শিরোনামহীন পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
373

#শিরোনামহীন[শেষ পর্ব]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৩.
সেই রাতে আমরা যাযাবরের মতো পথে পথে ঘুরলাম।সামির পকেটে হাত গুজে অন্যহাতে আমার হাত ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’এটা হলো আমার ব্যাচেলর জীবনের শেষ রাত,তোমার ক্ষেত্রেও তাই।আজ একটু ভবঘুরে হয়ে ঘুরো।কাল থেকে সংসার করবে মন দিয়ে।’

আমি হাসি।জানতে চাই,’কীভাবে সংসার করবো?কি আছে তোমার সংসারে?’

‘উহু।আস্তে আস্তে হবে সংসার।তুমি এতো ভেবো না।’

আমরা দু’জন ল্যাম্পপোস্টের ধাঁরে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।দূর থেকে কুকুরের ডাক কানে আসছে।সামির রাস্তা দেখতে দেখতে বলল,’আমরা একটা ছোট্ট সংসার বাঁধবো তরু।শুধু তুমি,আমি আর অনেক অনেক ভালোবাসা।’

আমি ফিক করে হেসে দিলাম।ঠোঁট টিপে বললাম,’ভালোবাসা ছাড়া আর দেওয়ার মতো তোমার আছে টা কি?’

সামির মুখ বাঁকা করে বলল,’বাজে বকো না তরু।কথায় কথায় খোঁটা দেওয়া কোনো ভালো বউয়ের কাজ না।’

‘বাবাহ!তুমি কোথাকার ভালো বর শুনি।’

সামির পাশে থাকা বাইকটা দেখিয়ে বলল,’আমি চাইলেই এটা বেচে দিয়ে আরামে আয়েশে দুই তিন মাস কাটিয়ে দিতে পারি।কিন্তু আমি শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবে এটা বেচার সিদ্ধান্ত নাকচ করেছি।’

আমি কপাল কুঁচকে বললাম,’কি?বাইক চালাবে তুমি।আর সিদ্ধান্ত নাকচ করেছো আমার কথা ভেবে?’

সামির গম্ভীর হয়ে বলল,’শোনো! আমার কাছে আপাতত সম্পদ বলতে এই বাইকটাই আছে।আমি যদি এটা বেচে দেই,তবে কি নিয়ে ঘুরবো?তোমাকেও বা কিসে করে ঘুরাবো?তাই এটাকে অন্ধের লাঠি হিসেবে রেখে দিলাম।বড় বিপদ হলে তখন বেচে দিবো।আমার চিন্তা সুন্দর,তাই না?’

আমি হাসি।মাথা নেড়ে বলি,’একদম।তোমার চিন্তা খুব সুন্দর।’

আমার গলায় একটা স্বর্ণের চেইন ছিলো।দুবাই থেকে বড়ো মামা এনেছিল গত বছর।আমি বাড়ি থেকে কোনো ক্যাশ আনিনি।জামাও এনেছি কেবল দুইটা,সাথে দু’টো শাড়ি।চেইনটা সামিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,’এই নাও।আপাতত এটা ভেঙে কাজ চালাও।’

সামির লজ্জিত মুখে চেইন টা হাতে নিলো।একেবারে নিচু স্বরে বলল,’যদি কোনোদিন সুযোগ হয়,তবে এর চেয়ে দশ গুন বেশি ফিরিয়ে দিবো তোমায়।আপাতত এই টানাটানির জীবনে মানিয়ে নাও তরু।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।সামিরের আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে বললাম,’কোনো ব্যাপার না সামির।খারাপ সময় বেশিদিন থাকে না।আমার বিশ্বাস একদিন আমাদেরও ভালো সময় ফিরবে।’

পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ আমি আর সামির কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিলাম।একেবারে অনাড়ম্বর আর সাধারণ বিয়ে বলতে যা বোঝায়,আমাদের বিয়েটাও তেমনই হলো।কোনো আয়োজন নেই,কিচ্ছু নেই।সামিরের তিনজন বন্ধু এলো কেবল।আমার পক্ষ থেকে কেউ ছিলো না।

আমি রাতেও বেশ স্বাভাবিক ছিলাম।কিন্তু কবুল বলতে গিয়েই আমার কি হলো জানি না,আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।প্রেমিকা হিসেবে তরুলতা সেদিন একশো তে একশো হলেও সন্তান হিসেবে সে নেমে এসেছিল একেবারে নিকৃষ্ট পর্যায়ে।আমার বাবা,যে আমাকে কোলেপিঠে মানুষ করলেন,আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিলেন,আমি তার বিশ্বাস,তার দম্ভ,তার মান সম্মান সবকিছুতে কালি মেখে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।অথচ এই পুরো ব্যাপারটায় আমি বাবার দোষ খুঁজে পাইনি।বাবা একটা বেকার ছন্নছাড়া ভবঘুরে ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চায়নি।এতে ভুল কি আছে?আমি তো কোনো ভুল খুঁজে পাই না।আমার সন্তান হলেও তো আমি এমনই করতাম তাই না?

সামির অপরাধীর মতো চোখ করে আমার দিকে তাকালো।আমি বুঝলাম তার কিছুটা অনুশোচনা হচ্ছে।কাজি অফিসের লোকজন সব অদ্ভুত চোখে আমায় দেখছিলো।আমি আর তামাশা করলাম না।দ্রুত কবুল বলে কাবিননামায় সাক্ষর করে দিলাম।

____

সামির আর আমার সংসার শুরু হয়েছিল মালিবাগে,দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসায়।ভাড়া ছিলো সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।অনেক খুঁজে তারপর এতো সস্তায় বাড়িটা জোড়ার করেছিল সামির।বলা বাহুল্য,আমাদের মাথার উপর কোনো শক্ত ছাদ ছিলো না।টিনশেডের খুবই নড়বড়ে বাড়িতে আমরা থাকলাম।

সামির বাড়িতে পা রেখেই অনুতপ্ত হয়ে বলল,’দুঃখিত তরু! বড়োলোকি জীবন থেকে ঠাস করে এমন গরীবি জীবনে নামিয়ে আনার জন্য আমি দুঃখিত।’

আমি স্বচ্ছ হেসে দুঃখদের বিদায় জানিয়ে দিলাম।এতো দুঃখ পেয়ে কি হবে?বাড়ি ছেড়ে পালানোর আগে সবকিছু ভেবে তবেই পালিয়েছি।আমার আর কোনো আফসোস নেই।এই ছোট্ট বাড়িতে থেকে যদি সামিরকে পাওয়া যায়,তবে সেটাই সই।

আমি যদিও বা এই টানাটানির জীবন মেনে নিয়েছিলাম,কিন্তু আমার শরীর কিছুতেই ব্যাপারটা মানতে পারছিলো না।টিনের বাড়ি।সকালে রোদ এসে পুড়িয়ে দিয়ে যায়।রাতে আবার ঠান্ডায় গা জমে যায়।আমি একেবারে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম।সামির আতঙ্কিত হয়ে বলল,’সে কি তরু! তোমার চেহারার এই অবস্থা কেন?ডাক্তারের কাছে যাবে?’

আমি দ্রুত মাথা নাড়ি।বিরোধ করে বলি,’কোনো প্রয়োজন নেই সামির।টাকা থাকলেই খরচ করতে হয় না।’

সামির কিছু বলে না।কেবল তার চোখে মুখে একটা অন্যরকম অসহায়ত্ব ফুটে উঠে।আমি কখনো রান্না করিনি।শখের বশে টুকটাক শিখেছিলাম কিন্তু সেভাবে নিয়ম করে কখনো রান্না করা হয়নি।সামিরের সাথে বিয়ের পর রান্নার দায়িত্বটা আমিই নিলাম।সামির অবশ্য আমায় একা কিছু করতে দিতো না।কাটাকাটির কাজটা সে নিজেই করতো।

সারাজীবন আড়ম্বরের সাথে বড় হয়ে হঠাৎই এই জীবন আমাকে কেমন নাজেহাল করে দিলো।সামির বাড়ি ফিরে আমার ঐ বিধ্বস্ত রূপ দেখেই হতচকিত হয়ে বলতো,’সেকি! চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?’

আমার হাত তখন চুলোর কালি মেখে বিচ্ছিরি দেখাতো।এমনকি কয়েকদিনে মুখটাও কেমন বিদঘুটে হয়ে গিয়েছিলো।আমি খাটে বসে আক্ষেপের সুর তুলে বলতাম,’ওসব কিছু না সামির।সবই কর্মফল।আমি বাবার মুখে কালি মেখে এসেছি।এখন প্রকৃতি আমার সমস্ত শরীরে কালি মাখাচ্ছে।’

বলেই আমি জোরপূর্বক হাসলাম।সামির সেই হাসির আড়ালে থাকা চাপা কষ্ট দেখলো বোধ হয়।তাই আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ হাত মুখ ধুতে চলে গেল।

আমার পুরোনো সিম আমি আরো অনেক আগেই ফেলে দিয়েছি।নতুন সিমে এই পর্যন্ত বাড়ির কাউকে ফোন দেইনি।দেওয়ার সাহসই হয়নি।বিয়ের সাতদিনের মাথায় আমি ভয়ে ভয়ে তমার নম্বরে ডায়াল করলাম।তমা আমার চাচাতো বোন।তার সাথে আমার সম্পর্ক আপন বোনের মতোই।

তমা কল রিসিভ করে প্রথমেই আমায় চিনলো না।নাম বলতেই সে কেমন ধড়ফড় করে উঠলো।অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,’তরু! তুই?’

আমি হড়বড়িয়ে বললাম,’তমা! বাড়ির অবস্থা কি?সব ঠিক আছে তো?’

‘আগে বল তুই কোথায়?তুই কি আসলেই সামির ভাইয়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছিস?’

আমি নিচু স্বরে বললাম,’হ্যাঁ।’

‘এরপর?’

তমার কন্ঠে উদগ্রীব ভাব ছিলো।আমি নিরাসক্ত হয়ে বললাম,’এরপর আমরা বিয়ে করে নিয়েছি।এখন মালিবাগে বাসা নিয়ে থাকি।’

তমা কতোক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকল।শেষে একটু ধাতস্থ হতেই করুণ সুরে বলল,’তুই জানিস না তুই যাওয়ার পর বাড়িতে কি কি হয়েছে?’

আমার বুকটা ধ্বক করে উঠে।আমি শ্বাস বন্ধ করে জানতে চাইলাম,’কি হয়েছে তমা?প্লিজ আমাকে বল।’

তমা বড় বড় দু’টো শ্বাস ছেড়ে বলল,’বড় চাচা গত চারদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি।দুই যাওয়ার দুইদিন পর চাচ্চু স্ট্রোক করেছে।’

আমার মনে হলো আমায় মাথায় কেউ প্রচন্ড ভারি কোনো বস্তু চাপিয়ে দিয়েছে।যেই চাপে আমার সমস্ত শরীর ভেঙে আসলো।আমি ধপ করে মেঝেতে গিয়ে বসলাম।আমার গলা ধরে আসছিলো,চোখের পানি নেমে এসেছিল গাল অব্দি।ফোনটাকে গালের সাথে চেপে ধরে কয়েকবার কথা বলতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।শেষে কন্ঠনালি ছিঁড়ে উচ্চারণ করলাম,’বাবা এখন কেমন আছে তমা?’

‘আছে।আগের তুলনায় ভালোই।কাল রাতে জ্ঞান ফিরেছে।তবে আরো এক সপ্তাহ হসপিটালেই থাকতে হবে।’

‘কোন হসপিটাল?’

তমা আচমকাই চেঁচিয়ে উঠল,’ওয়েটটট।তুই কি সামহাউ হসপিটালে আসতে চাইছিস?প্লিজ তরু।সবটা আর ঘেটে দিস না।যেখানে আছিস,সেখানেই কয়দিন থাক আপাতত।’

‘তমা!! ঐ মানুষটা আমার বাবা।’

তমার কন্ঠ এবার কিছুটা কঠোর শুনালো।সে চাপা স্বরে বলল,’বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে তোর বাবার কথা মনে পড়েনি?তুই কি পরিমান হেনস্তা করেছিস আমাদের তোর কোনো খেয়াল আছে?বড় চাচা কতোখানি কষ্ট পেয়েছে তুই জানিস?তুই কি পালিয়ে না গিয়ে অন্য কোনো উপায় বের করতে পারতি না?’

‘কি করতাম?চেষ্টা তো কম করি নি।তুই এমন করে কথা বলছিস কেন আমার সাথে?বিয়ে করলাম বলে আমি তোদের পর হয়ে গেলাম?’

তমা ফোনটা কেটে দিলো।একটু পর একটা হসপিটালের এড্রেস পাঠালো।আমি তখনই ফ্লোর ছেড়ে উঠলাম না।অনুভূতি শূন্য হয়ে আরো কিছুক্ষণ জড়ো পদার্থের মতো ফ্লোরেই বসে থাকলাম।এক আকাশ অপরাধবোধ,বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা,তীব্র অনুশোচনা আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল।

সামির বাড়ি আসলো আরো কয়েক ঘন্টা পরে।আমার এই ভেঙে পড়া রূপ দেখে সে আরো বেশি ভীত হলো।কাছে আসতেই আচমকা তাকে জাপটে ধরে আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।সামির শুধু বোকা বোকা চোখে আমার ব্যাকুলতা দেখে।আমি হেঁচকি তুলে বললাম,’সামির!বাবা নাকি স্ট্রোক করেছে।আমি মরে যাচ্ছি সামির।সত্যি সত্যি মরে যাচ্ছি।’

সে রাতে গুটি গুটি পায়ে আমরা দু’জন হসপিটাল গিয়েছিলাম।আমাদের দেখতেই বাড়ির লোকেরা এমনভাবে তাকালো যেন আমরা কোনো জেলফেরত আসামি।মা তো আমাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।আমি ভঙ্গুর পায়ে বাবার কেবিনে গেলাম।বাবা তখন আধশোয়া হয়ে ছিলেন।আমার দর্শন পেতেই তার দুই চোখ স্থির হলো।

‘ভেতরে আসবে না তরু।যেখানে দাঁড়িয়ে আছো,ওখান থেকেই ফিরে যাও।’

আমি জড়ানো স্বরে বললাম,’বাবা! প্লিজ।’

বাবা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।না কোনো ধমক দিলেন,না উঁচু স্বরে কথা বলে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করলেন।উল্টো বরফ শীতল কন্ঠে বললেন,’তুমি যাও তরু।তোমার আর আমার সামনে আসার প্রয়োজন নেই।তোমার মতো কুলাঙ্গার কে আমার আর না দেখলেও চলবে।যেদিন তুমি আমার বিশ্বাস কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাড়ির চৌকাঠ ছেড়েছিলে,সেদিনই আমি তোমায় মৃত বলে মেনে নিয়েছি।আমার তরু সেদিনই মরে গেছে।তুমি যাও।মন দিয়ে সংসার করো।আমার তোমাকে প্রয়োজন নেই তরুলতা।’

আমি মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।কান্নার দমকে আমার শরীর কেঁপে উঠল।সামির আমার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেল।তার আগেই বাবা খানিকটা ধমকে উঠলেন,’এ্যাই ছেলে! তুমি কোনো কথা বলবে না।আমি তোমার কাছে কোনো কিছু জানতে চাই নি।তোমার বউ কে নিয়ে ভালোয় ভালোয় হাসপাতাল ছাড়ো।আমি তোমাদের কারো মুখ দেখতে চাই না।’

আমিও তারপর আর বাবাকে মুখ দেখাইনি।অনুতাপ,অনুশোচনা আর এক বুক অভিমান নিয়ে আমি সামিরের সাথে ফিরে এসেছিলাম।অথচ সেই রাতে আমি একটুও ঘুমুতে পারি নি।ছটফট করতে করতে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।সামিরও পুরো রাত নির্ঘুম কাটালো।রাতের শেষটায় একেবারে নিভে আসা কন্ঠে বলল,’তরু! আমার জন্য তোমার এতো কষ্ট হচ্ছে।আই অ্যাম সরি।যদি জানতাম,ব্যাপারটা এতো সিরিয়াস পর্যায়ে যাবে,তবে কখনোই তোমার সাথে এমনটা করতাম না।’

আমি তার হাত জড়িয়ে ধরলাম।আমার চোখের পানিতে তার বুক ভেজাতে ভেজাতে বললাম,’সব আমার দোষ সামির।আমিই পারি নি সবাইকে খুশি করে চলতে।না বাবার মন জুগিয়ে চলতে পেরেছি,আর না তোমার সংসারে মন দিতে পারছি।আমি দুই দিক দিয়েই ব্যর্থ সামির।পুরোপুরি ব্যর্থ।’

এরপর দুই দিন কান্নাকাটির পর আমি নিজেকে শক্ত করলাম।শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে মন দিয়ে সংসার করার প্রতিজ্ঞা করলাম।ভালো সন্তান হওয়ার প্রতিযোগিতায় তো ইয়া বড় বড় দুটো শূন্য পেলাম।অন্তত ভালো স্ত্রী হওয়ার দৌড়ে কিছু নম্বর তো পেতেই পারি।

আমি অল্প অল্প করে রান্না শিখলাম।সেই সাথে শিখলাম ঘর গোছানো।আর সামির শিখলো সংসারী হওয়া।সে আর বাইরে বাইরে সময় নষ্ট করতো না।মাস খানেকের ভেতর একটা চাকরি জোগাড় করে সে পুরোদস্তুর সংসারী পুরুষ হয়ে উঠল।সকালে আমাকে দু’টো শুকনো চুমু খেয়ে অফিসে যাওয়া,আর অফিস থেকে ফিরে ঘন্টাখানেকের জন্য আমাকে নিয়ে বাইক দিয়ে ঘুরা ছিলো তার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ।আমার বড়ো ভালো লাগতো ব্যাপারটা।তরুলতা ধীরে ধীরে নিজেকে এই জীবনে মানিয়ে নেওয়া শুরু করল।

একদিন সামির আক্ষেপ করে বলল,’আমি আসলে তোমায় একটা মিথ্যা কথা বলেছি তরু।আমি বলেছিলাম আমার সাথে বিয়ে হলে আমি তোমায় রানী বানিয়ে রাখবো।অথচ রাণী বানানো তো দূর,তোমার বাবা তোমায় যেমন করে রেখেছিল,তার এক পার্সেন্টও আমি রাখতে পারি নি তরু।’

আমি মিষ্টি হেসে তার মাথায় বিলি কাটি।কোমল সুরে বলি,’রাণী হওয়া কোনটাকে বলে সামির?খুব বেশি অর্থবিত্তে থাকলেই কি রাণী হয়?রাণী অনেকভাবেই হওয়া যায়।এই যে তুমি রোজ রোজ আমায় নিয়ে ঘুরতে যাও,পাড়ার মোড় থেকে ফুচকা কিনে খাওয়াও,ছুটির দিনে পার্কে গিয়ে গাজরা কিনে দাও,,এই ছোট ছোট যত্নতেও মানুষ রাণী হয় সামির।আমার সংসারে অন্তত আমি নিজেকে রাণীই ভাবি।’

সামির গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকায়।তারপর ছোট বাচ্চাদের মতো আমার কোলে মাথা রেখে বলে,’আমরা একদিন অনেক ভালো থাকবো তরু।তুমি লিখে নাও আমার কথা।এমন লক্ষী বউ থাকতে কেউ খারাপ থাকতে পারে না।’

____
আমরা আক্ষরিক অর্থেই ভালো থাকতে পেরেছিলাম।চাকরির প্রথম দুই বছরে অল্প অল্প টাকা জমিয়ে সামির একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করলো।আমি বহু কষ্টে নিজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম।

ব্যবসার শুরুতে কিছুটা মন্দা গেল।তবে আস্তে আস্তে সামান্য লাভ আসতে শুরু করলো।মাস শেষে যখন টাকার পরিমান কিছুটা বাড়তো,তখন খুশিতে আমাদের দু’জনের চোখ ভিজে উঠতো।

এই কয় বছরে সামির আরো কয়েকবার বাবার দারস্থ হয়েছিল।বাবা প্রতিবারই তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিলেন।অথচ সে হাল ছাড়লো না।আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,’বাবা তোমাকে ছ্যাচড়া ভাবে সামির।আর কতোবার যাবে?’

সে কাটকাট স্বরে উত্তর দেয়,’যতোদিন না মানছে ততদিন যাবো।কিন্তু আমার তরুর জীবনে কোনো অপূর্ণতা আমি রাখবো না।’

**

আমরা বছরখানেক পরে বাসাবো তে একটা সুন্দর এপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম।যার ভাড়া ছিলো একুশ হাজার টাকা।মোট চারটা রুম।সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বাসা থেকে একুশ হাজার টাকার বাসায় শিফট হওয়ার যে নিদারুণ অভিযাত্রা,সেটা কেবল সামির আর আমিই জানলাম।

এই কয়েক বছরে সামির প্রচন্ডরকমের পরিশ্রমী হয়ে উঠলো।আমরা কোটিপতি হতে পারিনি।সেই অভিলাষ আমরা কখনোই করিনি।তবে আমরা স্বাবলম্বী হতে পেরেছিলাম।কাঁদামাটির উপর দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে আমরা ডুবে যাওয়ার ভয় করছিলাম।সেই কাঁদামাটি থেকে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে আমাদের বেশ কাঠখড় পোহাতে হলো।তবুও আমরা সেই ভয়াবহ দুর্যোগ পার করেছিলাম হাতে হাত রেখে।প্রেম ব্যাতীত আর কোনো অস্ত্র,আর কোনো শক্তি আমাদের ছিলো না।

আমি একটা বেসরকারি কলেজের লেকচারার পদে নিয়োগ পেয়েছিলাম।আর সামিরের ব্যবসা তখন জমজমাট।সব মিলিয়ে আমাদের সংসার যথেষ্ট ভালো যাচ্ছিল।আমরা সেই সংসারকে পূর্ণতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।সন্তান ছাড়া কি কোনো সংসার পূর্ণতা পায়?

***

আশ্বিনের শেষ ভাগ চলছে।আজকের আবহাওয়া চমৎকার।বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতোবার আকাশ দেখছি,ততবার আমার মন ভালো হচ্ছে যাচ্ছে।শরৎের স্বচ্ছ বাতাস আমার শরীরে লেগে আমার দু’জনকে সিক্ত করে গেল।আমি পেটে হাত রেখে বড়ো করে শ্বাস টানি।তার সাথে আমার তিন মাসের গভীর সম্পর্ক।

আজ আমার জন্মদিন।আমার স্বামী কাল রাতে নিজ হাতে আমার জন্য কেক বানিয়েছে।স্বাদের কথা জানি না,তবে কেক টা দেখে আমার মন চাইছিলো সারা জীবন সেটা শো কেসে রেখে দেই।সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ছেলেটা আনাড়ি হাতে আমার জন্য কেক বানালো।স্ত্রী হিসেবে তরুলতার আর কি চাইবার আছে?আমি যখন কেকটা মুখে দিলাম,তখন মনে হলো ভালোবাসা আর অনুভূতিরা সব কেকের রূপ ধরে আমার গলা বেয়ে নেমে এলো।

আমি সুখী ছিলাম।ছোট্ট এই জীবনে আমি খুব বেশি সুখী ছিলাম।শুধু একটা জিনিসেরই অপূর্ণতা ছিলো।

কলিংবেলের শব্দ পেতেই আমি দরজার দিকে ছুটে গেলাম।সামির এসেছে নিশ্চয়ই।দরজা খোলামাত্রই আমি তাজ্জব হই।সামির একা আসে নি।তার সাথে তার বোন,বোনের বাচ্চা আর তার দুলাভাই ছিলেন।সাথে আরো দুই জন ছিলো।তাদের দেখতেই আমার দুই চোখ ঘোলা হয়ে এলো।আমি দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে ধরা গলায় বললাম,’বাবা! মা! তোমরা।’

বাবা ঘরে পা রেখেই সবার প্রথমে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’তরু! আমার তরু! তুমি কতো বড়ো হয়ে গেছো মা।কতো বুঝদার হয়েছো তুমি!’

আমি নিষ্পলক চেয়ে থাকি।একবার চোখ যায় সামিরের দিকে।তার মুখে প্রশস্ত হাসি।এতো দিনের লাগাতার চেষ্টায় সফল হয়ে সে ভীষণ খুশি।আনন্দে চোখ বুজে আসে আমার।সামির মানুষটা এতো ভালো কেন?

আমার জীবনের সব প্রাপ্তি ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছিল।বাবা মা আমাদের মেনে নিলেন।মা রোজই এটা সেটা বানিয়ে আমার কাছে চলে আসতেন।সামিরের আয়ও অল্প অল্প করে বাড়ছিলো।মোদ্দাকথা সুখে থাকার জন্য রবের কাছে আমি যা কিছু চেয়েছিলাম,সময়ের ব্যবধানে রব আমায় তার সবটা ফিরিয়ে দিলেন।

একদিন রাতে আমরা দু’জন বারান্দায় গিয়ে বেতের চেয়ার দু’টোতে বসলাম।আমার তখন ছয়মাসের বাড়ন্ত পেট।মুখজুড়ে বিরাজ করতো অদ্ভুত মায়া।পেটে হাত রাখতেই প্রখর অনুভূতিরা আমায় জেঁকে ধরতো।আমি ঠোঁট কামড়ে সেই অনুভূতিদের নিয়ন্ত্রণ করতাম।সামির আমার পেটে হাত রেখে বলল,’ধন্যবাদ তরু।আমার শূন্য খাঁ খাঁ জীবনে এসে জীবনটাকে সুখের বৃষ্টিতে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য তোমায় ধন্যবাদ।তুমি না থাকলে আমি সেই কবেই বিলীন হয়ে যেতাম।’

আমি কোনো উত্তর দেই না।আলতো করে তার কাঁধে মাথ রাখি।রাত গভীর হতে শুরু করেছে।ব্যস্ত নগরী ঢাকা পড়েছে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে।আমি সেই নিস্তব্ধতা উপভোগ করি।জীবনের এই নাটকীয় পথচলা সিনেমার গল্পের মতো আমার স্মৃতি তে ভেসে উঠে।

সামির বলল,’মালিবাগের ঐ বাড়িতে যদি না থাকতাম,তবে কোনোদিন তোমার ভালোবাসা টের পেতাম না।বিশ্বাস করো তরু,তোমার মতো করে কেউ কখনো আমায় ভালোবাসি।আমি আমার তরুর সেই ক্লান্ত মুখটা ভীষণ মিস করি।তুমি আমায় ভাত মেখে খাইয়ে দিতে।আমার মনে হতো তুমি না,বরং আম্মা সামনে বসে আছে।’

আমি নিশ্চুপ হয়ে তার কথা শুনি।নিরবতা ছাপিয়ে সামির বলল,’চলো তরুলতা।আরো একবার নতুন করে প্রেমে পড়ি।তারপর সেই প্রেমে পরাজিত হয়ে তুমি বাড়ি ছাড়বে।আর তোমার প্রেমে পরাজিত হয়ে আমি সিগারেট ছাড়বো।’

আমার চোখ লেগে আসছিলো।আমি ঘুম ঘুম স্বরে বললাম,’হুমম।তারপর?’

‘আর তারপর শুন্য পকেটে আমরা আবার একজন অন্যজনের প্রেমে পড়তাম।আমি কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতাম।আর তুমি গরম গরম ভাতের থালা সাজিয়ে আমার অপেক্ষা করতে।টিনশেডের উপর ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়তো।আর সেই বৃষ্টির শব্দে আমরা আমাদের ভালোবাসা গুনতাম।তারপর একটা রুটলেস ছেলেকে ভালোবাসার দায়ে তোমার জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতো।’

আমার দু’চোখে তখন গভীর ঘুম।মুখ খুলে কিছু বলতেও আলসেমি হচ্ছিল।যদি বলতে পারতাম,তবে দৃঢ় স্বরে বলতাম,’তারপর জাগতিক সমস্ত কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তরুলতা তার প্রিয়তমের সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করতো।’

*****সমাপ্ত*****