গল্প #শিরোনামহীন
কলমে #মেহরিমা_আফরিন
সামিরের সাথে আমার প্রেম ছিলো আমার অল্পবয়সের আবেগজনিত প্রথম ভুলের একটি।যদিও সেটাকে ভুল বলতে আমার আপত্তি আছে।কারণ এই ভুলটিকে আমি সর্বদাই ফুল হিসেবে দেখি।সামির ছিলো আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র।ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের।তাকে সবসময় দেখতাম ডিপার্টমেন্টের সামনে আরো দুই চারজন বন্ধু নিয়ে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সেভাবেই তার সাথে আমার প্রথম দেখা।
সে প্রায়ই ফ্রেশারদের সাথে দেখা করার জন্য ক্লাসে আসতো।তেমনই এক দিনে তার সাথে আমার পরিচয়।আমি বসেছিলাম ক্লাসের সবচেয়ে পশ্চিম দিকের বেঞ্চে,ভীষণ জড়োসড়ো হয়ে।সামির আমার দিকে এগিয়ে এসেই বলল,’নাম কি তোমার?’
আমি মাথা নামিয়ে উত্তর দেই,’তরুলতা।’
সামির আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো।একেবারে কাটকাট স্বরে জানতে চাইলো,’প্রেম আছে কোথাও?’
আমি ধড়ফড়িয়ে উঠি।দ্রুত মাথা নেড়ে বলি,’না না।আমার কোনো প্রেম নেই ভাইয়া।’
সামির আর কিছু বলেনি সেদিন।কেবল মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।তারপর একদিন ছুটির পর আমার সামনে এসে বাইক থামিয়ে বলল,’বাড়ি কোথায় তোমার?’
আমি ভীতু স্বরে বললাম,’ওয়ারি।’
‘চলো।ড্রপ করে দেই।’
আমি তড়িঘড়ি করে উত্তর দেই,’না না।তার কোনো প্রয়োজন নেই।’
সামির খানিকটা ধমকে উঠলেন।থমথমে মুখে বললেন,
‘উঠতে বলেছি।চুপচাপ উঠো।’
আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে তার বাইকে উঠলাম।সামির আমাকে ঠিক গলির সামনে এনে নামিয়ে দিলো।আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নামিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।
এরপর থেকে সামির রোজ রোজ ক্যাম্পাসের বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।আমি বেরিয়ে আসতেই বাইক স্টার্ট দিয়ে বলতো,’চলো তরু! আমি তোমার বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছি।তোমায় ড্রপ করে দেই।’
সামির ছিলো ক্যাম্পাসের মেয়েদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।মেয়েদের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে।তারা যোগ্য ছেলেদের ছেড়ে বখাটে আর বাউন্ডুলে ছেলেদের প্রেমে মজে।সামিরের ক্ষেত্রেও সেটাই হলো।পড়াশোনায় তার অবস্থা ছিলো শোচনীয়।সারাদিন বাইকে করে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই তার একমাত্র কাজ।এমন একটা শেকড়হীন ছেলেকে পছন্দ করার মতো কিছুই নেই।অথচ মেয়েরা তাকে ভীষণ পছন্দ করত।বলতে দ্বিধা করলেও সত্য,একটা সময় গিয়ে আমি নিজেও সামিরকে পছন্দ করেছিলাম।
আমাদের ক্যাম্পাসে একদিন দুই রাজনৈতিক দলের ঝামেলা বাঁধলো।ককটেল,সাউন্ড গ্রেনেড আর ফায়ারিংয়ের শব্দে আমার তখন দিশেহারা অবস্থা।আমি ছিলাম ডিপার্টমেন্টের সামনে।গোলাগুলির শব্দে দারোয়ান চাচা ততক্ষণে ডিপার্টমেন্টের কেচি গেট বন্ধ করে দিয়েছেন।আমি এলোমেলো হয়ে চারপাশ দেখি।একটু দূরেই দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে।আমার তখন যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।শূন্য চোখে আমি শুধু সামনে দেখে গেলাম।
একটা ককটেল এসে ঠিক আমার চেয়ে একহাত দূরে ফাটলো।সেই শব্দে আমার শরীর জমে এলো।আমি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম।মাথা ঘুরাচ্ছিলো ভীষণ।চারদিকের শোরগোল,চিৎকার চেঁচামেচি,আর প্রচন্ড ধুলোর মাঝে আমি সব ঘোলা দেখছিলাম।এরই মাঝে দেখলাম সামির সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে।তাকে দেখতেই আমার ঠোঁটে হাসি ফুটলো।আমি ভরসা পেলাম।জানতাম,সামির থাকতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না।
সে আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেই আমার একটা হাত চেপে ধরলো।অন্য হাতে আমাকে আগলে নিয়ে ভীত স্বরে বলল,’তরু! তুমি ঠিক আছো তরু?কোথাও লাগে নি তো তোমার?’
আমি আলতো করে তার হাতে মাথা রাখি।একহাতে তার শার্ট খাঁমচে ধরে নিভে আসা কন্ঠে বিড়বিড় করি,’আমি ঠিক আছি সামির।তুমি এসেছো,আর আমি ঠিক থাকবো না,তা কি হয়?’
সেদিন সব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর সামির আমাকে নিয়ে সদর হাসপাতাল গেল।আমি বার বার বিরক্ত হয়ে বললাম,’কিচ্ছু হয়নি আমার।তুমি শুধু শুধু এতো টেনশন করছো।’
সামির এর চেয়েও বেশি বিরক্ত হয়ে বলল,’আহা তরু! চুপ করো তো তুমি।বড্ড কথা বলো তুমি! আপাতত কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকো।’
আমি চুপচাপ বসে থাকি।বসে বসে সামিরের উৎকন্ঠা দেখি।তার কপালে চিকন ঘাম জমেছে।আমি ওড়না দিয়ে সেই ঘাম মুছে দিলাম।সামির গভীর চোখে আমার দিকে তাকালো।আস্তে করে আমার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’তরু! একটা কথা শুনবে?’
আমি মুচকি হাসি।তার কথা কি সেটা আমি ভালো করেই জানি।তবুও না বোঝার ভান ধরে বলি,’কি কথা?’
সামিরকে এই প্রথম খানিকটা বিচলিত আর অপ্রস্তুত দেখালো।তবুও সমস্ত জড়তা দূরে ঠেলে সে বলল,’তরু! আমি তোমায় ভালোবাসি।সেই প্রথম দিন থেকে আমি তোমায় ভালোবাসি।তুমি আমায় ভালোবাসো নাকি জানি না।তবে আজ থেকে বাসার চেষ্টা করবে কেমন?’
এমন অদ্ভুত প্রেম প্রস্তাবে আমার হাসি পেল।আমি হাসি আটকে বললাম,’যদি না বাসি?’
সামির আমার হাত ছাড়ল না।উল্টো আরো শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে বলল,’তবে আমি খুব কষ্ট পাবো।তুমি আমার প্রথম অনুভূতি তরু।এর আগে কোনো মেয়েকে দেখে আমার এমন অনুভূতি কাজ করে নি।’
আমি পলক না ফেলে তার চোখ মুখ দেখি।তাকে সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত আর ভীত দেখাচ্ছে।
একটা হাত তার চুলে ছুঁয়িয়ে আমি বললাম,’জনাব সামির! সন্ধ্যা ঘনিয়েছে।দয়া করে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিন।’
সামির অধৈর্য হয়ে বললাম,’পৌঁছে দিব।তার আগে তুমি উত্তর দাও।’
‘বাড়ি গিয়ে ভাবতে হবে।’
‘এখনই ভাবো।’
‘উহু।বাড়াবাড়ি করছো তুমি।’
সামির বাচ্চাদের মতো চোখ মুখ কুঁচকে নিলো।প্রচন্ড আশাহত হয়ে বলল,’আচ্ছা চলো।নিচে বাইক রাখা আছে।’
আমি শুধু সংক্ষেপে জবাব দেই,’আচ্ছা।’
বাইকে উঠার পর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথা রাখলাম।সামির ব্রেক কষলো।ভীষণ বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ভালো না বাসলে এসব আদিখ্যেতার কি মানে?ছাড়ো আমায়।’
আমি আগের মতোই তার সাথে মিশে থাকি।চোখ বুজে মৃদুস্বরে বলি,’ছাড়বো না।এভাবেই বাইক চালাও।আমার ক্লান্ত লাগছে খুব।’
‘তরু!’
‘কি?’
‘বলো।’
‘কি বলবো?’
‘সেটাই যেটা আমি শুনতে চাই।’
‘আমার কিছু বলার নেই।’
সামির লটকানো মুখে বাইক স্টার্ট দেয়।যেতে যেতে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,’তোমরা মেয়েরা খুব নিষ্ঠুর তরু।তোমরা আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেও।আমি আর তোমার কাছে আসবো না।’
চলবে-