#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_54
#Writer_NOVA
সকালবেলা ঘুমের থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আম্মু,আব্বু, ইভাকে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো।জল বহুদূর গরিয়ে গেছে। এখন কিছু না করলে আমার কপাল চাপড়াতে হবে। আম্মু আমাকে তার পাশে বসিয়ে বললো,
— কেমন আছিস?
— অনেক ভালো। তোমরা কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
— যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। এই ইভু গিয়ে বোরখা খুলে হাত-মুখ ধুয়ে নে।
আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— কেমন আছিস মা?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো আব্বু?
— আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। মাত্র ঘুমের থেকে উঠলি?
— হ্যাঁ, একটু আগে। তোমরা বসো আমি আসছি। যাও সবাই আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।
আম্মু-আব্বু ভেতরের রুমে চলে গেল। ইভা শয়তানি হাসি দিয়ে আমাকে বললো,
— ও মোটু, তোমার বলে বিয়ে।
— ঐ তোকে কে বললো?
— তোমার বিয়ে দিতে আমরা আসলাম। আর তুমি বলো আমাকে কে বললো? তায়াং ভাইয়ার সাথে তোমাকে মানাবে কি করে? যদি মতো তায়াং ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয় তাহলে এনাজ ভাইয়ার কি হবে?
এনাজের কথা ইভা জানে। আমি কখনো আমার কোন কথা ওর কাছে লুকোই না। ও মাঝে মাঝে আমায় বড় বোনের মতো সবকিছুতে সাপোর্ট করে,সমস্যার সমাধান খুঁজে দেই। তাই ওর সাথে সব কথা শেয়ার করি।আমি মুখটাকে শুকনো করে ধপ করে সোফায় বসে পরলাম। তারপর ইভার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— কিচ্ছু জানি না। আমার কপালে এবার দুঃখ আছে। নিজের কপাল নিজে ফাটাইছি। এবার জোড়াও আমার লাগাতে হবে। কি যে করবো নিজেও জানি না।
— দাদীতো তাড়াহুড়ো শুরু করছে। আগামীকাল রাতেই নাকি কাজি ডেকে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে।
আমি চোখ কপালে তুলে চেচিয়ে বললাম,
— বলিস কি?
— সত্যি বলছি। তুমি কিছু জানো না? দাদীর তো তোমাকে অনেক পছন্দ। তাই তায়াং ভাইয়ার বউ করতে চাইছে।
— আমার মাথায় পানি ঢাল ইভা।আমি আজ নেই। আব্বু-আম্মু রাজী হয়েছে বিয়েতে?
— আব্বু প্রথমে রাজী ছিলো না আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে দিতে।কিন্তু আম্মু বলে তায়াং-এর মতো ছেলে হয় না। তাই রাজী হতে বাধ্য হয়েছে। তবে এখনো ততটা রাজী নয়। খালু তো গতকাল থেকে কলের ওপর কল। খালু তো ভীষণ খুশি তোমাকে তার ছেলের বউ করতে পারবে বলে।
— আমার বোধহয় এবার পিংক কালার বিষ খেতে হবে। দেখি আম্মুর সাথে কথা বলে।
আমি দ্রুত সোফা থেকে উঠে আম্মুর রুমের দিকে দৌড়ালাম। আব্বু ওয়াসরুমে গেছে। আম্মু বোরখা খুলে মাথা নিচ করে বসে আছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
— এসব কি শুনছি আম্মু?
— কোনসব?
— তায়াং ভাইয়ার সাথে নাকি আমার বিয়ে ঠিক করছো তোমরা?
— তোর আব্বু তো ততটা রাজী না। এখন আসছি দেখি কি হয়?
— তোমরা এসব ভাবো কি করে হ্যাঁ? তায়াং ভাইয়াকে আমি নিজের ভাইয়ের চোখে দেখি। তার সাথে আমার বিয়ে কিভাবে সম্ভব? ভাইয়াও আমাকে বোনের চোখে দেখে। এই সিম্পল বিষয়টা, তোমরা বুঝতে পারছো না কেন?
— ওর সাথে বিয়েতো তোর জায়েজ আছে।
— থাকুক জায়েজ। এমন হতো আমি তায়াং ভাইয়াকে পছন্দ করি কিংবা তায়াং ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে তাহলে বিষয়টা অন্যরকম। কিন্তু তেমনটা তো নয়।
— আগেই চিল্লাস না। আসছি যখন দেখি কি হয়?
— দেখি কি হয় বললে তো হবে না। এই বিয়ে কিছুতেই হবে না। আমি তায়াং ভাইয়াকে বিয়ে করবো না। উনি শুধু আমার ভাই। তাকে আমি কখনও অন্য চোখে দেখিনি আর দেখবোও না।
— কেন তায়াং ছেলে হিসেবে কোন দিক দিয়ে খারাপ?
— এখানে ভালো বা খারাপের প্রশ্ন উঠছে কেন?
— তাহলে তুই এসব কথা বলিস কেন? আল্লাহ যদি ওর সাথে তোর বিয়ে লিখে রাখে তাহলে কি তুই কিছু করতে পারবি? ভাগ্যে থাকলে তো বিয়ে হবেই।
— উদ্ভট কথাবার্তা বলে একদম মাথা গরম করবা না। এই বিয়ে হবে না মানে হবে না। আর কোন কথা নেই।
কথাগুলো বলে রাগী চোখে আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত রুমে চলে গেলাম। টেনশনে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। যেচে নিজের বিপদ ডেকে আনলাম। কেন যে ঐ দাদীকে বিয়ের কথা বললাম। আমার মজা করে বলা যে নয় নাম্বার বিপদ সংকেতে রূপ নিবে তা জানলে জীবনে বিয়ের কথা উচ্চারণও করতাম না।
💖💖💖
দুপুরে…..
খাবার খাওয়ার পর সবাই যার যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। গতকালের পর থেকে তায়াং ভাইয়ার সাথে আমার কোন কথা হয়নি। তাই গুটি গুটি পায়ে ওর রুমের দিকে রওনা দিলাম। ওর রুমের সামনে যেতেই দেখলাম ভাইয়া উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আমার আজ ভেতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না। দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। তারপর আস্তে করে দরজায় দুটো টোকা দিয়ে বললাম,
— ভাইয়া আসবো?
অপরদিক থেকে কোন শব্দ এলো না। শুনতে পাইনি ভেবে আরেকবার জোরে টোকা দিয়ে চেচিয়ে বললাম,
— ভাইয়া আসবো?
— হুম আয়।
ওর আওয়াজ কেমন জানি গম্ভীর লাগছে। আমার ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ভেতরে ঢুকলেই তায়াং ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে। পাঠাটা যাদের সাথে চেচামেচি করলে লাভ হবে তাদের সাথে করে না। সব ঝাল আমার ওপর মেটায়। এটা এখন নয় সবসময় করে। আমি ওড়নার আগা মোচড়াতে মোচড়াতে ভেতরে ঢুকলাম।ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
— ভাইয়া, তুই কিছু বলছিস না কেন? তোর সাথে আমার বিয়ে কনফার্ম করে ফেলছে। আর তুই চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছিস। এটা কি ঠিক বল?
ভাইয়া রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এক ঝাটকায় আমার হাত ধরে ওর পাশে বসিয়ে দিলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— তোর কি মনে হচ্ছে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি?
— তাই তো দেখতে পাচ্ছি।
— তোকে প্রথমে দুই গালে দুটো চটকনা (চড়) দিবো। তারপর বাকি সব।
আমি চট জলদী আমার দুই গালে দুই হাতে চেপে ধরলাম। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দিয়েও বসতে পারে। মুখটাকে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললাম,
— আমি কি করছি?
— এক থাপ্পড়ে সামনের পাটির দাত ফেলে দিবো শয়তান ছেমড়ি। আবার বলিস তুই কি করছিস?
— কি করছি তাতো বলবি?
— দাদীকে বিয়ের কথা বলছিস কেন? জামাই চাই, জামাই চাই বলে আন্দোলন কে করছিলো?
—😶😶
— এখন চুপ কেন? আমি গতকাল রাতে দাদীর রুমে গিয়ে দাদীর সাথে কথা বলছি। উনি তো রীতিমতো আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল আরম্ভ করেছিলো। তাই রেগে বের হয়ে গেছি।
— কি বলছে দাদী?
—আমি বলছি তোকে আমি নিজের বোনের চোখে দেখি। তোকে বিয়ে করতে পারবো না। উনি বলে তোর সাথে আমার বিয়ে জায়েজ আছে। বিয়ের আগে তোকে বোন ভাবছি বিয়ের পর বউ ভাবলেই চলবে। তোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তা তুই ভালো করেই জানিস।
— আমারও সম্ভব নয়।
— এনাজ, নূর দুজনেই আমাকে ভুল বুঝছে। একজনও কল পিক করছে না। এসব কিছু হয়েছে তোর জন্য। তুই দাদীর মাথায় বিয়ের ভূত চাপিয়েছিস।
— আমি কি জানতাম উনি সামান্য বিষয়কে এতটা সিরিয়াস করে ফেলবে?
— এখন এই বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব তোর। তুই কিভাবে ভাঙবি, কি করে ভাঙবি আমি কিছু জানি না। আমি শুধু জানি তুই বিয়ে ভাঙবি। যদি বাই চান্স তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে এই বাসায় আগুন লেগে যাবে। ভালো চাইলে বিয়ে ভাঙিস। নয়তো তোর কপালে কি আছে তুই নিজেও জানিস না।
— তুই খালামণি কিংবা দাদীকে নূর আপির কথা বলে দে। তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
— তুই এনাজের কথা কেন বলিস না?
— তোর বিষয় আর আমার বিষয় এক না। এনাজ যদি আব্বুকে প্রস্তাব দিতো তাহলে আমি সব বলে দিতাম। কিন্তু ও তো কিছু বলেনি। তুই সবাইকে নূর আপির কথা বলে দে।
— বলতে গিয়েছিলাম। কেউ আমার কথা শুনতে চাইনি।
— আজাইরা কথা বলিস না তো।
—আম্মুকে বলছি কিন্তু সে বলে তোর আব্বুকে বল। আব্বুকে কল দিয়েছি সে বলে তোমার বিয়ে নিয়ে টেনশনে আছি। কোন কথা শুনবো না। তোমার দাদী যাকে পছন্দ করেছে তাকে বিয়ে করে নাও। তুই তো জানিস আমি আব্বুকে একটু ভয় পাই। দাদীকে বলতে গেলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করে দিলো।
— তুই একটু কষ্ট করে দাদীকে বলে দেখ।
— দাদী আমার কথা শুনতে নারাজ। দেখ উনার এমনি হাই প্রেশার। যদি বেশি চাপ দেই তাহলে স্ট্রোক করে বসতে পারে। তখন আমার বাপ আমাকে তায্যপুত্র করবে। ঝামেলা তুই লাগিয়েছিস, তুই সব ঠিক করবি। আমি কোন হেল্প করবো না। সব নষ্টের গোড়া তুই।
— দেখ পাঠা রাগ উঠাইস না। তোর এমন গা সারা কথাবার্তায় আমার শরীর জ্বলছে।
— তোকে দেখেও আমার গা জ্বলছে। ভালো চাইলে বিয়ে ভেঙে দে।
— তুই না এতো রাগী, তাহলে বিয়ে ভাঙিস না কেন?
— দেখ, সব জায়গায় রাগ দেখানো যায় না। আমি এখন রাগ দেখালে দাদী স্ট্রোক করবে। তখন আরেক ভেজাল হবে।
— হু তা করবি কেন? পারিস তো শুধু আমার সাথে। যত রাগ সব আমার ওপর।
— কথা না বলে বিয়ে ভাঙার প্ল্যান কর। আমি তোকে একটুও সাহায্য করবো না। নিজে একা একা পাকনামি করছিস। এখন একা একা সব ঠিক করবি। এটাই তোর শাস্তি।
ওর কথা শুনে আমার মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো। রেগে সাপের মতো ফোঁস করে বললাম,
— ভাঙবো না বিয়ে। আমি তোকেই বিয়ে করবো। দেখি তুই কি করতে পারিস? আর বিয়ে কি করে ভাঙিস তাও দেখবো।
— এমনটা হলে কেয়ামত ঘটিয়ে ফেলবো আমি।
— কচু করবি। ধ্যাত, মুডটাই নষ্ট!
জোরে জোরে পা ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। এই পঠার কথা শুনে আমার রাগ উঠছে। সব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবই আমার কপাল।
💖💖💖
বিকেলে…..
টেবিলের ওপর ছোট একটা চিরকুটে লেখা ছিলো,”ছাদে এসো।” আমার মন বললো এটা এনাজের কাজ। তাই দ্রুত চলে এলাম।সিঁড়ি থেকে ছাদে পা দিতেই একটা হাত এসে টেনে আমাকে দেয়ালের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করতে গেলে মুখ চেপে ধরলো।পারফিউমের ঘ্রাণটা পরিচিত লাগছে। পিটপিট করে চোখ খুলে এনাজকে দেখে পিলে চমকে উঠলো। চোখ দুটো রক্তবর্ণ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ, মুখ ফুলে লালচে হয়ে আছে। রাগী কন্ঠে বললো,
— আমাকে মেরে ফেলার চিন্তা-ভাবনায় আছো?
— উম উম উম!
— কি শুরু করছো তোমরা ভাই-বোন মিলে? আগামীকাল তোমাদের বিয়ে টিডি পোকা! চিন্তা করছো আমার মনের অবস্থা এখন কিরকম? আমি কি অবস্থায় আছি তা একমাত্র আমি জানি।তোমরা কেউ আমার দিকটা একবারো ভেবে দেখলে না। এই তোমাদের বন্ধুত্ব, এই তোমাদের ভালোবাসা!
আমি চোখের ইশরায় তার হাতের দিকে দেখিয়ে দিলাম। যার মানে হলো,”মুখের থেকে হাতটা সরান।” উনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না। চোখ, মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি?
আমি আবারো তার হাত দেখিয়ে দিলাম। উনি এবার বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে ফেললো। তবে আরেক হাত দিয়ে আমার দুই হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আমি একটু থেমে থেমে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,
— আপনার বন্ধুকে কিছু না বলে আমার সাথে খেচাখেচি করছেন কেন? আমি তো বিয়ে ভাঙার জন্য উঠে-পরে লাগছি। কিন্তু ওর তো কোন রিয়েকশন নেই।
— বিশ্বাস করো বিয়েটা যদি তায়াং-এর সাথে ঠিক না হয়ে অন্য কারো সাথে হতো তাহলে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তায়াং হওয়ায় কিছু করতেও পারছি না।
— বোকার মতো কথা বলেন না। তুলে নিয়ে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে তা কে বললো আপনাকে। রাগের মাথায় কিছু করা ঠিক হবে না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।
— কি করবো আমি বলো? আমার মাথা কাজ করছে না। গতকাল যখন শুনলাম তোমার সাথে তায়াং-এর বিয়ে তখন ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেকে শেষ করে দেই।
— চুপ করেন। খালি উল্টোপাল্টা কথাবার্তা। আরেকবার মরার কথা বললে আমিই জানে মেরে ফেলবো।
— আমি জানি তুমি বিশ্বাস করতাছো না। তবে তুমি মিলিয়ে নিয়ো তুমি বিয়েতে কবুল বলবা সাথে সাথে আমি বিষ খাবো। একদিক দিয়ে তোমার বিয়ে হবে আরেকদিক দিয়ে আমার লাশ বের হবে।
— আপনি কিন্তু এবার বেশি বলছেন এনজিও সংস্থা।
— তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। বিশ্বাস করো তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো।
হাত ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার শব্দে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা ছেলে সামান্য কারণে কাঁদে না তা আমি জানি। আর এনাজকে এই প্রথম কান্না করতে দেখলাম।কতটা ভালোবাসলে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি, সে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাঁদছে। কান্না কন্ঠেই বললো,
— সব ঠিক করে দাও টিডি পোকা। আমার শুধু তোমাকে চাই। তুমি ছাড়া আমার জীবন আবার মরুভূমির মতো খা খা করবে। রংহীন জীবন নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। আর কিছু চাই না আমি। আমার প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার পরও আমার এতটা নিঃস্ব লাগেনি যতটা এখন লাগছে।সবে তো আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। ভেবেছি এই মাসটা গেলে সব গুছিয়ে তোমার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবো। কিন্তু সব এলোমেলো কেন হয়ে গেলো?
আমি তার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হাত দুটো আলতো করে তার পিঠে রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
— ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি প্লিজ একটু শান্ত হোন। এতটুকু কথা কান খুলে শুনে রাখুন, আমি যদি আপনার না হই তাহলে আর কারো হবো না। আমি শুধু আপনারি।
— তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তুমি এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার তোমাকেই লাগবে।
— আপনি শান্ত হোন আমি দেখছি। প্লিজ কান্না করবেন না। আমার অনেক খারাপ লাগছে।
এনাজ আমাকে ছেড়ে চোখ মুছে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ এখনো টলমল করছে। নাক টেনে চোখের পানি মুছে আমার দিকে ঘুরে বললো,
— যা করার দ্রুত করো। তায়াং-এর সাথে বিয়েটা না হলে আমি অন্য কিছু করতাম। কিন্তু যেখানে আমার জানে জিগার বন্ধু আছে সেখানে আমি তোমাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক গোলাতে চাইছি না। তবুও যদি আমার কোন হেল্প দরকার হয় তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের পাশে আছি। আরেকটা কথা, আমাকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে এই বিয়ে ভাঙো। নয়তো জামাই নিয়ে আমার মরামুখটা একবারের জন্য দেখে এসো।
— আবারো বেশি কথা😡।
— সত্যি মরে যাবো আমি। তোমাকে না পেলে আমি বেঁচে থাকবো না।
চোখের পানি মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি মূর্তির মতো সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। দেয়ালের সাথে নিজের মাথাটাকে ধরাম করে এক বারি মারলাম। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। বেশি পাকনামি করতে গিয়েছি এখন তার ফল ভোগ করছি।
#চলবে
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_55
#Writer_NOVA
পরেরদিন…..
শাড়ির দোকানে একের পর এক শাড়ি উল্টিয়ে যাচ্ছি। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বিয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছি। দোকানদার শাড়ি দেখাতে দেখাতে পাগলপ্রায় অবস্থা।খালামণি,দাদী, আমি, তায়াং ভাইয়া ও এনাজ এসেছি বিয়ের শপিং করতে।আমি আসতে চাইনি, খালামণি জোর করে নিয়ে এসেছে। আর এনাজকে দাদী নানা কথা বলে আসতে বাধ্য করেছে। দাদীর ইচ্ছে তার বড় নাতীর বিয়ের শপিং নিজ চোখে দেখবে। এখন আমার দাদীর ওপর অনেক বেশি রাগ উঠছে। মনে হচ্ছে উনি এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে। এনাজ আসতে চাইনি ওকে নিয়ে আসার কি দরকার? এমনি ও ভেতরে পুরো ভেঙে গেছে তার মধ্যে নিজের চোখের সামনে এসব দেখলে ও কি ঠিক থাকবে? ওকে সামলাতে পরবর্তীতে আমাকে হিমশিম খেতে হবে। আমি এক দৃষ্টিতে শাড়ির স্তুপের দিকে তাকিয়ে আছি। খালামণি আমাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই নোভা, এই লাল খয়েরী রঙের বেনারসিটা কেমন লাগে?
— হুম ভালো।
— তাহলে কি এটাই নিবো?
— তোমাদের যেটা ভালো লাগে তাই নাও।
— আমাদের পছন্দেই যখন নিবো তাহলে তোকে কেন নিয়ে এসেছি? এই তায়াং, এনাজ দেখতো এই শাড়িটা কেমন? নোভাকে কি মানাবে?
আমি মলিন মুখে একবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি একবার আমার দিকে রেগে তাকিয়ে খালামণিকে বললো,
— তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই নাও। আমার কোন দ্বিধা নেই। শাড়ির বিষয় তোমরা মেয়েরাই ভালো বুঝবে।
খালামণি আফসোসের সুরে বললো,
— দেখো দেখি কান্ড! আমার যদি সব পছন্দ করতে হয় তাহলে দল বেঁধে এসে কি লাভ হলো? এনাজ বাবা তুই বল তো কোন শাড়িটায় আমাদের নোভাকে পুরো পুতুল বউ লাগবে?
এনাজ একবার আমার দিকে ছলছল চোখে তাকালো। পৃথিবীতে আমি এই প্রথম ছেলে দেখলাম যাকে কিনা তার ভালোবাসার মানুষের জন্য বিয়ের শাড়ি চয়েজ করতে বলা হচ্ছে। তার ভেতরটা নিশ্চয়ই জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। আমার দিকে দৃষ্টি রেখে চোখের কোণের পানি মুছে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে খালামণিকে বললো,
— আন্টি ওকে একদম টকটকে লাল বেনারসিতে পুতুল বউয়ের মতো লাগবে। লাল শাড়িতে গোল্ডেন সুতোর কাজ পুরো ফুটে থাকবে। লাল শাড়ি মানেই হলো মেয়েদের অন্যরকম দূর্বলতা। আপনি দোকানদারকে লাল বেনারসি দেখাতে বলেন।
দাদী খুশিমনে বললো,
— এতক্ষণে আমার দুই নাম্বার জামাই একদম ঠিক কথা বলছে। বিয়ের শাড়ি লাল না হইলে আমার কাছে বউ মনে হয় না। তানভীরের মা লাল টকটকে শাড়ি দেখাইতে বলো। এনাজ শাড়ি পছন্দ করে দিবে।
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে বিয়ে নিয়ে আমারও অন্য সব মেয়ের মতো অনেক জল্পনা, কল্পনা ছিলো। লাল বেনারসি আমারও ভীষণ পছন্দ। কিন্তু কে জানতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে নিজের বিয়ের শপিংয়ে আসতে হবে। তাও অন্যের বউ সাজবো বলো। দোকানদার লালের মধ্যে অনেকগুলো বেনারসি বের করলো। খালামণি একটা টেনে নিয়ে আমার গায়ে জড়িয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— দেখ তো তায়াং এটা কেমন?
তায়াং ভাইয়া বিরক্তি সহকারে বললো,
— তোমরাই দেখো। আমার দেখার ইচ্ছে নেই।
কথাগুলো বলে গটগট পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। খালামণি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
— যাক বাবা, এই ছেলের আবার কি হলো? এনাজ একটা শাড়ি পছন্দ করে দে তো।
এনাজ পুরো দোকানে চোখ বুলিয়ে দোকানদারকে আঙুল দিয়ে একটা লাল বেনারসি দেখিয়ে দিয়ে বললো,
— মামা, ঐ শাড়িটা নামান তো।
দোকানদার শাড়ি নামাতেই এনাজ নিজ হাতে সেটাকে মেলে আমার মাথায় ঘোমটার মতো করে দিয়ে দাদীকে বললো,
— দেখো তো দাদী এটা কেমন? পুরো পুতুল বউ লাগছে না? তায়াং-এর পুতুল বউ।
“তায়াং-এর পুতুল বউ ” শব্দটা শুনে আমি চমকে তার দিকে তাকালাম। উনি জোর করে হেসে আমাকে বললো,
— এই শাড়িটা পরলে তায়াং তোমার দিক থেকে চোখ সরাতেই পারবে না। অনেক সুন্দর লাগবে তোমাকে।
আমি করুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মুখ দিয়ে আজ কোন কথা বের হতে চাইছে না। ফ্যালফ্যাল করে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খালামণি, দাদী এগিয়ে এলো।দাদী আমার থুতনিতে হাত রেখে বললো,
— বাহ, এনাজ তোর চয়েজ আছে বলতেই হয়। কি সুন্দর লাগছে আমার নাতবউটাকে! একদম লাল টুকটুকে বউ। তানভীরের মা এটাই নিয়ে নাও।
এনাজ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
— দেখতে হবে তো পছন্দটা কার? নিজের জানে জিগার বন্ধুর হবু বউয়ের জন্য সুন্দর শাড়ি চয়েজ না করে থাকতে পারি। মা শা আল্লাহ একদম পরীর মতো লাগছে।
খালামণি শাড়িটা নিয়ে দোকানদারকে বললো,
— এটা প্যাক করে দিন ভাই।
আমি স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। আমার মাথা কাজ করছে না। কি থেকে কি হচ্ছে তা আমি নীরব দর্শকের মতো সব দেখে যাচ্ছি। আমি যে তার প্রতিবাদ করবো সেই শক্তিটুকু আমার মাঝে নেই। বিয়েটা আজই হয়ে যেতো। কিন্তু তায়াং ভাইয়ার এক ফুপু আজ আসতে পারবে না। তাই আগামীকাল শুক্রবার দেওয়া হয়েছে।
বড় মামা, মামী আজ বিকেলে আসবে।নূর আপি আসবে না। তার অবস্থা বোধহয় এনাজের মতোই।আমার হাতে আরেক দিন সময় বেরেছে।কিন্তু কিভাবে কি করবো তাই বুঝতে পারছি না। এনাজ শাড়ি পছন্দ করেই দোকান থেকে বের হয়ে গেছে। আমি খালামণির দিকে না তাকিয়ে বললাম,
— খালামণি বিয়ের শাড়ি যেন পাঁচ হাজারের বেশি না হয়। পারলে এর কম নিয়ো। একদিনের জন্য এত দাম দিয়ে শাড়ি কেনার দরকার নেই।
— সে কি কথারে নোভা! কি বলিস তুই? বিয়ে তো মানুষের একবারই হয়। হোক একদিন পরবি।তাই বলে আমার একমাত্র ছেলের বউকে কি আমি এত কম দামের শাড়ি দিতে পারি?
— শো অফ করার কোন দরকার নেই খালামণি। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমাদের এতো বিলাসিতা চলে না। অল্পতে তুষ্ট হতে হয়।
— তুই টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করিস না তো।তোর খালু বিয়ের জন্য পুরো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।
— খালু প্রবাসে কষ্ট করে টাকা কামাই করে খালামণি। টাকাটা যদি তায়াং ভাইয়ার হতো তাহলে অন্য কথা ছিলো। কিন্তু টাকাটা খালুর। তাই আমাকে ভাবতে হচ্ছে।
দাদী খুশিমনে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— দেখলে তানভীরের মা। আমি কি ওকে শুধু শুধু তানভীরের জন্য পছন্দ করেছি? বিয়ের আগেই শ্বশুরের কষ্টের কথা চিন্তা করছে। এমন মেয়ে কি হাতছাড়া করা যায় তুমিই বলো? একদম সোনার টুকরো মেয়ে। দেখবে তোমার সংসার সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখবে। তোমার কিছু করতেই হবে না।
খালামণি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
— তুই যেভাবে বলবি সেভাবেই হবে। বিয়ের পর তোর হাতে পুরো সংসার তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
আমি মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। বাবা-মা যদি জানতো তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তাদের সন্তান নিজের ভালোবাসাটাকে কিভাবে বিসর্জন দেয়। তাহলে হয়তো এই শহরে এতো ভাঙা মনের মানুষ থাকতো না। তারা কেন বুঝে না তাদের পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করলে তাদের সন্তান ভালো নাও থাকতে পারে?
💖💖💖
অনেকখন ধরে তায়াং ভাইয়া ও এনাজের কোন দেখা নেই। কোথাও গেছে তাও জানি না। দুজনকেই কল দিলাম কিন্তু কারো রেসপন্স নেই। এনাজকে পোকামাকড়ের ঔষধের দোকানে দেখে আমার পিলে চমকে উঠলো। দ্রুত সেদিকে গেলাম।
— ভাই, ইদুর মারার হাই পাওয়ারের বিষ পাওয়া যাবে?
এনাজের কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু করলো। ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে কি করবে ও? নিজের ক্ষতি করার চিন্তা করছে না তো?আমি দ্রুত ওর হাত ধরে অন্য দিকে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে কি করবেন?
— খাবো।
— মানে?
— তোমার, তায়াং-এর বিয়ে হবে একদিক দিয়ে আরেক দিক দিয়ে আমি বিষ খাবো।
— কি পাগলামি শুরু করছেন?
— পাগলামির দেখছো কি তুমি?
— এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আপনার মতো বুদ্ধিমান ছেলেকে দিয়ে এমনটা আশা করি না আমি।
— বিয়েটা একবার হোক তারপর দেখো আমি কি করি। যাও গিয়ে বিয়ের শপিং করো।
— এনাজ আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।আর কিন্তু সহ্য হচ্ছে না।
— তোমাকে না পেলে আরো বেশি করবো। আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। আমার শুধু তোমাকেই চাই। তুমি আমার জীবনে থাকলে সব ঠিক থাকবে তুমি না থাকলে আমিও নাই।
— মাথা কি পুরো গেছে আপনার?
— হ্যাঁ, অনেকটা তাই। এই মাথা আমার ঠিক হবে না।
— আপনি শান্ত হোন। একদম উল্টো পাল্টা চিন্তা করবেন না। আমি কি মরে গেছি? এমন পাগলামি কেন করছেন? বুঝদার মানুষ হয়েও অবুঝের মতো কাজ করছেন।
উনি অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোমাকে আমি কারো সাথে ভাগ করতে পারবো না টিডি পোকা।
— একটু ঠান্ডা হোন। আমি দেখছি কি করতে পারি।
— আজকের দিন পেরুলে কাল তোমার বিয়ে। আর আমি ঠান্ডা হবো? এমনটা তুমি ভাবলে কি করে?
আমি তার কথার উত্তর দেওয়ার আগে পেছন থেকে তায়াং ভাইয়া বললো,
—এনাজ একটু শোন?
এনাজ মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বললো,
— আমি কারো কথা শুনতে ইচ্ছুক নই।
কথা শেষ হতেই এনাজ চলে গেলো। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— এই সবকিছুর মূলে তুই। আমাদের এতবছরে বন্ধুত্বে ফাটল ধরিয়ে দিলি। তোকে আমি ছাড়বো না।
তায়াং ভাইয়াও চলে গেল। আমি শুকনো মুখে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। ধীর পায়ে খালামণিদের কাছে যেতেই সে তায়াং ভাইয়াকে ডেকে আনতো বললো। আমি তাই আবারো ওকে খুঁজতে বের হলাম।শপিং মলের পেছনের দিকে এসে হঠাৎ দেখতে পেলাম তায়াং ভাইয়া চেচিয়ে কারো সাথে কথা বলছে। মনে হলো নূর আপির সাথেই বোধহয়। অপরপাশ থেকে কল কেটে যাওয়ায় তায়াং ভাইয়া রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। ওর সামনে যেতেও ভয় করছে। খালামণি ওদের ডাকছে। না গেলেও ভেজাল। মৃদুস্বরে দূর থেকে ডাকলাম,
— ভাইয়া!
— চোখের সামনে থেকে সর। নয়তো তোকে আমি খুন করে ফেলবো।
— খালামণি ডাকছে।
— তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না নোভা। ভালো চাইলে আমার সামনে থেকে চলে যা।
— সবাই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমার দিকটা কেউ বিবেচনা করছিস না?
— তোকে কেউ ভুল বুঝছে না। তুই যা করছিস তাই বুঝছে।
— নিজেদের দিকটা ভাবলি তোরা? একবার চিন্তা করলি না আমি কি অবস্থায় আছি। দাদীকে বিয়ের কথা বলেছি বলে এখন সব দোষ আমার? আমার মনের ভেতর কি চলছে তোরা কি তা জানিস? তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি এই বিয়েতে অনেক খুশি।জেনেশুনে তাই এসব করছি। আমি কি অবস্থায় আছি তা আমিই জানি ভাইয়া। আমি শুধু পারছি না চিৎকার করে কাঁদতে। তোরা তো আমাকে দোষারোপ করে নিজেরা পার পেয়ে যাচ্ছিস। কিন্তু আমি, আমি তো পারছি না বিয়ে ভাঙতে আবার পারছি না বিয়ে করতে। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছিস। আমাকে একটু হেল্পও করছিস না। আমি একা কি করবো তাই বুঝতে পারছি না। তোরা আমার সাথে থাকলে বিষয়টা কি এতদূর গড়ায় বল?হ্যাঁ, আমি মানছি আমার দোষ। আমি দাদীকে বিয়ের কথা বলছি। কিন্তু তোরা আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিস কেন? শুধু এতটুকু চিন্তা করিস ভাইয়া, তোদের মতো আমিও ভালো নেই। আমিও এনাজকে ভালোবাসি। আমার ওপর সব চাপিয়ে দিস না। তাহলে আমার মৃত্যু অনিবার্য।
কথাগুলো বলে এক মিনিটও দাঁড়ালাম না। কাঁদতে কাঁদতে অন্য দিকে চলে এলাম। দেয়ালের আড়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু চিৎকারের শব্দটা বাইরে বেরুতে দিলাম না। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ মুছে হাসি মুখে পেছনে ঘুরলাম। এনাজকে দেখতে পেয়ে আমার কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো। ওর বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার মাথাটা পেছন দিকে ধরে শক্ত করে তার বুকে চেপে ধরেছে। আজ আমার কোন লজ্জা, সংকোচ কাজ করছি না। কিছু সময় পর কান্নার বেগ কমতেই সে বললো,
— তায়াং-এর সাথে তোমার সব কথা আমি শুনেছি।আমায় মাফ করে দিও। আমিও শুধু আমার দিকটাই দেখেছি। তোমার মনের অবস্থাও চিন্তা করা উচিত ছিলো আমার।
আমি চোখ মুছে তাকে ছেড়ে দাঁড়ালাম। তার চোখ দিয়েও টপটপ করে পানি পরছে। আমি এগিয়ে গিয়ে তার দুই চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
— প্লিজ আপনি কান্না করবেন না। আপনার চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। অনেক কষ্ট হয়।
উনি এক হাত দিয়ে বুকের বা পাশটা ধরে বললো,
— তার থেকে বেশি কষ্ট আমার এইখানে হচ্ছে।
— আমি সব ঠিক করে ফেলবো। প্লিজ আপনি ভেঙে পরেন না।
হাত বাড়িয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে গেলেই উনি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
— লাগবে না।
— কেন?
— তায়াং-এর চুল ঠিক করে দিও।
— আচ্ছা তাহলে যাই।
এনাজ আমার এক হাত ধরে আটকে বললো,
— একদম না। আমারটা ঠিক করে দিবে তুমি। আর কারোটা নয়।
আমি তার চুল ঠিক করে দিয়ে গাল দুটো টেনে বললাম,
— ভালোবাসি!
— এটাও লাগবে না। ভালবাসলে বিয়েটা ভেঙে দিতে।
— আমার ভালোবাসাও লাগবে না?
এনাজ অভিমানী সুরে বললো,
— না লাগবে না।
— তাহলে সব জমা করে রাখি। তায়াং ভাইয়ার সাথে যদি বিয়ে হয় তাহলে ওকেই দিবোনি।
— একদম না। তুমি পুরোটাই আমার। তাই তোমার সবকিছু আমার। আমি কারো সাথে তোমাকে ভাগ করতে পারবো না।
— একটু ধৈর্য্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
— তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে বড্ড বেশি জেঁকে ধরেছে। শেষ পর্যন্ত তোমাকে পাবো তো আমি?
আমি চুপ হয়ে গেলাম। এই কথার উত্তর আমার কাছে নেই। দুদিন ধরে আমারও ভীষণ ভয় করছে। যদি আমি কিছু করতে না পারি?ভাইয়ার সাথে সত্যি যদি বিয়েটা হয়ে যায়! তাহলে কি করবো আমি? এনাজের বা কি হবে? ও যা পাগলামি শুরু করছে তাতে যেকোনো সময় নিজের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে এনাজ আবার জিজ্ঞেস করলো,
— বলো না শেষ অব্দি আমি তোমাকে পাবো তো? নয়তো সত্যি তোমাকে আমার মরা মুখ দেখতে হবে।
তার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আমার মাথায় রাগ চেপে উঠলো। রাগী গলায় বললাম,
— এক থাপ্পড় মেরে মরার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো।দুই দিন ধরে শুধু মরার কথা শুনছি মুখে। আরেকবার বললে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে এনাজ।
— সত্যি কথা বলছি তো বিশ্বাস করছো না। তোমার বিয়েটা যদি হয় তাহলে আমার কথা মিলিয়ে নিও।
— আবার😡!
— তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না তো। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। শুনতে পেয়েছো আমি কি বলছি? আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। এখন আমাকে বাঁচাতে চাইলে বিয়ে ভেঙে দাও। আর যদি মারতে চাও তাহলে বিয়ে করে নিও। আমাকে বাঁচাবে নাকি মারবে তা শুধুমাত্র তোমার হাতে।
গম্ভীর মুখে কথা শেষ করে এনাজ চলে গেল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। আদোও কি সব ঠিক করতে পারবো আমি? নাকি চারটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? কিচ্ছু জানি না।
#চলবে