শিরোনামহীন অনুভূতি পর্ব-০৯

0
14

#শিরোনামহীন_অনুভূতি
#রুহানিয়া_ইমরোজ
#পর্বসংখ্যাঃ০৯

নবাগত সূর্য উঁকি দিয়ে নতুন দিনের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ফোনের এলার্মটা বীভৎস শব্দে বাজতেই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো প্রিমা৷ তড়িঘড়ি করে সময়টা একবার দেখে নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে লম্বা একটা হামি তুলে বিছানা সংলগ্ন জানালার বাহিরে তাকাল সে৷ সমুদ্রের একখণ্ড অপার্থিব সৌন্দর্য চোখে পড়তেই তার মনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেলো। আনমনে বিড়বিড়য়ে বলল,

–” তোমার নৈসর্গিক সৌন্দর্য মণ্ডিত সুবিশাল প্রশস্ত বুকটায় আমারে একটুখানি ঠাঁই দিবে ?একাকীত্বের ভার বইতে বইতে আমি যে বড্ড ক্লান্ত। আমার একটুখানি সুখকর স্মৃতির কারণ হবে সমুদ্র?”

সময় বহমান। চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে জয়েন করার প্রায় সাত মাস পূর্ণ হয়েছে প্রিমার। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে একজন দায়িত্ববান এমপ্লয়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে প্রিমা। অফিসের সিনিয়রদের সহযোগিতা এবং নিজের প্রচেষ্টার ফলে আরশিয়ানের নিকট
যোগ্য পিএ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। তার উপর বেশিরভাগ কাজের দায়িত্ব দিয়ে আরশিয়ান এখন অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

আজ সকাল এগারোটার দিকে মিটিং রয়েছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিলের মিটিং এটেন্ড করতে গতকাল রাতের লাস্ট ফ্লাইটে চট্রগ্রাম এসেছে তারা। যে কোম্পানি ডিলটা পাবে নিঃসন্দেহে পরবর্তী দুই-তিন বছরের জন্য তাদের অবস্থান কেউ টলাতে পারবেনা সহজে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিলের প্রেজেন্টেশন দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়েছে প্রিমার কাঁধে। বেচারি নাওয়াখাওয়া ভুলে দিনরাত তার স্পিচ রেডি করতে ব্যস্ত। আরশিয়ান তার পাগলামি দেখে না পারতে কৌতুকের স্বরে বলেছিল,

–” বেচারা স্পিচ তুলোধুনো হয়ে গেছে মিস প্রিমা। এটলিস্ট এবার আপনি থামেন নয়তো আমার নিষ্পাপ কান জোড়া নীরবে অভিশাপ দেওয়ার আন্দোলনে নামবে।”

মনে মনে হাজারখানেক গালি দিলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি প্রিমা। এতবড় একটা দায়িত্ব তার কাঁধে দিয়ে সকলে নিশ্চিন্তে থাকলেও টেনশনে বেচারি রীতিমতো আধমরা। অতীত থেকে বেরিয়ে প্রিমা দ্রুত নিজের স্পিচ এবং প্রেজেন্টেশনের স্লাইড গুলো রিচেক করে নিলো অতঃপর সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে গেলো প্রিমা।

ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই শুনলো তার ফোনটা শব্দ করে বাজছে। দুর্ভাগ্যবশত কল রিসিভ করার আগেই তা কেটে গেলো। প্রিমা পুনরায় কল দেওয়ার পূর্বে তার চোখ আটকালো আরশিয়ানের পাঠানো মেসেজের নোটিফিকেশনে। মেসেজে লেখা আছে,

–” টেনশন কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট মিস করে ফেলা লস প্রজেক্টের শামিল মিস প্রিমা। আমি এবং ম্যানেজার সাহেব এদিকটায় আছি, ইফ ইয়্যু ওয়ান্ট দেন ইয়্যু ক্যান জয়েন আস।”

মেসেজটা পড়ে প্রিমা আনমনে হেসে ফেলল। গম্ভীর স্বভাবের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সকলকে নিজ থেকে এপ্রিশিয়েট করার ব্যপারটা প্রিমার বেশ ভালো লাগে। সে আর দেরি করলো না। দ্রুত জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিচে নেমে পড়ল।

_

কোনোরূপ বিড়ম্বনা ছাড়াই সময়ের পূর্বে মিটিং রুমে উপস্থিত হয়েছে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির সকল মেম্বার। ভেতরে প্রবেশ করতেই আরশিয়ান সহ বাকিরা উপস্থিত সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে নিজের জায়গায় বসলো। গল্পগুজবের ফাঁকে আচমকা প্রিমার নজর আটকালো স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করা এক সুদর্শন যুবকের দিকে। চেহারাটা ভালোমতো লক্ষ্য করতেই আকস্মিক প্রিমার চোখজোড়া বিস্মিত হয়ে গেলো। আতঙ্কে বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল বেচারির। নিজের অজান্তেই ফিসফিসিয়ে বলল,

–” আরভিদ ওয়াসীত্ব…?

সেই সুদর্শনের যুবকের অবস্থাও ঠিক একই। আট বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে আচানক নতুন রুপে সামনে দেখে সে-ও হতভম্ব। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো সেই যুবক কেননা এখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপ্রত্যাশিত ভাবে তার পাশে আরশিয়ান কে বসে থাকতে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে মনে মনে আরভিদ বলল,

–” প্রিয় বিবিজানের খুনির সাথে বসে আছে দ্যা গ্রেট আরশিয়ান ইসফার চৌধুরী? ইম্প্রেসিভ! ”

সেই যুবক বাঁকা হেসে প্রিমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। মুখে শয়তানি হাসিটা বজায় রেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

–” হ্যালো মিস রাদিয়াহ ওয়াসীত্ব। ”

অনাকাঙ্ক্ষিত সম্বোধনে প্রিমা কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো কিন্তু প্রত্যুত্তর করতে পারলোনা। আরশিয়ান তা দেখে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

–” আপনার সম্বোধনে ভুল আছে মিস্টার আরভিদ ওয়াসীত্ব প্রান্ত। পয়েন্ট টু বি নোটেড, উনার সারনেইম ইসলাম নট ওয়াসীত্ব। ”

আরভিদ হাতটা সরিয়ে নিয়ে মুখের হাসিটা চওড়া করে বলল,

–” ওহ্ আই সী! একচুয়েলি আম স্যরি.. উনি দেখতে কিছুটা আমার কাজিনের মতো এজন্যই গুলিয়ে ফেলেছিলাম। ”

আরভিদের শয়তানি দৃষ্টিতে প্রিমার শরীর ঠকঠক করে কেঁপে উঠল। ভয় এবং নার্ভাসনেসের কারণে কপাল গড়িয়ে টুপটাপ স্বেদজল নির্গত হলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে আকস্মিক কাঁপা হাতে আরশিয়ানের বাহু খামচে ধরে বুঁজে আসা কন্ঠে কোনোমতে বলল,

–” আ..মার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আ..ই নিড টু গো আউটসাইড। ”

প্রিমার ধারালো নখ জোড়া ইতিমধ্যে আরশিয়ানের তামাটে বর্ণের শরীরে খুব সূক্ষ্ণ এবং আপত্তিকর দাগের সৃষ্টি করেছে। আরশিয়ান একপলক নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রিমার আতঙ্কিত মুখশ্রীর দিকে তাকাল। প্রিমার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। শীতল হাতজোড়া থরথরিয়ে কাঁপছে।প্রিমার আকস্মিক এই পরিবর্তনে আরশিয়ান খানিকটা অবাক হলো। পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনা করে লম্বা শ্বাস ফেলে প্রিমার হাতটা আলতোভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

–” আমি নিয়ে যাচ্ছি.. চলুন। ”

প্রিমা যেনো হুঁশ খুইয়ে বসেছে। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে আরশিয়ানের হাতটা পুনরায় ধরে কাঁপা স্বরে বলল,

–” হুঁ। ”

উপস্থিত ক’জন দৃশ্যটা দেখে খানিকটা কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকাল। প্রিমা তা লক্ষ্য করে ঝট করে হাতটা ছেড়ে দিলো। আরশিয়ান অপ্রস্তুত হেসে বলল,

–” একচুয়েলি, শী ইজ নট ফিলিং ওয়েল। সো…”

আরভিদ জ্বলন্ত চোখে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” অফিসের কোনো এমপ্লয়ি ওয়েল ফিল না করলে এভাবেই খুকুমণির মতো তাদের ট্রিট করা হয় বুঝি ? এবার বুঝেছি রাতারাতি চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির এত বেশি উন্নতির কারণ । ”

ম্যানেজার সাহেব ও সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। এতক্ষণ আরভিদের তাচ্ছিল্য হজম করলেও এই পর্যায়ে বাঁকা হেসে তিনি বলে উঠলেন,

–” এত কিছু বুঝেও কী লাভ হলো আরভিদ সাহেব? রিসেন্টলি শুনলাম, কোন নারীঘটিত কেলেঙ্কারি নিয়ে কোর্টে রোজ হাজিরা দিতে হচ্ছে আপনাকে? সেদিন নিউজে পড়লাম, দু’টো মিল সিল গালা হলো আপনার। কোম্পানির অবস্থান ও মোটামুটি শোচনীয় পর্যায়ে। এতকিছু বুঝেও কেনো যে সেই ট্রিকস এপ্লাই করতে পারছেন না তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। বাই দ্যা ওয়ে আপনি চাইলে আমাদের সিইও তথা আরশিয়ান স্যারের থেকে উপদেশ নিতে পারেন। পার্সোনালি উনার ইমেজ স্বচ্ছ পানির ন্যায় টলটলে আর প্রফেশনাল লাইফে উনার সফলতা সম্পর্কে আপনারা সকলেই অবগত। ”

ম্যানেজার সাহেব কে উপযুক্ত জবাব দিতে দেখে আরশিয়ান আর কথা বাড়ালো না। কৃতজ্ঞতার একটা হাসি দিয়ে প্রিমা কে নিয়ে বাহিরে গেলো।

_

বৃষ্টিস্নাত প্রহর। হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি বাতাসের দাপটে এলোমেলো ভাবে পতিত হচ্ছে ধরণীতে। খোলা করিডোরের একটা বেঞ্চে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে প্রিমা। আরশিয়ান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে বাহিরের বৃষ্টিমুখর পরিবেশ অবলোকন করছে। কিছু সময় পেরোতেই আরশিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল,

–” দমবন্ধ হয়ে আসার কারণটা নার্ভাসনেস নাকি আরভিদ ওয়াসীত্বের কুদৃষ্টি ? ”

প্রিমা প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। বীভৎস অতীতের কথা চাইলেই বলা যায়? আরশিয়ান বিচক্ষণ দৃষ্টিতে প্রিমার দিকে একপলক তাকিয়ে পকেট থেকে একটা চকলেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,

–” প্রেশারটা স্বাভাবিক লাগছেনা আপনার। প্রেজেন্টেশনের আগমুহূর্তে কোনো ঝামেলা চাচ্ছি না আমি। টেক দিস্। ”

প্রিমা অসহায় চোখে তাকাল আরশিয়ানের বাড়িয়ে দেওয়া চকলেটটার দিকে। সাদা প্যাকেটটার উপরে রক্তিম অক্ষরে খুব সুন্দর মতো লেখা Raffaello। প্রিমা হাত বাড়িয়ে চকলেটটা নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। আরশিয়ান ভ্রু কুঁচকে তার উদাস দৃষ্টি অবলোকন করে নরম গলায় ডাকল,

–” মিস প্রিমা? ”

প্রিমা টলমল চোখে তাকাতেই আরশিয়ান অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” লাইফের জার্নিটা ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল। এই মেঘ তো এই বৃষ্টি কখন দেখবেন বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে আবার কখনো জলের অভাবে মরুভূমিতে রুপান্তর হচ্ছে। আমাদের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হবে কেননা জীবনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো অপশন নেই। আপনি শক্তপোক্ত মনোভাব নিয়ে মোকাবেলা করলে সমস্যা গুলো খুব শীঘ্রই সমাধান হয়ে যাবে কিন্তু আপনি ভীত হয়ে পড়লে বেঁচে থাকাটাই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। ”

এতটুকু বলে থামলো আরশিয়ান। অদ্ভুত ভাবে আরশিয়ানের বলা কথাগুলো শুনে এক নিমিষেই প্রিমার দুশ্চিন্তা গুলো গায়েব হয়ে গেলো। অতীতে যেখানে হার মানেনি সেখানে বর্তমানে এসে ভীত হয়ে পড়াটা নেহাত বোকামি। প্রিমার ভাবনার মাঝে আরশিয়ান পুনরায় গম্ভীর স্বরে বলল,

–” বর্তমান সময়ে মানুষ হিংসাপরায়ণ প্রাণীতে রুপান্তরিত হয়েছে। আপনার ভালো থাকা অন্যের মন খারাপের কারণ। বিবেক বিকিয়ে মানুষ কেবল স্বার্থপরের ন্যায় নিজের ভাবনায় মশগুল। দিনশেষে আপনার জন্য কেবল আপনিই লড়াই করবেন অন্যরা করবে স্রেফ উপহাস। এজন্যই অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভুগবেন না। আপনাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে হাজারটা মানুষ এগিয়ে আসবে কিন্তু দুঃসময়ে একটা কাকপক্ষী ও আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। ”

কথাগুলো বলে প্রিমার মনোভাব বোঝার জন্য তার চোখের দিকে তাকাতেই ভীষণ রকমের আশ্চর্য হয়ে গেলো আরশিয়ান । একটু আগেই সেই সম্মোহনী চোখজোড়ায় জল থৈথৈ করছিল অথচ নিমিষেই তা অক্ষিকোটরে মিশে শুষ্ক রুপ ধারণ করছে। সেজন্যই বোধহয় চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। আরশিয়ান কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে বলল,

–” এই নারী তোমার বিভ্রান্তিতে ফেলার সক্ষমতা কীভাবে অর্জন করল আরশিয়ান? এতটা অধঃপতন হয়েছে তোমার চরিত্রের? ভুলে গেলে মরহুম স্ত্রীর কথা? ”

আরশিয়ান মাথা ঝাঁকাল। লম্বা শ্বাস ফেলে বাহিরের দিকে দৃষ্টি ফেলে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। এমন সময় রিনরিনে কন্ঠে প্রিমা বলে উঠলো,

–” আম সো স্যরি স্যার। আকস্মিক আমি এতটা ভীত হয়ে পড়বো বুঝিনি। ধন্যবাদ এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার জন্য। আমি ঠিক আছি এখন। মিটিং শুরু হতে বেশি দেরি নেই। এখন বোধহয় আমাদের যাওয়া উচিত। ”

আরশিয়ান প্রত্যুত্তর না করে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

–” প্রেজেন্টেশনটা সাবলীলভাবে দিতে পারবেন নাকি আমি ব্যাকআপ দিবো? ”

প্রিমা হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

–” নো স্যার। আমি একাই দিতে পারবো। অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য আমি দুঃখিত। ”

আরশিয়ান মিটিং রুমের দিকে এক পা বাড়িয়ে রাশভারি স্বরে বলল,

–” আপনার শক্তপোক্ত মনোভাব দেখেই এতবড় দায়িত্বটা আপনাকে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আপনার দূরদর্শিতা দেখে আমরা আপনাকে চাকরিটা দিয়েছি কিন্তু আপনার পারফরম্যান্সের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আপনার চাকরির বিষয়টা নিয়ে আমাকে পুনরায় ভাবতে হবে। হোপফুলি পরবর্তীতে আপনার থেকে এরকম কোনো হতাশামূলক আচরণের সাক্ষী আমাকে হতে হবেনা।”

আরশিয়ানের তীক্ষ্ণ কথায় প্রিমার দৃষ্টি লজ্জায় নীমিলিত হলো। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনটা দাবানলের মতো সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো। বুক ভরে শ্বাস টেনে প্রশ্বাসের সাথে সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আত্মবিশ্বাসের সাথে মিটিং রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়য়ে বলল,

–” ইট’স টাইম টু প্রুফ মাইসেল্ফ। ”

দেশের নামকরা কোম্পানির মেম্বারদের নিয়ে আয়োজিত এই মিটিংয়ে সকলেই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছে। সকলের নির্ভুল এবং নিখুঁত প্রেজেন্টেশন দেখে ইনভেস্টাররা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। রেজাল্ট জানার অপেক্ষায় সকলেই তাকিয়ে আছে আয়োজকের দিকে। সবার দৃষ্টিতে বিচলিত ভাব থাকলেও প্রিমা বেশ শান্ত। যথাসম্ভব চেষ্টার পর কোনো কিছু হাতছাড়া হলে সেটা নিয়তির দোষ এমনটাই তার বিশ্বাস।

সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের। সবাইকে পেছনে ফেলে চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি পাচ্ছে ডিলটা। মুহূর্তের মাঝে আরশিয়ানের মুখে একটা স্বচ্ছ হাসি খেলে গেলো। সকলে আগ্রহী কন্ঠে তাদের কংগ্রাচুলেশনস জানালো কিন্তু আরভিদের চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল রাগ, ক্ষোভ এবং বিরক্তি। আন্তরিকতার সাথে সবার শুভেচ্ছা গ্রহণ করে ডিল সাইন করার পর প্রয়োজনীয় কাগজ গুলো প্রিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে আরশিয়ান বলল,

–” কংগ্রাচুলেশনস মিস প্রিমা। ”

প্রিমা নির্বিকার সুরে বলল,

–” সেম হেয়ার স্যার। ”

আরশিয়ানের কিছুটা খারাপ লাগলো। সে বোধহয় একটু বেশি রুড হয়ে পড়েছিল মেয়েটার সাথে। আরশিয়ান এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার পূর্বেই প্রিমা গেলো ওয়াশরুমের দিকে। আরশিয়ান থেমে গিয়ে কিছু একটা ভাবলো। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় আপাতত দুদিন ঢাকা টু চট্টগ্রাম রুটের সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ। যেহেতু ডিলটা সাকসেসফুল হয়েছে তাই ছোটোখাটো একটা ট্রিট দেওয়ায় যায় ম্যাডাম কে।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আচমকা আরভিদ কে দেখে থমকে গেলো প্রিমা কিন্তু এবার ভয় পেলনা বরং জ্বলন্ত চোখে তাকাল আরভিদের দিকে। আরভিদ শব্দ করে হেসে খোঁচা দিয়ে বলল,

–” এই রূপের কদর জানতাম বলেই ছোটোবেলায় তোকে পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই তো বুঝিসনি। অযথা খারাপ বলে দোষারোপ করেছিস। আমি যেটা চেয়েছিলাম সেটা তো ঠিকই আরশিয়ান কে দিচ্ছিস। বিনিময় লাগবে সেটা আমায় বলতে পারতি কিন্তু নিজের কাজিনকে বাদ দিয়ে অন্য..

বাকি কথা বলার পূর্বে জোরালো শব্দে থাপ্পড় পড়লো আরভিদের গালে। শীর্ণ হাতের থাপ্পড়ে গালের চামড়াটা জ্বলে উঠল তার। আর কথা বাড়ানোর পূর্বে দুমদাম কয়েকটা আঘাতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো সে। প্রিমা আরভিদের চুলগুলো মুঠো পাকিয়ে সজোরে টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” তুই একটা অমানুষ। তোর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা নেহাতই ভুল। অতীতের পরিচয় সেই ওয়াসীত্ব বাড়ির উঠোনে দাফন করে এসেছি। আমায় বাধ্য করিস না প্রান্ত তা-না হলে পুরো ওয়াসীত্ব পরিবারের অস্তিত্বে কালিমা লেপন করতে আমি দু’বার ভাববো না। সময় আছে শুধরে যা নয়তো তোর চরিত্র হীন চাচা ও তোকে বাঁচাতে পারবে না। ”

কথাগুলো বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে সেখান থেকে চলে গেলো প্রিমা। আরভিদ তার ক্ষতস্থান চেপে রেখে হিংস্র গলায় বলল,

–” জিহ্বা আগের তুলনায় খুব ধারালো হয়েছে তোর। নিয়তির কাছে তুই অসহায় কথাটা বারবার ভুলে যাস কেনো প্রিমা? দাফন করে আসা অতীতই তোর বিনাশের কারণ হবে শীঘ্রই। ”

_

বৃষ্টিমুখর বিকাল। ডিল সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লেগেছে। কাজ শেষ হতেই প্রিমা, আরশিয়ান এবং ম্যানেজার সাহেব হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন৷ আরশিয়ান বসেছে ড্রাইভিং সিটে তার পাশে বসেছে প্রিমা। পেছনের পুরো সিটটা দখল করে হাত পা ছড়িয়ে একাই বসেছেন ম্যানেজার সাহেব। দুদিন ছুটি পাওয়ার আনন্দে তিনি খুশিতে বাক-বাকুম করছেন রীতিমতো। আরশিয়ান তা লক্ষ্য করে টিটকারির সুরে বলল,

–” আপনাদের জন্যই আমার কোম্পানি কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে। ”

ম্যানেজার সাহেব কথাটা শুনে বেশ দুঃখ বোধ করলেন। নিজের অতিব পছন্দের ভুঁড়িতে হাত রেখে আফসোস মাখা কন্ঠে বললেন,

–” আপনার জন্যই আমার গর্ব তথা ভুঁড়িটা তড়িৎ গতিতে শুকিয়ে যাচ্ছে স্যার। ”

প্রিমা না চাইতেও ফিক করে হেসে দিলো। ম্যানেজার সাহেন খেঁকিয়ে উঠে বললেন,

–” মেয়ে মানুষ কী আর বুঝবে পুরুষের যাতনা? তারা তো নিজেরাই পুরুষের জীবনে এক মহা যন্ত্রণার নাম। ”

প্রিমা মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,

–” তাহলে মেয়ে মানুষ বিয়ে করেন কেনো? একটা সাদাসিধা সুদর্শন পুরুষ দেখে বিয়ে বসলেই পারেন। উপকার গ্রহণ করবেন আবার বদনামও করবেন? ”

ম্যানেজার সাহেব চোখমুখ কুঁচকে ভাব দেখিয়ে বললেন,

–” বাবার বয়সী একটা লোক কে এভাবে অপমান করতে তোমার বুক কাঁপল না? ”

প্রিমা ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

–” একদমই না আংকেল বরং প্রশান্তি কাজ করছে মনে৷ ”

ম্যানেজার সাহেব এবার রাগে খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
–” আংকেল কাকে ডাকলে তুমি? ”

প্রিমা পুনরায় ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

–” একটু আগে যে মহান ব্যক্তি নিজেকে আমার বাবার বয়সী পুরুষ দাবি করেছে তাকে। ”

আরশিয়ান মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে ওদের দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া শুনছিল এমন সময় আচমকা তার ফোনটা বেজে উঠে। আরশিয়ান দেখল বাসা থেকে কল এসেছে। এর পূর্বেও তিনবার কল এসেছিল কিন্তু তা রিসিভ করা সম্ভব হয়নি। ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত আরশিয়ান চিন্তিত স্বরে প্রিমাকে বলল,

–” কলটা রিসিভ করে একটু লাউডস্পিকারটা অন করে দিন। ”

আরশিয়ানের কথামতো ফোনটা রিসিভ করে লাউডস্পিকারটা অন করে দিলো প্রিমা কিন্তু তৎক্ষণাৎ অপর পাশ থেকে বলা কথা শুনে তার হাত ফস্কে ফোনটা পড়ে গেলো। স্টেয়ারিংয়ে থাকা আরশিয়ানের হাতজোড়া কেমন যেনো থমকে গেলো। ফোনের অপর পাশ থেকে আফিয়া চৌধুরী তখনও ক্রন্দনরত স্বরে বলে যাচ্ছেন,

–” মেহরিমা সুইসাইড করেছে আরশিয়ান। অবস্থা ভীষণ খারাপ। ডক্টররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এদিকে একমাত্র নাতনির অবস্থা দেখে তোর দাদু ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুই তাড়াতাড়ি আয় বাবা।”

চলবে?