ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব- ২৬ (১৮+ সতর্কতা)
মন ভাঙার যন্ত্রণাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা যায়! যায় বোধহয়, ইন্ট্রোভার্ট চরিত্রের মানুষগুলো পারে দুঃখগুলোকে খুব করে চেপে যেতে। শরত পারছে, সে ভেঙে পরেনি। অলির সাথে সরাসরি কথা বলেছে অথচ একটাবারও অনুনয় করেনি। অলি চোখে চোখ রেখে কোন জবাব দিতে পারেনি৷ শুধু মাথা নত করে মিথ্যে কিছু কথা বলেছে। আফসোস নেই শরতের এ নিয়ে। যার সুখ যেখানে মনে হয় সেখানেই যাক৷ তার বলার কিছু নেই। সে কোন উনিশ, বিশ বছরের পাগলা প্রেমিকও নয় যে প্রেমিকার জন্য দুনিয়ায় তোলপাড় করবে৷ সত্যিকার অর্থেই সে ভালোবেসেছিল। সময় লাগবে তবুও নিজেকে ঠিক বুঝিয়ে নেবে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকবে না৷ প্রকৃতির নিয়মে সব চলমান কোথাও কেউ স্থবির হয়ে নেই। সামনে এগিয়ে চলার নামই তো জীবন সেও এগিয়ে যাবে। আলতার অবস্থা স্কুলে যাওয়ার পর যেভাবে খারাপ হলো তাতে সবার মনে ভয় ঢুকে গেছে৷ মেয়েটা কি আর স্বাভাবিক হবে না! নকশি একাই যেতে চেয়েছিলো আজ আলতাকে নিয়ে হাসপাতালে৷ শরত নিজ গরজে বলেছে সেও যাবে। আহসানুল্লাহ শুনে বলল, “এটাই ভালো হবে৷ আওলাদকেও জানানো উচিত ছিল হয়ত কিন্তু তার স্ত্রী নাকি বাড়িতে খুব ঝামেলা করছে এ অবস্থায় না জানানো ঠিক হবে না। শরত চাইছে যাক ভাবী কি বলেন!” জয়তুন সামনেই ছিল সে বলল, ” যাক সমস্যা নাই আমার। হের মনমর্জি ভালা না তাই নিয়া আমার চিন্তা।”
“এজন্যই সে যাক। বাড়ির বাইরে, এলাকার বাইরে গেলেই ভালো হবে তার।” শিফা বলল কথাটা। নকশি বলছিলো লাগবে না কাউকে সাথে। তাদের জন্য বারবার কাজকর্ম ফেলে দৌড়ালে কি করে চলবে! আহসানুল্লাহ বা শরত কেউই শুনলো না। ঠিক ভোরে উঠে রওনা দিল তারা তিনজন৷ অত ভোরে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনের অপেক্ষা করা সময়ের ব্যাপার। আজকেই ডাক্তার দেখিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসবে এমনটা ইচ্ছে নকশি। এতে অবশ্য ধকলটা৷ বেশি হবে তবুও চাকরি ফেলে দু চারদিন করে সময় গেলে তার চলবে না। তাই খুব ভোরেই তারা বাসস্ট্যান্ডে গেল। বেশি সময় বসতে হলো না তাদের । ঠিক ছয়টার বাস পেয়ে গেল তারা। বাস ছাড়ার পনেরো কি মিনিট বিশ বাদেই ফোন দিলো শিশির। সে ফজরের নামাজের পর আর হলে ছিলো না। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নকশিকে ফোন দিয়ে জেনে নিলো তারা রওনা হয়েছে কিনা। শিশির ফোন রাখতেই কল দিলো আওলাদ। সে মেয়ের খবর জানার উদ্দেশ্যেই ফোন করেছিলো কিন্তু যখন জানতে পারলো নকশি ঢাকা যাচ্ছে তখন বোধহয় তার একটু খারাপ লাগলো। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো কষ্টে বুঝি তার গলা ধরা এসেছে৷ দু দিন আগেও খোঁজ নিয়েছিল আওলাদ তখন জানতে চেয়েছিলো আলতাকে নিয়ে ডাক্তার কাছে কবে যাবে! নকশি জবাবে বলেছে ছুটির দিন ছাড়া সম্ভব নয় অথচ আজ বুধবার আজই তারা শহরে যাচ্ছে আলতাকে নিয়ে! বলতে নেই, আওলাদ মেয়ে আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাড়িতে অনেকরকম ব্যবস্থাই করছে। প্রথমত, তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সে সরাসরিই বলেছে সে নকশির খবর পেয়েছে এবং তাদের একটি সন্তানও আছে৷ সে তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে আসবে। কিন্তু সেই মহিলা খেঁকিয়ে উঠেছিলেন এই বলে, “কোনো মা’গীরে আমি বাড়ি উডাইতে দিমু না৷ আর এত্তদিন পরে কোন মাইয়া পয়দা হইছে আমনের? কে জানে কোন ভা** এর লগে হুইয়া ওই মাইয়া পয়দা করছে। আমনের মাইয়া কইলেই হইবো?”
আওলাদ এ কথার পর স্ত্রীকে খুব মে/রেছিলো। আলতা যে তার মেয়ে সে বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই আলতার মুখ দেখলে। শুধু গায়ের রঙটাই তার মাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নকশি সাদা সুন্দর কিন্তু আলতার গায়ের রঙে ফর্সার মধ্যে হালকা একটা গোলাপি আভা ছড়ানো। চোখ দুটো তার কালো না হয়ে হ্যাজাল কিংবা নীলচে হলে হয়তো তাকে মিশরীয় কন্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আলতার নাক, ঠোঁট, চিবুক কিছুই তো বাবার চেয়ে ভিন্ন হয়নি। আওলাদ শ্যাম বর্ণ হলেও তার চেহারায় চমৎকার এক জৌলস আছে চল্লিশের উর্ধ্ব বয়সে এসেও৷ সে কেন তার বন্ধু কাশেম তো আলতাকে দেখেই বলেছিল এই মেয়ে তার তাতে সন্দেহ নেই আর নকশিও মেয়ে হিসেবে সৎ তা আওলাদ বিয়ের পরই বুঝেছে। একদিনই এমন মা’র মে”রেছে আওলাদ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তারপর সে মহিলা ভুল করেও বলেনি কিছু নকশি আর আলতাকে নিয়ে। বাড়িতে নিজের ভাগের দুটো বড়ো বড়ো ঘর আওলাদের। তার একটাতেই দুটো ঘর আর একটা বারান্দা নিয়ে থাকে সে। এক ঘরে দুই ছেলো অন্য ঘরে তারা স্বামী স্ত্রী থাকে। বারান্দার ঘরে খাওয়াদাওয়া চলে। যেদিন থেকে মাথায় ঢুকলো নকশি আর আলতাকে সে বাড়ি ফিরিয়ে নেবে সেদিন থেকেই সে অন্য বড় ঘরটি সাফ-সাফাই করা শুরু করেছে৷ সেখানে দুটো ঘর আর একটি খোলা বারান্দা আছে। আওলাদ ভাবছে খোলা বারান্দাটাকে সে দেয়াল টেনে দরজা, জানালা লাগাবে। সে শুনেছে নকশি পড়াশোনা করে হাইস্কুলে মাস্টারি করে। তার মেয়ে আলতাও বড় ক্লাসে পড়ে মেট্রিক দিবে৷ এই বারান্দাটা ঘর বানিয়ে মেয়ের পড়ার ঘর বানাবে। আওলাদ বিদেশে থেকে টাকা ভালোই আয় করেছিলো। কিন্তু সে টাকার হকদার তো একমাত্র নকশি। নকশির বাবার টাকায় বিদেশ গিয়েছিলো বিনিময়ে নকশির বাবা কি পেয়েছেন, নকশি কি পেয়েছে! বছর দশেক ছিল আওলাদ বিদেশে। এরই মাঝে দু’বার দেশে এসেছিলো তারমধ্যে প্রথম এক বছর থেকেই তার মায়ের জন্য আসতে হয়েছিল৷ নকশি ততদিনে পুরোপুরি নিঁখোজ অপবাদ নিয়ে৷ আওলাদ মায়ের বলা কথা শুনে কান ভারী করে বিয়ে করলো খালাতো বোনকেই। খালা আর মায়ের কুচক্রী অভিযান সম্পন্ন হলো। জন্ম হলো প্রথম ছেলের আওলাদ তখন পুনরায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল। তারপর আবার এলো দেশে তার মায়ের মৃত্যুর আগে। মহিলা মৃত্যুশয্যায় পড়ে সব সত্য প্রকাশ করলো কিন্তু এতে লাভ কি হবে! নকশি তো আওলাদের ধরাছোঁয়ার অনেক দূর হয়ে গিয়েছিল আগেই। আর এখন যখন সে ফিরে পেল নকশিকে সেই সাথে পেল তাদের সন্তানকে তখন বাড়িতে তার আরো দুটো সন্তান আছে। সেই সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তার খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। আলতাকে আর দূরে রাখবে না সে। কিন্তু কাছেও থাকতে পারছে কই! এই যে মেয়েটা আবার অসুস্থ হলো নকশি একটাবার তাকে বলল না। সে তো যেচে নিজের ফোন নম্বরটা মেয়ের কাছে দিয়েছিলো নকশিকে দেখিয়ে৷ আবার নকশির ফোন নম্বরটাও এনেছে। বুক ফাটা আর্তনাদ করতে গিয়েও যেন নিজেকে মিথ্যে বুঝ দিলো আওলাদ। হয়তো তাড়াহুড়ায় নকশি সময় পায়নি তাকে জানানোর।
বাস এসে গন্তব্যে পৌঁছুতেই শরত জোর করলো নকশিকে কিছু খেয়ে নিতে। ভোরে বের হওয়ার সময় কেউ কিছু খায়নি। বাসে বসেই আলতাকে এক পিস কেক আর পানি খাইয়েছিলো জোর করে সেটাও বমি করে উগরে দিয়েছে। তাই শরত বারণ করলো আর কিছু দিতে হবে না। সে কোন এক স্টপেজে নেমে স্যালাইন আর ছোট এক বোতল পানি কিনে তা খাইয়ে দিলো৷ এতে উপকারই হলো আলতার। বাকিটা পথ কাহিল হয়নি আসতে আসতে কিন্তু নকশিকে প্রচণ্ড দূর্বল লাগছে৷ শরত নিজেও কিছু খায়নি কিন্তু সে নকশিকে জোর করে পাউরুটি আর পানি খাওয়ালো। হাসপাতালে পৌছুতে পৌছুতে দুপুর দুটো পেরিয়ে গেছে৷ লাঞ্চ আওয়ার হওয়ায় তাদের অপেক্ষার পালা শুরু হলো। ডাক্তার আছে আছে করেও পাওয়া গেল না কাউকে৷ এরই মাঝে শিশির ফোন করে জিজ্ঞেস করলো তারা পৌছুছে কিনা! শরত বলল তারা পৌছে গেছে। শিশির বলল, “আমার ল্যাব টেস্ট আছে আজ৷ সেটা শেষ হলেই সোজা হাসপাতালে আসছি।”
“তুই সেখানেই মনযোগী হ, আমি আছি তোকে আসতে হবে না।”
শরত বারণ করলো কিন্তু শিশিরের মন বলল, “সেই তো কত ক্রোশ দূরত্ব কমিয়ে এতখানি কাছে এসেছে। চোখের দেখাটা দেখে আসবোনা তাই কি হয়! ভেতরটা যে এমনিতেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে প্রতিটি ক্ষণ!” পরের সময়টুকু শিশিরের ঘোরের মধ্যেই কেটেছে৷ হলে ঢুকে কোনমতে গোসলটা সেরেছে তাতেই বিকেল তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেজে গেল৷ এখান থেকে হাসপাতালে যেতেই দশ মিনিট লেগে যাবে এদিকে ঠিক চারটায় থাকতে বলেছে সোহা। বন্ধুরাও সবাই পৌঁছে যাবে। সে কি একটা টেক্সট করে দিবে সোহাকে দেরি হবে বলে! ভাবলো ঠিকই কিন্তু টেক্সট আর করা হয়নি। ঘোরেই আছে মন তার। দ্রুত হাতে কালো একটা শার্ট আর কালো খুব সিম্পল একটা জিন্স পরে দু হাতে ভেজা চুলগুলো পাট করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো শিশির। ভুলে গেল সোহার জন্মদিন উপলক্ষে কেনা ঘড়িটাও সাথে নেওয়ার কথা। শিশির যখন হাসপাতালে পৌঁছুলো তখন আলতা আর নকশি ডাক্তারের কেবিনে। দু ভাইয়ে দেখা হলো। শরত খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো, “কেমন আছিস রে?”
শিশির কোন জবাব না দিয়ে দু পা আরো এগিয়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। দৃশ্যটা খুব সাধারণ অথচ এর অর্থ দারুণ মূল্যবান। ডাক্তারের কেবিনের সাথে তারা ছাড়াও আরও কিছু মানুষ ছিল। প্রত্যেকেই অবাক কিংবা বিষ্ময় নিয়ে দেখছে দৃশ্যটা কেউ কেউ বোধহয় কারণ ছাড়াই মুগ্ধও হলো৷ শরত অপ্রস্তুত বোধ করলো। সে শিশিরের পিঠ হাকলা চাপড়ে বলল, “কি হয়েছে? সব ঠিক আছে?”
শিশিরের খেয়াল হলো সে কোন পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভাইকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে জড়িয়ে ধরেছে। মায়ের কাছে যেদিন শুনেছিলো ঘটনাটা সেদিন থেকেই ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিলো সে৷ ভাই কতোটা চাপা স্বভাবের তাতো ভালো করেই জানে। ভাই কতোটা সৎ তাও অজানা নয়। অলির ব্যাপারে কখনোই ভাই প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। যা হয়েছে তারই করা সবটা। সে যদি অলিকে সেদিন ভাইয়ের ভালোবাসার কথাটা না বলতো তাহলে হয়ত এই প্রেমের সম্পর্কটা কখনোই গড়ে উঠত না। ভাই সময় হলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবই পাঠাতো। ভাইকে দেখতেই তার বুকটা কেঁপে উঠেছিলো অজানা কষ্টে। শরত আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে শিশির?”
শিশির ভাইকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো৷ শরত খেয়াল করলো শিশিরের গাল, মুখ, চোখ। আজই প্রথম খেয়াল করলো তার ছোট ভাইটা আর ছোট নেই৷ চোখে মুখে স্পষ্ট তারুণ্যের ছাপ৷ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি-গোফ আর শক্ত চোয়ালের তীক্ষ্ণতা চোখে পড়লো৷ কিশোর শিশির কবেই যেন পরিপূর্ণ যুবক হয়ে উঠেছে খেয়ালই করেনি সে।
শিশির ক্ষীণ স্বরে বলল, “মাফ করে দাও ভাই। আমি বুঝতে পারেনি অলি…”
“ওরে তুই এমন বলছিস কেন? এসব বাদ দে সে কি, কেমন তা ভেবে কাজ নেই। আজ না ল্যাব টেস্ট ছিলো?”
শরত আর শিশিরের কথার মাঝে নকশি আর আলতা বেরিয়ে এলো ডাক্তারের কেবিন থেকে। উদগ্রীব হয়ে শরত, শিশির দুজনেই জানতে চাইলো কি বলল ডাক্তার!
নকশি বলল দুটো টেস্ট দিয়েছে আর তার মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য মানসিক ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলেন। একজন ডাক্তারের নামও আর কোন ব্লকে বসেন সব লিখে দিয়েছে এখানে, বলেই নকশি প্রেসক্রিপশনের কাগজটা এগিয়ে দিল। শিশিরই নিয়ে দেখলো কাগজটা৷ কায়সার হামিদ নামটা পড়তেই শিশিরের মনে হলো পরিচিত নাম কিন্তু কে মনে করতে পারলো না। এদিকে সময় হয়েছে ততক্ষণে পৌনে পাঁচটা। শিশিরের ফোন বেজে উঠলো তাদের কথার মাঝেই। সে ফোন সাইলেন্ট করে রাখতে গেলেই শরত বলল, তুলে কথা বলে নে।
শিশিরও রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে অনু গালি দিয়ে বলল, “শা/লা তুমি কোন চান্দের দেশে থাকো! যখনই কোন আয়োজন হয় তখনই লেট করো কোন দুঃখে? তোমার রঙিলা রুপবান কি অন্য ব্যাটার লগে ভা’গছে?”
ফোনের স্পিকার লাউড না থাকলেও ভলিউম ভালোই উঁচু ছিলো৷ শিশিরের পাশেই শরত দাঁড়ানো এবং শরত কিছু শুনলো কিনা ভেবেই খক খক করে শুকনো গলায় কেশে উঠলো শিশির। তার এখানে আসার পর অনেকগুলোই বন্ধু জুটেছে৷ তারমধ্যে দুজন মেয়েও আছে, সোহা আর অনু। সোহা খুব রাগী হলেও মুখের ভাষায় যথেষ্ট শ্লীলতা আছে তার। কিন্তু অনু এ ব্যাপারে ছেলেদেরও হার মানায়। শিশির কি জবাব দেবে তা খুঁজতেই কিছু সময় পার করে দিলো এরই মাঝে অনুর ফোন হাতবদল হয়ে সোহার হাতে গেল। সোহা বলল, “ইচ্ছে করেই আসোনি তাই না!”
“না সোহা আসলে ফুপুআম্মারা এসেছেন হাসপাতালে তাই আমি সেখানে এসেছি।”
“ওহ, তোমার সেই কাজিনকে নিয়ে?” সাবলীল ভাবেই প্রশ্ন করলো সোহা।
“হ্যা। তোমরা সেলিব্রেট করো আমি অন্য আরেকদিন জয়েন করবো।”
“কোন হাসপাতালে আছো?”
শিশির বুঝতে পারলো এই মেয়ে শুনবে না কথা। সে হাসপাতালের নাম বলতেই সোহা কল কেটে দিলো। শিশির খেয়াল করলো না তার কথার বলার পুরোটা সময় একজোড়া চোখ তাকে কত অসহায়ত্বের সাথে দেখছিলো। সে টেরই পেলো না একজনের চোখে অভিমান আর মনের ভেতর সোহা নামটা কি পরিমাণ যে উচ্চারিত হয়েছে বজ্রঘাতের মত। শরত ব্লক নাম্বার চেক করে নকশি বলল আলতার টেস্ট দুটো কোথায় করাতে হবে৷ তারা সেদিকে যাবে বলে শিশিরকে বলল, “তুই চলে যা কোন অনুষ্ঠান বোধহয়!”
” পরে যাবো ভাই। সোহার জন্মদিন উপলক্ষে ট্রিট দিতে চাচ্ছিলো সে। পরে একসময় গিফট করে দেবো কিছু।”
“তার কি দরকার। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে তুই যা। আমাদের আর তেমন কাজ নেই তবে পরের কাজটা তোর। আজকে টেস্ট করিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। রিপোর্ট হয়ত দু, একদিনে দিবে তখন তুই এসে কালেক্ট করিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে জেনে যাবি সমস্যাটা।” শরত বোঝাতে চাইলো শিশিরকে এখন সে চলে যাক৷ শিশির নাছোড়বান্দা সে গেল না বরং আঁড়চোখে আলতাকে দেখতে থাকলো। আলতার টেস্ট করা শেষ হওয়ার আগেই সোহা আবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোন দিকে আছো?”
শিশির বুঝলো সোহা এসেছে তাই সে বলল লোকেশন। সোহা আর অনু এসে উপস্থিত হলো শিশিরের সামনে। প্রথমে অনুই কথা বলল, “কিরে, শা/লা পূর্ণিমার চাঁদ তোরে তো আমি ভাঙা হারিকেন দিয়া খুঁজি আজকাল।”
কথাটা বলতে বলতে অনু ধাক্কা খেলো শিশিরের বিপরীতে দাঁড়ানো শরতের সাথে। চোখ-মুখ কুঁচকে ধাক্কা খাওয়া মানুষটিকে এক পলক দেখে অনু অনুতপ্ত তো হয়নি বরং বিরক্তির স্বরে বলল, “ও কি মনু চোখে দেখো না? নাকি মাইয়া দেইখা চোখ চান্দে পাডাইছো?” সোহা আর শিশির দুজনেই হকচকিয়ে গেছে অনুর আচরণে আর শরতকে দেখে। সোহা মুখ চেপে ধরলো অনুর সাথে সাথে ক্ষমাও চাইলো, “স্যরি ভুল হয়েছে ও খেয়াল করেনি। প্লিজ ঝামেলা করবেন না।”
শিশিরও অনুকে ধমকে উঠলো, মাথা খারাপ হয়ে গেছে অনু? সব জায়গায় এমন আচরণ ঠিক না। ভাই মাফ করে দাও ও একটু অন্যরকম স্বভাবের।”
শরতের মুখে ‘ভাই’ শব্দটা শুনে সোহা, অনু দুজনেরই যেন একটু লজ্জা লাগলো। আর শরত কঠিন চোখে তাকালো একবার অনুর দিকে৷ পা থেকে মাথা অব্দি তার উশৃংখলতার ছাপ। কালো কেডস, ফাটা জিন্স, স্লিভলেস টপ তার ওপর স্লিভলেস শর্ট কোটি। চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা, চোখে মোটা কাজল। কাজলটা বোধহয় মাত্রাতিরিক্ত মোটা। প্রচণ্ডরকম বিরক্তবোধ হলো তার কিন্তু রাগ হলো না৷ মেয়েটার ঠোঁটে ডার্ক পার্পল লিপস্টিক দেখে তার কিছুটা হাসিও পেল ভ্যাম্পায়ার মুভির কিছু নায়িকা এমনই লিপস্টিক লাগায়। কিন্তু তাদের ড্রেসাপ এতোটাও হাস্যকর লাগেনি শরতের। সে খুব কমই দেখেছে ইংলিশ মুভি৷ তবুও মেয়েটাকে আজব প্রাণী বৈ অন্যকিছু মনে হচ্ছে না তার। শরতের মুখ দেখে কেউ কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে রেগেছে কি বিরক্ত হয়েছে! তবুও অনু নিজের ভুল বুঝে স্যরি বলল শরতকে। তারপর শিশিরই ছোট করে পরিচয় করিয়ে দিলো ভাই আর দুই বান্ধবীকে। আরো অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সোহা বলল, “শিশির যাবে না?”
তাদের অন্য বন্ধুরাও ফোন দিচ্ছে বারংবার তা বুঝতে পেরে শরত বলল, “তুই চলে যা। হয়ে যাচ্ছে আর একটু পর আমরাও রওনা হব।”
শরতের কথার মিনিট খানেক পরই আলতাকে নিয়ে নকশি এলো। টেস্ট করা হয়ে গেছে। ছোট দুটো কাগজ নকশি শিশিরকে এগিয়ে দিলো, “রিপোর্ট কাল দুপুরে দিবে। তুমি সময় করে এসে নিয়ে যেও।”
“আচ্ছা ফুপুআম্মা।” শিশির এইটুকু বলে আবার সোহা আর অনুকে পরিচয় করিয়ে দিলো ফুপু আর ফুপুর মেয়ের সাথে। আলতা শুধু চুপচাপ চেয়ে রইলো সোহার দিকে। এই সেই মেয়েটা। সেদিন দূর থেকে যতোটা চমৎকার লেগেছিল আজ সামনে থেকে তার চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। মনে মনে আবারও হিংসা করলো আলতা মেয়েটা এত সুন্দর কেন!
দুপুরে খাওয়া হয়নি কারোই। শরত কাওয়ার জন্য নকশিকে বলতে যাচ্ছিলো তখনি সোহা আবদার করলো তাদের সাথেই খেয়ে যেতে। পরে না হয় অনুর গাড়িতে করে তাদের বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে আসবে। শরত বক্রচোখে একবার দেখলো অনুকে পরক্ষণেই বলল, “না তারা এদিকেই হালকা কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়বে। সোহা জোর করলো শিশিরও একবার বলল কিন্তু নকশি আর আলতা কেউ রাজী হলো না। আলতা শুধু ভাবলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে এই শহর ছেড়ে যাবে৷ এ শহরের বাতাসটাও তার বিষাক্ত লাগছে খুব৷ তার কারণেই আরও দ্রুত চলে যেতে হলো তাদের। যাওয়ার সময় অনু একবার খুবই বিনয়ী স্বরে শরতকে বলল তার গাড়িতে করে বাসস্ট্যান্ড পৌছে দেবে। শরত হাসি মুখে না করে দিলো।
চলবে