শিরোনাম পর্ব-১০

0
141

#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_১০
#মুসফিরাত_জান্নাত

ঠকঠক শব্দ হচ্ছে দরজায়।শাশুড়ির কণ্ঠ বেয়ে কাকুতিমিনতি ঝরে পরছে।বার বার ক্ষমা চাইছেন তিনি।বেঁচে যাওয়ার শেষ পন্থা হিসেবে এ মুহুর্তে কনার পা ধরতেও দ্বিধা করবে না মনোয়ারা।বদ্ধ ঘরে তার প্রচুর ভয়।বন্দী জীবন তার জন্য নয়।এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে পানের পিক ফেলে গাল গল্প না করলে পেটের ভাত তার হজম হয় না।সেখানে কারাগারের বন্ধ কুঠুরিতে থাকবেন কি করে তিনি?জিনাতেরও অবস্থা ভালো নয়।শরীর আধ একটু খারাপ বোধ করে ইদানীং। এ মাসের তারিখ মিস গিয়েছে।শুভ কিছু তার জীবনে অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়েছে।ঠিক এ মুহুর্তে জেলের ভাত খাওয়াটা কত ভয়ংকর তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার।এ মুহুর্তে তাই সেও দমে গেলো।পরাজয় স্বীকার করে কনার সাথে আপোষ করতে চাইলো।কনা দরজা খোলেনি। শুরুতে তো খুলতে ইচ্ছে করেইনি।কিন্তু পরে বুঝলো দরজা খুলতে সে সমর্থ নয়।তার শরীরটা এ মুহুর্তে আর দিচ্ছে না।কণ্ঠ ভেদ করে কোনো স্বরও বের হচ্ছে না।চোটটা কি একটু বেশিই লেগেছে? নিস্তেজ চোখে চারিদিকে তাকায় সে।ঘরজুড়ে ছায়া ছায়া অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে।মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে।এ সময়ে হুইসেল বাজিয়ে এক জিপ গাড়ি এলো।পরক্ষণেই সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
ক্ষীণ হয়ে কানে বাজলো তা।তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না কনা।ঠাই পড়ে রইলো বিছানায়।চোখ দু’টোও বুঁজে এলো পালাক্রমে।

বাইরে পুলিশের আগমন হয়েছে। সদর দুয়ার আটকে রেখেছিলো মনোয়ারা।ফলে ভিতরে এখনো প্রবেশ করতে পারেনি তারা।তবে যে হারে হাকডাক করছে দরজা না খুলে উপায়ন্তরও নেই।হয়তো দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে।এমন পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝতে পারলেন না তিনি।কুলকুল করে ঘামতে লাগলেন।ঘাম ছুটলো জিনাত ও মুরাদেরও।কাঁপতে লাগলো থরথর করে।এদিকে কনার চুপচাপ থাকা ও ওদিকে পুলিশ। সব মিলিয়ে দারুন বিপাকে পড়ে গেলেন তারা।মুরাদ পরিস্থিতি বুঝে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

“অবস্থা তো বেগতিক। বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে।পুলিশ টের পাওয়ার আগেই পিছনের গেইট দিয়ে পালাই চলো।”

মুরাদের কথায় সায় দেয় জিনাত।এছাড়া আর উপায় নেই।কিন্তু আমতা আমতা কেরেন মনোয়ারা।বলেন,

“কিন্তু ঘরের মধ্যে বউ রেখে পালানো কি ঠিক হবে?অতগুলো বেডা মানুষ বেডি মানুষ আসছে।”

একটা মানুষের সব দিক খারাপ হতে পারে না।বৃদ্ধা মনোয়ারা ঠিক কি ইঙ্গিত করছেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।জিনাত নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে বাগড়া দিয়ে বলে,

“ওসব নিয়ে ভাবতে গেলে পুলিশের হাতে সমর্পন করা লাগবে।তুমি কি এই বুড়া বয়সে জেলে যাইতে চাও?”

মনোয়ারা তাও আমতা আমতা করেন।মুরাদ বুঝায়,

“মা, যেই মেয়ে পুলিশকে কল দিতে পারে। আপনাদের সাথে এমনে প্রতিবাদ করতে পারে।সে সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারবে।আপনি চলুন তো।”

মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় জিনাত,

“হ ঠিক।”

মনোয়ারা তবুও বার বার ঘরের দিকে তাকায়।পুলিশ এসেছে।ডাকাডাকি করছে।কনার এখনও দরজা বন্ধ করে রাখার কথা নয়।ভিতরে ঠেলে পাঠানোর সময় পেটে চোট পেয়েছিলো মেয়েটা।দূর্ঘটনাক্রমে খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো?মন কু গেয়ে ওঠে ওনার।তিনি পালাতে চান না।কনার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়ে তবেই নিজেকে বাঁচাতে চান।হাজার হলেও ওই মেয়ের পেটে এই বংশের বাতি জ্বলজ্বল করছে।যে বংশধরের জন্য এতোটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো সেই বংশধরের জননীকে অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে তিনি পালাতে পারেন না।নাকচ করে দেন মুরাদের প্রস্তাবনায়।গম্ভীর হয়ে বলেন,

“আমাকে জেলে নেয় নেবে।আল্লাহ যা ভাগ্যে লিখেছেন তাই হবে।কিন্তু আমার বেটার সন্তানের সঠিক খোঁজ না জেনে আমি এক পাও নড়বো না।মনের ভিতরে এমন খচখচ করে কেন?ও মা কনা…”

আচমকা গলা ভিজে ওঠে বৃদ্ধার।জীবনে বহুত অন্যায় করেছেন তিনি।কিন্তু পুরোপুরি অমানবিক কখনো হতে পারেননি।জেরিনকে বিদায় করলেও ক্ষনে ক্ষনে মেয়েটার কথা মনে পড়ছে ওনার এই বাড়ির আনাচে কানাচে জেরিনের স্মৃতি।কনা কোনো কাজ করে না।সব কাজ ওনাকে করতে হয়।বেখেয়ালে কতবার যে সাহায্য পেতে জেরিনকে ডেকে বসেছেন তারও ইয়ত্তা নেই।উপরে যতই কঠোর থাকুন ভেতরে ভেতরে মেয়েটার স্মৃতি খুবলে খাচ্ছে ওনাকে।প্রায় এক মাসেই শরীর ভেঙে পড়েছে ওনার।চোয়াল ঝুলে এসেছে। এ মুহুর্তে এসে সেটার প্রায়শ্চিত্ত করতেই না কেন কে জানে?তিনি কনার দরজায় গিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিলেন।হু হু করে কেঁদে উঠলেন হুট করে।একদিকে মায়ের মায়া কান্না ও অন্যদিকে পুলিশের তোল পাড়ে বিপাকে পড়লো জিনাত।এ মুহুর্তে ঠিক কি করবে বুঝে আসছে না মুরাদেরও।ঠিক যখন কাঠের ভেঙে দরজা খোলা খোলা ভাব তখন নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে পিছন গেইট দিয়ে এক লাফে পালিয়ে গেলো মুরাদ।এদের জন্য অহেতুক ঝামেলায় সে পড়তে চায় না।জিনাত স্বার্থপরের মতো মা’কে রেখে যেতে নিলেও ততক্ষণে পুলিশ এসে খপ করে ওকে ধরে ফেললো।

ঘরের দরজা ভাঙার পর এক ভয়ানক দৃশ্য দেখতে পেলো পুলিশ সদস্যরা।বিষয়টা নজরে এলো মনোয়ারা ও জিনাতেরও।ওমনি পিলে চমকে উঠলো দুজনের।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কনা।বিছানা লাল তরলে ভিজে জবজবে।র’ক্তের বন্যা বইছে যেনো।মনোয়ারার ভাবনাই সত্যি হলো।অশুভ ঘটনাটা হয়তো ঘটেই গেলো।সবকিছু নিমিষেই তছনছ হয়ে গেলো।কনার জেদের নিকট পরাজয় বরণ করে বেশ তো ছিলেন তিনি।জুবায়ের না হয় কটা বছর জেল খাটতো।তারপর তো মুক্তি ঠিকই মিলতো।তাদের একমাত্র আশা ছিলো বংশধর পাওয়া।তাদের বংশের বাতি এভাবে জ্বলে ওঠার আগেই ধপ করে নিভে যাবে তা কি কেও কখনো ভেবেছিলো?

মাঝেমধ্যে ছোট ঘটনাই বিশালাকৃতির রুপ ধারণ করে।মাঝেমধ্যে না বুঝেই আমরা বিরাট ভুল করে ফেলি।যার পরিণাম কেবল অনুতাপ আর আমগ্লানিকে মার্জনা হয় না।কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয় পরিণামে। কঠিন শাস্তি।ইহকাল ও পরকালে যার প্রায়শ্চিত্ত সহজে ফুরায় না।জিনাতের উপর এ মুহুর্তে চরম ঘৃণা জাগলো মনোয়ারার।নিজের মেয়ের উপর অভিশাপ দিলেন তিনি।আক্রোশে গর্জে উঠে বললেন,

“আজ তোর জন্য আমার সুখের সংসারে ধ্বস নামলো।তোর জন্যই আমাদের বংশের বাতি নিভে গেলো।তোর উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক মা*।”

মায়ের মুখে এমন বিশ্রী ভাষা শুনে চমকে ওঠে জিনাত,

“মা..!”

“চুপ কর হারামি।তোর মুখে আমাকে মা ডাকবি না।আল্লাহ গো।এ কি সর্বনাশ করলা।একজনের ঘর ভাঙছিলাম বইলা আমার সংসারটাই ভাইঙা দিলা?আমার বংশের বাতি…!”

ক্রোধিত হয়ে জিনাতকে হুশিয়ারী দিয়ে নিজে নিজেই বিলাপ করলেন তিনি।কথায় আছে না?অধর্মের বাতি ধপ করে জ্বলে ধপ করে নিভে? ওদের দশাও তাই হলো।জিনাতের প্ররোচনায় পরে জুবায়েরকে বিয়ে করিয়ে একের পর এক দুঃসংবাদ ভীর জমালো।তাদের কপালে আর কোনো আশার আলো থাকলো না।কিচ্ছুটি পাওয়ার থাকলো না।চারিদিক থেকে ঘোর অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো।অন্যায়ের শাস্তি সৃষ্টি কর্তা এতো দ্রুতই তাদের দিলেন?অন্যায় করে কিছুদিনের সুখও কি তাদের ভাগ্যে জুটলো না?ভীষণ আফসোস করলেন মনোয়ারা।উচ্চস্বরে আক্ষেপ করে বাড়ি মাথায় তুললেন।তার ছেলে তার সন্তান ও সন্তানের জননীকে দেখে রাখার দায় ভার ওনাকে দিয়েছিলপন।তা তিনি রাখতে পারলেন না।বরং নিজ হাতে জুবায়ের এর সন্তানকে খুন করলেন।একদম নিজ হাতে।যা অর্জনের জনয় অন্যায়ের সাথেও এককালে আপোষ করেছিলেন।অথচ আজ!এ কেমন ভাগ্যের লেখন ওনার?

মনোয়ারার বিলাপে বিরক্ত হয়ে ওসি সাহেব ধমক দিলেন,

“আহ! চুপ করুন তো।”

জিনাত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।ওসি সাহেব কাওকে নির্দেশ দিলেন,

“এই এদের থানায় নিয়ে যাও।আমি মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করছি।”

শেষ বাক্যটা ওনার পিছনে দাঁড়ানো এক মহিলা পুলিশকে বললেন।তারপর কনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
_________
জীবনের গতি বদলে গেলে সবকিছু কেমন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে।নিজের বিজয়ের পরও থমকে যায় চারিপাশ।খুব কষ্টে অর্জিত বিজয়ও তখন সুখের হয় না।সুখের হয় না নিজের জয়জয়কারের গান।তখন কেবলই এক বুক দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে থাকে বুকে।যা বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করে বুকের মালিককে অত্যাচার করে।সর্বদা দাপিয়ে বেড়িয়ে জানান দেয় তার দুঃখের কথা।তার অস্তিত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণের কথা। জেরিন কোনোক্রমেই স্বাভাবিক হতে পারছে না।পারছে না
জুবায়েরকে ভুলতে।জুবায়ের এর তার সাথে করা অন্যায়কে ভুলতে।মাঝের এই সময়টায় তাও একটা উত্তেজনার মধ্যে দিন কেটেছে তার।জুবায়ের এর সর্বোচ্চ শাস্তি আদায়ের লক্ষ্যে চেষ্টা তদবির করেছে।এ নিয়ে মন সারাক্ষন ব্যস্ত ছিলো।কিন্তু আজ শাস্তির রায় ঘোষিত হওয়ার পর নিজেকে সকল বাঁধন থেকে ছিন্ন মনে হলো তার।নিজের জীবনকে গতি বিহীন নিশ্চল সাগর মনে হতে লাগলো।যার উপর বাঁচার বা ম’রার কোনোরুপ ইচ্ছে ছাড়াই ভেসে বেড়াচ্ছে সে।কোথাও কোনো কিনারা নেই, কোনো নৌকা নেই,কোনো মাঝি নেই।আছে কেবলই শূণ্যতা আর ধু ধু শূণ্যতা।

কোর্ট থেকে এসে সেই যে নিশ্চুপ হয়েছে জেরিন তার আর বিরাম নেই।বিধ্বস্ত চোখে মুখে এতটুকু জয়ের আনন্দ চিহ্ন নেই।মেয়ের এই বেহাল দশা দেখে বুকের মাঝে মোচর দিয়ে ওঠে হেলেনার।তিনিও যে সমান তালে কষ্ট পাচ্ছেন তা স্পষ্ট।তিনি উদগ্রীব হয়ে ওঠেন মেয়ের কষ্ট দূর করতে।ভেবে অকুলান হন কি করলে মেয়ে তার স্বাভাবিক হবে।এভাবে থাকলে যে মেয়ের জীবনটা অন্ধকারে পতিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।ওনার জীবনেও এক সময় এমন ঘোর অন্ধকার এসেছিলো।স্বামীর থেকে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা যে কতোটা কষ্টকর তা তিনি জানেন।হয়তো মেয়ের মতো প্রতারণার শিকার হননি।কিন্তু স্বামীর মৃ’ত্যুতে এমন মরুভূমির ন্যায় জীবন তো পেয়েছিলেন।কথায় কথায় ছেলের বউকে ব্যাপারটা বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি।কমলের বউয়ের বয়স কম।এখনও কোনো সন্তানাদি হয়নি।বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ীর সব কথা মেনে চলে সে।বিয়ের বয়স কম হওয়ায় শাশুড়ির সব কথায় হ্যা হু করেই কাটায়।তবে এবার তার ব্যতিক্রম হলো।ননাসের অবস্থা দেখে হয়তো মন পুড়ছে কিঞ্চিৎ।এজন্য সে না বলে পারলো না,

“না মা।আপনি আপুর মতো জীবন পাননি।আপনি প্রতারিত হননি।তারচেয়ে বড় কথা আপনার বেঁচে থাকার আশ্রয় ছিলো।আপনার বুকে আপনার দুই সন্তান ছিলো।কিন্তু আপুর জীবনে তা নেই।আপু আপনার চেয়েও অধিক নিঃসঙ্গ বোধ করছে।বেশি বিষন্নতায় ডুবে গিয়েছে।”

ছেলের বউয়ের কথায় দ্বিমত করলেন না হেলেনা।কথায় যুক্তি খুঁজে পেলেন।এতে মেয়ের জন্য কষ্টটা আরও তীব্রতর হলো।বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি,

“হ ঠিক বলছো।কি করলে যে আমার মেয়ের দুঃখ ঘুচবে কে জানে!ওর এই কষ্ট কি কোনোদিন ফুরাবে না বলো?বন্ধ্যা, ডিভোর্সী মেয়েকে স্বার্থ ছাড়া ভালোবেসে কে বিয়ে করবে বলো?কে ওর জীবন গোছাবে?”

রাতের খাবার গোছাতে গোছাতে শাশুড়ির সাথে আলাপ করছিলো তুলি।শাশুড়ীর কথায় চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো সে।কাঠ হয়ে বললো,

“আম্মা! আপনি মা হয়ে এমন হতাশাজনক আচরণ করলে আপুর কি হবে ভেবেছেন?তাছাড়া এসব কথা এমনি লোকে বলে বলেছেন টিটকারি দিচ্ছে। আপনি বললে তারা লাই পেয়ে যাবে না?”

হেলেনা মাথা নত করে।চিন্তায় চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে ওনার।বোধ বুদ্ধিও কমে এসেছে মেয়ের কষ্ট দেখে। মেয়ের কাছে শক্ত থেকে সাহস যোগালেও আড়ালে আড়ালে কত যে ভেঙে পরেছেন তিনি তা বলার ইয়ত্তা রাখে না।তিনি অসহায় হয়ে বললেন,

“আমি কিছু ভাবতে পারছি না তুলি।কিছু ভাবতে পারছি না।এতোটা অসহায় লাগছে কেনো বলতে পারো?স্বামী হারিয়েও তো এমন দিশেহারা হইনি।মেয়ের দুঃখে কেনো এমন হলাম?কি করলে আমার মেয়ে আমার মানিকের দুঃখ ঘুচবে বলতে পারো মা?দুদিন পর তোমরা ওকে বেশি নজরে দেখবে না বলো?তখন ওর কি হবে?”

আচমকা কণ্ঠ ধরে এলো ওনার।চোখে পানি জমলো।আজকাল শাশুড়ী ননদ ছেলের বউদের কাছে চোখের বিষ।তাদের সময়ে হাজার অন্যায় অত্যাচার সয়েও ঘর সংসার করেছে মেয়েরা।শেষ বয়সে শাশুড়ীকেও দেখেছে।কিন্তু আজকাল যুগ বদলেছে।বিয়ের পরপরই স্বামী নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থাকে বউদের।সেখানে তুলি কয়দিন তাকে দেখবে তা নিয়েই সন্দিহান তিনি।সেখানে জেরিনকে নিয়ে আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন।নিজে একা মানুষ যা না তাই খেয়ে পড়ে থাকতেন।কয়দিনই বা বাঁচতেন তিনি?কিন্তু মেয়ের তো সামনে বিশাল পথ।এত পথ একা কিভাবে পাড়ি দিবে জেরিন?

তুলি বুঝতে পারে শাশুড়ীর মনোভাব।টেবিলের উপর পানি ভর্তি জগ রেখে শাশুড়ীর কাছে এসে বসে।ওনার হাত ধরে বলে,

“আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা।আমরা মেয়েরা মায়ের জাত,অন্তরে মায়া ধারণ কারী জাত।অকারণে শাশুড়ী ছেলের বউয়ের দা কুমড়োর সম্পর্ক হয় না।আপনারা যথেষ্ট ভালো মানুষ।আপনারা এমন ভালো থাকলে আমি কখনো আপনাদের বেশি নজরে দেখবো না।আপুকেও কষ্ট দিবো না।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

হেলেনা খানিকটা ভরসা পেলেন এতে।তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন।দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব শুনে শক্ত হয়ে গেলো জেরিন।মস্তিষ্কে অন্য চিন্তা খেললো তার।এতক্ষণ বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলো না সে।কোনো কর্ম খুঁজে পাচ্ছিলো না বাঁচার তাগিদে।আচমকাই তা বদলে গেলো।নিজের জীবন গোছানোর ঢাল নিজে হওয়ার মনোবাসনা জন্মালো।সে বুঝে গেলো এভাবে বাঁচলে কুকুর বেড়ালের মতো দয়া দক্ষিনা পেয়ে বাঁচতে হবে।যা হতে দেওয়া যাবে না।মানুষ হয়ে জন্মে আত্মসম্মান বলিদান করে অন্যের পায়ে ভর করে সে বাঁচবে না।সে কর্ম খুঁজে নেবে।বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে নেবে।অবশ্য সবচেয়ে বড় কারণ এমনিই রয়ে গেছে।নিজের জন্য বেঁচে থাকা।জেরিন ঢাল ধরলো এটার।নিজের জন্য বাঁচবে সে।স্রেফ নিজের জন্য।বহুদিন তো অন্যের জন্য বাঁচলো।অন্যের জন্য কাজ করে গেলো এবার না হয় নিজের জন্যই বাঁচুক।নিজের জন্যই কর্ম খুঁজুক।নিজের দায়ভার এবার না হয় সে নিজেই নিক।

চলবে