#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
ফারহানা আক্তার রুপকথা
১.
“মেয়ে তার মায়ের বিয়ে দিয়েছে!আলতা তো মহান কাজ করে ফেলেছে। এমন মেয়ে ক’জনের হয়?”
মায়ের বিয়ে দেওয়া সমাজের চোখে খুব বড় প্রশংসনীয় আর বাহবা’র কাজ। কিন্তু কিশোরী প্রায় বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকতেও মায়ের বিয়ে সমাজের চোখে কি পরিমাণ জঘন্য আর সমালোচনাতূল্য তা অজানা ছিলো আলতার। সে তো মায়ের বিয়ের রাতেই পাড়ি জমিয়েছিলো ঢাকার পথে৷ কিন্তু তারপরের দিন থেকে সমাজের মানুষগুলোর ছি ছি আর ধিক্কার তা যে তার মাকেই সইতে হচ্ছে। নকশির আর জহিরের বিয়েটা যতখানি চুপচাপে হয়েছিলো ততোটা নিশ্চুপ ছিলো না তার পরের সময়গুলো এখনো নেই। তাদের আড়ালে আবডালে পাড়া প্রতিবেশীরাই পরের দিন মুখরোচক গল্প বানিয়ে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিলো। তাতেই আর শেষ হয়নি ঘটনা বরং দু দিনের মাথায় নকশি যখন স্কুলে গেল তখনি কানে এলো অনেকের ছি ছি।
“মাইয়া বিয়া দেওয়ার বয়সে নিজেই বিয়া বইছে। মনের ভিত্রে রস, রঙ্গ আছে বইলাই মাইয়ারে শহরে পাডাইছে পড়ার নাম কইরা। আহারে আতলাডার কপাল মন্দ!”
আবার কেউ কেউ তো বলে বসলো, “জহিরের লগে আগে থাইকাই কিছু আছিলো৷ তা না হইলে পোলাডা এত বছর বিয়া করলো না ক্যান। এই নকশিই কিছু করছে।”
এমনই কিছু সংলাপ মুখস্ত বাক্যের মত অনেকেই আওড়ায় নকশির সামনে। বুকের ভেতর তীব্র ঘৃণা জমে গেল নিজের প্রতি দু দিনেই। জহিরকে দেখলেই কেমন গা জ্বলে যায় তার। বারবার মনে হয় সব দোষ জহিরের। কে বলেছিলো তাকে এতগুলো বছর ধরে এভাবে তার পেছনে পড়ে থাকতে! আলতা তো জহিরের কথা জানতে পেরেই উতলা হয়েছে নিজের মাকে সংসারী করার জন্য। নইলে আগে তো সে এমন কোন ভাবনাই ভাবতে পারেনি৷ নাকি আওলাদের সাথে দেখা হওয়াটাই কাল হলো! তার কলিজার টুকরোটা তার বিয়ের পেছনে এমনি এমনিই পড়েনি। যে মেয়ে তাকে ছেড়ে এক রাত কাটাতে পারে না সে মেয়ে আজ মাস পেরিয়ে গেছে শহরে পড়ে আছে একা। হোস্টেলে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের সাথে কিভাবে থাকছে! যে মেয়ে কখনো ভাতটা বেড়ে খায়নি, নিজের কাপড় ধুয়ে দেখেনি সেই মেয়ে এখন কি করে নিজের ঘর গুছিয়ে, কাপড় ধুয়ে পড়াশোনা করছে! আবার নাকি মেয়েটা হোস্টেল থেকে অনেকটা দূরে কোচিংও করতে যায় সপ্তাহে তিনটা দিন। কালই তো শিশির জানালো আলতা নাকি একটা টিউশনি পেয়েছে। ছোট্ট আলতা নিজেই নাকি শিক্ষকতা শুরু করেছে। শিশিরই খুঁজে দিয়েছে টিউশনিটা। মাস শেষে চার হাজার টাকা ছোট্ট একটা বাচ্চার হাতেখড়ির জন্য৷ সপ্তাহে চারটা দিন একটা ঘন্টা করে পড়িয়ে আসে সে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটোয় জল ছাপিয়ে গাল ভিজে গেলো। জহিরের সাথে বিয়েটা সে এখনো মানতে পারেনি অথচ চল্লিশ পেরোনো জহির একটা মাসের বেশি সময় হলো ধৈর্য্য ধরে আছে নকশির মনের পরিবর্তন হবে এই আশায়। একটা পুরুষ কতদিন অপেক্ষায় কাটাবে? নারীদেহের স্বাদ নিতে একটা পুরুষ কি পরিমান কামুক হয় তাতো নকশির অজানা নয়। বুকের ভেতর চাপা আর্তনাদ নিয়ে নকশি ডায়াল করলো আলতার নাম্বারটা। মেয়ে দূরে থাকবে বলে আওলাদই অনেকগুলো টাকা দিয়ে শিশিরকে বলেছে একটা ফোন কিনে দিতে। শিশিরও আওলাদকে সাথে নিয়েই ফোন কিনে সব সেটিংস বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলো আলতাকে। নকশিরও একটা দামী ফোন হয়েছে জহিরের বদৌলতে। জহির তার পুরনো ফোন নষ্ট হওয়ায় নতুন ফোনটা কিনেছিলো নিজের জন্য। হঠাৎই তার মনে হলো নকশির একটা দামী ফোন হলে সে নিশ্চয়ই আলতাকে ভিডিও কল করবে নকশির আগের ফোনটা তো বিয়ের দিনই ভেঙে ফেলেছিলো । বড় আনন্দে সে ফোনটা নকশিকে দিয়েছে৷ নকশি প্রথমে নিতে চায়নি তখন জহির বলল, “এখন তোমার আর আমার বলতে তো আলাদা কিছু নাই। যা আমার তাই তোমার। ফোনটা তোমার কাছে থাকুক।”
ভর দুপুর ; মাথার ওপর রোদের তীব্রতা মস্তিষ্ক গলিয়ে দেওয়ার মত৷ স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে বলেছিলো অনেকেই নকশি ছাড়েনি। বিয়ে করায় তার দ্বায়িত্ব যতোই জহির নিতে চায় নেক কিন্তু সে একদম হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। তার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকেই ভাবতে হবে। আওলাদ হয়ত তার মেয়ের জন্য কম করবে না তাতে কি নকশি নিজের দ্বায়িত্ব ভুলে যাবে! আরো কয়েকবার মেয়েকে ফোন করেও লাভ হলো না। কি করছে মেয়েটা এখন কে জানে! ঘামে ভেজা মুখ, গলা শাড়ির আঁচলে মুছে ফোন রেখে ক্লাসে ঢুকলো নকশি৷ নবম শ্রেণিতে এখন তার ক্লাস আছে। চিন্তাময় মনটা নিয়েই আপাতত নিজ কাজে ব্যস্ত হলো।
ডিপার্টমেন্ট হেড আজ শিশিরকে ডেকে কিছু কাজ দিয়েছেন। বলা চলে একদমই ব্যক্তিগত কাজ আর তাই কাজগুলো তাকে করতে হবে বিকেলে টিউশনিতে যাবার আগে। এখন দুপুর প্রায় মরে এসেছে। রোদের আলো কম থাকলেও তেজ মোটেই কম নয়। ডিপার্টমেন্ট হেড ইউসুফ স্যার মধ্যবয়স্ক লোক। বিয়ের পিড়িতে অনেকটা দেরিতে বসেছিলেন বলেই সন্তানাদিও বিলম্বের লিস্টে। তার দুটি ছেলে মেয়ে তারমধ্যে প্রথম সন্তানের বয়স চার আর দ্বিতীয় সন্তানটি গত মাসেই জন্ম নিয়েছে। আর আজ শিশিরের কাজ স্যারের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বউ বাচ্চাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে আসা। চাইলেই আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমেই কাজটা করানো যেত। স্যারের নিজেরই ছোট ভাই, ভাইয়ের বউ আর মা-বাবাও আছেন৷ কিন্তু পারিবারিক কোন ঝামেলার কারণে নিজেও শ্বশুরবাড়ি যান না আর না বাড়ির কাউকে যেতে দেন৷ শিশির তার ডিপার্টমেন্টে বরাবরই প্রশংসনীয় আর সব প্রয়োজনে শিক্ষক ছাত্র প্রায় সবারই বিশ্বাসযোগ্য। সেকারণেই স্যার তাকে ডেকে খুবই স্বাভাবিক ভাবে বললেন কাজটা করতে। শিশিরও ঠিকানা নিয়ে রওনা দিলো মিরপুরের দিকে। শিশির যখন তার গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে যাচ্ছে তখনই তার ফোনটা বাজলো। স্ক্রীণে ভেসে ওঠা আলতার নাম।
– হ্যাঁ বল
-আমি একটু মার্কেটে যেতে চাচ্ছিলাম।
– আজ আমি একটু ব্যস্ত কাল নিয়ে যাব।
শিশির ঝটপট বলল কথাটা৷ আলতা ভয়ে ভয়ে বলল, “তোমার আসতে হবে না আমি রুমমেট শৈলি আপার সাথে যাচ্ছি।”
আলতার কথা শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠলো শিশির, “যাচ্ছি মানে কি হ্যা! সব প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে কি ঢং করতে ফোন দিয়েছিস? এ্যাই তোর কলি’জা কতখানি বড় হয়েছে ঢাকায় এসে!”
শিশিরের এমন গর্জন করা আওয়াজ শুনে ট্যাক্সির ড্রাইভার একবার আয়নায় দেখলো তাকে। ওপাশে আলতাও ভয়ে চুপসে গেছে। ঢাকায় এসেছে মাস পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন সে একাই কলেজে যায়, কয়েক দিন ধরে টিউশনিতেও তবুও এমন আচরণ করার কি আছে! মার্কেটে কি সে একা যাচ্ছে! কিন্তু এই কথাটাই আর মুখ ফুটে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলা যায় না। সে আবারও ধীর স্বরে বলল, “আমার খুব দরকার যাওয়াটা।”
“কি দরকারে যাবি বল আমি দরকার পূরণ করবো বল শিগ্রই।”
এবারও ঝাড়ি মেরে কথা। আলতার ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু কি করে বলবে তার দরকারটা কি। ওসব কথা কি ছেলেদের বলা যায়! বাড়ি ছেড়ে জীবনে কোথাও গিয়ে সে দশ বারো দিন কাটায়নি অন্তত মাসের সেসব দিনগুলোতে তো নয়ই। আর ঢাকায় আসার সময়ও মনের অবস্থা ঠিক ছিলো না কি গোছাতে কি গুছিয়েছে নিজেই জানে না। দরকারি জিনিস বলতে খাতাপত্র আর পোশাকটাই জরুরিভাবে গুছিয়েছিলো সে। আর ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো তো সব শিশির ভাই নিজেই জোগাড় করেছে কিছু অনলাইনে কিছু শরত ভাইয়ের মাধ্যমে। ফোনের ওপাশে অধৈর্য্য গলায় ধমকে ওঠে কল কাটলো শিশির। আলতা তার বিছানায় বসে মন খারাপ করে আছে। শৈলী আপু তার মুখ দেখেই বুঝলেন মেয়েটা অনুমতি পায়নি বাইরে যাওয়ার। বিগত দিনগুলোতে তিনি খেয়াল করেছেন আয়শা যাই করে সবটা তার মামাতো ভাই শিশিরকে জানিয়ে আর অনুমতি না মিললে তার সাধ্য নেই কিছু করার। আলতাকে হোস্টেল, কলেজ সবাই আয়শা আহমেদ নামেই চেনে। শৈলী আর যাওয়ার কথা বলল না আলতাকে বরং তার থেকে টাকা নিয়ে গেল নিজেই এনে দেবে সব।
সন্ধ্যার আকাশে আঁধার কতটুকু তা বোঝার উপায় নেই রাস্তাঘাটে জ্বলে ওঠা কৃত্রিম আলোয়। ইউসুফ স্যারের শ্বশুর বাড়ি থেকে মাত্রই বের হয়েছে শিশির স্যারের বউ বাচ্চা নিয়ে। আধঘন্টার মত বসেছিলো সে অথচ কেউ এক গ্লাস পানিও সাধেনি। শিশিরের মনে হলো এদের মধ্যে আন্তরিকতা নেই আর এ কারণেই বোধহয় স্যারের সাথে এদের দ্বন্দ্ব! কিন্তু তার এসব ভাবনার বিষয় নয় তার ভাবনা হলো আজ দুটো টিউশনি মিস হয়ে গেছে। তার ওপর আলতার জন্যও খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই খুব জরুরি কিছুর জন্যই বের হতে চাচ্ছিলো সে!
সন্ধ্যের বাজার আজ খুব গরম। শরত, আহসানুল্লাহ দুজনের দোকানেই ক্রেতার ভীড়। হাঁটের দিনগুলোতে এমনই হয়। আজও দম ফেলার উপায় নেই এরই মাঝে শরতের ফোনটা বেজে চলছে অনবরত। কয়েকবার ফোন রেখেই কাস্টমারে মনযোগ দিলেও বারবার কল আসায় নতুন কর্মচারীটিকে সামলাতে বলে ফোন রিসিভ করলো। স্বভাবসুলভ ভাবেই শরত প্রথমে সালাম দিলো। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি বুঝি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। নিজের মতোই বলে গেল, “কি অবস্থা শরত? আমি অনু বলছি।”
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২.
“চিনতে পারেননি আমায়! আমি শিশিরের ফ্রেন্ড অনু ওই যে সিগারেট হাতে যে মেয়েকে দেখে আপনি কপাল কুঁচকেছিলে।”
সপ্রতিভ কণ্ঠে কত চমৎকারভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে দিলো অনু। শরত তার কথা শুনে যেন অবাক হতেও ভুলে গেছে। একটা মেয়ে তার পরিচয় দিচ্ছে সে ধূমপান করে এটা বলে! শরত তাকে চিনতে পেরেছে কিন্তু এ মুহূর্তে বিষ্ময় আর প্রশ্নই বেশি চলছে মাথায় তার। দোকানে কাস্টমারের আসা যাওয়া লেগেই আছে। কিন্তু এই মুহুর্তে অনু তাকে কেন ফোন করেছে তা জানাটা জরুরি। হতে পারে শিশিরের কারণেই!
“হ্যাঁ চিনতে পেরেছি আপনাকে।”
“এত জিরিয়ে কথা বলো কেন আর আমাকে তুমি করে বলবে। কি ভাবছো ফোন নম্বর কোথায় পেলাম আর কল কেন দিয়েছি! নম্বরটা শিশিরের ফোন থেকে চুরি করেছি আর কল করেছি কথা বলতে।” এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলেই হি হি করে হেসে যাচ্ছে অনু। আপাতত এই হাসি শরতের বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছে। তাই আর কোন জবাব না দিয়ে কল কেটে দিলো শরত। মেয়েটা দেখতেই কেমন পাগল পাগল আচরণে এখন তা আরো স্পষ্ট।
“তুই গড় গড় করে সবটা বলে দিলি কেন৷ শিশির যদি জানতে পারে খুব রাগ করবে আমার ওপর।”
অনুর বাহুতে থাপ্পড় মেরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে সোহা। অনুর কথামতো সে-ই শিশিরের ফোন থেকে নাম্বারটা টুকে নিয়েছিলো। অনু তো বলেছে সে শুধু কল দিবে কিন্তু কিছুই বলবে না কিন্তু এই মেয়ে তো কি সুন্দর গটগট করে সব বলে দিলো। এখন নিশ্চয়ই শরত ভাইয়া শিশিরকে বলে দিবে। শিশির ময়নাতদন্তে নেমে যখন জানবে সোহা নাম্বার দিয়েছে তাও কিনা এমন লুকিয়ে তখন নিশ্চয়ই রাগ করবে। আর যাই হোক শিশিরের রাগ তার সহ্য হবে না। সে কষ্ট পাবে তেমন কিছু হলে। অনু তার ভাবনাগ্রস্ত চুল টেনে বলল, “চিল বেব ইটস অল মাই ফল্ট নট ইউর’স।”
সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা এক টান দিয়ে আবারও বিজ্ঞের মত অনু বলল, “শরত দেখতে একদম কুল আর হ্যান্ডসাম বয়। কেন জানি তাকে দেখে মাম্মা’স বয় টাইপ ফিলিংসের সাথে না একটা রোমান্টিক ভাইবও আসে। মানে এই ছেলে বউ আর মায়ের জন্য সব করতে পারবে টাইপ। শিশির আবার যথেষ্ট এগ্রেসিভ তাই না!”
সোহা চুপচাপ শুনছে আর চিন্তায় অস্থির হচ্ছে। শরত ভাইয়া যদি এখন শিশিরকে ফোন দিয়ে বলে দেয় কথাটা তবে নিশ্চয়ই শিশির কল দিয়েই আগে তাকে ঝারবে।
“এই অনু আমার ভয় লাগছে খুব। শিশির খুব রেগে যাবে রে। সে তো বলেছিলো তার ভাইয়া খুবই শান্ত, সরল মানুষ ফাজলামো একদম পছন্দ করেন না।”
“শিশিরের চামচা চুপ থাক তুই আমাকে আমার কাজ করতে দে।”
কথাটা বলেই অনু সোহার হাত থেকে তার ফোনটা কেড়ে নিলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে একটা বার্তা লিখলো, “এত রুড আচরণ করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হলো।”
শরতের নম্বরে মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়েই অনু কুটিল হেসে বলল, “কল এলে রিসিভ করবি।”
সোহা হা করে দেখলো সবটা। এই মেয়ে কি পাগল হলো! শরতের বড় ভাইকে এমন জ্বালাতে থাকলে নিশ্চিত শিশিরের ক্রোধের মুখে পড়তে হবে সেই সাথে লজ্জাতেও।
শিশির দাঁড়িয়ে আছে আলতার হোস্টেলের গেইটের সামনে। ঠিক নয়টায় গেইট বন্ধ হয়ে গেছে। এই হোস্টেলে প্রায় সব মেয়েই স্টুডেন্ট। এখানে চাকুরিজীবী কোন সদস্য নেই বলেই নিয়মটা এমন। নয়টার পর কেউ কিছুতেই বের হতে পারবে না আর না ঢুকতে পারবে। তাই আলতা এসে গেইটের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিশিরের ফোন পেয়ে।
“বল এবার কি জন্য বাইরে যেতে চাচ্ছিলি?”
গম্ভীরতা এখনও বজায় রেখে কথা বলছে শিশির। আলতার সাথে শৈলীও এসেছে তা শিশির খেয়াল করেনি। সে আবারও কিছু বলতে চাইলে শৈলী বলল, ” ও কি তোমাকে সব দরকার জানিয়ে পূরণ করবে নাকি! একটা মেয়ের কত কি প্রয়োজন হতে পারে সব কি তোমার অপেক্ষায় ফেলে রাখবে, আশ্চর্য!”
শৈলীর কথায় শিশির এবার খেয়াল করলো আলতার পাশের শুকনো, ফর্সা এক মেয়েকে। শিশিরের গলার স্বর নরম হলো এবার। শৈলী আপু জগন্নাথের ছাত্রী শিশিরের চেয়েও সিনিয়র। তারা আগে থেকেই পরিচিত এবং শিশিরের এক বন্ধুর বড় বোন সে আর সব খোঁজ নিয়েই আলতাকে এখানে রেখেছে সে। নরম কণ্ঠে এবার নিজেই বলল, “না আপু তেমন কিছু না। কিন্তু ওর তো মোটামুটি প্রয়োজনীয় সব আগেই কিনে এনেছিলাম ফুপুআম্মার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী।”
“তাহলে তার কাছে স্যানিটারির জিনিসপত্র নেই কেন শিশির? সে একটা মেয়ে তার মান্থলি সমস্যা থাকতে পারে এটা কেন তোমার ফুপু ভুলে গেছেন? আর তুমিও ফুপুর ভাতিজা সবসময় ওকে ঝাড়ির ওপর রাখো।”
শৈলীর বেশ বিরক্ত লাগছে। আলতা যেদিন থেকে এখানে থাকছে সেদিন থেকেই দেখছে আলতা এক পা-ও নিজের মত এদিক ওদিক চলে না। তার এসব ভালো লাগে না। প্রয়োজন অনেকরকম হয় সবসময়ই কি সে শিশিরকে ডেকে এনে তারপর পূরণ করবে! হ্যাঁ মেয়েটা ছোট আর আগে ঢাকায়ও ছিলো না কখনও সে হিসেবে সতর্ক থাকা ভালো কিন্তু এত রেস্ট্রিকশন নিয়ে কি থাকা যায়! শিশির বুঝতে পারলো সমস্যাটা কোথায় কিন্তু শৈলী আপুর সামনে কিছু বলতে আনইজি লাগছে তার। শৈলীও বোধহয় খেয়াল করলো শিশিরের সংকোচ তাই কাউকে কল করার বাহানায় গেইট থেকে সরে বাগানের দিকে গেল। শৈলী যেতেই শিশির বলল, “আমি আধঘন্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা করছি কল দিলে আবারও একটু গেইটে আসবি।”
আলতার খুব লজ্জা লাগছে শিশির ভাইয়ের দিকে তাকাতে। সে জীবনেও এসব সমস্যা কোন ছেলের সামনে বলেনি কিংবা শোনেনি। বড় মামী সবসময় বলতো এসব মেয়েলি ব্যাপার লুকিয়ে রাখতে হয়। পুরুষরা শুনলে লজ্জা তাইতো সে বিকেলে শিশির ভাইকে তার প্রয়োজনটা বলতে পারেনি। কিন্তু এখন শিশির ভাই নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসবেন। অনেকটা দ্বিধা আর লজ্জাভারে মাথা নুইয়ে সে জবাব দিলো, “শৈলী আপা সব এনে দিয়েছে।”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন শিশির। কারণ সে নিজে এখন এসব আনতে গেলে বিপদে পড়তো। কি লাগবে, কি কিনবে, কিভাবে কিনবে কিছুই তো জানে না তবুও আলতার প্রয়োজন বলেই হয়ত বলে ফেলেছে নিয়ে আসবে এখনই। তার মেজাজটা এখন একটু খারাপই আছে বলা যায় বিকেল থেকেই। তার নোভা নামের এক কলেজ ছাত্রী তাকে কাল থেকে খুব ডিস্টার্ব করছে। মেয়েটা ভালোবাসার কিছুই বোঝে না শুধু পাগল হয়ে পড়ে আছে তার পেছনে। সে খুব শিগ্রই এই টিউশনি হারাবে ভেবে আজ নিজেই মেয়েটার মাকে ফোন দিয়ে বলেছে সে আর পড়াবে। ওখানে গিয়ে মেয়ের আচরণে যদি তার সম্মানে আঘাত লাগে! তারচেয়ে বরং নিজেই ঝুঁকি এড়িয়ে চলা ভালো। কিন্তু এতো মহা বিপদ হলো মেয়ের মা নিজেই মেয়েকে সামলানোর বদলে বলল, “আমার মেয়ে দেখতে এতোটাও খারাপ নয়। কিছুদিন না হয় তার সাথে মিলিয়েই পড়াও সামনেই তো বোর্ড পরীক্ষা।”
শিশির ঝামেলা নিতে চায় না কাঁধে। মাসান্তে তার চার হাজার টাকা কমে যাবে তবুও মেয়েলি বিপদ কাঁধে নিয়ে চলা মুশকিল। আলতার মুখটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বলল, ” খেয়েছিস?”
“হু”
“পড়াশোনা ঠিকঠাক করছিস তো!”
“হুম”
“রেগে আছিস?”
শিশির কথাটা বলতেই চকিতে তাকালো আলতা। শিশির ভাই জানতে চাচ্ছে সে রেগে আছে কিনা! এ জীবনে এমন কথা এই প্রথম বলল শিশির ভাই। শিশিরও বোধহয় আলতার সেই চাহনির অর্থ বুঝলো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “ভেতরে যা আমি চলে যাচ্ছি। কিছু লাগলে আমাকে সরাসরি ফোন করে বলে দিবি আর যদি কল না তুলি মেসেঞ্জারে লিখে দিবি।”
আলতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে শিশির ইশারা করলো আলতাকে চলে যেতে। আলতাও চলে গেল শৈলীর কাছে তা দেখে শিশিরও ফিরে গেল।
সারারাত ছটফট করে কাটলো সোহার৷ অনু তাকে এ কেমন বিপদে ফেলল! এখন শিশির যদি কোনরকমে জেনে যায় ঘটনা নিশ্চয়ই তাকে খারাপ ভাববে। অনুর জন্য সে শিশিরকে মিথ্যে বলে তার ফোন থেকে শরতের নাম্বার নিয়েছে। তারই বোঝা উচিত ছিলো অনুর কমনসেন্স নেই। কখন কি করে তার ঠিক নেই একদমই। নাহ, ভয় হচ্ছে খুব এতক্ষণে নিশ্চয়ই শরত ভাইয়া শিশিরকে বলে দিয়েছে তার বান্ধবী ফোন করেছে। আর অনু কি চমৎকার নিজের দোষ ঢেকে তার নাম বলে দিলো। সোহা সবে রাতের খাবার খেতে বসেছিলো অমনি তার ফোনে অনুর কল।
“কি সমস্যা শান্তিতে খেতেও দিবি না!” মেকি রাগ দেখিয়ে বলল সোহা।
“দোস্ত, শরত কল দিছে। বলতেছে তুমি, আপনি এমন সম্মোধন করছো কেন আমি তোমার ফ্রেন্ডের বড় ভাই। কল করে আমার সাথে মজা করাটা খুব বেশিই অভদ্রতা হয়ে গেল না! ব্যাটারে যত ইনোসেন্ট মনে করছি ততোটা নারে। আমি বলে দিছি তোমারে ভাল্লাগছে খুব তাই খুশিতে ভুলে গেছি তুমি বলবো না আপনি।”
সোহা অবাক হলো অনু কথা শুনে। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল! কত অগোছালোভাবে কথা বলছে সে। লোকটা কি জাদু জানে নাকি! অনুর মত মেয়েটাও ওই গ্রাম্য হ্যান্ডসাম ছেলের জন্য অস্থির হয়ে গেল! ওপাশ থেকে অনু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আরো অনেক কিছুই বলল সোহা শুনলো না। সে ভাবছে শিশিরকে কাল সব বলে দেবে। সে চায় না শিশির তাকে কোনভাবেই ভুল বুঝুক।
নকশি রাতের খাওয়া শেষ হতেই পান বানিয়ে শোবার ঘরে গেল। জহির আজ সন্ধ্যায় পান-সুপুরি এনে নকশিকে দিলো। বলল, ” আমি এখন থেকে রোজ রাতে একটা করে পান খাবো ভাবছি।”
নকশি তার মুকের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর জিনিস।”
কথাটাতে রাগ কিংবা শাষণ ছিল কিনা বোঝা গেল না। তবে জহিরের মন বলল একটু ধমকে দিক নকশি তাকে। জোর করে বলুক, এসব ছাইপাঁশ খাওয়া চলবে না। কিন্তু না নকশি তেমন মানুষ নয়। জহিরকে সে ধমক দেয় না, শাষণ করে না আবার ভালোবেসে নরম সুরে কোন আবদারও করে না। বিয়ের আগেই নকশি তাকে বলেছিলো, “আমাকে বিয়ে করলে আপনি ঠকে যাবেন। বিশ্বাস করেন, আমার মনটাতে এখন কোন পুরুষ মানুষকে নিয়ে চাওয়া বা আকাঙ্ক্ষা নেই। যা আছে সবটাই আমার মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা।”
সবটা জেনেই জহির সামনে এগিয়েছে। তবুও কেন জানি একন একটু আপন চাওয়া তীব্র হয়ে উঠছে আর তা সে নকশিকেও বোঝাচ্ছে একটু একটু। নকশি পান সাজিয়ে হাতে দিতেই জহির ঠোঁট টেনে হাসলো। জিজ্ঞেস করলো আজ আলতার সাথে কথা হয়েছে কিনা৷ মেয়েটা কেমন আছে তার কিছু লাগবে কিনা! নকশি খুশি হলো জহিরের এইটুকু কথাতেই। আজ আলতা তার ফোন তোলেনি একবারও কথা বলেনি তা নিয়ে মন খারাপ ছিলো। কিন্তু এখন এই যে জহির তার মেয়ের খোঁজ জানতে চাইলো এতেই বুঝি আপাত মন খারাপের রেশ কেটে গেল। মনের কষ্টগুলো একপাশে রেখে এখন রাতটা পার করা যাবে।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই শিশির আগে গোসলে গেল। আজ সারাদিন সে হাতে সময় পাবে না আর তাই আগেভাগেই গোসলটা করা। ক্লাস আছে আজ দুটো এরপরই সে কাল মিস হয়ে যাওয়া টিউশনির একটা করবে। আজকের শিডিউলে যে টিউশনিগুলো আছে সেগুলোও করবে। এতে করে তার দিনের পুরোটা সময় কভার থাকবে এগুলোতেই। গোসল আর হবে না আজ। গোসল শেষে মাকে ফোন করে নাশতার জন্য হলের ডাইনিংয়ে গেল৷ অনেকেই নাশতা শুরু করেছে সেও বসলো। ফোনটা পকেটে রাখতে নিলো অমনি সেটা বেজে উঠলো। সোহা কল করেছে দেখে রিসিভ করলো না। ক্যাম্পাসে গিয়েই কথা বলা যাবে তাদের সাথে। কিন্তু না মেয়েটা কল ধরছে না দেখেও অনবরত কল করেই যাচ্ছে৷ বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে বলল, “কি হলো সোহা আমি নাশতা করে কল ব্যাক করতাম তো ”
“নাশতা আমি করাবো ক্যাম্পাসে আসো কথা আছে।”
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
৩.
কপালের মধ্যিখানে ক্রোধের চিহ্ন রেখা হয়ে স্পষ্ট শিশিরের। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সিগারেট ফুঁকছে অনু আর লজ্জায়, খারাপ লাগায় মুখ নুইয়ে আছে সোহা। তার কারণ একটু আগে শরতের আসা ফোনকল। সোহার ফোন পেয়ে নাশতা না করেই ক্যাম্পাসে এসেছে শিশির। তার কিছুক্ষণ পর এসেছে অনু আর সোহা। দুজনে আসতে আসতে ভেবে নিয়েছে শিশিরকে কি আর কিভাবে বলবে। কিন্তু দেখা হওয়ার দু মিনিটের মাথায় ভেজাল করলো অনু। সোহা মাত্রই গত কালকের ঘটনা নিয়ে বলতে শুরু করেছিলো তখনি অনু সোহার ফোন টেনে নিয়ে শরতকে টেক্সট করলো, ” গুড মর্ণিং শরৎচন্দ্র।”
সোহা বলছিলো, “শিশির কাল একটা ফাজলামো করা হয়ে গেছে। মানে অনু করেছে কাজটা জানি ঠিক হয়নি আমরা স্যরি করবো।”
শিশির বোকার মত তাকাচ্ছিলো সোহার দিকে অমনি সোহার ফোন বাজলো। শরত কল দিয়েছে তা দেখে অনু মুচকি হেসে কল রিসিভ করে লাউড স্পিকার অন করে দিলো। সে স্বভাবতই সালাম না দিয়ে বলল, “টেক্সটেই জবাব দেওয়া যেত ভাই শরৎচন্দ্র এত কিসের তাড়া!”
অনুর বেয়াদবি এ পর্যায়ে শরত আর নিতে পারলো না। সে শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বলল, “শিক্ষাটাকে শুধু সার্টিফিকেট পর্যন্ত না রেখে আচরণেও ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন ভবিষ্যতে কাজে আসবে।”
কণ্ঠ শুনে ভাইকে চিনতে এক সেকেন্ড এর বেশি সময় লাগেনি শিশিরের। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিলো তার। শরতের কল কাটার পর কিছু সময় স্তব্ধ ছিলো তারপরই সে অনুর হাতের ফোনটা খেয়াল করে। সোহা আরো বেশি ভয় এবং লজ্জায় নুইয়ে যায়। তবে তার কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না অনু নিজেই গড়গড় করে সবটা বলে দেয়। শিশিরের ফোন থেকে সোহাই শরতের নম্বরটা নিয়েছিলো। অনু তো নিজেই শরতকে কল দিয়েছে আবার অভদ্রের মত তুমি আপনি করে মিশ্র সম্মোধনে নিজের মত কত কথা বলে দিলো। সব শুনে রাগে শিশিরের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছিলো। বান্ধবী দুজনকে কিছু বলার মতও খুঁজে না পেয়ে সে বসা থেকে উঠে গেল। অনু অবশ্য কয়েকবার শিশিরকে ডাকলো সে জবাব দেয়নি। শিশির যেতেই সোহাও উঠে চলে গেল আর অনু আগের জায়গায় বসেই সোহাকেও ডাকলো। সেও জবাব না দিয়ে চলে গেল। বিরক্তিতে এবার অনু এবার স্বগোতক্তির মত বলে উঠলো, “ভালোবাসা কি এমন অন্যায়! এত ড্রামা কোন দিনের জন্য বুঝি না।”
“শরতের বিয়েটা এবার যে করেই হোক দিতে হবে।” পান মুখে পুরে জয়তুন শিফাকে শুনিয়ে বলল কথাটা। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ অথচ নকশি এখনো এলো না। জহির তো বলে গেছে ভাবী আজ বিকেলে নকশি আসবে বলছে এ বাড়ি।
জহিরের কথা শুনেই শিফা বিকেল থেকে অপেক্ষা করে আছে। বিয়ের পর সে এ বাড়ি এসেছে কয়েকবার কিন্তু একবারও রাতে থাকা হয়নি তার। কিন্তু আজ শিফার সাথে সাথে জয়তুনও অপেক্ষায় নকশির। ভেবে রেখেছে জোর করে তাকে দু রাত থাকতে বলবে। নকশি যে তাদের জীবনে কতোটা আপন তা শুধু তারাই জানে আর জানে নকশি নিজেও। কিন্তু সময়ের বাঁক সবসময় নিজের ইচ্ছেমত হয় না। শরতও সেদিন বলছিলো, “ফুপুআম্মাকে বলো এসে এখানে থাকতে কয়েকদিন সাথে জহির কাকাকেও। ফুপুআম্মা তার বাবার বাড়ি কখনোই যাবে না আর আমরা থাকতে তার আদর, আপ্যায়নও বাদ যাবে সেটা আমার ভাল্লাগে না।”
শরত হয়ত গুছিয়ে বলতে পারেনি কথাটা কিন্তু জয়তুন বুঝেছিলো শরত কি বলতে চাইছিলো। এক যুগেরও বেশি সময় নকশি এ বাড়ির আঙিনায় কাটিয়েছে। এখন বিয়ে করে জহিরের বাড়ি আছে তার এতদিনের চেনা বাড়িঘর ছেড়ে হুট করে সেখানে থাকতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে৷ তার মেয়েটা কাছে নেই বিয়েটাও তো একদম স্বাভাবিক নয় তার জন্য তাই কিছুটা সময় তার এখনো প্রয়োজন নিশ্চয়ই নিজেকে মানিয়ে নিতে! তাই জয়তুন আর শিফা দুজনেই চাইছে নকশি এসে এখানে থাকুক দিন কয়েক। জহিরকে সে কথা আহসানের মাধ্যমে জানানোও হয়েছিলো। তাই আজ নকশির আসার কথা অথচ এখনো এলে না বলে চিন্তা হচ্ছে তাদের দু জা’য়ের। জয়তুন এবার বললেন, “শিশিরে মা একটা ফোন কইরা দ্যাখ নকশিরে। এহনও আইলো না ক্যা!”
শিফাও তাই করলো। নকশিকে ফোন দিতেই নকশি তুলল। শিফা এখনো না আসার কারণ জানতে চাইলে বলল জহির নাকি বাজারে গেছে। সে না আসা অব্দি নকশিকে যেতে বারণ করেছে কিন্তু জহির বিকেলে বেরিয়েছে অথচ এখনো ফেরেনি। সে ফিরলেই চলে আসবে। শিফা ফোন রাখলো তারপর আবারও দু জা মিলে অনেক অনেক আলাপ করলো। তাদের সকল আলাপ ঘুরেফিরে শরতের বিয়ে আর তাদের বাড়ির বর্তমান নিস্তব্ধতা নিয়েই ছিলো। শিশির শহরে পড়তে গেল মানে গেল। এরপর ছেলে যদি ভালো রেজাল্ট করে নিশ্চয়ই শহরেই বড় চাকরিবাকরি করবো। বিয়াশাদী কইরা সে শহরেই থাকতে চাইবে। আলতা মেয়ে তাকেও একদিন বিয়ে দিয়ে দিবে। এমনিতেও আলতার বাবা -মা মেয়ের দ্বায়িত্ব পালন করবে তারা শুধু মামী হয়ে দোয়া দেবে এইটুকুই। শিউলিও চলে গেছে পরের ঘরে। শরতটার সাথে যা ঘটলো তারপর ছেলেটা আরো বদলে গেছে। বছর পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও কোন পরিবর্তন নেই। দিনভর বাড়িটাতে পাখির কলতান আর রাতের আঁধারে ভুতূড়ে নিস্তব্ধতা। জয়তুন এখন মনে প্রাণে শুধু ছেলের বিয়ে আর সংসার দেখতে চান। বাড়িতে একটা লাল টুকটুকে বউ আসবে, বছর ঘুরতেই একটা ছোট্ট বাচ্চা আর সেই বাচ্চা নিয়েই মেতে থাকবে সে। ভালো লাগে না তার এই নিঃসঙ্গতা। শরতের বাবার মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটো নিয়ে কষ্ট হলেও নিঃসঙ্গতা এতোটাও টের পাননি। অথচ ছেলেমেয়ে বড় হতেই কেমন বুকের ভেতর শূন্যতার হাহাকার। রাতভর চোখের পাতায় ঘুম নামে না একাকীত্বের বেদনায়। মেয়েটার ভরা সুখের ঘর দেখে মনে স্বস্তি আছে কিন্তু এখনও চিন্তা শেষ হয়নি। ছেলেটার জন্য একটা ভালো মেয়ে না আনতে পারলে এ জীবনে আর তার ভালো থাকা হবে না। দু জায়ের সকল আলাপ আলোচনার মাঝেই নকশি এসে দাঁড়ালো বাড়ির উঠোনে। তার পেছনেই মিষ্টির প্যাকেট হাতে জহির। দুজনের মুখেই কেমন আড়ষ্টতা। নকশির অস্বস্তি হচ্ছে এভাবে তার সাথে জহির এসেছে বলে আর জহির লজ্জা পাচ্ছে এ বয়সে এসে মিষ্টি হাতে শ্বশুর বাড়ি আসা নিয়ে। শ্বশুরবাড়িই বটে! নকশির বাবার বাড়ির চেয়েও আপন এ বাড়ির মানুষগুলো তা জহির জানে। তাই সে এ বাড়িকেই নিজের শ্বশুরবাড়ি বলে মনে করে।
টিউশনি শেষ করে শিশির হলে ফিরে আগেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে নেয়। রুমে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না কিছুতেই তাই হল থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকটায় যায়।সেখানে সারি সারি রঞ্জন রশ্মি আর হাসনাহেনার গাছ। এক দিকে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া আর তার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে বেলী ফুলের ঝাড় অনেকটা জায়গা জুড়ে লতার মতন বেয়ে আছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ অথচ চারদিকে কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে ভূলোকে সে আলো ম্লান। বাতাসে ফুলের সুবাস চমৎকার এক এরাবিয়ান আতরের সুবাসের মত লাগছে৷ আলোর উদ্ভাস এতো বেশি না হলে হয়তো আজকের এই চন্দ্রালোয় ঘোর লেগে যেত শিশিরের। মনটা বড় গ্রামের পথঘাটের জন্য অস্থির হয়ে আছে আজকের এই চাঁদটাকে দেখে। গ্রামের অন্ধকার পথ চাঁদের আলোয় ফকফকা, ঝিঁঝির ডাক আর সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। কয় বছর পেরিয়ে গেল সে এমন একটা রাত উপভোগ করতে পারছে না! এ রাতে সে আরো একটা জিনিস মিস করে খুব। কারেন্ট চলে যেতেই আলতার হৈ হল্লা করে বাড়ি মাথায় তোলা। পড়তে হবে না ভেবেই কেমন আনন্দে চেঁচিয়ে পাশের বাড়ির বাচ্চাদের ডেকে এনে ফুলের নাম, মাছের নাম খেলা। ভাবতে ভাবতেই শিশিরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় শিশিরের এসএসসি পরীক্ষার সময়ের কথা। একরাতে কারেন্ট যেতেই আলতা সবাইকে ডেকে এনে খেলা শুরু করে। শিশির তখন নিজের ঘরের দোর টেনে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ায় মন দেয়। কিন্তু একটু পর পরই “আয়রে আমার গোলাপ কখনোবা জবা, কখনো শিউলি” একেকটা ফুলের নাম বলে বলে নিজের দলের সদস্যদের আহবান করছিলো আলতা। মূলত দুই দলের দুজন লিডার। আলতাও তার নিজ দলের লিডার হিসেবেই সদস্যদের ডাকছিলো। পুরো খেলায় সবারই গলার আওয়াজ কমবেশি শোনা গেলেও আলতার আওয়াজ ছিলো সর্বোচ্চ। শিশির পড়ায় মন দিতে পারছিলো না ঠিকঠাক তাই রেগে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চাঁদের আলোয় আবছা দেখলো আলতার মুখখানা আর সাথে সাথেই তার চুলের বেণী টেনে ধরলো। আকস্মিক আক্রমণে সবাই ভড়কায় কিন্তু তবুও শিশির ছাড়ে না তাকে৷ রেগে বলে উঠে, আজ তোর গোলাপ জবা আমি ছুটিয়ে দিব। জানিস না আমার পরীক্ষা আর আম্মা কই আম্মা!”
সে রাতে চুল টেনে কত যে শাস্তি দিয়েছিলো শিশির আলতাকে। আর তারপর আব্বার কাছে তাকেও ধমক খেতে হয়েছে আর সেদিনই তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো আলতার গায়ে স্পর্শ না করার। তখনও তার চোখে আলতা খুব ছোট, দস্যি এক বাচ্চা মেয়ে। দেখতে দেখতে সেই মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। এই মুহুর্তের চমৎকার ওয়েদারে একটাবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ফোন হাতেই সরাসরি কল দিলো শিশির। কয়েক সেকেন্ড পরই কলটা রিসিভ হলো। আলতা সালাম দিতেই শিশির বলল, “পড়তে বসেছিস?”
“না। খেয়ে এসেছি মাত্রই।”
“রুমেই আছিস?”
“হ্যাঁ”
“শরীর ঠিক আছে তোর কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?”
” ঠিক আছি।”
“তাহলে তুই এভাবে কেন কথা বলছিস?”
আলতা বুঝলো না সে কিভাবে কথা বলছে। সেতো একদম স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে এ কথা বলার সাহস হলো না৷ সে বলল, “ওই একটু খারাপ লাগছিলো।”
শিশির কি বুঝলো কে জানে সে বলল, “ভিডিও কল দে তো৷ তোর সাথে আর কে আছে?”
আলতার পাশে এখন যে কেউ নেই তা শিশির আগেই টের পেয়েছে। পাশে কেউ থাকলে একটু না একটু সাউন্ড তার রুমে থাকবে৷ হয় শৈলী আপা নয় আলতার এক ক্লাসমেট দুজনেই শব্দ করতেই থাকে। যেন শিশির কল দিলে তারা ইচ্ছাকৃত কোন শত্রুতা পালন করে৷ তাই এ মুহূর্তের নিস্তব্ধতা প্রমাণ করে আলতা একা। আলতার কলের অপেক্ষা না করে সে নিজেই ভিডিও কল দেয়। আলতাও সময় ব্যয় না করে তুলে নেয় কল। সত্যি বলতে তার খুব ইচ্ছে করছিলো শিশিরকে একবার দেখার। কাল যে তাকে ধমকে গেল সন্ধ্যায় তখন খুব কষ্ট পেয়েছে আলতা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে শিশিরকে দেখলেই আবার কষ্টটা দূর হয়ে যাবে৷ হলোও তাই সারাদিন মন খারাপ ছিলো আর এখন শিশিরের মুখটা দেখতেই সব কষ্ট হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আচ্ছা শিশির কি কোনদিনও জানতে পারবে এ কথা! শিশির আলতার মন খারাপের ঔষধ। কিশোরী মেয়ের মনোরোগ নিরামায়ক হয়ে গেছে এই যুবক। শিশির তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রীণে তার মনযোগ আলতার মুখে। আর আলতার দৃষ্টি কখনো ফোনের পর্দায় কখনোবা রুমের চারপাশে। তার গোলাপি ফর্সা মুখটায় লজ্জার আবরণ আচমকাই স্পষ্ট দেখলো শিশির। চমকে গেল সে পলকেই। আলতা কি লজ্জা পাচ্ছে তার দিকে তাকাতে! ভাবতেই বুঝি বুকের খাঁচায় বসন্তের হাওয়া তিরতিরিয়ে বয়ে গেল। শিশির আর থাকতে চাইলো না কলে। “সাবধানে থাকিস।” বলেই টুপ করে কলটা কেটে দিলো শিশির। আলতাও যেন আটকে রাখা নিঃশ্বাসটাকে এবার ছেড়ে দিলো৷ বুকের ভেতর শীতল শিহরণ অজানা ভালো লাগায়। সত্যিই কি এই ভালোলাগা তার অজানা! নাহ একদমই নয়। শিশির জানে না তবে আলতা জানে এই আলতা শিশিরে ভিজে গেছে অনেক আগেই। ভালোলাগার তরল অনুভূতিতে শিশিরে সিক্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সেই কবেই।
চলবে