ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৭
চট করে কখনো একটা মানুষকে ভালবাসা যায় না আবার হুট করেই কাউকে ভুলেও যাওয়া যায় না। প্রত্যেকটা জিনিসেই প্রকৃতিগতভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। আলতাকে নিয়ে যেদিন হাসপাতালে গিয়েছিল শরত আর নকশি সেদিনই হঠাৎ করে আকদ হলো অলির। ঘটনাটা প্রথমে চাপা ছিলো গ্রামে। আকদের খবরটা অলির আত্মীয়স্বজনরাও অনেকে জানতো না। ভীষণভাবে গোপনীয়তা বজায় রেখে তবেই সম্পন্ন হয়েছিল কাজটা। আর সবটাই ছিল অলির অতি চালাক বাবার কারসাজি। অলি একটু আপত্তি তুলেছিলো কারণ পাত্রের সাথে এখনো তার ঠিকমত দেখা- সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু অলির বাবার চিন্তা ছিল অন্যরকম। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে সবে আর তখনি কানে এলো মেয়ে এলাকায় একজনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। মেয়ে এখন মুখে যতোই বলুক সে প্রেম করেনি সত্যিটাতো এলাকার অনেকেই জানে। আর আহসানুল্লাহ মাস্টারও একদিন দুজন মুরুব্বি নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছিল। তার প্রস্তাব সরাসরি ফেলে দেওয়ার মত নয় বলে সেদিন কথা কাটিয়েছে বাড়িতে আলোচনা করে জানাবে। কিন্তু এই আলোচনার ধারেকাছেও যেতে চায় না সে। শরত নিঃসন্দেহে ভালো, যোগ্য ছেলে কিন্তু ভালো ধুয়ে কি পানি খাবে? কোথায় সেই গাড়িওয়ালা, মস্ত বাড়িওয়ালা ছেলে আর কোথায় শরত মুদি দোকানি। শরতের ব্যবসা ভালো চলে ঘরে অভাব নেই কিন্তু ব্যবসা সবসময়ই ভালো চলবে তার কি নিশ্চয়তা! এমন আরো অসংখ্য যুক্তি নিজে নিজে দাঁড় করিয়ে লোকটা চুপিচুপি আকদটাই করিয়ে দিলো। কে যেন বলেছিলো শরত ভোর রাতেই নকশিদের সাথে ঢাকা গিয়েছে। আর সে কারণেই অলির বাবা অনেক রকম চালাকি করে ঘটকের সাথে কথা বলে একটু উল্টো চাল দিলো। ব্যস এতেই সন্ধ্যের পর অলির আকদটা হয়ে গেল। তবে এসব বিয়ে-শাদি, প্রেম ভালোবাসা বেশিক্ষণ চাপা থাকে না। অলির বিয়ের কথা চাপা রইলো না। পরের দিন সকালেই শরত দোকান খুলতে গিয়ে ঘটনাটা শুনলো। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলো এক জায়গায়। তারপর আবার নতুন উদ্যমে কাজে মন দিলো। দিনরাত তার কাটে দোকানে ব্যস্ত থেকে। আগে তার আর আহসানুল্লাহর দোকান বন্ধ হতো রাত নয়টায় এখন বাজারে সকল দোকান বন্ধ হবারও আধ, একঘন্টা পর বন্ধ হয় শরতের দোকান। গ্রামাঞ্চলে রাত এগারোটা মানে কারো কারো জন্য মধ্যরাত প্রায়। শরত সেই রাতেই বাড়ি ফিরে। বাজার ছেড়ে কাঁচা মাটির পথ, দু পাশে কিছু অংশে বাঁশের ঝাড় তো কিছু অংশ জুড়ে ক্ষেত, খোলা মাঠ তারপর কয়েকটা বাড়ি আবার ক্ষেত, ঝোপ, বিভিন্ন গাছগাছালি। তারপরই শুরু তাদের পাড়া। নিকষ অন্ধকারে হুতুমের ডাক, ঝিঁঝির ডাক আরও কত কি ডাকে। কোন কিছুই কানে যায় না তার। চোখের সামনে হঠাৎ হঠাৎ শেয়ালও এসে পড়ে পাত্তা দেয় না সে। কাজ আর নিজের ভেতর গুমরে থাকে সারাক্ষণ। বাড়ির প্রতিটা সদস্য তার জন্য কষ্ট পায় কিন্তু সে তাদের সামনে খুব স্বাভাবিক আচরণ করে৷ প্রথম প্রথম জয়তুন উঠে পড়ে লেগেছিলেন অলির ক্ষতি করতে আর শরতের বিয়ে দিতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে না পেরে এখন সেও চুপচাপ থাকে খুব। শিউলি ইদানীং খুব একটা আসতে পারে না বাপের বাড়ি৷ নতুন অবস্থায় ঘনঘনই আসার সুযোগ পেয়েছে এখন আর শ্বাশুড়ি মা অনুমতি দেয় না।
আলতার জন্য মাস্টার বাড়িতে আওলাদের ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু হয়েছিল। যত যাই হোক নিজের ঔরসজাত সন্তানের মায়া তাকে খুব করে জেঁকে ধরেছে। আর এই মায়ার জের ধরে তার সংসারে অশান্তি গুরতর হচ্ছিলো। কিন্তু সেই খবর আলতা কিংবা নকশির জানা নেই। বাবা- মেয়ের পরিচয়ের অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আলতারও যেন আপনাআপনিই পিতার প্রতি একরকম মায়া জন্মে গেল। নকশি টের পেয়ে আলতাকে সাবধান করতে চাইলো। এই মায়া গাঢ় হলে বাবা মেয়ে দুজনেরই কষ্ট হবে। আওলাদের বাড়িতে একটা সংসার আছে, স্ত্রী – সন্তান আছে। আলতা তো এত বছর বাবাকে ছাড়াই কাটালো এখন কাছে পেয়ে কোন বাড়াবাড়ি যেন না হয়। এতে সেই পরিবারের মানুষগুলো ব্যথিত হবে, কষ্ট পাবে। আলতা অবাক হয়ে শোনে মায়ের কথা। নিজেদের কষ্ট না ভেবে নিজের ভাগে যারা দখল বসালো তাদের কথা ভাবছে! এ ব্যপারেও নকশির যুক্তি তারা দখল করেনি এটা তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের অগোচরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছু অংশ পৌঁছে গেছে আহসানুল্লাহর কানে। আর ঘটনাটা পৌঁছে দিয়েছে আওলাদের দ্বিতীয় স্ত্রী নিজেই। প্রতিদিনকার মত আহসানুল্লাহ দোকানে বসেছিলেন। তখন সময়টা দুপুরের আগ মুহূর্ত। একজন বোরকা পরা মহিলা এসে দাঁড়ালো তার দোকানে। সাথে একটা সাত কি আট বছর বয়সী ছেলো। মহিলাটি এসে একবার চোরা চোখে চারপাশ দেখে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আহসানুল্লাহ মাস্টার?”
মহিলার প্রশ্নটিতে মোটেও বিভ্রান্ত হয়নি আহসানুল্লাহ। সে স্কুলের সব রকম দ্বায়িত্ব ছেড়েছে প্রায় ছ’মাস হয়ে গেছে। তবুও অনেক অভিভাবক বিভিন্ন প্রয়োজনে তার কাছেই চলে আসে। আশপাশের দু,তিন গ্রামেও তার নামডাক খুব। সে মহিলাটির প্রশ্নের জবাব দিতেই মহিলাটি আরেকটু সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “আলতা আপনার বইন?”
“না না আলতা আমার ভাগ্নি। আপনি কে?”
“ও তাইলে আলতা তেনার মাইয়া। আমি আলতার বাপের বউ। আপনের বইনের নাম কি তাইলে? ”
প্রথমেই কথাটা ধরতে পারলো না আহসানুল্লাহ । একটু সময় নিতেই বুঝতে পারলো এই মহিলা আওলাদের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার মুখ, চোখ কিছুটা গম্ভীর হলো। সে কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি আবার বলল, “আলতার মায় আপনের আপন বইন না আমি জানি৷ কিন্তু অর বাপের মুখে যতখানি হুনছি অগো গারজিয়ান নাকি আপনেরেই মানে সবাই।”
মহিলা এ পর্যায়ে দম নিলেন। পাশেই তার ছেলেটা দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে আছে। আহসানুল্লাহর মনযোগ মহিলার কথাতেই। মহিলায় পুনরায় বলতে শুরু করলেন, “ভাইজান গো আমার সংসারডা নষ্ট করতে দিয়েন না। আমার দুইডা পোলা আছে, এতগুলা বছর আমি সংসারডা আগলায় রাখছি, নিজের হাতে সাজাইছি আমি সইতে পারুম না।” এই বলে মহিলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পিচ্চি ছেলেটাও মায়ের কান্না দেখে এগিয়ে এসে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরলো। আকস্মিক কান্নাকাটিতে হকচকিয়ে গিয়েছিল আহসান। পাশেই শরতের দোকান। সে প্রথমে মহিলাকে কাস্টমার ভেবেছিলো। মহিলার অনেকটা সময় কথা বলা দেখে ধারণা করলো স্কুল বিষয়ক কোন কাজে এসেছে হয়ত এ আর নতুন কিছু না। কিন্তু মহিলার কান্নাকাটিতে ভড়কে গেল সেও। দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কাকার দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দেখলো আশপাশেরও কয়েকজন এগিয়ে আসছে৷ এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বাজে অবস্থা হলো আহসানুল্লাহর। সে বিচক্ষণ হলেও আকস্মিক ঝামেলা সামলে উঠা তারও মুশকিল মনে হলো। শরত জিজ্ঞেস করতেই মহিলা আবার সবিস্তারে শুরু করলো পুরো ঘটনা। এতে করে এলাকার অনেক পুরুষই ঘটনা শুনে গেল। প্রথম কয়েকদিন পর্যন্ত নকশির কানে না গেলেও তারপর আবারও আওলাদের আগমনে আহসানুল্লাহ নিজেই সব বলে দিলো। নকশি, আলতা দুজনেই হতভম্ব কি বলবে তা বুঝে পেল না। নকশি হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলো আওলাদকে আসতে বারণ করবে। করলও তাই তবে সেই বারণ বেশিদিন টিকলো না৷ আলতা সুস্থ হওয়ার পর থেকেই আর কখনো একা স্কুলে যায়নি। সকালের সময়টা যেচে শরত নিজেই নিয়ে যেতে লাগলো কখনো কখনো আহসানুল্লাহ। ছুটির সময় মা, মেয়ে একসাথে ফিরতে লাগলো৷ এরই মাঝে আওলাদ অনেকবার এলো মেয়ের সাথে দেখা করলো তবে সবটাই নকশির আড়ালে। জোরজবরদস্তি মেয়েকে কিছু কিছু টাকাও দিয়ে গেল। শরত একদিন বারণ করেছিল পরবর্তীতে তার মনে হলো দরকার নেই৷ সন্তানের জন্য বাবার নিশ্চয়ই কষ্ট হয় খুব! আহসানুল্লাহ জানলো কথাটা এবং তারপরই শেষ মুহুর্তে নিজ থেকে একটা কথা বলে বসলো আওলাদকে। সময়টা শীতের শেষ দিকে৷ আলতার টেস্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিলো৷ আলতাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে আওলাদকে দেখলো। আলতার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতে দিলো আহসানুল্লাহ। আলতা যখন বাবা আর মামার কাছে বিদায় নিয়ে স্কুলে ঢুকে গেল তখন আহসানুল্লাহ বলল, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে আওলাদ।”
“কন আহসান ভাই।”
“তোমার আর নকশির সম্পর্কটা সম্পর্কের মত নয়। নামমাত্র একটা কাগজ ছাড়া কিছুই নেই তোমাদের মাঝে তা সবাই জানি৷ আমি ঠিক করেছি নকশির বিয়ে দেব।”
বাজারের দিকে চলতে চলতে কথা বলছিলো আহসানুল্লাহ। তার পাশে পাশে চলছিলো আওলাদ৷ ‘নকশির বিয়ে দেব’ কথাটা কানে ঢুকতেই পা থেমে গেল আওলাদের। সে করুণ চোখে তাকালো আহসানুল্লাহর দিকে। তারপরই অসহায়ের মত গলার স্বর নরম করে বলল, “আহসান ভাই আমি যদি তাগোরে আমার লগে নিতে চাই! কোন রকমের কষ্ট দিমু না ভাই।”
আহসানুল্লাহ বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান লোক। সে জানে এখন যদি আওলাদ তার স্ত্রীর আগমন এবং তার কাছে বলে যাওয়া কথাগুলো জানে তবে এই অশিক্ষিত, বোকা লোকটা অন্য আর দশটা বোকা পুরুষের মতোই হয়ত বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে পেটাবে অথবা গালিগালাজ করে নিজের মত করে মানিয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু এই মানিয়ে নেওয়ার পর কি নকশির সেখানে সুখ হবে! আর সবচেয়ে বড় কথা হলো নকশি কি চায়? এত বছরের না থাকা সম্পর্কটাতে সে আদৌ ফিরতে চাইবে কিনা কে জানে! আর সে কারণেই আহসানুল্লাহ এখানে, এই নির্জন পথেই কথাটা তুলেছে। নিজের মত করে আওলাদকে একটা বুঝ দিতে এবং নিজেও আওলাদের মনোভাব বুঝে নিতে। তার ধারণা স্পষ্ট হয়নি তাই সে বলল, “তুমি তাদের কষ্ট দিবে না তা কি করে মানি আওলাদ? নকশি আমাকে শুধু মুখেই ভাই বলে না মন থেকেই মানে। আমিও তাকে আমার বোন ভেবে অভিভাবকের মত আগলে রেখেছি আজ প্রায় ষোলো বছর হতে চলল। যখন তোমাকে তার পাশে দরকার ছিলো তখন তুমি মাথা উঁচু করতে পারোনি। তোমার মায়ের মুখ তুমি চেষ্টা করলে আগেই আটকাতে পারতে তুমি করোনি। থাক সেসব অতীত কিন্তু এখন ঘরে তোমার স্ত্রী, সন্তানেরা আছে৷ দুই সংসার একসাথে রাখতে গেলে হাঁড়িতে ঠোকাঠুকি তো লাগবেই এর বেশিও কিছু হতে পারে। তাই আমার মনে হয় তোমাদের বিচ্ছেদ এবার সম্পূর্ণরূপে হওয়া উচিত। নকশিকে আমি নিশ্চয়ই যোগ্য কারো হাতেই দেবো। আজকাল বত্রিশ, তেত্রিশ বছর বয়সী নারীর জন্যও ভালো পাত্র পাওয়া মুশকিল নয়৷”
পথ ফুরিয়ে গেছে; আওলাদ আর আহসানুল্লাহ এসে দাঁড়িয়েছে দোকানের সামনে। আহসানুল্লাহ পকেট থেকে চাবি বের করে দোকান খুলতে খুলতে আঁড়চোখে একবার দেখলো আওলাদকে। তার মুখের অভিব্যক্তি কেমন তা বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। আওলাদ আর বেশি সময় না নিয়ে চলে গেল। আহসানের কথার জবাব বাকি রয়ে গেল সেদিন। এরপর সময় করে একটু আলাদা করে বসলো আহসান। তার সাথে উপস্থিত ছিলো বাড়ির নারী সদস্য শিফা আর জয়তুনও৷ আহসান একইরকম কথা বলল নকশিকেও আর এ কথাতেই যুক্ত করলো নকশির বিয়ের কথাটা। নকশি শুরুতেই আঁতকে উঠেছে বিয়ের নামে। সে এক মুহূর্ত ব্যয় না করেই বলে দিলো মেয়েকে অসহায় করে সে নিজের জীবনে কিছুতেই আর রং ঢালতে পারবে না। রঙিন জীবন যদি তার পাওয়ার ইচ্ছে থাকতোই তবে মেয়ে যখন ছোট ছিল তখনই করতো। তার পক্ষে এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। ঘরের আলোচনা আর এগোয়নি সেদিন। সবাই যখন আহসানের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঠিক তখনি শিফা খেয়াল করলো পাশের ঘরের দরজার আড়ালো লুকোনো আলতাকে। নিঃশব্দে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠে ছলছলে চোখে তাকালো আলতা মামীর দিকে।
“তুই সব শুনেছিস?”
ভয়ে ভয়ে প্রশ্নটা করলো শিফা। আলতা কয়েক সেকেন্ড মামীর দিকে তাকিয়ে থেকে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শিফা স্পষ্ট দেখেছে আলতার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছিলো তার চিবুকে।
আলতাকে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে আসার পরও অনেকগুলো দিন শিশির আলতার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি৷ রোজ সে নকশির ফোনে কল দিতো এই আশায়, হয়ত আলতা তুলবে কলটা। কিন্তু তার নসীবে সে সময়টা খুব দূরেই ছিল। অনেক অনেক দিন পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। বসন্তের শেষ দিকে এক বিকেলে কল দিতেই ফোনটা তুলল আলতা। সে নাম দেখেছে তবুও সেদিন আর শিশিরকে অগ্রাহ্য করেনি৷ কল তুলতে তুলতে ভেবেছিলো প্রশ্ন করবে কিছু৷ কিন্তু তার দূর্ভাগ্য সে হ্যালো বলার সাথে সাথে শিশিরই প্রশ্ন করলো অনেকগুলো। যার কিছু উত্তর দিলো আলতা আর কিছু উত্তর বুকের ভেতর জমাট করে বরফ করে রাখলো৷ কোন এক খা খা রোদ্দুরে তপ্তদুপুরে বের করে তা গলিয়ে নেবে আত্মপ্রশান্তির প্রয়োজন পড়লে। শিশিরের সেদিন প্রথম প্রশ্নই ছিলো, “আমাকে কেন অবহেলা করছিস বলতো?”
চলবে
ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৮
ঘুৃম ভাঙলেই চোখে ভাসে পদ্মরঙা মুখটা। পদ্মাদিঘিতে থাকে সেই পদ্মকন্যা যার পা’দুটো আলতায় রঙিন, হাতের কড়ায় ছুটির দিনে রিনিঝিনি করে কাঁচের গাছি গাছি চুড়ি। সুযোগ পেলেই যার অঙ্গে ফুলের মালা জড়ায় সে কন্যা আজকাল শিশিরের জাগ্রত চোখে পদ্মফুলের মত ভাসে সারাক্ষণ। সেদিন যখন শিশির ফোন করে জানতে চাইলো তাকে অবহেলা কেন করে? আলতা তখন নিশ্চুপ হয়েছিল অনেকটা সময়। শিশির আবারও যখন জানতে চাইলো আলতা সেই হলুদের রাতে তার অসংযত আচরণ, জোর করে তাকে স্পর্শ করার অভিযোগ কেন করেনি বড়দের কাছে তখনও আলতা চুপচাপ ছিলো। শিশিরের মনে হয়েছে এখনো সময় হয়নি আলতাকে নিজের অনিভূতিটুকুর খোলাসা করার তবুও সেদিন প্রশ্ন করেছিলো, “তুই কি আমায় ভুলে যাবি আলতা? তুই কি আমায় ভুলে অন্যকারো হবি কখনো? আমি তবে মরেই যাবো মনে রাখিস। তুই কি আমায় একটু ভালোবাসবি আলতা?”
কিশোরী মেয়ে ভালোবাসার মানে কতটুকু বোঝে! আলতা কি বুঝেছিলো সেদিন শিশির তা জানে না শুধু মনে পড়ে আলতা সেদিন মুখের ওপর একটা জবাব দিয়েছিলো, “না।”
একটুও ব্যথিত হয়নি শিশির এই উত্তরে । তার মনে হয়েছিলো এই উত্তর অভিমানী। এই একটা শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য শব্দ, বাক্য আর অগণিত অনুভূতি। আলতা কল কেটে দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তার কানে বেজেছিলো আলতার ঝংকার তোলা চঞ্চলতা৷ আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকটা সময় বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে শিশির কল্পনা করছিলো আলতাকে নিয়ে। এইতো একটুখানি ছিলো আলতা আর শিশির তাকে কোলে তুলে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতো, “তোর কারণে আমার আদর কমে গেছে তোরে আমি গাঙপাড় ফেলে আসবো। তুই অনেক ফর্সা না! গাঙপাড়ে রোদে পুড়ে কালো কুচকুচে হয়ে গেল বাড়ি আনবো। আর কেউ তোকে আদর করবে না। ”
কখনও কখনও বলতো, “তোকে আমি বে’চে দিব পদ্মদিঘির মেলায়। তারপর সেই টাকায় কটকটি কিনে খাবো।”
সকালটা কেটে গেছে মিটিমিটি হাসিতে। রুমমেট ছেলেটা একবার নিজের বিছানা থেকে শিশিরকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো, “প্রেম টেম করছো নাকি সোহার সাথে?”
এই প্রশ্নটা নতুন নয়। আরো অনেকেই শিশিরকে একই প্রশ্ন করেছে বহুবার। তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে সে জানতে চাইলো, “ভাইয়া, আপনারা সবাই সোহাকে নিয়ে এমনটা কেন ভাবেন?”
ছেলেটিও বেশ হাসি হাসি মুখেই বলল, “সোহা মেয়েটা খুবই শান্ত স্বভাবের। তাকে যারা চেনে সবাই জানে এই মেয়েটা ভার্সিটির কোন ছেলের সাথেই খুব একটা মেশে না অথচ তোমার সাথে সময় পেলেই গল্প আড্ডা এমনকি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করলেই তোমাকে থাকতে হয় তার সাথে। এতে করে বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই সবার ধারণা অযৌক্তিক নয় তোমাদের নিয়ে।”
“বুঝলাম ভাইয়া। সবার এই ধারণাটা ভুল আমার জীবনে সোহা নয় অন্য কেউ।” শিশির কথাটা বলতেই ছেলেটি বলে উঠলো, “আর সোহার জীবনে?”
চমকে গেল শিশির ; তবে কি সোহা তাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবে!
টেস্ট পরীক্ষার পর আবারও একটা পরীক্ষা নিচ্ছেন শিক্ষকরা। বলা যায় এটা প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা। বোর্ড পরীক্ষার আর মাত্রই কিছুদিন বাকি সেই সাথে বিদায় অনুষ্ঠান। আলতা এ বছরে প্রায় অর্ধেকটা সময় স্কুলে যেতেই পারেনি অসুস্থতার জন্য। শেষ দিকে এসে শরতের কড়া কথা, ধমক এসবের পর বাধ্য হয়েই তাকে স্কুলে যেতে হয়েছিল। মায়ের বিয়ে নিয়ে মন খারাপ করবে সেই সুযোগটাও শরত তাকে দেয়নি। ওদিকে শিশিরের সাথে ফোনে কথা হওয়ার পর থেকেই যেন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অনেকটা আগের মত ; শিশির নিয়ম করে তাকে সাজেশন পাঠায়, ভিডিও কলে বিভিন্ন পড়া চেক করে আবার বুঝিয়েও দেয়। শিশিরের নিজেরই একজন পরীক্ষার্থী স্টুডেন্ট আছে আর সেই সুবাদে আলতার পড়াশোনার ব্যাপারটা তার জন্য সামলে নেওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। মোটকথা, আলতার আজকাল রাগ হয় খুব৷ শিশির ভিডিও কল করলেই সে দেখার জন্য চোখ তোলে কিন্তু শিশির হুটহাট ধমকে বলবে, নজর শুধু পড়ায় থাকবে। আলতাও তাই করে কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয় শিশির তাকিয়ে দেখছে তাকে। ধরাও পড়েছে শিশির কয়েকবার আলতার দিকে নজর দেওয়া অবস্থায় কিন্তু মোটেও আলতাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। বাড়িতে কারো কাছে অস্বাভাবিক লাগে না শিশিরের এমন ফোনকল আর আলতাকে পড়ানো নিয়ে শুধু শিফা হাসে খুব। সে মাঝেমধ্যে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মশকরাও করে ফেলে। এ যেন খুব সহজ ব্যাপার কিন্তু শিশির লজ্জা পায় মায়ের আচরণে। মা তার সাথে প্রেমিকা নিয়ে ঠাট্টা করে। শিশির বোঝে মা আলতাকেই ইঙ্গিত করে কিন্তু এখনো মাকে খোলাখুলি সবটা বলার সাহস হয় না। সংকোচ হয় খুব; ছোট থেকে তো এতোটা ফ্রী ছিলো না। শহুরে অভিভাবকদের মতো মা কিংবা বাবা কারো সাথে তার কথাবার্তা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো না কোনদিন। বাবার আদর এবং কথাবার্তায় বরাবরই বন্ধুত্ব ছিলো কিন্তু তারপক্ষ থেকেই একটা সুক্ষ্ম দেয়াল ছিল তাই এখন চাইলেও সে বলতে পারছে না। আলতাকেও সে সরাসরি ভালোবাসি কথাটা বলেনি আর এখন বলতে চাইছেও না।
“সামনে আলতার বোর্ড পরীক্ষা এখন তোমরা এসব নিয়ে আলোচনা করবে না।”
উঠোনের এক কোণে বসে শিফার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো জয়তুন। তখনই দু জা মিলে গল্পে গল্পে নকশির কথা তুলে আফসোস করছিল। বাড়িতে এই মুহুর্তে শিফা আর জয়তুন ছাড়া কেউই ছিলো না। আহসানুল্লাহ কোন এক প্রয়োজনে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরেছিলেন। তখনি টিনের গেইট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলেন শিফা বলছে, “ভাবী আমরাই সবাই মিলে চলেন রাজী করাই নকশিরে৷ তার ভবিষ্যৎ এখনো পড়ে আছে সামনে। অল্প বয়সেই বিয়েশাদী করে বাচ্চা জন্ম দিলো আবার স্বামীর ঘরও হারালো। একা একা বাঁচা তো মুশকিল তবুও আলতা মেয়ে না হয়ে একটা ছেলে হলে কথা ছিল।”
জয়তুনও শিফার কথায় তাল মেলালো, “ঠিকই কইছোস তুই, এমনেই তো চারপাশে পুরুষরা গিল্লা খাইতে চায় ওরে। আমাগো জহির মানুষ হিসাবে ভালা এহনও সময় আছে আমরাই বুঝাইয়া, শোনাইয়া তার একটা ব্যবস্থা কইরা দেই। আলতারে নিয়া ভাবা লাগবো না ওরে তো আমরা বাড়িতই রাখতে পারি চাইলে।” জয়তুনের কথার অর্থ স্পষ্ট ছিলো না কিন্তু শিফা খুশি মনে তা স্পষ্ট করতেই বোধহয় আরেকটু বলল, “হ্যাঁ, আলতারে নিয়ে চিন্তা তো আরো আগেই শেষ হয়ে গেছে এখন শুধু সময় হওয়ার অপেক্ষা। আওলাদ ভাইয়ের সাথে তালাকটা ঠিকঠাক হলেই নকশির বিয়া নিয়া ভাবা যায়।”
আহসানুল্লাহ তার বাড়ির এই দুই নারীর কথা সবটা শুনেই সে বাঁধা দিলো। আর যেন এসব কথা না শোনা যায় অন্তত আলতার পরীক্ষা অব্দি।
আওলাদ অনেক ছুটোছুটি করলো, নকশির বাপের বাড়ি, বাপ-ভাই সবার কাছেই গেল। অনেক গুলো বছর সে কারো সামনে না গিয়ে যোগাযোগ রেখেছিলো সে বাড়ির দু একজন সদস্যের সঙ্গে যেন নকশির খোঁজ পেলেই তাকে জানায়। কিন্তু তারা এত বছরেও নকশির খোঁজ পায়নি বলা যায় খোঁজ করেনি। শুধু নকশির মা মেয়ের জন্য মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেঁদেছেন মেয়ের শোকে। এখন যখন নকশিকে পেয়েও আওলাদ নিজের করে পাবে না বুঝলো তখনি সে চলে গেল নকশির পিতার কাছে। হয়ত কোন এক ব্যবস্থা হয়ে যাবে! কিন্তু হয়নি; নকশির বাবা মেয়ের কথা শুনে এক মুহূর্ত আবেগে ভেসে কেঁদেছেন, মেয়েকে দেখতে যাবেন বলে নকশির ঠিকানাও জেনেছেন কিন্তু আওলাদকে সমর্থন না করে বলেছেন, “আমার মাইয়ারে ছাড়া এত জীবন খারাপ থাহো নাই অহনও থাকবা না।” বৃদ্ধার এই জবাব আওলাদের পছন্দ হয়নি। সে ফিরে এসে আবারও আহসানুল্লাহর কাছে অনুরোধ জানায় নকশিকে ফিরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু নকশি তো রাজী না আওলাদের ঘর করতে। তবে নকশি বলেছিল আলতা চাইলে তার বাবার কাছে যেতে পারে সে বাঁধা দেবে না। যেহেতু মেয়ের জন্মদাতা আওলাদ আর অনেকগুলো বছর নকশি লুকিয়েছে তার পিতার কাছে সন্তানের কথা সেক্ষেত্রে অন্যায় তার আছে৷ আহসান ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে নকশির মতের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। আওলাদ আশাহত হয়ে ফিরে গেছে। নকশির বোর্ড পরীক্ষা জেনে আবার এলো এক সকালে কলস ভর্তি দুধ আর এক ঝুড়ি দেশি মুরগির ডিম নিয়ে। ছুটির দিন থাকায় নকশিও বাড়িতে ছিলো। আহসান আর শরত দুজনেই দোকানে ছিলো সে মুহূর্তে। শিফা এতসব দেখেই কেমন সন্দেহি হয়ে আহসানকে ফোন করে জানালো ঘটনা। আহসানের মনে হলো আওলাদ এখন কোনো রকম ভেজাল করবে বলেই নতুন উদ্যমে আগাচ্ছে এদিকে৷ তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আওলাদ পঁচিশ হাজার টাকা সামনে রেখে বলল, “একটা ফিরিজ(ফ্রিজ) কিন্না দিবার চাই। আমার মাইয়া এই দুধ, ডিম ফিরিজে রাইখা খাইবো। আমার নিজের খামার করছি নতুন। এহন থাইকা সবসময় দিতে চাই এইগুলা।”
সব সময়ে নকশির হয়ে কথা বলাটা ভালো দেখায় না বলেই মনে করে আহসান। আওলাদের এবারের রাখা প্রস্তাবে সে মুখ খুলল না। নকশি নিজেই বলল ফ্রিজ তার লাগবে না। আলতা উপস্থিত ছিল তখন সেখানে। সে মায়ের মুখের দিকে একবার তো বাবার দিকে একবার তাকালো। তার বাচ্চা মন খুশি হয়ে গিয়েছিলো ফ্রিজের কথা শুনে তারপরই আবার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠলো মায়ের নিষেধ শুনে। তার অপরিপক্ক মন এক মুহুর্তে ভেবে বসলো মা খুব জেদী। একটা ফ্রিজ থাকলে কত ভালো হতো তাদের কিন্তু না এ পর্যায়ে ফ্রিজ হলো না। বাবাও মন খারাপ করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আলতার হাতে গুঁজে দিয়ে গেলেন দু হাজার টাকা। এই টাকা তার কাছে অনেক বেশি। সে ভেবেছিলো মাকে বললে মা বকবে। কিন্তু না তেমন কিছ হয়নি। মা দু দিন পর একটা মাটির ব্যাংক এনে তাকে দিয়ে বললেন, “টাকা গুলো এতে রাখ তোর কাজে লাগবে পরে।”
দোনোমোনো করছিলো আলতা তা দেখে মা কিছু না বলে মাটির ব্যাংকটা সরিয়ে চৌকির নিচে রেখে চলে গেল। সেদিন রাতেই শিশির যখন ফ্রী হয়ে আলতাকে পড়ানোর জন্য কল দিলো নকশির ফোনে, তখন আলতা মুখ ফুটে বলেই ফেলল, “আম্মা আজকাল আমাকে বুঝি আর ভালোবাসে না।”
“এ কথা কেন বলছিস?”
“আব্বা আমার জন্য ফ্রিজ কেনার টাকা নিয়া আসছিলো। আম্মা ফেরত দিয়া দিছে। আব্বা দু হাজার টাকা দিছে সেটাও একটা ব্যাংক দিয়া বলে রেখে দে।” মন খারাপ করে কথাটা বলতে বলতেই আলতা বইয়ের ভাজে রাখা টাকাগুলো দেখালো। শিশির দেখলো এবং খুব মনযোগে আলতাকেও দেখলো।
“তুই তোর আম্মাকে ভালোবাসিস আলতা?”
“হ্যাঁ, অনেক বাসি।”
“তুই তোর আব্বাকে ভালোবাসিস? ”
“জানি না কিন্তু মায়া লাগে আব্বার জন্য।”
অনেকটা দ্বিধার সঙ্গে বলল আলতা।
শিশির আবার বলল, “তোর জন্ম, তোর বড় হওয়া সবটা কেমন করে হয়েছে তা জানিস আলতা?”
এবারেও অকপটে স্বীকার করলো, সে জানে। শিশির আবারও প্রশ্ন করলো, “তোর বাবার আরো একটা সংসার আছে। সেই সংসারে একটা স্ত্রী এবং দুজন ছেলে আছে। তুই আর তোর মা ছাড়াও তোর বাবার আঁকড়ে ধরার মত লম্বা শেকড় আছে। তোর আম্মার কি আছে?”
“আমি একাই।”
“ফুপুআম্মারে বিয়ে দেওয়ার মত বয়স এখনো আছে। এক কাজ করতে বলি আব্বাকে, ফুপুআম্মাকে বিয়ে দিয়ে দিক তুই তোর বাবার সাথে চলে যা তোর বাড়িতে।”
শিশিরের এবারের কথাটা একদম ছুরির মত বিঁধে গেল আলতার বুকে।কোন একটা উত্তর দিতে গিয়ে আলতা থমকে গেল। শিশির এতসব প্রশ্নোত্তর কেন করলো তা সে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে৷ হঠাৎ করেই তার নিজের ওপর রাগ হলো, কষ্টও হলো। সে কি লোভী হয়ে পড়েছিলো! আম্মার জীবনে সেই একমাত্র আপন মানুষ৷ আম্মা নিশ্চয়ই যা করবে সব তার ভালোর জন্য! সে কেন স্বার্থপরের মত আচরণ করছিল! শিশির ভিডিও কলে দেখছিলো সবটা। চৌকির তলা থেকে আলতা মাটির ব্যাংকটা বের করে টাকা গুলো রেখে দিল। কান্না পেলো আলতার বুকের ভেতর থেকে উতলে ওঠা কান্না। সে কান্না শুরু করলো, ফুঁপিয়ে উঠলো আর এসব চুপচাপ গভীর মনযোগে দেখতে থাকলো শিশির। গোলাপি বরণ মুখখানা মুহুর্তেই লালচে আভায় রক্তিম হয়ে উঠলো। হিংসে হয় শিশিরের, এই মেয়েটাকে এত সুন্দর হতে কে বলেছিল? শিশিরের তো ভয় হয় সারাক্ষণ নজর না লেগে যায় কারো। আলতায় শুধু শিশির ফোঁটা গড়াবে, আলতা শুধু শিশিরেই মিশে যাবে। এমনটা না হলে দম আটকে মরেই যাবে এই শিশির।
চলবে
ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৯
এসএসসি প্রথম পরীক্ষার দিন সন্তানের সাথে বাবা-মা থাকবে এটাই হয়ত সব সন্তানের কাম্য। আলতারও ব্যতিক্রম নয়। আলতার পরীক্ষার হল পড়েছে উপজেলা হাই স্কুলে। সকাল থেকে শিশির দু বার কল দিয়ে এটা ওটা অনেক কিছু বুঝিয়ে বলেছে৷ ভয় পেতে বারণ করে দিয়েছে বারংবার বলে দিয়েছে মাথা ঠান্ডা রেখে যেন পরীক্ষা দেয়। কোন কিছু কমন না পড়লেও যেন ঘাবড়ে না যায়। মোটামুটি রকমের সব বিষয়েই সতর্ক করলো, বুঝিয়ে দিল। আগে থেকেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছে আহসানুল্লাহ। গাড়িও এসে হাজির যথা সময়ে, নকশি আর আলতাও তৈরি। কিন্তু আওলাদ এসে এখনো পৌঁছায়নি। সময় বসে থাকবে না তার জন্য আর তাই বিরক্ত হলো আহসানুল্লাহ। নকশি বলল, “আমরা চলে যাই ভাই।তাঁর যদি ইচ্ছে হয়ই যাওয়ার আলাদা চলে যাবে।”
আলতার একটু মন খারাপ হলো। কত আশা নিয়ে সে অপেক্ষা করছিল তার সাথে আজ আব্বা-মা যাবে। কিন্তু হলো না তার ইচ্ছে পূরণ। আহসানুল্লাহ সায় দিতেই নকশি আর আলতা উঠে বসলো অটোতে। অটো চলতে শুরু করলো। বাড়ির পথ ছেড়ে বাজারের সামনে আসতেই দেখা গেল এক রিকশায় বসা আওলাদ। সে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। আলতার চোখে পড়তেই সে ডেকে উঠলো ‘আব্বা’ বলে। আওলাদও ডাক শুনতে পেয়ে রিকশা থেকেই পেছনে ফিরে তাকালো। অটো থামিয়েছে নকশি। আওলাদ রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ব্যস্ত পায়ে অটোতে গিয়ে উঠলো। আঁড়চোখে একবার নকশিকে দেখে নিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলল, “বাজারে আসার আগেই অটো নষ্ট হইয়া গেছে তাই কতখানি হাইট্টা আইসা এখন রিকশা পাইছি তাই দেরি হইয়া গেছে।”
“আচ্ছা সমস্যা নাই আব্বা এখনো সময় আছে। আমরাই তাড়াতাড়ি বের হইছি।”
আলতা খুব স্বচ্ছন্দ্যে বাবার সাথে কথা জুড়ে দিলো৷ নকশি চুপচাপ শুনতে লাগলো তাদের বাবা মেয়ের কথোপকথন৷ গন্তব্যে পৌঁছে আলতা হলরুম খুঁজে ঢুকে পড়লো নির্দিষ্ট রুমে। নকশি আর আওলাদ হলরুম থেকে একটু দূরে স্কুল মাঠের এক কোণে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মতো আরো অসংখ্য অভিভাবক গণ মাঠ জুড়ে এদিক ওদিক হাটছে, কেউ কেউ ঘাসের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসে পড়ছে। অনেকেই হাতে বাদাম, বুট এটা সেটা খেতে খেতে গল্প জমিয়ে দিচ্ছে৷ নকশির পরিচিত অনেকেই আছে আশপাশে। অনেকে উৎসুক নজরে আবার নকশির পাশের আওলাদকেও দেখছে। নকশি ভালোভাবে চারপাশ দেখে নিল। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই চাইলে বসা যায় ঘাসের ওপর। মাথার ওপর বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে তাই এপাশে ছায়াও আছে কিছুটা। নকশি বলল, “এখানে বসলে ভালো হতো আমার একটু কথা ছিল।”
আওলাদ দ্বিমত করলো না। নকশির দেখানো জায়গায় বসে গভীর আগ্রহে তাকালো তার দিকে৷ মনে মনে বলল, “এমন কিছু কইয়ো নকশি যা শুনলে অন্তরডা শীতল হইবো এতগুলান বছর পর। বহুত ভালোবাসি আমি তোমার ফিরা আসার অপেক্ষায় আছি বউ।”
মনের কথাগুলো মনে রেখেই আওলাদ বলল, “কও কি কইবা।”
“আইন-কানুনে যেভাবে হয় সেভাবে তালাকনামার ব্যবস্থা করেন আমি কোন দ্বায় ছাড়াই সব শেষ করতে চাচ্ছি।”
ঝলমলে আকাশটা হঠাৎ করেই যেন মেঘে ঢেকে কালো হয়ে গেল। মেঘমেদুর ছায়া এসে পড়লো আওলাদের শ্যামবর্ণা মুখটার ওপর। নকশি চোখ তুলে দেখলো না একবার তার পাশে বসা মানুষটার অন্তরের ভেতরে জ্বলে যাওয়া অঙ্গারের রঙটা কেমন তার বাহ্যিক রুপটাকেও অন্ধকার করে ফেলেছে। আওলাদ মাত্রই তো শুনতে চাচ্ছিলো তাদের একসাথে থাকার কথাটা আর নকশি কিনা বলল তার বিপরীত! বুকটা কেমন যেন আচমকাই ভেঙেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। হাহাকার করে উঠলো ভেতরে ভেতরে আর সেই হাহাকার বেরিয়ে এলো চোখের কার্ণিশে জল হয়ে। নকশি দেখলোই না আওলাদের চোখ ভরো ভরো হয়ে গেছে। সে আপনমনে আরও বলে গেল, “আমি খুব শিগ্রই বিচ্ছেদ চাই। আপনার কাছ থেকে কোন প্রকার খোরপোশ বা মেয়ের দ্বায়িত্ব কিছুই গছাবো না শুধু নিয়ম কানুন মেনে তালাকনামা দিয়ে দিবেন।”
নকশি বলে চলল আওলাদও শুনতে থাকলো। সে টের পেল তার কান্না উতলে উঠছে কিন্তু পুরুষ মানুষের কি কাঁদতে আছে! সে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, বারংবার চোখের পাতা ঝাঁপাতে লাগলো এতে হয়তো জলটুকু গড়িয়ে পড়বে না। আরো কিছু সময় সেভাবেই চুপচাপ রইলো কিন্তু নকশিকে সে কোন জবাব দিলো না। একটু পর আমি একটু আসছি বলে জায়গাটা ত্যাগ করলো আওলাদ।
“কি ব্যাপার বন্ধু এত চিন্তিত কেন আজ?”
ক্লাস নেই আজ তবুও ক্যাম্পাসে এসে চিন্তিত মুখে ঘুরছে সকাল থেকে শিশির। তার খোঁজে তার বন্ধু তন্ময়ও এসেছে ক্যাম্পাসে। দীর্ঘক্ষণ পাশাপাশি পা চালিয়েও যখন শিশিরের কোন হেলদোল দেখলো না তখনই প্রশ্ন করলো তন্ময়। উত্তর দেবার মত যা আছে তা শুনলে নিশ্চয়ই এখন খুব হাসাহাসি করবে ছেলেটা। আগেও এমন করেছে সে আর তাই শিশির কোনমতে এড়িয়ে যেতে চাইছে ব্যাপারটা। সে উল্টো প্রশ্ন করলো, “আমাকে খুঁজছিলি কেন?”
“তা ভুলে গেছি, তুই বল তোর কি হলো? এত সকালে মাথায় চিন্তার বোঝা রেখে পায়চারী করছিস কেন?”
হাতঘড়িটায় নজর বুলিয়ে দু আঙ্গুলে আবার কপালটা একটু ঘষলো শিশির। মাথাটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে তার। ব্যথার কারণ পেটের খিদে জেনেও সে এখনো কিছু পেটে দিতে পারেনি৷ তন্ময়ের সাথে পরিচয়টা সোহা আর অনুর আগে হয়েছিল। একঝাঁক ছেলে একই ডিপার্টমেন্টের হওয়া সত্ত্বেও পরিচিত ছিল না তারা। কোন এক নোট নিয়ে ডিপার্টমেন্টে শিশিরের নামের হৈ চৈ পড়েছিল তা থেকেই অনেকে যেচে পড়েই পরিচিত হয় শিশিরের সাথে। তার মধ্যে তন্ময়ও একজন ছিলো। সবার সাথে বন্ধুত্ব হয়নি গুনে, বেছে কয়েকজনের সাথেই হয়েছিল। এরমাঝে তন্ময় ভালো বন্ধু বলা যায় বেস্ট ফ্রেন্ড উপাধি পাওয়ার মত একজন হয়ে উঠেছে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর সেই বন্ধুত্বে তুমি শব্দের বিলুপ্তি ঘটে তুই শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল। তারপর কত গল্প, আড্ডা আর ধীরে ধীরে মনের কথা, প্রিয় মানুষদের কথাও জানাজানি হয়েছে। শিশির কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইলেও তন্ময় হঠাৎ বলল, “আজ থেকে তো এসএসসি পরীক্ষা শুরু। ওহহো বন্ধু তুই তোর মারবেলরানীর জন্য চিন্তিত?”
তন্ময়ের কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলো শিশির। সেই কবে আলতার মারবেল খেলার গল্প বলেছিল তখন থেকেই সে কথায় কথায় আলতাকে মারবেলরানী নামে সম্মোধন করে। সে তো এও ঠিক করেছে শিশিরের সাথে যদি আলতার বিয়ে হয় তবে সে আলতাকে মারবেল ভাবী বলে ডাকবে তাদের বিয়ের দিন।
তন্ময়ের হাসিঠাট্টা চলল অনেকক্ষণ তারপর অনেকটা জোর করেই শিশিরকে নিয়ে নাশতা করালো। দুপুর ঠিক দেড়টায় শিশির ফোন দিলো নকশিকে। আলতা তখন তার বাবার পাশে বসে পাঁচ টাকায় কেনা রঙিন আইসক্রিম খাওয়ায় ব্যস্ত। নকশি ফোন রিসিভ করতেই শিশির জিজ্ঞেস করলো, “আলতার পরীক্ষা কেমন হলো ফুপুআম্মা।”
“বলল তো ভালোই। প্রশ্ন চেক করলাম কমনই দেখছি বাকিটা সে তার খাতায় কি লিখেছে সেই ভালো জানে।”
“কি করতেছে এখন সে?”
“কি আর করবে বাপ আহ্লাদ করে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে আর সে বসে খাচ্ছে। নিউমোনিয়া, ঠান্ডার কথা হয়ত বাপ বেটি দুজনেই ভুলে গেছে। দেবো আলতাকে?”
শিশির তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো “দেন”
“আলতা ধর শিশির ফোন করেছে পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস বল।”
হাতের আইসক্রিমটা এখনো
পুরোপুরি শেষ হয়নি। শেষের অংশটুকু চিবিয়ে গিলে ফেলে পরেই ফোনটা হাতে নিলো। কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই শিশির ধমকালো, “সালাম দেওয়া ভুলে গেছিস?”
“আসসালামু আলাইকুম।”
ঝড়ের গতিতে সালাম দিলো আলতা। শিশির জবাব নিয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস?”
“ভালো।”
“শুধু ভালো?”
“অনেক ভালো।”
“অনেকটা কেমন?”
“শুরু থেকে শেষ সবগুলো নং ঠিকঠাক দিয়েছি৷ কিছু বাদ পড়েনি, বানান চেক করেছি। লেখায় কাটাকাটি একদম করিনি, ওভাররাইটিংজ করিনি৷ কারো থেকে দেখাদেখি করিনি কাউকে দেখাইওনি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” বলেই ফোন কেটে দিলো শিশির। কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থেকে হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেল অথচ তার হাসি থামার নাম নেই। ভাগ্যিস সে তার রুমে একা আছে নইলে অন্যরা তো দেখলে তাকে পাগল ভেবে পাগলাগারদে রেখে৷ আসতো।
আলতা ফোন মায়ের হাতে দিতেই ভড়কে গেল। নকশি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে তার বাবাও।
“কি হয়েছে?”
“তুই একদমে এতসব কি বললি?”
“কি বললাম আবার! শিশির ভাই-ই তো জিজ্ঞেস করলো কেমন ভালো দিয়েছি পরীক্ষা। ”
“আর সেই ভালোর নমুনা তুই সবিস্তরে দম ফেলে জানালি তাকে। গাধী কোথাকার!” কথাটা বলেই নকশিও মুচকি হাসলো। আওলাদ স্থির দৃষ্টিতে দেখলো সেই হাসিটুকু। ঠিক ষোলো বছরই হবে হয়ত এতগুলো বছর পর সে নকশির হাসি দেখলো। বুকটা আবারও চিনচিন করে উঠছে নকশির বলা কথাটা মনে পড়তেই। সে বিচ্ছেদ চায় অবশ্য দুজনের মধ্যে তো কিছু ছিলোই না নামমাত্র তালাকনামাটা বাকি শুধু। আওলাদ মনে মনে ঠিক করে নিলো যা নকশি চায় তাই হবে। আহসানুল্লাহ ভাই তো বলেই দিয়েছে নকশিকে তিনি সংসারী করবেন। পাত্রও নাকি দেখে রেখেছেন। শুধু মেয়ের দ্বায়িত্ব থেকে তাকিয়ে সরিয়ে যেন না দেয় সেই আরজি জানাবে। খুব সাধ জাগে মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখার কিন্তু সাহসে কুলোয় না আবদার করার। ভাড়া করা অটো আবার যথাসময়েই এসে হাজির হয়েছিল৷ আওলাদ বাড়ি পর্যন্তই গেল নকশি আর আলতার সাথে। বাড়ির ভেতর তাদের পৌঁছে দিয়ে পরেই ফিরে গেল। আলতার পরীক্ষা চলাকালীনই আওলাদ কিছুটা ছুটোছুটি করে কাগজপত্রের ব্যবস্থা করলো তালাকনামার। এরই মাঝে আলতার আরো তিন পরীক্ষা হয়ে গেল। আলতার সাথে একদিন গেল আহসানুল্লাহ, একদিন শিফা আর জয়তুন দু জা একসাথে। তারপর আবার নকশির পালা। আওলাদ আর আসেনি সে কদিন। তবে নিয়ম করে একবেলা মেয়েকে ফোন প্রতিদিনই করেছে সে। আলতার পঞ্চম পরীক্ষার দিন আওলাদ এলো খুব ভোরে। আলতা তখনও ঘুমে ছিল৷ আওলাদ রান্নাঘরে থাকা নকশির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে অসহায়ের মত বলল, “তালাকের বন্দোবস্ত হয়ে যাইবো আর এক সাপ্তাহ পরে। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ ছিলো তোমার কাছে।” আওলাদ কথাটা বলতেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো নকশি। আর তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো আলতার কণ্ঠস্বর, “কিসের অনুরোধ আব্বা!”
চলবে