শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৩৬+৩৭

0
611

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_36
#Writer_NOVA

সারাদিন হেলায় ফেলায় কেটে গেলো। বিকেল থেকে ভালো লাগছে না। তাই সন্ধ্যার দিকে ভাবলাম চানাচুর, পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে একটু মুড়ি মাখাই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সবকিছু কমপ্লিট করে তন্বীকে পাঠালাম ইফাত,সিফাতকে নিয়ে আসতে। পুচকো দুটোর সাথে থাকলে মন খারাপ দূরে পালায়। এমনিও আমি বাসায় কিছু বানালে ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসি। নয়তো ওদের বাসায় পাঠিয়ে দেই। সবাই মিলে একসাথে কিছু খাওয়ার মজাই আলাদা। হোক সেটা অল্প পরিমাণের। ইফাত,সিফাত এসে সোফায় চুপ করে বসলো। আমি সরিষার তেল নিয়ে সবকিছু একসাথে মিক্সিং করতে লাগলাম। হঠাৎ ইফাত বললো,

— আমি তুমারে ছাড়া বাচমু না বউ।

ইফাতের কথায় মুড়ি মাখানো বন্ধ করে ওর দিকে তাকালাম। বেচারা করুন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে ছিলো ওকে ইচ্ছে মতো বকুনি দিবো। কিন্তু ওর মুখ দেখে আর পারলাম না। ফিক করে হেসে উঠলাম। আমাকে হাসতে দেখে সে বললো,
— তুমি আমারে একটুও ভালোবাসো না।

তন্বী, সিফাত দুটোই মুচকি হাসছে। ওদের দিকে চোখ রাঙিয়ে ইফাতকে বললাম,
— তোকে আমি ভালোবাসি।

— সত্যি 😍!

— এত খুশি হওয়ার মতো কিছু হয়নি। আমি তোকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসি।

— মনটা ভেঙে দিলা💔।

— আহারে! খুব কষ্ট হচ্ছে?

— হুম অনেক।

— দেখ নেংটি ইদুর তুই এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তাহলে অনেক ভালো ভালো মেয়ে তুই পাবি। কিন্তু পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমার পেছন ঘুরলে কোন লাভ হবে না।

— আমার তোমাকেই লাগবে।

— ধূর ব্যাঙ। কি বলি আর কি বুঝে?

আমি বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললাম। সিফাত মুখ টিপে হেসে বললো,
— ভাইয়া তো তোমার শোকে পাগল হয়ে যাবে ভাবী। আমার ভাইয়াকে বিয়ে করতে তোমার এতো কিসের সমস্যা? কি নেই আমার ভাইয়ার বলো?

— আরেকবার বাংলা মুভির ডায়লগ মারলে তোর মাথায় ফুলদানি ভাঙবো সিফাত।

— আরে আরে রাগো কেন? আমি তো এমনি বললাম। তোমাদের জামাই-বউয়ের বিষয় তোমরাই বুঝো।

— দুটো ছেলেই বেশি পেকে গেছে।

আমি দুটোর দিকে মুখ বাঁকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম। তন্বী ব্যঙ্গ সুরে বললো,
— তোমায় কত ভালোবাসে নোভাপু। আর তুমি ইফাতকে পাত্তাই দাও না। ইফাত ভাই আমার। আয় আমার কাছে আয়। তোর দুঃখে আমিও দুঃখিত।

আমি হুংকার দিয়ে বললাম,
— মাছের মায়ের পুত্রশোক হচ্ছে। তা এতই যখন খারাপ লাগছে তাহলে নিজের ঘাড়ে নিয়ে যা না।

— ইফাত তো তোমায় ভালুপাসে। আমি কেন নিবো?

— তাহলে মুখটা অফ রাখ। নয়তো ভাতের চামচ দিয়ে এমন জোরে বারি দিবো স্মৃতি শক্তি থাকবে না।

সারা হাত সরিষার তেলে মাখামাখি মুড়ির ডিব্বা থেকে যেই মুহুর্তে মুড়ি নিবে সেই মুহুর্তে কপালে ছোট দুটো ঠোঁটের পরশ পেতেই চমকে উঠলাম। তাতে কিছু মুড়ি নিচে পরে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখি ইফাত মিটমিট করে হেসে মুখ ঢেকে ফেললো। তার মানে এটা এর কাজ। আমি রেগে বললাম,

— এই এটা কি করলি? বেশি পেকে গেছিস?

ইফাত লাজুক সুরে বললো,
— বউকে ভালোবাসা দিছি।

এর কথা শুনে আমার মাথা ভনভন করতে লাগলো। পুঁচকে পোলা বলে কি। তন্বী, সিফাত দুজনে একসাথে মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলো। আমার কথা শুনে মোবাইল থেকে মাথা উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে নোভাপু?

— কি হয়েছে ভাবী?

আমি রেগে দাঁত কটমট করে বললাম,
—কি হয়নি তাই বল। কিছু না। তোরা তোদের কাজ কর। ইফাতের আজকে খবর আছে।

আমি এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে যেই খপ করে ইফাতকে ধরবো তখুনি কোলিং বেল বেজে উঠলো। আমি একবার দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। আমার বাড়িয়ে রাখা হাতটাকে দুই হাতে ধরে আবারো পুঁচকেটা চুমু খেলো। আমি বাম হাতে নিজের কপালে জোরে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দরজা খুলতে চলে গেলাম। এই বিচ্ছু ছেলে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে।

💖💖💖

দরজা খুলতেই দুটো ক্লান্ত মানুষকে দেখতে পেলাম। তায়াং ভাইয়া ও এনাজ দুজনের শরীরের অবস্থা কাহিল। সেই সকাল দশটায় বেড়িয়েছে। এখন সন্ধ্যা সাতটা। বিয়ের শপিং করতে গিয়ে বেচারাদের অবস্থা নাজেহাল। আমাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তায়াং ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— ভেতরে কি ঢুকতে দিবি?

আমি কোন কথা না বলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। তারা ভেতরে ঢুকতেই দরজার সিটকিনি লাগিয়ে ওদেরকে বললাম,
— ফ্রেশ হয়ে আয়। মুড়ি মাখাচ্ছি। সবাই একসাথে খাবো।

তায়াং ভাইয়া আচ্ছা বলে তার রুমে চলে গেল। সাথে এনজিও সংস্থা। বড় এক বোল ভর্তি মুড়ি মাখলাম। এক প্লেট খালামণির রুমে দিয়ে এলাম। আরেক প্লেট ভর্তি করে ইফাতের আম্মুর জন্য নিয়ে গেলাম৷ কয়েকবার বেল বাজাতেই ইফাতের দাদী দরজা খুললো। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম সোফায় বসে আন্টি টিভি দেখছে। সামনের টি-টেবিলে প্লেটটা রেখে বললাম,

— বউ, শাশুড়ী একসাথে সিরিয়াল দেখছিলো বুঝি। যাক ভালো। এখন সিরিয়াল দেখতে দেখতে খাওয়া হয়ে যাবে।

ইফাতের দাদী আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
— কি বলে ধন্যবাদ দিমু তা জানি না। তবে আজকে সকালে তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস নাতনী।

আমি তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— আপনি বুঝতে পেরেছেন এটাই আমার কাছে অনেক কিছু দাদী। আপনার মতো করে যদি সব শাশুড়ী বুঝতো তাহলে আর ঘরে ঘরে বউ শাশুড়ীর এত যুদ্ধ চলতো না। অনেকে তো বুঝেও না বোঝার ভান করে। কিন্তু আপনি তা না করে নিজের ভুল সংশোধন করে নিয়েছেন। সারাজীবন এমন থেকেন। তাহলেই হবে। আমি যাই। ঐদিকে ওরা কি করে কে জানে? শাশুড়ী আম্মা খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে। দাদী দরজাটা লাগিয়ে দিয়েন।

দ্রুত দরজা দিয়ে বের হয়ে এলাম। সোফায় বসে থাকা আন্টির মুখে ছিলো তৃপ্তির হাসি। যা না চাইতেও মনটাকে কেড়ে নিয়েছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি তায়াং ভাইয়া, এনাজ সোফায় বসে আছে। এনাজের কোলে ইফাত। তারা দুজন পুটির পুটুর করে কথা বলছে। আমি পুরো বোল সামনে দিয়ে বললাম,

— সবাই নিয়ে খাও। ঐ তন্বী মোবাইল রাখ। সিফাত নিয়ে খেতে থাক।

সবাই একসাথে মুড়ি খেতে লাগলাম। ইফাত কিছু সময় পরপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে আর দুই চোখ মারছে। আমি চোখ রাঙানি দিলেই মুখ টিপে হাসছে। আমাদের দুজনের কান্ড দেখে এনাজ জিজ্ঞেস করলো,

— কি চলছে তোমাদের মাঝে? আমাকে একটু বলবে কি? এই টিডি পোকা তোমার সাথে ওর এতো আই কানেকশন কেন?

ইফাত এনাজকে কিছুটা চেচিয়ে বললো,
— তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না। আমার ও আমার বউয়ের মধ্যে তুমি কথা বলো না।

এনাজ ওর কথা শুনে চোখ দুটো রসগোল্লা বানিয়ে বললো,
— কি বললে? টিডি পোকা তোমার বউ হলো কবে?

— এখনো হয়নি তবে হবে। নুবা শুধু ইফাতের। নুবা যদি ইফাতের না হয় তাহলে আর কারো হবে না।

আমি রাগী গলায় বললাম,
— ইফাতরে আমার নাম নোভা নট নুবা।

আমাদেরও কান্ড দেখে সবাই হো হো করে হাসতে লাগলো। শুধু এনাজ বিস্মিত চোখে ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তায়াং ওকে ধাক্কা মেরে বললো,
— মুখটা বন্ধ কর এনাজ। সবে তো শুরু আরো কতকিছু যে দেখবি।

এনাজ মুখ বন্ধ করে অসহায় কন্ঠে বললো,
— আমরা জীবনে কি করলাম তায়াং? আজ অব্দি প্রপোজ করতে পারলাম না। আর এই পিচ্চি বলে টিডি পোকা নাকি শুধু ওর বউ। ও ছাড়া অন্য কারো হবে না। ভাই আমারে ধর। আমার মাথা চরকির মতো ঘুরতাছে।

ইফাত এনাজের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
— জানো ভাইয়া আমি ওরে কত ভালবাসি। কিন্তু ও আমারে বুঝেই না। শুধু আমার সাথে রাগ দেখায়। ওরে ভালোবেসে একটা কিসি দিলেও মানে না। বরং আরো বেশি রেগে যায়।

এনাজ আরেকদফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি ওকে চুমু খাইছো?

— হ্যাঁ খাইছি তো। আমার বউ আর আমি চুমু খাবো না। তা কি হয় বলো? একটু আগেও তো ওর কপালে আর হাতে চুমা দিছি।

এবার ইফাতের কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকালো। আমি লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। এই পিচ্চি আমারে লজ্জা দিয়া শেষ করে দিবে। তন্বী “ওহো” বলে চেচিয়ে উঠলো। এনাজ অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মুখটাকে শুকনো করে জিজ্ঞেস করলো,
— টিডি পোকা এগুলো কি সত্যি?

আমি এক হাতে মুখ ঢেকে উপরনিচ মাথা নাড়ালাম। এনাজ ওর মাথাটা সোফায় হেলিয়ে দিয়ে হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— তায়াংরে আমি ফিট খাইছি। আমার জ্ঞান ফেরা।

তায়াং ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো,
— সেদিন তো আমার কথা বিশ্বাস করিসনি। আজকে হয়েছে তো? এখন কি ওয়াসরুম থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে তোর মাথায় ঢালতে হবে?

— তাই কর ভাই। এই জীবন রেখে কি লাভ? এতো প্রেমিকের ভিড়ে আমি হারিয়ে গেছি। টিডি পোকা ইফাতের হলে আমার কি হবে?

ইফাত এনাজের সামনে এসে বললো,
— তোমার কি হইছে ভাইয়া?

এনাজ ওর দিকে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
—এখনো কিছু হয় নাই ভাই। তবে খুব শীঘ্রই আমি চান্দের দেশে পারি দিবো৷ নিজের ওপর রাগ উঠতাছে। এই জীবন রেখে কি করবো? যদি ১০ বছরের বাচ্চা ছেলে আমাদের থেকে এডভান্স হয়।

আমি এদের কথা শুনে হাসতে হাসতে তন্বীর ওপর পরে গেছি। তন্বী কিছুটা দম নিয়ে বললো,
— জানো ভাইয়া আজকে নোভাপু কি করছে?

আমি ওর মুখ আটকে ধরে বললাম,
— চুপ একটা কথাও বলবি না।

এনাজ উৎসুক চোখে সোফায় দুই পা উঠিয়ে বললো,
— টিডি পোকা ওর মুখ ছাড়ো।

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,
— ছাড়বো না কি করবেন?

— ইফাত দুইটা চুমু দিছে। আমি চারটা দিবো।

তার কথা শুনে তন্বীর মুখ ছেড়ে আমি একটা ভেংচি কাটলাম। ইফাত কাঁদো কাঁদো ফেসে এনাজের হাঁটুতে মারতে মারতে বললো,
— আমার বউরে আমি চুমা দিবো। তুমি দিবা কেন? তুমি ওর সামনেও যাইবা না।

এনাজ দুই হাতে ওর হাত আটকিয়ে বললো,
— না ভাই কিছু করবো না। আমি তো এমনি বলছিলাম। আর শোন আমি একটা কথা বলি?

ইফাত মার থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি কথা?

— শুনো ইফাত, তোমার বউ আমারও বউ। কিন্তু আমার বউ তোমার ভাবী।

— আচ্ছা।

ইফাত মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। কিন্তু কিছু সময় পর চিৎকার করে বললো,
— না আমার বউ শুধু আমার। আর কারো না।

এনাজ তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ভাই যা করার জলদী করতে হইবো। অবস্থা বেগতিক। নয়তো দেখা যাবে আমার আগে আমার বউকে অন্য কেউ নিয়া পালাইবো। এতো প্রেমিক দেখে আমারি ভয় করছে। কবে জানি বাতিলের খাতায় আমার নাম উঠে যায়। আর দেরী করবো না আমি। তুই ব্যবস্থা কর। আগমীকাল আমি সব জানিয়ে দিবো।

এদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। তায়াং ভাইয়া এনাজের কানে কানে কি জানি বললো। তারপর ভাইয়া তন্বীকে জিজ্ঞেস করলো,
— তুই কি জানি বলতে চাইছিলি।

আমি তন্বীকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। কিন্তু তন্বী শয়তানি হাসি দিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— আজকে কলেজ থেকে আসার সময় একটা চিকনা ছেলে নোভাপুর মোবাইল নাম্বার চেয়েছে।

এনাজ চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো,
— তারপর?

তন্বী আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বললো,
—সামনের দেয়ালে ছিলো কলিকাতা হারবালের পোস্টার। নোভাপু ঐ চিকনা ছেলেরে কলিকাতা হারবালের নাম্বার দিয়ে দিছে।

এনাজ চোখ দুটোকে উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— সিরিয়াসলি??

তন্বী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে হাসতে লাগলো।আমি তন্বীর দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে মুড়ি চাবাতে লাগলাম। মনে হচ্ছে মুড়ি নয় তন্বীকেই চাবাচ্ছি। হাসি-ঠাট্টায় সবার মুড়ি খাওয়া শেষ।সিফাত দৌড়ে ওদের বাসায় চলে গেল। কিন্তু ইফাত তায়াং ভাইয়া ও এনাজের মাঝখানে বসে আছে। ওরা কি জানি কি নিয়ে কথা বলছে। আমি বোলটা বেসিনে রেখে হাত ধুয়ে নিলাম। তারপর বোল ধুয়ে উপুড় করে রেখে ড্রয়িংরুমে যেতেই ইফাত দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কান্ডে আমি শর্কড। এনাজ বুকের বাম পাশে হাত রেখে কাদো কাদো মুখে বললো,
— ভাই এমন করে ধরিস না। কলিজা ফাইট্টা যাইতাছে৷ বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যাথাও শুরু হইছে। খুব শীঘ্রই বোধহয় আমি স্ট্রোক করবো। তুই এভাবে ওকে ধরে রাখলে আমি বোধহয় বেশি সময় বাঁচবো না। ওরে ছেড়ে দে ভাই🥺।

এনাজের কথায় তায়াং ভাইয়া সোফায় লুটোপুটি খেয়ে হাসছে।আমি ইফাতকে ঝাটকা মেরে ছাড়িয়ে নিলাম। তন্বীও হাসতে হাসতে শেষ। এনাজ তন্বীকে বললো,
— বোইন একটু পানি দে। সিউর আজ আমি হার্ট অ্যাটাক করবো। তোরা মিলিয়ে নিস আমার কথা।

ইফাতের ডান কান মুলে দিয়ে বললাম,
— এসব কি?

ইফাত দাঁত কেলিয়ে বললো,
— বউকে জড়িয়ে ধরলে ভালোবাসা বাড়ে।

এনাজ সবেই মুখে পানি নিয়েছিলো খাওয়ার জন্য। ইফাতের কথা শুনে বিষম খেলো। মুখের পানি সব তায়াং ভাইয়ার ওপরে পরে গেছে। তায়াং ভাইয়ার সেদিকে খেয়াল নেই। সে তো হাসতে হাসতে বোধহয় আজকে শহীদ হয়ে যাবে। আমি ইফাতকে ধমক দিয়ে বললাম,

— কে বলছে তোকে এসব?

— আমি বাংলা ছবিতে দেখছি। শাকিব খান বলছিলো এই কথাটা।

তন্বী পেট ধরে বললো,
— এবার তোমরা একটু থামো। আর হাসতে পারছি না। কি শুরু করছো তোমরা?

এনাজ গ্লাস থেকে পানি নিয়ে নিজের মাথার তালুতে পানি ডলতে লাগলো। বিষম খেয়ে তার অবস্থা নাজেহাল। বেচারার মুখ লাল হয়ে গেছে। আর আমি আপাতত কোমায় আছি। সেখান থেকে ফিরলে বাকি কাহিনি বলবোনি🌚।

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_37
#Writer_NOVA

তন্বী আজ দুই ক্লাশ করে কোথায় জানি চলে গেলো। আমাকে ভালো-মন্দ কিছু বললো না। শুধু বললো চলে যাচ্ছি। তারপর রাস্তার দিকে ছুটলো। ওর এমন অদ্ভুত আচারণে আমি একটু নয় বরং অনেক বেশি অবাক হয়েছি।কলেজ ছুটি হয়েছে মিনিট দশ আগে।শারমিনকে বিদায় জানিয়ে গেইট পার হতেই এনাজের সাথে দেখা। বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে রওনকের সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। আমি তাদের সামনে যেতেই রওনক বড় করে একটা সালাম দিলো।

— আসসালামু আলাইকুম।

— ওয়া লাইকুমুস সালাম।

— তা কেমন আছেন ভাবী?

ভাবী ডাক শুনে বিস্মিত চোখে রওনককে জিজ্ঞেস করলাম,

— ভাবী! কে ভাবী?

এনাজ ওর দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করতেই বেচারা থতমত খেয়ে বললো,
— ওফস সরি। বড় আপু হবে।

— জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার?

— বিন্দাস। তা আপনি আজকাল থাকেন কোথায়?

— কেন বাসায়?

— আরে ধূর তা না। আপনাকে যে আজকাল কলেজে দেখি না তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি একটা আসি না। গত সপ্তাহে মোবাইল চালাতে চালাতে রাস্তা পার হতে গিয়ে ম্যানহোলে পরে গিয়েছিলাম৷ পায়ে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছি। বাসায় ফুল রেস্টে ছিলাম। তাই এতদিন দেখেননি।

— একদম ঠিক হয়েছে। রাস্তা পার হওয়ার সময়ও কি মোবাইল চালাতে হয়? এবার বুঝুন ঠেলা।

— হ্যাঁ, আমি নিজেও স্বীকার করি দোষ আমার। আচ্ছা আসি তাহলে। এনাজ ভাই আসছি। আজ আবার বিকেল তিনটায় আমাদের ছাত্র সংসদের মিটিং আছে। তার বন্দবস্ত করতে হবে।

এনাজ ওর কাঁধে হালকা চাপর মেরে বললো,
— সাবধানে যাস।

রওনক হালকা পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কলেজের ভেতর দিকে চলে গেল। আমি এক পলকে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। এনজিও সংস্থা চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই আমার ধ্যান ভাঙলো।

— এই যে মিস টিডি পোকা। হারালে কোথায়?

— কই কোথাও না। আজ হঠাৎ আপনি এখানে?

— কেন আসতে পারি না?

— তা কখন বললাম?

— চলো আমার সাথে।

— কোথায়?

— আজ আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে প্রপোজ করবো। তুমিও আমার সাথে থাকবে।

কথাটা শোনার সাথে সাথে সারা শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য চোখে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল শুনেছি। এখুনি এনাজ বলবে, “আসলে তেমন কিছু নয়। তোমার সাথে মজা করছি।” কিন্তু আমার ভাবনা ভুল করে দিয়ে এনাজ আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,

— কি হলো চলো?

— আমি যাবো না।

— কেন?

— আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।

— সেকি কথা! কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো তো? কোন সমস্যা হয়েছে কি?

— এমনি ভালো লাগছে না। আমআমি বাসায় যাবো।

— না, এটা তো হতে পারে না। তুমি সেদিন কফি হাউসে বলেছিলে আমাকে সাহায্য করবে। এখন পালাতে চাইলে তো হবে না। তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে। তুমি সব ব্যবস্থা করবে বলে আমি কিছু করতে চাইছি না। আর এখন এরকম কথা তো আমি মানছি না।

— প্লিজ আমাকে জোর করবেন না। আপনি যান। আপনাদের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো।

— এটা কিন্তু ঠিক নয় টিডি পোকা। তুমি কিন্তু তোমার কথার বরখেলাপ করছো। তুমি বলেছিলে প্রপোজ করার সময় তুমি আমার সাথে থাকবে। তাহলে এখন না যাওয়ার কথা কেন আসছে?

আহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু সে কি জানে আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সেই পোড়া গন্ধ তার নাকে যাচ্ছে না? যাবে কি করে? সে তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাহলে কেন আমাকে তার প্রতি দূর্বল করলো? আবারো কষ্ট পাওয়ার জন্য। এনাজ আমার কোন কথা শুনলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে বাইকে বসিয়ে দিলো। আমার চোখের পানিগুলো টলমল করছে। এই বুঝি অবাধ্য হয়ে ঝরে পরবে। আজ তার কাঁধে হাত দেওয়ার মতো সাহসটা আমার হচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা হাতে তার কাঁধে হালকা করে হাতটা রাখতেই উনি বাইক চালু করলো।

💖💖💖

সময় এখন বিকেল সাড়ে তিনটারো বেশি হবে। এই এনাজের হাবভাব আমার সন্দেহজনক লাগছে। সেই দুপুর দুটোর দিকে আমাকে কলেজ থেকে নিয়ে আসলো। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাবার খেলো। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কি খাবার নামে? তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রেখে কোনরকম খেয়ে উঠে গেছি। তারপর আবার বাইকে করে রওনা দিলাম। নদীর পাড়ে এসে বাইক থামলো। যতদূর চোখ যায় নদীতে টলটলা পানি। নদীর পাড়টা বালি আর বালি। সেখানে থোকায় থোকায় সাদা কাশফুল ফুটে আছে। পড়ন্ত রোদের আলোতে চারিদিকটা অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অন্য সময় হলে আমি খুশিতে টিডি পোকার মতো লাফাতাম। কিন্তু এখন সেই মুডে নেই। মনটা ভীষণ খারাপ।

এনাজ বাইক থেকে নেমে কারো সাথে মোবাইলে কথা বললো। তারপর কথা বলতে বলতে আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। একবার হাত সরিয়ে নিলেও আরেকবার নিজে আমার হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি আর কোন দ্বিধা করলাম না। ঝরঝরা বালুতে হাঁটতেও বিরক্ত লাগছে। রোদ না থাকলেও বালু বেশ গরম। ছনের চালা বিশিষ্ট একটা ছোট ঘরের কাছে এসে থামলাম। শুধু ছনের চাল আছে। আর কিছু নেই। বাঁশের সিড়ি দেওয়া বেশ উঁচু জায়গাটা। এনাজ খুব সাবধানে আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গেলো। আমি আশেপাশে কাউকে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

— তায়াং ভাইয়া, আপনার বন্ধু কাউকে যে দেখছি না। তারা কোথায়?

— এখুনি চলে আসবে।

মিনিট দুই পর আমার মাথার ওপর ফুলের পাপড়ি আর জরি পরতে লাগলো। ওপরে তাকিয়ে দেখি মাথার ওপরে থাকা বেলুনগুলো আপনাআপনি ফেটে আমাদের গায়ের ওপর ফুলের পাপড়ি, জরি পরছে। মন খারাপ থাকায় ওপরের দিকেও খেয়াল হয়নি। একসময় হৈ হৈ করে তিনজন এসে হাজির। তায়াং ভাইয়া, তওহিদ ভাইয়া তাদের সাথে রওনককে দেখে বেশি অবাক হলাম। আমি রওনককে জিজ্ঞেস করলাম,

— আপনার না মিটিং আছে। তাহলে আপনি এখানে কি করেন?

রওনক শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— বড় ভাই তার ভালোবাসার মানুষকে প্রপোজ করবে। আর আমি থাকবো না। তা কি হয় বলো?

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমাদের দুজনকে এক গ্লাস করে ঠান্ডা লাচ্ছি দিলো। আমি ধীরে ধীরে সেটা খাওয়া শেষ করলাম। তারপর সেখান থেকে নেমে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলো। সেখানে লাইন বাই লাইন কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম।ইমরান হাশমি ভাইয়া, শাহেদ ও রায়হান ভাইয়া হাতে বড় একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার একবার মনে হচ্ছে এসব আমার জন্য। আবার মনে হয় না আমার জন্য নয়। আমি এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে যে দেখছি না।

এনাজ মুচকি হেসে বললো,
— চলতে থাকো তাহলেই দেখতে পাবে।

তায়াং ভাইয়া মুখ টিপে হেসে বললো,
— কিরে শাঁকচুন্নি কেমন লাগছে?

— আমার আবার কেমন লাগবে? এসব তো আমার জন্য নয়।

কথাটা বলে মুখ গোমড়া করে রাখলাম। তায়াং ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে করছিলো ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু বলা হলো না। সামনে যেতেই শারমিন ও তন্বীকে দেখে বড়সড় একটা ঝাটকা খেলাম। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি রে তোরা এখানে?

শারমিন ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?

— তুই না বাসায় চলে গেলি?

— আবার চলে এসেছি।

ওদের হাতেও একিরকম সাদা শক্ত হার্ড কাগজ। সম্ভবত তাতে কিছু লেখা। কিন্তু উল্টো করে রাখায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কাগজে কি লেখা?

তন্বী মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
— দেখাবো না। ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষের আগে এগুলো কেউ দেখতে পারবে না।

— ওহ্।

নদীর দিকে চোখ যেতেই ফুলে সজ্জিত একটা নৌকা দেখতে পেলাম। নৌকার কিনারে ও ভেতরে নানা ফুলের সমাহার। এনাজ আমার এক হাত ধরে নৌকা উঠলো। আমি বোকার মতো সবকিছু দেখছি। কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য নয়। এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

এনাজ কথার উত্তর না দিয়ে নৌকার ওপর থেকে সবার মতো হার্ড কাগজটা নিয়ে এক হাঁটু মুড়ে বসে আমার দিকে মেলে ধরলো। আরেক হাতে কতগুলো গোলাপ বাড়িয়ে দিলো।কাগজে থাকা লেখাটা পড়ে আমার চোখ দুটো বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। পেছনে তাকিয়ে দেখি সবাই হাসছে। আর তাদের হাতের কাগজেও সেম লেখা। অবিশ্বাস্য চোখে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে এনাজের দিকে তাকালাম। এনাজ কাতর গলায় কাগজে লেখা কথাটাই বললো,

— নোভা,will you be my পোলাপাইনের আম্মা?

এনাজ কথাটা বলার সাথে সাথে সবাই একসাথে “ওহো” বলে উঠলো। পার্টি স্প্রে দিয়ে পুরো সাদা ভুত বানিয়ে দিলো আমাদের দুজনকে।আমি এখনো শর্কডে আছি। আমি বোধহয় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি। নিজের গায়ে জোরে একটা চিমটি মারলাম। না, স্বপ্ন দেখছি না। বেচারা আমার উত্তরের আশায় এখনো উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতকিছু তাহলে আমার জন্য ছিলো। আর এনাজের ভালোবাসার মানুষটা আমি। এতকিছু দেখেও আমি পুরো সিউর হতে পারলাম না। কিন্তু এখন আমার খুশি হওয়ার বদলে রাগ লাগছে। আমি ভেবেছিলাম সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই এতকিছু ইনজয় করতে পারিনি। এখন উনি সারপ্রাইজ দিলো তো দিলো পুরো মাটি করেই দিলো। আগে একটু বললে কি হতো? তাহলে কি এত আনন্দ নষ্ট করতাম আমি। আমার এখন হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে😵। দাঁতে দাঁত চেপে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কটমট করে বললাম,

— ভাই তোরা শুরু করছিস কি? আমাকে আগে থাকতে অল্প একটু জানালে কি হতো? নয়তো আমি এত সুন্দর সুন্দর মোমেন্টগুলো কি মন খারাপ করে বরবাদ করতে পারতাম? এখন তোরা আমারে এক গ্লাস আনারস না থুরি দুধ আর সাথে আনারস দে। খাইয়া, চিৎ হইয়া ভেটকাইতে ভেটকাইতে মইরা যাই।

#চলবে