শিরোনাম পর্ব-০১

0
144

#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_০১
#মুসফিরাত_জান্নাত

স্বীয় স্বামীর ব্যাপারে গোপন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে শাশুড়ি ও ননদকে নিচু কণ্ঠে আলাপ করতে শুনতেই থমকে দাঁড়ায় জেরিন।শাশুড়ি মনোয়ারা ওনার মেয়ে জিনাতকে নিচু স্বরে বলছেন,”ঘটনা সত্যি কিনা আগে যাচাই করতে হবে।জামাইকে বল গাইনী ডাক্তারের কাছে একটা সিরিয়াল দিতে।আমি নিজে হাসপাতালে যাবো।আল্ট্রাসোনো করে নিশ্চিত হয়ে তবেই বাড়ি ফিরবো।ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের কপাল খুলে যাবে।জেরিনের সব দেমাগ মুহুর্তেই কেমনে ঝরঝর করে চু’রমার হয় তাই চোখ মেলে দেখতে পাবো।এরচেয়ে সুখের দিন আর দুইটা হবে না রে জিনাত।আমার কি যে খুশি লাগতাছে।জুবায়ের এতোদিনে একখান কাজের কাজ করছে।”

জবাবে তার ননদ জিনাত বলে উঠলো,“তা আর বলতে হবে নাকি?ঘটনা সত্যি হইলে ওই মেয়ের পতন দেখা যাবে।আমাদের দয়া দক্ষিণা ও করুণায় ওই মেয়ে বেঁচে থাকবে তখন।আমাদের আদেশে উঠবস করবে। এরচেয়ে সুখের সংবাদ আর কি হতে পারে বলো?আমার তো ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চুমু দিতে মন চাচ্ছে।ইয়াহু!”

খুশিতে হুল্লোড় করে উঠলো সে।শাশুড়ি মনোয়ারাও তাল মিলিয়ে বলে উঠলো, “দিতে তো মন চাইবেই।হাজার হলেও আমার ছেলে বলে কথা।দেখবি তো আগে কার গর্ভ থেকে উদয় হয়েছে।কিন্তু ঘটনা যদি সত্যি না হয় তবে খুব বাজে হবে।এতোদিনে জুবায়ের আমাদের পক্ষে আসছে।জেরিনকে আগেই এসব বিষয়ে কিছু বুঝতে দেওয়ার কোনো দরকার নাই।আগের মতোই অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।এই মেয়ে ভ’য়ংক’র খারাপ।আমাদের জীবন তছনছ করে দিবো।অহেতুক ঝামেলা বাঁধানো ঠিক হবে না।সব করতে হবে চুপে চুপে।ডাক্তারের চেম্বারেও চুপে চুপেই যেতে হবে।সাবধান থাকবি সবসময়।”

মায়ের কথায় মাথা নাড়ে জিনাত।সেও যে বিষয়টা ভাবছে না তা নয়।কোনোভাবে জেরিনের কানে গেলে কে’লেংকা’রী লেগে যাবে।আ’গুন নিয়ে খেলতে চাইছে তারা।ঘটনা সত্যি প্রমাণিত হওয়ার আগ অবধি এই আ’গুনে ঝাপ দেওয়া উচিত হবে না।অন্যথায় আম ছালা দু’টোই হারাবে।এমনিতেই তারা নিশ্চিত নয়।জুবায়ের এর মতিগতিও বোঝা দায়।ফলে সাবধানে থাকতে হবে তাদের।বাড়াবাড়ি রকমের সাবধানে থাকতে হবে।জিনাত ফট করে বুদ্ধি দিলো,

“আমি বলছি কি মা।ভাবিকে আগে নাইওর পাঠাও।ও বাপের বাড়িত গেলে সবকিছুর আয়োজন করো।তাছাড়া অহেতুক হাসপাতালে গেলেও ওই মেয়ে সন্দেহ করতে পারে।হাড়ে হাড়ে বুদ্ধি এই মেয়ের।ওকে এই বাড়ি থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করলে তবেই শান্তি পাওয়া যেতো।কিন্তু আমাদের কি আর সে কপাল আছে?”
এখানের সব রাজত্ব তো সে নিজের করে নিয়েছে।আমরাই এখন এ বাড়ির ভাসা পানা।তোমাকে কোনো কাজও করতে দেয় না।এই মেয়ে তোমার সংসার ধীরে ধীরে নিজের করে নিচ্ছে। এতসব বরদাস্ত না করে তোমার উচিৎ ছিলো আগেই ওকে ভাইয়ার থেকে আলাদা করা।তবে সুযোগ যখন এসেছে। এখন আর ভুল করো না।ওকে ভালোয় ভালোয় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে কাজ উদ্ধার করো।”

তাদের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার যোগাড় হলো জেরিনের।সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যেতে লাগলো।
এসব কি বলছে তার শাশুড়ি ও ননদ?তার আড়ালে আড়ালে কি ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন ওনারা?জুবায়ের তাদের পক্ষে গিয়েছে মানে?আর হাসপাতালে গিয়ে কিই বা পরীক্ষা করতে চাইছে।কি হচ্ছে কি এসব?কোনো কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা ভনভন করতে লাগলো তার।সে জানে এদের মুখ থেকে সহজে সত্যিটা জানা যাবে না।জানতে হলে তাকেও অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।তাদের সাথে সায় মিলিয়ে গোপনে সবটা জানতে হবে।অন্যথায় তার ঘর ভাঙার যে পায়তারা চলছে এদের কর্মে তা ফলিত হতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না তার।এমনিতেই তাকে খুব একটা পছন্দ নয় মনোয়ারা ও জিনাতের।এক প্রকার জুবায়ের এর জেদের কবলেই বিয়েটা করিয়েছিলেন ওনারা।ফলে জেরিনের ঘর ভাঙতে যে সর্বোচ্চ তৎপরতা থাকবে মা মেয়ের তা এমনিতেই স্পষ্ট।যা সে কখনোই চায় না।জুবায়েরকে অনেক ভালোবাসে সে।আর কোন মেয়েই বা সেচ্ছায় নিজের ঘর ভাঙতে চায়?

নিজেকে দ্রুতই ধাতস্থ করলো সে।চুপিসারে চলে গেলো সেখান থেকে।দুপুরের রান্নাটুকু যত্ন করেই সম্পন্ন করলো।অন্তরের চিন্তাটুকুর বিরাম দিয়ে মুখোভঙ্গি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।রান্না শেষে ঘর উঠান ঝাড়ু দিয়ে গোছল শেষে নামায আদায় করলো।দুপুরে খেতে বসলো একসাথে।মনোয়ারা তখনই ইনিয়ে বিনিয়ে আলাপ তুললেন,

“তা বউমা, অনেকদিন তো হলো এখানে এসেছো। বাপের বাড়ি যেতে মন চায় না তোমার?না মানে বলছি কি জিনাত তো এখন এসেছেই।থাকবে ভালোই কিছু দিন।তুমি এর ফাঁকে একবার বাপের বাড়ি গিয়া ঘুরে আসলেও তো পারো।তোমারও মন হালকা হলো এতে।জুবায়ের পঞ্চগড় থেকে ফিরলেই তুমি চলে এসো।”

ব্যবসার প্রয়োজনে দিন দুই হলো জুবায়ের পঞ্চগড় গিয়েছে।আরও দুই তিনদিন থাকবে হয়তো।এর মাঝেই তারা কিছু একটা ঝামেলা পাকাতে চায়।সেজন্যই মনোয়ারা যে এমন কিছু বলে বসবে তা ঢের বুঝেছিলো জেরিন।তার কর্মও সে ঠিক করে ফেলেছিলো।সে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকালো।এদের উদ্দেশ্য জানতে হলে এটাই উৎকৃষ্ট টোপ।তারা তাকে যেমন টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে, সে জেনেশুনে সেই টোপ হয়ে তাদেরকেই নিজের শিকার বানাবে।মনের ভেতরে ঝড় উঠেছে তার।কি হচ্ছে জানার জন্য মাথার ভেতর প্রবল চিন্তা কাজ করছে।কিন্তু বেশ স্বাভাবিকই থাকলো সে।খাওয়া দাওয়া শেষ করে সরল আচরণেই ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাবার বাড়ির পথ ধরলো।

শাশুড়ী ও ননদের হাসি হাসি মুখ দেখে বিদায় নিয়ে জেরিন সত্যি সত্যি বাবার বাড়ি যাত্রা করলো।পথে মাথায় চাপলো নানান চিন্তা।সে যে ঝোঁকের বশে বাড়ি যাচ্ছে, এদের খবরাখবর সে পাবে কি করে?চেনা কাওকে তো তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে বলা হয়নি।সে তথ্য জানার জন্য যে ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু করেছে তা আদৌ সফল হবে তো?বাড়ি থেকে ক্রোশ খানেক পথ পেরুতেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলো সে।মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিতে লাগলো।ঝাপসা হয়ে আসা চোখে সে তাকিয়ে কেবল দেখতে পেলো ওই যে বাজার।ওই যে সরকারি হাসপাতাল।হাসপাতালের আশেপাশে গড়ে ওঠা ক্লিনিক।এখানেই তার শাশুড়ী আসবে নিশ্চয়ই?কিন্তু কি এমন কারণে?তার চুপিসারে কেনো আসতে হবে?হাসপাতালে কি কারোর ঘর ভাঙে?হাসপাতাল তো মানুষের রোগের শুশ্রূষা দেয়। ঘর ভাঙতে হলে তো চুপিসারে উকিলের দরবারে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।অথবা কাজী অফিসে গিয়ে অন্য কারোর সাথে জুবায়ের এর বিয়ে পড়ানোর কথা ছিলো।কিন্তু হাসপাতালে এসে তার সংসারে আ’গুন দিবে?এটা আবার কেমন পরিকল্পনা?কি খেলছে তাদের মাথায়?জেরিনের মাথায় কিছু ঢুকলো না।কিচ্ছু না।সে কেবল বিমর্ষ হয়ে চিন্তা করতে লাগলো।এতগুলো বছর ধরে যাদের জন্য জান প্রাণ এক করে এতকিছু করে গেলো।তার বিনিময়ে কেবল তার ঘর ভাঙার ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু পেলো না?এ কেমন ভাগ্য তার?সে সবাইকে বিনা স্বার্থে এতকিছু দেয় বলেই কি সবকিছু থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়?কেনো?জুবায়েরই বা কি করেছে তার অগোচরে?তার শাশুড়ি ও ননদ না হয় শুরু থেকেই তাকে মেনে নিতে পারেনি।কিন্তু জুবায়ের? সেও বা কিভাবে পারছে তার থেকে একটু একটু দূরে সরে যেতে?

তার হুট করেই মনে হলো জুবায়ের পঞ্চগড় যায়নি।মায়ের সাথে মিলে কোনো নষ্ট পরিকল্পণা এঁটেছে।তাছাড়া তার শাশুড়ী ওমনটা বললো কেনো?সম্ভাবনা টের পেতেই চোখে পানি জমে তার।বিষাদের সমস্ত মেঘ মনে জড়ো হয়।টুপটাপ কয়েক ফোঁটা অশ্রুও ঝড়ে বেদনার চপেটাঘাতে।সে জানে মনোয়ারা ও জিনাত আজই এখানে আসবে।বিকেলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া অন্য সকল সেবা বন্ধ থাকে।তখনের প্রয়োজনে মানুষ আশেপাশের ক্লিনিকে আসে।চেম্বারে ডাক্তার দেখায়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে।ভ্যানের ভাড়া মিটিয়ে সতর্কভাবে একটা দোকানে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে।এমন পয়েন্টে বসলো যেনো তাকে কেও খেয়াল না করতে পারে।অথচ সে আশেপাশের সব ক্লিনিকে লোকজনের যাতায়াত স্পষ্ট দেখতে পায়।তার ধারণা সঠিক হলো।মনোয়ারা ও জিনাত মিনিট পনেরো পরেই হাজির হলো।তার মুখ বরাবর অবস্থিত পুরাতন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকলো।অনেকক্ষণ সময় গেলেও বের হচ্ছেনা দুজন।কি একটা ভেবে সেও পিছু নিলো।আর ভিতরে ঢুকতেই যা দেখলো ও শুনলো তাতে নিজের চোখ ও কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার।তার স্বীয় স্বামী সত্যিই পঞ্চগড় যায়নি।তার স্বামী ও স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের গর্ভধারিনী হিসেবে অন্য অপরিচিত এক রমনী সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।তার গর্ভধারণের বিষয়টা মাত্রই ডায়াগনাইজ করে নিশ্চিত হয়েছে দুজন।চোখেমুখে উচ্ছ্বাস ফে’টে পড়ছে।হাতে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট জ্বলজ্বল করছে।যেটাকে নিজের তালাকনামা হিসেবে দেখতে পেলো জেরিন।তার সাধের ঘরটুকু ভাঙার আয়োজন দেখলো।এত দ্রুত এভাবেই তার ঘর ভাঙবে বুঝি?হাতের শক্তি হারিয়ে হাতে চেপে রাখা কাপড়ের ব্যাগটা নিচে লুটিয়ে পড়লো।তার শব্দেই কি কে জানে?তার দিকে তাকিয়ে জুবায়ের সহ মনোয়ারা ও জিনাত ভু’ত দেখার মতো চমকে উঠলো।

চলবে