#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৮+২৯.
রঙমাখা ভোর,
ভিজে রোদ্দুর!
শিশিরের বিন্দু;
মন অতল সিন্ধু
তুমি ছুঁয়ে দিও শিশিরের মত ফোঁটায় ফোঁটায়
আমি আলতা হয়ে রবো মিলিয়ে তোমার……
আরও কিছু শব্দের যুগলবন্দী মনে মনেই তৈরি করতে চেয়েছিল আলতা। কিন্তু তার শব্দ ভান্ডার এতই অল্প যে সে চেয়েও আর কিছু লিখতে পারেনি। ফোন কিবোর্ডে লাইনগুলো লিখে চুপটি করে বসে রইলো কিছু সময়। তবুও পারলো না শিশিরকে সেন্ড করতে এই ছোট ছোট বাক্যগুলো। মনের কোণে আজ শিশির জমেছে আলতার গলে যাওয়া বাকি। তবুও চঞ্চল মন সকল বৈরী সময়কে ভুলে আজ আবার চঞ্চল, ছটফটে হতে চাইছে। রাত শেষ হতেই তার পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ জেগে উঠছে শিশিরের সামনে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। রাতভর ঘুমটাও খুব দু*শমনি করেছে তার সাথে আজ। এখন এই সকালেই মাথা ভার হয়ে আছে সারাটা দিন কেমন কাটবে তা কল্পনা করতে করতে। ফোনের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তার নতুন রুমমেট টুম্পা তার বয়সীই তবে মেয়েটি অন্য কলেজে পড়ে। টুম্পা প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ফেসপ্যাক লাগিয়ে মুখ দেয়। মেয়েটা বলেছে এই ফেসপ্যাক দিয়ে তার ত্বক দারুণ চকচক করে একদম যেন কাচের ত্বক তার। আলতার মনে হলো তার ত্বকটা আগের চেয়ে কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এখন হুট করে কেউ তাকে দেখলে শ্বেতাঙ্গ বিদেশি বলে ভুল করে। তার কি একটু রূপচর্চা করা দরকার! এমন কোন টোটকা নেই যা,দিয়ে তার ত্বকটা খুব সাধারণ বাঙালির মত মনে হবে! টুম্পা কি একবার জিজ্ঞেস করবে এ ব্যাপারে? কথাটা মাথায় আসতেই সে ফিরে তাকালো তার সামনের দিকের বিছানাতে৷ কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে টুম্পা এখন ডাকলে হয়ত রাগ করবে। আলতা চলে গেল মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হতে তখনই টের পেল ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভাইব্রেশনে থাকায় কল এসে কাঁপছে বুঝতে পেরে আলতা ফোনটা হাতে নিলো৷ ‘শিশির ভাই’ নাম দেখতেই বুকের ভেতর তিরতিরিয়ে হাওয়া লাগল। সত্যিই কি আজ তেমনটা হবে যেমনটা সে ভাবছে! আজই শিশির ভাইয়ের মনের কথা জানা হয়ে যাবে। ভালোবাসার মৌখিক দখল আজই নেবে তারা দুজন দুজনার। যদি আলতা না বলতে পারে শিশির ভাইকে তার ভালোবাসার কথা! না না আজ মুখে মুখে বলে দিতে হবে সবটা। শিশির ভাই দূরে গিয়ে যদি ভুলে যায় তাকে! তারচেয়ে ভালো আজই লজ্জা শরমকে তালাবদ্ধ করে মনটাকে বিছিয়ে দেবে তার তরে। এরপর শুনতে হবে অপেক্ষার পালা। দূর থেকে দূরত্বের যন্ত্রণায় পিষ্ট হবে দুজন তবুও অপেক্ষার মধুময় স্বাদ আস্বাদন করে এক হবে। কত কি ভাবনায় কল কেটে গিয়ে পুনরায় বাজতেই আলতার ভাবনা ছেদ হলো। এবার রিসিভ করে কানে তুলতেই ভেসে এল সেই আদেশপূর্ণ কণ্ঠস্বর।
“এখনো ঘুমাচ্ছিলি?”
“নাতো।”
“তাহলে কল ধরতে এত সময় লাগল কেন?”
“রুমে ছিলাম না।”
“আচ্ছা শোন, শাড়িটা পরে আসিস। আর সময় চেঞ্জ করেছি নয়টার মধ্যেই চলে আসিস রেস্টুরেন্টে। পারবি না?”
শিশিরের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আজ্ঞাবহ দাসের মত জবাব দিলো, “পারব।”
“ঠিকঠাক পারবি তো না আমি আসব ভেবে বল।”
“আমি পারব। এখান থেকে রিকশায় দশ মিনিটের পথ আমি আগেও তো গিয়েছি অনেকবার।”
“আচ্ছা তবে চলে আয় আমি অপেক্ষা করব।”
শিশির আর কোন বাক্যব্যয় না করে ফোন কাটল৷ আলতা ভাবল আগে সময় দেখা যাক কয়টা বাজে তারপরই না হয়। সে ফোনের স্ক্রীণেই দেখল সময়টা আর সাথে সাথেই মাথায় হাত। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তারমানে আর দেড় ঘন্টা। তার তো গোসল করে চুল মুছতেই এক ঘন্টা পেরিয়ে যাবে। শাড়ি পরে সেজে বের হতে হতে নয়টা কি খুব বেশিই কম সময় হলো না! বক্ষপিঞ্জরের তীব্র ছটফটানি গবার আলতাকে আরও এলোমেলো করে দিল। সে দপ করে বসে পড়ল বিছানায়। গুণে গুণে একটা ঘন্টা তার ওভাবেই কেটে গেল বসে থেকে। টুম্পা যখন ঘুম থেকে উঠল তখন আলতাকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। আলতার অসাড়, অচল বসে থাকা দেখে আতঙ্কিত গলায় ডেকে উঠলো, “কি হয়েছে আয়শা এভরিথিং ইজ ওকে!”
এই এক ডাক আবার আলতাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো যেন। সে বসা থেকে উঠে অস্থির পায়ে ব্রাশ নিয়ে বেরিয়ে গেল বাথরুমের উদ্দেশ্যে। পাঁচ মিনিটেই সে মুখহাত ধুয়ে এসেছে। এই মুহুর্তে গোসল করা সম্ভব নয় ভেবে নিজের ছোট্ট কাপড়ের ড্রয়ারটা থেকে শাড়ির ব্যাগটা বের করল। শিশির দেওয়া সেই জারুলরঙা শাড়ি ; এর সঠিক নাম বোধহয় ল্যাভেন্ডার নাহার বলেছিল। আলতা দু হাতে শাড়িটাকে মেলে দেখে নিলো ভালো করে। এর সাথে নতুন ব্লাউজটা সাদা রঙের এনেছে সে । নাহার বলেছিল এই রঙের শাড়িতে সাদা ব্লাউজ সুন্দর মানায় তাই আলতাও তাই কিনেছে। একা একা শাড়ি পরাটা ভালো নাও হতে পারে ভেবে টুম্পাকে বলল শাড়িটা পরিয়ে দিতে। কয়েক মিনিট সে আর টুম্মা মিলে জোর হাত লেগে পড়লেও শাড়িটা ঠিকঠাক পরানো হয়নি৷ আলতা ফোনের পর্দায় সময় দেখে হতাশ হয়ে গেল। শিশির ভাইয়ের দেওয়া সময় মত সে কিছুতেই পৌঁছুতে পারবে না ভাবতেই কান্না পাচ্ছিলো। তখনই ফোন বেজে উঠলো আলতার। এবার মনে হলো শিশির ভাই রেগে যাবে। তবুও ভয় নিয়েই ফোন তুলল সে। টুম্পা তখনও শাড়ির কুচি তোলার চেষ্টা করছে। আলতা ফোন ধরে হ্যালো বলতেই শিশির জানতে চাইলো সে কোথায়।
“আমমম আমি আমি শাড়ি পরতে পারছি না।” কাঁপা কণ্ঠস্বরে জবাব দিল আলতা। কান্নার ঢেলা আটকে আছে গলায় তা বুঝতে বাকি নেই শিশিরের। খুব হাসি পেল ভাবতেই মেয়েটা তাকে এখনো আগের মতই ভয় পায়। শিশির যে তাকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে এ কথা কি আলতা জানে না! না জানার তো কথা নয়। শিশির শুনেছে মেয়েদের নাকি অদৃশ্য এক তৃতীয় চক্ষু আছে তাদের এক দারুণ বোঝার ক্ষমতা আছে যা দ্বারা তারা বুঝতে পারে কোন ছেলের তাদের প্রতি থাকা সম্মোহন, মোহ বা ভালোবাসা। তাহলে আলতারও নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে যাওয়ার কথা শিশির ভাই তাকে কতোটা ভালোবাসে! শিশির আলতার ভয় টের পেয়েই তাকে শান্ত করতে বলল, “শাড়ি পরতে না পারলে বাদ দে।”
মজা করে আরেকটু বলল, তুই যেমন আছিস তেমনই চলে আয় তোকে আর কে দেখবে! আমি তো তোকেই এমনিতেই চোখে হারাই।”
শেষ বাক্যটা বড্ড অস্পষ্ট রেখে উচ্চারণ করলো শিশির। আলতাও তাই বুঝতে পারলো না কথাটা। শিশির পাশ থেকে কেউ হয়ত ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে তা শুনে শিশির আবার আলতাকে বলল, “তুই সময় নিয়েই দ্যাখ শাড়িটা পরতে পারিস কিনা। দেরি হলে সমস্যা নেই। আচ্ছা আমি রাখছি তুই তাড়াহুড়ো না করে সাবধানে আসিস।”
শিশির কল কেটে ফোন পকেটে রাখতেই অনু কনুই খামচে ধরলো তার।
“চলে আসছে নাকি সময় লাগবে আরো?”
“ও এখনো শাড়ি পরতে পারছে না বলে মন খারাপ করছে। আরও সময় লাগবে আসতে।”
“গ্রেট! তাহলে আমাদের কাজ হয়ে যাবে কি বলিস?” ব্যগ্র গলায় অনু বলল। কিন্তু শিশিরের ভালো লাগছে না এসব অভিনয়। যেখানে সম্পর্কটা রাখার ইচ্ছে নেই সেখানে এত লুকোচুরির কি আছে সরাসরি ব্রেকআপ কর বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। আংটি ফিরিয়ে দেয় পরিবারকে জানিয়ে তাহলেই তো হয়ে যায়। কিন্তু না সোহা আর অনুর কথা সেভাবে সম্ভব নয় তাওহীদকে চরমভাবে অপমান না করলে সে অনুর পিছু ছাড়বে না। শিশির বলল সেটা কি করে সম্ভব আর তাতেই দুজনে চমৎকার একটা পরিকল্পনা করেছে বলে জানালো। সব শুনে শিশির বলল, “বলির পাঠা তোরা আমাকেই কেন বানাবি!”
কিন্তু দু বান্ধবী তার জবাবে শুধু বলেছে, “তুই-ই তো তুরুপের গুটি তাই তোকেই লাগবে।”
শিশির ঠিকঠাক তখনও বোঝেনি তবে এখন বুঝতে পারল মূল ঘটনা যখন তাকে বলে দেওয়া হলো তাওহীদ রেস্টুরেন্টে পা রাখতেই কি কি করতে হবে।
আজ বহুদিন বাদে পদ্মদিঘি বাজারে আড্ডা জমেছে আহসানুল্লাহর বন্ধুদের। বয়স এখন মধ্যপথে সংসারও সকলের ভরাট। তার মধ্যে শুধু এখনও ছোট সংসার রয়ে গেল দুই বন্ধু জহির আর আহসানের। তবুও আর বছর কয়েকের মাঝেই হয়ত আহসানুল্লাহ ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে নাতিপুতির মুখ দেখবে কিন্তু জহিরের দিকটাই লম্বা অপেক্ষার। মজা করে কেউ কেউ তো আহসানকে উস্কাচ্ছে, “দোস্ত তুই আরেকটা বাচ্চা কাচ্চা নিয়া ফ্যাল। কপাল ভালো হইলে একটা মেয়ে যদি হইয়া যায় তাইলে জহিরের পোলার লগে তোর মাইয়া বিয়া দিয়া আমরা ডবল সম্পর্কে ডবল খাওয়া পামু।”
আহসানুল্লাহ তো বন্ধুদের কথা শুনে মেকি ধমকে উঠলেন, লজ্জা শরমের মাথা খাইলি নাকি! জহিরের তো প্রথম সন্তান সেটা মানা যায় আর আমার শিশির তো মাশাআল্লাহ বড় হয়ে গেছে এখন আবার নিজের সন্তান কি এখন তো নাতিপুতির শখ মনের মধ্যে। এই যে বাড়ির বড় ছেলের জন্য তো মেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু দেখি শখটা কবে পূরণ হয়।” কথাটা বলতে বলতে শরতের দোকানের দিকে তাকালেন আহসান। শরত তখন দোকানের গদিতেই বসে আছে আর আহসানদের আড্ডা চলছে রফিকের দোকানে বসে। মূলত আজ জহির সব বন্ধুকে একত্রে সকালের চা নাশতা করানোর জন্যই বসিয়েছিল এখানে। ছেলে হয়েছে শুধু সেই উপলক্ষে মিষ্টিতে পোষায়নি বন্ধুদের তাই আজ নাশতার আয়োজন। কিন্তু আহসানের মুখের কথা শুনে রফিক একটু কেমন করে যেন তাকালো তার দিকে। পাঁচ ছয়জন বন্ধুর মাঝে বসে থাকা আহসানকে সে কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করে বসল তখনই, “মাইয়া খুঁজোস মানে কি শরতের লগে নকশির মাইয়ার বিয়া দিবি না!”
উপস্থিত সকলের হাতেই আছে চায়ের কাপ আর সামনে আছে বাজারের মোটা পরোটা আর ডালের সবজি। রফিকের কথায় প্রত্যেকেই এবার মুখ তুলে তাকালো একবার রফিক তো একবার আহসানের দিকে। সকলেরই এবার মনে ধারণা এলো শরতের সাথে বুঝি নকশির মেয়ের বিয়ে ঠিক। কিন্তু তাতে হতবিহ্বল দেখালো আহসান আর জহিরকে। কারণ দুজনেরই কারোই তেমন কিছু মনে আসেনি কখনো আর না কোনদিন এমন কিছু আলোচনা হয়েছে তাদের পরিবারে। মুহূর্তের মাঝেই আবার বন্ধু মহল গরম হলো এই আলোচনায়। আহসান স্বাভাবিক গলায় বলল, “আরেহ না তেমন কিছু তো না। আলতা এখনও কত ছোট আর শরতকে তো এ বছরই আমরা বিয়ে করাতে চাইছি।”
“ওহ, তার মানে হইলো পোলা মাইয়া দুইটা গোপনে সম্পর্কে আছে!”
রফিকের বলার ধরণটা এবার কানে বাজল খুব সকলেরই। আহসান অবশ্য রফিকের প্রথম কথাতেই বুঝেছিলেন কিছু একটা তো ইঙ্গিত করছে রফিক কিন্তু এবার তো ভরা মজলিশে অপ্রস্তুত কারবার। জহিরেরও যে অস্বস্তি হচ্ছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। বন্ধুদের সামনে যেহেতু এমন এক কথা উঠলো তখন খোলাখুলি কথা হওয়া দরকার নয়ত পরে বাকিরা পিঠ পিছে ঘাটাঘাটি করে আরও ঘোলা করবে সবটা। তাই আহসান এবার ঝেড়ে কাশল। রফিকের উদ্দেশ্য করে বলে, তোর কথা ঠিক বুঝিনি রে রফিক কি বলতে চাইলি? কারা গোপন সম্পর্কে আছে!
“শরত আর তোর ভাগ্নি আলতা”
রফিকের ছোট এই একটা বাক্য উপস্থিত বাকিদের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক করল। আহসান বিচলিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো বন্ধুর দিকে৷ সে কি মশকরা করলো এই মুহুর্তে!
“তোর এমন কিছু কেন মনে হলো?”
আহসান সপ্রতিভ কণ্ঠেই প্রশ্ন করলো রফিককে৷ ভেতরের বিচলিত ভাবটা সকলকে প্রকাশ করার চেয়ে স্বাভাবিক থেকে ঘটনা জানাটা উচিত বলে মনে হলো তার। ব্যক্তিত্বের ধারও এ পর্যায়ে অবিচল থাকলো তার। রফিক এবার যেন সুযোগ পেল বিগত কয়েক মাস ধরে চেপে রাখা কথাটা ফাঁস করার। সে মনে করিয়ে দিলো বন্ধুকে গত শীতের কথা। আলতা আর শরত নদীর পাড়ে কাশফুলের ক্ষেতে বসে… এতটুকু বলেই সে মুখটাকে এমন ভাবে বাঁকালো যেন দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপারটাই সেখানে সে ঘটতে দেখেছিল। তার কথা শুনে প্রত্যেকেরই চোখে বিষ্ময় আর কৌতূহলের ঝিলিক৷ এলাকায় প্রায় প্রত্যেকের চোখে শরতের অবস্থান একজন সৎ, নিষ্ঠ আর চরিত্রবান যুবক হিসেবেই। সে ক্ষেত্রে শরতের নামে এমন কিছু শোনা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আহসান কিছু বলবে তার আগে জহিরই বলল, “তুই বোধহয় ঠিকঠাক দেখিসনি রফিক। আলতা তো কতগুলা মাস ধরেই ঢাকায় আর শরতকে তুই চিনিস না সে কেমন ছেলে?
” আরেহ জানি বইলাই এতমাসেও এই কথা তোদের বলি নাই। ভাবছিলাম হয়ত তোরাই বিয়াশাদী ঠিক করছোস পারিবারিক ভাবে কিন্তু এখন আহসানের কথায় বুঝলাম গোপনে চলতাছে সব। আর জহির তহন আলতা গ্রামেই ছিল সাথে তো আরো দুইটা শহরের মাইয়া ছিল নৌকায় ঘুরছে।”
রফিকের এবারের কথায় আহসান আর জহির দুজনেরই টনক নড়লো যেন। সত্যিই কি তবে ছেলে মেয়ে দুটোর মাঝে অন্য সম্পর্ক আছে? এ কথা তো সত্যি শীতের সময় আলতা গ্রামে এসেছিলো সাথে শিশিরের দুই বান্ধবী। রফিক যা বলল তাতে বোঝা গেল ওই একদিন শাড়ি পরে ওরা সবাই নদীর পাড় গেল। কিন্তু শরত সাথে ছিল না তো সেদিন তাদের তবে কি শিশির ছিল! এই কথাটা একমাত্র আহসানের মাথাতেই এলো কিন্তু আবারও দ্বিধায় ভুগলো। রফিক তো শিশির আর শরত কাউকে না চেনে না সে কেন শিশিরকে দেখে শরতের নাম বলবে? নাশতার পর্বটা খুব বেশি আর জমলো বন্ধুদের৷ যে যার নিজ কাজে চলে গেলে আহসানও নিজের দোকানে গিয়ে বসলো। জহিরও চলে যাচ্ছিলো আবার কি মনে করে আহসানের কাছে গেল।
“নকশিরে কি বলব কোন কিছু এ বিষয়ে?”
“না থাক, হুট করে ওকে কিছু বলবি পরে সে চিন্তিত হবে তার চেয়ে ভাবি আগে ঘটনা কি আজ আবার শরত বাড়ি থাকব না আমরা রাতে ঢাকায় যাব শিশিরকে এয়ারপোর্টে দিতে।”
সকালের সময়টা রেস্টুরেন্টে কোলাহল কম। শিশির একবার চারপাশে ভালো করে নজর বুলিয়ে নিলো। সোহা দাঁড়িয়ে আছে রেস্টুরেন্টের ঠিক দরজামুখো। এর পেছনে গোপন এক প্ররোচনা সংঘটিত আছে। রেস্টুরেন্টের কাঁচ ঘেরা দরজা বরাবরই শিশিরদের টেবিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে অনু আর শিশির। সোহা খেয়াল করেছে রাস্তার পাশে তাওহীদের গাড়ি। লোকটা গাড়ি ডোর লক পায়ে পায়ে উঠে আসছে দরজা অভিমুখে তা দেখতে পেয়েই সোহা ইশারা করলো শিশিরকে। তৎক্ষনাৎ এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল শিশির অনুর সামনে। হাতে তার ছোট্ট একটা বক্স তা দেখে মনে হচ্ছে সেটা কোন রিং বক্সই হবে হয়ত। তাওহীদ কাঁচের দরজা ঠেলে আধখোলা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো শিশির অনুর অবস্থান দেখতেই। তার সহজ সরল দৃষ্টি নিমেষেই কঠিন হয়ে উঠলো, চোয়াল শক্ত হলো, হাত দুটোও আচমকাই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। সোহা আড়ঁচোখে সেই দৃশ্য দেখেই সরে পড়ল জায়গাটা থেকে হাতে তার ফোন ভিডিও অন করে ভাব এমন করলো যেন সে দৃশ্যটুকু ক্যামেরা বন্দী করতেই এই দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরিকল্পনা সফল ভাবেই এগিয়ে চলছে। আলতা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে পা বাড়ালো গন্তব্যে। রেস্টুরেন্টের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো সামনে দাঁড়ানো কোন পুরুষকে দেখে। বিরক্ত লাগল তার লোকটা কেমন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা কি করে ঢুকবে! মনে মনে ভেবে নিয়েছে তার মিষ্টি, মধুর অনুভূতির মুহূর্তে কিছুতেই মুডটাকে খারাপ হতে দিবে না তাই খুব ধীরে ভদ্রতার সাথে বলল, “একটু সাইড দিন আমি ভেতরে যাব।”
লোকটার কর্ণগোচর হলো না বুঝি আলতার কণ্ঠস্বর। সে আবারও একই বাক্য উচ্চারণ করতেই লোকটা একটুখানি সরে জায়গা দিলো অথচ পুরোপুরি চলে গেলো না। আলতা এবার বিরক্ত ভঙ্গিতে আঁচলের কোণ আঙ্গুলে টেনে পা বাড়ালো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আর এক পা বাড়িয়ে থমকে গেল আলতা। চোখ দুটো কি অতিরিক্ত ফোন চালনায় নষ্ট হয়ে গেল! সে কি ভুলভাল দেখছে এখন এই আলোয় ঝলমল জায়গাটাতেও। মাথার ভেতর ভোমরের ভনভন আওয়াজের মতই কেমন আওয়াজ হচ্ছে। হাত পা গুলোও কেমন অসাড় লাগছে। চোখ ছলছল গলায় আটকে গেছে কান্নার ঢোক। সামনে বাড়িয়ে দেওয়া পা এবার ঠিক পেছনে ফিরে এলো আগের জায়গায়৷ অস্পষ্ট সুরে শুধু উচ্চারিত হলো, “শিশির ভাই!”
আলতার সেই অস্পষ্ট সুর দরজায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটা ঠিকই শুনলো। বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুনটাকে পাত্তা না দিয়ে সে ফিরে তাকালো পাশে দাঁড়ানো শাড়ি পরিহিতা মেয়ের দিকে। তাওহীদের কয়েক মিনিট সময় লাগলো আন্দাজ করতে মেয়েটির বয়স। প্রথমে সে প্রাপ্ত বয়স্ক কেউ বলেই ধারণা করেছিল। কিন্তু মেয়েটি যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাইরে সিঁড়িতেই বসে পড়ল তখন আর তাওহীদও দাঁড়ালো না অনু শিশির রঙ্গমহল দেখতে। সেও মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। বয়স কত হবে ষোলো, সতেরো! কিন্তু নাক, মুখ, চোখ যেন কোন অপ্সরা সে। আর গায়ের রঙ এত গোলাপি! তাওহীদের মনে হলো মেয়েটি বোধহয় ব্রিটিশ বংশদ্ভূত কোন পরিবারের। নয়ত এমন রঙ এশিয়ানদের মধ্যে আর শুধু পাকিস্তানিদেরই হয়ত হয়। অনু আর শিশিরের মুহূর্তটুকু যেমন তার মস্তিষ্কে আগুন ঢেলে দিচ্ছিলো তেমনই শীতল ঢল নামলো এই মেয়েটিকে দেখে। এই মেয়েটা কি ওই শিশিরকে ভালোবাসে! অনুর মত কি শিশিরও ধোঁকা দিলো তার প্রেমিকাকে? এক মুহূর্ত মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি ভেতরে ঢুকে শিশিরকে খুন করে ফেলে কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে দোষী তো অনু শিশিরের সাথে তার কি শত্রুতা!
আলতার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে কান্না চেপে রাখার চেষ্টায়। রাস্তার মানুষজন তাকিয়ে দেখছে এভাবে তার পাবলিক প্লেসে বসে থাকা। বুজের ভেতর যে ঝড় চলে তা কেন অচেনা লোকদের দেখানো! বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা চলে গেল রাস্তায়। খালি রিকশা পেতেই সে ফিরে গেল হোস্টেলে। রুমে ঢুকে গা থেকে টেনে খুলে ফেলল শাড়িটা। কাঁধে, কুচিতে পিন লাগানো অংশ টেনে ছিঁড়ে ফেলল অনেকটা অংশ। দু হাতে শাড়িটাকে ছুঁড়ে ফেলে বসে পড়লো মেঝেতে। আকাশ-পাতাল এক করে কেঁদে উঠল বুক ভাঙা আর্তনাদে। একেই বুঝি বলে প্রতারণা যেমনটা আজ শিশির ভাই করল? কাঁদতে কাঁদতে মনে পড়ে গেল সেই মুহুর্তগুলো যেগুলোতে মিশে ছিলো না বলা প্রেমের অনুভূতি৷ অনেকটা সময় মেঝেতেই পড়ে রইল আলতা৷ ফোন বাজল তার অনবরত। যখন হুঁশ এলো তার সে কান্না থামিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে রাখলো বিছানায় ওপর। কোনমতে শাড়িটাকে গায়ে পেঁচিয়ে ঢুকে গেল গোসলখানায়। কল ছেড়ে বসে রইলো আবারও অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুহূর্তেটুকু।
“will you be my Love?”
এই একটা বাক্য শুনেই তো তার দুনিয়া দুলে উঠেছে। মনে পড়ে গেছে শিশির ভাই তার গার্লফ্রেন্ডকে দেখাবে বলেছিল আর আলতা কিনা নিজেকেই তার গার্লফ্রেন্ড ভেবে বসে আছে! বাথরুমের দরজায় কেউ ধাক্কাচ্ছে বুঝতে পেরে কল বন্ধ করলো আলতা। তড়িঘড়ি কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে বের হলো। ভেজা শাড়িটা দু হাতে মুচড়ে পানি চিপে ফেলে সেটা রুমে নিয়ে একটা পলিথিন খুঁজে তাতে ভরে নিলো। চোখ, নাকের ডগা আর ঠোঁট দুটো ভীষণরকম লাল হয়ে আছে তার। যে কেউ দেখলে নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারবে এই মেয়েটা কোন অসহনীয় যন্ত্রণায় কেঁদেছে। রুমমেটরা তখন কেউ না থাকায় যেন রক্ষে আলতার। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বিছানায় পড়ে রইলো। ভেজা চুলগুলোর পানি টপাটপ পড়ে ভিজতে লাগল বালিশ, চাদর, তোশক সেই সাথে ভিজতে লাগল অন্তর্দেশ অশ্রুমেঘের তুমুল বর্ষণে।
আলতা আর তাওহীদ দুজনেই এসেছিল রেস্টুরেন্টের দরজায় তাওহীদ চলে গেছে সেই সাথে চলে গেছে আলতাও। আর এই আসা -যাওয়া দৃশ্যের একমাত্র চাক্ষুষ স্বাক্ষী হয়ে ছিল সোহানা বিনতে আশরাফ। তাওহীদ চলে যাওয়ার পরও অভিনয় চলল অনেকটা সময়। সেই অভিনয়ের সমাপ্তি টেনে বিরক্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল শিশির। সে সোহার উদ্দেশ্যে বলল, এ্যাই ক্যামেরা অফ করো সোহা। ভিডিও তো এমনভাবে করছো যেন সত্যিই আমি ওরে প্রপোজ করতেছি৷ আমার চঞ্চল পাখিটা এসে না দেখে ফেলে এসব! এ্যাই অনু তোর তাওহীদরে কল দিয়ে দ্যাক সত্যিই আসবে নাকি হুদাই। আর আমার কলিজাটাও এত লেট করছে কেন কে জানে!” বলেই শিশির আলতার নাম্বারে কল দিয়েছিল। এবং তারপর লাগাতার দিয়ে গেল অনেকবার কোন রেসপন্স আসেনি। তারপরই শুরু হয়েছিলো শিশিরের ছটফটানি। আলতা যখন বিছানায় শুয়ে চুল আর চোখের পানিতে ভিজে চুপচুপে তখন অদূরে শিশির ভিজে গেছে চিন্তার শিশিরে। লাগাতার ফোন করে গেল একটা ঘন্টা কোন রিসিভ হয়নি একটাও ফোন কল৷ এরই মাঝে হঠাৎ ফোন এলো অনুর নম্বরে তার মায়ের নম্বর থেকে। ইমিডিয়েট বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ পড়লো। বাধ্য হয়েই অনুকে চলে যেতে হলো বন্ধুকে অস্থির আর চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায়। আলতার রেসপন্স না পেয়ে শিশির যখন পাগল প্রায় ঠিক তখনই সোহা আরও একটা ছক কষে নিলো মনে মনে। শিশিরকে বলল, “চলো আলতার হোস্টেলে গিয়ে দেখে আসি সে কেন আসছে না আবার ফোনও তুলছে না।”
শিশিরের মনে হলো এছাড়া আর উপায় নেই৷ তৎক্ষনাৎ তারা চলে গেল আলতার জন্য হোস্টেলে। সেখানে পৌঁছুতেই শিশিরকে দাঁড়াতে হলো রাস্তার ওপাশে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি সবার নেই। গার্লস হোস্টেল বলেই একমাত্র অভিভাবক হিসেবে যাদের নাম রেজিস্টার করা আছে শুধু মাত্র তারাই ভেতরে যেতে পারবে তাও কিনা ওয়েটিং রুমে। সেক্ষেত্রে আলতার জন্য আওলাদ আর শরতের নাম দেওয়া হয়েছিল। শিশির নিজেই বসিয়েছিল নাম দুটো আর আজ মনে হলো খুব বড় ভুল হয়েছে তার। সোহার কোন সমস্যা হয়নি ভেতরে যাওয়া নিয়ে সে অনায়েসেই চলে গেল। শিশিরের কাছে জেনে গেল রুম নম্বর। মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই ফিরে এলো সোহা। সে প্রথমেই এসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কল কি রিসিভ করেছে আলতা?”
শিশির মাথা নাড়িয়ে জানালো ‘না’। সে প্রশ্নাত্মক চোখে সোহার দিকে তাকাতেই সোহা বলল, “আলতা তো নেই ভেতরে রুম লক। একজন বলল কলেজে চলে গেছে আরও আগেই।”
“তা কি করে সম্ভব! সে আমাকে বলল শাড়ি পরতে পারছে না তারপরও তৈরি হয়ে চলে আসবে বলেছে। কলেজে যাওয়ার হলে ও আমাকে আগেই বলতো কিন্তু তেমন কিছুই বলেনি।” আলতা তার সাথে দেখা না করে কলেজে চলে গেছে তা মানতে চাইলো না যেন শিশির। তার মন বলছে ঘটনা অন্য কিছু কিন্তু কি! আজ বাদে কাল সকালে শিশির পাড়ি দেবে প্রবাসে৷ তারপর দুজনার দেখা হবে না, মুখোমুখি বসা হবে না, কথা হবে না সামনাসামনি দুটো বছর৷ আলতা কি করে থাকবে তখন আজ দেখা না করে! আফসোস হবে না তার শিশির ভাইকে না দেখতে পেয়ে? এই প্রথম ভেতর থেকে কোন দুশ্চিন্তা যেন তাড়া করলো শিশিরকে। সে সোহাকে বোঝাতে চাইলো, তুমি ঠিকমতো দেখোনি৷ ভুল হয়েছে তোমার কোথাও হয়ত তুমি ভুল রুমে খোঁজ করেছো। কিন্তু না সোহা তাকে সঠিক রুমনম্বরটাই বলল৷ সে সঠিক রুমেই খোঁজ নিয়েছে তবুও আলতার খোঁজ পায়নি। অর্ধবেলা শিশির ফোন করতেই থাকলো আলতাকে। এক সময় তার নিজের ফোনটার চার্জ শেষ হওয়ায় হলে ফিরে ফোন চার্জে লাগালো। মাথার ওপর রোদ গনগনে তেজ ছড়াচ্ছে। ঘামে ভেজা শরীরটা দুশ্চিন্তায় যখন নেতিয়ে পড়ছে শিশিরের তখনই মাথায় এলো ফুপুআম্মাকে কল দেওয়ার কথা। নকশিকে ফোন করতেই সে কুশল জেনে নিলো। পরে অনেকটা সংকোচ নিয়েই প্রশ্ন করলো, আলতার সাথে কথা হয়েছে আপনার?
“হ্যাঁ সকালেই তো হলো ওই যে তুমি নাকি নাশতা করাবে সবাইকে কোথায় নিয়ে সেজন্য যাচ্ছিলো৷ তখনই রিকশায় থাকা সময়টুকু কথা হলো পরে বলতেছে চলে আসছে তাই ফোন কেটে দিলো৷ আবার রাতে ভিডিও কল দিব বাবুকে দেখতে। ওর তো এখন কল দেওয়ার রুটিন বদলে গেছে তার ভাইয়ের জন্য।” হাসতে হাসতে মেয়ের কথা বলতে লাগল নকশি। তার কথা শুনে ফোনের ওপাশে আরও বেশি চিন্তায় পড়লো কোনমতে নকশির সাথে কথা শেষ করে আবারও কল লাগালো শিশির। এবার ফোনটা রিসিভ হলো শিশির কিছু বলে ওঠার আগেই আলতা মুখ খুলল, ” কলেজ থেকে ফোনে নোটিশ দিয়েছে আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা ক্লাসও যে মিস করবে তার প্রতিদিন তিনশো টাকা করে জরিমানা তাই হঠাৎ চলে গিয়েছি। ফোনটা ভুলে রুমে রেখে গেছি তাই তোমাকে কিছু জানাতে পারিনি।”
আলতার কথা শুনে প্রচণ্ড রাগ করবে নাকি কৈফিয়ত চাইবে এই হুট করে আজকেই একদম এমন নোটিশ কি করে এলো! তাও কিনা আজই নোটিশ দিলো আজই তা কার্যকর হচ্ছে! দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলো সে কিছু সময়। আলতার আবারও কান্নায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে সেই বলল আবার, “সব গোছগাছ হয়ে গেছে শিশির ভাই?”
শিশির তার রুমেই পায়চারী করলো কয়েক সেকেন্ড তারপর হুট করেই কল কেটে দিলো। আলতা কল ব্যাক করলো না মনে মনে চাইলো শিশিরও আর কল না দেক। তার যে বড় কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। এত যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে যা সে তার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনায় আঘাত পেয়েও হয়নি। ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু ছেড়ে দিলো সে। এরপর কেটে গেল সময় আরও কয়েক ঘন্টা। শিশির রাগ দমিয়ে এবার ঠিক করলো এখনি দেখা করবে আলতার সাথে। জেদ আর অভিমানে পিষে এই শেষ সময়টুকুও না হাত থেকে বেরিয়ে যায় পরে আফসোস করে মরতে হবে দুটো বছর। কে বলতে পারে সে দু বছরে যদি আলতা বদলে যায়! না না এ কথা ভাবতেও যে তার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে আসতে চায়। শিশির আবার কল দিলো আলতাকে কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার ফোন তুলল তারই রুমমেট টুম্পা। সে জানালো আলতা প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ঔষধ খেয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে আর তাকে যেন কোন প্রয়োজনেই ডাকা না হয় বলে দিয়েছে। শিশির বিনা বাক্যে কল কেটে দিল। কঠিন মুখটাতে তার হঠাৎ করেই কেমন অসহায়ত্বের কুয়াশা ছেয়ে গেল। হাতে গুণে আর মাত্র তেরো ঘন্টা সময় আছে তার হাতে। আলতা তার হোস্টেল থেকে আর আধঘন্টা পর কিছুতেই বের হতে পারবে না। হাতে গুণে ত্রিশটা মিনিট সময়ই তো সে নিতে চাইছিল আলতার থেকে আজ সেটাও জন্য নেই আলতার কাছে। তবে কি আলতার অনুভূতির ভুল ব্যাখ্যা জেনেছে শিশির! আলতার মনে তার জন্য কিছুই নেই কোন দাম নেই তার আলতার জীবনে? সিগারেটের প্যাকেট হাতে সে হল থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে সিগারেট ধরালো। কয়েক মিনিটে প্রথম সিগারেট শেষ করে কল দিলো বাড়িতে। আব্বা আর শরত ভাই বাড়ি থেকে রওনা দিবে দশটায়। তার বুঝি মন্দ কপাল এই বিদেশ যাত্রার নামে! ফোন করতেই জানতে পারল আব্বার প্রেশার বেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শরত একা আসবে তার কাছে শরতই তাকে বিদায় জানাবে। তবে কি তার জন্য এ যাত্রা অশুভ! কুসংস্কার না মানা শিশিরের মনেও অজানা শঙ্কা ঢুকে গেল হঠাৎ। মন বলছে বাদ দে স্বপ্নের কথা থেকে যা আপন মানুষগুলোর কাছে। যুক্তি বলে এভাবে ভয় পেতে নেই৷ শরতও ফোনে খুব বোঝালো চিন্তা না করার। কথা বলল আম্মা, আব্বা, জেঠির সাথেও। রাতটা কেটে গেল নির্ঘুম সিগারেটের ধোঁয়ায় ডুবে। তার পাশে, তার সাথে রাত জেগেছিলো হলের বন্ধুরাও। সকাল হতেই ফজর পড়ে শিশির কল দিলো অনুকে। নয়টার ফ্লাইট ইমিগ্রেশনের জন্য আগেই থাকতে হবে। শরত এসে পৌঁছায়নি তখনও তা দেখে শিশির বাড়িতে কল দিলো প্রথমে। আহসানুল্লাহর প্রেশার কমেছে কিছুটা তবুও বিছানায় আছে। শরতকে ফোন করে জানা গেল সে পৌঁছে গেছে প্রায়। সোহাকেও ফোন করতে ভুলল না শিশির শুধু একটা নম্বরে কল দিবে দিবে করেও মন বলল অপেক্ষা কর কল আসবে। সেই অপেক্ষা নিয়েই সে গোসল সারলো, জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিলো। শেষ মুহূর্তের দেখা সাক্ষাৎ হলের প্রভোস্ট স্যার থেকে শুরু করে সিনিয়র, জুনিয়র এমনকি দারোয়ান মামা আর মালী কারো কাছ থেকেই বিদায় নেওয়া বাদ রইলো না। চেনা জানা সকলের দোয়া আর শুভ কামনার পসরা নিয়ে পা বাড়ালো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। শরত আসার পর আর এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে শিশির বেরিয়ে এলো হল ছেড়ে। তার ব্যাগপ্যাগ, লাগেজ নিয়ে সি এনজিতে বসতেই শরত বলল, “আমাদের আলতা বানুর কি খবর তার সাথে দেখা করতে যাবি না?”
মুখ ভার করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল শিশির। শরতের কথা শুনতেই সে বলে উঠলো, “সময় নেই ভাই। কথা হয়েছে ওর সাথে আর ওর জরুরি ক্লাস আছে সকালেই।”
শরত সব শুনে আর আলতার কথা বলল না। সে অন্য প্রসঙ্গে কথা তুলল আর মনে মনে ভাবতে লাগল সোহার কথা। আনমনেই ভেবে গেল সোহার পাগলামিগুলো। খুব সম্ভবত ঢাকায় এসেছে আবার অনুর সাথেও দেখা হবে বলে মনে পড়ে গেল সোহার কথা৷ একবার মনে হলো শিশিরকে জিজ্ঞেস করুক সোহা কি আসবে না তার বন্ধুদের সি অফ করতে! কিন্তু না এই প্রশ্নটাই অপ্রয়োজনীয় তাদের মাঝে। যথা সময়েই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল অনু আর তার পরিবার সাথে সোহাও এসেছে। শিশিররা পৌঁছুতেই সোহা একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ালো যেন সে কিছুতেই শরতের মুখোমুখি হতে চায় না। নির্দিষ্ট সময়ে শিশিররা চলে গেল ভেতরে। অনুর বাবা মা ফিরে যাওয়ার সময় সোহাকে সঙ্গে যেতে বলতেই সে জানালো তার একটু কাজ আছে পাশেই। তাই তারা চলে গেলেন সোহাকে রেখে। শরতকেও সাথে নিতে চেয়েছিলেন শরত অনুর বাবাকে জানালো সে তার কাজিনকে দেখতে যাবে তাই আর সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। সত্যিই সে আলতার সাথে দেখা করতে যাবে কিন্তু সোহার থেকে যাওয়াটা তাকে ভাবনায় ফেলল। মেয়েটা কি আবারও আগের মত পাগলামি করবে!
হাতে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় বাকি। শিশির বসে আছে এক কোণায় ওয়েটিং সিটে। অনু ওয়াশরুমে গিয়েছিল ফিরেই শিশিরকে জিজ্ঞেস করলো নাশতা করেছে কিনা। শিশির জানালো করেছে শরত আসার পর নাশতা তারা পথেই করেছে৷ অনু আরও অনেক রকম কথা বলতে থাকলো বাকি সময়টা অথচ শিশির পুরোটা সময় অপলক চেয়ে রইলো ফোনের স্ক্রীণে। কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি থেকে কি আজ তার জন্য একটা মেসেজ, কল কিংবা মিসকল আসবে না! সত্যিই কি তার আলতা তাকে ভালোবাসেনি! আলতার মন কি এতটুকুও বড় হয়নি যতটুকু হলে সে বুঝতে পারবে তার শিশির ভাইয়ের ভেতরের অনুভূতি। এনাউন্সমেন্টে জানা গেল সময় ফুরিয়েছে। অনু উঠে পড়েছে, বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শিশিরও। শেষ মুহূর্তে আরও একবার ফোন নম্বরটা দেখে এবার নিজেই কল দিলো আলতার নম্বরে।
“আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না……”
চলবে