শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-২৯

0
16

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
২৯

মধ্যরাত পেরিয়েছে। পরিশেষে বউ নিয়ে ফ্ল্যাটের সামনে হাজির হয়েছে ইশতিরাজ। ফারজানা তো লজ্জায় গুটিশুটি মেরে দূরে পালানোর ধান্দায় আছে। ইশতিরাজ অধিকার ফলিয়ে বেঁধে রেখেছে তাকে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ফারজানার দিকে তাকিয়ে ইশতিরাজ ধীর কন্ঠে বলে,

–” রিক্ত আমিটার আপনি বিহীন কেউই নেই সুরঞ্জনা। বরণের আয়োজনটা বর্ণিল না হওয়ার আক্ষেপটা ভুলে যাওয়া কষ্টসাধ্য হবে? ”

ফারজানা নীমিলিত চোখজোড়া তুলে ইশতিরাজের দিকে তাকায়। লোকটার মুখে ম্লান হাসি দেখে জানার খারাপ লাগে। লজ্জা ফেলে কয়েক কদম এগিয়ে এসে রাজের হাত জড়িয়ে ধরে বলে,

–” বর্ণিল আয়োজন বর্ণহীন হয়ে পড়ে যদি বিপরীত পক্ষের মানুষটার মনে জাঁকজমকপূর্ণ অনুভূতির সমাচার না থাকে। বাহ্যিক সাজসজ্জাও অদরকার হয়ে উঠে ক্রমশ। আমার সাদামাটা জীবনে হুলুস্থুল আয়োজনের বিশেষ গুরুত্ব নেই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন জনাব। ”

ইশতিরাজ স্মিত হাসে। আকস্মিক ফারজানাকে কোলে তুলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমির ছলে বলে,

–” আপাতত ঘরের বাত্তি জ্বালিয়ে দিন। সংসারের বাত্তি জ্বালানোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বাকি রাত পড়েই আছে। ”

ফারজানা লজ্জায় হতভম্ব হয়ে যায়। ঠোঁটকাটা লোকটা বিয়ের পর থেকেই তার মান সম্মান নিলামে তুলেছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে ফারজানা বলল,

–” মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না আপনার? ”

ইশতিরাজ তাকে সোফার উপর আলতোভাবে বসিয়ে দিয়ে বলল,

–” ক’দিন পর হাতের অবাধ্য বিচরণও আটকাবে না ম্যাডাম। বি প্রিপেয়ার্ড। ”

ফারজানা শিউরে উঠে। কথা আঁটকে আসে তার। ইশতিরাজ বাসার দরজা বন্ধ করে এসে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়। মিনিট দশেক পর একটা ট্রে-তে হালকা মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং দু গ্লাস শরবত নিয়ে হাজির হয়। খাবার সমেত ট্রে টি-টেবিলে রেখে ফারজানার পাশ ঘেঁষে বসে ইশতিরাজ। ফারজানার একটু অস্বস্তিবোধ হলেও কিছু বলেনা। ইশতিরাজ এক চামচ পায়েস নিয়ে ফারজানার মুখের সামনে তুলে ধরে বলে,

–” অভিনন্দন আপনাকে মিসেস চৌধুরী। নতুন সংসারের জন্য স্বাগতম। ”

ফারজানাও ফিরতি জবাবে রাজকে এক চামচ পায়েস খাইয়ে দিয়ে বলে,

–” আপনাকেও অভিনন্দন। ”

ফারজানার ক্লান্ত মুখাবয়ব দেখে জুসের গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশতিরাজ হালকা গলায় বলে,

–” আমি জানি আপনি ভীষণ ক্লান্ত তবে আমি চাইছিলাম দু’জনে মিলে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়তে। বেশি কষ্ট হয়ে যাবে? ”

ইতস্ততায় ফারজানার মুখাবয়ব রক্তিম হয়ে উঠে। এদিক-ওদিক নজর ফিরিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। ইশতিরাজ ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে তার অভিব্যক্তি। ফারজানা আঁটকে আসা গলায় বলে,

–” ইয়ে মানে আসলে..

ইশতিরাজ বুঝে যায় তার সমস্যা। বেচারিকে অস্বস্তিতে না ফেলে সহজ গলায় বলে,

–” ডোন্ট ওয়ারি আমি বুঝে নিয়েছি। আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। দুইটা আবদার রাখবেন আমার ? ”

ইশতিরাজের আচরণে ফারজানা মোমের মতো গলে যাচ্ছে। এতটা আদর, যত্ন, ভালোবাসা সত্যি সে ডিজার্ভ করে? প্রশ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,

–” কী আবদার? ”

ইশতিরাজ আদুরে কন্ঠে বলে,

–” আমার কাবার্ডে হোয়াইট কালার পোলো টিশার্ট আছে বেশ কয়টা। আপনি তন্মধ্যে যেকোনো একটা পরবেন? নামাজের সময়টায় আমার পাশে বসে থাকবেন? ”

ফারজানা সাধারণত টিশার্ট পরেনা তবে রাজের আবদার ফেরাতে পারলোনা কেনো জানি। ধীর কন্ঠে বলল,

–” ঠিকাছে। ”

ইশতিরাজ খুশে হয়। টুকটাক কথাবার্তা বলে দু’জনে যায় ফ্রেস হতে। ফারজানার অতিমাত্রায় বিরক্ত লাগছিল বিধায় চটজলদি শাওয়ার নিয়ে চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ারের মাধ্যমে শুকিয়ে নামাজে মগ্ন রাজের পাশে এসে বেডের উপর বসে। দু’রাকাআত নফল নামাজের কথা বললেও ইশতিরাজ চার রাকাআত নামাজ পড়ে। মোনাজাতে গিয়ে একটা বারের জন্য তার ঠোঁট নড়েনি উল্টো কিছু বলার আগেই সে কেঁদে ফেলে। ফারজানা অবাক হয়ে দেখে তার কান্না। লোকটা এমন ব্যকুল হয়ে কিসের আর্জি জানাচ্ছে?

ফারজানার ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় বসে থাকায় অসহ্য ব্যথায় দিন দুনিয়া জাহান্নাম লাগতে শুরু করে। ফারজানা না পারতে বেডে হেলান দিয়ে বসে। ইশতিরাজের কান্নার স্বর তাকে ভেতর থেকে বিচলিত করে তুলছিল। কিছু সময় পেরোতেই ইশতিরাজ তার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড়িয়ে কিছু দোয়া পড়ে তার মাথায় ফু দিয়ে দেয়। ফারজানা চোখ বুঁজে ফেলে প্রশান্তিতে। এত যত্ন এর পূর্বে কখনোই তার কপালে জোটেনি।

ইশতিরাজ নিরবে ফারজানার অবস্থা অবলোকন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অতঃপর মিনিট পাঁচেক পর ফিরে আসে একটা হিট প্যাচ হাতে। ফারজানা কিছু বলার পূর্বে ইশতিরাজ নিজ দায়িত্বে তার নরম উদরে আলতো করে সেটা বসিয়ে দিয়ে বলে,

–” অল্প একটু সময় অপেক্ষা করুন। ইয়্যু উইল ফিল বেটার। ”

ফারজানা সেই বিষয়ে কথা বাড়ায়নি। ইশতিরাজ তার বিপরীত সাইডে শুয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

–” আপনার পাশ ঘেঁষে শোয়ার অনুমতি দিবেন? প্রমিজ করছি একটুও দুষ্টুমি করবো না। ”

ইশতিরাজের কন্ঠে আকুতি স্পষ্ট। ফারজানা অল্প একটু সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

–” সমস্যা নেই তবে একটা প্রশ্ন করি? ”

ইশতিরাজ আলতো করে তার হাত জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

–” হুঁ। ”

ফারজানা শিউরে উঠে ইশতিরাজের কান্ডে। নিজেকে সামলে অস্পষ্ট স্বরে বলে,

–” মোনাজাতে বসে কান্না করছিলেন কেনো? ”

ইশতিরাজ ম্লান হেসে বলল,

–” আমার বত্রিশ বছরের জীবনে আমি কেবল দু’টো কারণে খোদার দরবারে আর্জি জানিয়েছিলাম তন্মধ্যে আজ একটা পূরণ হয়েছে বলে শুকরিয়া আদায় করছিলাম। ”

ফারজানার অন্তস্তলে প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় তবে কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করে,

–” আমি আপনার দ্বিতীয় মোনাজাতের কারণ হলে প্রথম মোনাজাতের কারণ কী ছিলো? ”

নারী সুলভ সন্দেহের বিষয়টা টের পেয়ে ইশতিরাজ মৃদু হাসে। অন্ধকারে সেটা দৃশ্যমান হয় না। জানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ম্লান স্বরে বলে,

–” প্রথম মোনাজাতের কারণ ছিলো আমার জন্মদাত্রী মা। সেই অভাগিনীর পরকালের সুখ সুনিশ্চিত করতেই আমার এত আয়োজন। ”

ফারজানা টের পায় ইশতিরাজের গলা কাঁপছে। এমুহূর্তে এই প্রসঙ্গটা একদমই টানতে চাইলো না ফারজানা। চুপচাপ ইশতিরাজের আদুরে স্পর্শ গুলো উপভোগ করতে লাগলো। তার চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা আনন্দের অশ্রু। পরিশেষে সুখের পায়রা তার আঙিনায় হাজিরা দিয়েছে।

_

নিস্তব্ধ রজনীর অন্তিম প্রহর। প্রিমার পালকের ন্যায় হালকা শরীরটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে শান। তার ক্লান্ত চোখদুটোতে ঘুমের লেশমাত্র নেই। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শূন্যে। মস্তিষ্কে চলছে হাজারো ভাবনা। বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে শঙ্কিত। সে আনমনে ভেবে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যওয়া ঘটনা।

প্রিমার ভরসাযোগ্য সান্ত্বনায় আরশিয়ান অল্প সময় এর মাঝে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে। ধাতস্থ হয়ে নিজেকে সামলে দরজা খুলে বেরিয়ে ট্রাকের অবস্থা দেখতে এগিয়ে যায়। দুঃখজনক বিষয় হলো ট্রাকটা স্লিপ করে অনেকটা দূর এগিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়ে থেমেছে। সেদিকে যাওয়া পসিবল নয়। আরশিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ট্রিপল নাইনে কল করে জানিয়ে দেয় এবং উবার ডেকে প্রিমাকে নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরে।

প্রিমা তেমন কোনো আঘাত না পেলেও আরশিয়ান হালকা পাতলা চোট পেয়েছে। বাসায় ফিরে প্রিমা নিজ দায়িত্বে তার ড্রেসিং করে দেয়। আরশিয়ান টু শব্দও নির্গত করেনি কেবল চুপচাপ যত্নটুকু গ্রহণ করেছে। বহুদিন পর তাদের সম্পর্কে অল্প একটুখানি স্বাভাবিকতা ফিরেছে। আরশিয়ান মনে মনে ভাবে এবার বোঝাপড়াটা করে নেওয়া উচিত।

দুজনেই বেশ ক্লান্ত ছিলো। প্রিমা বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ে। বেচারির শরীরটা হালকা একটু গরম ছিলো। জ্বর আসার চিন্তায় শানের ঘুম উবে যায়। রাতের অন্তিম প্রহর পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন প্রিমার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয় তখন স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিজেও একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে আরশিয়ান। বিধ্বস্ত মস্তিষ্ক প্রিয় নারীর সান্নিধ্য পেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

সূর্যের সোনালি আভায় ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে। রোদের মৃদু ঝলকা চোখেমুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় আরশিয়ানের। চোখ মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই খেয়াল করে প্রিমা নেই। তার বুকটা ধ্বক করে উঠে কারণ প্রিমা কখনোই তার আগে উঠে না। সে হতভম্ব কন্ঠে ডাকে,

–” প্রেম? কোথায় আপনি? ”

প্রিমার সাড়া পাওয়া যায় না। আরশিয়ান চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বেলকনি এবং ওয়াশরুম চেক করে। কোথাও নেই মেয়েটা। আরশিয়ানের চিন্তার পারদ তরতর করে বাড়ে। হুঁশ খুইয়ে অনাবৃত দেহেই ঘর থেকে বেরিয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে প্রিমাকে।

ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আরিয়ান চৌধুরী। ছেলের অবস্থা দেখে হতভম্ব কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

–” এ কী হাল তোমার? ”

উন্মুক্ত দেহে কেবল একটা ট্রাউজার পরা অবস্থায় আরশিয়ানকে বেরিয়ে আসতে দেখে হকচকিয়ে উঠেন আরিয়ান চৌধুরী। আরশিয়ান কখনোই এই বেশে ঘর ছেড়ে বেরোয় না। বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে আরশিয়ান জিজ্ঞেস করে,

–” তোমার বউমা কোথায়? ”

আরিয়ান চৌধুরী ভাব নিয়ে বললেন,

–” কে বউমা? কিসের বউমা? আমি কোনো বউমা কে চিনি না। ”

আরশিয়ান তেঁতো মুখে বলে,

–” তোমার সুইট লিটিল প্রিন্সেসের কথা জিজ্ঞেস করছি। ”

আরিয়ান চৌধুরী হাসি আঁটকে বলে,

–” সে তো রান্নাঘরে। তোমার আম্মুর সাথে গল্…

বাকি কথা শোনার আগেই প্রস্থান করলো শান। আরিয়ান চৌধুরী অবাক চোখে তাকালেন ছেলের যাওয়ার পানে। তার উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছুটে যাওয়া এবং ব্যকুলতা দেখে খানিকটা চমকালেন বটে। আনমনে কিছু একটা ভেবে হাঁক ছেড়ে স্ত্রীকে ডাকলেন।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সকালের নাস্তার জন্য পরোটা ভাঁজছিলেন আফিয়া চৌধুরী। উনার পাশে দাঁড়ানো প্রিমা ফ্লাক্স থেকে চা ঢালছিল। আকস্মিক শানকে রান্নাঘরে আসতে দেখে আফিয়া চৌধুরী চমকে তাকিয়ে বললেন,

–” কী হয়েছে আব্বু? কিছু লাগবে? এই অবস্থায় রান্নাঘরে এসেছিস কেনো? ”

আরশিয়ান এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করতে থাকে। প্রিমা আড়চোখে একবার তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। আরিয়ান চৌধুরীর হাঁকডাক শুনে আফিয়া চৌধুরী বিরক্ত হয়ে প্রিমাকে বলেন,

–” একটু এদিকটা সামলে নিস। আমি আসছি। ”

আফিয়া চৌধুরী চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে যেতেই আরশিয়ান রান্নাঘরের পর্দাটা টেনে দিয়ে প্রিমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। প্রিমা তখন পরোটা ভাঁজতে ব্যস্ত ছিলো। আরশিয়ানের ঘনিষ্ঠতা টের পেয়েও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করছিল।

আরশিয়ান পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হালকা ভাবে চুম্বন এঁকে দেয় অতঃপর ধীর কন্ঠে শুধায়,

–” সকালে উঠে আমায় ডাকেননি কেনো? ”

আদুরে স্পর্শ গুলো হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছিল প্রিমার। আরশিয়ানের উৎকন্ঠ বেশ ভালোমতো টের পেয়েছে প্রিমা। তাকে হারানোর ভয়টা জেঁকে ধরেছে বেচারাকে।মনটা আকস্মিক ভালো হয়ে যায় প্রিমার। প্রশ্নের উত্তরে শান্ত স্বরে বলে,

–” আপনি গভীর ঘুমে আছন্ন ছিলেন তাই ডাকিনি।সরে দাঁড়ান। আম্মু চলে আসবে যেকোনো সময়। ”

আরশিয়ান সরলো না উল্টো প্রিমার খোলা চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

–” ভেজা চুলে রান্নাঘরে এসেছেন কেনো? কালকে মাথা ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন সেটা ভুলে গেছেন? ”

প্রিমা নার্ভাস হয়ে পড়ে আরশিয়ানের এমন কান্ডে। বুকটা কেঁপে উঠছে বারংবার। কোনোমতে কাঁপা কন্ঠে বলে,

–” চুল আহামরি ভেজা ছিলো না। ঘামের জন্য বেশি ভেজা লাগছে। আম্মুর সাথে গল্প করতে এসেছিলাম এখানে। ”

আরশিয়ান শুনলো প্রিমার কৈফিয়ত তবে বাড়তি কথা বললো না। নিজ দায়িত্বে লম্বা চুলগুলো হাত খোপা করে দিলো। এতদিন প্রিমাকে করতে দেখে তারও আয়ত্তে এসেছে বিষয়টা। প্রিমা হতচকিত দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে তাকালে আরশিয়ান আলতো করে প্রিমার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলে,

–” আম্মুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনি গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসুন। নাস্তা সেরে আমরা ডক্টরের কাছে যাবো। ”

প্রিমা হতবাক হয়ে তাকায় কিন্তু কথা বলতে পারে না। আরশিয়ান বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই আফিয়া চৌধুরী উপস্থিত হোন রান্নাঘরে। প্রিমা হাজারবার নিষেধ করলেও তিনি ঠেলেঠুলে তাকে ড্রয়িংরুমে পাঠিয়ে দেন। মা ছেলের কর্মকান্ডে মুখ ভার করে প্রিমা ড্রয়িংরুমে বসে থাকে। নাস্তা সেরে দুজনে বেরিয়ে পড়ে হসপিটালিটি উদ্দেশ্যে।

_

আল্ট্রাসাউন্ড রুমে অবস্থান করছে প্রিমা এবং শান। আরশিয়ানের চোখ আঁটকে আছে মনিটরের দিকে।তার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস লেপ্টে আছে। বুক কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে । প্রথমবার বাবা হওয়ার আসল অনুভূতির সাথে পরিচয় ঘটেছে তার। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে তার সন্তানদের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। কর্ণকুহরে ধাক্কা দিচ্ছে এক মধুর সুর। মূলত বাচ্চাদের হার্টবিট এর শব্দ তাকে আবেগাপ্লুত করে ফেলেছে।

প্রিমার অবস্থাও একই। তার চোখের কোণে জমেছে আনন্দের অশ্রু। ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়নের ফলে মাতৃত্বের সুখকর অনুভূতি অনুভব করতে পারেনি। আজ সকল অভিমান উবে গেছে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ অন্তস্তলে মমতার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো তারা। গ্যাং ওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় আরশিয়ান বলল,

–” শরীর ঠিক আছে? ”

ধীরেসুস্থে হাঁটছিল প্রিমা। আরশিয়ানের আকস্মিক প্রশ্নে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

–” হুঁ। ”

খানিকটা সময় নিয়ে আরশিয়ান বলে,

–” এখান পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা লেক আছে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। ওখানে একটুখানি বসি আমরা? ”

প্রিমা ধীর স্বরে বলল,

–” চলুন তাহলে। ”

কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর তারা কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌঁছালো। লেক থেকে কিছুটা দূরে একটা সিটিং জোনে পাশাপাশি বসলো তারা। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরশিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

–” কিছু কথা বলার ছিলো। শুনবেন? ”

আরশিয়ানের কন্ঠে অস্থিরতা মিশে ছিলো। প্রিমা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

–” বলুন। ”

আরশিয়ান ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,

–” নীহা আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়। তার প্রতি থাকা সমস্ত অনুভূতি নিঃশেষ হয়ে গেছে। বিগত দুইটা মাসে আমি প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। মন মস্তিষ্ক কতটা বিক্ষিপ্ত ছিলো সেটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। সত্যি বলতে করতে চাইছিও না। আমি কেবল আমার বর্তমান অর্থাৎ আপনি নামক অধ্যায়টাকে আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আপনি কী আমায় সেই সুযোগটা দিবেন? ”

প্রিমা বেশ শান্ত চোখে পরখ করছিল আরশিয়ানকে। তার বলা কথাগুলো শুনে একটু সময় নিয়ে প্রিমা বলে উঠল,

–” আপনাকে সুযোগ দিয়েছি বলেই আজ নির্বিঘ্নে এতটা কাছাকাছি অবস্থান করছি আমরা। আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার অনুতপ্ততার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছেন তবে সেটা কেবলই আপনার ভ্রান্ত ধারণা । ”

আরশিয়ান প্রশ্নবোধক কন্যা শুধাল,

–” তাহলে কেনো সুযোগ দিয়েছেন আমায়? ”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিমা বলল,

–” আমাদের সংসার প্রায় আট মাসের। প্রথম দিকে আমি কেবলই আপনার দায়িত্ব ছিলাম কিন্তু সময়ের সাথে অনেক কিছু পরিবর্তিন হয়। আপনার অনুভূতি পাল্টেছিল আমার প্রতি তবে অনুধাবন করার আগে এই ধ্বংসাত্মক ঝড় সবকিছু শেষ করে দেয়। আমি জানি সেইদিন যে নৃশংস মানুষটা আমার সামনে ছিলো সেটা আপনার একটা নেগেটিভ সাইড..সমগ্র আপনিটা নন। আমি অনুভব করেছি আমার প্রতি থাকা আপনার সুপ্ত অনুভূতি। সবমিলিয়ে মনে হলো আরেকটাবার সুযোগ দিতে ক্ষতি নেই। ”

আরশিয়ান উৎকন্ঠিত স্বরে বলল,

–” জোরপূর্বক কিংবা মেনে নেওয়া অথবা মানিয়ে নেওয়ার সংসার চাই না আমার। একটা সুন্দর প্রাণবন্ত সংসার চাই। আপনি সম্মতি দিবেন ? ”

প্রিমা হাসলো। আরশিয়ানের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–” সংসার প্রাণবন্ত হয় অনুভূতির শক্ত গাঁথুনিতে। আমাদের সংসারটা যদি প্রচেষ্টার কাতারে পড়ে থাকে তাহলে কখনোই এই সংসার কিংবা আমিটা আপনার স্বস্তির কারণ হতে পারবো না। ”

আরশিয়ান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অতঃপর বলে,

–” আপনিটা অলরেডি আমার স্বস্তির কারণ হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। বাড়িতে ফিরলে আপনাকে না দেখলে আমার অস্থির লাগে। আপনার রাগ, অভিমান, বিরক্তি আমাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দেয়৷ আপনার সান্নিধ্যে আমি সুখ খুঁজে পাই। ”

প্রিমার অবাক চোখে তাকায় আরশিয়ানের দিকে। তার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো রীতিমতো। গাধা লোকটা কী অকপটে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে অথচ ভালোবাসি বলতেই তাহার যত সমস্যা। কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে প্রিমা বলল,

–” আমার প্রতি বেশ কিছু শিরোনামহীন সুপ্ত অনুভূতি জন্মেছে আপনার হৃদকুঞ্জে। হয়তো এটাই ভালোবাসার প্রারম্ভিক ধাপ। আমি অপেক্ষা করবো আপনার অন্তিম স্বীকারোক্তির । ”

আরশিয়ান শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে শুধাল,

–” যদি কখনো জানতে পারেন আপনি স্রেফ আমার ইনফ্যাচুয়েশন ছিলেন তখন কী করবেন? ”

প্রিমা স্মিত হেসে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,

–” বয়সের সংখ্যাটা যে ঘরেই থাকুক তাৎক্ষণিক আপনার সংসার ছেড়ে একাকীত্বকে বরণ করে বহুদূরে হারিয়ে যাবো। আমি সুনিশ্চিত করবো আমার নির্মম মৃত্যুর খবরটাও যেনো আপনার নিকট অব্দি না পৌঁছায়। ভালোবাসার কাঙালিনী বলে ইনফ্যাচুয়েশন নামক অপমানজনক তকমা হজম করবো না জনাব।”

আরশিয়ান কেঁপে উঠল কিঞ্চিত। প্রিমার কথায় তার বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে। মনে মনে নিজেক শ’খানেক গালি দিয়ে প্রিমার পাশ ঘেঁষে বসে তাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে চঞ্চল গলায় বলে,

–” আমার হৃদকুঞ্জে জন্মানো শিরোনামহীন অনুভূতির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আপনি খুঁজে নিয়েন। আমি না-হয় অনুভব করানোর দায়িত্ব নিবো। প্রত্যেকটা মানুষের কিছু অপারগতা থাকে। আমার কমতিটা মর্জনা করার অনুরোধ রইল। ”

প্রিমা টের পায় আরশিয়ানের অস্থিরতা। তাকে আমৃত্যু আগলে রাখার প্রচেষ্টা স্পষ্ট দৃশ্যমান হচ্ছে তার আচরণে। লোকটার চোখের দিকে তাকালেই একরাশ মায়াময় চাহুনির দেখা মিলে। জড়িয়ে ধরার সময় তীব্র অনুভূতির আভাস পাওয়া যায়। ছোটো ছোটো স্পর্শ গুলোতে মিশে থাকে যত্ন। এতসব কিছুর বিনিময়ে তার সমান্য অপারগতা খানিক সময়ের জন্য মাফ করা যেতেই পারে। লোকটার প্রচেষ্টায় কমতি নেই কিন্তু অতীতের নিষ্ঠুরতা ভোলা এতটও সহজ নয়।

ভাবনার মাঝে আচমকা তলপেটে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভূত হয় প্রিমার। অস্ফুটস্বরে গুঙিয়ে উঠতেই আরশিয়ান হতভম্ব কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

–” কী হয়েছে প্রেম? ”

প্রিমা লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে বলে,

–” লং টাইম বসে থাকার জন্য এরকম হচ্ছে বোধহয়। ”

আরশিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে চটজলদি তাকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে হাঁটা দিয়ে বলে,

–” নিজের প্রতি এতটা অযত্নশীল কেনো আপনি? আপনার মাঝে কারও প্রাণভোমরা লুকিয়ে সেটা কেনো ভুলে যান? ”

আকস্মিক এমন হওয়াতে প্রিমা চমকে যায়। শানের গলা জড়িয়ে ধরে ব্যথার মাঝেও দুষ্টুমির স্বরে বলে,

–” সবসময় শুধু বাচ্চাদের চিন্তা করলে হবে? ”

আরশিয়ান হাঁটার গতি শ্লথ করে প্রিমার চোখে চোখ রেখে বলে,

–” বাচ্চারা আমার কলিজার অংশ প্রাণভোমরা বলতে বুঝিয়েছি তাদের মমতাময়ীকে। বুঝলে বুঝ পাতা না বুঝলে তেজপাতা। ”

চলবে?