শিরোনাম পর্ব-০৫

0
78

#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_০৫
#মুসফিরাত_জান্নাত

জীবনের এ পর্যায়ে এসে ভীষণ আফসোস হলো জুবায়ের এর।বেঁচে থাকার সকল সম্ভাবনা ও আশ্বাসটুকু হারিয়ে সে এ পর্যায়ে বুঝলো, জীবন বড় সংকীর্ণ।এই সংকীর্ণ জীবনের এতটুকু শখ আহ্লাদ পূরণ করতে গিয়ে সে কেবল প্রতারক হয়েই মৃ’ত্যু বরণ করছে।তার জন্য দু ফোটা অশ্রুও কেও ফেলবে না।বরং পাড়া পড়শিও সবটা জেনে তার পাপের শা’স্তি হয়েছে বলে নাক শিটকাবে।এভাবে সবার ঘৃণার পাত্র হয়ে দুনিয়ার বুকে করুণ সমাধি হবে তার।যে সন্তানের মোহে এমন কাজ করলো সে সন্তানের মুখটা দেখার ভাগ্যও তার হবে না।ভাগ্য নিদারুন খেলা খেললো তার সাথে।পাপের শাস্তিতে পৃথিবীর বুকে গুটি কতক অভিশাপ নিয়ে কীট পতঙ্গের কা’মড় সয়ে পঁচতে হবে তাকে।প্রতারণার শাস্তি পরকালে আল্লাহ কতটা ভ’য়ংকর করে দিবেন তা সে জানে না।তবে মন বলছে মাজলুমের দীর্ঘশ্বাসে ভয়ানক পরিণতি হবে তার।দুর্বিষহ হবে পরকাল।ভাবতেই হাড় হীম হয়ে এলো।নিজেকে ধিক্কার জানাল সে।হায় সন্তানসুখ! হায় আফসোস! এই সংকীর্ণ জীবনে যেখানে বেঁচে থাকা অনিশ্চিত সেখানে সন্তানের মোহে এমন প্রতারণা সে কি করে করলো?পানিতে দাপাদাপি করতে করতে আল্লাহর নাম জপতে থাকে জুবায়ের।চিৎকার করে জেরিনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।কনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে।তার চিৎকার পানি ভেদ করে বাতাসে আসে না।তবে চমৎকার এক মিরাকেল ঘটে তার সাথে।বাতাস ভেদ করে পানির তলায় এসে কে যেনো আকড়ে ধরে তার হাত।উদ্ধারকর্তার মতো তাকে টেনে তোলে উপরে।এতক্ষনে সে ঢোকে ঢোকে পানি খেয়েছে।শ্বাস নিতে ক’ষ্ট হয়েছে।দুনিয়ার বাতাসে এসে শ্বাস সচল হওয়ার সাথে সাথে দেহের ভার ছেড়ে দেয় সে।দু চোখ মেলে দুনিয়ার আলোয় তাকে বাঁচানো সুদর্শন লোকটার মুখ দেখার আগেই মূর্ছা যায়।হারিয়ে যায় ক্ষন কালীন অন্ধকারে।
__________
জীবনের আঁধারে কিঞ্চিৎ আলোর সন্ধান নিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ফেরে কনা।নিজের জীবনের ঘোর অন্ধকার তার চোখে মুখে ছেয়ে আছে।সেই অন্ধকার ফুঁড়ে বাড়ি ঢুকে বাবার পদতলে গিয়ে আশ্রয় নেয় সে।বুকের মাঝে তার দাউদাউ আগুন।সে আগুনে জ্বলেপুড়ে সে খাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“আমারে বিয়ে দেওয়ার সময় তুমি ওদের সম্পর্কে কতটুকু খোঁজ নিছিলা আব্বু?জুবায়ের সম্পর্কে কতটুকু জানছিলা তুমি?তুমি না বিয়ার আগে এক সন্ধ্যা ওদের বাড়ি খাইয়া আসলা?তার বাড়িতে কি অন্য কাওকে চোখে পড়ে নাই তোমার?”

হুট করে কনার এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যান মোকছেদ মিয়া।মেয়ের মনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের খবর ওনার অজানা।মেয়ের সন্তান সম্ভবা হওয়ার সংবাদ ওনাকে এতটাই পুলকিত করে রেখেছে যে চমকিত ভাব মুহুর্তেই বিলীন হয়ে যায়।হয়তো কন্যার কথার ধরনটা তিনি ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেননি।এজন্যই এ মুহুর্তে মেয়ের এমন প্রশ্নে রসিকতা করতে পারেন তিনি। সহাস্য বদনে জিজ্ঞেস করেন,

“কেনো রে মা?শ্বশুর বাড়ির কথা খুব মনে পড়তাছে বুঝি?”

কনা জবাব দেয় না এ কথার।পাশে থেকে কনার দাদী জরিনা বানু মুখ টিপে হেসে বলেন,

“যাওয়ার দিন ঘনাইয়া আইতাছে। মনে তো পড়বেই।তবে ও বাড়িতে গেলে তোর খুব একটা কষ্ট হইবো না রে ছেড়ি।পোয়াতি মানুষ শ্বশুর বাড়ি যাইতেছিস।বেশ আদরেই থাকবি তুই।তোদের সন্তানও আদরেই বড় হইবো।”

মায়ের ইশারা পূর্বক কথায় মা ছেলে মিলে মুখ টিপে হাসে।এদের এই হাসিতে মুখটা ম্লান হয় কনার।সে বাবাকে বোঝাতে পারে না তার মনের ঝড়।দাদীকেও কিছু বলতে পারেনা বাবার উপস্থিতির জন্য।ক্লান্ত চোখে তাকায় কেবল।স্থবির কণ্ঠে বলে,

“হুম,আমার সন্তান আদরেই বড় হবে দাদী।মায়ের ছায়ায় ও আদরেই বেড়ে উঠবে।”

“ধুরু বোকা! এ কেমন উপমা দিলি?সন্তানেরা মায়ের বুকে বেড়ে ওঠে। আর বাবার ছায়ায়।বল মায়ের বুকে ও আদরে বেড়ে উঠবে।”

কনার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেন জরিনা।কনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কেনো দাদী? মায়েরা ছায়া দিতে পারে না?”

আনন্দঘন এ মুহুর্তে আগ্রহী হয়েই যুক্তি দেখান মোকছেদ,

“পারে তবে ব্যতিক্রমী সংসারে।সাধারণ সংসার গুলোতে মায়েরা হয় সংসার নামক গাছের শিকড়।শিকড় যত মজবুত, গাছও তত শক্তিশালী। এই শিকড়ে ঠাঁই পায় সন্তানরা।আর বাবারা হয় কান্ড, ডাল-পালা, পাতার মিশ্রণ।তারাই ডালপালা ছড়িয়ে সন্তানদের ছায়া দেয়।সন্তানের মাকেও দেয়।মায়ের নিজেরই ছায়ার প্রয়োজন।তারা সন্তানকে ছায়া দিবে কি করে বল?”

“আমার সংসার বোধহয় ব্যতিক্রমীই হতে চলেছে।আমি আমার সন্তানকে ছায়া দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই মায়েদের পিঠে যত চড়া রোদই পরুক মায়েরাও উপর হয়ে ছায়া দিতে পারে।”

কনার এমন কথা শুনে চকিতে তাকায় মোকছেদ ও জরিনা।হুট করে পিলে চমকে ওঠে দুজনের।হুট করে কনা এটা বললো কেনো?কিছু কি হয়েছে কনার?জুবায়েরকেও তখন কেমন খাপছাড়া লাগছিলো।তিনি বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

“তুই হটাৎ এটা বলছিস কেনো?কি হয়েছে কনা?”

বাবার দিকে চেয়ে বিষয়টা লুকাতে চায় কনা।প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,

“কিছু হয়নি।আমি শুধু জানতে চাইলাম তুমি জুবায়ের সম্পর্কে কতটুকু জানতে?মেয়ে বিয়ে দেওয়ার আগে কতটুকু খোঁজ নিলে এই আরকি!”

মেয়ের কথার মাঝে লুকানোর গন্ধ পেলেন বৃদ্ধ।তিনি বুঝতে পারলেন কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে।সেটা কি হতে পারে তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলেন।আমতা আমতা করতে থাকলেন মোকছেদ।তার এমন আচরনে সন্দেহ প্রবল হয় কনার।হাত পা অবশ হয়ে আসতে শুরু করে এতে।সে সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকিয়েছিলে আব্বু?তুমি জুবায়ের এর ব্যাপারে সবটা জানতে তাই না?”

মোকছেদ নির্বাক।কি জানার কথা জিজ্ঞেস করছে তার মেয়ে?মনের মাঝের সংশয়ের দেওয়ালে আ’ঘা’ত পড়ে যেনো।দুরুদুরু কাঁপে বুক।
___________
এশার ওয়াক্তের বেশ খানিক পরে সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো।জেরিন জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছে।নামায আগেই শেষ হয়েছে।দরজায় আওয়াজ শুনেও উঠে খিড়কি খোলার কোনো ব্যস্ততা তার মাঝে দেখা গেলো না।এ সংসারের সব দায় দ্বায়িত্ব থেকে আজই বিরাম নিয়েছে সে।যে সংসারে আর থাকবে না সে সংসারের জন্য এতটুকু শ্রমও সে দিবে না।এ সংসারে শরীরের ঘাম প্রচুর ঝরিয়েছে।আর নয়।মনোয়ারা ও জিনাত হয়তো বুঝেই গিয়েছে ব্যপারটা।এজন্য জেরিনকে আজ আর দরজা খোলার আদেশ দেয় না।বরং নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে।কিছুটা অবাকই হয়েছে দুজন।এই অসময়ে আবার কে এলো?জুবায়ের তো গেলো শ্বশুর বাড়ি।বিষম ভাবনা নিয়ে দরজা খুলতেই আঁতকে ওঠেন মনোয়ারা।আহাজারি করে ওঠেন,

“ও বাপ কি হইছে তোর?তুই এমনে আসলি কেন?কনা কি জেদের বসে তোরে লোক ঠিক করে মা’রাইছে?”

অসময়ে কে এলো এটা নিয়ে জেরিনকে তেমন চিন্তিত দেখা না গেলেও মনোয়ারার এমন কথায় একটু আগ্রহ জাগলো তার।জায়নামাজ তুলে গুছিয়ে রাখলো সে।ঘরের দরজা ভেদ করে উঁকি দিতেই চোখে ভেসে উঠলো বিধ্বস্ত জুবায়েরকে।একটি অপরিচিত যুবকের কাঁধে ভর দিয়ে বেহাল দশায় সে দাঁড়িয়ে আছে।ঘটনা কি সঠিক জানতেই সেদিকে নজর রাখলো সে।মনোয়ারা না বুঝেই হায় হুতোশ শুরু করে দিলো।জিনাতও সঙ্গ দিলো ওনার।একজন অপরিচিত মানুষের সামনে এমন করায় বিরক্ত হলো জুবায়ের।সে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

“আহ মা! ও আমাকে মা’রবে কেনো?এসব এলোমেলো কথা বলা বন্ধ করো তো!”

ছেলের স্পষ্ট বিরক্তিতে আহাজারি বন্ধ করেন তিনি।জিনাত বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“তাহলে তোমার কি হইছে ভাইয়া?ও জনাব কি হইছে আমার ভাইয়ের?”

শেষ প্রশ্নটা অপরিচিতের উদ্দেশ্যে করলো সে।লোকটি এতক্ষণ অবাক হয়ে এদের কাণ্ড দেখছিলো।এদের কথা বার্তা সন্দিহান করে তুলেছে তাকে।বৃদ্ধার ভাষ্যমতে সে বুঝতে পারে কোথাও কোনো গণ্ডগোল আছে।পেশাগত কারণেই বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ জাগে তার।আগ্রহ দমিয়ে জিনাতের কথার জবাব দেয় সে,

“এক্সিডেন্ট করে খালে পড়ে গিয়েছিলো।পানিতে পড়ায় কোথাও মেজর কোনো চোট লাগেনি আলহামদুলিল্লাহ।পানিতে পড়ার আগে গাছের সাথে আঘাত লেগে হাঁটুতে একটু ফ্র্যাকচার হয়েছে এই যা।আল্লাহ তায়ালা চাইলে সেটাও সেড়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।আপনারা প্যানিক হবেন না।ওনাকে একটু বসার ব্যবস্থা করুন।”

জুবায়ের এর চোখ মুখ শুকনো।সে জানে তার পা সাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীন।সারা জীবন হয়তো পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে অন্যের করুনায় বাঁচতে হবে তাকে।জীবন হবে দূর্বিষহ।তবে জানে বেঁচে ফিরেছে যে এটা নিয়েই এ মুহুর্তেই সে অধিক সন্তুষ্ট।সে কীভাবে এক্সিডেন্ট করেছিলো তা একমাত্র সেই জানে।তার মা ও বোনের তা অজানা।তারা জানলে তার প্রাণে বাঁচার জন্যই কেবল শুকরিয়া আদায় করতো।কিন্তু তারা তা জানে না।এজন্য ভদ্রলোকের এমন কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাদের।তারা হায় হায় করতে থাকে।এ কি হলো তাদের সাথে?হাঁটু ভেঙে গিয়েছে?আজ একটা সুসংবাদ শোনার সাথে সাথেই তাদের জীবনে এ কেমন বিপর্যয় নেমে এলো?আল্লাহ তায়ালা এটা কি করলেন তাদের সাথে?এসব বলেই বিলাপ করছিলো দুজন।ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে শান্ত চোখে দৃশ্যটা দেখলো জেরিন।বাতাসে ভেসে গেলো তার ধিক্কারের স্বর,

“আল্লাহর বিচার!”

দু শব্দের বাক্য শুনে চট করে তাকায় ভদ্রলোক।দরজার ভেতর থেকে মাথা বের করে এগিয়ে আসা জেরিনকে দেখে বিষ্ময়,ধরে রাখতে পারে না লোকটা।তাকে দেখে জেরিনও চমৎকৃত হয়।তার বর্তমান পরিস্থিতিতে এ লোককে যে এভাবে পেয়ে যাবে তা কি কখনো সে ভেবেছিলো?

চলবে