শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
14

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া_ইমরোজ
৩৫(প্রথমাংশ)

কুয়াশা জড়ানো শীতের সকাল।পূর্ব আকাশে তখনও সূর্য উঠেনি। প্রভাতের অস্পষ্ট কুয়াশা ভেদ করে কবরস্থানের মূল ফটকে এসে থামলো একটি গাড়ি। ভেতর থেকে নেমে আসলো ছ’ফুট উচ্চতার দীর্ঘ দেহী এক পুরুষ। শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষটা স্লিভ গুটিয়ে নিয়ে কলপাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। অভিব্যক্তিহীন ভাবে ওযু শেষে এগিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতেই থমকে যায় পুরুষটির দৃঢ় কদম।

কাঙ্ক্ষিত কবরটা নজরে আসতেই আরশিয়ান হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়লো। কীয়ৎকাল একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো বাঁধাই করা কবরটার পানে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো একটা দীর্ঘশ্বাস। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলে উঠল,

–” আমাদের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। কী দোষ করেছিলাম আমি? বস্তবতা আমার বেলায় কেনো কঠোর আচরণ করে?..

অজানা কারণে কন্ঠ রোধ হয়ে আসে তার। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বিতৃষ্ণা নিয়েই ছুঁয়ে দেয় কবরের মাটি। অস্ফুটস্বরে পুনরায় শুধায়,

–” আমার বিবাহিতা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে যাওয়ার অন্যায়টা কীভাবে ক্ষমা করবো আমি? খুব প্রয়োজন ছিলো এসব করার? পূরণ করিনি আমি তোমার চাহিদা? চিনতে না তুমি আমাকে? জানতে না আমি কেমন মানুষ? তবুও কেনো তাদের ষড়যন্ত্রে শামিল হলে? কেনো আমায় ঠাকালে নিহা? ”

অপর পাশ থেকে উত্তর আসেনা। আরশিয়ান ও কথা বাড়ায় না। দশটা বছর হয়ে গেলো মানুষটা পৃথিবীতে নেই। সবটা মেনে নিলেও তার অন্যায়টা মানতে পারেনি। আরশিয়ান পারেনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ক্ষমা করতে। প্রায় তিনটে বছর নিজের সাথে যুদ্ধ করে অতঃপর আজ মুখোমুখি হয়েছে অভিশপ্ত সত্যের।

নিজেকে সামলে আরশিয়ান উঠে দাঁড়ল। গোরস্থান ছেড়ে এতিমখানায় গেলো অতঃপর ইনচার্জের সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসলো। পেছনে ছেড়ে গেলো এক অপ্রিয় অতীত। এগিয়ে গেলো নিজ গন্তব্যে কেননা তার জন্য কেউ একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

_

সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে তাজরিয়ান। আচমকা বুকের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট অস্তিত্বের নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ঘুমটা হালকা হয়ে আসে তার। ফট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার প্রিয় ভাতিজা প্রান্তিক চৌধুরী ঘুমের ঘোরে নাকের পাটা ফুলিয়ে কান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাজরিয়ান ঘুম কাতরে চোখ জোড়া মেলে আলতো হাতে পিঠে দু’চারটে থাবা বসিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এবং নিজেও উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

নাস্তার জন্য ডাকতে এসে ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে বড্ড বেশি হতাশ হয় মেহরিমা। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে প্রথমে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয় অতঃপর আলতো স্বরে তাজরিয়ানকে ডাকতে থাকে। মেহরিমার ডাকে তাজরিয়ান চোখ মেলে তাকায়। অস্ফুটস্বরে বলে,

–” সারাটা রাত আমাকে অনাহারে রেখে দিনের বেলা খাঁচায় বন্দী হতে এসেছিস? ”

মেহরিমা লজ্জায় লাল হয়ে ধীর স্বরে বলে,

–” ভাতিজা শুয়ে আছে পাশে। একটু তো লেহাজ…

তাজরিয়ান খপ করে মেহরিমার হাত পেঁচিয়ে ধরে সুর টেনে গেয়ে উঠে,

–” অভদ্র হয়েছি আমি তোমারই প্রেমে তাই…

গানটা শুনে মেহরিমা ছিটকে সরে যেতে নেয়। বিষয়টা টের পেতেই তাজরিয়ান এক টানে তাকে বুকের উপর ফেলে অতঃপর মেয়েলী কোমরটা পেঁচিয়ে ধরে হাস্কি স্বরে বলে উঠে,

–” দূরে সরার চেষ্টা করিস না বউজান.. তাজরিয়ান শ্বাস আঁটকে মরে যাবে। ”

মেহরিমা দূরে সরলো না। তাজরিয়ানের প্রশস্ত বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীর স্বরে বলল,

— ” আমি তো অক্সিজেন নই তাহলে শ্বাস আঁটকে মরবেন কেনো? ”

তাজরিয়ান ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

–” তুই আমার প্রাণ ভোমরা রে বউজান। তুই বিহীন বেঁচে থাকবো কীভাবে? ”

মেহরিমা কথা বাড়ালো না। চুপচাপ লেপ্টে রইল তাজরিয়ানের প্রশস্ত বক্ষে। বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। এই মানুষটার উন্মাদনা তার অদেখা নয়। এইতো তার প্রেগন্যান্সির সময়কার ঘটনা, পজেটিভ রেজাল্ট এনসিওর করার জন্য তৎক্ষণাৎ তাজরিয়ান ছুটেছিল হসপিটালে। দীর্ঘ সময় পরীক্ষানিরীক্ষার পর জানা যায় মেহরিমা একদম সুস্থ এবং বেবির কন্ডিশন ও ভালো।

সবকিছু ঠিকঠাক দেখে খুশিতে পাগলপারা তাজ এবং বাড়ির বাকি সদস্যরা। পুরো অফিসে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল এই উপলক্ষ্যে কিন্তু দিন শেষে তাদের খুশিটা হাতছানি দিয়ে হারিয়েছে বহুদূরে। মেহরিমার প্রেগন্যান্সির পুরো জার্নিটা চমৎকার ছিলো। সাফার করার বদলে প্রত্যেকটা মুহূর্ত ইনজয় করেছে সে। তবে সাত মাসে পড়তেই শরীরটা একটু দুর্বল হয়ে পড়ে।

খানিকটা সময় পেরোতেই আচমকা একদিন মেহরিমা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সকাল থেকেই প্রেশার লো ছিলো। অল্প খাবার খেতেই দুর্বল মেহরিমা বমি করে পুরো শরীর মাখিয়ে ফেলে। তাজরিয়ান সবটা পরখ করে মেহরিমাকে শাওয়ারের জন্য নিয়ে যায়। শাওয়ার শেষে মেহরিমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে তাজরিয়ান যায় কাপড় ধৌত করতে। এর মধ্যে আচমকা মেহরিমার পানি পিপাসা পায়। আশেপাশে খুঁজে দেখে পানির জগটা বেলকনির সেন্টার টেবিলে রাখা।

তাজরিয়ানকে বিরক্ত না করে মেহরিমা আস্তেধীরে নিজেই উঠে যায়। সাবধানে বেলকনিতে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে অল্প একটু খায় কিন্তু সেটুকু পেটে সয় না। গলগলিয়ে বমি করে ভাসিয়ে ফেলে ফ্লোর। দুর্বল মেহরিমা ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ে পাশ্ববর্তী সোফায়। আকস্মিক সবটা অন্ধকার হয়ে আসে। মেহরিমা নিজেকে সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। উষ্ণ তরলে ভেসে যায় পুরো ফ্লোর। অসহ্য যন্ত্রণায় শ্বাস আঁটকে আসে মেহরিমার। অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,

–” তা..জ। ”

মিনিট দশেক পর তাজরিয়ান বেরিয়ে আসে। ঘরের ভেতর মেহরিমাকে না পেয়ে বেলকনিতে খুঁজতে আসে। কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই হুট করে তার চোখ আঁটকায় রক্তাক্ত মেহরিমার দিকে। হতবিহ্বল তাজরিয়ান তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে তার নিকট। মেহরিমা তখনও হুঁশে ছিলো। তাজরিয়ান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আর দেরি করেনি। তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় হসপিটালে কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মেহরিমাকে বাঁচাতে পারলেও তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করে।

এরপরের পরিস্থিতি গুলো ছিলো ভয়াবহ। মেহরিমা ভীষণ ভেঙে পড়ে। ধৈর্যহীন তাজরিয়ান অদ্ভুত ভাবে ভীষণ ম্যাচিউর হয়ে উঠেছিল। কোনোপ্রকার পাগলামি করেনি উল্টো নিজের সাথে মেহরিমাকেও সামলেছে চমৎকার ভাবে।

মেহরিমাকে চুপটি করে শুয়ে থাকতে দেখে তাজরিয়ান মৃদুস্বরে ডাকে,

–” মেহু জান? ”

মেহরিমা বেখেয়ালে উত্তর দেয়,

–” হুঁ?

তাজরিয়ান আকস্মিক তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

–” কোন জগতে হারিয়েছিস? ”

মেহরিমা উদাস স্বরে বলল,

–” আজ যদি ও থাকতো তাহলে…

তাজরিয়ান বুঝে যায় মেহরিমার না বলা কথা তাই তাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে,

–” অতীত নিয়ে আফসোস করিস না জান। নিয়তি হয়তো অন্যকিছু চেয়েছিল। উপরওয়ালা আমার কোল খালি করলেও বুক খালি করেনি। আমি এতেই সন্তুষ্ট। আরকিছু চাই না জীবনে। ”

মেহরিমার চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ নোনাপানি। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

–” আমি যদি আরেকটু কেয়ারফুল হতাম তাহলে এমন কিছুই হতো না। আপনি ঠিক বলেছিলেন। বেবির দায়িত্ব নেওয়ার মতো ম্যাচিউরিটি আমার মধ্যে ছিলো না। আই ওয়াজ ডেফ এন্ড ডাম্ব।আপনার কথা বুঝিনি উল্টো জেদ ধরে নিজেদের সম্পর্ক নষ্ট করেছি। সেদিন যদি বুঝতাম..

তাজরিয়ান থামালো না মেহরিমা কে। কাঁদতে দিলো খানিকক্ষণ অতঃপর বলল,

–” তুই কখনোই অকারণে আমার অবাধ্য হোস না। এই বিষয়ে এত বেশি জেদ করার পেছনে নির্দিষ্ট কিছু রিজন আছে অথচ তুই আমাকে এখনো সেসব কিছুই বলিসনি। তুই কি এই বিষয়টা শেয়ার করতে চাইছিস না?

মেহরিমা চুপ রইল। তাজরিয়ান ও নিশ্চুপে তাকিয়ে রইল তার মুখপানে। তা দেখে মেহরিমা চোখ বুঁজে ফেললো। মনে মনে বলল,

–” আপনার মায়ের শর্ত আপনাকে কীভাবে বলি? কীভাবে বলি আপনার শ্রদ্ধেয় মা আমাকে বলেছিলেন, ” যদি আমি অতি শীঘ্রই আপনাকে সন্তানের সুখ দিতে না পারি তবে উনি আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছাড়বেন।” আপনি সইতে পারবেন এই অপ্রিয় সত্য? থাক না কিছু সত্য আড়ালে। সংসারে নতুন কোনো অশান্তি হোক সেটা আমি চাই না তাজ। ”

_

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আরশিয়ানকে পাশে পায়নি প্রিমা। ভেবেছিল জিমে আছে তাই নিজেই উঠে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে একটু রুপচর্চা করছিল। মশচরাইজার দেওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই তার এক মাত্র কন্যা আরিশফা ইরিন চৌধুরী কেঁদে উঠে। প্রিমা স্কিন কেয়ার ভুলে মেয়েকে দোলনা থেকে কোলে তুলে নেয় । ইরা কে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে অল্প একটু ফিডিং করায় অতঃপর ড্রয়িংরুমে বসে থাকা আরিয়ান চৌধুরীর জিম্মায় রেখে রান্নাঘরে আসে। এক ফাঁকে অবশ্য তার বড় ছেলে আহিয়ান চৌধুরীকে ফ্রেশ করিয়ে তার দাদীর কাছে রেখে আসতে হয়েছে।

সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত প্রিমা। চটজলদি হাত চালিয়ে পরোটা বানাচ্ছে সে। আজকে হেল্পিং হ্যান্ড আসেনি বিধায় একটু বেশি প্রেসার পড়ে গেছে বেচারির উপর। তবে এতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত নয় প্রিমা উল্টো খুশি মনে গুনগুনিয়ে চায়ের ধোঁয়া ওঠা কাঁচের কেটলিতে একের পর এক ইনগ্রিডিয়েন্ট সংযুক্ত করছে। তার কাজের মাঝে বাগড়া দিতে হাজির হয় কেউ একজন। প্রিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে স্বয়ং তার সোয়ামী উপস্থিত হয়েছে রান্নাঘরে। তাকে দেখে প্রিমা প্রশ্ন করলো,

–” সকাল বেলা শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবি পরে কোথায় গিয়েছিলেন? ”

আরশিয়ান এগিয়ে আসতে আসতে নিরেট স্বরে জাবাব দেয়,

–” অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে…

প্রিমা বুঝে নিলো যা বোঝার। কথা না বাড়িয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল,

–” কী চায়? ”

আরশিয়ান খেয়াল করেনি প্রিমার কথা। কিচেনে ঢুকতেই তার নজর আটকেছে প্রিমার উন্মুক্ত কোমরে। চোখের দৃষ্টি আস্তে-ধীরে উপরে উঠতেই তার অস্থিরতা অনুভব হয়। প্রিমার পরনে আছে ডিপ নেক ব্লাউজ যার ফলস্বরূপ তার অধিকাংশ পিঠের অংশবিশেষ উন্মুক্ত। প্রিমা পরোটা ভাজতে ভাজতে পুনরায় একই প্রশ্ন করলো। আরশিয়ান নির্বিকার চিত্তে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে প্রিমার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল অতঃপর তার অনাবৃত কাঁধে আঙ্গুল স্লাইড করে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে মৃদু স্বরে বলল,

–” একটুখানি ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে চাইছি আপনার উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশে। এক্ষুনি.. এমুহূর্তে আর এখানেই। অনুমতি দিবেন? ”

প্রিমা কেঁপে উঠে কিঞ্চিত। এলোমেলো হয় তার দৃষ্টি। বরাবরের মতো অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায় সর্বাঙ্গে। এরমধ্যেই আচমকা ইরার কান্নার শব্দ শোনা যায়। ঘোর কেটে যায় দুজনেরই। প্রিমা হতাশ কন্ঠে বলে,

–” তিন বাচ্চার বাবা হওয়ার পূর্বে অনুমতি চাইলে ভেবে দেখার অপশন ছিলো। এখন কী আর সেই উপায় আছে? ”

আরশিয়ান হেসে ফেলে প্রিমার কথায়। কিছু একটা মনে পড়তেই শুধাল,

–” ড্রয়িংরুমে শুধু ইরা আর আহিয়ান কে দেখলাম.. প্রান্তিক কোথায়? ঘুমাচ্ছে? ”

প্রিমা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,

–” তাজ ভাইয়ার কাছে আছে। রাতে ওখানেই ঘুমিয়েছে। ”

আরশিয়ানের বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মেহরিমা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রান্তিক কে প্রায় ওরা নিজেদের সাথে রাখে। আরশিয়ান বাঁধা দেয় না তবে ওদের অবস্থা দেখে তার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। তিন সন্তানের মধ্যে কেউ একটু চোট পেলে আরশিয়ানের কলিজা কাঁপে অথচ তাজরিয়ান নিজের কাঁধে তার সন্তানের লা শ বহন করেছে। আরশিয়ান আর ভাবতে চাইলো না সেসব নিয়ে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল,

–” আপনি ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? চুল তো এখনো ভেজা.. হেয়ার ড্রায়ার কী নষ্ট হয়ে গেছে? ”

প্রিমা লজ্জা পেয়ে গেলো। কী আশ্চর্য..কী শুরু করেছে এই লোক। প্রিমা হাসি চেপে রেখে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,

–” আমার একদম ঠিক আছি। হেয়ার ড্রায়ার ও ঠিক আছে। রান্না সেরে চুল শুকাতে যাবো। ”

আরশিয়ান ভ্রুকুটি করে বলল,

–” ঠান্ডা লেগে যাবে না? একটু সাবধানে চলাফেরা করুন। আপনার ঠান্ডা লাগলে ইরাও সাফার করবে। বি কেয়ারফুল ওকে? ”

প্রিমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আরশিয়ান ঠিক কথা বলেছে। ছেলে দুজন শক্তপোক্ত হলেও মেয়েটা একটু দুর্বল। তাদের মাঝে বয়সের ফারাক নেই তবুও আহিয়ান এবং প্রান্তিকের তুলনায় ইরার ইমিউনিটি সিস্টেম উইক। মেয়েটা একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

প্রিমাকে একমনে কাজ করতে দেখে আরশিয়ান বিরক্ত হয়ে গেলো। প্রিমার শাড়ির ফাঁক গলিয়ে নিজের হিমশীতল হাতখানা রেখে আলতো করে তার উদর চেপে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলল,

–” কথা বলছেন না কেনো? রেগে আছেন কোনো কারণে নাকি ইগনোর করছেন? ”

প্রিমা আঁতকে উঠলো তার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে। মুখ ফুলিয়ে বলল,

–” বলছি তো কথা। আমি একদমই রেগে নেই ইরার আব্বু। শুধু একটু ব্যস্ত আছি রান্নাবান্নায়। ”

আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,

–” সার্ভেন্ট কোথায়? এইটা কী আপনার ডিপার্টমেন্ট? আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম আপনাকে। বলেছিলাম না,আমি বাসায় থাকাকালীন আপনি রুম থেকে বেরবেন না। তাহলে এখন কাজের বাহানা দেখাচ্ছেন কেনো?”

প্রিমা মনে মনে গুটিকয়েক গালি দিয়ে ধীর স্বরে বলল,

–” দু’জনেই ছুটিতে আছে। আম্মা এই অবস্থায় রান্না ঘরে আসতে পারবে? এটা ভালো দেখায়? ”

আরশিয়ান ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

–” এটাই লাস্ট টাইম। আমি সার্ভেন্টের বিষয়টা দেখছি তবে এরপর আমি বাসায় থাকাকালীন সময় আপনি রুমের বাহিরে থাকবেন না কেমন? ”

প্রিমার বড্ড হাসি পেলো এমন ধারার কথায়। প্রায় তিন বছর অতিক্রম হয়েছে তাদের সংসার জীবনের অথচ মানুষটা আগ্রহ হারানোর বদলে দ্বিগুণ ভাবে পাশে থাকার আবদার করছে। নিছকই পাগলামি এসব। প্রিমা দুষ্টুমির ছলে আচমকা বলে উঠল,

–” সেদিন যদি আমি না ফেরার দেশে পাড়ি জমাতাম তাহলে কী করতেন? আপ..

প্রিমা কথাটা শেষ করতে পারেনি তার আগেই টের পেলো আরশিয়ানের হাতের বাঁধন আলগা হয়েছে। মানুষটা সরে গেছে এক ঝটকায়। প্রিমা দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। বেচারি এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। ভীত চোখে সামনে তাকাতেই দেখে আরশিয়ান মুঠো পাকিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিমা আমতা আমতা করে বলল,

–” ইয়ে মানে.. আমি ওভাবে বলতে চাইনি।

আরশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” বাচ্চাদের বাহিরে রেখে রুমে আসুন। কী বলতে চেয়েছেন কিংবা চাইছেন সেটা একটু পরখ করে দেখবো..

চলবে?

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
রুহানিয়া_ইমরোজ
৩৫(শেষাংশ)

নাস্তার টেবিলে অবস্থান করছেন চৌধুরী বাড়ির সকল সদস্য। প্রিমা আর মেহরিমা মিলেমিশে খাবার সার্ভ করছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে নাস্তা খেলেও আরশিয়ান আঁড়চোখে বারংবার প্রিমার দিকে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টিতে মিশে আছে মৃদু রাগের ছটা। প্রিমাকে রুমে আসতে বললেও ফাঁকিবাজ মহিলা একদমই তার কথা শুনেনি। তার শাসন থেকে বাঁচতে রান্নার বাহানায় বাহিরেই থেকে গেছে।

আরশিয়ানের ক্ষিপ্রতা বেশ ভলোই টের পেয়েছে প্রিমা। তাইতো ভয়ের চোটে ঘরে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায়নি। তবে সেটাও তো আর বেশিক্ষণ সম্ভব নয়। দিনশেষে তার ঠিকানা তো ওই গম্ভীরমুখো জাঁদরেল মানুষটাই। প্রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরাসরি তাকাল আরশিয়ানের দিকে। মহাশয় মেয়েকে উরুর উপর বসিয়ে চামুচ দিয়ে খিচুড়ির খাওয়াচ্ছেন।

প্রিমা খুব ভালো মতো জানে, সে গিয়ে আরশিয়ানের পাশের চেয়ারে না বসলে সেই ভদ্র লোক একটা দানাও স্পর্শ করবে না। ডেলিভারির পর থেকে এই নিয়ম চলছে। অসুস্থ প্রিমা তখন পুরোপুরি শানের উপরই নির্ভরশীল ছিলো। লোকটা খুব যত্নে সামলেছে তাকে৷ কখনো বিরক্ত হয়নি উল্টো তার সাথে সাথে বাচ্চাদের দিকটাও নজরে রেখেছে। প্রিমা কখনোই ফিড করার সময়টুকু বাদে অন্য সময় বাচ্চাদের কাছে পেতো না। বাড়ির সদস্যগণ এবং দু’জন নার্স মিলে সামলাতো বাচ্চাদের। বাচ্চাদের জন্য কখনোই প্রিমাকে রাত জাগতে হয়নি তবে বাচ্চাদের বাবা তাকে খুব একটা ছাড়ও দেয়নি। নিজের হিসেবের লাভটুকু ঠিকই বুঝে নিয়েছে। কথাগুলো মনে পড়তেই ভালোলাগা এবং লজ্জায় ছেয়ে গেলো প্রিমার অন্তঃকরণ।

প্রিমাকে টেবিলের কর্ণারে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টেবিলে বসা আরিয়ান চৌধুরী বলে উঠলেন,

–” আম্মা? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেলে কিন্তু খেতে ভালো লাগবে না। জলদি খেতে বসুন। ”

আরিয়ান চৌধুরীর কথায় প্রিমার ধ্যান ভাঙে। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

–” জ্ জ্বী বাবা বসছি। ”

কথাগুলো বলে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গিয়ে বসল আরশিয়ানের পাশের চেয়ারে। টেবিলের উপর উল্টে রাখা প্লেটটা সোজা করতেই আরশিয়ান খিচুড়ি রাখা হটপটটা এগিয়ে দিলো। প্রিমা সামান্য থেমে আঁড় চোখে তাকিয়ে দেখলো সেটা। মহাশয়ের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক দেখে স্বস্তি পেলো। প্লেটে খিচুড়ি তুলে নিতে নিতে শুনলো ইরা বলছে,

–” নো ব্ বাবা। আন না.. কাবো না। ( আর খাবো না)

মেয়ের আধো স্বরে বলা কথাগুলো ঠিকই বুঝলো আরশিয়ান। সে নিজেও হালকা স্বরে বলল,

–” ঠিকাছে বাবা। আর দিবো না।

লাস্ট চামচ খাইয়ে মেয়ের হাতে পানির ফিডারটা তুলে দিলো আরশিয়ান। ইরা সানন্দে সেটা গ্রহণ করলো। পরিশেষে ন্যাপকিনের সাহায্যে মেয়ের মুখ মুছিয়ে দিয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। ইরাও ছোট্ট কদম ফেলে তার খেলনার বাক্সের দিকে অগ্রসর হলো। পুরো দৃশ্যটা মুগ্ধ চোখে দেখছিল প্রিমা। উপস্থিত সকলেও বড্ড উপভোগ করেছে বাবা মেয়ের মিষ্টি বন্ডিং।

খাবার নিয়ে থম মেরে বসে থাকতে দেখে প্রিমার পানে দৃষ্টি ফেরালো আরশিয়ান। নিজের প্লেটে খিচুড়ি, আচার এবং অল্প একটু ঘী তুলে নিয়ে সেটা প্রিমার প্লেটের সাথে এক্সচেঞ্জ করতে করতে বলল,

–” খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভাল্লাগবে না। ”

প্রিমা হকচকিয়ে উঠল। ইদানীং একটু বেশিই হেয়ালি হয়ে গেছে সে। সুযোগ মিললেই খালি কল্পনায় ডুবে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেট টেনে খওয়া শুরু করলো। আরশিয়ান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বারংবার দেখছিল প্রিমাকে। খেতে বসে এমনটাই করে সে। খাবারের বিষয়ে প্রিমা বড্ড উদাসীন। এজন্য এদিকটা তারই নজরে রাখতে হয়। খাওয়ার এক পর্যায়ে প্রিমা মরিচ সহ ভাতের লোকমা মাখিয়ে ফেললে আরশিয়ান বলে উঠে,

–” ঝাল মরিচ খেলে ক্ষতি হবে। ওটা ফেলে দিন। ”

প্রিমা থতমত খেয়ে যায়। ঝাল খেতে তার তেমন একটা সমস্যা হয় না। ইচ্ছে বশতই মরিচ সহ লোকমা মাখিয়ে ছিলো কিন্তু আরশিয়ানের নিষেধাজ্ঞায় থেমে গেলো। তাকে মূর্তির মতো বসে থাকতে দেখে আরশিয়ান নিজেই খিচুড়ির সমস্ত মশলা ভালোমতো বেছে ফেলে দিয়ে বলল,

–” এবার খেতে পারেন। মশলা কিংবা মরিচ নেই..

উপস্থিত সকলে ঠোঁট চেপে হাসছিল। চৌধুরী বাড়ির সবথেকে নিরামিষ এবং নিরপেক্ষ ছেলেটার অমায়িক পরিবর্তনে তারা বিস্মিত। প্রিমা লজ্জা পেয়ে যায় সবার টিটকারিতে। আরশিয়ান নির্বিকার ভঙ্গিমায় খেতে থাকে। হুট করে তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। ভ্রু কুঁচকে পকেট থেকে ফোন বের করে কলার আইডিতে ইশতিরাজের নাম দেখে আরও বেশি অবাক হয়। ঝটপট রিসিভ করে বলে,

–” সব ঠিকাছে? এত সকালে কল দিলি যে..

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজ বলে উঠল,

–” মিসেস লড্ডুকে নিয়ে একবার আসতে পারবি ? জানার কন্ডিশন তেমন একটা ভালো না। সকাল থেকে বড্ড বেশি ঠান্ডা আচরণ করছে। আমার সাথে একটুও কথা বলছে না। সকাল থেকে একটাবার ও তার মুখনিঃসৃত কোনো শব্দ শুনিনি। যদি ব্যস্ততা না থাকে তাহলে একবার আসবি ? ”

আরশিয়ান তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,

–” এক্ষুনি আসছি। তুই চিন্তা করিস না। উনাকে চোখে চোখে রাখ। নিজেও একটু স্ট্রং হওয়ার চেষ্টা কর। আমরা আসছি। ”

আরশিয়ানের উত্তর শুনে ভারাক্রান্ত স্বরে ইশতিরাজ বলল,

–” হুঁ। ”

_

সময়ের পরিক্রমায় জীবন বদলায়। ইশতিরাজ এবং ফারজানার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। হানিমুন ফেইজ পার হয়ে জীবন এগিয়ে চলেছে বহুদূর। ভালো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সংযুক্ত হয়েছে তিক্ত গল্প। বিয়ের পর ফারজানার হার্টের চিকিৎসায় তৎপর হয়ে উঠে ইশতিরাজ। এক বছরের মাথায় সমস্ত কোর্স কমপ্লিট হয় এবং ফারজানার কন্ডিশন বেশ খানিকটা স্টেবল হয়। দু’জনেই পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে সন্তান গ্রহণের সিধান্ত নেয় তবে নিয়তির লীলাখেলা বোঝা বড় দায়।

কোনো রুপ শারিরীক জটিলতা না থাকলেও সন্তান ধারণে ব্যর্থ হয় ফারজানা। টানা একটা বছর এত প্রচেষ্টার ফল বৃথা হওয়ায় মানসিক ভাবে একদম বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে সে। দিনরাত নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,

–” আমি কলঙ্কিনী বলেই পবিত্রতা আমার নিকট ধরা দিচ্ছে না। ”

ইশতিরাজ যথেষ্ট বুঝিয়েছে তবে লাভ হয়নি। দিনকে দিন মেয়েটার কন্ডিশন বিগড়ে যাচ্ছে। ইশতিরাজ সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু তাতেও বিশেষ উপকার হয়নি। মেয়েটা কোঅপরেট করতে নারাজ৷ ইশতিরাজ জোর করেনি উল্টো তাকে যথাসম্ভব সময় এবং সাপোর্ট দিয়েছে।

আরশিয়ানের সাথে কথা বলে ইশতিরাজ ঘরে এলো। দৃষ্টি বুলাতেই দেখলো ফারজানা বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার শীর্ণকায় শরীরে একটা কম্ফোর্টার টেনে দেওয়া। ডার্ক সার্কেল আবৃত চোখদুটো উদাসীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সিলিং এর দিকে। ইশতিরাজ ধীর কদমে এগিয়ে গেলো। ফারজানার পায়ের কাছটায় বসে তার পা জোড়া কোলের উপর টেনে নিয়ে বলল,

–” কিসের চিন্তায় বিভোর আমার মহারাণী? ”

ফারজানা নির্জীব দৃষ্টি ফেলে বলে,

–” কিছু না। অফিস যাবেন না? ”

ইশতিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

–” আজ শুক্রবার জানা। এই দিনে আমি হসপিটাল যাই না। ”

ফারজানা ম্লান স্বরে বলল,

–” তাইতো। স্যরি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম ব্যপারটা।

ইশতিরাজ সহ্য করতে পারলো না তার এই নির্লিপ্ততা। কৌশল অবলম্বন করে ফারজানার ছোট্ট কোমল দেহখানা কোলের মধ্যে নিয়ে আসলো। যদি-ও ফারাজানা আসতে চাইনি তবে একপ্রকার জোর করেই নিজের বুকের সাথে তাকে চেপে ধরে রেখেছে ইশতিরাজ। ফারজানা হাত-পা ছুঁড়ে অস্ফুটস্বরে বলে,

–” ছাড়ুন আমায় রাজ। অপবিত্র আমি। আমার সংস্পর্শে এলে আপনার ক্ষতি হবে।

ইশতিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” তোমার অবহেলায় জিন্দা লাশ হয়ে যাচ্ছি সেই খবর রেখেছো? আফসোস..শরীরের মৃত্যু তোমাকে ভাবায় অথচ আমার আত্মিক মৃত্যু তোমায় স্পর্শ করে না। ”

ফারজানার নাকের পাটা ফুলে উঠে। বুক ফেটে কান্না পায় কিন্তু সে কাঁদে না। শান্ত হয়ে ইশতিরাজ এর বুকে লেপ্টে থেকে বলে,

–” আমি আসলেই ব্যর্থ। বউ হিসেবে ব্যর্থ। স্বামীকে সুখ দিতে ব্যর্থ। তাকে বুঝতে ব্যর্থ। আর..

ইশতিরাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–” হুঁশশশ.. আজাইরা কথা বলো না জানা। এসব কথা ভিত্তিহীন। কে বলেছে তুমি ব্যর্থ? বউ হিসেবে তুমি পার্ফেক্ট। আমি যেমনটা সপ্নে দেখেছিলাম ঠিক তেমনটাই বাস্তবে পেয়েছি। কে বলেছে তুমি আমায় সুখ দিতে ব্যর্থ? একান্ত মুহূর্ত কাটানোর পর আমার চেহারার পরিতৃপ্তি তোমার অদেখা? কে বলেছে তুমি আমায় বুঝতে ব্যর্থ? আমি সন্তান চাই বলেই তো তুমি নিজের জানের পরওয়া না করে, স্রেফ আমায় বাবা হওয়ার সুখ দিতে সন্তান ধারণ করতে প্রস্তুত। আর কী চাই আমার? সুখে হতে আর কিছু লাগে না সুরঞ্জনা৷

ফারজানা ব্যর্থ হলো নিজের কান্না আঁটকে রাখতে। ইশতিরাজের পাথর কঠিন বুকে মাথা ঠেকিয়ে আর্তনাদের সহিত বলে উঠল,

–” আমি আপনাকে সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ। ”

ইশতিরাজ স্মিত হেসে তার চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে বলল,

–” আপনি নামক সুখেই আমি সন্তুষ্ট। জীবনে আর কোনে চাহিদা কিংবা আশা আকাঙ্খা নেই। আপনি নামক সুখ পাখিটারে আজীবন বক্ষপিঞ্জরে আঁটকে রাখতে পারলেই আমি সুখে থাকবো। কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনি যদি খাঁচা ছাড়া হয়ে পরকালে পাড়ি জমান তাহলে যে আমি বাঁচতে ভুলে যাবো জানপাখি। আপনি আমায় এত কষ্ট দিতে চান?”

ফারজানা ব্যকুল হয়ে কাঁদে। ইশতিরাজ থামায় না। ভেতরকার যন্ত্রণা গুলো উগরে দেওয়ার সুযোগ দেয়। ফারজানা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,

–” এই অপূর্ণতার জন্য আপনি আমায় ছেড়ে যাবেন না তো? ”

ইশতিরাজ দৃঢ় গলায় বলল,

–” অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া মানুষকে ত্যাগ করা যায় না। এই নরম তুলতুলে শরীরটার সংস্পর্শ না পেলে আমার অস্থির লাগে। তোমার শরীরে মিশে থাকা মিষ্টি সুবাস নাসারন্ধ্রে না পৌঁছুলে আমার শ্বাস আঁটকে আসে। সুখের ঠিকানায় যখন তুমি তখন তোমায় কীভাবে ত্যাগ করি? ”

ফারজানা আশ্বাস হলেও অপূর্ণতার দহনের যন্ত্রণা তাকে স্বস্তি দিলো না। কেঁদেকুটে বুক ভাসাল তার প্রিয়তমের। একটা পর্যায়ে ভারসাম্য হয়ে নেতিয়ে পড়লো ইশতিরাজের কোলে। আচানক এমনটা হওয়ায় চমকে যায় ইশতিরাজ। ফারজানা কে ডাকলেও কোনো প্রকার সাড়া মেলে না। নিমিষেই ঘাবড়ে যায় ইশতিরাজ। ঠিক তক্ষুনি তার বাসায় কলিং বেলটা বেজে উঠে। বিকারগস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে সে ছুটে যায় দরজার খুলতে।

মূল ফটকে আরশিয়ান আর প্রিমাকে দেখে রাজ হড়বড়িয়ে বলে,

–” জানা জ্ঞান হারিয়েছে। আমি ডক্টরকে ডাকতে যাচ্ছি। তোরা একটু ওর কাছে বস..

ইশতিরাজের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় তারা। দু’টো ছেলেকে বাসায় রেখে আসতে পারলেও বাবার নেওটা ইরাকে রেখে আসা সম্ভব হয়নি। প্রিমার কোলেই ছিলো ইরা। অনাকাঙ্ক্ষিত খবর শুনে দিগবিদিক শূন্য হয়ে দৌড়াতে নিলে আরশিয়ান তাকে থামিয়ে দেয়। ইরাকে কোলে নিয়ে সতর্ক স্বরে বলে,

–” রিল্যাক্স। দৌড়ে যেতে হবে না। এখান থেকে হাঁটা পায়ে ঘরের দূরত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের। ”

প্রিমা শুনল না সেসব। হন্য হয়ে ছুটে গেলো ফারজানার কাছে। আরশিয়ান ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোলো সেদিকে। ফারজানার চেতনাশূন্য ফ্যাকাসে মুখশ্রী প্রিমার নজরে আসতেই মেয়েটা কেঁদে ফেলল। তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাঙা স্বরে ডাকল,

–” বু..বু। কী হয়েছে তোমার? এভাবে শুয়ে আছো কেনো? তোমার লাড্ডু এসেছে তো। চোখ খুলো?

প্রিমার ক্রন্দনরত স্বর শুনে আরশিয়ান বিচলিত হয়ে উঠে। নিজেকে সামলে কোনোমতে বলে,

–” হয়তো প্রেশার আপ-ডাউন হয়েছে কিংবা স্ট্রেস নিতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছেন। জলদিই ঠিক হয়ে যাবেন উনি। আপনি কান্নাকাটি বন্ধ করুন প্লিজ। সেরকম সিরিয়াস কিছু হলে রাজ নিশ্চয়ই উনাকে বাসায় রাখতো না?

প্রিমা কানেই তুলল না তার কথা। সে-তো ফারজানার ঠান্ডা হাত মুঠোয় পুরে তাকে ডেকে যাচ্ছে। ইরা বেচারি এসব দৃশ্য দেখে খানিকটা ভীত হয়ে বলল,

— ” মা কানছে্.. আব্ বাহ.. মা দুক্কু পাইতে।

মেয়ের অস্পষ্ট কথায় আরশিয়ান কান দিলো না। তার মুখটা পেছনে ফিরিয়ে পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বলল,

–” আম্মু কান্না করছে বাবা। আপনি জ্বালাতন করলে আরও কাঁদবে। গুড গার্লরা কখনোই মাম্মা কে কাঁদায় না। ঘুমিয়ে পড়ুন তো দেখি..

ইরা বাড়তি একটা কথা বললো না। চুপচাপ বাবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজে ফেলল। ওদিকে মিনিট দশেক পেরুতেই ইশতিরাজ হাজির হলো ডক্টর সমেত। তড়িঘড়ি করে বলল,

–” কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়েছে। একটু দেখুন প্লিজ। আমি বুঝিতেছিনা কিছু…

সর্বদা পরিপাটি শান্ত ছেলেটার আচরণ বড্ড অশান্ত। হম্বিতম্বি করছে স্রেফ। ডক্টর তার কথা শুনে এগিয়ে গেলেন ফারজানার কাছে। সবাইকে বললেন রুমের বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে। ইশতিরাজ নাকচ করতে চাইলে আরশিয়ান জোর করে টেনে বাহিরে আনে তাকে। ইশতিরাজ অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে থাকে।

কিছুক্ষণের মাঝে ডক্টর বেরিয়ে আসেন। তার থমথমে মুখশ্রী দেখে ইশতিরাজ ভয় কাতুরে স্বরে জিজ্ঞেস করে,

–” এভরিথিং ইজ ওকে না ম্যাম? আমি কী ওকে হসপিটালে নিবো? আইসিইউ রেডি করতে বলি.. অক্সিজ্…

প্রৌঢ়া নারীটি হেসে ফেললেন এপর্যায়ে। নিজের ডক্টরি ক্যারিয়ারে এমন পাগলপারা পাবলিক কখনোই দেখেননি। শুরু থেকে ফারজানার ট্রিটমেন্ট তিনিই করছেন। বছরখানেক যাবত তাদের ব্যর্থ ফলাফল উনাকেও হতাশ করতো তবে শেষমেশ উপরওয়ালা মুখ তুলে চেয়েছেন। অপেক্ষার প্রহর তিনি দীর্ঘ করতে চাইলেন না। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,

–” কংগ্রাচুলেশনস মাই বয়। ইয়্যু আর গোয়িং টু বি আ ফাদার। ”

ইশতিরাজ হকচকিয়ে উঠে। মিনিটখানেক কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে না। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। মুখ ফুটে এক শব্দও নির্গত হয় না কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় ডক্টরের পানে। প্রিমা নিজেও বিস্মিত হয়। আরশিয়ান স্মিত হেসে ইশতিরাজের কাঁধে হাত রেখে চাপড় দেয়। ডক্টর তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলেন,

–” সিল্যি বয়, আমাকে চেম্বার থেকে তুলে এনেছে। পেশেন্টরা ওয়েট করছে। আমার যেতে হবে। থম মেরে বসে থেকো না। গো এন্ড সেলিব্রেট ইয়্যোর হ্যাপিনেস। একটু পরই ফারজানার জ্ঞান ফিরবে। মেয়েটা কিন্তু বেশ দুর্বল। খেয়াল রেখো ওর। কাল একবার মেডিকেলে এসো। ওর ইন্টার্নাল চেক-আপ করতে হবে। ”

ইশতিরাজ তখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বিস্মিত স্বরে আবারও শুধায়,

–” ম্যাম… ইজ ইট ট্রু? আমি … মানে আমরা প্যারেন্টস হবো? ”

ডক্টর হেসে বললেন,

–” ইয়েস মাই চাইল্ড তুমি বাবা হচ্ছো এবং তোমরা অভিভাবক হচ্ছো। তুমি নিজেই ওর ট্রিটমেন্ট করতে পারতে। নিজেই ফাইন্ড আউট করতে পারতে নিউজটা। বউয়ের জ্ঞান হারানো দেখে তুমিও হুঁশ খুইয়ে বসেছিলে। একজন হার্ট স্পেশালিষ্টের এমন দুর্বল হৃদয় হলে কী করে হবে? ”

ইশতিরাজ তখন সুখের সাগরে ভাসছে। চোখের কার্ণিশে জমেছে খুশির অশ্রু। সে আঁটকে আসা গলায় বলে,

–” ওর প্রসঙ্গে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। মস্তিষ্ক কাজ করে না। আমি সবকিছু ভুলে বসি। সাহস হয় না কাছে ঘেঁষার। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু টের পেলে ওর চিকিৎসা করার আগেই আমি হার্ট আট্যাক করবো ফর শিওর। ”

উপস্থিত সকলেই হেসে ফেললো। ডক্টর নিজেও কুশল বিনিময় করে বিদায় নিলেন। প্রিমাদের বিকেল অব্দিই থাকতে বলে ইশতিরাজ গেলো ফারজানার কাছে। মেয়েটা তখনো ঘুমে আছন্ন। ওদিকে আরশিয়ান বেরুতে হলো ইমার্জেন্সি কাজের জন্য। অগত্যা ঘুমন্ত মেয়েকে নিয়ে প্রিমা পাশের ঘরে রেস্ট করতে গেলো।

_

প্রায় ঘন্টাখানেক পর জ্ঞান ফিরল ফারজানার। জ্ঞান ফিরতে দেখে ইশতিরাজ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ফারজানা চোখ খুলতেই দেখলো ইশতিরাজ তার দিকে ঝুঁকে আছে। বেচারার চোখজোড়া সিক্ত। মুখ জুড়ে খুশির রেশ বিদ্যমান। দুর্বল কন্ঠে ফারজানা শুধাল,

–” কী হয়েছে আপ…

ফারজানা কথাটা শেষ করতে পারলো না তার পূর্বেই ইশতিরাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তার কাঁধে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ফারজানা হকচকিয়ে গেলো। কী হলো হঠাৎ? রাজ তো কাঁদার মানুষ না। তাও আবার একরম করে। ফারজানার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল। সে কাঁপা স্বরে শুধাল,

–” কাঁদছেন কেনো জনাব? কিছু হয়েছে..

ইশতিরাজ সাসপেন্স রাখলো না। অস্পষ্ট স্বরে ভাঙা কন্ঠে বলল,

–” আমরা প্যারেন্টস হচ্ছি। আমি বাবা হবো..তুমি মা হবে। আমাদের আর কোনো অপূর্ণতা রইল না সুরঞ্জনা। আমাদের সংসারটা এবার পূর্ণতার ছোঁয়া পাবে। একটা নরম তুলতুলে ছোট্ট অস্তিত্ব এসে আমাদের সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে। তুমি ভাবতে পারছো? ”

ফারজানা হতভম্ব। বড্ড আকাঙ্খিত কিছু পেয়ে গেলে কীভাবে রিয়েক্ট করা উচিত জানা নেই। তাই তো খুশিটা প্রকাশ করতে পারছে না সে। প্রথমে খোদার নিকট শুকরিয়া জানাল ফারজানা অতঃপর ইশতিরাজের পিঠে হাত রেখে বলল,

–” কংগ্রাচুলেশনস বাবুর আব্বু। ”

ইশতিরাজ তাকে আশ্লেষে চুমু খেয়ে বলে,

–” লাভ ইয়্যু বাবুর আম্মু। ”

ফারজানা হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ সময় কাটলো তাদের একান্তই। ইশতিরাজের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকা ফারজানা একপর্যায়ে বলল,

–” বাহিরের বিশুদ্ধ হাওয়ার সংস্পর্শে যেতে মন চাইছে। একটু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়? ”

ইশতিরাজ নাকচ করলো না। ফারজানাকে কোলে তুলে বেলকনিতে নিয়ে গেলো। সুউচ্চ রেলিং ঘেঁষে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে রইল। ফারজানা একটুও লজ্জা অনুভব করলো না উল্টো ইশতিরাজের গলায় হাত রেখে তার উন্মুক্ত বুকে চুম্বন এঁকে দিলো।

ফারজানার আকস্মিক কান্ডে ঠান্ডা এক শিহরণ বয়ে যায় ইশতিরাজের শরীরে বেয়ে। নিজেকে সামলাতে চোখদুটো বন্ধ করে পরপর বার কয়েক ঢোক গিলে দু’হাতে শক্ত করে ফারজানা কে জড়িয়ে ধরে বুজে আসা গলায় বলে,

— ” ডোন্ট ডু দিস্ ডার্লিং! তুমি অসুস্থ, এ-ই মুহূর্তে আমার নিয়ন্ত্রণহীনতার মূল্য চুকানোর জন্য তুমি একদমই প্রস্তুত নয় জান। ”

ইশতিরাজের কন্ঠের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন যত্ন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে ফারজানা । তারপর ও রাজের কথা এড়িয়ে পাদু’টো সামান্য উঁচিয়ে তার কাঁধে মুখ গুঁজে আধোআধো গলায় ফারজানা ব’লে,

— ” উহুঁ! আমি পুরোপুরি সুস্থ। ”

সারাদিন ইশতিরাজের দাপট চললেও আদুরে বউয়ের দস্যিপনায় নিমিষেই জব্দ হয়ে যায়। ফাঁকা ঢোক গিলে বেসামাল কন্ঠে ইশতিরাজ বলে,

— ” আমার লজ্জাবতী বউয়ের উপর অগাধ বিশ্বাস আছে। সে কখনোই আমার কথার বিরুদ্ধে যাবে না আমি জানি।

ব্যস এতেই কাজ হলো। ইশতিরাজের কাঁধ ছেড়ে রেলিংয়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফারজানা বলে উঠে,

— ” অন্ধ বিশ্বাস করা উচিত নয় জনাব! ”

বউয়ের কথায় মৃদু হাসে ইশতিরাজ। ফারজানার কোমরে হাত রেখে তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। ফারজানা কে আরেকটু কাছে টেনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাস্কি স্বরে ফিসফিসয়ে ইশতিরাজ বলে,

— ” আমার অনাগত বাচ্চাদের আম্মুকে বিশ্বাস না করলে, বউ’তো আমাকে ছেড়ে পালাবে ম্যাডাম। বউয়ের ভাষায় আমি হলাম বেহায়া পুরুষ, তা-ই তো বউ বিহীন এক দন্ড থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। ”

ফারজানা লজ্জায় সিঁটিয়ে যায়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ইশতিরাজ তার ডান হাতটা নিজের রুক্ষ হাতে’র মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের বাঁ পাশে ঠেকিয়ে পুনরায় বলে,

— ” বউ বিহীন অন্তঃকরণে জঘন্য রকমে’র শূন্যতা অনুভব হয় ম্যাডাম।

ফারজানা দুষ্টুমির ছলে বলল,

–” শূন্যতা মেটাতে নাহয় আরেকটা বিয়ে করে ফেলুন।

ইশতিরাজের কথাটা পছন্দ হলো না। কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে কাটকাট স্বরে বলে,

–” এই বুকের শূন্যতা মেটাতে আপনি নামক পূর্ণতাই যথেষ্ট সুরঞ্জনা। আলাদাভাবে আর কাউকে প্রয়োজন নেই। পয়েন্ট টু বি নোটেড, শাওকাতুল ইশতিরাজ চৌধুরীর জীবদ্দশায় আপনি ব্যতীত কোনো নারী স্ত্রীর তকমা পাবে না।

_

আরশিয়ানের কাজ শেষ হতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায়। হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে ইশতিরাজের বাসায় ফিরলে একজন মেইড এসে দরজা খুলে দেয়। ড্রয়িংরুমের আশেপাশে কাউকে না দেখে কৌতুহল বশত আরশিয়ান জিজ্ঞেস করে,

–” সবাই কোথায়? ”

সার্ভেন্ট অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে,

–” রাজ স্যার এন্ড জানা ম্যাম নিজেদের ঘরে আছেন এবং প্রিমা ম্যাম ও ইরা মামুনি পাশের ঘরে আছেন। ”

হাতের প্যাকেট সেন্টার টেবিলের উপর রেখে আরশিয়ান এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে। প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে নিলো অতঃপর বিছানার দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো মা মেয়ে দু’জনেই ঘুমিয়ে আছে। বিছানার অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে ইরা৷ খাটের অপর প্রান্তে এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে প্রিমা। তার পরিধেয় কাপড়ের অবস্থা বেহাল।

মেয়েকে ফিড করাচ্ছিল বোধহয় তবে ঘুমের ঘোরে বুকের উপর কাপড় রাখতে ভুলে গিয়েছে। শান একটুও হেজিটেট ফিল করলো না৷ প্রিমার পরনের কাপড়টা নিজ হাতে ঠিক করে দিলো। মেয়েকে সাইডে রেখে দু’টো বালিশ দিয়ে সিকিউর করে দিয়ে প্রিমাকে বেডের মাঝ বরাবর শুয়ালো। নিজে একটু জায়গা তৈরি করে প্রিমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। শাড়ির আস্তরণ সরিয়ে হালকা মেদযুক্ত উদরে হাত রাখলো। দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রিমার সান্নিধ্যে এসে তার উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশে মুখ ডুবালো। ব্লাউজের গলাটা বড় হওয়ায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটলো না তার কাজে।

সকালে এই সাজপোশাকে দেখেই মাথা বিগড়েছিল আরশিয়ানের। মেয়েটাকে কত করে বোঝাল কিন্তু দুষ্ট বউ ধরা দিলে তো? উপরন্তু বলেছে অপ্রীতিকর কথা৷ এই মেয়েটাকে হারাতে আরশিয়ান ভয় পায়। মেয়েটা বুঝে না কেনো জানি। বারংবার অতীতের প্রসঙ্গ টেনে আনে। আরশিয়ানের কলিজায় চির ধরে সেটা কী টের পায় না মেয়েটা?

সেদিন প্রিমাকে হসপিটালে নেওয়ার পরপরই তার কন্ডিশন দেখে তাকে ওটি রুমে নেওয়া হয়। সি- সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চারা সেইফলি দুনিয়ায় আসলেও ইরার অবস্থা ছিলো খুব খারাপ। জন্মের পর তার বাচ্চা মেয়েটা কাঁদেনি। ওদিকে প্রিমার অবস্থা ছিলো বেগতিক। এক প্রকার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে প্রিমা কোমায় চলে গিয়েছিল। টানা তিনটা মাসের প্রার্থনা এবং অপেক্ষার পর প্রিমা কোমা থেকে বেরিয়ে আসে।

শুধু প্রাণটাই ফেরত এসেছিল তার। ডক্টর বলেছিলেন, প্রিমা আর কখনোই পুরোপুরি ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। নানান ধরণের শারীরিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তাকে। আজীবন বইতে হবে অসুস্থতার ভার। পুতুলের মতে যত্নে রাখতে হবে তাকে। আরশিয়ান বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছিল সবটা। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও তার যে প্রিমাকে চায়। এর পরের স্ট্রাগল গুলো ছিলো ভয়াবহ। প্রায় মৃত মানুষকে সুস্থ করে তোলা সহজ কাজ নয় তবে আরশিয়ান তা করে দেখিয়েছে।

আরশিয়ানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির যাতনায় ঘুম ভেঙে যায় প্রিমার। নিজের সাথে লেপ্টে থাকা আরশিয়ান এর দিকে ফিরে প্রিমা বলে,

–” এমন করছেন কেনো? ”

আরশিয়ান টুপ করে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

–” আপনার ঘুম ভাঙানোর ইনটেনশন ছিলো না ওয়াইফি। আম সো স্যরি। ”

প্রিমা ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,

–” আপনি ব্যাড বয় হয়ে যাচ্ছেন চৌধুরী সাহেব। আমার নাজুক অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন। দিস ইজ নট ফেয়ার। ”

আরশিয়ান স্মিত হেসে বলল,

–” আমি ব্যাড বয় হয়েছি বলেই আজ আপনি আমার তিন সন্তানের জননীর। আপনি আহ্বান করলে আমি সুযোগ নিবো না কেনো? এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন বিবাহ।

শেষের কথাটাই ফিক করে হেসে দিলেও প্রথম দু’টো কথার মানে বুঝে প্রিমা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ইরাকে খাওয়াতে গিয়ে ব্লাউজটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছিল প্রিমা। আচমকা ঘুমের ঘোর আসায় সেটা ওমনই আনবাটন থেকে গেছে। শাড়ির আঁচল সামনের দিকে ঠিক থাকলেও পেছনটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। সবটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলো প্রিমা। আরশিয়ান তার অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো তবে রেহাই দিলো না। প্রিমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। প্রিমা লজ্জায় মুখ লুকালো আরশিয়ানের বুকে। আরশিয়ান তার উন্মুক্ত প্রায় পিঠে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল,

–” কিছু বলবেন? ”

প্রিমা লজ্জারুণ কন্ঠে বলল,

–” আমার জানামতে বুড়ো বয়সে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। সম্পর্কে দূরত্বে বাড়ে, গুরুত্ব কমে, মায়া মোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, যত্নের অভাবে প্রেম মরে যায়। আপনার ক্ষেত্রে দেখি বিষয়টা উল্টো। এমনটা হওয়ার কারণ? ”

আরশিয়ান তার কাঁধে মুখ গুঁজে নির্লিপ্ত স্বরে বলল,

–” এমনটা হওয়ার কারণ ভালোবাসা। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি প্রেম। ”

আরশিয়ানের বেলাগাম স্পর্শে আবেশে ডুবে ছিলো প্রিমা। আচানক অনাকাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তি শুনে তার চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে গেলো। কিছু বলতে গিয়ে বুঝতে পারলো সে বিস্ময়ে বাকশক্তি হারিয়েছে। প্রিমাকে ওমন শকড হতে দেখে শান হেসে ফেললো৷ সবাই বলে নারী কে বোঝা দায় তবে পুরুষেরা যে আস্ত গোলকধাঁধা সেটা কেউ টেরও পায় না। শেষমেশ অনাকাঙ্ক্ষিত তিনটা সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত ভাবেই সমাপ্ত হলো।

সমাপ্ত