শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৫৬ + Special Part

0
737

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Special_Part
#Writer_NOVA

— ঐ ছেমড়ি জলদী দৌড় দে।

তায়াং ভাইয়া তাড়া পেয়ে শাড়ির কুঁচি ধরে দিলাম ভো দৌড়। প্রথমে শাড়ি তার ওপর বোরখা পরে কি দৌড়ানো যায়? এই সহজ কথাটাই আমি পাঠারে বোঝাতে পারছি না। আমি থেমে কিছুটা রাগ দেখিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললাম,

— কি ধরনের কথাবার্তা এগুলা তায়াং ভাইয়া?

— বেশি কথা না বলে শাড়ি উচাইয়া দৌড় মার আগে।

— মান-সম্মান আর কিছু রাখলি না তুই পাঠা।

— কেউ দেখলে ধরে-বেধে বিয়ে দিয়ে দিবে বোইন। তোর পায়ে পরি জলদী দৌড় মার।

— শাড়ির ওপর বোরখা পরছি। এক কদমও দিতে পারছি না। তুই দৌড়াতে বলছিস বলে কোনরকম চেষ্টা চালাচ্ছি। এর পর যদি বেশি কথা বলিস তাহলে তোকে শাড়ি,বোরখা পরিয়ে দৌড়াতে দিবো।

— এই গলির থেকে যেতে পারলেই নিরাপদ।

— আরেকটু দেরী হলে এতখনে সর্বনাশ হয়ে যেতো। ঐ পাঠা দাঁড়া। আমার জুতা বাঁকিয়ে গেছে।

আমি কিছুটা পেছনে পরে গেলাম। তায়াং ভাইয়া দৌড় থামিয়ে পেছনের দিকে চলে এলো। রেগে বললো,

— বিয়ের জুতা জোড়ায় পরে আসতে হইছে? তোর কি আর জুতা নাই রে শাঁকচুন্নি?

— দেখ, অনেক কষ্ট করে তিন ঘন্টা পার্লারে বসে থেকে বউ সাজছি। লাল বেনারসির সাথে যদি বিয়ের জুতা না পরি তাহলে কি আমায় বুটুফুল(বিউটিফুল) লাগবে বল?

— তোর বিউটিফুলের গুল্লি মারি।তোকে ইচ্ছা করছে কোলে তুলে আছাড় মারতে।জুতা খুলে হাতে নে। তারপর দে দৌড়।

— কেন জুতা খুলমু কেন? এগুলা সব আমার। একটা জিনিসের দাবী রাখবি না। শেষ অব্দি বিয়েটা ভেঙে দিলাম। এখন পালাচ্ছি। এই শাড়ি, গহনা, জুতা সব আমার। তুই তোর বউকে নতুন কিনে দিস।

— চুপচাপ সবকিছু দিয়ে দিবি। এগুলোর ওপর আমার নূরের অধিকার।

— এত ছেঁচড়া কবে হলি তুই? তোর বউকে কি নতুন কিনে দিতে পারবি না? এগুলো আমার খালুর টাকার। বিয়েতে যেহেতু আমায় দিয়েছে তাহলে সব আমার।গহনার একটা পুঁতিও আমি ফেরত দিবো না।

— যা তোরে ভিক্ষা দিয়ে দিবোনি।

— ঐ ভিক্ষা দিবি কেন? এগুলো আমার জন্য খালামণি কিনছে। তাই এগুলো সব আমার।

— জ্বি না ময়না। এগুলা আমার বউয়ের জন্য কিনছে। তুই যদি আমার বউ হতি তাহলে এগুলো সব তোর হতো। কিন্তু এখন আমার বউ হবে নূর তাই এগুলো সব ওর।

— আমি একদিন পরে ফেলছি। তুই তোর বউকে পুরাতনটা দিবি ভাইয়া?

— হুম দিবো। একদিন পরলে কিছু হয় না।

— কিপ্টা! এগুলো আমাকে না দিলে আমি ফিরে গেলাম বাসায়। তুই থাক। গিয়ে বলবো আমি তোকে বিয়ে করতে রাজী আছি। এমনিও তুই জামাই হিসেবে খারাপ না। তাহলে তো এতো গহনা, শাড়ি, জুতা সব আমার হয়ে যাবে।

— সিরিয়াসলি, তুই এসবের জন্য আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস? দাঁড়া এনাজকে বলছি। পরে মজা বুঝবি।

— বল তোর ঐ বন্ধুকে। আমি কি ভয় পাই নাকি?

— আচ্ছা একটু ওয়েট কর।

— বিয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র খালুর টাকায় কেনা হয়েছে। তাই এসবে কোন দাবী করতে পারিস না।

— আমি দাবী করবোই।

— কেন তোর টাকা দিয়ে কিনছিস?

— আমার বাপের টাকা দিয়ে কিনছি।

— ইস আসছে। যা ভাগ।

— তোর কি ইচ্ছে আছে বিয়েটা করার?

— না তো। তাহলে কি পালাতাম নাকি?

— তাহলে এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন?

— ওহ সত্যি তো। আমি তো ভুলেই গেছিলাম আমরা যে বিয়ের আসর থেকে পালাইছি।

— এখন তো মনে পরছে। দয়া কইরা বোইন এবার দৌড় দে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। তায়াং ভাইয়ার হাত ধরে দিলাম দৌড়। এতখনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা কেন দৌড়াচ্ছি? বাসা থেকে পালিয়েছি আমরা দুজনেই। আরেকটু দেরী হলে কাজী আমাদের বিয়ে পরিয়ে ফেলতো। তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে পার্লারে সেজেছি। পার্লার থেকে সন্ধ্যার পর ফিরে এসেছি। আগের থেকে সব প্ল্যান করে রেখেছিলাম। সুযোগ বুঝে ইফাত,সিফাতকে দিয়ে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে। সেই ফাঁকে শাড়ির ওপর কোনরকম বোরখাটা পরে হিজাব পেঁচাতে পেঁচাতে আমি ও তায়াং ভাইয়া ছুট।আমাদের পালাতে তন্বী,ইভা,ইফাত,সিফাত প্রচুর সাহায্য করেছে। তন্বী সবার চোখের আড়ালে আমাদেরকে বের করতে হেল্প করেছে। ইভা সবকিছু পাহারা দিয়েছে।বাসা ভর্তি মানুষকে ফাঁকি দিয়ে পালানো তো চারটি খানি কথা নয়।গহনা খোলার সময়ও পাইনি। এখন শাড়ি,বোরখা, গহনার ভারে আমার অস্বস্তি লাগছে। দৌড়াতেও পারছি না। শাড়ির কুঁচি পেচিয়ে যাচ্ছে। তায়াং ভাইয়াকে থামিয়ে চেচিয়ে বললাম,

— ঐ তোর বাইক কোথায়? বাইক থাকলে কি এতো দৌড়াতে হয়?

— মেইন রোডে ইমরান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

— বাসার নিচে থাকলে কি সমস্যা হতো? পাঠা কি তোকে সাধে বলি আমি? মাথার মধ্যে ঘিলু নামক কোন বস্তুই নেই। আমি আর দৌড়াইতে পারছি না। একটু দাঁড়া ভাই। বোরখার সাথে শাড়ির কুঁচি পেচিয়ে যাচ্ছে।

— বেশি দাঁড়ানো যাবে না। ধরা পরে গেলে আমরা শেষ।

— শাড়ি পরে কি দৌড়ানো যায়? তার ওপর বোরখা! আমি হাঁপিয়ে উঠছি। এর জন্য এই ব্যাঙের শাড়ি আমার পরতে ইচ্ছে করে না। কুচি পায়ের সাথে বেজে যায়। বিয়েতে লেহেঙ্গা দিলে কি হইতো? তাহলে আমি অনায়াসে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে দৌড়াতে পারতাম।

— আম্মুকে বলোস নাই কেন? শপিং তো তোকে নিয়ে করতে গিয়েছিল।

— তখন কি জানতাম নাকি বাসা থেকে এভাবে পালাতে হবে। শোন ভাই, নূর আপিকে বিয়ের দিন লেহেঙ্গা দিবি।

— কেন ও কি তোর মতো পালাবে নাকি?

— আরে না তার জন্য নয়। শাড়ি সামলাতে অনেক কষ্ট। শাড়ি সামলানোর মতো ঝামেলা ২য়টা নেই।

— দ্রুত পা চালা তুই। বকরবকর করতে করতে মাথা ধরিয়ে ফেলছিস।

— কোথায় যাবো আমরা?

— দেখি কোথায় যাওয়া যায়।

হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে চলে এলাম। সেই আলোতে তায়াং ভাইয়াকে দেখে আমি হাসতে হাসতে পেট ধরে বসে আছি। তাড়াহুড়োয় তায়াং ভাইয়া যে ড্রেসআপ পরছে তাতে হাসি আসারি কথা। এতখন অন্ধকার থাকায় খেয়াল করিনি।ও বিয়ের শেরওয়ানি পায়জামার সাথে ওপরে টি-শার্ট পরে চলে আসছে। ওকে যা লাগছে না 🤣। টি-শার্টটাও শর্ট। দুই/তিন বছর আগের হবে। ভালো করে দাঁড়ালে পেট বের হয়ে যায়।আমি হাসতে হাসতে বললাম,

— ঐ তুই এগুলা কি পরছিস?

— কেন দেখোস না?

— ভালো করে নিজের দিকে তাকা ভাই।

তায়াং ভাইয়াও খেয়াল করিনি কিসের মধ্যে কি পরেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে কপালে জোরে একটা চাপর মেরে বললো,

— দেখ তো এগুলো কোন কথা? আম্মু গতকাল চেয়ারের মধ্যে দুই বছর আগের টি-শার্টগুলো ভাজ করে রাখছিলো। ঘর মুছবে তার জন্য। আমি তাড়াহুড়ো করে পাঞ্জাবী বদলে ঐ জায়গা থেকে একটা পরে দিছি দৌড়।

— তোকে যা লাগছে না ভাইয়া। একদম ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো। তুই একটু হাত দুটো উঁচু কর।

— কেন?

— তাহলে তার টি-শার্ট ব্লাউজে রূপান্তরিত হবে😂।

— ভেটকাইস না। এখন রাত হয়ে গেছে। কেউ আমায় খেয়াল করবে না। এটা পাল্টে আসতে গিয়ে কি বিপদে পরবো নাকি?

— থাক, সমস্যা নেই। ব্লাউজ আর পায়জামায় তোকে খারাপ লাগছে না।

—মজা নিচ্ছিস?

— হো🤭।

ভাইয়া আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। আমি মুখ টিপে হেসে ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে শাড়িতে বেজে দুইবার উষ্ঠা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম।

💖💖💖

মেইন রোড গিয়ে ইমরান ভাইয়ার থেকে বাইক নিয়ে আমরা রওনা দিলাম উত্তরের রাস্তায়।সময় এখন রাত আটটা।আমার কাছে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরটা আজ অন্য রকমভাবে সেজেছে। মাথা থেকে বড় একটা প্যারা তো নেমে গিয়েছে। এখন প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবো।মাথাটাও পাতলা লাগছে। তায়াং ভাইয়াকে খোচা মেরে বললাম,

— এই ভাইয়া শোন।

— খোচাচ্ছিস কেন?

— আমার কথাটা শোন।

— বল শুনছি। কিন্তু খোঁচা মারিস না।

— আমাকে ট্রিট দিস।

— কেন?

— ও মা একা একা সব প্ল্যান করলাম। বিয়েটা ভেঙে দিলাম। তুই কিছু করিস নি।

— তো?

— তো মানে কি? সব আমি একা সামলিয়েছি। অদক্ষ হাতে পুরোটা কমপ্লিট করলাম।

— যেহেতু তুই ভেজাল লাগিয়েছিস সেহেতু তুই সব করবি। আমরা করবো কেন?

— এর জন্য আমাকে ট্রিট দিবি না?

— প্রশ্নই উঠে না।

— যদি ট্রিট দিস সাথে বিয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র আমাকে দিয়ে দিস,তাহলে দুই দিনের মধ্যে তোর আর নূর আপির বিয়ে কনফার্ম করে দিবো।

ভাইয়া খুশি হয়ে বললো,
— সত্যি?

— হ্যাঁ তিন সত্যি।

—আচ্ছা আগে সব ঠিক করে দে। তাহলে তোকে আমি ট্রিট তো দিবোই সাথে এই জিনিসপত্রও।

—ওকে তুই শুধু দেখতে থাক কি করি আমি।

— কিন্তু কালকে বাসায় গেলে আমাদের ঢুকতে দিবে তো?

— কালকেরটা কালকে দেখা যাবে। আজকে চিন্তা করে মাথায় চাপ নিস না তো।

— প্লিজ বল না আগামীকাল কি করবো?

— কি আর করবো বল? তুই দাদী আর খালামণির পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবি। আমি আম্মু-আব্বুর পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। যতক্ষন পর্যন্ত তারা না মানবে ততক্ষণ পা ধরে বসেই থাকবো। না মেনে কোথায় যায় তাও আমি দেখবো।

— আইডিয়া পছন্দ হয়েছে।

— দেখতে হবে তো কে দিয়েছে।

কিছু সময়ের জন্য আবার নীরব হয়ে গেলাম। হঠাৎ ভাইয়া চেচিয়ে বললো,
— ঐ ছেমড়ি দূরে সর। আমার সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতাছিস কেন?

— ঐ কি বলিস এগুলা? আমি ঘেঁষাঘেঁষি কখন করলাম? আমি ভালো করে বসতে পারতাছি না। বোরখাটা পিছলিয়ে যাচ্ছে। বসে শান্তি পাচ্ছি না। তুই আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে বস না ভাই।

— কত জায়গা লাগে তোর মুটি? নে সামনে এগুয়েছি। এবার বস ভালো করে।

দুজন ঝগড়া করতে করতে গন্তব্যে চলে এলাম। পাঁচ তলা এক দালানের সামনে তায়াং ভাইয়া বাইক থামালো। আমি বাইক থেকে নেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

— এটা কাদের বাসা ভাইয়া?

— দুইতালায় এনাজ থাকে।

— আজকের রাতটা আমরা এনাজের কাছে থাকবো?

— হুম।

— ওকে, আমার কোন সমস্যা নেই। তোর মোবাইলটা দে।

— কেন?

— এতো কেন কেন করিস কেন তুই?

— মোবাইল বন্ধ করে রাখছি। খুললে বিপদে পরতে হবে।

— আমরটা তো বাসায় রেখে আসছি।

— মোবাইল দিয়ে কি করবি তুই?

— কয়েকটা ছবি তুললাম। তিন ঘন্টা বসে থেকে কি সুন্দর বউ সাজলাম। পালানোর ধান্দায় একটা ছবিও তুলতে পারিনি। ফিলিং দুক্কু 🥺।

— আহারে! থাক মন খারাপ করিস না। এনাজের সাথে তুলুস।

— আচ্ছা।

আমি ও ভাইয়া বাইকসহ গেইট দিয়ে ঢুকলাম। ভাইয়া ভেতরে ঢুকে বাইক তালা মেরে পাশে রেখে আমাকে বললো,

— উপরে চল।

— দাঁড়া এক মিনিট।

— কি হয়েছে?

— তোর পায়জামা উপরের দিকে উঠা। পেট বের হয়ে আছে🌚।

— শাঁকচুন্নি।

— এক কাজ কর ভাইয়া, তুই পায়জামাটাকে আরেকটু উঠিয়ে টি-শার্টটাকে ইন করে পর। তাহলে পেটও দেখা যাবে না। তোকেও খারাপ লাগবে না।

ভাইয়া আমার মজা করা বুঝতে পেরে দুই হাত কোমড়ে রেখে রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো।আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। ওর দিকে তাকালেই আমার হাসি পায়। শর্ট টি-শার্ট আর পায়জামায় ওকে দেখে আমার হাসি আটকে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। এখন যদি ওর সাথে একটু ছবি তুলতে পারতাম। তাহলে ওর এই সুন্দর ড্রেসআপটা দেখিয়ে পরে ব্লাকমেইল করতে পারতাম।ভাইয়া রেগে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। আমিও হাসতে হাসতে ওর পিছু নিলাম।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।
দু-চোখ পুড়ে কি দহনে তুই তো দেখিস না।
তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।

চোখের ভেতর বৃষ্টি ঝরে, হৃদয়টা হয় যেন নদী
তোর না থাকার একেকটা খন ছুয়ে দেখতি যদি
আমায় ছেড়ে কখনো দূরে যেতি না
তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

ফ্ল্যাটের দরজার সামনে কান পেতে রেখেছি। ভেতর থেকে ইমরানের “তুই তো দেখিস না” গানটা বাজছে। আমি দরজার থেকে কান সরিয়ে একবার মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোসোর সুরে বললাম,

— আহারে বেচারা কষ্টের গান শুনছে। তার কষ্টে আমি সত্যি কষ্টিত।

— নোভা,তুই কিন্তু এবার বেশি করছিস।

—একটুও না। তোর বন্ধু এগুলো কি গান শুনে? শুনবে তো জোরে সাউন্ড দিয়ে অপরাধী গান।

ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। আমি মেকি হাসি দিয়ে জোরে চেচিয়ে হেড়ে গলায় গান গাওয়া শুরু করলাম,

“ও মাইয়া, ও মাইয়ারে তুই অপরাধীরে
আমার স্বপ্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে
আমার অনুভূতির সাথে খেলার অধিকার দিলো কে
মাইয়া তুই বড় অপরাধী তোর ক্ষমা নাই রে।”

— চুপ কর।

— তোর বন্ধু এই গান শুনবো। আসল ছেঁকা খাওয়া গান তো এইগুলা।তা না করে আমার ফেভারিট সিঙ্গারের গান শুনে কেন?

— কথা কম বল তুই। আমরা যে ওর বাসায় আসবো তা ও জানে না। ওকে সারপ্রাইজ দিতে এখানে চলে আসছি। কিন্তু তুই যা শুরু করছিস।

আমি মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললাম,
— এত সুন্দর করে গান গাইলাম। কোথায় বাহবা দিবে। তা না করে ইনসাল্টিং করছে। আজকাল আর্টিস্টদের কেউ সম্মান করে না। মনে রাখিস একসময় আমার নাম সুপার সিঙ্গারদের তালিকায় থাকবে। তখন আমার অটোগ্রাফ নিতে তোকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

— হইছে চাপা কম মার। চাপা না মেরে দরজা ঠেলা মার। কথা বলতে বলতে আমার কানের পর্দা ফাটায় ফেলানোর চিন্তায় আছিস।

আমি চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকালাম।ও সেদিকে নজর না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। দরজা বাইরে থেকে আটকানো ছিলো। ভেতরে ঢুকে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। সবকিছু এলোমেলো। কোন কিছু গুছানো নেই। তায়াং ভাইয়া বসার রুম ক্রস করে আমাকে নিয়ে একটা রুমে চলে এলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কড়া সিগারেটের গন্ধ নাকে এলো। ভাইয়া লাইট জ্বালিয়ে দিতেই দেখলাম এনাজ উপুর হয়ে শুয়ে আছে। তায়াং ভাইয়া মৃদুস্বরে এনাজকে ডাকলো,

— এনাজ!

কিন্তু অপরপাশ থেকে এনাজের কোন রেসপন্স এলো না। তায়াং ভাইয়া সামনে গিয়ে ওকে ঠেলা মেরে আবারো ডাকলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া ভীত কন্ঠে বললো,

— এনাজের শরীর তো ঠান্ডা নোভা। ওর কোন সাড়াশব্দও নেই। ও কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেনি তো?

ভাইয়ার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই এনাজ বিষ খেয়ে নেইনি তো? আমার হাত-পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। আমরা কি আসতে দেরী করে ফেললাম? আমাদের জন্য কি আরেকটু অপেক্ষা করা যেতো না?

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_56
#Writer_NOVA

ভাইয়ার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সত্যি, সত্যি এনাজ বিষ খেয়ে নেইনি তো? আমার হাত-পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। আমরা কি আসতে দেরী করে ফেললাম? ভয়ে আমি সামনে এগুতে পারছি না। মনে হচ্ছে পা দুটো কেউ আটকে রেখেছে ফ্লোরের সাথে। আমি শুকনো ঢোক গিলে ভাইয়াকে বললাম,

— ভাইয়া, একটু ধাক্কা মেরে দেখ তো।

— আচ্ছা দেখছি।

তায়াং ভাইয়া এনাজকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নাম ধরে ডাকতে লাগলো,
— এনাজ, এই এনাজ!

— হুহ।

এনাজের কন্ঠস্বর পেয়ে আমার কলিজায় পানি এলো। বড় করে হাফ ছাড়লাম। আরেকটু হলে আমি জ্ঞান হারাতাম। তায়াং ভাইয়া ওকে আবার ধাক্কা দিয়ে বললো,

— উঠ।

এনাজ জড়ানো গলায় বললো,
— তায়াং তুই এখানে কেন? তোর না আজকে বিয়ে। যা ভাই বাসায় যা। সরি রে ইয়ার আমি তোর বিয়েই থাকতে পারবো না।

— তুই উঠে দেখ কে আসছে।

— আমি তো মরি নাই। তাহলে বউ নিয়ে আমাকে দেখতে আসার মানে কি বল? আমাকে আরো পোড়াতে আসছিস?

—একটু আগে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি আর এখন এসব বলছিস?

— বেঁচে আছি এখনো ভাই।

উল্টোপাল্টা কথা শুনে এনাজের ওপর আমার রাগ হচ্ছে। তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকাতেই সে আশ্বস্ত গলায় বললো
— তোর শোকে পাগল হয়ে গেছে। একটু পরই তোকে দেখে ঠিক হয়ে যাবে। শীতে শরীর ঠান্ডা হয়ে ছিলো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

এনাজ সোজা হয়ে উঠে বসলো। কিন্তু আমাদের দিকে না তাকিয়ে চোখের ওপর হাত দিয়ে বললো,

— লাইটটা অফ করে দে তায়াং। চোখে লাগছে।

— এখন না। আগে বল তোর পাঞ্জাবী কোথায়?

— কেন? পাঞ্জাবী দিয়ে কি করবি?

— গায়ে দিবো।

— ওয়ারড্রবের তিন নাম্বার ড্রয়ারে দেখ।

ভাইয়া ওয়ারড্রব খুলতে খুলতে এনাজকে বললো,
— সামনে একটু তাকিয়ে দেখ কে আসছে।

— কে আসছে?

চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকালো। প্রথমে খেয়াল করলো না। অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে কিছু একটা ভেবে চোখ ডলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তায়াং, আমি সত্যি দেখছি?

— হুম তোর টিডি পোকা।

— তোদের বিয়ে হয়ে গেছে?

— জ্বি না। আমরা পালিয়ে তোর কাছে চলে আসছি।

কথাটা শোনার সাথে সাথে এনাজ লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে আমার কাছে চলে এলো। এর মাঝে আমি বোরখা খুলে ফেলেছি।উনি এগিয়ে এসে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম,

— আমি বলছিলাম না সব ঠিক করে দিবো।কি এবার বিশ্বাস হলো তো?

— লাল শাড়িতে তোমাকে সত্যি পুতুল বউ লাগছে।

— শুকরিয়া।

—আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলছি।

— এই জন্য সিগারেট টানা হয়েছে?

এনাজ আমাকে ছেড়ে মাথা চুলকে বোকা ভঙ্গিতে বললো,
— হু একটু-আধটু আরকি।

— সারা রুম সিগারেটের গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। আর উনি বলছে একটু আধটু।

উনি মাথা নিচু করে বোকার মতো মাথা চুলকাতে লাগলো। চোখ, মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। চেহারার বেহাল দশা। পরনের টি-শার্ট, টাউজার কুঁচকে তেরটা বেজে আছে। মাথার চুল উসকো খুসকো। একদিনে কি অবস্থা করেছে নিজের। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

— এনাজ, নোভার নামে একটা বিচার আছে।

— কি বিচার?

— ও বলছিলো আমাকে বিয়ে করতে নাকি রাজী আছে। আমি বলছি তোর কাছে বলে দিবো। ও বলে তোকে নাকি ভয় পায় না।

আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ভাইয়া মোকি হাসি দিয়ে পাঞ্জাবী নিয়ে যেতে যেতে বললো,
— অনেক জ্বালিয়েছিস আজকে। এবার তোর প্রেমিকের ঠেলা সামলা। দিয়েছি পাগলকে রাগিয়ে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে বোইনা।টা টা বাই বাই।

আমি রেগে ভাইয়ার পিঠে কিল দিতে গেলেই ও দৌড়ে বাইরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। আমি সামনের পাটি দাঁত বের করে এনাজের দিকে তাকাতেই দেখলাম এনাজ আমার দিকে খাইয়া ফালামু লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— তায়াং যা বলে গেলো তা কি সত্যি?

আমি ভয়ে থতমত খেয়ে বললাম,
— না মেনে হ্যাঁ। হ্যাঁ না মানে না।

— সত্যি বলো?

আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। ও ভীষণ রেগে আছে। মনে মনে বললাম,

— আব ত্যারা কেয়া হোগা নোভা! তু তো আজ গেয়া।

এনাজ ধমক দিয়ে বললো,
— কথা বলছো না কেন?

আমি বিরবির করে বললাম,
— খাইছেরে আমি আজকে শেষ। কেন যে পাকনামি করে শয়তানটাকে ঐসব কথা বলতে গিয়েছিলাম। এখন আমার কি হবে? আমাকে কে বাঁচাবে? দরজাও তো আটকানো😵।

এনাজ মুখে রাগী ভঙ্গীমা রেখেই এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি মনে মনে আল্লাহর নাম জপছি। আজ বোধহয় আমার রক্ষা নেই। আল্লাহ তুমি বাঁচিয়ো। বেঁচে থাকলে সবার আগে তায়াং ভাইয়াকে কেলিয়ে আলু ভর্তা করবো। শয়তান ছেমরা। আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে পালালো।

💖💖💖

কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজে সারা বাসা গুছানোর কাজে লেগেছি। পুরো বাসাটাকে গোয়ালঘর করে রেখেছে। দেখতে কিরকম বিচ্ছিরি লাগছে। শার্ট,প্যান্ট এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।দেড়-দুই ঘন্টার ওপর লাগবে এগুলোকে গুছাতে। এনাজ দরজায় হেলান দিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তখন অনেক কষ্ট করে পাগলকে থামিয়েছি। নয়তো এতখনে এসপারওসপার হয়ে যেতো। আমি বিছানা ঝাড়ু দিয়ে চাদর টানটান করে তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি দেখেন?

— তোমাকে।

— অদ্ভুত ব্যাপার তো।আগে কখনো আমাকে দেখেননি?

— হুম দেখেছি। কিন্তু আজ তোমাকে বউ বউ লাগছে।এসেই কিরকম আঁচল গুঁজে কাজে নেমে পরেছো। মনে হচ্ছে আমার বউ তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসছে।

— হয়েছে আর পটাতে হবে না। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। চেহারার কি বেহাল দশা করছেন তা কি আয়নাতে দেখছেন?

উনি মুচকি হেসে গানের সুরে বললো,
— আমার হৃদয় একটা আয়না। সেই আয়নায় তোমার মুখটি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

আমি বালিশের কভার ঠিক করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসলাম। একটু আগের এনাজের সাথে এখনকার এনাজের আকাশ-পাতাল তফাৎ। কতটা উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। নাহ মানুষটাকে আমি ছাড়বো না। তাকে আমার চাই। এতটা কেয়ারিং ও ভালোবাসা আমি অন্য কারো থেকে পাবো না। বিছানা পুরোটা গুছিয়ে চেয়ারের ওপর জামা-কাপড় ধরতে গেলেই সে বললো,

— ঐগুলো আধোয়া,ময়লা কাপড়। ভাজ করতে হবে না। বুয়া আসলে তাকে দিয়ে ধুইয়ে নিবো।

— বুয়া কি প্রতিদিন আসে?

— না সপ্তাহে এক দিন এসে সব কাজ করে দিয়ে যায়।

— তাহলে রান্না কে করে?

— মন চাইলে আমি করি। নয়তো বাইরে থেকে খেয়ে আসি। দুটোর একটাও করতে মন না চাইলে না খেয়েই থাকি।

— হু না খেয়ে খেয়েই তো চেহারার এই দশা। (চেয়ার দেখিয়ে) দেখেন তো চেয়ারটাকে কি অবস্থা করে রাখছেন। প্রতিদিন দুই একটা করে ধুয়ে ফেললে তো এতগুলো জমে না।

— এখন জমবেই। তুমি যখন ধুয়ে দিবে তখন জমবে না। জামা-কাপড় ধোয়ার জন্য হলেও তোমাকে চাই।

— ওহ্ কাজের জন্য আমাকে লাগবে?

— সবকিছুর জন্য লাগবে। আমার কি মন চাইছে জানো?

— কি?

— পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।

— খবরদার এরকম চিন্তা ভাবনা মাথায়ও আনবেন না। আমি কিন্তু এখন আপনার বউ না।

— এর জন্য তো দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আফসোস করছি।

— তায়াং ভাইয়া কোথায়? দরজা খুলে দিয়ে গেলো কোথায়?

— বাইরে এনামের কাছে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে।

— এনাম ভাইয়া আসছে?

— হুম সকালে।

— ওহ্ এর জন্য দরজা বাইরে থেকে আটকানো ছিলো।

— জ্বি হ্যাঁ।

—আমি ফ্রেশ হতে যেতে বলছি।

— হুম যাচ্ছি। আগে মন ভরে তোমাকে দেখে নেই।

— আমাকে পরেও দেখতে পারবেন। আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আপনি দয়া করে ফ্রেশ হতে যান।

এনাজ শয়তানি হাসি দিয়ে দুষ্টামির সুরে বললো,
— এত সুন্দর করে জান বলে যেতে বললে আমি কি না গিয়ে থাকতে পারি।

— আমি আপনাকে যেতে বলছি জান বলিনি।

—ঐ একই।জানো, তোমার এই শাসনগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমার বউ আমাকে শাসন করছে।

— না বেশি কথা বলছেন। কাজের সময় এত কথা আমার ভালো লাগে না।

— নিজে যখন কথা বলতে বলতে কান পচিয়ে ফেলো তখন কিছু হয় না। আমি একটু কথা বললেই দোষ।

— হ্যাঁ, দোষ। এবার ফ্রেশ হয়ে আসেন।

— যথাআজ্ঞা মহারাণী।

উনি মাথা নাড়িয়ে ওয়াসরুমের দিকে যেতে নিলে আমি তাকে ডেকে বললাম,

— এই যে শুনেন!

— জ্বি বলো।

— উনাদের বাইরের থেকে খাবার আনতে মানা করে দিন।

— কেন?

— আমি আজ বাসায় রান্না করবো।

— না তার দরকার নেই। পুরো বাসা গুছিয়ে তুমি হাঁপিয়ে যাবে। আবার রান্না করতে গেলে তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে। এমনি সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে তোমার ওপর।

আমার ছোটখাটো বিষয়গুলোও সে খেয়াল করে, কতটা কেয়ার করে। তার এই বিষয়গুলো আমাকে মুগ্ধ করে।আমি মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমার কথা এতো চিন্তা করতে হবে না।

— তাহলে কে করবে?

— আমি আজ বাসায় রান্না করবো। ব্যাস শেষ কথা। আর আমি কি একা রান্না করবো নাকি? আপনারাও আমাকে সাহায্য করবেন।সবাই হাতে হাতে কাজ সেরে ফেলবো।

— আচ্ছা তাহলে ওদের বলে দেই।

— কি করে বলবেন? ভাইয়ার মোবাইল তো বন্ধ।

— এনামের মোবাইল খোলা আছে।

এনাজ ওয়ারড্রবের ওপর থেকে মোবাইল নিয়ে এনাম ভাইয়াকে কল করে খাবার আনতে মানা করে দিলো। তারপর ওয়াসরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আমি পুরো রুম গুছিয়ে বসার রুম গোছাতে চলে গেলাম।

💖💖💖

পাক্কা দুই ঘন্টায় পুরো বাসাকে গুছিয়ে গোয়ালঘর থেকে মানুষের ঘরে পরিণত করেছি। এখন গহনাগাটি সব খুলে কিচেনে রান্না করছি। হাতে শুধু চিকন দু গাছি চুড়ি, নাকে নাকফুল। এই দুটো আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেমন বিবাহিত বিবাহিত ফিলিংস আসে। এক চুলোয় ভাত চড়িয়েছি। আরেক চুলোয় ডিম সিদ্ধ। রাতের জন্য শর্টকাটে ভাত,ডিম ভুনা, ডাল রান্না করবো। সময় পেলে আলু ভর্তা বানাবো। না তায়াং ভাইয়াকে নয়, আলুকেই ভর্তা বানাবো। তায়াং ভাইয়ার ওপর পরেছে পেঁয়াজ কাটার দায়িত্ব। তায়াং ভাইয়া চোখ বন্ধ করে চেচিয়ে আমাকে বললো,

— শাঁকচুন্নি আমাকেই কি তোর পেঁয়াজ কাটতে দিতে হলো? পেঁয়াজের কি ঝাঝ! এখন আমার চোখের পানি, নাকের পানি এক হয়ে যাচ্ছে।

আমি নাক সিটকিয়ে বললাম,
— ছিঃ খাচ্চোর। কি বলিস এসব? যা সর।

এনাজ বসা থেকে এগিয়ে এসে বললো,
— দে তায়াং আমি কেটে দেই।

আমি সামনে থাকা খুন্তিটা উঁচিয়ে এনাজকে শাসনের সুরে বললাম,
— খবরদার ওকে একটুও হেল্প করবেন না। বউকে নাকি সব কাজ করে খাওয়াবে। তাহলে এতটুকু পেঁয়াজ কাটতে নাকের পানি, চোখের পানি এক হলে কি কাজ করে খাওয়াবে?

— তাই বলে তুমি বেচারাকে এভাবে কষ্ট দিবে?

— এটা ওর শাস্তি। গত দুই দিন আমাকে অনেক প্যারা দিছে। আপনি যদি ওকে পেঁয়াজ কাটতে সাহায্য করেন তাহলে আমি কিচেন থেকে বের হয়ে যাবো।

— বাপরে! বিয়ের আগেই কি থ্রেট দেয়🥶। বিয়ের পর যে কি করবে আল্লাহ মালুম।

তায়াং ভাইয়া আফসোসের সুরে বললো,
— তোর জীবন তেজপাতা থেকে বাঁশপাতায় রূপান্তরিত করবে ভাই।

এনাজ একগালে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— আমিও সোজা করতে জানি। যে যেমন তার সাথে তেমন করে সিধা করার অভিজ্ঞতা আছে আমার।

— অবশ্য তুই এটা ঠিক বলেছিস। সেদিন রোশানকে যা মারটা দিলি ভাই। আমি তো অবাক। আমি তো ভেবেছিলাম তুই একা গিয়ে মার খেয়ে আসবি। পরে দেখলাম তুই একাই ওর তেরটা বাজিয়ে দিলি।

— তোরা শেষে গিয়ে না ধরলে ওকে আমি মেরেই ফেলতাম। অতিরিক্ত বাড় বেড়েছিলো ও। কিছু বলছিলাম না বলে পার পেয়ে গেছে ভেবেছে। মনের আশ মিটিয়ে যদি মারতে পারতাম।

— তাহলে মরেই যেতো। এমনি এক হাত, পা ভেঙে হসপিটালে ছিলো কতদিন।

আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম,
— কাজটা আপনি ঠিক করেননি এনাজ। ও অনেক ডেঞ্জারাস। সুযোগ বুঝে আপনাকে একা পেলে আক্রমণ করতে পারে। এত সহজে ও আপনাকে ছেড়ে দিবে না। আমার জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। আল্লাহ না করুক আপনার যদি কোন ক্ষতি করে ফেলে।

এনাজ আস্বস্তের গলায় বললো,
— তুমি টেনশন নিও না তো। রোশান আমার মাথার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। ও যেই রাস্তা অবলম্বন করবে সেই রাস্তা আমরা বহু আগে পার করে এসেছি। ভাগ্যক্রমে ও বেঁচে গেছে। নয়তো ওর কপালে নয় নম্বর বিপদ সংকেত থাকতো।

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
— হু নেতা তো আপনারা। আপনাদের কত সাঙ্গপাঙ্গ আছে। আপনাদের কি কিছু হতে পারে নাকি?

— এই তো বুঝে গেছো।

— নিন এবার নেতা সাহেব এই সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দিন। তায়াং ভাইয়া তোর পেঁয়াজ কাটা হয়েছে?

তায়াং ভাইয়া মুখটাকে শুকনো করে বললো,
— আরেকটু বাকি আছে।

— এত মোটা করে কাটছিস কেন? আরো চিকন হবে।

— আরো চিকন চাইলে নিজে করে নে। আমি পারবো না। এতটুকু করেছি অনেক কষ্টে।

— এই চেহারা নিয়ে বউকে কাজ করে খাওয়াতে হবে না। একটু পেঁয়াজ কাটতে কপাল বেয়ে ঘাম পরছে।দে আমার কাছে। আমার কাজ তো কমাসনি। উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছিস।

তায়াং ভাইয়া চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে জিহ্বা দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। আমি হাতের ছুরিটা উঁচু করে ওকে একবার ভয় দেখিয়ে পেঁয়াজ কাটায় মনোযোগ দিলাম। এনামের কথা মনে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম,

— এনাম ভাইয়া কোথায়?

তায়াং ভাইয়া বললো,
— আমাকে এনাম বললো, “ভাইয়া আপনি চলে যান আমি একটু পর আসছি।” এখনো তো আসার নাম নেই।

— আই এম হেয়ার।

এনাম ভাইয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে কথাটা বললো। আমি মুচকি হেসে বললাম,

— এই তো এনাম ভাইয়া চলে এসেছে। তা ভাইয়া কেমন আছেন?

— আলহামদুলিল্লাহ ভাবী। আপনি কেমন আছেন?

— আলহামদুলিল্লাহ। গত দুই দিন ভালো ছিলাম না। এখন অনেক ভালো আছি।

— আমিও ছিলাম না। এখন আমার ভাইয়ার হাসিখুশি মুখটা দেখে আমি পুরো ভালো আছি।বিয়েটা হয়ে গেলে আমি পুরো নিঃস্ব হয়ে যেতাম। ভাইয়া তো গত দুই দিন ধরে উল্টোপাল্টা বকছে। তাই ভয়ে চলে এলাম। যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। এসব কথা এখন বাদ দেই। যা চলে গেছে তাতো গেছেই। এখন তো সব ঠিক আছে।

— ভাইয়া বাইরে থেকে আসছেন এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন।

— আমি কি কোন কাজে হেল্প করতে পারি?

— না না তার দরকার নেই। আমার হেল্পার দুইজন আছে। আপনাকে কিছু করতে হবে না।

— আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসি।আরেকটা কথা ভাবী।

— কি?

— আপনাকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে। আমার ভাইয়ের বউ মনে হচ্ছে। বাসায় ঢুকেই বুঝে গিয়েছিলাম কোন গুছানো মেয়ের আবির্ভাব ঘটেছে।

— কিভাবে বুঝলেন?

— এই যে পুরো বাসাটা কি সুন্দর করে গুছানো। এটা মেয়েদের কাজ। বেশিরভাগ ছেলেরাই রুম অগোছালো করে রাখে। তবে সবাই নয়। অনেক ছেলেও আছে গুছানো। তবে সেগুলোকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়।

আমি মুচকি হেসে বললাম,
— তেমন কিছু নয়। অগোছালো দেখতে ভালো লাগছিলো না।কেমন জানি দমবন্ধ লাগছিলো। তাই কোমড়ে সবকিছু গুছিয়ে ফেললাম।

— আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

এনাম চলে গেল।তায়াং ভাইয়া এনাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— দেখলি ভাই একদিকে গরম আরেকদিকে নরম। আমাদেরকে খাটিয়ে মারছে। অন্য দিকে তার দেবরকে বাচিয়ে দিলো। এনাম হেল্প করতে চাইলেও মানা করে দিলো।

এনাজ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
— ইহাই ভাবীদের কাজ। দেবরের জন্য বেশি মায়া থাকে।

আমি ভাত হয়েছে কিনা সেটা দেখে তায়াং ভাইয়াকে বললাম,

— আজাইরা বসে আছিস তো ভালো লাগছে না, তাই না? যা ডাল ধুয়ে দে। আরেক চুলো খালি যাচ্ছে। ডাল সাজিয়ে বসিয়ে দিবো।

তায়াং ভাইয়া রেগে ফোঁস করে উঠলো। আমি ওর দিকে নজর দিলাম না। ভাত হয়ে গেছে। এখন মাড় ঝড়াতে হবে। ভাইয়া ডাল ধুতে বেসিনের দিকে চলে গেলো। অবশেষে দেড় ঘন্টা যুদ্ধ করে রান্না শেষ করলাম। রান্না শেষ করে একসাথে সবাই হৈ-হুল্লোড় করে খাবার খেলাম। তারপর ল্যাপটপে ভুতের মুভি দেখলাম। রাত আড়াইটার দিকে ঘুমাতে চলে গেলাম। তারা তিনজন এক রুমে আমি একা আরেক রুমে।

পরেরদিন আমাদের জন্য কি খারাপ কোন ঘটনা অপেক্ষা করছে? হুট করে মনটা কিরকম জানি কু ডাকছে। আচ্ছা সত্যি কি খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে? যার কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।

#চলবে