#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩০(প্রথমাংশ)
তীব্র ক্ষুধা অনুভূত হতেই ঘুমটা আলগা হয়ে আসলো ফারজানার। চোখ মেলে তাকাতেই অনুভব করলো একটা বলিষ্ঠ শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার সাথে। প্রথমে হকচকিয়ে উঠলেও পরক্ষণে মনে পড়লো গতকাল রাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গটা।
সদ্য জাগ্রত ফোলা চোখগুলো ঝাপটিয়ে বুকের সাথে মিশে থাকা ইশতিরাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো ফারজানা। লোকটা বাচ্চাদের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে আনমনে হাসলো সে। গতকাল রাতে মানুষটার মাত্রাতিরিক্ত পাগলামি দেখেছে। ছোটো বাচ্চারা যেমন পছন্দের কিছু পেলে সেটা নিয়েই মত্ত থাকে ইশতিরাজেরও হয়েছিল ঠিক একই দশা। কিছুক্ষণ পরপরই উঁকি দিয়ে দেখছিল তাকে। কখনো আবার ধরে রাখা হাতটাতে এঁকে দিচ্ছিল অসংখ্য ভালোবাসার পরশ। বারংবার ফিসফিসিয়ে বলছিল,
–” থ্যাংকস ফর কামিং ইন মাই লাইফ। আই উইল নেভার লেট ইয়্যু গো সুরঞ্জনা। ”
ফারজানা চোখ বুঁজে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকলেও সবটা শুনেছে। উপলব্ধি করেছে লোকটার অন্তহীন ভালোবাসা। বাস্তবতা হজম করতে বেগ পোহাতে হয়েছে তাকে। ভেবেছিল এটাও হয়তো কোনো সপ্ন কিন্তু সকালের চমৎকার দৃশ্য তার ভ্রম কাটিয়ে দিলো। নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে রাজের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ফারজানা বলল,
–” শুনছেন জনাব? উঠবেন না? ”
ইশতিরাজ জবাব দেয় না। ফারজানা ব্যর্থ হয়ে রাজের কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকে। আচমকা ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় ইশতিরাজের মেজাজ খিঁচড়ে যায়। মেডিকেল লাইফে এন্টার করার পর গাঢ় ঘুম খুব কম হয়েছে তার। বহুদিন পর আজকে একটু প্রশান্তির ঘুমে মগ্ন হতে পেরেছিল তন্মধ্যে শুরু হয়েছে হাউকাউ। চোখ মেলে জলদগম্ভীর স্বরে বলে,
–” হু আর ইয়্যু? ”
ইশতিরাজের ঘুম আছন্ন চোখদুটোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফারজানা ধীর স্বরে জবাবা দেয়,
–” ইট’স মি.. ইয়্যোর সুরঞ্জনা। ”
ইশতিরাজ পিটপিটিয়ে তাকায়। দু’বার মাথা ঝাঁকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসে জানার দিকে বড় বড় চোখে তাকায়। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস্য ভাবটা স্পষ্ট। তোতলানো স্বরে কোনোমতে বলে,
–” মিস জানা.. আপনি এখানে? আমার বেডে?”
ইশতিরাজের কথায় ফারজানা শব্দ করে হেসে ফেলে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ইশতিরাজের ফোলা চোখ, স্নিগ্ধ মুখশ্রী এবং এলোমেলো চুলের বাহার এবং চমকপ্রদ রিয়েকশন দেখে হাসি আটকাতে পারেনি বেচারি। ইশতিরাজ কনফিউজিং দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অতঃপর কী যেনো ভাবে। পুরো বিষয়টা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই সে-ও ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে। মাথা চুলকে লজ্জিত কন্ঠে বলে,
–” আসলে হুট করে আপনাকে দেখে মানে…
ফারজানা হাসি থামিয়ে বলে,
–” রাতে বিয়ে করা বউকে সকালে চিনতে না পারার অপরাধে আপনাকে বউ বিহীন বনবাসে পাঠানো উচিত। ”
ইশতিরাজ চোখমুখ কুঁচকে বলে,
–” সান্নিধ্যে আসার আগেই দূরে পালাবার ধান্দা? ”
ফারজানা বিরস মুখে বলল,
–” গত রাতে একটা মিনিটের জন্যও দূরে ছিলেন? ”
ইশতিরাজ স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মোহ মাখা কন্ঠে বলে,
–” সান্নিধ্যের অভ্যন্তরে বিদ্যমান দূরত্বটুকু মিটিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় কেউ একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। ”
ইশতিরাজের অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে ফারজানা থমকালো। চমকে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমতাআমতা করে বলল,
–” অনেক বেলা হয়েছে এবার আমাদের ফ্রেশ হওয়া উচিত।
ইশতিরাজ অপলক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ফারজানার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী। স্মিত হেসে বলল,
–” আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন এরপর আমি যাচ্ছি।
ফারজানা তড়িঘড়ি করে উঠে দৌড় দিলো ওয়াশরুমে। ইশতিরাজ দৃশ্যটা দেখে শব্দ করে হেসে ফেললো। আড়মোড়া ভেঙে ফোনটা হাতে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেইল গুলো চেক করতে শুরু করলো।
_
হসপিটাল থেকে ফেরার মাঝে আচমকা আরিয়ান চৌধুরীর কল আসে। আরশিয়ান কিঞ্চিত অবাক হয়ে কল রিসিভ করতেই আরিয়ান চৌধুরী দ্রুত তাদের বাসায় ফিরতে বলেন। বাবার এহেন ধারার কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ে শান। জলদিই ড্রাইভ করে পৌঁছে যায় বাসায়। আরশিয়ানের অবস্থা দেখে প্রিমাও খানিকটা অবাক হয়েছিল তবে প্রশ্ন করেনি।
বাসায় পৌঁছাতেই দেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় লাগেজ সমেত হাজির হয়েছে তাজরিয়ান এবং মেহরিমা। অন্যদিকে কোথাও যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তাদের পাশে অবস্থান করছেন আফিয়া এবং আরিয়ান চৌধুরী। তাদের চোখেমুখে লেপ্টে আছে দুশ্চিন্তার ছাপ। আরশিয়ান প্রিমাকে ধীরেসুস্থে সোফায় বসিয়ে দিয়ে প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলে,
–” কী হয়েছে আব্বু? ”
আরিয়ান চৌধুরী হতাশ কন্ঠে বললেন,
–” জমিজমা নিয়ে ঝামেলা চলছে। তোমার দাদু এসবের চিন্তায় একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অতি শীঘ্রই আমাদের গ্রামে আসার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এই ঝামেলা সমাধানের দায়িত্ব নাকি আমাকেই নিতে হবে এবার। ”
বাবর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশিয়ান। মসজিদ, মাদ্রাসা এবং গোরস্থানের বেশকিছু জমি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। ওই জমির পাশে আরিয়ান চৌধুরীর অংশ থাকায় উনার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক কিন্তু তার মাথায় খেলে গেলো ভিন্ন চিন্তা। তার বাবা এবং মা না থাকলে প্রিমাকে কার ভরসায় বাসায় রেখে যাবে। আরশিয়ানের চিন্তিত মুখশ্রী দেখে আফিয়া চৌধুরী ম্লান মুখে বললেন,
–” ঝামেলাটা বেশ বড়সড়। এই অবস্থায় তোর বাবাকে একা ছাড়া অসম্ভব।এসব শেষ হতে কতদিন লাগবে তার ইয়ত্তা নেই তবে তুই চিন্তা করিস না। তাজ আর মেহু এখন থেকে তোদের সাথেই থাকবে উপরন্তু রাজ এবং জানা তো আছেই।”
আরশিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল,
–” আমরা এদিকটা সামলে নিবো আম্মু। তোমরা টেনশন নিয়ো না। নিজেদের খেয়াল রেখো। ”
আফিয়া চৌধুরী এবং আরিয়ান চৌধুরী প্রিমার সাথে ভালোমন্দ কথা বলে একগাদা সাজেশন দিলেন। অন্তুিম প্রহরে কুশলাদি বিনিময় করে বিদায় নিলেন। আরশিয়ান তাদের এয়ারপোর্টে পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আরিয়ান চৌধুরী সেই প্রস্তাব নাকচ করেন। আরশিয়ান কথা বাড়ায়নি। বিশ্বস্ত ড্রাইভার কে বলে উনাদের গাড়িতে তুলে দেয়।
হসপিটালের ঝক্কি-ঝামেলা সামলে প্রিমা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তাই আরশিয়ান তাকে ঘরে রেখে আসে।মেহরিমা নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করতে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে এগিয়ে যায়। আরশিয়ান গিয়ে বসে তাজরিয়ানের পাশে। মূলত তাজ নিজেই তাকে ডেকেছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আরশিয়ান সোফায় বসে নিচু কন্ঠে শুধায়,
–” কাজ কদ্দূর এগোলো?”
তাজরিয়ান ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল,
–” আরভিদের ল্যাপটপের যাবতীয় ডিটেইলস হাতের মুঠোয় নিয়ে সেগুলো দিয়ে প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেছি। এবার শুধু এক্সিকিউট করার পালা। আমার তরফ থেকে বউমনির জন্য এটা একটা স্যরি গিফট হবে। ”
আরশিয়ান স্মিত হেসে বলল,
–” রওশন ওয়াসীত্ব এবং নাহার ওয়াসীত্বকে ট্রেস করতে পেরেছিস? ”
তাজরিয়ান বাঁকা হেসে ভাব নিয়ে বলল,
–” তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স, প্রেজেন্ট এড্রেসসহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্রেস করে ইনফরমেশন কালেক্ট করা ডান। ”
আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
–” তাহলে এখনো কাঙ্ক্ষিত কাজটা আঁটকে আছে কেনো? দু’দিন পর তোর বউমনির বার্থডে। আমি তাকে সেরা গিফটটা দিতে চাই তাজ। ”
তাজরিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আরভিদের বাবার পার্সোনাল পিএ কে এখনো ট্রেস করা যায়নি। কোন গর্তে ঢুকে আছে খোদা জানেন। তবে চিন্তার কারণ নেই। জাল বিছানো হয়েছে। ব্যাটা হাতের মুঠোয় আসলো বলে। ”
আরশিয়ান তাজের ক্রিমিনাল মাইন্ড দেখে স্মিত হেসে শুধাল,
–” আরভিদের এক্সজিসটেন্স সম্পর্কে কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি তো? ”
তাজরিয়ান বাঁকা হেসে বলল,
–” প্রতিনিয়তি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ খাটিয়ে খুব নিখুঁত ভাবে তার দলীয় নেতা কর্মীর সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছি এবং তার ফেসবুক প্রোফাইলে প্রত্যেকদিন কিছু ছবি সংযুক্ত করা হচ্ছে। সন্দেহের অবকাশ নেই ভাইয়া।”
আরশিয়ান ইম্প্রেস হলো তার বুূ্দ্ধিমত্তায়। সোফায় নিশ্চিতে গা এলিয়ে দিয়ে শুধাল,
–” রাজকে ইনফর্ম করেছিস কিছু? ”
তাজরিয়ান জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
–” এতটুকু ইনভেস্টিগেশন আমি আর রাজ ভাই দু’জনে মিলেই করেছি। তবে… সবকিছুর মাঝে বিরাট একটা খটকা বাসা বেঁধেছে আমার মনে। ”
আরশিয়ান ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,
–” কীসের খটকা। ”
তাজরিয়ান সন্দিহান কন্ঠে বলল,
–” আরভিদের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড আমার কাছে নরমাল মনে হয়নি এজন্যই নারকোটিক্স ডেপ্টের ডিটেকটিভদের কাছে জরুরি তথ্য গুলো সাবমিট করেছি। ”
আরশিয়ান ক্ষণিকের মধ্যে কিছু একটা ভেবে বলল,
–” ডকুমেন্ট গুলো মেইল করে দিস তো। ”
তাজরিয়ান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। দুজনের কথোপকথনের মাঝে আচমকা ইশতিরাজ হাজির হয়। তাদের একসাথে দেখে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলে,
–” কিরে দুঃখির দল। আমার মতো সুখী পাবলিক কে আলোচনা থেকে বাদ দেওয়ার দুঃসাহস কোথায় পেলি? ”
তাজরিয়ান কিছুই বললো না তবে আরশিয়ান চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠল,
–” ফালতু বকিস না রাজ। তুই ব্যস্ত ছিলি বিধায় ডাকিনি তাছাড়াও এসব বিষয়ে তুই অবগত। বাকিটা সময়মতো জানিয়ে দেওয়া হতো। ”
ইশতিরাজ ধপাস করে আরশিয়ানের পাশে বসে নির্বিকার গলায় বলল,
–” এবার কাজের কথা বলি শোন। আমার এক বন্ধু নতুন রিসোর্ট তৈরী করেছে গাজীপুরে। মনোরম পরিবেশ এবং চমৎকার ভিউ। কম দূরত্বে অধিক সৌন্দর্যে মন্ডিত প্রকৃতির ফীল নিতে হলে একবার অন্তত ভিজিট করা উচিত। বিয়ের গিফট হিসেবে সম্পূর্ণ রিসোর্টটা তিনদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। রিসোর্টে বেশ কয়েকটা কটেজ আছে তাই ভাবলাম একা না গিয়ে তোদেরও অফার করি।
তাজ এবং শান দু’জনেই একটু ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। ইশতিরাজ নাকমুখ কুঁচকে বলল,
–” নিরামিষের দল! লাস্ট কবে বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিস মনে আছে? ব্যস্ত জীবন তোদের রেহাই দিবে না মগা। নিজেদের জন্য সময় বের কর নয়তো শেষ বয়সে গিয়ে অঢেল টাকা থাকলেও সুখকর স্মৃতির ঘরটা শূন্যই থাকবে। ”
ইশতিরাজের কথায় লজিক আছে। সত্যি বলতে পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যার কবলে পড়ে মস্তিস্কে জং ধরে গেছে। মনে প্রশান্তির অভাব। ছোট্ট একটা আউটিংয়ে গেলে মন্দ হয় না। আরশিয়ান কিছু একটা ভেবে বলল,
–” সবই ঠিক আছে তবে আমার মিসেস ইদানীং একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অসুস্থতা বেড়েছে পূর্বের তুলনায়। এই অবস্থায় অত দূরে যাওয়া সেইফ? ”
ইশতিরাজ হালকা হেসে বলল,
–” মর্নিং উইকনেস, মোশান সিকনেস, অল্পতে ক্লান্ত হয়ে পড়া এসব নরমাল সিম্পটমস। আহামরি খুব দূরের জার্নি হলে আমি নিজেই সাজেস্ট করতাম না। রিপোর্টস যেহেতু নরমাল সেহেতু যাওয়ায় যায়। মূল কথা হলো আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটলে উনারও ভালো লাগবে। ভেবে দেখতে পারিস। ”
তাজরিয়ান এবং আরশিয়ান কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে জবাব দিলো,
–” যাওয়া যাক তাহলে। ”
চলবে?
#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া
৩০(শেষাংশ)
ভোরবেলার আকাশে তখনও পুরোপুরি রোদ ওঠেনি। নরম কুয়াশা পাতলা চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে চারদিক। জ্যামে পড়ার ভয়ে সকাল সকাল যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে গাজীপুরের দিকে রওনা দিয়েছে সকলে। গাড়ি চালানোর দায়িত্ব এসে পড়েছে তাজরিয়ানের কাঁধে। ব্যাকসিটে ঘাঁটি গেঁড়েছে বাকি দুই দম্পতি।সকলেই জাগ্রত অবস্থায় আছে। গাড়িতে মৃদু ছন্দে চলমান রবীন্দ্র সঙ্গীত তাদেরকে অদ্ভুত এক ঘোরে আছন্ন করে রেখেছে।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর সকলে এসে পৌঁছাল কাঙ্ক্ষিত রিসোর্টের সামনে। তাদের গাড়িটা গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলে অভিভূত দৃষ্টিতে দেখলো প্রকৃতির মনোরম সৌন্দর্য। গোলাকৃতির রিসোর্টটা মূলত একটা লেকের উপর নির্মান করা হয়েছে। আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু উঁচু উঁচু গাছ যার ফাঁক গলিয়ে আসা সূর্যের আলো প্রকৃতির সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রিসোর্টের পুরোটা জুড়ে নানান ধরণের ফুলের বাহার রয়েছে।
গাড়ি থেকে নামতেই আশেপাশের চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বুক ভরে শ্বাস টানলো প্রিমা। বিশুদ্ধ বাতাসের সংস্পর্শে এসে মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেছে। প্রিমার ঘুম আচ্ছন্ন চেহারার মিষ্টি হাসিটা অবলোকন করে আরশিয়ান এগিয়ে এসে বলল,
–” প্রকৃতির মনোরম রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম ওয়াফি। পছন্দ হয়েছে ? ”
কিছুটা দূরে অবস্থিত কটেজগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রিমা মৃদুস্বরে বলল,
–” হুঁ। ভীষণ সুন্দর জায়গাটা। বহুদিন পর একটু রিল্যাক্স লাগছে। ”
বিনিময়ে আরশিয়ান কেবল হাসলো। ওদিকে ঘুমে ঢুলতে থাকা মেহরিমা কোনোমতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে হামি তুলছে। বউয়ের অবস্থা দেখে তাজরিয়ান বেরিয়ে এসে ইশতিরাজকে বলল,
–” আমাদের লাগেজ গুলো সাইডে রেখে দিয়ো রাজ ভাই। বলদটারে ঘরে রেখে আসছি আমি। ”
ইশতিরাজ চোখ ছোটো-ছোটো করে তাদের দিকে তাকিয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলল,
–” স্টাফদের দিয়ে সবার লাগেজ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তোরা তোদের মুরগি নিয়ে খাঁচায় যা। ”
কথাটা শুনে তাজরিয়ানের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে উঠলো। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় মেহরিমা কে কাঁধে তুলে পিছু ফিরে টিটকারির সুরে বলল,
–” খাঁচায় যাওয়ার তাড়া তোমার থাকার কথা ছিলো অথচ তুমি পানসে মুখে দাঁড়িয়ে আছো। কী ব্যপার রাজ ভাই? ভাবি পাত্তা দিচ্ছে না নাকি? ছিঃ ছিঃ.. শত-শত নারীর হার্টথ্রোব শেষমেশ কিনা নিজের মুরগির কাছে পাত্তা পাচ্ছে না? হাউ দুঃখজনক বিষয়! ”
ইশতিরাজ কটমটিয়ে তাকাল তাজরিয়ানের দিকে কিন্তু ততক্ষণে সে দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেছে। আড়চোখে পাশে তাকাতেই বউয়ের রাগী দৃষ্টি দেখে কনফিউজড হয়ে বলল,
–” এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? ”
ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে নাকের পাটা ফুলিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
–” মিলিয়ন ট্রিলিয়ন নারীর হার্টথ্রোবের দিকে কীভাবে তাকানো উচিত? ”
ইশতিরাজ বুঝলো তার মিসেসের জেলাসি। অসহায় চোখে চেয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–” একটু প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে ঠিকই বুঝতে পারতেন আমি কতটা ইনোসেন্ট। ”
ফারজানা রাগের বশে রাজের পায়ে মৃদু পাড়া দিয়ে বলল,
–” নিজের সুইটহার্টদের কাছে গিয়ে প্রেমময় দৃষ্টির আবদার করুন.. যত্তসব। ”
বউয়ের যাওয়ার পানে দুঃখি দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেও ছুটলো তার পিছু। তাদের কীর্তি দেখে লেকের পাশে দাঁড়ানো প্রিমা মৃদু হেসে শানকে বলল,
–” এই দুই জুটির খুনসুটি গুলো ভালোই লাগে তাইনা? ”
আরশিয়ান দুষ্টুমির স্বরে বলল,
–” আমার তো কেবল আপনাকে ভাল্লাগে বাকিদের বিষয়ে কিছু জানি না। ”
প্রিমা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল,
–” সাতসকালে শয়তানী চেপেছে মাথায়? ”
আরশিয়ান প্রত্যুত্তরে প্রিমাকে কাছে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” সমীরণে ভেসে বেড়ানো প্রেমের বন্দনা চেপেছে বোধহয় । ”
প্রিমা মুখ চেপে হেসে মিছেমিছি হামি তুলে বলল,
–” কিন্তু আমার চোখে তো ঘুম চেপেছে। আপনি প্রকৃতির সাথে প্রেম করুন আমি বরং ঘুমুতে যাই। ”
আরশিয়ানের মুখটা চুপসে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আলতো করে কোলে তুলে নিতেই প্রিমা তার গলা জড়িয়ে ধরে। আরশিয়ানের চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। প্রিমার প্রাণোচ্ছল হাসি দেখে আরশিয়ানের গম্ভীর মুখটায় মৃদু হাসি ফুটে উঠে।
_
সময়কাল প্রায় সকাল দশটা। রিসোর্টে এসে একচোট ঘুমানোর পর আরশিয়ানের মেসেজ পেয়ে রেস্টুরেন্ট এরিয়ায় হাজির হয় রাজ এবং তাজ। দু’জনে এসে দেখে আরশিয়ান ফিটফাট হয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে মাঝেমধ্যে আবার টেবিলের উপর থাকা ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক বসাচ্ছে। মিনিট দশেক বসে থাকার পরও শানের ভাবাবেগে না দেখে ইশতিরাজ বিরক্ত মুখে বলে,
–” নতুন বউয়ের বাতাস লাগছে গায়ে? আমাদের ডাইকা চুপচাপ বইসা আছোস ক্যা? ”
ইশতিরাজের মিশ্রিত ভাষায় করা কটুক্তি শুনে চোখ তুলে তাকাল আরশিয়ান। সামনে তাকাতেই দেখলো স্লিপিং আউটফিটে ঘুমঘুম চোখে হাজির হয়েছে বেচারা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” তোদেরকে দেওয়া কাজটা কমপ্লিট হয়েছে?”
আরশিয়ানের কথায় ঘুম ছুটে পালালো দু’জনের চোখ থেকে। তাজরিয়ান ভারিক্কি আওয়াজে বলল,
–” হ্যাঁ ভাই এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা। ”
আরশিয়ান ল্যাপটপটা বন্ধ করে সাইডে রেখে বলল,
–” হোয়াট এবাউট মিস্টার আশরাফ ওয়াসীত্ব? ”
ইশতিরাজ মনে মনে কয়টা বিশ্রী গালি দিয়ে তেঁতো মুখে বলল,
–” গতকাল ডিটেকটিভ টিমের চিফের সাথে কথা হয়েছে আমার। তিনি জানালেন জঙ্গি দলের সাথে হাত মিলিয়েছিল আশরাফ ওয়াসীত্ব। আরভিদের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডে আসলে একটা এট্যাকের ইনফরমেশন ছিলো। উনারা সবটা জেনে ক’জন টেরোরিস্ট কে হেফাজতে নিয়েছেন ইতিমধ্যে তবে কোনোভাবে এই বিষয়টা আগেভাগে টের পাওয়ায় মূল হোতা সহ আশরাফ ওয়াসীত্ব আপাতত নিরুদ্দেশ রয়েছে। ”
আরশিয়ান কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল,
–” তাহলে তো আমরাও সেফ না। ”
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে দিলো তাজরিয়ান অতঃপর বলল,
–” এইখানে সবথেকে বেশি সেইফ আমরা । তুমি চিন্তা করো না ভাইয়া যত ব্যবস্থা করা লাগে সমস্তটা করে ফেলেছি । তুমি জাস্ট ভ্যাকেশন ইনজয় করো।”
আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
–” তার মানে এটা ভ্যাকেশন নয়? আমরা জাস্ট নিজেদের সেইফটির জন্য জায়গা পরিবর্তন করেছি? ”
ইশতিরাজ লম্বা একটা হামি তুলে বলল,
–” ইয়েস ব্রাদার। তুই অতো চিন্তা করিস না আপাতত আমার বোনের দিকে নজর দে। আমরা আছি বাকিটা সামাল দিতে। তবে দিনশেষে শুধু একাউন্টে কাঙ্ক্ষিত এমাউন্টটা পৌঁছে দিলেই চলবে। ”
বিনিময়ে আরশিয়ান হাসলো কেবল। হুট করে তাজরিয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। মেহরিমার কল দেখে আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে কটেজের দিকে গেলো। তাজকে বেরিয়ে যেতে দেখে ইশতিরাজ বলল,
–” আমাদের তাজ কিন্তু আগের তুলনায় অনেকটা পাল্টেছে। এগ্রেসিভ ভাবটা একদমই নেই। উল্টো অনেক কেয়ারিং হয়েছে ইদানীং । ”
আরশিয়ান স্মিত হেসে বলল,
–” মেহরিমা ওর জন্য তাবিজের মতো। যতক্ষণ ওর সাথে আছে ততক্ষণ তাজের মাঝে মনুষ্যত্ব আছে।ভুলক্রমে যদি একবারও ওটা সামান্য দূরত্বে যায় তবে ওর মন্সটার সাইডটা এক্টিভেট হয়ে যাবে। হি ইজ অ্যা হিরো ফর হার গার্ল বাট..
বাকি কথা শেষ করার আগেই ইশতিরাজ বলল,
–” হি ইজ অ্যা ভিলেইন ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড এন্ড হি ক্যান ডেস্ট্রয় দ্যা হোল ওয়ার্ল্ড ফর হিজ গার্ল। ”
আরশিয়ান পুনরায় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
–” হি ক্যান অলসো ডেস্ট্রয় হিমসেল্ফ ফর হার। ”
কথার বিনিময়ে ইশতিরাজ স্রেফ হাসলো। কিছুক্ষণ পর আচমকা শুধাল,
–” তুই কী কিছু নিয়ে টেনসড? ”
আরশিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” ইদানীং খুব ভয় হয়। ক্ষণে ক্ষণে খুব প্রিয় কিছু হারানোর ভয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে উপরন্তু কাঁধে চেপে বসা দায়িত্ব ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে পারবো কি-না সেটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দিহান আমি। ”
প্রিমাকে হারানোর ভয়টা বুঝলেও বাকি কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো ইশতিরাজের। সে ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
–” কাঁধে চেপে বসা দায়িত্ব মানে? ”
আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” মেজো বাবা চাচ্ছিলেন তাজ চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থানটা বুঝে নিক অথচ এই বিষয়ে তাজ একেবারেই ভ্রূক্ষেপ। সেই সাত বছর আগে দেওয়া ত্যাজ্য বাণীকে সে ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই বিষয়ে যদি আমি তাকে মানাতে না পারি তবে এটার এফেক্ট আমাদের পরিবারের উপরেও পড়বে। সবমিলিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত।
ইশতিরাজেরও কপালে ভাঁজ পড়লো। আসলেই বিষয়টা চিন্তার। ধন সম্পদ সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে ফাটল ধরাতে সময় নেয় না। আরশিয়ানকে ক্ষমতা লোভী বানাতে বিন্দুমাত্র সময় নিবে না কিন্তু তাজের অবজ্ঞা কেউ আমলেই নিবে না। কিছু একটা ভেবে ইশতিরাজ শুধালো,
–” তোর ধূর্ত মস্তিষ্কে কোনো সমাধান কড়া নেড়েছে?
আরশিয়ান শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধীর কন্ঠে বলল,
–” ইদানীং আমার মিসেসের শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সময় বাড়ার সাথে সাথে উনি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। খুব সম্ভবত আর দু’মাস আমি অফিসের দায়িত্বে থাকতে পারবো এরপর আমাকে কয়েক মাসের জন্য লিভ নিতে হবে। এই মহড়া দিয়ে তাজের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করবো ভাবছি। আমার অবস্থা দেখে বেচারা নিষেধ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ”
ইশতিরাজ কপাল কুঁচকে বলল,
–” তাজরিয়ান এতটাও গাধা নয় যে তোর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল বুঝবে না। এটা হওয়ার চান্স ফিফটি ফিফটি। ”
আরশিয়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
–” উনাকে ভুল বোঝার দায়ে তাজের মনে সুপ্ত অপরাধবোধ আছে। এই অপরাধবোধ তাকে বাধ্য করবে আমার অবর্তমানে অফিস জয়েন করতে। ”
ইশতিরাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
–” এইটা কাজে দিতে পারে। যাইহোক, মিসেস লাড্ডুকে নিয়ে ভয় পাস না। উপরমহল মাত্র তিনদিন সময় নিয়েছেন আমাদের থেকে। উনারা কনফার্ম করেছেন এরমধ্যেই আশরাফ ওয়াসীত্বকে গ্রেফতার করা হবে। ডোন্ট ওয়ারি দোস্ত। ”
আরশিয়ান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” সিকিউরিটি মেইনটেইন করার পরও গতবার আমাদের সাথে দূর্ঘটনা ঘটেছে ইভেন তোদের বিয়ের রাতে আমরা এক্সিডেন্ট করতে করতে বেঁচেছি। ভয় হয় ভীষণ। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড় এসে অতি যত্নে বাঁধা ঘরটা ভেঙেচুরে নিঃস্ব করে দেবে না তো? ”
ইশতিরাজ কীয়ৎকাল থেমে অতঃপর বলল,
–” নিয়তির লিখন খণ্ডানোর সাধ্যি আমাদের নেই তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি। দেখা যাক অন্তিমে জয় টা কার হয়। ”
আরশিয়ান খানিকক্ষণ চুপ থেকে অন্য আলাপে ব্যস্ত হলো। ইশতিরাজ গভীর মনোযোগে সেসব শুনতে লাগলো এবং প্রত্যুত্তর দিলো।
_
মেহরিমার কল পেয়ে কিঞ্চিত চমকেছিল তাজ। ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে গিয়েছিল সে। অল্প সময়ে কী হলো ভাবতেই প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো কপালে। কটেজের দরজার তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফোঁপাচ্ছে মেহরিমা। আশেপাশের সমস্ত জিনিস মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মহারাণী রেগেমেগে এই আকাম ঘটিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তাজের।
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্লোরে পড়ে থাকা ভাঙা কাঁচ গুলো এড়িয়ে মেহরিমার পাশে গিয়ে বসলো তাজরিয়ান। তার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্বিগুণ তেজে অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করলো মেহরিমা। তাজের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। কী হলো হঠাৎ? তার বউটা এমন ক্ষেপলো কেনো? উত্তর জানতে মেহরিমার মাথায় হাত রেখে এলোমেলো চুলগুলো ঠিকঠাক করতে করতে ভীষণ আদুরে স্বরে তাজরিয়া বলল,
–” বউজান? কী হয়েছে সোনা? ”
তাজরিয়ানের আদুরে ডাকে আরও বেশি রেগে যায় মেহরিমা। ছিটকে সরে যায় আরেকটু দূরে। অল্প একটু সরলেই সোজা কাঁচ ভর্তি ফ্লোরে গিয়ে ধপাস করে পড়বে বেচারি । অঘটন টের পেয়ে খপ করে তার হাত টেনে ধরে জোর পূর্বক তাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে আনে তাজরিয়ান। মেহরিমা সরে যাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে তাজরিয়ান শক্ত করে চেপে ধরে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
–” কী হয়েছে মেহু? না বললে বুঝবো কীভাবে? অহেতুক জেদ দেখিয়ে বেলা শেষে তুই কষ্ট পাবি।শক্তিতে কখনো টেক্কা দিতে পারবি আমাকে? অযথা সরে যাওয়ার পায়তারা করছিস কেনো? আমি রেগে যাওয়ার আগে ভালোই ভালোই কারণটা বল। ”
শেষ কথাটা ধমকের ন্যায় শোনাল। মেহরিমা শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠে তাজরিয়ানের বুকে ধাক্কা দিলো নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কিন্তু তাজরিয়ান ছাড়লো না। উল্টো তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
–” কী হয়েছে আমার বউজানের ? অভিমান জমেছে? আক্ষেপ হয়েছে নাকি অভিযোগ রয়েছে? ”
তাজরিয়ানের আদুরে স্বরে কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে যায় মেহরিমার। ক্রন্দনরত স্বরে জেদি গলায় তেজ ঢেলে অভিযোগের সুরে বলে,
–” টানা তিনটা দিন একটুও শান্তিতে ঘুমুতে পারিনি আমি। রাত জেগে আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি অতঃপর আপনার কারণে শেষ রাতে ঘুমিয়েছি। সকাল বেলা জলদিই উঠে এক্সামের পড়া করতে হয়েছে। দিনে দুই-এক ঘন্টা ঘুমালেও শান্তির ঘুম হয়নি একদমই। আজকে একটু ঘুমিয়েছিলাম অথচ আপনি আমাকে ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।এত সাধনার ঘুমটা নিমিষেই শেষ। আমার জাস্ট অসহ্য লাগছে এখন। ভীষণ রাগ উঠছে। একটুও ভাল্লাগছেনা। ”
মেহরিমার শরীর কাঁপছে। চোখদুটোতে ঘুমের তীব্র রেশ বিদ্যমান। তাজরিয়ান নিরবে সবটা পর্যবেক্ষণ করে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সান্ত্বনা বাণী দেওয়ার বদলে মেহরিমার নতজানু কোমল দেহটাকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো। ঘুম কম হওয়ার ফলে মাত্রাতিরিক্ত হাইপার হয়ে উঠেছে বেচারি। তাজরিয়ানের উচিত ছিলো এক্সামের দিন গুলোতে তার সান্নিধ্যে ত্যাগ করা। অপরাধবোধে ভেতরটা মুষড়ে পড়লো তবে সেটা প্রকাশ করলো না। মেহরিমা একটুখানি শান্ত হয়ে আসতেই তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো তাজরিয়ান। মেহরিমা রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে নিলে ভীষণ ঠান্ডা গলায় তাজ বলে,
–” আই সোয়্যার মেহু। তুই যদি অকারণে জেদ দেখিয়ে উঠিস তাহলে প্রতি রাতের ঘটনা আজকে অবাধে রিপিট হবে এবং হুঁশ হারিয়েও তুই আমার থেকে রেহাই পাবি না। ”
মেহরিমা ব্যর্থ হয়ে তাজরিয়ানের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠে। বিড়বিড়িয়ে কত-শত অভিযোগ করে। তাজরিয়ান কেবল শুনে কিন্তু প্রত্যুত্তর করেনা। তার মন মস্তিষ্কে চলছে ভিন্ন চিন্তা। মেহরিমার অবস্থার সাথে নিজের অতীতের খুব নিখুঁত কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছে তাজরিয়ান। বিদেশ যাওয়ার পর মেহরিমাকে একটুখানি দেখার তৃষ্ণা, কথা শোনার অভিপ্রায়ে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আজ সেই মেয়েটাই তার প্রতি এতটা অবসেশড হয়ে পড়েছে যে তাকে ছাড়া চোখের পাতায় শান্তির ঘুমটা পর্যন্ত ধরা দেয় না।
মেহরিমার ভারিক্কি উষ্ণ প্রশ্বাস বুকের কাছটায় অনুভূত হতেই ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসলো তাজরিয়ান। চোখ ফিরিয়ে তাকালো তার সাথে আদুরে ছানার ন্যায় লেপ্টে থাকা মেহরিমার দিকে।মেয়েটার পরনে রয়েছে কম্ফি ওভারসাইজ টিশার্ট। বিষয়টা পছন্দ হলো না তাজের। ঘুমন্ত মেহরিমাকে বুকে রেখেই ওটা খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো সে। মেহু একটু নড়েচড়ে উঠতেই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ বুঁজে বুঁজে আসা কন্ঠে বলল,
–” আমি জিতেছি মেহু। আমার ধৈর্য আমার ত্যাগ কোনোটাই বৃথা যায়নি। এতদিন পর এসে উপলব্ধি করলাম আমাদের সম্পর্কটাতে বিবাদের তুলনায় বিস্ময়াভিভূত প্রণয় বেশি, আক্ষেপের তুলনায় অনুভূতি বেশি, অভিমানের তুলনায় প্রায়োরিটি বেশি। না পাওয়া সবকিছু কেবলই ঠুনকো এক স্মৃতি। ”
তাজরিয়ানের কন্ঠে কম্পন তবে তার উষ্ণতায় লেপ্টে থাকা মেহরিমা কিছুই টের পেলো না। ভীষণ সাবধানে তার মুখশ্রী জুড়ে অসংখ্য ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলো তাজরিয়ান। অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাঝেমধ্যে হেঁচকি উঠতে থাকা মেহরিমার অনাবৃত দেহখানা নিজের সাথে আরেকটু নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে তাজরিয়ান বলল,
–” আম রিয়েলি ভেরি স্যরি বউজান। আর একটুও কষ্ট দিবো না তোকে। একদম গুড বয় হয়ে যাবো আমি। ভীষণ খেয়াল রাখবো তোর। বেশি পাগলামি করে ফেলেছি না? আর হবে না তো। তুই রাগ করিস না কেমন? প্রয়োজনে আমি কানে ধরে স্যরি বলবো তবুও তুই কাঁদিস না। আমার বুকটা বড্ড পোড়ে তুই কাঁদলে। ভীষণ অস্থির লাগে তবে হাসলে তোকে একদম আমার মহারাণীর মতো দেখায়। ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তোকে মেহু। ”
চলবে?