#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০৬
অমাবস্যার নিস্তব্ধ রজনী। ছাঁদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিকষিত আঁধারে আছন্ন রজনীর দিকে চেয়ে আছে ফারজানা। মস্তিষ্ক ভর্তি চিন্তা এবং বুক ভরা বিষন্নতা নিয়ে আচমকা হেসে ফেলল সে। হাসির দমকে হরিণীর ন্যায় টানা টানা আঁখিদ্বয়ে জমলো বিষাদের অশ্রু। অতীতের ভুলগুলো স্মরণে আসতেই দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড়য়ে বলল,
–” আমার ভালোবাসা’ই ছিলো নিজস্বতার মোড়ক অথচ সে চেয়েছিলো তার প্রাক্তনে’র পরিপূরক। নতুনত্ব যেখানে পরিহার্য বিচ্ছেদ সেখানে অনিবার্য। ”
জন্মলগ্ন থেকেই ফারজানা জেনে এসেছে এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। এতিম ফারজানা বড় হয়েছে সুখহৃদ কুঞ্জ নামক এক এতিমখানায়। যার মালিকানায় ছিলেন প্রিমার মা মিসেস আদ্রিতা ইসলাম প্রমি। শান্ত স্বভাবের নজর কাড়া সুন্দরী ফারাজানার প্রতি ভদ্রমহিলার আলাদা একটা সফট কর্ণার ছিলো।
পড়াশোনার প্রতি তীব্র ঝোঁক থাকায় ফারজানা তার পঞ্চম জন্মদিনের উপহার হিসেবে মিসেস আদ্রিতার কাছে পড়ালেখা করতে চাওয়ার আবদার রাখে । ভদ্রমহিলা কী ভেবে যেনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। তবে এই সিধান্ত ফারজানার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এসএসসি দেওয়ার পর ফারজানা কে ভর্তি করানো হয় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বলা বাহুল্য সেটা ছিলো কলেজ এবং ভার্সিটি। মর্নিং শিফটে কলেজ হতো এবং দুপুরের শিফটে ছিলো ভার্সিটি। তাদের এলাকার এমপির বদরাগী ছোটো ছেলে তূর্জয় শাকিল চৌধুরী ও পড়তো সেই একই ভার্সিটিতে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলো সে। কলেজের প্রথমদিন তার বজ্রকন্ঠের ভাষণ, আত্মবিশ্বাসী স্বর এবং বলিষ্ঠ গড়ন ফারজানার কিশোরী মনে মুগ্ধতা ছড়ায়। নিঃসন্দেহে সেটা কেবল ইনফ্যাচুয়েশন ছিলো তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে তা ভালোবাসায় রুপ নেয়।
কলেজটিতে ছিলো সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন। আকস্মিক একদিন ভার্সিটিতে মারামারি শুরু হলে বেচারি ফারজানা দ্বন্দ্বের মাঝে আঁটকে পড়ে। পুরো ভার্সিটির পরিস্থিতি তখন উত্তাল। বেচারি ভীতু ফারজানা ওয়াশরুমের ভেতর লুকিয়ে ছিলো। ঝামেলা বাঁধার সময় পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলেনি। আশেপাশের তীব্র ভাঙচুরের শব্দে মুখ চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছিল সে। ভীতসন্ত্রস্ত ফারজানা আরও ভীত হয়ে উঠে ধোঁয়ার কুন্ডুলী দেখে। বাধ্য হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে করিডর ধরে সাবধানে ভার্সিটি থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে থাকে। আকস্মিক দোতালায় পৌঁছাতেই তার পিলে চমকে উঠে।
ভার্সিটির জনপ্রিয় মুখ এবং সবার অতিব পছন্দের ভাই তুর্জয় শাকিল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পিলারে হেলান দিয়ে লাগাতার কাউকে কল দিয়ে যাচ্ছে।রক্তক্ষরণের মাত্রাটা নেহাত কম নয়। যেকোনো সময় ভারিক্কি দেহটা ছেড়ে লুটিয়ে পড়লো বলে। ফারজানা উপায়ন্তর না দেখে দ্রুত তার কাছে গিয়ে বলে,
–” আপনি এখানে কেনো? যেকোনো সময় যে কেউ এসে পড়বে। বিরোধী দলের কেউ আসলে ইজিলি আপনাকে টার্গেট করবে। আপনি এই অবস্থায় মারামারি করবেন কীভাবে? ”
তুর্জয় দাঁতে দাঁত চেপে মাথামোটা ফারজানার দিকে রক্তিম দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বেচারি ফারজানা গুটিয়ে গিয়ে মিনমিনে স্বরে বলেছিল,
–” আমি তো শুধু আপনার জন্য চিন্তা থেকে এমন কথা বলেছি। স্যরি, ভুল হয়ে গেছে। ”
কথাটা বলে প্রস্থান করতে নিলে আচমকা ব্যথাতুর সুরে রাগ ঢেলে হুমকির স্বরে তূর্জয় বলে উঠে,
–” ফাজিল মেয়ে, চুপচাপ এদিকে এসে আমাকে উঠতে সাহায্য করো তা না হলে এক্ষুনি তোমার খুলি উড়িয়ে দেবো। ”
ফারজানা শুকনো ঢোক গিলে পেছনে ফিরে বলে,
–” আপনার ভার নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব তাছাড়াও আপনি যেকোনো সময় জ্ঞান হারাবেন বলে মনে হচ্ছে। আমি কীভাবে আপনার ভারিক্কি ওজন বহন করবো? ”
ওরকম পরিস্থিতি ফারজানার বোকামি কথাবার্তায় তূর্জয় হেসে ফেলে। কোনোমতে নিজেকে সামলে গম্ভীর স্বরে বলে,
–” তুমি জাস্ট আমাকে সাপোর্ট দিয়ে নিচের ইমার্জেন্সি এক্সিট পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ওখানে আমার লোকজন আছে, তারা নিচের পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত বিধায় উপরে এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারছেনা। আমরা কোনোভাবে নিচ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে তারা সেইফলি আমাদের বের করে দিবে। ”
ফারজানা কী ভেবে যেনো রাজি হয়ে যায়। প্রথমবার কোনো পুরুষের সান্নিধ্যে এসে বারংবার লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছিল তবে পরিস্থিতি মাথায় রেখে সে তার দায়িত্ব পালন করে। সৌভাগ্যক্রমে তারা দু’জনে নিরাপদ ভাবে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
সেই ঘটনার পর ফারাজানা তূর্জয়ের নজরে পড়ে যায়। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের দেখাশোনা হয় এবং কথাবার্তা এগোতে থাকে। তূর্জয় হুট করে একদিন প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেয়েটা সংকোচে পড়ে তা নাকচ করে দেয়। তূর্জয় জোর করেনি বরং দ্বিগুণ ভাবে নিজের অধিকার বিস্তার করতে শুরু করে ।
পুরো ক্যাম্পাস ফারজানা কে তূর্জয়ের জান হিসেবে জানতো। টিচারদের এক্সট্রা কেয়ার, সিনিয়রদের থেকে সম্মান এবং জুনিয়দের থেকে ভালোবাসা পাওয়ায় ফারজানা কিছুটা নরম হয়। বাহ্যিক পরিস্থিতি তার কাঙাল মনটাকে জব্দ করে ফেলে। ফারজানার কিশোরী মনে আকস্মিক প্রেমের দমকা হাওয়া লাগে। সিনিয়র বড় ভাইয়ের মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিয়ে সহজ সরল মেয়েটা তলিয়ে যায় প্রণয়নের গভীরে। ভীতু মেয়েটা কীভাবে যেনো মজে যায় তীব্র ভালোবাসায়।
দীর্ঘ দেড়বছরের প্রেমে কত-শত সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে একসাথে তার ইয়ত্তা নেই। বদমেজাজি, খিটখিটে, মারকুটে ছেলেটা তার সান্নিধ্যে আসলে কেমন যেনো শান্ত হয়ে যেতো। মারামারিতে পিএইচডি প্রাপ্ত ছেলেটা তাকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়ার সময় ভীষণ যত্ন করে আলতো স্পর্শে তার হাতটা আগলে নিতো।
শত ব্যস্ততার মাঝে তিনবেলা ফোন করে খোঁজ নেওয়া নিত্যদিনের ঘটনা ছিলো। গোমড়ামুখো ছেলেটার সাথে ফোনে সর্বচ্চো কথা হয়েছিল নয় মিনিট কারণ ফারজানা সেদিন তীব্র জ্বরে ভুগছিল। অবস্থা বেগতিক হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং তা জানতে পেরে তূর্জয় সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেষ রাতে হসপিটালে আসে দূর থেকে স্রেফ এক নজর ফারজানা কে দেখতে । ফারজানা অর্ধ অচেতন অবস্থায় দেখেছিল তূর্জয়ের চিন্তিত মুখশ্রী।সেই যত্নের মোহনায় ডুবে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়েছিল ফারজানা। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক হওয়া সত্ত্বেও লুটিয়েছিল নিজের মূল্যবান সম্পদ। অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বিবেক হারিয়ে আবেগে ভেসে অতিক্রম করেছিল সমস্ত সীমা।
তীব্র প্রেম আকস্মিক বিচ্ছেদে রুপ নেয়। আঠারো বছর বয়সে উপনীত হলে এতিমখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গটা তূর্জয় কে জানালে প্রত্যুত্তরে সে জানায়,
–” বয়স আঠারো হলেই তোমাকে আমার ঘরণী করে নিয়ে যাবো ফারজানা। ”
এই সামান্য এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে বোকা ফারজানার হৃদয় তুমুল ভালো লাগায় আন্দোলিত হয়েছিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এইচএসসি পরীক্ষার সময়কাল কাছিয়ে আসে। দূরত্ব বাড়তে থাকে তূর্জয় এবং ফারজানার। পরীক্ষার মাঝখানে পড়ে ফারজানার আঠারো তম জন্মদিন, এতিমখানার কর্তৃপক্ষ তাকে বিষয়টা অবগত করতেই ফারজানা পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় চায়। মালকিনের কাছের মানুষ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ কিছুটা সদয় হোন।
এর মাঝে ফারজানা তূর্জয়ের সাথে যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পরীক্ষার দিন হল থেকে বেরিয়ে ভার্সিটিতে গেলেই দেখা মিলে বন্ধুদের সাথে আড্ডারত তূর্জয়ের। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে তার সন্নিকটে এগিয়ে যেতেই তূর্জয় উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ফাঁকা ক্লাসরুমে টেনে আনে। বিরক্ত ভরা কন্ঠে শুধায়,
–” আমি ইগনোর করার পরেও আমাকে এভাবে স্টক করছো কেনো ফারজানা? ”
ফারজানা ক্রন্দনরত স্বরে শুধায়,
–” আপনি আমাকে ইগনোর করছেন কেনো? ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে? ”
ফারজানার মুখের দিকে তাকিয়ে তূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফারজানার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–” আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসিনি ফারজানা। তুমি আমার ইনফ্যাচুয়েশন ছিলে। নিজের খোরাক মেটাতে আমি তোমাকে জাস্ট ইউজ করেছি। ”
ফারজানার মাথায় যেনো বাজ পড়ে। পদতলের জমিন যেনো সরে যায়। কোনোমতে কাঁপা কন্ঠে বলে,
–” অতীত… কীসের অতীত? ”
তূর্জয় কাঁপতে থাকা ফারজানা কে চেয়ারে বসিয়ে নিচে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতদুটো মুঠোয় পুরে অপরাধী গলায় বলে,
–” আমার সাত বছরের একটা সম্পর্ক ছিলো। রাজনীতি, জুয়া এবং নেশার ঘোরে ডুবে যাওয়ায় আমার ব্রেকাপ হয়ে যায়৷ মেয়েটাকে আমি সত্যি ভালোবাসতাম বিধায় ওর ছেড়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি। নিজেকে সংশোধন করতে রিহ্যাবে যায়। পুরোপুরি নেশার ঝোঁক কাটিয়ে উঠে পুনরায় তাকে পাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু সে অসম্মতি জানায়। জাস্ট ইনফ্যাচুয়েশন থেকে এবং ওকে জেলাস করতে আমি তোমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি।”
কিছুটা সময় নিয়ে পুনরায় তূর্জয় বলে উঠে,
–” হয়তো আমি তোমাকে বিয়ে করতাম তবে এখন সেটা সম্ভব নয়। আমার প্রথম প্রেম ফিরে এসেছে। ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি নিঃসন্দেহে ভালো মেয়ে ফারজানা। তোমার যতটুকু ক্ষতি করেছি আমি তার সবটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। তুমি কেবল আমার দাবি ছেড়ে দাও। আমি শত চেষ্টা করলেও তোমার হতে পারবোনা।”
ফারাজানা স্থবির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আক্ষেপ ঢেলে শুধায়,
–” কী এমন কমতি ছিলো আমার মাঝে যার জন্য আমি কেবল আপনার ইনফ্যাচুয়েন রয়ে গেলাম? কী এমন যোগ্যতা আছে সেই মেয়ের যার জন্য সে আপনার ভালোবাসা হয়ে গেলো? ”
তূর্জয় কেনো যেনো উত্তর দিতে পারেনি। ফারজানা মূর্তির ন্যায় কিছুক্ষণ বসে থেকে আকস্মিক শুধায়,
–” ভার্সিটিতে আরও কত মেয়ে ছিলো ওদের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশন জন্মায়নি কেনো আপনার? আমাকে ভোগ করা সহজ, ইজিলি ইগনোর করা যায়, আমার হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ নাই, মাথার উপর অভিভাবকের হাত নেই… এজন্যই বুঝি আমাকে টার্গেট করেছেন? ”
তূর্জয় শোনে ফারজানার আর্তনাদ। যে মেয়ে কোনোদিন চোখ তুলে কথা বলেনি সেই মেয়ের কন্ঠে স্পষ্ট প্রতিবাদ শুনে তূর্জয় ফাঁকা ঢোক গিলে। তাকে সামলাতে চাইলে ফারজানা সরিয়ে দেয়। দুর্বল কন্ঠে বলে,
–” মরে গেছে আমার তূর্জয়। মনের কবরে দাফন করে দিয়েছি সমস্ত ভালোবাসা। খোদার কাছে প্রার্থনা করেন, এই এতিমের রুহের হায় যেনো আপনার না লাগে। দোয়া করি ভীষণ সুখী হোন আপনি। ”
ফারজানার বুক ফাটা আর্তনাদে তূর্জয় আঁতকে উঠে। ফারজানা বেরিয়ে আসতে চাইলে তূর্জয় তাকে বাঁধা দেয়। দু’জনের মাঝে শুরু হয় তুমুল ধস্তাধস্তি, আচমকা ফারজানা ওর বুকে মাথা রেখে তীব্র শব্দে কেঁদে উঠে। তূর্জয় ভড়কে গিয়ে ওকে থামাতে চাইলে আকস্মিক ফারজানা নিজেই থেমে যায়। ঢলে পড়ে প্রিয়তমের বুকে, নাক, মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা রক্তের স্রোতে ভেসে যায় তূর্জয়ের ধূসর বর্ণের শার্ট।
ভীত তূর্জয় দ্রুত ফারজানা কে নিয়ে হসপিটালে ছুটে যায়। দীর্ঘ সময়ের পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানা যায় ফারজানার হার্টে ছোট্ট একটা ছিদ্র আছে। দুর্বল হার্টের রোগী সে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা সহ্য করতে না পেরে এমনটা হয়েছে। তূর্জয় পেরেশানিতে পড়ে যায়। ফারজানার জ্ঞান ফিরলে তার কাছে গিয়ে নরম গলায় বলে,
–” তোমার পরিস্থিতি সম্পর্কে এতিমখানায় ইনফর্ম করতে হবে। ইনচার্জের নম্বরটা দাও। ”
ফারজানা নির্বিকার গলায় বলল,
–” আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে আমার। আমি আর এতিমখানার দায়িত্বে নেই। আমার অভিভাবক আমি নিজেই। ”
তূর্জয়ের গ্লানিবোধ তরতরিয়ে বাড়লো। কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে সোজা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। ভাবলেশহীন ফারজানা নিশ্চুপে পড়ে রইল সেখানে। ভাবতে লাগলো পরবর্তীতে তার অবস্থান কোথায় হবে? রাস্তায় নিশ্চয়ই.. কথাটা ভেবে শব্দ করে হেসে ফেললো সে।
সন্ধ্যার দিকে বিধ্বস্ত তূর্জয় পুনরায় ফিরে আসলো। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে সোজাসাপ্টা ফারজানা কে নিয়ে গেলো একটা মেসে। হাতে কালো রঙের একটা চাবি এবং একটা ক্রেডিট কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–” আমি তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছি তার ক্ষমা হয়না তবে তুমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত আমি তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি। তোমার যাবতীয় প্রয়োজনে আমাকে পাশে পাবে শুধু একটাই কথা বলতে চাই, আমার জন্য কোনো আক্ষেপ পুষে রেখোনা। আমার অন্যায়টা গুরুতর কিন্তু আমি চাইনা তুমি আমায় ঘৃণা করো। তোমার চোখদুটোতে নিজের জন্য সীমাহীন সম্মান দেখে এসেছি এতকাল , সেই দৃষ্টিতে ঘৃণাটা বোধহয় সহ্য হবেনা। ”
ফারজানা তখনও নির্বিকার। তূর্জয় তার চোখের দিকে তাকিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলল,
–” আমাদের পথচলা এই পর্যন্তই ছিলো। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটা এমাউন্ট আমি তোমার একাউন্টে জমা করে দিবো। কোনো প্রয়োজন হলে আমার এসিস্ট্যান্ট সৌরভ কে জানাবে সে দেখবে ব্যপারটা। আর কিছু বলতে চাও? ”
দুর্বল ফারজানা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। খানিকটা সরে গিয়ে মেসের বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে কার্ডটার দিকে একবার তাকায়। তূর্জয়ের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে শুধায়,
–” আপনার তরে লুটিয়ে দেওয়া সতীত্বের মজুরি দিলেন বুঝি? ”
ধারালো কথাটা তূর্জয়ের বুকে গিয়ে বিঁধে। কন্ঠে জোর এনে বলে,
–” কীসব বলছো ফারজানা? আমি…
তূর্জয়ের মুখ দিয়ে কথা বেরোয়নি আর। ফারজানা ক্রন্দনরত স্বরে বলেছিল,
–” নিশ্চিন্তে সংসার জীবনে পদার্পণ করতে পারেন আপনি, আপনার সুখে নজর দেওয়ার ধৃষ্টতা আমি দেখাবো না । আমার দীর্ঘশ্বাস, আক্ষেপ, অভিশপ্ত অশ্রুকণা যদি আপনাকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে এনে দাঁড় করায় তাহলে আমাকে মাফ করে দিয়েন। ”
তূর্জয় আর কথা বাড়ায়নি। নৈঃশব্দে প্রস্থান করেছিল। ফারজানা হাতের বস্তু দু’টো মুঠ পাকিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে তীব্র গতিতে ছুঁড়ে ফেলেছিল অদূরে। অসুস্থ শরীর, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ছুটে গিয়েছিল শেষ তার আশ্রয়ের কাছে।
_
ছাঁদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের পানে আনমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারজানার কাঁধে হাত রাখে প্রিমা। পেছনে ফেরার পূর্বে চোখদুটো চটপট মুছে ফেলে স্বাভাবিক কন্ঠে ফারজানা শুধায়,
–” পড়াশোনা নেই তোর? সারাক্ষণ আমার পেছনে ঘুরঘুর করিস কেনো? ”
প্রিমা বাচ্চাদের মতো পেছন থেকে ফারজানা কে জড়িয়ে ধরে বলল,
–” তুমি তাকে এখনও ভালোবাসো বুবু? ”
ফারজানা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
–” ভালোবাসা ভীষণ সুন্দর এবং স্নিগ্ধ এক অনুভূতি। একজন প্রতারক কখনোই তা ডিজার্ভ করে না। তার দেওয়া আঘাত আমার সমস্ত নিখাঁদ অনুভূতিকে নির্বিকার করে দিয়েছে। বাস্তবতার অতলে আবেগ ফুরিয়েছে সেই সাথে ভালোবাসা ও হারিয়েছে। ”
প্রিমা নির্লিপ্ত স্বরে শুধায়,
–” তুমি কী তাকে ঘৃণা করো বুবু? ”
ফারজানা শীতল স্বরে স্মিত হেসে উত্তর দিল,
–” আমরা যাদের কে নিজের সর্বস্বটা বির্সজন দিয়ে ভালোবাসি তাদেরকে আজন্ম ঘৃণা করতে পারি না।হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি নিংড়ে নিখাঁদ ভালোবাসাটুকু যার পদতলে কুরবান করি তার প্রতি ঘৃণা বোধটা ঠিক জন্মায় না। অধিক আঘাতে কিংবা তীব্র শোকে আমরা কেবল ভালোবাসতে ভুলে যায়। ”
প্রিমার বুক চিরে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। ফারজানার শরীরের কম্পন টের পেয়ে দ্রুত বলে উঠে,
–” তোমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। খেয়ে মেডিসিন নিয়ে সোজা ঘুমাবে ঠিকাছে? ”
ফারজানা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
–” মেডিসিন কেনার টাকা আসলো কোত্থেকে? ”
প্রিমা ফারজানার হাত টেনে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
–” ম্যানেজ করেছি সামহাও। ”
ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–” তুই ধার নেওয়ার মতো মানুষ না। সত্যি করে বল টাকা কোত্থেকে এনেছিস? টাকা ম্যানেজ করা এত সহজ হলে বাড়িওয়ালার ভাড়া সময় মতো দিয়ে দিতিস। সত্যি করে বল প্রিমা, কী লুকচ্ছিস?”
প্রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারজানা কে বলল,
–” আমার উপর ভরসা থাকলে চুপ করে থাকো। অবিশ্বাস করলে কিছু করার নাই আমি উত্তর দিবো না। ”
ফারজানা থেমে গেলো। ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা কোনোমতেই নিজের মুখ খুলবে না তা বেশ বুঝল। শরীরটা সত্যি খারাপ লাগছে তার। সময়ের সাথে অস্থির ভাবটা বাড়ছে যা প্যানিক আট্যাকের লক্ষণ। সময় নষ্ট না করে প্রিমা চটজলদি ফারজানা কে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। জরুরি মেডিসিন গুলো নিতেই ফারজানার কাঁপুনি শিথিল হয়। দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে পড়ে । প্রিমা কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ স্বরে শুধায়,
–” ঘুমিয়ে পড়েছো বুবু? ”
ফারজানা ঘুমকাতুরে স্বরে বলে,
–” না। কিছু বলবি? ”
প্রিমা পাশ ফিরে বাচ্চাদের মতো ফারজানার একটা হাত দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
–” বুবু শুনছো? আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। ”
ফারজানা ঝট করে চোখ মেলে তাকাল। অস্থির কন্ঠে শুধাল,
–” সত্যি? ”
প্রিমা অশ্রুভেজা চোখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। ফারজানা খোদার দরবারে শুকরিয়া জানাল। হুট করে কিছু মনে পড়তেই বলল,
–” মনির সাথে দেখা করিবনা? এত বড় একটা সংবাদ তাকে জানাবি না? ”
কথাগুলো শুনে প্রিমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। কন্ঠনালিতে দলাপাকিয়ে থাকা কান্না গুলো গিলে ফেলে কোনোমতে বলে,
–” হুঁ, যাবো কাল সকালে। প্রাচীরের বাহিরে থেকে এক পলক দেখে চলে আসবো। ”
ফারজানা প্রিমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
–” কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিস না কেনো? মা হয় তোর। মৃত্যুর পরও কেউ অভিমান পুষে রাখে? ”
প্রিমা জেদ ধরা কন্ঠে বলল,
–” উনি আমাকে সবসময় কম ভালোবেসেছে আপা। এজন্যই তো দুঃসময়ে আমাদের একা ফেলে সহজে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পেরেছে । আমার অভিমান নেই কেবল অভিযোগ আছে। কখনো উত্তর পাবো না বিধায় কবরের ধারের কাছেও যাইনি। ”
খানিকটা থেমে আবারও ধরা কন্ঠে প্রিমা বলল,
–” আমার জীবনের সমস্ত সুখ কেড়ে নেওয়া এক ধ্বংসবতীর কবর আছে সেখানে। আমি চাইলেও ভেতরে ঢোকার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারিনা বুবু। অতীতের জঘন্য স্মৃতি গুলো তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত করে ফেলে আমায়। আমি একটু সুখী হতে চাই, হাঁপিয়ে উঠেছি এই বীভৎস অতীতের তান্ডবলীলায়।”
ফারজানা প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলে উঠল,
–” যেটা ভালো বুঝিস। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানানোর ছিলো তোকে। ”
প্রিমা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
–” হুঁ?”
ফারজানা জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
–” আমাদের অফিশিয়াল ড্রেস কোড পরিবর্তন করা হয়েছে। ফর্মাল স্যুটের বদলে ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি সিলেক্ট করা হয়েছে। কালকে তো ছুটির দিন আছে, মার্কেটে যাবি? ”
প্রিমা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিরক্ততে রেগেমেগে বলল,
–” শেষমেশ শাড়ি? যদি উষ্টা খাই, ধপাস করে পড়ে যায়, যদি এক্সিডেন্টলি শাড়ি ইন্না – লিল্লাহ হয়ে যায় তবে কে দায় নেবে? অফিসের স্টাফ জনে জনে সবাইকে কোলে তুলে বাড়ি দিয়ে আসবে নাকি? তোমার অফিসের ইনচার্জ ব্যাটা দেখছি বেশ লুচু। ”
ফারজানা প্রিমার মাথায় চাটি মেরে বলল,
–” সবাই তোর মতো আছাড় খাওয়া পাবলিক নয় বুঝলি? ”
প্রিমা মুখ ফুলিয়ে অন্য পাশে ফিরে শুলো। শাড়ি তার কাছে ঝামেলা ব্যতীত কিছুই না। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
_
শুক্রবারের স্নিগ্ধ প্রভাত। ফজরের নামাজ পড়ে ব্যক্তিগত গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আরশিয়ান। বহু বছর পর প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে। তার পরনে রয়েছে সাফেদ রঙের একটা পাঞ্জাবি। বরাবরের মতো স্লিভদুটো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা । বাঁ হাতের কব্জিতে সিলভার কালারের একটা রোলেক্স ঘড়ি। তার শক্ত হাতের মুঠোয় রয়েছে এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ চন্দ্রমল্লিকার বুকে।
আরশিয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে সমাধির কাছে পৌঁছুল। হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে কবরের উপর ফুলগুলো রাখল। আলতো হাতো কবরের মাটি স্পর্শ করে নরম কন্ঠে বলল,
–” শুনছো রাধাচূড়া? তোমার বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমি এসেছি। এই নিরেট প্রশস্ত বুকটা আজও তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ । জলদি এসে দখল করো তোমার রাজত্ব। তোমার মহারাজা তোমার তৃষ্ণায় প্রবলভাবে তৃষ্ণার্ত। তার সকল অভাব পূরণের যথাযোগ্য কারণ হিসেবে ধরা দাও জলদিই । ”
পুরুষের সত্যিকারের ভালোবাসা কতটা মোহনীয় তা কেবল ভাগ্যবতী নারী জানে। কথিত আছে, শুদ্ধ পুরুষের সত্যিকারের ভালোবাসা যে নারী পেয়েছে সে পৃথিবীতেই জান্নাত সম সুখ আহরণ করেছে। আরশিয়ানের পাগলের প্রলাপ চললো ঘন্টাখানেক। দীর্ঘ নয় আট বছর পর প্রিয়তমা স্ত্রীর সন্নিকটে এসে বেচারা যেনো হুঁশ হারিয়েছে।
সকাল ছয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে কবরের লম্বা প্রাচীরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় প্রিমা। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় অদূরে থাকা মমতাময়ী মায়ের কবরের দিকে। বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চায় তবে প্রিমা নির্লিপ্ত ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে। তার মুখ ফুটে কথা বেরোয়নি, রক্তিম চোখজোড়া কেবল একরাশ আক্ষেপ এবং অভিযোগ নিয়ে তাকিয়েছিল দেওয়াল ঘেরা সমাধির দিকে।
আচমকা তার ধ্যান ভাঙে এবং দৃষ্টি যায় গোরস্থানের গেইট দিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে আসা আরিয়ানের পানে। নির্মল মুখশ্রী বড্ড বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছে কপালে। লম্বা শরীরটা ভারসাম্যহীন ভাবে এদিকওদিক হেলে যাচ্ছে। গাড়ির কাছে আসতে নিলেও খানিকটা দূরে আচমকা বসে পড়ে আরশিয়ান। প্রিমা দোটানার মাঝে এগিয়ে যায় তার কাছে। আরশিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসুক কন্ঠে শুধায়,
–” অসুস্থবোধ করছেন? হসপিটালে নিয়ে যাবো আপনাকে?”
আরশিয়ানের দৃষ্টি ঘোলাটে। কোনোমতে বলল,
–” বাসায় ইনফর্ম ক.. র
এতটুকু বলতেই দম ফুরিয়ে এলো যেনো তার। প্রিমা চটজলদি ওর সাইড ব্যাগে থাকা পানির বোতলটা আরশিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। আরশিয়ান কাঁপা হাতে সেটা নিয়ে পুরোটা মাথায় ঢেলে দিলো। আচমকা এহনও কান্ডে খানিকটা হকচকিয়ে উঠল প্রিমা। গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করল,
–” আপনার বাসা কোথায়? ”
আরশিয়ান ধীর স্বরে সময় নিয়ে পুরো উত্তর জানাল। আরও কিছুটা সময় নিয়ে পুনরায় ধীর স্বরে বলল,
–” জাস্ট বাসায় একটু ইনফর্ম করে দিন, কেউ এসে নিয়ে যাবে।
প্রিমা এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল আরশিয়ানের দিকে৷ তার পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে। ভেজা চুলগুলো বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে তামাটে বর্ণের সুশ্রী মুখশ্রীতে। প্রিমা বিড়বিড়িয়ে বলল,
–” এসব পুরুষলোক বাড়ি থেকে বের হয় কেনো? এদের একেকটা লুক নারী মনে প্রেমের তীক্ষ্ণ তীর নিক্ষেপ করে সে খবর রাখে তারা? এদের মতো জাঁদরেল পুরুষলোকের বউয়েরা বাসায় আদৌ শান্তিতে থাকতে পারে? বর কিডন্যাপ হলো কি-না সেই চিন্তায় বোধহয় বেচারিরা নাওয়া খাওয়া ভুলে থাকে সারাক্ষণ।”
আচমকা হুঁশ ফেরে প্রিমার। নিজেকে শাসিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু কোন প্রকার উপয়ান্তর না দেখে আরশিয়ানের দিকে ঝুঁকে ধীর গলায় শুধায়,
–” আপনার ফোন কোথায়? ”
আরশিয়ান ইশারায় গাড়ির দিকে তাক করল। গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে দেখল সেটা লক করা। প্রিমা চাবি চাইলে আরশিয়ান গাড়ির চাকার সাথে হেলান দিয়ে শরীরের সম্পূর্ণ ভারটুকু ছেড়ে দিয়ে বলল,
–” প..কে টে আছে বোধহয়। ”
প্রিমা ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। বাধ্য হয়ে আরশিয়ানের পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করল কিন্তু বিধিবাম তৎক্ষণাৎ আচমকা কিছু লোক উপস্থিত হলো সেখানে। একটা মেয়েকে ওভাবে অপর এক পুরুষের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখায় তারা রাগান্বিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” তোমরা কারা? এখানে কী করছো? ”
প্রিমা থতমত খেয়ে ঝট করে পাশে সরতে গিয়ে আকস্মিক ধপাস করে আরশিয়ানের পাশে বসে পড়ে। আরশিয়ান কেবল ঢুলুঢুলু দৃষ্টি তাকায় সবার দিকে। তার মস্তিষ্ক পরিস্থিতি বুঝলেও রিয়্যাক্ট করতে অক্ষম। প্রিমা পরিস্থিতি সামলাতে ফট করে বলল,
–” আমারা কবর জিয়ারত করতে এসেছিলাম। হুট করে উনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি উনাকে টেনে গাড়িতে তুলার চেষ্টা করছিলাম। ”
লোকগুলো সরু দৃষ্টিতে তাকাল প্রিমার দিকে। তার পরনে নীল রাঙা গোলাকার জামা এবং মাথায় হিজাব দেখে উনাদের দৃষ্টি খানিকটা নরম হয়ে এলো। লোক দুটো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসলে পাশে দাঁড়ানো মহিলাটা বলে উঠল ,
–” এক রত্তি মাইয়া হইয়্যা এমন বীরপুরুষ রে সামলান যায়? সোয়ামির পাশাপাশি নিজের ও যত্ন নিস মেয়ে। শরীরের হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই তো দেখছিনা। এমন চললে স্বামী, সংসার, পোলাপান সবই যাইবোগা রসাতলে। ”
বৃদ্ধার কথায় কান লাল হয়ে এলো প্রিমার। প্রত্যুত্তরে কিছু বলার পূর্বে লোকগুলো বলল,
–” গাড়ির দরজাটা খুলেন। আপনার স্বামীর হুঁশ নেই।”
প্রিমা পুনরায় ভড়কালো। এ কোন মুসিবতে পড়লো। কথা না বাড়িয়ে ঝটপট আরশিয়ানের পকেট হাতড়ে চাবি বের করে আনল। গাড়ির লক খুলে আরশিয়ান কে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। শুকনো হেসে তাদের ধন্যবাদ বলে গাড়ির গ্লাসগুলো উঠিয়ে দিলো।
আরশিয়ান সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। গাড়ির ঝাঁকুনিতে হেলেদুলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। বাধ্য হয়ে বুকে সাহস নিয়ে আরশিয়ানের সিটবেল্টটা আঁটকে দেয় প্রিমা। সরে আসতেই বুক ভরে শ্বাস টানে বেচারি। আরশিয়ানের ম্যানলি পারফিউমের স্ট্রং ফ্রেগরেন্সে তার দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয়।সকল ভাবনাকে দূরে ঠেলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সখের বশে শেখা ড্রাইভিং এভাবে কাজে লেগে যাবে কে জানতো?
_
চৌধুরী বাড়ির লোকজন রীতিমতো ছোটো খাটো জটলা বাঁধিয়ে ফেলেছেন আরশিয়ানের রুমে। শক্তপোক্ত সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেটা আকস্মিক অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে শুনে তাদের কলিজা কেঁপে উঠেছিল। বিছানার হেডবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে চোখবুঁজে রেখেছে আরশিয়ান। পাশেই ডক্টর বসে তার ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করছে। আফিয়া চৌধুরী আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদেই যাচ্ছেন। আরশিয়ানের রুমে পুরো চৌধুরী বাড়ির লোকজন হাজির হয়েছে কেবল তুরাব এবং তাজরিয়ান বাদে। তুরাব হসপিটালে ডিউটি করছে আর তাজরিয়ান বেরিয়েছে তার কাজে।
সকলে চিন্তিত চোখে পরখ করছে আরশিয়ান কে। আরশিয়ান তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রেশারটা আকস্মিক এভাবে প্রতারণা করে বসবে সেটা বোঝেনি বেচারা। বাড়ির সকলের আচরণে সে রীতিমতো হতাশ। মানুষ অসুস্থ হতেই পারে। এত বছর পর দেশে ফিরেছে, আবহাওয়া স্যুট করতে সময় লাগবেনা? এরকম মরাকান্না জুড়ে দেওয়ার পেছনে এক্সাক্ট কোনো লজিক খুঁজে পেলনা আরশিয়ান। তার হতাশা কে ডাবল করতে ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে তাজরিয়ান বলল,
–” সুন্দরী সিঙ্গেল মেয়ে দেখা মাত্রই তোমার ব্লাড প্রেশার এভাবে ফল করে গেলো? শেষপর্যন্ত কি-না দ্যা গ্রেট আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী জ্ঞান হারিয়ে একটা মেয়ের কোলে চড়ে বাড়ি ফিরল? ইয়ে তো গাজাব বেইজ্জতি হ্যায় ইয়ার। এ্যাঁই ব্যাটা নেমকহারাম প্রেশার কে এক্ষুনি শাসন করো ভাইয়া নাহলে ভবিষ্যতে তোমার মানসম্মানের ছিটেফোঁটা ও অবশিষ্ট থাকবেনা । ”
তাজরিয়ানের আকস্মিক বলা কথাটা শুনে উপস্থিত সকলে যেনো বিষম খেলো। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নির্লিপ্ত প্রিমা খানিকটা লজ্জা পেয়ে অন্য পাশে তাকাল। আরশিয়ান দুর্বল দৃষ্টি ফেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,
–” আই সোয়্যার তাজ, তুই এক্ষুনি এই ঘর ছেড়ে না বেরোলে ভবিষ্যতে বাবা ডাক শোনার অধিকার হারাবি। পরবর্তীতে হারবাল খেয়েও হারানো সম্পদ ফিরে পাবি না। ”
উপস্থিত সকলে এবার চোখ বড় বড় করে তাকায়। প্রিমা ও বিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শান্ত স্বভাবের অতি ভদ্র মানুষের এরুপ মুখের ভাষা হজম করতে কিছুটা কষ্ট হয় সকলের। তাজরিয়ান ভ্রু কুঁচকে মুখটা গম্ভীর করে ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
–” আমার একমাত্র ইনোসেন্ট সম্পত্তির বিরুদ্ধে এরূপ ষড়যন্ত্র করার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ উপরওয়ালা তোমাকে প্রতিবছর এক হালি বাচ্চার পিতা হওয়ার তৌফিক দান করুক। আমীন আমীন আমীন আমীন। ”
তাজরিয়ানের বলা শেষ কথাটুকু সকলের কর্ণকুহরে পৌঁছায়। আরশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার ছেড়ে বলে,
–” তাজজজজজ্!
তাজরিয়ান বেরিয়ে গিয়েছল। আকস্মিক নিজের নামের হুংকার শুনে পেছনে ফিরে আরশিয়ানের কক্ষের খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
–” ইয়া খোদা তুমিই একমাত্র সুষ্ঠু বিচারক। আমি সত্য কথা বলা মাত্রই তৎক্ষণাৎ অপরপক্ষের প্রেস্টিজ ব্যথায় টনটনিয়ে উঠে। ইহা কী আমার দোষ? একদমই নয় সুতরাং তুৃমি একটা সুষ্ঠু পথ দেখাও খোদা। হয় তাদের ব্রেইনে দুফোঁটা বুদ্ধি দাও নয়তো আমার সেন্স অব হিউমারে ছোটোখাটো একটা ক্র্যাশ ঘটিয়ে এটাকে ভ্যানিস করে দাও। এই দোটানার যন্ত্রণা আর নেওয়া যাচ্ছেনা। ”
চলবে?