শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-২৬

0
14

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৬

ড্রয়িংরুমের বিশাল সোফায় গা এলিয়ে চোখবুঁজে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে আরশিয়ান। চিন্তায় অস্থির লাগছে তার। সংসারটা বোধহয় এবার আর বাঁচানো যাবে না।জোরপূর্বক কী সম্পর্ক টেকানো যায়?এমনিতেই অতীতের ঘটনার জন্য প্রিমা তেমন একটা কথা বলে না।আজকের স্বীকারোক্তির পর আদৌ তার মুখ দর্শন করবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আরশিয়ান।

বুকের ভেতরটা অসহ্য অনুভূতিতে দগ্ধ হচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে বিশ্রী অনুভূতির আলোড়ন দমানোর চেষ্টা করল আরশিয়ান।মস্তিষ্কে চলমান অযাচিত হাজার ভাবনা। আচমকা ইশতিরাজকে দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে আরশিয়ান হতভম্ব হয়ে গেলো। পেছন থেকে জোরালো কন্ঠে শুধাল,

–” কোথায় যাচ্ছিস তুই? ”

ইশতিরাজ পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ছুটতে ছুটতে গলা উঁচিয়ে বলল,

–” আমার না হওয়া বউয়ের কাছে যাচ্ছি দোস্ত..

ইশতিরাজের বলা বাকি কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আরশিয়ান অবাক হলো। কিছুক্ষণ অহেতুক দোনোমোনো করে নিজেও ঘরের দিকে এগোলো। ভেতরে ঢুকে দেখলো প্রিমা বারান্দায় বসে আছে। হাওয়ার তোড়ে তার কেশরাশি এলোমেলো ভাবে উড়ছে। আরশিয়ান শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকে অবলোকন করে ফাঁকা ঢোক গিললো।সাহস করে প্রিমার সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিতেই প্রিমা চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। আরশিয়ান আমতা আমতা করে বলল,

–” প্রচুর বাতাস বইছে। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। ঘরে চলে আসলে হয় না? ”

প্রিমা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল। আরশিয়ান ভড়কে গিয়ে বলল,

–” অনেকক্ষণ যাবত বসে আছেন তাই বললাম আরকি। ”

প্রিমা কাট কাট গলায় বলল,

–” আমি হেঁটে যেতে পারবোনা। ”

আরশিয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে আমতা আমতা করে শুধাল,

–” আমি কোলে করে নিয়ে যাবো? ”

প্রিমার কেনো জানি আচমকা প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। আরশিয়ান কী ছোটো বাচ্চা নাকি? তাকে হাতে কলমে সব শিখিয়ে দিতে হবে? একটু সময় নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরশিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রিমা বলল,

–” বাজারে গিয়ে ইমিডিয়েটলি ফাদার্স হরলিক্স কিনে আনেন। কিনে আনার পর রোজ তিনবেলা নিয়ম করে খাবেন ঠিকাছে ? ”

আরশিয়ান বিভ্রান্ত হয়ে গম্ভীর মুখে শুধাল,

–” আপনি কী আমায় অপমান করলেন? ”

প্রিমা মেকি রাগ দেখিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

–” একদমই নয়। সতীনের জামাইকে অপমান করার সাহস আছে নাকি আমার? আমি তো কেবল আপনার বুদ্ধিহীন মস্তিষ্কের জন্য উপযুক্ত মেডিসিন সাজেস্ট করলাম। পছন্দ হয়নি ?”

কথাটুকু বলেই হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকলো প্রিমা। শান কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবলো,

–” রাজের সাইকোলজি ক্লাসের পরপরই আমার ওয়াফির মেজাজে সমস্যা দেখা দিলো কেনো? ”

আবহাওয়া বেশ খারাপ। বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। প্রিমা বেলকনিতে উঁকি দিয়ে দেখলো আরশিয়ান রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিমা দৃশ্যটা দেখে ভেঙ্গচি কেটে মনে মনে বলল,

–” বিচ্ছেদের বিরহে চোখমুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে আছে তবুও বেডার ভাব যায় না। বউকে ভালোবাসে না মানে? তার তিন বাচ্চার আম্মাকে ভালো না বেসে বান্দা কোথায় যায় আমিও দেখবো। ”

_

প্রথম ফ্লোরের সিঁড়ি ভেঙে অবশেষে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল ইশতিরাজ। ঝটপট নেমে আসার দরুন সে হাঁপাচ্ছে। শরীর বেয়ে নির্গত হচ্ছে স্বেদজল কিন্তু সেসবের দিকে তার কোনো ধ্যান নেই। মস্তিষ্কে চলছে কাউকে আসন্ন ঝড়-ঝাপটা থেকে আগলে নেওয়ার চিন্তা। অধৈর্য হয়ে লিফটের বাটনে প্রেস করতেই তা কয়েক সেকেন্ড বাদে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে এসে থামে।

লিফটের দরজা খুলতেই ইশতিরাজ থমকে যায়। ভেতরে জড়সড় হয়ে লিফটের দেওয়াল আঁকড়ে ফারজানা দাঁড়িয়ে আছে। বেচারিকে ভীষণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। জোরেশোরে শ্বাস টানার ফলস্বরূপ বুকটা হাঁপড়ের ন্যায় ওঠানামা করছে। অতিরিক্ত কান্নার কারণে মেয়েটার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে লেপ্টে আছে।

এহেন অসহনীয় দৃশ্য ইশতিরাজের সহ্য হলোনা। সে একটু এগিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে ফারজানার হাতের কব্জি ধরে তাকে লিফট থেকে বের করলো। মেয়েটা যেনো একটা ঘোরের মাঝে আছে। ইশতিরাজ ধীর স্বরে ডাকে,

–” মিস জানা? আর ইয়্যু ওকে? খুব বেশি খারাপ লাগছে ? ”

ফারজানা প্রত্যুত্তর করেনা।কেবল অশ্রুভেজা চোখে ইশতিরাজের দিকে তাকায়। এতেই যেনো রাজের কলিজা ছিঁড়ে আসে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে রাজ পুনরায় শুধায়,

–” বাসার চাবি কোথায়? ”

ফারজানা কোনোমতে তার হ্যান্ডব্যাগের দিকে নির্দেশ করে। ইশতিরাজ দেরি না করে চটজলদি ব্যাগ হাতড়ে চাবি খুঁজে অতঃপর ঘরের দরজা খুলে। ফারজানা ততক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীরে একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। রীতিমতো টলছে সে। দরজা খুলতেই ফারজানাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ইশতিরাজ।

ভেতরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফাতেই ফারজানা ধপ করে বসে পড়লো। শীর্ণ শরীরটা আতঙ্কে তিরতির করে কাঁপছে। ইশতিরাজ মেইন ডোরটা সম্পূর্ণ খোলা রাখলো। সে চায় না হুঁশে ফেরার পর ফারজানা একটুও অস্বস্তি বোধ করুক। ফারজানার দিকে তাকাতেই ইশতিরাজ দেখলো বেচারি থরথর করে কাঁপছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশতিরাজ ম্লান কন্ঠে শুধাল,

–” মেডিসিন কোথায় আছে আপনার? ”

ফারজানা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে কোনমতে বলল,

–” বেড সাইড বক্সের লাস্ট ড্রয়ারে। ”

ইশতিরাজ দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে মেডিসিন এনে ফারজানাকে খাইয়ে দিলো। মেডিসিন খাওয়ানোর পর একটুখানি সময় দিলো ধাতস্থ হতে অতঃপর ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” কঠোর হয়েও নমনীয় রয়ে গেলেন? ”

ফারজানা ক্লান্ত স্বরে বলল,

–” ব্যপারটা কঠোর কিংবা নমনীয়তার নয়। ”

ইশতিরাজ শান্ত কন্ঠে শুধাল,

–” তাহলে? ”

ফারজানা একটু থেকে অতঃপর বলল,

–” রুহের হায় কতটা ভয়ংকর হয় সেটার চাক্ষুষ প্রমাণ আমাকে থমকে দিয়েছিল। রিভেঞ্জ অফ নেচার কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দেয়না সেটার উৎকৃষ্ট প্রমাণ দেখে আমি জাস্ট খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ”

ফারজানার শরীরটা খারাপ থাকায় হাফ টাইম অফিস করে দুপুরে সিক লিভ নিয়েছিল। অফিস থেকে তার বাসার দূরত্ব মাত্র বিশ মিনিটের। সে সচারাচর হেঁটেই যাতায়াত করে। আজকেও পায়ে হেটে মোটামুটি পাঁচ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করার পর অতিরিক্ত যানজট দেখে তার ভ্রু কুঁচকে আসে।

সাধারণত সেই রাস্তাটায় কখনোই জ্যাম বাঁধে না। আজকে এমন হওয়ায় সে কিঞ্চিত অবাক হয় উপরন্তু ক’জন মানুষের উদ্ভট কথা বলতে শুনে শেষমেশ বুঝতে পারে সামনে বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং ভিক্টিম কোনো এক নেতার বউ। তবে দুঃখের বিষয় হলো সেই ভদ্রমহিলা এবং তার তিন বছরের সন্তান স্পটেই মারা গিয়েছেন।

ফারজানা যথেষ্ট শক্তপোক্ত মানুষ। এসবে তার তেমন একটা ভয় করেনা। কৌতূহল বশত সামনে এগোতেই তার কানে বাজে বহুল পরিচিত এক পুরুষালী কন্ঠের আর্তনাদ। ফারজানা দুরুদুরু বুকে সামনে আসতেই থমকে যায়। সেই কাঙ্ক্ষিত নেতা আর কেউ নয় বরং তার প্রাক্তন তূর্জয় শাকিল চৌধুরী। ফারজানার বুক কেঁপে উঠে রীতিমতো।

উদ্ভ্রান্ত তূর্জয় কোলের মধ্যে তার ছোট্ট শিশুর রক্তে মাখা নিথর দেহটা নিয়ে আহাজারি করছে। তার সম্মুখে রয়েছে চাদরে ঢাকা একটা মেয়ের লাশ। ফারজানা বুঝতে পারে এটা আর কেউ নয় বরং তূর্জয়ের স্ত্রী। যার জন্য বছর কয়েক আগে তাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল তূর্জয়। পুরো বিষয়টা দেখে মনের মনিকোঠায় দাবিয়ে রাখা এক কঠিন বাস্তবতার কথা স্মরণে আসে ফারজানার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার শ্বাস আঁটকে আসে। আশপাশ জাহান্নামের মতো মনে হয়। সে এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে।

ফারজানার কথা শুনে ইশতিরাজ পুনরায় শুধায়,

–” এখনও তূর্জয়ের যন্ত্রণায় আপনার হৃদয় ব্যথিত হয়? ”

ফারজানা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

–” একদমই নয়। ”

ইশতিরাজ এবার কৌতূহলী গলায় শুধাল,

–” তাহলে এই প্যানিক এট্যাকের রিজন কী? ”

ফারজানা কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলে,

–” সবকিছু হারিয়ে আমি যতটা আহাজারি করেছি তূর্জয় আজ তার থেকেও বেশি হাহাকার বুকে চেপে আর্তনাদ করছে। নিঃস্ব আমিটা যেই যন্ত্রণা উপভোগ করেছি নিয়তি তাকে সেই একই কষ্ট বিস্তার পরিসরে উপভোগ করতে বাধ্য করছে। দিনশেষে আমি সুখী থাকলেও প্রকৃতি তার আজন্মকালের সুখ কেড়ে নিয়েছে। ”

এতটুকু বলে সামান্য থেমে ফারজানা আবারও বলল,

–” তূর্জয়ের অবস্থা দেখে বীভৎস অতীত মস্তিষ্কে কড়া নেড়েছিল। বহুদিন পর দমবন্ধকর পরিস্থিতি গুলো স্মরণে আসার ফলস্বরূপ অসুস্থতার আগমন ঘটেছে।ব্যক্তি হিসেবে আমি দুর্বল নই। আমি একজন আত্মমর্যাদাবান নারী। আমাকে বিচলিত করতে পারার সক্ষমতা কোনো কাপুরুষের নেই। ”

ইশতিরাজ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল ফারজানার জ্বলন্ত চোখের দিকে অতঃপর ধীর স্বরে বলল,

–” প্রমাণ করতে পারবেন? ”

ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বলল,

–” প্রমাণ করার কী আছে? যেটা সত্য সেটাই বলেছি। আপনার মতো অহেতুক ফ্লেক্স নিই না আমি। ”

ইশতিরাজ স্মিত হেসে বলল,

–” তাহলে প্রমাণ করে দেখান। আপনি যদি আমার দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারেন তাহলে মেনে নিবো আপনার বক্তব্য। ”

ফারজানার রাগ হয়। বোকামি করে বলে,

–” ঠিকাছে। যথাযোগ্য শর্ত হলে অবশ্যই মানবো।”

ইশতিরাজ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

–” মাগরিবের পর তূর্জয়ের মরহুম স্ত্রী এবং সন্তানের জানাজা। আপনি যদি এই সিচুয়েশনে তূর্জয়কে ফেস করতে পারেন তাহলে আমি মেনে নিবো যে আপনি তাকে ভুলে নিজেকে আত্মমর্যাদাবান নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। ”

ইশতিরাজের কথায় ফারজানা হকচকিয়ে যায়। চমকে উঠে বলে,

–” কী বলছেন এসব। আমি কীভাবে ওখানে যাবো..

ইশতিরাজ হামি তুলে বলল,

–” তূর্জয় হারামজাদাটা ভুলবশত আমার চাচাতো ভাই হয়ে জন্মেছে। ওদের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক না থাকলেও আজকে যেতেই হবে। আমি নামক গ্রিন কার্ড আপনার সাথে থাকলে এন্ট্রি পাস পাওয়া কোনো ব্যপার না। ”

ইশতিরাজের কথা ফারজানা শুনলো কিনা কে জানে তবে শর্তের কথাটা শুনে তার মাথা ভনভন করছে। ফারজানা কোনোভাবেই চায় না তূর্জয়কে ফেস করতে। বিতৃষ্ণায় গা গুলিয়ে উঠে তার কথা স্মরণে আসলে। ফারজানা তেঁতো মুখে বলল,

–” আমি যাবো না। ”

ইশতিরাজ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

–” ঠিকাছে। ”

ফারজানা কিছুক্ষণ পর উশখুশ করে শুধাল,

–” আপনি কী আমায় ব্যক্তিত্বহীন ভাবছেন? ”

ইশতিরাজ সহজ গলায় বলল,

–” সেটাই কী স্বাভাবিক নয়? তূর্জয়ের দুঃখ সহ্য করতে পারবেন না বলেই তো যাচ্ছেন না। মনে মনে এখনো তার জন্য অপেক্ষা করেন নাকি? ”

ফারজানা রেগেমেগে অধৈর্য গলায় বলল,

–” কীসব ফালতু কথা বলছেন? একজন বিবাহিত পুরুষের জন্য আমি কেনো অপেক্ষা করতে যাবো? তূর্জয় আমার সাথে যা করেছে তার পর ওর জন্য দুঃখ পাওয়ার মতো মহান দরদী মানুষ আমি নই। ”

ইশতিরাজ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

–” তাহলে ওখানে যেতে সমস্যা কোথায়? ”

ফারজানা খানিক্ষন থেমে অস্বাভাবিক রকমের শান্ত গলায় বলল,

–” কিছু না বলা অপ্রিয় অতীত সামনে চলে আসবে। যেটা বহু বছর যাবত বুকের গহীনে অতিকষ্টে দাফন করে রেখেছি। সবটা সামনে আসলে নতুন করে কলঙ্কিত হবে আমার সত্তা। একটা ভুলের মাশুল আর কত দিবো? ”

ইশতিরাজ শান্ত কন্ঠে বলল,

–” আরেকটাবার কলঙ্কিত হয়ে যান নাহয়। আমার মন বলছে মিস জানা.. এরপর উপরওয়ালা সুখের আব্রুতে আপনাকে এমন ভাবে মুড়িয়ে দিবে যে আপনি দুঃখের সংজ্ঞা ভুলে যাবেন।”

ফারজানা চোখ তুলে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে শুধাল,

–” অতীতের স্মৃতির কী হবে ? ”

ইশতিরাজ হালকা হেসে বলল,

–” স্মৃতি?সে তো সচল মস্তিষ্কের নীরব ঘাতক এবং
ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের স্বৈরাচারী শাসক। আমৃত্যু ওটার থেকে নিস্তার পাওয়া দুষ্কর। ”

ফারজানা নিশ্চুপে শুনে। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। ইশতিরাজ উঠে বিদায় নিতে চাইলে ফারজানা বলে,

–” আমি যেতে চাই। নিয়ে যাবেন আমাকে? ”

ইশতিরাজ মনে মনে হাসে। এটাই তো চাইছিল সে। ফারজানা কে জোর করার মূল উদ্দেশ্য হলো তাকে সুস্থ করে তোলা। প্যানিক এট্যাক একটা ভয়ংকর রোগ। যতক্ষণ না একজন ব্যক্তি তার ট্রমা কাটিয়ে উঠে ততক্ষণ তার লাগাতার প্যানিক আট্যাক হতেই থাকে। এই এট্যাক হার্টের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ফারজানা যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তখন ইশতিরাজ চুপিসারে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে ফারজানার পরিচয় করিয়ে দেয়। ব্যপারটা গোপন হওয়ায় মেডিসিন কিংবা কার্যকারি থেরাপি দেওয়া সম্ভব হয়নি তবে ডক্টর তার সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং ইশতিরাজকে বলেছিলেন তাকে এক্সপোজার থেরাপি দিতে। এক্সপোজার থেরাপি মানে হলো ভিক্টিমকে তার অতীত কিংবা ট্রমার সাথে পরিচয় করানো। তখন সম্ভব না হলেও একবার যখন সুযোগ মিলেছে তখন ইশতিরাজ পিছু হটবে না। ভাবনা থেকে বেরিয়ে সে ফারজানার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” যাওয়া যাক তাহলে। ”

_

আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ির গেট পেরিয়ে ইশতিরাজের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতেই ফারজানার হৃৎস্পন্দন এর গতি বৃদ্ধি পায়। ইশতিরাজ তার বিচলিত মুখ দেখে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পার্কিং এরিয়ার দিকে যেতে যেতে বলে,

–” রিল্যাক্স। আমি আছি না? কেউ আপনাকে প্রশ্ন করার সাহসটা পর্যন্ত পাবে না। আমি পরিচয় এনাফ আপনাকে সেফ এন্ড সিকিউরড রাখার জন্য। ডোন্ট ওয়ারি ওকে? ”

ফারজানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। সাহস করে চলে আসলেও এখন তার সবকিছু অসহ্য লাগছে। ইশতিরাজ কিছু একটা ভেবে ফারজানাকে বলল,

–” বাসার কারও সাথে অহেতুক আলাপে যাওয়ার দরকার নেই। আমি জানাজায় গেলে আপনাকে আমার রুমে দিয়ে আসবো। কেউ নক করলে দরজা খোলার দরকার নেই। আপনি চাইলে একটা শর্ট ন্যাপ নিতে পারেন। আমি জলদিই চলে আসবো কেমন? ”

ফারজানা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলে,

–” আপনি যাবেন না প্লিজ। আম্ আমার দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো। ”

ইশতিরাজ ফারজানার দিকে সামান্য ঝুঁকে ধীর স্বরে বলে উঠে,

–” আমি বাঁচিয়ে নিবো আপনাকে। বৈধ অনুমতি থাকলে অবশ্য বাঁচানোর প্রক্রিয়াটাও বর্ণনা করতাম।”

ফারজানা ছিটকে সরে এসে অস্ফুটস্বরে বলে,

–” আল্লাহ বাঁচাইছে। ভাগ্যিস বৈধ অনুমতি নেই। ”

ইশতিরাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে গাড়ি পার্ক করে এসে ফারজানাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। ভেতরে প্রবেশ করতেই আগরবাতির কড়া গন্ধে ফারজানার দম বন্ধ হয়ে আসে। বিশাল রাজকীয় ড্রয়িংরুমের সর্বত্রে শোকের মাতম বিরাজমান। কান্নার চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। ফারজানা ইশতিরাজের বাহু খামচে ধরে। ইশতিরাজ ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তার অবস্থা পরখ করে ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝিতে রাখা দু’টো লাশের খাটিয়ার দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ফারজানা হাত টেনে ধরে বলে,

–” জীবন্ত কবরস্থ হওয়ার মতো যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারবোনা। দোহাই লাগে আল্লাহর। আমাকে ওখানে নিবেন না। আমি মরেই যাবো নাহলে। ”

ফারজানা ভুলভাল বকছে। ইশতিরাজ দেখলো এসি চলা সত্বেও বেচারি দরদর করে ঘামছে। লাশের দিকে নেওয়ার পরিকল্পনাটা স্থগিত করলো রাজ। ফারজানাকে ড্রয়িংরুমের রাজকীয় সোফায় বসিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করতে ছুটলো। সবাই লাশের দিকটায় ব্যস্ত থাকায় প্রথমে ইশতিরাজের উপস্থিত কেউ টের পায়নি কিন্তু পরবর্তীতে তাকে দেখে সকলে রীতিমতো চমকে উঠে। প্রায় সতেরো বছর পর বাপের ভিটায় পা পড়লো ছেলেটার।

অভিমান কী তবে কমেছে? ভুলেছে অতীত? উত্তর জানে না কেউই। তবে সকলেই ছুটে আসলেন তার কাছে। ইশতিরাজ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে সবার আদর ভালোবাসা গ্রহণ করে হাতের পানির গ্লাসটা সোফায় বসে থাকা ফারজানার দিকে এগিয়ে দিলো। তাহার এহেন কান্ডে এবার সকলের নজর এসে স্থির হয় ফারজানার পানে। কেউ কিছু বলার আগে রাজ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

–” শী ইজ মাই উডবি ওয়াইফ। কোনোপ্রকার প্রশ্ন পর্বে যাওয়ার অনুমতি নেই। এই টপিক এখানেই ক্লোজ এবার আসি মেইন টপিকে। তোমাদের বউমা মরেছে বলে আসিনি। মেয়েটা আমার মামাতো বোন বলেই দায়িত্ববোধের খাতিরে উপস্থিত হয়েছি। মরা বাড়িতে এসেছি কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যাবো। এমন কোনো অযাচিত কান্ড করো না যাতে চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা কীটের জীবনপ্রদীপ নেভাতে আমাকে বাধ্য হতে হয। ইয়্যু গাইজ নৌজ ওয়েল.. আমি কী.. আমি কে এবং আমি কী করতে পারি। ”

ইশতিরাজের এহেনও ঠান্ডা গলার হুমকিতে সবাই জমে গেলো। ফারজানার উপর যে কয়টা কৌতূহলী দৃষ্টি ছিলো সব-কয়টা নিমিষেই সরে গেলো। হুট করে ফারজানা আর্তনাদ করে উঠল। ইশতিরাজ তড়িত গতিতে তার দিকে তাকিয়ে শুধাল,

–” কী হয়েছে? ”

ফারজানা ব্যথাটা হজম করে বলল,

–” নিচে বোধহয় কাঁচ জাতীয় কিছু ছিলো। পা সরাতে গিয়ে বিঁধে গেছে। ”

ইশতিরাজের কপালের রগ ফুলে উঠে রীতিমতো। সে হাঁটু ভেঙে ফারজানার পাশে বসে তার পা হাতের উপর নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলে,

–” চৌধুরী বাড়ির কালো টাকার পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে নাকি? স্ট্যান্ডার্ড মানের স্যালারি দিয়ে ক’জন ভালো মানের গৃহপরিচারিকা রাখার সামর্থ্য হারিয়েছে ? লাইফলেস পাবলিক কোথাকার। ”

ইশতিরাজের রাগ দেখে সকলে চুপসে গেছে। লাশের দিকটায় যারা আছে তারা এখনও একদিকের খবর জানে না বলেই বাড়িতে চাপা গুঞ্জন বিরাজমান।যদি জানতো তাহলে কারও মুখ থেকে একটা শব্দ নির্গত হতো কি-না সন্দেহ। ইশতিরাজের বড় ফুপু দ্রুত ফার্স্ট এইড কীট এনে দেয়। ইশতিরাজ কাঁচের টুকরা সরিয়ে ভালোমতো ব্যান্ডেজ করে দেয়। সবাই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইশতিরাজ তাতেও বিরক্ত হয়। রাম ধমক দিয়ে বলে,

–” সার্কাস চলছে এখানে? দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনেছি আপনাদের? লাশ ওদিকে আছে। চোখে দেখেন না? অন্যের সুখে নজর দিতে পইপই করে চলে আসেন কেনো? ”

ইশতিরাজের অসংলগ্ন আচরণে মেজাজ খুইয়ে বসে ফারজানা। পারিবারিক বিষয় বলে কিছুই বলতে পারছিল না সে তবে এবার বাধ্য হয়ে বলে,

–” কী শুরু করেছেন আপনি? এখানে আসার আগে ম্যানার্স গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছেন? ”

সবাই বিস্মিত চোখে তাকাল ফারজানার দিকে। তার অবস্থা কী হবে সেটা ভাবতেই শিউরে উঠলো সবাই। তবে তাদের অবাক করে দিয়ে ভীষণ নমনীয় স্বরে ইশতিরাজ বলে উঠল,

–” আম স্যো সরি। আর হবে না। আপনাকে রুমে দিয়ে আসি? ”

সকলে ফাটা চোখে তাকাল রীতিমতো। ফারজানা ওসবের তোয়াক্কা না করে একপলক ড্রয়িংরুমের ওপর পাশে থাকা লাশের খাটিয়া দুটোর দিকে তাকিয়ে আস্তেধীরে উপরে উঠে যায়। ফারজানা কে রেখে ইশতিরাজ বেরিয়ে পড়লো জানাজার উদ্দেশ্যে।

_

ইশতিরাজের ঘরের বেলকনিটা চমৎকার। অভ্যন্তরে কোনো সাজসজ্জা না থাকলেও বাহিরের দৃশ্যটা খুব সুন্দর। নিচে থাকা সুবিশাল বাগান এবং সুইমিং পুল এর ইনফিনিটি ভিউ দেখে ফারজানার অস্থির মনটা শান্ত হয়ে এলো। তাকে রুমে বসিয়ে দেওয়ার পর কেউই আসেনি। ফারজানা নিজেও বের হয়নি।

প্রায় ঘন্টা তিনেক পেরিয়েছে কিন্তু ইশতিরাজ এখনো আসেনি। ফারজানা সিধান্ত নিয়েছি একবার ইশতিরাজ আসলেই তারা বেরিয়ে পড়বে। এখানে এসে বহুত বড় সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে দিয়েছে। আর কিছুই প্রমাণ করতে চাইনা সে। আপন ভাবনায় ব্যস্ত ফারজানার ভ্রম কাটলো এক পুরুষালী কন্ঠের করা প্রশ্নের ফলে। ফারজানা তড়িৎ গতিতে সাইডে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার সবচেয়ে অপ্রিয় অতীত। তার প্রাক্তন তূর্জয় শাকিল চৌধুরী।

ছেলেটার একটুও পরিবর্তন ঘটেনি। আগের মতোই শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহ। গমগমে পুরুষালী স্বর এবং একই ঘনসন্নিবিষ্ট চোখের আকর্ষণীয় পাপড়ি রয়েছে তবে পার্থক্যটা অন্য জায়গায়। আগে এসব কিছু ফারজানাকে মুগ্ধ করতো আর আজ কেবল অন্তঃপটে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করছে।

আলোআঁধারির মাঝে ডুবে থাকা বারান্দা রাস্তায় জ্বলতে থাকা সোডিয়াম লাইটের আলোয় হালকা আলোকিত। সেই নরম আলোয় ফারজানা স্পষ্ট দেখলো একজোড়া নিষ্প্রাণ রক্তিম চোখ অসহায় হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। ফারজানাকে নিশ্চুপ দেখে তূর্জয় পুনরায় শুধায়,

–” প্রচন্ড ঘৃণা করো আমায় তাইনা? পাপ যেহেতু করেছি সেহেতু ঘৃণাটা আমার প্রাপ্য কিন্তু এত ভয়ংকর অভিশাপ কেনো দিয়েছিলে আমায়? অন্যায় তো আমি করেছিলাম শাস্তিটা আমার সন্তান কেনো পেলো ফারজানা? ”

ফারজানা বিমূঢ় হয়ে শুনছিলো তার কথা। মস্তিষ্ক খানিকক্ষণ সময় নিলো পুরো বিষয়টা প্রসেস করতে অতঃপর বলল,

–” ঘৃণা অত্যন্ত সন্মানিত একটা অনুভূতি যেটা আপনার মতো প্রতারক ডিজার্ভ করেনা। আমি আপনাকে অভিশাপ দেয়নি বরং ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। আপনার প্রতি এতটাই বিতৃষ্ণা জন্মেছিল যে আমি চাইনি দ্বিতীয়বার ক্ষমার অছিলায় আপনি আমার সম্মুখে আসেন। আপনার স্ত্রী সন্তানের মৃত্যুটা ভবিতব্য ছিলো। এক্ষেত্রে আমার কোনো ভূমিকা ছিলোনা। অহেতুক দোষারোপ করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না। ”

তূর্জয় দেখলো ফারজানার জ্বলন্ত চোখ। কী ভীষণ বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে সেটা টের পেতেই তার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। মেয়েটার মাঝে কিশোরী সুলভ আচরণ গুলো বিদ্যমান নেই উল্টো গাম্ভীর্য ভর করেছে। ফারজানার কথার বিপরীতে তূর্জয় পুনরায় বলে উঠল,

–” আমার দৃঢ় বিশ্বাস.. তোমার রুহের হায় আমার ধ্বংসের একমাত্র কারণ। দোষটা আমি করেছিলাম অভিশাপটা নাহয় আমায় দিতে। আমার নিষ্পাপ স্ত্রী সন্তানের কী দোষ ছিলো বলো? তোমার আক্ষেপ, অভিমান এবং দীর্ঘশ্বাস আমার সর্বনাশের মূল সেটা অস্বীকার করতে পারবা? ”

ফারজানার কী হলো কে জানে। আচমকা এগিয়ে এসে সপাটে চপেটাঘাত বসালো তূর্জয়ের গালে অতঃপর আঙ্গুল উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” কী ভাবিস নিজেকে তুই? মহাপুরুষ? তোর তো পুরুষ হওয়ারই যোগ্যতা নাই। তুই ভাবলি কীভাবে যে তোর মতো পুরুষের জন্য আমার রুহ কষ্ট পাবে? অত যোগ্যতা তুই অর্জন করতে পারিসনি। তবে এটা খাঁটি সত্য যে কারও রুহের হায়, আক্ষেপ, অভিমান তোর ধ্বংসের মূল কারণ। তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে ভূমিষ্ট আগেই বিলীন হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত জানতে পেরেছিল কারও ক্ষনিকের আবেগ, কয়েক মুহূর্তের মোহ এবং অবৈধ পাপের ফসল সে। এজন্যই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং আমাকে বাচিঁয়ে দিয়েছিল আরেকটা কলঙ্কের হাত থেকে। ”

ফারজানার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ব্যথাতুর ব্যর্থতার অভিব্যক্তি। চুল খামচে ধরে ফোঁপাচ্ছে বেচারি। এদিকে তূর্জয় কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে শুধায়,

–” তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে? আম্ আমার সন্তান তোমার গর্ভে ছিলো? আমাকে জানানো হয়নি কেনো ব্যপারটা? এখন কোথায় সে? নাকি মেরে ফেলেছো ওকে?”

ফারজানা ক্রন্দনরত সুরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

–” অভিনেতা হিসেবে শীর্ষ পদক দেওয়া উচিত তোকে। কী বলেছিলি মনে নেই ? সম্পর্ক ছিন্ন করে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে হানিমুনে ব্যস্ত পাবলিক এতদিনে নিজের মৃত সন্তানের অস্তিত্ব নিয়ে ব্লেইম করছে আমাকে। তোকে জুতার মালা পরালে জুতারাই লজ্জা পেয়ে যাবে তবুও তোর মতো বেহায়া এবং অবিবেচক জীবনেও শুধরবেনা। ”

খানিকক্ষণ থেমে জোরেশোরে শ্বাস টানলো ফারজানা। ক্রমশ দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কী নিদারুণ যন্ত্রণায় বুকটা নিষ্পেষিত হচ্ছে তা বর্ণনাতীত। তূর্জয়কে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে ফারজানা পুনরায় ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল,

–” রুহের হায়ে সংঘটিত সর্বনাশের কথা বলছিলি না? মজার ব্যপার কী জানিস.. আমি তোকে ছেড়ে দিলেও তোর নিজের অস্তিত্ব তোরে রেহাই দেয়নি। তুই যেমন তার অস্তিত্বের খোঁজ রাখিসনি সে-ও তেমন তোর সুখের অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেনি। তার আক্ষেপ তোকে আজীবন পোড়াবে। তার অভিমান তোকে আজীবন কাঁদাবে। লোক ঠকিয়ে নিজে সুখে থাকতে চেয়েছিলি না? তার বদদোয়া তোর শান্তি পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে। ”

তূর্জয় যেনো পাথর বনে গেছে। ফারজানার অবস্থা তখব বেগতিক। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সে। তূর্জয় সেসব তোয়াক্কা না করে পুনরায় শুধায়,

–” আমার সন্তানকে কোথায় কবরস্থ করা হয়েছে? ”

তূর্জয়ের প্রশ্নে আচমকা ফারজানা হো হো শব্দ করে হেসে দেয় অতঃপর বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে বলে,

–” তোর মতো সুখী ব্যক্তি আমি হতে পারিনি। তিন বছরের সন্তানকে বুকে আগলে আদর করে অতঃপর বিদায় জানানোর পর তুই আক্ষেপ ঝাড়ছিস অথচ মাত্র পাঁচ সপ্তাহের ভ্রুণের আদলে থাকা সন্তানকে হারিয়েও আমাকে কান্না গিলে ফেলতে হয়েছিল। নয়তো সমাজ যেনে যেতো এক অবৈধ ফসলের গল্প। তুই কবরের খোঁজ করিস? আমি তো তার অবয়ব ও দেখিনি। শুধু দেখেছি চাপা রক্তের দলা। শেষবার তাকে আঁকড়ে ধরে একটু মমতা মিশ্রিত আদর দিতেও সক্ষম হয়নি। একদম চুপিসারে এসেছিল এবং অজান্তেই চলে গিয়েছে। ”

সামান্য থেমে ফারজানা পুনরায় হাঁপানো স্বরে বলে উঠল,

–” নির্দোষ আর দোষী ফতুয়া দিচ্ছিলি না? আমি তোকে বলি শোন। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেবল পাপীরাই অক্ষত থাকে আর পাপীদের পাপের ছায়ার অনলে দগ্ধ হয়ে নির্দোষেরা পুড়ে মরে। যেমন পাপ করেছি আমি অথচ খেসারত গুনেছে আমার ছায়ার অতলে থাকা ওই অজানা অস্তিত্বটা ঠিক তেমনই লোক ঠকিয়েছিস তুই কিন্তু আল্লাহ কেড়ে নিয়েছে তোর স্ত্রী সন্তানের জীবনটা। ”

ফারজানা আর নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারলোনা। গলগলিয়ে বমি করে ভাসালো ফ্লোর। ইশতিরাজ এতক্ষণ ঘরে বসে যাবতীয় আলোচনা শুনছিলো। ফরজানার বমির আওয়াজ শুনে ভ্রম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ফারজানাকে আগলে নেয়। ফারজানা একটুও ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। ইশতিরাজ ও না পারতে তাকে নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। ফারজানা থরথর করে কাঁপছে। থেমে থেমে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে তার শরীর। অযাচিত কতশত কথা অস্ফুটস্বরে বলছে তবে রাজ সেসবে পাত্তা না দিয়ে ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে ধীর গলায় বলল,

–” রাগ, অভিমান, আক্ষেপ, আফসোস যা ছিলো সব ঝেড়ে ফেলেছেন এবার শান্ত হোন। চোখ মেলে দেখেন আপনি কোথায় আছেন। এখানে অবস্থান করলে কোনো বিপদ আপনাকে ছুঁতে পারবে না। একটুখানি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন নয়তো আমি বেসামাল হয়ে যাবো। আপনাকে কষ্ট দেওয়া প্রত্যেকটা কারণকে নিমিষেই অস্তিত্বহীন করে ফেলবো। আপনি কী তাই চান? ”

ফারজানা খামচে ধরে আটকালো ইশতিরাজকে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে এসব দেখলেও শেষমেশ তূর্জয় প্রস্থান করে। ফারজানা তখনো অচেতন অবস্থায় লেপ্টে ছিলো ইশতিরাজের বুকে। ফারজানার গালে হাত রেখে ইশতিরাজ বারংবার তাকে ডেকে যাচ্ছিল আচমকা তার হাতে আঠালো জাতীয় উষ্ণ তরলের মতো কিছু একটা আসে। হাতটা চোখের সামনে ধরতেই দেখে টকটকে লাল তাজা রক্ত। ইশতিরাজ হতভম্ব হয়ে ফারাজানার পালস চেক করতেই কিছুটা স্বস্তি অনুভব করে।

অতিরিক্ত মানসিক চাপে পড়লে নাক কিংবা মুখ হতে রক্ত নির্গত হওয়াটা স্বাভাবিক। ইশতিরাজ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ফারজানাকে আলতো করে ডেকে বলে,

–” সব কষ্ট আজ এই পাপিষ্ঠ মহলে দাফন করে দেন। এপরপর থেকে এই সুন্দর মুখটায় কেবল সুমিষ্ট হাসি দেখতে চাই এবং হাসির পেছনের কারণটাও কেবল আমিই হতে চাই। একটু বেশিই ভদ্রলোকের ভূমিকা পালন করে ফেলেছি এবার আসল ফর্মে ব্যাক করতে হবে। আমার আপকামিং বাচ্চারা টিকিটের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ দ্যাটস হোয়াই আই হ্যাভ টু বি অ্যা লিটল অসভ্য ম্যান। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড মিস জানা। ”

চলবে।