির্মল অনুভূতিরা তৎক্ষণাৎ অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এই হৃদয়ে কারও জন্য ভালোবাসা নেই তবে গভীর ভাবে ভালোবেসে প্রাপ্ত তরতাজা এক জখম আছে। সেই জখমটা সারিয়ে তোলার জন্য আপনি নামক ঔষধের ভীষণ প্রয়োজনীয়। ”
প্রিমা অভিমানী কন্ঠে বলল,
–” আমি কারও প্রয়োজন হতে চাইনা। ”
আরশিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল,
–” আপনি তো আমার প্রিয়দর্শিনী প্রেম। ”
প্রিমা প্রত্যুত্তর করালো। তার মন মস্তিষ্কে তুফান চলছে। বিগত দিনগুলোর কথা একের পর এক স্মরণে আসছে তার। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে অসহায়ের মতো ফুঁপিয়ে উঠল প্রিমা। আরশিয়ান হকচকিয়ে উঠে চটজলদি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–” প্রেম? কী হয়েছে জান? ”
প্রিমা ক্রন্দনরত স্বরে হাহাকার মিশিয়ে বলল,
–” অশান্তি লাগছে আমার। আমি পারছিনা ওসব মেনে নিতে। পারবোনা সেসব ভুলতে। আমার স্বামী হয়ে নিজেকে অন্যের ব্যক্তিগত পুরুষ দাবি করার বিষয়টা আমৃত্যু আমাকে যন্ত্রণা দিবে। আল্লাহ মরণ দেয়না কেনো আমাকে? ”
আরশিয়ান মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
–” কীসব বলছেন আপনি? আদৌ হুঁশে আছেন? মানুষ আমি। করে ফেলেছি একটা অন্যায়। সেটার জন্য আমি যথেষ্ট অনুতপ্ত। আর কী করতে পারি বলুন? ”
প্রিমা উন্মাদের মতো বলল,
–” আমায় ছেড়ে দেন।”
আরশিয়ানের এবার রাগ লাগলো। প্রিমার মুখটা উপরে তুলে বিনাবাক্যে সোজা তার অধরোষ্ঠ দখলে নিলো। রাগ ঝাড়লে না বরং ভীষণ আদুরে স্পর্শে প্রিমাকে বেসামাল করে তুললো। প্রিমা কিল-ঘুষি মেরে সরতে চাইলে ভীষণ সাবধানে তার হাতদুটো ব্লক করে ফেললো। কিছুক্ষণ পেরোতেই প্রিমার শ্বাস নেওয়ার তোরজোড় দেখে শেষপর্যায়ে তাকে রেহাই দিলো। দু’জনে হাঁপাচ্ছে সমানভাবে। প্রিমা সম্পূর্ণ ভারটুকু ছেড়ে দিয়েছে আরশিয়ানের উপর। একটুও নড়াচড়া করছেনা বেচারি। আরশিয়ান তার রাগ দেখে ধীর কন্ঠে বলল,
–” ধরার আগেই ছাড়ার কথা বললেন বিধায় হালকা পাতলা নমুনা দেখালাম। পছন্দ হয়নি ওয়াইফি? ”
প্রিমা হাঁপানো সুরে বলল,
–” আমি চলে যাবো। থাকবো না আপনার কাছে। আপ…
আরশিয়ান তাকে মাঝপথে থামিয়ে ধীর কন্ঠে শুধাল,
–” মিস ফারজানার কাছে যাবেন তাইতো”
প্রিমা কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–” হুঁ। ”
আরশিয়ান চোখমুখ শক্ত করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” আপনার একটা পদক্ষেপ যদি মিস ফারজানার জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তহলে আপনার কেমন লাগবে? ”
প্রিমা অবুঝ কন্ঠে শুধাল,
–” মানে? ”
আরশিয়ান সামান্য ঝুঁকে প্রিমার ফোলা ওষ্ঠে বৃদ্ধাঙ্গুলি স্লাইড করে বলল,
–” আপনার বোনের চাকরিটা যদি না থাকে এবং আমার নির্দেশে তাকে আর কোথাও চাকরি দেওয়া না হয় তবে তার ঔষধের যোগান দিবে কে? দু’বেলা মেডিসিন মিস গেলে উনি তৃতীয় বেলা আদৌ সুস্থ থাকবেন তো? ”
প্রিমা হতবাক কন্ঠে বলল,
–” আপনি এটা করতে পারেন না। ”
আরশিয়ান অপলকভাবে প্রিমার দিকে চেয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল,
–” প্রসঙ্গ যদি হয় আপনাকে নিজের সাথে বেঁধে রাখার আমি অনায়াসে ভাঙ্গবো হাজারটা নিয়ম বারংবার।”
প্রিমা আরশিয়ান টিশার্ট মুঠো পাকিয়ে ধরে বলল,
–” আপনি আমার সাথে এমন করতে পারেন না। ”
আরশিয়ান টুপ করে প্রিমার নাকে ডগায় চুমু বসিয়ে বলল,
–” আমি সবই করতে পারি ওয়াইফি। আপনি যখনই আমার অবাধ্য হবেন আমি তখুনি সকল নীতি অগ্রাহ্য করে অনিয়ম করবো। আপনি যদি বেপরোয়া আরশিয়ান ইসফার চৌধুরীকে দেখতে চান তাহলে এই অধম বান্দা কীভাবে নির্বাক থাকবে বলুন? ”
আরশিয়ানকে ছেড়ে দিয়ে প্রিমা চুপচাপ বসে রইল। দমবন্ধ লাগছে তার। কী ভেবেছিল আর কী হলো। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো কিছু প্রসেস করতে পারছেনা। আরশিয়ান তার অবস্থা দেখে বলল,
–” একটুও যদি প্যানিক করেন তাহলে নিজ দায়িত্বে আপনার ছটফটানি বাড়ানোর কাজটা স্পেশাল ওয়ে তে সম্পন্ন করবো। আমি হুমকি দিচ্ছিনা জাস্ট ফ্যাক্ট বলছি। সুস্থ থাকুন এবং স্রেফ আমার হয়ে থাকুন। বাকি সবাই এমনিতেই ভালো থাকবে। বুঝেছেন? ”
প্রিমা প্রত্যুত্তর করলোনা কেবল শান্ত চোখে মেঝের দিকে চেয়ে রইল। আরশিয়ান আরও কিছু বলার পূর্বে দরজায় টোকা পড়ল। আরশিয়ান এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো তার পরিবারের লোকজন এসেছে। আরশিয়ান কিছু না বলে তাদের রেখে বেরিয়ে পড়ল।
চলবে?
#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৪
#অংশঃ০২
টপ ফ্লোরের লম্বা করিডর পেরিয়ে একদম শেষ প্রান্তে ইশতিরাজের কেবিন অবস্থিত। পুরো ফ্লোরটা ভিআইপি নামে খ্যাত। এটা জাস্ট ফ্যামিলি মেম্বার্স এবং সেলিব্রিটিদের ট্রিটমেন্ট দেওয়ার জন্য বানানো হয়েছে।
প্রিমার কেবিন থেকে বেরিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ধীর পায়ে আরশিয়ান ইশতিরাজের কেবিনের দিকে যায়। বিনা পারমিশনে কেবিনের দরজা খুলে হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ইশতিরাজ তখন সবে খাবারের প্যাকেটে হাত দিয়েছে। আচমকা ধুপধাপ শব্দ শুনে বেচারা ভড়কে যায়। আরশিয়ান বিনাবাক্য এসে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ইশতিরাজ নিশ্চুপে এতক্ষণ তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে অতঃপর দাঁত কেলিয়ে বলে,
–” কী হইছে দোস্ত। বেড কম্ফোর্টেবল ছিলোনা নাকি? তোর মুডের বারোটা বেজে আছে কেনো? ”
আরশিয়ান চোখ থেকে হাত সরিয়ে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–” আজাইরা কথা বলিস না। ভাল্লাগছে না এসব। ”
ইশতিরাজ লম্বা শ্বাস টেনে ধীর কন্ঠে বলল,
–” পিচ্চি অনেক বেশি রিয়েক্ট করেছে? ”
আরশিয়ান ধরা গলায় বলল,
–” শী ওয়ান্টস ডিভোর্স। ”
ইশতিরাজ স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বলল,
–” স্বাভাবিক। তুই এত সেন্টি খাচ্ছিস কেনো? তোর অনাগত বাচ্চাদের কাস্টাডি এনসিউর কর। বউয়ের প্রয়োজন পড়লে আরেকটা বিয়ে করবি নাহয়। ”
আরশিয়ান ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–” বাচ্চারা ফোর্থ সাবজেক্ট। বউ হিসেবে আমার উনাকেই লাগবে। আমি পারবো না তাকে ছাড়তে। বিশ্বাস কর রাজ। বিগত দুইটা মাস আমি কীভাবে কাটিয়েছি শুধু আমি জানি। গ্লানিবোধ আমায় কতটা পুড়িয়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ”
ইশতিরাজ শান্ত চোখে দেখলো আরশিয়ানের পাগলাটে অভিব্যক্তি৷ চোখেমুখে অনুতাপের ছাপ স্পষ্ট৷ তার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে গ্লানিবোধের কারণে। ইশতিরাজ সবটা বুঝে ভীষণ শান্ত কন্ঠে বোঝানোর স্বরে বলল,
–” সমস্যাটা কোথায় জানিস.. প্রিমা কখনোই তোর থেকে ভালোবাসা আশা করেনি। তোর পাস্ট জানার পর মেয়েটা নির্দ্বিধায় স্বাভাবিক সংসারের সপ্ন ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু চেয়েছিল একটুখানি রেসপেক্ট এবং তুই সেটা দিতে ব্যর্থ। এখন তুই বল প্রিমা কেনো থাকবে তোর কাছে? ”
আরশিয়ান রক্তাভ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে বলল,
–” আমাদের মাস কয়েকের বিবাহিত জীবনে সেই একটা ঘটনা ব্যতীত উনি কখনোই কোনো বিষয়ে কোনো প্রকার অভিযোগ তুলতে পারবেন না৷ আমি অলওয়েজ উনার সকল মতামতকে সম্মান করেছি এবং ব্যক্তি প্রিমার জন্য আমার দৃষ্টিতে অগাধ শ্রদ্ধা ছিলো। সেদিনের বিষয়টা পুরোপুরি আলাদা ছিলো। আমি হুঁশে ছিলাম না একদমই। আমার দ্বারা বিরাট অন্যায় হয়েছে সেটা আমি স্বীকার করছি। প্রয়োজনে তোরা শাস্তি দে আমাকে কিন্তু দূরত্বের নামে মৃত্যুসম যন্ত্রণা দিস না। একটা সুযোগ কী আমি ডিজার্ব করি না? ”
ইশতিরাজ অবাক হয়ে দেখলো আরশিয়ানকে। শক্তপোক্ত ছেলেটা এত বেশি ভেঙে পড়েছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ইশতিরাজ। নীহার মৃত্যুতে তাকে কাঁদতে দেখা যায়নি অথচ আজ প্রিমাকে হারানোর ভয়ে তার অক্ষিকোটর অশ্রুসিক্ত। টুপটাপ কয়েক ফোঁটা অশ্রু ইতিমধ্যে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে। ইশতিরাজ কৌতূহলী গলায় শুধাল,
–” তুই পিচ্চিকে কী বলে এসেছিস? ”
আরশিয়ান নাক টেনে ধীর গলায় বলল,
–” কোনোমতেই আমার বক্ষপিঞ্জরার বন্দিনী হয়ে থাকতে চাইছিল না তাই বাধ্য হয়ে হালকার উপর ঝাপসা করে ব্ল্যাকমেইল করেছি। ”
ইশতিরাজ হতভম্ব গলায় বলল,
–” তুই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিস শান। এমনিতেই সবকিছু এত কমপ্লিকেটেড তন্মধ্যে তুই আবার ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে এসেছিস। আমার সামনে অনুতপ্ত হয়ে লাভ আছে? যাকে আঁটকে রাখতে চাইছিস তাকে বুঝিয়ে বল নিজের ফিলিংস। ”
আরশিয়ান দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
–” আমার অনুতাপ উনাকে আঁটকাতে পারবেনা কারণ আত্মসম্মানটা উনার প্রধান প্রায়োরিটি। বাধ্য হয়ে আপনজনের প্রসঙ্গ টেনে আমার খাঁচায় তাকে বন্দী করে রেখেছি। আমার অনুতাপে জর্জরিত কন্ঠ কিংবা চোখভর্তি গ্লানিবোধ কোনোটাই উনাকে বিন্দু মাত্র প্রভাবিত করতে পারতোনা… আঁটকে রাখা তো বহু দূরের বিষয়। ”
বিশ্লেষণ করতে গেলে আরশিয়ানের বলা একটা কথাও ভুল নয়। ইশতিরাজ হাল ছেড়ে দিয়ে ম্লান কন্ঠে বলল,
–” ভালোবাসার মানুষ কে আঁটকে রাখতে নেই শান। তাদের খোলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গনার ন্যায় উড়তে দেখার মাঝেই সীমাহীন আনন্দ লুকিয়ে আছে। যত বেঁধে রাখবি সম্পর্ক তত বেশি নির্জীব হয়ে উঠবে। একতরফা সংসার হয়না। তুই তাকে আঁটকে রাখতে পারলেও তার মনকে বশীভূত করতে পারবিনা। ”
আরশিয়ান অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,
–” তার মনের একচ্ছত্র আধিপত্য না পেলেও আমি তাকে আঁটকে রাখতে চাই। আপেক্ষিক ভালোবাসা আমার লাগবেনা। আমার কেবলমাত্র তাকে চায়। যে কোনোকিছুর বিনিময়ে আমৃত্যু তাকে আমার বন্দিনী করে রাখতে চাই। তাকে সুযোগ সন্ধানী বলার নিষ্ঠুর অপরাধের কারণে আজীবন যদি তাকে না ছোঁয়ার প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয় তবুও শেষপর্যন্ত আমি তাকেই চাইবো।”
সমান্য থেমে আরশিয়ান পুনরায় বলল,
–” তার নির্লিপ্ত দৃষ্টিজোড়ায় আমি সুখ খুঁজে নিবো। অভিমান বুকে পুষে বাধ্য হয়ে আমার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখলেও আমি তাতেই শান্তি খুঁজে নিবো। আক্ষেপের স্বরে হাজারটা কটুবাক্য শোনালে সেটাকেই মধুর বাণী হিসেবে গ্রহণ করবো তবুও বিচ্ছেদের ব্যপারে সম্মতি জ্ঞাপন করবো না। সর্বোপরি আমার তাকেই লাগবে। ”
ইশতিরাজ হতবাক কন্ঠে শুধায়,
–” তুই একাকীত্বকে এতটা ভয় পাস? বিচ্ছেদে এত আপত্তি কেনো তোর? ”
আরশিয়ান ম্লান হেসে বলল,
–” একাকীত্বের ভয়াবহতা কেবল তারা জানে যারা তীব্রভাবে কাউকে চাওয়ার পর রিক্ত বক্ষে একরাশ হাহাকার এবং মস্তিষ্কে তার কল্প চিত্র সাজিয়ে বসে আছে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখার চেষ্টায় তারা রোজ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করে। সেই ব্যক্তির কন্ঠস্বর শোনার জন্য তারা প্রতিমুহূর্ত তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায় ছটফটায়। সেই ব্যক্তিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য নির্ঘুম রাতে অসহায় হয়ে জায়নামাজে বসে মোনাজাতে শব্দহীন কান্নায় কত-শত আর্জি জানায় তার ইয়ত্তা নেই। এসব অনুভূতি সহ্য করার মতো সক্ষমতা আমার নেই রাজ। একদমই নেই.. ”
সামান্য থেমে আরশিয়ান পুনরায় বলল,
–” কাব্যিক ভাষায় দূরত্ব রেখে সেই মানুষটাকে অন্যের সাথে সুখী থাকতে দেওয়াকে হয়তো প্রকৃত প্রেম বলে কিন্তু বাস্তবিক অর্থে নিজের মানুষটাকে নিজের কাছে রাখার মাঝেই প্রকৃত সুখ বিদ্যমান। মানুষ যত বড়োই মহামানব হোক না কেনো নিজের সুখকে অন্য কারও বক্ষে শান্তিতে দেখলেও তাদের অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসহনীয় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। রইলো কথা বিচ্ছেদের? বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কেবল তারা উপলব্ধি করতে পারবে যারা নিজের সর্বস্বটা দেওয়ার পরও অপর প্রান্তের মানুষটাকে আঁটকে রাখতে পারেনি। সেটা আরেক অবর্ণনীয় নীলাভ যন্ত্রণা। যা আজীবন মনিকোঠায় ক্ষণে ক্ষণে যাতনা সৃষ্টি করে সুখের পরিসমাপ্তি ঘটায়৷ ”
ইশতিরাজের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিবেচনা করতে গেলে দু’জনেই নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক৷ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হবে জানা নেই তবে দু’জনে একে-অপরকে ভীষণ ভালোবাসে৷ সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ইশতিরাজ বলে,
–” এখন কী করবি? ”
আরশিয়ান চোখমুখ মুছে ধীর কন্ঠে বলল,
–” মিস ফারজানাকে একটু ডেকে দে। ”
ইশতিরাজ বিভ্রান্ত চোখে ওর দিকে একবার তাকিয়ে ফোন উঠিয়ে কল করলো কাউকে। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন নক করলো কেবিনে। ইশতিরাজ অনুমতি দিতেই ফারজানা কক্ষে প্রবেশ করলো।
ভেতরে ঢুকে আরশিয়ান এবং ইশতিরাজকে দেখে খানিকটা অবাকই হলো ফারজানা। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আরশিয়ানের পাশের চেয়ারটায় বসে ধীর কন্ঠে শুধাল,
–” ডেকেছিলেন আমায়? ”
ইশতিরাজ ধীর কন্ঠে বলল,
–” আরশিয়ান আপনার সাথে কথা বলতে চায়। ধৈর্য নিয়ে শোনার অনুরোধ রইল। ”
ইশতিরাজের চোখে আকুতি। ফারজানা কিঞ্চিত অবাক হলো তাদের অভিব্যক্তি দেখে। ফাঁকা ঢোক গিলে ধীরে সুস্থে বলল,
–” বলুন কী বলতে চান। ”
খানিকটা সময় নিয়ে আরশিয়ান তার দিকে ফিরে মাথা নত করে কম্পমান কন্ঠে বলল,
–” মিসেস প্রিমার অভিভাবক আপনি। আমি জানি না চাইতেও আমি আপনাকে হার্ট করেছি। আমার ওয়াদা পালনে ব্যর্থ হয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি স্বইচ্ছায় এসব করিনি। আরভিদের জালে পা দিয়ে বিরাট বড় অন্যায় করেছি আমি। আমার অপকর্মের জন্য আমি অনুতপ্ত। আপনাদের ইচ্ছে হলে আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন আমার আপত্তি থাকবে না। শুধু একটাই অনুরোধ করছি.. উনাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিবেন না প্লিজ। আমার পক্ষে এই বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ”
ফারজানা হতভম্ব চোখে তাকাল আরশিয়ানের দিকে। কান্নার ফলে স্নিগ্ধ মুখটা হালকা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অপরাধবোধর গ্লানিতে চোখজোড়া নীমিলিত হয়েছে। সর্বদা দাম্ভিকতা নিয়ে চলা ফেরা করা মানুষটা তার সামনে হাতজোড় করে প্রিমাকে চাইছে ব্যপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল তার।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে ফারজানা দৃঢ় গলায় বলল,
–” আপনার গ্লানিবোধ আমার বোনের মান সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবেনা মিস্টার চৌধুরী। ওর কাছে নিজের আত্মসম্মানের উপর কিচ্ছু নেই। আপনার পরিস্থিতি বুঝলেও আমি নিরুপায়। এক্ষেত্রে প্রিমার মতামতই শিরোধার্য। ”
আরশিয়ান অসহায়ের মতো বললো,
–” অজান্তেই আমার দ্বারা একটা অন্যায় হয়েছে।আমি কী একটা শেষ সুযোগ ডিজার্ভ করিনা? ”
ফারজানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আমি সুযোগ দেওয়ার কেউ নই। যার সাথে অন্যায় করেছেন সে যদি আপনার আকুতি মঞ্জুর করে তাহলে হয়তো মিলবে সুযোগ। ”
আরশিয়ান অনুরোধের কন্ঠে বলল,
–” আপনার সাপোর্ট ভীষণ দরকার এমুহূর্তে। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। ”
ফারজানা তার আকুতি দেখে কৌতূহলী কন্ঠে শুধায়,
–” আমার সাপোর্ট বলতে? ”
আরশিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
–” চৌধুরী বাড়ির আবহাওয়া মিসেস প্রিমার জন্য উপযুক্ত নয় তাছাড়াও ডক্টর বলেছেন এটা হাই রিস্কি প্রেগন্যান্সি৷ সবটা বিবেচনা করে আমি হসপিটালের পাশ্ববর্তী একটা এপার্টমেন্টে শিফট হতে চাইছি। সেই সাথে আপনাকেও অনুরোধ করছি আমাদের সাথে থাকতে। আমি উনাকে একা ছাড়তে পারবোনা কিন্তু উনার শখ অপূর্ণ রাখতে চাইছিনা।”
ফারজানা ইতস্তত করে বলল,
–” এটা সম্ভব নয়৷ আমি….
আরশিয়ান উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
–” মিসেস প্রিমার মেন্টাল কন্ডিশন ভীষণ নাজুক। এই পরিস্থিতিতে আমি একা উনাকে কোনোভাবেই সামলাতে পারবোনা। আপনার অস্বস্তিবোধ হবেনা এতটুকু শিওরিটি আমি আপনাকে দিচ্ছি। আপনার এপার্টমেন্ট আলাদা হবে এবং সমস্ত খরচ অফিস বহন করবে। এখান থেকে যাতায়াতেও বেশ সুবিধা হবে আপনার। একটু ভেবে দেখুন৷ অফারটা কিন্তু চমৎকার। ”
ফারজানা কিছু একটা ভেবে বলল,
–” ঠিকাছে আমি সম্মতি দিবো তবে এক শর্তে। ”
আরশিয়ান কাঁপা কন্ঠে শুধাল,
–” কী শর্ত? ”
ফারজানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” অতীত পাল্টানোর সক্ষমতা আমাদের নেই। যা হয়েছে তার জন্য আপনি যথেষ্ট অনুতপ্ত একই সাথে আমার বোনের জন্য অগাধ কন্সার্ন দেখেছি আমি আপনার চোখে এজন্যই আপনার অনুরোধ রাখছি তবে ভবিষ্যতে যদি কখনো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় তবে আমি ফারজানা কখনোই আমার বোনকে আপনার সংসারে রাখবো না। ”
আরশিয়ান স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
–” এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ। এর পরে মিসেস প্রিমাকে আমি আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী অভিযোগ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ দিবো না। ”
ফারজানা কথা বা বাড়িয়ে চুপ রইল। আরশিয়ান আরও কিছু বলার পূর্বে পুনরায় কেবিনে নক পড়লো। একজন নার্স বলল,
–” মিসেস চৌধুরীর হাসবেন্ডকে ডক্টর এখুনি দেখা করতে বলেছেন। ”
আরশিয়ান তৎক্ষনাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বের হয়ে যায়৷ তার প্রস্থানের পানে চেয়ে ফারজানা বলল,
–” উনি এত দ্রুত প্রিমাকে ভালোবেসে ফেলবেন আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। ”
ইশতিরাজ মৃদু হেসে বলল,
–” মিসেস লাড্ডু ছোটোখাটো একটা রুপাঞ্জেল। বন্ধু আমার প্রেমে না পড়ে যবে কই? ”
ফারজানা হেসে ফেললো। পরক্ষণে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
–” সত্যি বলতে আমার পরে প্রিমা যদি কারও সাথে সেইফ থাকে তবে সেটা নিঃসন্দেহে মিস্টার চৌধুরী তবে আমার ভয় করছে। প্রিমা অভিমান ভুলে আদৌ মানুষটাকে একসেপ্ট করতে পারবে তো? ”
ইশতিরাজ খাবার তিনটা পোর্শানে ভাগ করতে করতে বলে,
–” আপনার কী মনে হয়? মিসেস লাড্ডুর কী করা উচিত? ”
ফারজানা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” উনাকে আরেকটু সাফার করিয়ে অতঃপর গ্রহণ করে নেওয়া উচিত। মানুষটার ভালোবাসা কিংবা যত্নে কোনো কমতি নেই। লোকদেখানো কোনো ব্যপার নেই। যতটুকু আছে তার সবটুকুই খাঁটি। ”
ইশতিরাজ পুনরায় শুধাল ,
–” মিসেস লাড্ডু কী করবেন বলে আপনার মনে হয়? ”
ফারজানা খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
–” আমার মনে হয় প্রিমা উনাকে একসেপ্ট করতে পারবেনা। ”
ইশতিরাজ খাবারের প্লেটটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
–” কেনো? ”
ফারজানা জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই উপরন্তু সে ক্ষুধার্ত তাই প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” সমস্যাটা দোষারোপ কিংবা ভুলবোঝাবুঝি নিয়ে নয়। প্রিমার মনে যে বিষয়টা দাগ কেটেছে তা হলো মিস্টার চৌধুরীর নিজেকে অন্য কারও দাবি করার বিষয়টা। প্রিমার আম্মুকে ছেড়ে তার বাবা যখন ওই ডাইনীটাকে চুজ করেছিল তখন থেকেই প্রিমা থার্ড পারসন ব্যপারটা একদমই মানতে পারেনা। ইভেন আমি যদি কোনো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটু বেশি আদর করি তাহলে সেটা ওর পছন্দ হয়না। আপন মানুষ গুলোকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা নিমিষেই গ্রাস করে ফেলে ওকে। ”
ইশতিরাজ এবার ধরতে পারলো আসল বিষয়টা। ডালে পরোটা ডুবিয়ে একটা বাইট মুখে নিয়ে অস্ফুট স্বরে শুধাল,
–” উনার ইনসিকিউরিটির ইস্যু আছে? ”
ফারজানা সায় জানিয়ে বলল,
–” মারাত্মক লেভেলের। ”
ইশতিরাজকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে ফারজানা কৌতূহলী কন্ঠে শুধাল,
–” এই বিষয়ে আপনার অভিমত কী? ”
ইশতিরাজ শান্ত কন্ঠে বলল,
–” মানুষ কখনোই নিখুঁত হয়না। অল্পসল্প দোষত্রুটি সকলের মাঝে বিদ্যমান। মানুষকে যদি ফেরেশতার আদলে পরিমাপ করতে যান তাহলে আপনি বোকা পাবলিক। ভালো এবং খারাপ গুণের সমন্বয়ে মানুষ এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্ট। কাউকে ভালোবাসলে তার সমগ্র সত্তাটাকেই ভালোবাসা উচিত। আপনি যদি তার পজেটিভ সত্তাটা ভালোবাসেন তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি স্বার্থপর। ”
ফারজানা কনফিউজড হয়ে বলল,
–” মিস্টার চৌধুরী লাড্ডুকে সবার সামনে অপমান করেছেন।নিজেকে অন্য নারীর স্বামী দাবি করেছেন। এরপরও প্রিমার ক্ষমা করতে না চাওয়াটা কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা স্বার্থপরতা? ”
ইশতিরাজ স্মিত হেসে বলল,
–” মিসেস লাড্ডু নিজের অবস্থানে একদম ঠিক আছেন। একটা সম্পর্কে ভালোবাসার চাইতেও সম্মানটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সমস্যা হলো উনি অভিমানের চাইতে জেদকে বেশি পাত্তা দিচ্ছেন। ”
ফারজানা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–” কীভাবে? ”
ইশতিরাজ লম্বা শ্বাস টেনে গম্ভীর গলায় বলল,
–” মিসেস লাড্ডু আরশিয়ানকে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু আরশিয়ানের বলা কথাগুলো তার অনুভূতির দেওয়ালে নিষ্ঠুর এক আঘাত হেনেছে। উনি বর্তমানে ইমোশনালি ইমব্যালেন্সড কারণ এই অযাচিত ধাক্কা উনাকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। সম্মান ভার্সেস অনুভূতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজ ইচ্ছেকে অকারণে মাটিচাপা দিয়ে ফেলছেন সেদিকে উনার খেয়ালই নেই। ”
ফারজানা বিরক্ত হয়ে বলল,
–” এত পেঁচিয়ে কথা বলেন কেনো? বুঝিয়ে বলুন সবটা। ”
ইশতিরাজ মৃদু হেসে আড়মোড়া ভেঙে বলল,
–” বর্তমানে আপনার লাড্ডু চায় আরশিয়ান তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুক এবং অনুভব করুক বিগত দুই মাসের অসহ্য একাকীত্বের যন্ত্রণা কিন্তু সমস্যা হলো যে আরশিয়ান উনার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এটা স্বীকার করতে উনি একদমই চাইছেন না। উনি চাইছেন আরশিয়ান উনার কমতি বুঝুক। নিজের অনুভূতি বিশ্লেষণ করতে শিখুক এবং সর্বোপরি উনাকে ভীষণ ভালোবাসুক কিন্তু জেদের বশে সোজাসাপটা সেটা না বলে উনি বিচ্ছেদের প্রসঙ্গ তুলছেন। ”
ফারজানা হতভম্ব হয়ে বলল,
–” আমি যতটুকু প্রিমাকে চিনি সে কখনোই তার আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করবে না। ”
ইশতিরাজ বিরক্ত হয়ে বলল,
–” আত্মসম্মানের গানটা বন্ধ করে আগে বাস্তবতা বুঝেন। আল্লাহ মানুষকে.. মুখ দেখে কুন্ডলী পড়ে ফেলার মতো চমৎকার সক্ষমতা প্রদান করেননি সেটাও মাথায় রাখা উচিত আপনাদের। সেই ভিডিওটা সম্পূর্ণ রিয়েল এটা যাচাই করার পরই প্রিমাকে দোষ দেওয়া হয়েছে। ছাদ থেকে পড়ে নীহা মরেছে এমনটা জানানো হয়েছিল সুতারং এখানে শানকে দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। ”
ইশতিরাজ সামান্য থেমে আবারও বলল,
–” এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। আরশিয়ানের জীবনে প্রথম প্রেম হলো নীহা। স্ত্রীর প্রতি কতটা স্বচ্ছ অনুভূতি থাকলে আটটা বছর একটা পুরুষ একলা জীবন পার করে সেই আইডিয়া আছে আপনার? আরশিয়ান যখন জানতে পারে নীহা কে মার্ডার করা হয়েছে তখন থেকে সে পাগল এর মতো খুনিকে খুঁজছে কিন্তু ক্লু না থাকায় সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ ঘোষিত হয়। শুধুমাত্র নীহার ভ্রম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শানকে কত-শত সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তার সাক্ষী একমাত্র আমি।শান যখন জানতে পারে নিজের অতীত ভুলে যেই নারীর সাথে ভবিষ্যত সাজানোর পরিকল্পনা করছে সেই নারী তার প্রথম প্রথম প্রেমের খুনি তখন তার ভায়োলেন্ট হয়ে উঠাটা খুব অযৌক্তিক কিছু?
ফারজানার মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। সে প্রিমার বিষয়টাই কেবল আমলে নিয়েছিল। শানের দিকটা বোঝার চেষ্টাও করেনি কিন্তু ঘটনাতো এক পাক্ষিক হয়না কখনো। বেচারা কতটা সাফার করছে সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে তার। ইশতিরাজের প্রশ্নের জবাবে ফারজানা ধীর কন্ঠে বলল,
–” উঁহু । ”
ইশতিরাজ পুনরায় গম্ভীর গলায় বলল,
–” সেই মোমেন্ট দাঁড়িয়ে একজন স্ত্রী হিসেবে মিসেস লাড্ডুর উচিত ছিলোনা ওকে না রাগিয়ে ঠান্ডা মাথায় সবটা খুলে বলা? আরশিয়ান আগেই ভায়োলেন্ট হয়ে যায়নি মিস জানা। আপনার লাড্ডুর কোল্ড বিহেভিয়ার তাকে বাধ্য করেছে ভায়োলেন্ট হতে। আমি আরশিয়ানকে নির্দোষ বলছিনা। নিজের স্ত্রীকে তার অধিকার নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা অবশ্যই অন্যায় কিন্তু তাকে সেই পর্যায়ে উপনীত করার জন্য মিসেস প্রিমাও কিন্তু দোষী৷ আবেগের বশবর্তী হয়ে বলছেন আরশিয়ানের উচিত ছিলো প্রিমাকে বোঝা। আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি। একজন স্ত্রী হিসেবে মিসেস প্রিমা কতটুকু আরশিয়ানকে বুঝেছে? মিসেস প্রিমা জানেন না আরশিয়ান কেমন ব্যক্তিত্বের মানুষ? কথা ধরে অভিমান করার আগে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ব্যপারটা সমাধান করা যেতে পারতো না? হুঁশে ফিরে নিজেকে নীহার দাবি করলেও বেহুঁশ অবস্থায় কেবল আপনার লাড্ডুর নাম জপেছে মাতাল আরশিয়ান। লোকে বলে মাতালেরা নাকি মিথ্যা বলেনা। আপনার বোন দ্বিতীয় বিষয়টা ধরে সরাসরি বিচ্ছেদ বেছে নিচ্ছে তাহলে প্রথম বিষয়টার জন্য সংসার করার সিধান্ত নিচ্ছে না কেনো? ”
ফারজানা প্রত্যুত্তর করতে পারেনা। একটা যুক্তিও অযৌক্তিক নয়। আরশিয়ানের দোষ থাকলেও সে বিচ্ছেদের মতো ভয়াবহ শাস্তি ডিজার্ভ করেনা। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেমন যেনো। কিছু একটা মনে পড়তেই ফারজানা শুধাল,
–” মিস্টার চৌধুরী ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে সেটা কীভাবে বুঝলেন?”
ইশতিরাজ ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিলো,
–” এতকিছুর পরও শুধুমাত্র শানকে একপলক দেখার জন্য বিগত দুইমাসে উনি বহুবার বেলকনি থেকে উঁকি দিয়ে পার্কিং এরিয়ায় তাকিয়ে থাকতেন। উনার ফোনের সার্চ লিস্টের সর্বত্র আরশিয়ানের নাম বিচরণ করছে। কখনো উনার ভয়েস শোনার ইচ্ছে হলে শান এর অফিসের রেকর্ডেড প্রেজেন্টেশন গুলো দেখে কান্না করতেন উনি। এসব কী নির্দেশ করে? ”
ফারজানার মাথা হ্যাঙ হয়ে যায়। ইশতিরাজের কথার বিপরীতে বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আসে। এত কমপ্লিকেটেড ব্যপারটা আদৌ ঠিকঠাক ভাবে সমাধান হবে তো? শেষ পর্যন্ত গিয়ে প্রিমা সুখী হবে তো? ফারজানা থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। অযাচিত ভাবনায় মস্তিষ্ক তোলপাড়।
এরপর আর কোনো কথা হয়না। দু’জনে নিজের মতো করে নাস্তায় মনোনিবেশ করে। ফারজানা খাওয়ার সময় খেয়াল করে ডালে একটাও মশলা কিংবা মরিচ নেই। বিষয়টাতে একটু খটকা লাগলেও ফারজানা কিছুই বললো না। খাবার শেষ হতেই প্লেট রাখতে গিয়ে দেখলো তার ডালের সব মশলা আগে থেকেই বেছে ফেলে দেওয়া হয়েছে অথচ ইশতিরাজ নিজের ডালের একটা মশলাও ফেলেনি উল্টো খাওয়ার সময় বড্ড বিরক্তি নিয়ে সেগুলো সরিয়ে সাইডে রাখছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত যত্নটুকু ফারজানার মনে দাগ কাটে। মাঝেমধ্যে সে আসলে ইশতিরাজ চরিত্রটকে বুঝতে পারেনা। ফারজানাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাজ একটুকরো ডাল মাখানো পরোটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–” আমার খাবারের দিকে নজর কেনো দিচ্ছেন লাড্ডুর আম্মা? ”
ফারজানা থতমত খেয়ে পরোটার টুকরোটা মুখে পুরে বলল,
–” আমি নজর দিইনি। আমি তো জা…
ইশতিরাজ তার ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা ডালের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,
–” আপনাকে এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না ম্যাডাম। আমি জানি আপনার সাথে তর্কে ইহজীবনে আমি জিতবো না সো আই সারেন্ডার বাট নিজের প্রতি একটু যত্নশীল হোন নয়তো অন্য কেউ খুব বাজে ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। ”
ফারজানা তার কথার মানেটা বুঝতে পেরে শিউরে উঠে। সে অস্ফুটস্বরে বলে,
–” এসব কোন ধরনের সতর্কবার্তা? ”
ইশতিরাজ স্মিত হেসে বলল,
–” এডাল্ট ডিসক্লেইমার ম্যাডাম৷ বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? বর্ণনা সহ বিস্তারিত বুঝিয়ে দিবো? ”
ফারজানা হতভম্ব কন্ঠে বলল,
–” একদমই না। চুপ করুন এবং চোখ সরান। ”
ইশতিরাজ হু হা করে হেসে বলল,
–” মিস লাজরাণী.. আপনার সেন্স অব হিউমার দেখে আমি শিহরিত। যাক.. আমার কষ্টটা একটু কমলো। এটলিস্ট হাতে কলমে সবকিছু বুঝাতে হবে না এটাই ঢের বেশি। ”
ফারজানা স্তব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমতা আমতা করে বলল,
–” কী মিন করতে চাইছেন আপনি? ”
ইশতিরাজ স্থবির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–” আপনার সাথে সংসার করতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে মিন করেছি আমি। বুঝেও না বোঝার ভান কেনো করছেন আপনি? ”
ফারজানা থতমত খেয়ে বলল,
–” এটা অসম্ভব। নিষেধ করার পরও এসব টপিকে কথা বলছেন কেনো আপনি? ”
ইশতিরাজ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
–” আপনার নিষেধাজ্ঞা মানতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে নাকি মিস জানা? ”
ফারজানা এবার কঠোর গলায় বলল,
–” আমার প্রসঙ্গে আপনি কতটুকু বলবেন কিংবা কতটুকু স্কিপ করবেন সেটা বলার রাইট আমার অবশ্যই আছে। ”
ইশতিরাজ ম্লান হেসে শুধাল,
–” এটা অসম্ভব কেনো? ”
ফারজানা না পারতে এবার বলেই ফেলল,
–” আপনাকে দেওয়ার মতো কোনো আমানত আমার কাছে অবশিষ্ট নেই। প্রেমের মোহে ডুবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম এক কাপুরুষের কাছে। সুযোগ বুঝে সে প্রতারণার ফাঁদ গুটিয়ে পালিয়েছে কিন্তু আমার কলঙ্ক স্রেফ আমারই রয়ে গেছে। আর কোনো রিজন লাগবে? ”
ফারজানার শরীর কাঁপছে। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে বেচারি। ইশতিরাজ তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
–” শান্ত হয়ে কথা বলুন। ”
ফারজানা কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিজেকে একটু শান্ত করতেই ইশতিরাজ ঠান্ডা স্বরে বলল,
–” ভালোবাসা পেতে হলে সতীত্ব অক্ষুণ্ণ থাকতে হবে এমনটা আমি কোথাও পড়িনি। তথাকথিত সমাজের রুলসে ব্যপারটা ইনক্লুডেড হলেও আমি বাল দিয়েও মানিনা ওসব ভণ্ডামি। একটা মানুষের পাস্ট থাকলে তার বর্তমান সুন্দর হইতে পারবে না এমন মূর্খ নীতি কোন হ্লার্পুত বানাইছে? ”
ইশতিরাজের এই রুপের সাথে ফারজানা পরিচিত নয়। খানিকটা সময় নিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠল,
–” আমি ধর্ষিত হয়নি। স্ব ইচ্ছায় কলঙ্ক কুড়িয়েছি। আমার প্রতি মানুষের সম্মানবোধ থাকাটাই উচিত নয় সহমর্মিতা কিংবা ভালোবাসা তো দূরের বিষয়। ”
ইশতিরাজ আলতো হেসে বলল,
–” আবেগের বশবর্তী হয়ে বিবেক হারিয়ে ফেলাটা আমি সমর্থন করিনা কিন্তু একতরফা দোষ দিলেই কেবল সুবিচারক হওয়া যায় না মিস জানা। আপনি কেনো কাজটা করেছিলেন বলেন তো? শুধুমাত্র আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে আঁটকে রাখার জন্য। যে মানুষটার আগাগোড়ায় কেউ নেই সে তার ব্যক্তিগত মানুষটাকে আগলে রাখার জন্য কলঙ্কিত হয়েছে। এখানে আমি দোষের কিছু দেখছিনা শুধু অনুভব করতে পারছি বোকা রমণীর একপাক্ষিক বৃথা প্রচেষ্টা। ”
ফারজানা হার মেনে বলল,
–” এসব জাস্ট দুদিনের মোহ। ক’দিন যাক। নতুন কাউকে পেলে ওসব ঠুনকো অনুভূতি জানালা দিয়ে পালাবে। ”
ইশতিরাজ কঠোর গলায় বলল,
–” সবাই তূর্জয় শাকিল চৌধুরী নয় মিস জানা। ”
ফারজানার বুক ধ্বক করে উঠে। কতদিন পর নামটা শুনলো তার হিসেবে নেই কিন্তু অন্তঃপুরে নিরাসক্তি ব্যতীত অন্য কোনো অনুভূতি ধরা দিলো না। বেচারি কাঁপা স্বরে বলল,
–” আপনি এসব জানলেন কীভাবে? ”
ইশতিরাজ পেপারওয়েট টা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
–” আমার কলিজার উপর যার এককালীন রাজত্ব ছিলো তার খোঁজ খবর নেওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু? ”
ফারজানা আতঙ্কিত স্বরে বলে,
–” অহেতুক পাগলামি করছেন আপনি। ”
ইশতিরাজের হাতটা থেমে যায়। ফারজানার ঘর্মাক্ত মুখশ্রীর অবলোকন করে ফাঁকা ঢোক গিলে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
–” ভালোবাসি আপনাকে। ”
ফারজানা আঁতকে উঠে বলে,
–” ঘৃণা করি শব্দটাকে। ”
ইশতিরাজ ব্যকুল কন্ঠে বলল,
–” ভালোবাসা গ্রহণ করতে হবে না শুধু আমার হয়ে যান। আমি একবারও ভালোবাসার আর্জি জানাবো না কেবল নিরবে নিভৃতে আপনাকে অনুভব করাবো।
ফারজানা দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে উন্মাদের মতো বলে,
–” কখনোই না। ”
ইশতিরাজ কন্ঠে আকুতি মিশিয়ে শুধল,
–” আপনার পাস্ট ব্যতীত এই ব্যক্তি ইশতিরাজকে রিজেক্ট করার কোনো স্পেসিফিক রিজন আছে? যদি থাকে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি সেই রিজনটা মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিস করে দিবো আমি কিন্তু আমার আপনাকে চায়। ”
ফারজানার মাথায় তখন কেবল এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার প্ল্যান ঘুরছে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর ভীষণ শান্ত কন্ঠে ফারজানা বলল,
–” আপনি একজন সিঙ্গার এবং তার পাশাপাশি টুকটাক মডেলিং করেন। যার ফলস্বরূপ আপনাকে হাজারটা মেয়ের সান্নিধ্যে যেতে হয়। এই একটা বিষয় যথেষ্ট নয় আপনাকে রিজেক্ট করার জন্য? ”
গান ইশতিরাজের প্রাণভোমরা। প্রফেশন হিসেবে সবসময় ওটাকেই সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছে সে।কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তার প্রফেশনের কথা তবে সর্বপ্রথম সে নিজেকে সিঙ্গার দাবি করে। তার অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা বিষয়টাকে নিয়ে ফারজানার আপত্তি দেখে কলিজা ছিঁড়ে আসে রীতিমতো। ইশতিরাজ হতভম্ব কন্ঠে বলে,
–” কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের সান্নিধ্যে যাওয়া আর পরকীয়া করা সেম বিষয় নয় মিস জানা। ”
ফারজানা ধরে আসা গলায় বলল,
–” ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমার অবস্থাও একই। ”
ইশতিরাজ নিশ্চুপে কিছুক্ষণ ভাবে অতঃপর ম্লান হেসে নিরব কন্ঠে বলে,
–” আমি ইশতিরাজ চৌধুরী আপনাকে কথা দিচ্ছি ম্যাডাম লাস্ট একটা কন্সার্টে বিদায় সম্ভাষণ নিয়েই এই সিঙ্গিং ক্যারিয়ারের ইতি টানবে আমি। অতঃপর আমার কন্ঠনালি নিঃসৃত প্রত্যেকটা গান ও গিটারের সুর আমৃত্যু কেবল আপনাকেই উৎসর্গ করে গাইবো। এবার বলুন আমার এই বক্ষ নামক দূর্গের একমাত্র ঘরণী হবেন মিস জানা? ”
ফারজানা আঁতকে উঠে রীতিমতো। তিরতির করে কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। ইশতিরাজ তার অবস্থা বুঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে তার পাশের চেয়ারে বসে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
–” এখুনি উত্তর লাগবেনা। যতোটা দরকার ততোটা সময় নিন কিন্তু দিনশেষে আমার নগ্ন বক্ষে আপনার অনাবৃত দেহটা আগলে নেওয়ার অধিকার আমার চাই মানে চাই। ”
ফারজানা বিষম খেলো। মুখের পানি ছিটকে গিয়ে ইশতিরাজের উপর গিয়ে পড়লো। ইশতিরাজ চোখ বুঁজে ব্যপারটা হজম করে নিলো। ফারজানা এদিক ওদিক চেয়ে সেখান থেকে বেরোনোর বাহানা খুঁজতে লাগলো। পরিশেষে টেবিলের উপর আধখোলা খাবারের আলাদা পোর্শন টুকু দেখিয়ে প্রশ্ন করল,
–” ওটা কার জন্য রেখেছেন? ”
ফারজানার টপিক ঘোরানোর ব্যপারটা বেশ ভালোমতো বুঝলো ইশতিরাজ। সে আর ফাজলামি না করে সহজ গলায় বলল,
–” আরশিয়ান কাল রাত থেকে না খাওয়া। কখন জানি প্রেশার বাবাজি লাল সালাম দিয়ে বসে তার ইয়ত্তা নেই। ডক্টরের কেবিন থেকে বেরোলেই ওকে খাওয়ানোর যুদ্ধে নামবো তাই অস্ত্র সাজিয়ে রেখেছি।”
ইশতিরাজের কথায় বেশ হাসি পেলো ফারজানার। আরশিয়ান আর তার সম্পর্কটা চমৎকার। ইতিউতি চেয়ে ফারজানা আমতা আমতা করে বলল,
–” আপনি তাহলে আপনার বন্ধুর সেবাযত্ন করুন আমি বরং আমার লাড্ডুর কাছে যাই। ”
কথাটুকু বলেই ফারজানা উঠে চলে যেতে নিলে ইশতিরাজ তার লম্বা চুলের বিনুনি ধরে আঁটকায়। ফারজানা পিছু ফিরে শ্রাগ করে বলে,
–” টিজ্ করছেন? ”
ইশতিরাজ চেয়ারে সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে পেছনে হেলে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিল। মুখে তার মৃদু হাসির ছটা। ফারজানার কথার প্রত্যু্ত্তরে দৃঢ় কন্ঠে সে বলে উঠল,
–” আপনার মুখাবয়বের কোথাও ভয় কিংবা অস্বস্তির ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না মিস জানা। তাহলে এটা টিজিং হলো কীভাবে? ”
ফারজানা এগিয়ে এসে ইশতিরাজের শক্তপোক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
–” আপনি একটা ডাকাত। ”
ইশতিরাজ বাঁকা হেসে বলল,
–” তাহলে আপনার পবিত্র হৃদয়টা ছিনিয়ে নিই? ”
ফারজানা থমকে গেলো। ইশতিরাজের কৌতূহলী মুখপানে চেয়ে বলল,
–” ওটা কবেই কাঠিন্যতার কবলে পড়ে পাথুরে অবয়ব ধারণ করেছে। মরিচাধরা মূল্যহীন জিনিস ছিনলে আপনার বিন্দুমাত্র লাভ হবে ডাকাত বাবু। আপনি বরং জহরতের খোঁজ করুন। ”
ইশতিরাজ তার কথা শুনে আলতো হেসে বিনুনি ধরে সজোরে টান দেয়। বেচারি ফারজানা হুমড়ি খেয়ে ইশতিরাজের বুকের উপর আছড়ে পড়ে। ফারজানা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালে ইশতিরাজ তার চোখে চোখ রেখে ধীর স্বরে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে,
–” আমি পাথরে ফুল ফোটাবো,
শুধু ভালোবাসা দিয়ে! ”
চলবে?