#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৭
#প্রথমাংশ
[ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত ]
সন্ধ্যার অন্তিম প্রহর পেরিয়ে রাত নেমেছে। সময়টা প্রায় বারোটার কাছাকাছি। আয়নার সামনে বসে নিজের বেহালা চেহরাটা ঠিকঠাক করার প্রচেষ্টা করছে প্রিমা। বিগত কয়েক মাস যাবত অবহেলার ফলস্বরূপ সর্বাঙ্গে অযত্নের ছাপ বিরাজমান । মুখে নাইট ক্রিম দিয়ে এবার চুলের যত্নে মনোনিবেশ করলো সে। রুক্ষ চুলের জট ছাড়িয়ে সুন্দর
মতো তেল দিয়ে বিনুনি করতে করতে গুনগুনিয়ে গাইল,
–” যদি ভালবাসা নাই থাকে
শুধু একা একা লাগে
কোথায় শান্তি পাব কোথায় গিয়ে?
বলো কোথায় গিয়ে?
বিছানায় বসে ফোন দেখার বাহানায় চোরা নজরে সবটা অবলোকন করছিল আরশিয়ান। প্রিমাকে গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুনে কান খাঁড়া করে রেখেছিল কিন্তু গানের মানেটা বুঝতে পেরে তার মুখে আঁধার নামে।প্রিমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করাতে মনোযোগী হয় আরশিয়ান।
আচমকা তার নিউজফিডে প্রিমার একাউন্ট থেকে আপলোড করা একটা পোস্ট সামনে আসে যাতে লেখা,
— “আমার নিকট আপনি বহুল প্রতীক্ষিত অপেক্ষার শিরোনাম অথচ আপনার জীবনে আমি নিছকই এক উপেক্ষিত উপনাম।”
আরশিয়ানের বুকটা কেঁপে উঠে। প্রচন্ড খারাপ লাগায় ভারাক্রান্ত হয় হৃদয়। পোস্টটা প্রায় মাস খানেক আগের করা। কৌতূহল বশত কমেন্ট বক্সে প্রবেশ করতেই তার দুঃখ জেলাসিতে রুপ নেয়। প্রিমার আইডিতে ভালোই ফলোয়ার্স আছে তবে কমেন্ট বক্সে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের প্রেম মূলক কমেন্ট বেশি। একেকজনের রঙঢঙ মেশানো কমেন্ট পড়ে ভ্রু কুঁচকে আসে আরশিয়ানের।
কিছু একটা ভেবে প্রিমার ফেসবুক একাউন্ট এর ম্যারিটাল স্ট্যাটাস চেক করতেই তার কপালে ভাঁজ গাঢ় হয়। বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা সামলে গম্ভীর স্বরে প্রিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–” আপনার ফেসবুক আইডির ম্যারিটাল স্ট্যাটাসে ম্যারিড দেওয়া নেই কেনো? ”
প্রিমা আকস্মিক প্রশ্ন একটু অবাক হলো অতঃপর ভাবলেশহীন গলায় বলল,
–” আমি বিবাহিত ব্যাচেলার উর্ফে সিঙ্গেল তাই। ”
আরশিয়ান থমথমে কন্ঠে আবারও শুধাল,
–” তাহলে আমি আপনার কে হই? ”
প্রিমা আরশিয়ানের দিকে ফিরে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
–” রুমমেট। ”
আরশিয়ান হতভম্ব হয়ে গেলো। বলে কী এই মেয়ে।শেষমেশ এই ছিলো কপালে? ওদিকে প্রিমা শানের মুখাবয়ব দেখে মিটমিটিয়ে হাসে। মনে মনে বলে,
–” যেমন কর্ম তেমন ফল। ”
আরশিয়ান কথা বাড়ায় না। তার মস্তিষ্কে ঘুরতে থাকে ভিন্ন চিন্তা। প্রিমা আজব আচরণের পাশাপাশি আরেকটা বিষয় সে খুব ভালোমতো লক্ষ্য করেছে।আগে মেয়েটা বিশাল এক বিষন্ন ঘোরের মাঝে ডুবে থাকতো তবে ইশতিরাজের সেশনের পর থেকে এই ব্যপারটা নির্মুল হয়েছে। একদিক দিয়ে সবটা ঠিক হলেও আরেকদিক সামলাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে আরশিয়ান। প্রিমা নিজের ফ্রাস্ট্রেশন প্রকাশ করছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই।
আনমনে এসব ভাবার মাঝেই আচমকা ইশতিরাজ এর কল আসলো। মনে মনে কয়টা ভয়ংকর গালি দিয়ে কলটা রিসিভ করে বলল,
–” হবু বউ কয়টা লাত্থি দিলো সেই হিসেব জানাতে কল করেছিস? ”
ওপাশ থেকে ইশতিরাজ থমথমে কন্ঠে বলল,
–” মজার মুডে নেই আপাতত। সম্ভব হলে আন্টিকে মিস ফারজানার বাসায় আজকের রাতটা থাকতে বল। উনি হুট করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ”
আরশিয়ান চুপ করে শুনলো অতঃপর তড়িৎ বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে চাপা স্বরে বলল,
–” রাজ? ভাই আমার.. জাস্ট মিনিট কয়েক নিজেকে সামলা। আমি আসছি। ”
ইশতিরাজ কাঁপা গলায় বলল,
–” আসা লাগবে না। তুই পিচ্চির কাছে থাক। উনার এই অবস্থা সহ্য করতে পারবে না বেচারি। ”
আরশিয়ান লিফটের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে বলল,
–” এমুহূর্তে তোর আমাকে দরকার… এর বেশি আর কিছুই জানতে চাইছি না আমি। ”
ইশতিরাজ কথা বলল না। ঠোঁট কামড়ে কেবল কান্না আঁটকে রাখার বৃথা চেষ্টা করল। মিনিট কয়েকের মাথায় আরশিয়ান উপস্থিত হলো ইশতিরাজের সামনে। আরশিয়ান তার নাম ধরে ডাকা মাত্রই পেছনে ফিরে একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো আরশিয়ানকে। বেচারা আরশিয়ান পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। ইশতিরাজ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরশিয়ান ওকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিয়ে অতঃপর নরম কন্ঠে শুধাল,
–” আন্টির কথা মনে পড়ছে? ”
ইশতিরাজ সরে এসে নাক টেনে চাপা গলায় বলল,
–” নাহ্। আফসোস হচ্ছে। রাগ লাগছে। আমি জানি এসব অযাচিত অনুভূতি তবুও উনার মুখনিঃসৃত কথা গুলো স্মরণে আসলেই কলিজা ছিঁড়ে আসছে আমার। নিজেকে ব্যর্থ লাগছে ভীষণ। ”
আরশিয়ান গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
–” তূর্জয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন উনি? নতুন কোনো অতীত সামনে এসেছে? ”
ইশতিরাজ সায় জানিয়ে ধীরে সুস্থে সমস্তটা খুলে বলল। সবটা শুনে আরশিয়ানের বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ক’দিন পর সে নিজেও তিন সন্তানের পিতা হবে। একজন বাবা কিংবা মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কতটা ভয়ানক সেটা আন্দাজ করতে পেরেই তার বুক কাঁপছে। সামান্য সময় নিয়ে আরশিয়ান পুনরায় বলে উঠল,
–” সবটা বুঝলাম কিন্তু তুই কাঁদছিস কেনো? তোর গিল্টি ফিল হওয়ার কোনো রিজন আমি দেখছি না।”
ইশতিরাজ মাথা নিচু করে কাঁপা স্বরে বলল,
–” অতীতে যদি আমি উনার সঙ্গে থাকতে পারতাম তাহলে আজ উনি এতটা সাফার করতেন না। আমি অলমোস্ট হারিয়ে ফেলেছিলাম উনাকে। সময় বুঝে হসপিটালে না নিলে আমার বুকটা আজন্মকালের জন্য খালি হয়ে যেতো। নিজেকে ডক্টর হিসেবে গণ্য করতেও ঘৃণা লাগছে। ”
একজন মানসিক রোগীকে বেসিক ট্রিটমেন্ট এবং মেডিসিন না দিয়ে সরাসরি থেরাপি দেওয়া উচিত নয়। যাদের সল্প সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও যারা জটিল মানসিক রোগে ভুগেন তাদের প্রপার ট্রিটমেন্ট ছাড়া হুটহাট কোনো থেরাপি নেওয়া প্রাণঘাতী হতে পারে। ফারজানার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
কনসালটেন্টের সাথে কথা বলে ইশতিরাজ সিধান্ত নিলেও আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যাচাই করা উচিত ছিলো। উপরে সমান্য বিষন্নতা প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে এতটা ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করছিল ফারজানা সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। যার ফলস্বরূপ সেই এক্সপোজার থেরাপির কারণে ফারজানা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে তার হার্টবিটের গতি তরতর করে বাড়তে থাকে এবং তাকে হসপিটালে নেওয়ার পর প্রায় দুই ঘন্টা মতো অক্সিজেন দেওয়া লাগে।
আরশিয়ান পুরো বিষয়টা সুক্ষ্ম ভাবে বিবেচনা করে বলল,
–” দোষটা তোর নয়। মিস ফারজানা ইচ্ছেকৃত ভাবে রোগ পুষে রেখে এতটা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছেন। অতীত নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই রাজ তবে উনার বর্তমানটা সুন্দর করার চেষ্টা কর। অহেতুক গিল্ট সাইডে রেখে কনফিডেন্স গেইন কর। উনাকে রাজি করানো খুব একটা সহজ হবে না। ”
ইশতিরাজ লম্বা শ্বাস ফেলে সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। আরশিয়ানের সাথে কথা বলে একটু হালকা লাগছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে শান কে জিজ্ঞেস করল,
–” পিচ্চি ঠিক আছে? ”
আরশিয়ানের মাথাটা ফট করে গরম হয়ে গেলো। ইশতিরাজের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–” কাউন্সিলং এর নামে আমার বুঝদার ওয়াইফি কে কীসব ভুলভাল বুঝিয়েছিস? ঘরে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এমন এমন কথা বলছে যার প্রত্যুত্তর করা আমার মতো ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজটা ভালো করিসনি রাজ। ”
এতক্ষণ দুঃখের সাগরে ভাসলেও আরশিয়ানের কথায় শব্দ করে হেসে ফেললো ইশতিরাজ। মজার ছলে বলল,
–” স্বীকারোক্তি দিতে তোর সর্বাঙ্গে ব্যথা হয় এজন্যই পিচ্চিকে উন্নতমানের কার্যকারি মেডিসিন এপ্লাই করার পরামর্শ দিয়েছি। তোর অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে আমার ফ্রি-তে করা কাউন্সিলিং এর একচুয়াল বেনিফিটটা উসুল হয়ে গেছে। ”
আরশিয়ান রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। ইশতিরাজ সেটা দেখে পুনরায় শব্দ করে হেসে ফেললো। আরশিয়ান আর কিছু বললো না। ইশতিরাজ এগিয়ে গিয়ে অত্যন্ত সাবধানে জ্ঞানহীন ফারজানাকে পাজাকোলে তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। আরশিয়ান ওদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড়য়ে বলল,
–” মানুষ দুটোকে আর কষ্ট দিয়ো না খোদা। বহুত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে এবার অতন্ত ওদের প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দাও। ইশতিরাজের জন্য যদি মিস ফারজানা অকল্যানকর হয় তবে তুমি তাকে কল্যানকর বানিয়ে দাও। ”
_
সময়টা বিকালের শেষ প্রহরের। আজ ভার্সিটিতে এক্সাম ছিলো মেহরিমার। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে বউকে সারপ্রাইজ দিতে তার ভার্সিটিতে হাজির হয়েছে তাজরিয়ান। মেয়েটা তার উপর বড্ড রাগ করে আছে। এই মিছে রাগ ভাঙানোর জন্যই এত প্রচেষ্টা।
সন্ধ্যার দিকে ইশতিরাজের কন্সার্ট অনুষ্ঠিত হবে ** স্টেডিয়ামে। লোকমুখে শোনা গেছে এটাই নাকি রাজের লাস্ট কন্সার্ট। এরপর আর কখনোই তাকে স্টেজে পারফর্ম করতে দেখা যাবে না। মেহরিমা তার ডাই হার্ট ফ্যান বিধায় এই খবর শুনে নাকের পানি চোখের পানি এক করেছে এবং তাজরিয়ানের থেকে অনুমতি চেয়েছে কন্সার্টে যাওয়ার জন্য। ভিড়ভাট্টা বড্ড বেশি অপছন্দ তাজরিয়ানের এজন্যই সাফ সাফ নিষেধ করে দিয়েছিল। ব্যস এতেই মহারাণী রেগেমেগে অস্থির। দুপুরে নাকি খেয়েও বেরোয়নি।
বউয়ের আবদার রাখতেই মিটিং ফেলে তার পাগলামির সঙ্গী হতে ছুটে এসেছে তাজরিয়ান। বহু কষ্টে লাস্ট মোমেন্টে টিকিট ম্যানেজ করেছে তবে এই ব্যপারে মেহরিমা কিছুই জানে না। সবটা জানার পর বেচারির রিয়াকশন কী হবে সেটা ভেবেই হাসি পায় তাজের।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দলে দলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হল ছেড়ে বের হচ্ছে। তাজরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তার কাঙ্ক্ষিত রমণীকে খোঁজার চেষ্টায় আছে। তাকে এরকমভাবে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে ক’জন মেয়ে একটু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। তাজের মেজাজ বিগড়ালেও সিনক্রিয়েট করলো না।
কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসলো মেহরিমা। ভীড়ের মাঝে আচমকা হাতে টান পড়ায় বেচারি হকচকিয়ে উঠে কিন্তু প্রিয় পুরুষের স্পর্শ চিনতে পেরে নিশ্চুপ থাকে। লোকটা এমন ভাবে তাকে আগলে নিয়েছে যে ভীড়ের মাঝে উপস্থিত কেউই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মেহরিমার ক্লান্ত মুখশ্রীতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
তাজরিয়ান সযত্নে মেহরিমাকে পেছন থেকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে ভীড় ঠেলে বেরোনোর চেষ্টা করে।লম্বাচওড়া তাজরিয়ানের কাছে মেহরিমার নতজানু দেহটা নেহাতই ঠুনকো। তাজরিয়ানের নিঃসঙ্কোচ অভিব্যক্তি দেখে আশেপাশের ক’জন স্টুডেন্ট শিষ্ দিয়ে উঠে। মেহরিমা লজ্জায় পড়ে অস্ফুটস্বরে শুধায়,
–” আপনি এখানে এসেছেন যে ? ”
তাজরিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” তুই বাধ্য করেছিস তাই। ”
মেহরিমা অবাক কন্ঠে শুধাল,
–” আমি আবার কী করেছি? ”
মেহরিমার কোমর জড়িয়ে রাখা হাতটাই আরেকটু বল প্রয়োগ করে তাজরিয়ান বলল,
–” এই ছোট্ট মোলায়েম উদরকে ক্ষুধার্ত রেখেছিস। আমার ঘুমানোর জায়গাটার সাথেও তোর এত কিসের শত্রুতা? ”
মেহরিমা চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নির্লজ্জ লোকটার মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না। বহুকষ্টে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে মেহরিমা বলল,
–” আপনি আমার একটা কথা শুনেন না।আমার শখও পূরণ করেন না। এরপরেও আপনার শান্তির সাথে শত্রুতা করবো না বলছেন ? ”
তাজরিয়ান একপলক মেহরিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–” শত্রুতার নামে ষড়যন্ত্র মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। দিনদিন শুকিয়ে হাড্ডি মিনিস্টার হচ্ছিস অথচ নরম ফোমের বালিশ ছাড়া আমার ঘুম আসে না। ”
তাজরিয়ানের ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় মেহরিমার কাশি উঠার জোগাড় হয়। কয়েক পা এগিয়ে গাড়ির সামনে আসতেই হুট করে কোত্থেকে জানি ভার্সিটির বহুল পরিচিত এবং র্যাগিং এর জন্য ফেমাস দলের দু’জন সিনিয়র শিক্ষার্থী উপস্থিত হলো। মেহরিমা তাদের দেখা মাত্রই মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
–” আসসালামু আলাইকুম আপু। কেমন আছেন? ”
মেয়ে দু’টো বাঁকা হেসে জবাব দিয়ে কটাক্ষ করে বলল,
–” বয়ফ্রেন্ড নাকি? এরকম হাঙ্কি মাল কোত্থেকে পাইলি? আমিও তো বলি ন্যাচরালি একটা মেয়ে এত গ্লো কেমনে করতে পারে? এবার বুঝেছি তোর রুপের আসল রহস্য। ”
তাজরিয়ান ভীষণ শান্ত চোখে অবলোকন করে সামনে দাঁড়ানো মেয়ে দু’টোকে। বখাটেপনায় ছেলেদেরকেও হার মানাবে তাদের পরিচ্ছদ এবং আচরণ। স্বভাবতই রেগেমেগে ভুলভাল কিছু না করে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল,
–” নাম, ডেপ্ট এবং ইয়ারের ইনফরমেশন দে। ”
মেয়ে দু’টো কিঞ্চিত অবাক হয়ে তাকায়। সাংঘাতিক সুন্দর ছেলেটার ভাষার বিশ্রী টোন শুনে তাদের মেজাজ খারাপ হয়। একটা মেয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
–” দেশের ফেমাস শিল্পপতির মেয়ের সাথে কথা বলছিস সুতরাং ভদ্রতা বজায় রাখ। পছন্দ হয়েছে বলে প্রথমবারের মতো মাফ করলাম। ”
তাজরিয়ান বাঁকা হেসে বলল,
–” জাস্ট একটা ফোনকল অতঃপর তোর বাপ মাত্র ঘন্টা খানেকর মধ্যেই রাস্তার ফকির। সবার সামনে বেহায়াপনা প্রদর্শন করে লাভ নেই। ভদ্রলোকেরা কুকুরের উগলে ফেলা বমির দিকে ফিরেও তাকায় না। গট ইট? ”
একটা মেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–” পুরুষ মানুষ হায়েনার চাইতেও বেশি খারাপ। এক নারীতে ওদের পোষায় না। ”
তাজরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহরিমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ভীষণ শান্ত গলায় বলল,
–” রুচিশীল পুরুষেরা ঘরে সুগন্ধি রেখে নর্দমার ময়লা গায়ে মাখে না। স্লাটদের সান্নিধ্যে যাওয়া কাপুরুষের দল পুরো পুরুষজাতির জন্য কলঙ্ক কিন্তু এক নারীতে আসক্ত পুরুষ সবসময় অতুলনীয়। ”
মেয়ে দু’টো ভীষণ অবাক হয়। শিল্পপতির মেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
–” ইম্প্রেসিভ। আমার ভাবনার চাইতেও বেশি কড়া মাল তুই। এমন একটা জীবনসঙ্গী পেলে আর কী লাগে? নজর পড়েছে তোর উপর সাবধানে থাকিস।”
ওদের সামনেই মেহরিমার কপালে আলতো চুম্বন এঁকে দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে তাজরিয়ান বলল,
–” বিবাহিত পুরুষ আমি। আমার হৃদয়ে বৈধতার সিলমোহর ঠুকে দিয়ে আজন্মের জন্য কেউ একজন আমার অধিপত্য পেয়ে গেছে। কেয়ামতের আগমনের আগপর্যন্ত এই হৃদয়ে দ্বিতীয় কোনো নারী কখনোই ঠাঁই পাবে না। জান্নাতের সত্তুর জন হুরের পরিবর্তে এই পবিত্র নারীকেই সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি আমি। ”
মেয়েটা হিংসা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাল। এদিকে মেহরিমা রাগে ফুঁসছে। তাজরিয়ান পুরো পরিস্থিতি সামলাতে মেহরিমাকে টেনে গাড়ির দিকে নিতে চাইলে পেছন থেকে মেয়েটা জেদি গলায় বলল,
–” আমার জেদ কখনো অপূর্ণ থাকে না। ”
তাজরিয়ান চিল্লিয়ে উঠে বলল,
–” তাজরিয়ান জাওয়াদ চৌধুরী স্লাটদের সান্নিধ্যে যায় না। তার চাহিদা, চাওয়া- পাওয়া এবং ভালোবাসা কেবল এক নারীর জন্যই বরাদ্দ। ”
মেয়েটা আর কিছুই বললো না। তাজরিয়ান জোর করে মেহরিমাকে গাড়িতে বসিয়ে বলল,
–” রাগ করিস না সোনা। ওদের ছোঁয়া তোর গায়ে লাগুক সেটা আমি একদমই চাইনি এজন্যই মারতে দিইনি। যে হাত আমাকে ছুঁয়ে দেয় সেটা অপবিত্র হতে দিতে পারি না আমি। ”
মেহরিমা ফুঁসে উঠে বলল,
–” একদম দরদ দেখাতে আসবেন না। ওদের সেফ করেছেন আপনি। আমি সবই বুঝি। ”
তাজরিয়ান জানে বেচারি রাগের মাথায় ভুলভাল বকছে তাই পাত্তা দিলো না। সে গাড়ি চালানোতে মনোনিবেশ করে কিন্তু আকস্মিক মেহরিমার নাক টানার শব্দে তাজরিয়ান হতবাক হয়ে তাকাল। গাড়ি সাইডে দাঁড় করিয়ে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–” পাগল তুই? কাঁদছিস কেনো সোনা? ”
মেহরিমা ঝাঁঝাল গলায় বলল,
–” আমার জামাইয়ের দিকে নজর দেওয়া শাঁকচুন্নির শ্বাসরোধের কারণ হতে না পারার দুঃখে কাঁদছি। আপনার সমস্যা আছে? ”
তাজরিয়ান ভীষণ অবাক হয়। মেহরিমা স্বভাবতই ভীষণ নরম মনের অধিকারী। তার থেকে এরকম সাংঘাতিক কথাবার্তা আশা করা যায় না। তাজ একটু অবাক হলেও পরক্ষণে দুষ্টু হেসে বলল,
–” আর ইয়্যু জেলাস বউজান? ”
মেহরিমা চিল্লিয়ে বলল,
–” আমার মাথার চুল থেকে পাশের নখ সবকিছুই সাংঘাতিক ভাবে জেলাস। আপনি আমার হাসবেন্ড। আমারভালোবাসার মানুষ। আমার শখের পুরুষ। অন্য নারীর সাহস হয় কীভাবে.. আমার সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে নিজের দাবি করার? ”
তাজরিয়ান বুঝলো মেহরিমা অতিরিক্ত রেগে গেছে। বউকে শান্ত করার জন্য এক ঝটকায় সিট থেকে তুলে এনে নিজের কোলের উপর বসালো৷ মেহরিমা ছটফটিয়ে উঠলে তাজ তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে রাখে।মেহরিমা রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তাজরিয়ানকে। বেচারা তাজ অস্ফুটস্বরে বলে,
–” ব্যথা পাচ্ছি বউজান। ”
মেহরিমা দ্বিগুণ তেজী কন্ঠে বলে,
–” আমিও ব্যথিত তাই আপনিও ব্যথা উপভোগ করুন। ”
তাজরিয়ান উপয়ান্তর না পেয়ে মেহরিমার হাত দু’টো পেছনে মুড়িয়ে ধরে গ্রীবাদেশের সর্বত্র ভালোবাসার স্পর্শ মেখে দিতে দিতে বলে,
–” নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করিস না নয়তো সারপ্রাইজ ভেস্তে যাবে। ”
মেহরিমা অস্ফুটস্বরে বলল,
–” কীহ্? ”
তাজরিয়ান প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। নিজের মতো করে মেহরিমার উপর অধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করলো। খানিক্ষন পর মেহরিমা শান্ত হয়ে আসলে পুনরায় শুধাল,
–” কিসের সারপ্রাইজ? ”
মেহরিমার গলায় মুখ ডুবিয়ে রাখা তাজরিয়ান ধীর স্বরে বলল,
–” কন্সার্টে যাচ্ছি আমরা। ”
মেহরিমা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–” সত্যি? ”
তাজরিয়ান সরে এসে মৃদু হেসে বলল,
–” ইয়েস বউজান তবে এখন তুই লাঞ্চ করবি অতঃপর পুরো তিনঘন্টা ঘুমাবি। স্টেডিয়ামে পৌঁছালে আমি তোকে ডেকে দিবো। ”
মেহরিমা কথা বাড়ালো না। তাজরিয়ানের কোল থেকে সরে এসে খাবারের বক্স নিয়ে বসলো অতঃপর খাওয়া-দাওয়া শেষে সীটে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। এই গাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে, সীট পুরোপুরি বেডে রুপান্তর করা যায়। মেহরিমা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালে তাজরিয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়। মেহরিমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“মানুষ আমারে উন্মাদ বলে। তুই বল..স্বাভাবিক মানুষেরা কখনো নিখাঁদ ভাবে ভালোবাসতে পারে? পাগলরা নিজের ভালো-মন্দ বুঝে না বলেই তো অনুভূতি নামক ফাঁসির ফান্দা গলায় জড়িয়ে নিঃসঙ্কোচে বেহিসেবী ভালোবাসে। তীব্র ভাবে ভালোবাসার সক্ষমতা স্বাভাবিক নামক স্বার্থপর মানুষদের পক্ষে সম্ভব? ”
চলবে?
#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ২৭
#শেষাংশ
সন্ধ্যালগ্ন প্রহর। অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা নিলো ফারজানা। শরীর কিংবা মন কোনোটাই ভালো নেই বিধায় হেঁটে যাওয়ার চিন্তাটা মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেললো। রিকশায় উঠে আনমনে ভাবতে লাগলো গতদিনের কথা।
ইশতিরাজের বুকে জড়িয়ে নেওয়ার পর আর কী হয়েছিল সেটা একদমই মনে নেই ফারজানার।ঘুম থেকে উঠে দেখে সে তার ঘরে অবস্থান করছে। সব থেকে বেশি অবাক করা বিষয় হলো আফিয়া চৌধুরী তার সাথে ছিলেন সারারাত। জানা ঘুম থেকে উঠার পর টুকিটাকি কুশলাদি বিনিময় করে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,
–” একটা কথা বলবো মা? ”
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফারজানা কিছুটা থতমত খেয়ে নরম গলায় বলেছিল,
–” জ্বী আন্টি অবশ্যই। ”
আফিয়া চৌধুরী ফারজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কন্ঠে দরদ মিশিয়ে বলেছিলেন,
–” তুমি প্রাপ্তবয়স্ক এবং যথেষ্ট ম্যাচিউরড। একজন পুরুষের চোখের ভাষা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে সক্ষম। রাজকে তোমার কোনো দিক দিয়ে খারাপ মনে হয়? ”
বুদ্ধিমতী ফারজানা বেশ বুঝেছিল আফিয়া চৌধুরীর আসল উদ্দেশ্য। প্রত্যুত্তরে ছোট্ট করে বলেছিল,
–” সমস্যাটা তো সেখানেই আন্টি। উনি নিখুঁত কিন্তু আমার জীবনটা খুঁতে ভরপুর। ”
আফিয়া চৌধুরী স্মিত হেসে বলেছিলেন,
–” কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় মা। প্রত্যেকের জীবন কাহিনী, স্ট্রাগল, পরিস্থিতি এবং অবস্থান ভিন্ন হয়।প্রকৃত ভালোবাসা খুঁত সম্পন্ন মানুষের জীবনকে নিখুঁত সৌন্দর্যে সাজিয়ে তোলার সক্ষমতা রাখে। ”
ফারজানা নত মুখে বলেছিল,
–” প্রচন্ড ভয় হয় আন্টি। জীবনে এত বড় বোকামি করেছি যে সঠিক সিধান্ত নেওয়ার সাহসটা হারিয়ে গেছে। পুনরায় ভেঙে পড়ার ভয়ে নিজেকে কারও সাথে জড়াতে ভীষণ রকমের ভয় করে। ”
আফিয়া চৌধুরী তার মাথায় হাত বুলিয়ে নমনীয় কন্ঠে বলেছিলেন,
–” একাকীত্বের চেয়ে ভয়ংকর কিছু আর হয় না মা। জীবন তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এবার সুখের পায়রা হাজিরা দিয়েছে তোমার আঙিনায়। যদি দুঃখের সহচর ভেবে তাড়িয়ে দাও তাহলে আজন্মকাল আফসোস করতে হবে। ”
ফারজানা কথা বাড়ায়নি। আফিয়া চৌধুরী তার গম্ভীর ভাবমূর্তি দেখে বলেছিলেন,
–” জীবনটা বড্ড ছোটো। পাওয়া না পাওয়ার গল্পে পরিপূর্ণ আমাদের অভিজ্ঞতার থলি। সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিধান্ত না নিলে আমৃত্যু অপূর্ণতার আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হয় এজন্যই বলছি সময় থাকতে মনের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে শিখো। দুঃখের আয়নায় কখনো সুখ প্রতিফলিত হয় না তবে সুখের আয়নায় দু’চারটা দুঃখ উঁকি দিয়ে সুখের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়।”
ফারজানা নিরবে সায় জানায়। আফিয়া চৌধুরী তাকে নাস্তার জন্য জোরাজোরি করলে ফারজানা জানায় জরুরি মিটিং আছে এবং তার এখুনি যেতে হবে। সময় পেলে ক্যান্টিনে খেয়ে নিবে। সবটা শুনে আফিয়া চৌধুরী আর কিছুই বলেননি।
সারাটাক্ষন ফারজানা কেবল সেই কথাগুলোই ভেবেছে। তার মন মস্তিষ্কে অযাচিত অস্থিরতা বিরাজমান। সবকিছু বড্ড অসহ্য লগছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অফিসে আসার পর ব্যাগ হাতড়ে ফোন খোঁজার সময় ব্যাগে একটা টিকিটের সন্ধান মিলে। টিকিটের উপর আঁটকে থাকা ব্লু কালার স্টিকি নোটসে লেখা ছিলো,
–” আজকের কন্সার্টের গেইট পাস এটা। আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার আপনার জন্য। আজকে যদি কন্সার্টে আপনি না আসেন তাহলে আমি ভেবে নিবো আপনি আমার প্রতি উইক কিন্তু স্বীকারোক্তি দিতে ভয় পাচ্ছেন। কনফার্মেশন পেয়ে গেলে রাজ তার রাজত্ব বুঝে নিতে এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করবে না ম্যাডাম। ~ ইয়্যোর অসভ্য ম্যান।
ফারজানা মোটেও ইশতিরাজের হুমকিধামকিতে ভয় পায় না। এরূপ বাচ্চামি দেখলে তার হাসি পায় কিন্তু কেনো যেনো আজকে ইশতিরাজের আবদারটা ফেলতে পারলোনা। আকস্মিক সিধান্ত নিয়ে বসলো সে কন্সার্টে যাবে। ব্যাগ হতে মোবাইলটা বের করে একবার সময় দেখে নিলো ফারজানা। কন্সার্ট শুরু হবে রাত আটটায় আর এখন বাজে মাত্র বিকাল ছয়টা।
এখান থেকে স্টেডিয়ামে পৌঁছাতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ফারজানা কিছু একটা ভেবে রিকশা ওয়ালাকে বলল সিএনজি স্ট্যান্ডে যেতে। সিএনজি নিলে অল্প সময়ে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে।
_
প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ স্টেডিয়ামের পার্কিং লটে এসে থামলো তাজরিয়ানের গাড়িটা। মেহরিমা তখনও গভীর ঘুমে অচেতন তবে এখন না উঠালে কন্সার্ট মিস হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। যদিও পরিচিত লোক আছে তবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা তাজরিয়ানের পছন্দ নয়। সে মৃদুস্বরে মেহরিমাকে ডাকলো। বেচারি নড়াচড়া করে আবারও চোখ বুঁজে ফেললো। তাজরিয়ান উপয়ান্তর না পেয়ে ধীর স্বরে ডাকলো
–” বউজান? তাড়াতাড়ি উঠ সোনা। কন্সার্ট মিস হয়ে যাবে কিন্তু। ”
মেহরিমা চকিতে চোখ মেলে তাকিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলল,
–” কন্সার্ট মিস হয়ে গেছে? ”
সদ্য ঘুম থেকে উঠা মেহরিমা বুঝতে পারেনি তাজের কথা। তাজরিয়ান তাকে হকচকিয়ে যেতে দেখে আস্তে করে নিজের কোলের উপরে মেহরিমার ছোট্ট শরীরটা টেনে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো অতঃপর কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলল,
–” সময় আছে আরও আধঘন্টা। ”
মেহরিমা বিরক্ত হয়ে বলল,
–” তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন কেনো? জলদিই চলেন। ”
তাজরিয়ান সেসবের তোয়াক্কা না করে মেহরিমার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে মোহাবিষ্ট স্বরে বলল,
–” শর্ট ন্যাপ তোর সৌন্দর্য এতটা ভয়ংকর ভাবে বাড়িয়ে দিবে জানলে আমি তোকে ঘুমাতেই দিতাম না। তুই দিন দিন আদুরে বিড়াল ছানা হয়ে যাচ্ছিস মেহু। ”
মেহরিমা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
–” আর আপনি লাগামছাড়া কন্ট্রোললেস হয়ে যাচ্ছেন তাজ।
তাজরিয়ান বাঁকা হেসে মেহরিমার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে আরেকটুখানি নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে গলায় আলতো ভাবে রক্তিম চিহ্ন এঁকে দিয়ে বলল,
–” টাইটেল যখন দিচ্ছিস তখন আমারও তো উপযুক্ত প্রমাণ দেওয়া উচিত। তাইনা বউজান?”
মেহরিমা তাজের মুখে হাত চেপে ধরে অসহায় গলায় বলল,
–” আপনার জন্য একটাও কলার বিহীন জামা কিংবা ব্লাউজ পরতে পারিনা। আলাদা করে হিজাব ক্যারি করা লাগে। বাসায় থাকলে গলায় মধ্যে দুই তিন প্যাঁচ দিয়ে ওড়না পরতে হয়। আমার দুঃখ কী আপনার চোখে পড়েনা? আদুরে বিড়াল ছানার উপর অত্যাচার করতে আপনার একটুও খারাপ লাগে না? ”
তাজরিয়ান শব্দ করে হেসে ফেললো অতঃপর বলল,
–” এই আদুরে বিড়াল ছানার জংলী নখের আদর মাখা সিলমোহর আমার শরীরের সর্বত্র বিরাজমান। জিমে গেলেও শার্টলেস হওয়া যায় না। গরম লাগলেও স্লিভস গুটিয়ে রাখা যায় না এসব নিয়ে আমি কখনো অভিযোগ করেছি বউজান? ”
মেহরিমা অপরাধী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দু’পাশে মাথা নাড়ালো। তাজরিয়ান সেটা দেখ পুনরায় বলল,
–” তুইও এরপর থেকে এসব অর্থহীন অভিযোগ করিস না। তোর শরীরে থাকা প্রত্যেকটা চিহ্ন জানান দেয় তুই একান্তই আমার। এই চিহ্ন গুলো আমায় প্রশান্তি অনুভব করায়। ”
মেহরিমা মিছে অভিমান দেখিয়ে বলল,
–” আমি নিষেধ করলেও আপনি মানবেন না? ”
তাজরিয়ান ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল,
–“তুই হাজারবার নিষেধ করলেও সেই নিষেধাজ্ঞা আমি আমান্য করবো। নতুন উদ্যমে তোর শরীরের আনাচেকানাচে আমার ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিবো। তুই যখনই আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি দেখবি তখনই তুই অনুধাবন করবি.. শরীরটা তোর হলেও সর্বাঙ্গে কেবল আমার কর্তৃত্বের ছাপ বিরাজমান। ”
মেহরিমার মুখে লজ্জারুণ হাসি ফুটে উঠল। বলার মতো একটা শব্দও খুঁজে পেলনা। তাজরিয়ান এবার দুষ্টুমির ইতি টেনে মেহরিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্টেডিয়ামের এন্ট্রান্সে আসতেই তাদের তল্লাশি নিয়ে অতঃপর ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো। ইশতিরাজের কন্সার্টের চমৎকার একটা দিক হলো সবখানে কড়া সিকিউরিটি থাকে।
তাজরিয়ান এবং মেহরিমা সামনের দিকে কয়েক পা এগোতেই আচমকা ফারজানার সাথে ওদের দেখা হয়ে যায়। মেহরিমা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
–” আরেহ.. আপু। আপনি এখানে? ”
ফারজানা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
–” এইতো এসেছি..আরকি। ”
মেহরিমা এগিয়ে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে কিছুক্ষণ কথা বলল। মেহরিমার দেখাদেখি তাজরিয়ানও এগিয়ে এসে নম্র কন্ঠে সালাম দিয়ে বলল,
–” আপনার যদি সমস্যা না থাকে তাহলে ইয়্যু ক্যান জয়েন আস। ”
ফারজানা সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বলল,
–” ভালোই হয় তাহলে। যাওয়া যাক? ”
তাজরিয়ান মৃদু হেসে সায় জানালো। তারা তিনজনে এগিয়ে গেলো স্টেডিয়ামের দিকে। তখনও স্টেজ ফাঁকা। মাঠে ভীড় জমিয়েছে কয়েকশো মানুষ। এসব দেখে মাথা ঘুরিয়ে আসে ফারজানার। সবার উচ্ছ্বাস দেখে রীতিমতো অবাক হয় সে। মানুষটা এত বেশি ফেমাস কখনো টেরই পয়নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক তার চলনবলন। ডক্টর ইশতিরাজের সাথে সিঙ্গার রাজকে মেলাতে পারলো না ফারজানা।
_
স্টেজে ইশতিরাজের আগমন পুরো স্টেডিয়ামে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে। ইশতিরাজ ভীষণ সময়নিষ্ঠ মানুষ। তার এই অসাধারণ গুণটা দর্শকের মন কাড়ে বেশি।সাধারণ একটা ক্যাজুয়াল লুকে স্টেজে উপস্থিত হয়েছে ইশতিরাজ। সবার বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে অতঃপর হাতে মাইক নিয়ে স্মিত হেসে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–” গুড ইভনিং গাইজ্। হার্টের কন্ডিশন ঠিকঠাক? দুর্বল হলে হার্টবিটকে ঘুষ খাইয়ে হলেও কন্সার্টের শেষ অব্দিই সচল থাকার জন্য অনুরোধ করুন।”
সকলেই জানে ইশতিরাজ একজন হার্ট স্পেশালিষ্ট তাই তার প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠার বদলে সকলেই হেসে ফেললো। ইশতিরাজ সামান্য থেমে পুনরায় বলে উঠল,
–” আপনারা সকলেই জানেন এইটা আমার লাস্ট কন্সার্ট। ব্যক্তিগত কিছু রিজনে আমি এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যাচ্ছি তাই আজকের কন্সার্টটা গতানুগতিক ধারর থেকে কিছুটা আলাদা হলে আপনারা রাগ করবেন? ”
সকলেই সমস্বরে চিৎকার করে না বোধক উত্তর করলো। চারপাশে হরেকরকমের আলো ঝলমল করছে তবে আঁধারে ডুবে থাকা স্টেডিয়ামের এক কোণে অবস্থানরত ফারজানা কে ইশতিরাজ লক্ষ্য করবেনা ভেবেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো ফারজানা। বেচারি যদি জানতো তার প্রবেশের পর থেকে প্রতিটা পদক্ষেপের হিসেব রাজ রাখছে তাহলে বোধহয় লজ্জায় ছুটে পালাতো অজানায়।
ইশতিরাজ আরও কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথা বলে গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো ইশতিরাজ গান শুরু করবে ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই পুরো স্টেডিয়ামে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। একটা মানুষের জন্য কতটা সম্মান, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ও ভালোলাগা থাকলে এই অসম্ভব কাজটা ন্যাচরালি পসিবল হয় সেটা জানা নেই ফারাজানার। সে কেবল অবাক চাহুনিতে দেখছিল সবটা।
তার ভাবনার ছেদ ঘটে ইশতিরাজের বলা কিছু বাক্যে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধীমি তালে বেশ কিছু ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো হচ্ছে। পুরো স্টেজের লাইটিং পাল্টে গেছে। স্পটলাইটের নিচে দাঁড়ানো ইশতিরাজ মাইক হাতে নিয়ে নেশাতুর কন্ঠে বলে,
–” আম ডেডিকেটিং দিস সং টু সামওয়ান ভেরি স্পেশাল। হেয়ার উই গো…..
কতটা কঠিন বাঁচা তুমিহীন
আঁধারে বিলীন স্বপ্নেরা হায়
থেমে জীবন আছে এখন
বাঁচার এমন মানে কোথায়
কেন যে হায় পূর্ণতাকে
মেলালে নীল শূন্যতাতে
বলো কিভাবে রবো এভাবে
আমায় গোছাবে কে দু’হাতে
ফিরে আসো না, আর তো পারি না
বাঁচি চলো না আবার একসাথে…
গানটার শেষের দিকে ইশতিরাজের গলা কেঁপে উঠেছিল সেটা বুঝতে পেরে দর্শক মহল ভীষণ অবাক হোন। যে গায়ক স্টেজে উঠলে পুরো অডিটোরিয়াম নেচে উঠে তার এহেন অবস্থা সকলের মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটালো। একজন প্রৌঢ়া নারী নিজেকে সামলাতে না পেরে গলার সবটুকু জোর প্রয়োগ করে চিল্লিয়ে বললেন,
–” আপনার চোখের ভাষা এবং গলার স্বর ভিন্ন কথা বলছে গায়ক সাহেব। আমরা সত্যটা জানতে চাই। একজন দর্শক হিসেবে এতটুকু অধিকার আমাদের আছে নিশ্চয়ই। ”
সামনের সারি থেকে উচ্চস্বরে আসা শব্দ গুলো শুনে ইশতিরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সেই নারীর সাথে সহমত পোষণ করে স্টেডিয়ামের বাকিরা চিল্লিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে। আনমনে কিছু একটা ভেবে ইশতিরাজ ম্লান হেসে বলতে শুরু করে,
–” গান আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিন্তু গান নিয়ে অভিযোগ করা মনুষটা আমার জীবন। শর্টকাটে কারণ জানিয়ে দিলাম এবার খুশি?
স্টেডিয়ামের অপর পাশ থেকে একজন ছেলে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
–” কেউ আপনাকে ভালোবাসলে আপনার সমগ্র সত্তাটাকেই ভালোবাসবে। পজেটিভ সাইড একসেপ্ট করে নেগেটিভ সাইড নিয়ে অভিযোগ তুললে বুঝে নেওয়া উচিত.. সে আপনাকে ভালোবাসে না।”
ইশতিরাজ স্মিত হেসে বলল,
–” তিনি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন না। বিষয়টা একতরফা এবং আমি আকারে, ইঙ্গিতে এবং সরাসরি শতাধিক বার রিজেক্ট হয়েছি তবুও আশায় বুক বাঁধি এবং নিরাশায় হতাশ না হওয়ার চেষ্টা করি৷ ”
সকলেই অবাক চোখে তাকিয়ে আফসোস সূচক শব্দ করে। কেউ কেউ তো কেঁদে ফেলে রীতিমতো। সবার থমথমে অবস্থা দেখে ইশতিরাজ বলে,
–” কাম অন গাইজ্। রিজেক্ট হয়েছি আমি অথচ কাঁদছেন আপনারা। ইজ দিস্ ফেয়ার? আমার ম্যাডাম কিন্তু জেলাস হয়ে যাবে। ”
ইশতিরাজের কৌতুকপূর্ণ কথায় অনেক মানুষ হেসে ফেলে। স্টেডিয়ামের হলকা আলোআঁধারির মাঝে মিশে দাঁড়িয়ে থাকা ফারজানাও চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। ইশতিরাজ সবটা সামলাতে পুনরায় বলে,
–” আপনাদের একটা স্পেশাল অপরচুনিটি দিবো কিন্তু বিনিময়ে এসব কান্নাকাটি থামাতে হবে। আই বিলিভ দ্যাট কাঁদলে মেয়েদের ভয়ংকর সুন্দর লাগে কিন্তু সেটা কেবল আমার ম্যাডামকেই.. আর বাকি সব মেয়েদের ইয়্যু নো হোয়াট আই ওয়ান্টেড টু মিন।
কথাটুকু বলেই ইশতিরাজ দুষ্টু হাসে। পুরো স্টেডিয়ামে হাসির রোল পড়ে। ইশতিরাজ মাথা ঝুঁকিয়ে মৃদু হেসে আঁধারে লুকিয়ে থাকা তার আদরীনির দিকে তাকায়। মেয়েটা তার থেকে পালাতে গিয়ে বারংবার তার কাছে চলে আসে। বেসামাল ইশতিরাজ কীভাবে সামলাবে নিজেকে? ইশতিরাজের কথা শুনে ভিআইপি জোনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফ্যান জিজ্ঞেস করে,
–” কী অপরচুনিটি পাবো আমরা? ”
ইশতিরাজ সামান্য হেসে স্টেজের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলে,
–” আমার সাত বছরের সিঙ্গিং ক্যারিয়ারে কখনো কাউকে ইন্টারভিউ নেওয়ার অনুমতি দেয়নি আমি কিন্তু আজকে আপনারা আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। জাস্ট বিকজ অব এইটা আমার লাস্ট কনসার্ট তাই আপনাদের এতবড় একটা সুযোগ দিচ্ছি। তবে বাছাইকৃত ভাবে কেবল কিছু সংখ্যক মানুষকে এই সুযোগ দেওয়া হবে। ”
মুহূর্তের মধ্যে পুরো স্টেডিয়ামে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়। ইন্টারভিউ পর্বের শুরুতে একজন ফ্যান জিজ্ঞেস করেন,
–” ম্যাডাম যদি উত্তর দিতেন তাহলে আপনি তাকে কোন প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেন। ”
ইশতিরাজ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তার চোখমুখ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে ব্যথাতুর অভিব্যক্তি। ফারজানার অস্পষ্ট অবয়বের দিকে তাকিয়ে বুঁজে আসা কন্ঠে মোহ মিশিয়ে ইশতিরাজ বলে উঠল,
–” কেমন প্রেমে ফালাইয়া দিশেহারা করলেন আমায়… দুনিয়ার সকল ধ্রুব সত্য ছাপাইয়া আমার মনডা খালি আপনার জন্য কাতরায়। আঁখি জোড়া খালি একটাবার আপনারে দেখবার জন্য আজন্মের তৃষ্ণায় ছটফটা’য়। তবুও দিনশেষে আশ্বাসের বদলে দীর্ঘশ্বাসই কেনো সঙ্গী হয়? ”
পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে হৈচৈ থেমে গেছে। কারও মুখে ঘোর অন্ধকার আবার কারও চোখে নিরব অশ্রু।কিছু সংখ্যক মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্টেজে দাঁড়ানো ইশতিরাজের ভঙ্গুর পরিস্থিতি সকলের মনে অশনি ঝড় তুলেছে অথচ ইশতিরাজ বরাবরের মতোই শান্ত। কিছু একটা ভেবে ইশতিরাজ বলল,
–” কন্সার্টকে ইন্টারভিউ হল বানালে কতৃপক্ষ আমাকে জরিমানা করবে। লেটস চেঞ্জ দ্যা প্যাটার্ন। আপনারা প্রশ্ন করবেন কিন্তু আমার উত্তর কাব্যিক ভাষায় নয় বরং গানের ভাষায় হবে। রাজিইইই? ”
সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। একজন ফ্যান বলল,
–” গানের মাধ্যমে ম্যাডামকে প্রপোজ করতে হলে কোন গানটা গাইতেন আপনি? ”
ইশতিরাজ কীয়ৎকাল ভাবলো অতঃপর সুরেলা আওয়াজে গেয়ে উঠল,
–” তোমার চোখেই আকাশ আমার,
চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা!
ভেতর থেকে বলছে হৃদয়,
“তুমি আমার প্রিয়তমা! ”
হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠলো স্টেডিয়াম। এদিকে গান শুনে ফারজানার গাল আরক্ত হয়। আচমকা আরেকজন দর্শক জিজ্ঞেস করে,
–” আপনি যদি ম্যাডামকে নিজের ভালোবাসার দাবিতে আশ্বাস্ত করতে চান তাহলে কোন গানটা গাইবেন। ”
ইশতিরাজ হকচকিয়ে উঠল সবার বুদ্ধিমত্তা দেখে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন্ঠে মাধুরি মিশিয়ে গাইল,
–” তুমি দেখা দিলে তাই,
মনে জাগে প্রেম প্রেম কল্পনা!
আমি তোমার হতে চাই,
এটা মিথ্যে কোনো গল্প না!
গানটা শেষ হতেই করতালির আওয়াজে মুখরিত হয় স্টেডিয়াম। ইশতিরাজ সবাইকে থামিয়ে বলে উঠে,
–” এবার আমরা লাস্ট কোয়েশ্চন নিবো অতঃপর আমাদের আজকের কার্যক্রম এখানেই সমাপ্ত ঘোষিত হবে। ”
সবার মুখে আঁধার নামলো। তবে কিছুই করার নেই।যেটার শুরু আছে সেটা সমাপ্ত হবেই। একজন দর্শক খুবই উচ্ছ্বাসের সাথে প্রশ্ন করলেন,
–” আজ এই কন্সার্টে যদি আপনার ম্যাডাম উপস্থিত থাকতেন তবে ভালোবাসার আর্জি জানাতে আপনি কোন গানটা গাইতেন। ”
প্রশ্নটা শুনে ইশতিরাজের মাথায় ভিন্ন চিন্তা ভর করলো। একপলক চোরা চোখে ফারজানার দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে অভিভূত দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে আছে। আচমকা ওর মাথায় উদ্ভট এক পরিকল্পনা নাড়া দিলো।
ফারজানার মনে ইশতিরাজের জন্য একটা সফট কর্ণার আছে। রাজ জানে ফারজানা তাকে একসেপ্ট করার চেষ্টা করছে কিন্তু ইনসিকিউরিটির জন্য পারছেনা। একমাত্র স্বীকারোক্তি পারে এই রোগ দূর করতে। ইশতিরাজের মনে হলো আজ এই কন্সার্টে যদি কোনোভাবে ফারজানাকে উপলব্ধি করানো যায় যে ইশতিরাজ কেবল তার প্রেমেই উন্মাদ তাহলে হয়তো একটা সুযোগ মিলবে..
ইশতিরাজ বেশি ভাবলো না। চোখবুঁজে অন্তিম সিধান্তে পৌঁছালো। নিজের ব্যাকআপ টিমের কাছে গিয়ে দ্রুত কিছু একটা বলল অতঃপর স্টেজের শেষ মাথায় এসে কন্ঠে উচ্ছ্বাস চেপে গম্ভীর স্বরে বলল,
–“দেরিতে রেসপন্স করার জন্য দুঃখিত তবে আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে আমার ম্যাডাম এমুহূর্তে এখানেই উপস্থিত আছেন। আপনাদের অনুরোধে আকাশসম আশা নিয়ে উনার চোখে চোখ রেখে পুনরায় ভালোবাসার আর্জি জানাতে যাচ্ছি। উইশ মি বেস্ট অফ লাক। ”
উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই। সকলের মাঝে শুরু হলো কানাঘুঁষা। ফারজানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ছিলো ইশতিরাজের দিকে। বেচারি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার উপর স্পটলাইটের আলো পড়ে। মেয়েটা হকচকিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ আড়াল করে ফেলে। কেবল বিস্মিত চোখজোড়া উন্মুক্ত রয়। দর্শক মহল রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় করে উঠে।
কেউ কেউ শিষ্ দিয়ে উঠে কেউ আবার অতি খুশিতে করতালি দিয়ে বসে। দর্শকেরা ফারজানার কাছে আসার চেষ্টা করলেও সেটা সম্ভব হয়না কারণ ফারজানাকে গোল করে ঘিরে এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন গার্ড। তাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা এতোটাও সহজ নয়। ইশতিরাজ বাঁকা হেসে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে বুকে জমানো সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে নিখুঁত স্বরে গেয়ে উঠল,
–” কতটা হাত বাড়িয়ে দিলে,
তোমার মন ধরা যায়?
কতটা পথ পাড়ি দিলে,
তোমার প্রেম ছোঁয়া যায়?
পাব কি পাব না জানি না,
তোমাকে তো বুঝিনা আ আ আ আ
ইশতিরাজ খেয়াল করে ফারজানা কাঁপছে। অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। ওই চোখজোড়ার সর্বত্র বিরাজ করছে বিস্ময় এবং অজানা অনুভূতি। পরিস্থিতি বুঝে গান গাইতে গাইতেই স্টেজ থেকে নেমে ফারজানার দিকে এগোতো এগোতে স্মিত হেসে পুনরায় গাইলো,
–” তবু তোমার প্রেমে আমি পড়েছি,
বেচেঁ থেকেও যেন মরেছি।
তোমার নামে বাজি ধরেছি,ধরেছি…
ফারজানার কাছে এসে ইশতিরাজের কদম থামলো এবং গানটাও শেষ হলো। ফারজানা তখনও স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ওদিকে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে দর্শক মহল। কতজনে কত কী বলছে তবে সেসবের কিছুই বুঝতে পারছে না ইশতিরাজের মস্তিষ্ক। সে তো ডুবে আছে ফারজানার চোখের মোহে। তাকে হুঁশে ফেরাতে আচমকা কম্পনরত একটা শরীর তার বুকে আছড়ে পরে। তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে মেয়েটা। ইশতিরাজ অবাক হয়ে ফারজানার মাথায় হাত রেখে শুধায়,
–” কী হয়েছে মিস জানা? অনুচিত কাজ করে ফেলেছি আমি? ”
ইশতিরাজ বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে। ফারজানা রীতিমতো টলছে। গতদিনই এতবড় একটা ইন্সিডেন্ট ঘটলো আজকে আবার মেয়েটা শক পেয়েছে। গত দিন ডক্টর পইপই করে বলেছিল ফারজানাকে সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখতে সেখানে ইশতিরাজ প্রতিনিয়ত তর চিন্তার কারণ হচ্ছে। নিজেকে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে ইশতিরাজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–” রিল্যাক্স হোন প্লিজ। আপনার অভিযোগ, অভিমান কিংবা আক্ষেপ সবটা আমি শুনবো। আপনি যদি আমৃত্যু আমার মুখদর্শন করতে না চান তাতেও আমি আপত্তি করবো না কিন্তু প্লিজ অসুস্থ হয়ে নিজের ক্ষতি করবেন না। একটুখানি শান্…
ইশতিরাজ বাকি কথা বলার পূর্বে ফারজানা কাঁপা
হাতে তার শার্টের একাংশ খামচে ধরে ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
–” বিয়ে করবেন আমায়? এক্ষুনি.. এমুহূর্তে।
চলবে?