শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৫৯+৬০

0
654

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_59
#Writer_NOVA

— নুবা!

সোফায় দুই পা মুড়ে বসে, কোলে বিশাল বড় প্লেট রেখে গাজরের খোসা ছাড়াচ্ছিলাম। মনোযোগটা পুরো দমে কাজের মধ্যেই ছিলো। হঠাৎ ইফাতের বিখ্যাত “নুবা” ডাক শুনে চমকে ওর দিকে তাকালাম। বেচারার মুখটা কিরকম শুকনো লাগছে। সেই শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আমি রাগ করতে পারলাম না। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

— কিছু বলবি ইফাত?

ইফাত মাথা উপর-নিচে করে বললো,
— হুম।

— কি বলবি বলে ফেল।

— তুমি কি ব্যস্ত?

— হুম একটু বলা যায়।

— গাজর দিয়ে কি করবে?

— গাজরের হালুয়া বানাবো।

— তুমি হালুয়া রান্না করতে পারো?

— হুম পারি।

— আমার আম্মুরও গাজরের হালুয়া অনেক পছন্দ।

— তাই নাকি! বাহ ভালোই তো।তাহলে বানিয়ে আন্টিকে দিয়ে আসবোনি। তোর পছন্দ নয়?

— আমার ততটা ভালো লাগে না।

— ওহ আচ্ছা।

আমি সোফার এক সাইড সরে ওকে জায়গা করে দিয়ে বললাম,

— এখানে বস।

ইফাত চুপচাপ এসে আমার পাশে বসলো। মাঝে মাঝে কাজ করার সময় একজন কথা বলার মানুষ পেলে আমার ভালোই লাগে। এমনি একা একা বোরিং হচ্ছিলাম। মনে মনে আল্লাহর কাছে একটা কথা বলার মানুষ চাইছিলাম। আল্লাহ মিলিয়েও দিলো। আজ মন ভালো নেই বলে কলেজেও যাইনি। তন্বী একাই চলে গেছে। একা থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিলো। তাই ভাবলাম কিছু রান্না করি সময় কেটে যাবে। দাদী তো আমার সাথে চার-পাঁচ দিন ধরে কথা বলে না। খালামণি অবসর সময়ে দাদীর সাথে গল্প করে।কিংবা মোবাইলে সিরিয়াল দেখে, সবার সাথে ইমো তে কথা বলে। ইফাত কিছু সময় চুপ করে আমার কাজ দেখলো। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিয়ে বললো,

— কার জন্য রান্না করবে?

— তায়াং ভাইয়র জন্য। ও গাজরের হালুয়া অনেক পছন্দ করে। ফ্রীজে গাজরগুলো কবের থেকে পরে আছে। কিছুই করা হয় না। তাই ভাবলাম ওর জন্য একটু হালুয়া করে ফেলি।তোর স্কুল নেই আজকে?

— মাথাব্যথা করছিলো। তাই আম্মু বললো যেতে হবে না। সিফাত একটু পর যাবে।

— তুই আজ এত ভদ্র ছেলে যে? অন্য সময় তো বউ বউ করে কান পচিয়ে ফেলতি। কি হয়েছে?

— আম্মুর শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো না জানো। আম্মু খালি উল্টোপাল্টা কথা বলে। উনি নাকি মারা যাবে আরো কতকিছু। আমার না অনেক খারাপ লাগে। তার কিছু হলে আমাদের কি হবে বলো তো?

কথাগুলো বলতে বলতে ইফাতের চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। আগের পিচ্চি ইফাতের সাথে আজকের পিচ্চির অনেক তফাৎ। নেই কোন দুষ্টমী করার তাড়া। বরং মা কে হারানোর ভয় তার চোখে স্পষ্ট। তার জন্য হয়তো দুষ্টমীগুলো তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। আমি প্লেটটা সামনের টি-টেবিলে রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,

— চিন্তা করিস না। কিছু হবে না আন্টির।

— আম্মুর কিছু হলে আমি বাঁচবো না আপু।

মাথা নিচু করে ডুকরে কেঁদে উঠলো ইফাত। ওর কথার মধ্যে আজ আমি কোন বাচ্চামো খুঁজে পাচ্ছি না। বরং মনে হচ্ছে কোন বড় মানুষের সাথে কথা বলছি। কোথায় জানি পড়েছিলাম,”বাবা-মা হয়তো জানে না সন্তানরা নিজের মৃত্যুর থেকেও বেশি ভয় পায় তাদের মৃত্যুকে।” কথাগুলো চিরন্তন সত্য। এমনি ভালো লাগছিলো না তার মধ্যে ওর কান্না যেন আমার মনকে আরো খারাপ করে দিলো। ওর মাথা উঠিয়ে চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিয়ে বললাম,

— তুই না গুড বয়? গুড বয়রা তো কখনও কান্না করে না। বরং কোন কিছুতে ভেঙে না পরে শক্ত হয়ে থাকে। আচ্ছা এখন এসব কথা বাদ দে। কি জন্য এসেছিস তাই তো বললি না।

— আম্মু তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

— এ মা কি বলিস? আগে বলবি না। আচ্ছা চল আন্টির সাথে দেখা করে আসি। তবে তুই একটু অপেক্ষা কর আমি ফ্রীজ থেকে দুধের বোতল বের করে ভিজিয়ে রেখে আসি। এই যাবো আর আসবো।

— দুধ দিয়ে কি করবে?

— পায়েস রান্না করবো।

— তুমি পায়েসও রান্না করতে পারো?

ইফাত বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। ওর মুখের রিয়েকশন দেখে না হেসে পারলাম না। ইফাত আবারো তাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— বললে না, তুমি পায়েস রান্না করতে পারো?

— না পারি না।

— তাহলে রান্না করবে কি করে?

— ইউটিউব দেখে। নয়তো খালামণি দেখিয়ে দিবে।

পায়েসটা পোলাওয়ের চাল দিয়ে রান্না করবো।আমি পোলাও জাতীয় রান্নাগুলোতে পানির আন্দাজ বুঝি না। তাই এই খাবারগুলো ছাড়া বাকি সবই পারি। পোলাওয়ের চালে পানিটা পরিমাণ মতো দিতে হয়। বেশি দিলে চাল গলে যাবে, কম দিলে ফুটবেই না৷ তাই পোলাওয়ের চাল দিয়ে তৈরি রান্নাগুলো আমার কাছে এক্সট্রা ঝামেলা মনে হয়। পায়েস এনজিও সংস্থার ভীষণ পছন্দ। তার জন্য রান্না করে পাঠিয়ে দিবো। যদি মহাশয়ের ইগনোর করাটা একটু কমে তাই। কিচেনে গিয়ে ফ্রীজ থেকে দুধের বোতল বের করে ছোট বালতিতে ভিজিয়ে রাখলাম। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িংরুমে এসে ইফাতকে বললাম,

— হুম চল।

— হালুয়া বানাবা না?

— পরে। আগে তোর আম্মুর কাছ থেকে আসি।

— পায়েসও কি তায়াং ভাইয়ার জন্য রান্না করবে?

— না।

— তাহলে কার জন্য।

— তায়াং ভাইয়ার বন্ধু এনাজের জন্য। ঐ যে সেদিন যার কোলে বসে দুষ্টামী করেছিলি তার জন্য।

— ওহ্।

— হুম, এবার চল।

দরজা বাইরের থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে আমি ও ইফাত ওদের বাসার ভেতরে চলে গেলাম। আজ আন্টির সাথে অনেক সময় গল্প করবো। উনাকে মানসিকভাবে সাহস যুগাতে হবে। উনি ইদানীং অনেক বেশি ভয় পাচ্ছে। আন্টির রুমের সামনে এসে দেখলাম আন্টি বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ইফাত মৃদুস্বরে ডাকলো।

— আম্মু!

— হু বল।

— আপু আসছে।

— ভেতরে আসতে বল।

ইফাত আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তুমি ভেতরে যাও। আমি আমার রুমে চলে যাই।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ইফাত চলে গেল। আমি গুটি গুটি পায়ে আন্টির সামনে গিয়ে সালাম দিলাম।

—আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?

উনি মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ আছি ভালোই। তুমি কেমন আছো?

আমি তার পাশে বসে হাসিমুখে বললাম,
— আলহামদুলিল্লাহ। আমার শ্বাশুড়িও তো মা শা আল্লাহ আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছে।

— মরে যাবো তো তাই বোধহয়।

— আন্টি উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না😤।

— সত্যি কথা মা। মানুষ তো মারা যাওয়ার আগে সুন্দর হয়। তুমি জানো না।

— চুপ করুন তো। হায়াতের মালিক আল্লাহ। এসব বলতে হয় না। কেন ডেকেছেন তাই বলেন।

— ইফাত বললো তুমি বাসায় আছো। তাই ভাবলাম তোমাকে ডেকে একটু গল্প করি।বাঁচি না মরি তাতো বলতে পারি না। যদি মরে যাই তাহলে তো আর গল্প করা হবে না। আমার কয়েকদিন ধরে অনেক বেশি মনে হচ্চে আমার মৃত্যু সন্নিকটে।

— আন্টি আপনি যদি এমন কথা বলা বন্ধ না করেন তাহলে আমি কিন্তু চলে যাবো। আর কখনো আসবো না।

আমি রাগী গলায় কথাটা বলে উঠতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে আটকে বললো,
— এই না না কোথাও যেয়ো না। বসো এখানে।দুই দিন ধরে শরীরটা অনেক খারাপ। হাত-পা নাড়াতে পারি না। সারাক্ষণ অস্থির অস্থির লাগে।

— টেনশন করেন না। ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনার মাথায় একটু তেল দিয়ে দেই। পায়ের তালুতেও একটু তেল ডলে দিবোনি। তাহলে ভালো লাগবে।

— না না তোমার এতো কষ্ট করতে হবে না।

— আমার কোন কষ্ট হবে না। আপনি চুপটি করে এখানে বসুন।

উনি আর অমত করলো না। আমি ডেসিং টেবিল থেকে তেলের বোতল নিয়ে তার মাথায় তেল দিতে লাগলাম। তেল দেওয়ার মাঝে মাঝে তার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। এতে উনি একটু বেটার ফিল করবে তাই।

💖💖💖

বিকালে……

সকাল থেকে আকাশটা আজ ভার। মনে হয় এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। শীতের দিনে বৃষ্টি আমার একদম পছন্দ নয়। শীত আমার পছন্দের ঋতু হলেও বৃষ্টি আমার ভীষণ অপছন্দ। ঈশান কোণে কালো মেঘের আনাগোনা। আমার মন ও আকাশের অবস্থা এখন একিরকম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ঠান্ডা বাতাস বইছে।সারা শরীর শিরশির করছে সাথে শরীরের পশমগুলো ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও বারান্দা থেকে সরতে ইচ্ছে করছে না। ভাবনায় বিভোর হয়ে আছি আমি। চিন্তা করছি তিন দিন আগের কথা। আম্মু যাওয়ার আগে তার সাথে কথা বলেছিলাম এনাজের বিষয় নিয়ে। ডুব দিলাম কল্পনায়।

ফ্লাশব্যাক…..

আম্মুর জন্য হালিম রান্না করেছি।আম্মুর হালিম অনেক পছন্দ।কারো রাগ,অভিমান ভাঙানোর, কোন কাজ বা উদ্দেশ্য হাসিল করতে খুব জাদুকরী একটা উপায় হলো তার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো। কেউ আমার ওপর রাগ, অভিমান করলে সেগুলো ভাঙাতে কিংবা কোন কাজ হাসিল করতে আমি এই ট্রিকসটা কাজে লাগাই।গরম গরম হালিম নিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগামীকাল সকালে তারা চলে যাবে। পর্দা কিছুটা সরিয়ে আম্মুর থেকে অনুমতি চাইলাম,

— আম্মু আসবো?

অপরদিক হতে আম্মু শুধু আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কোন কথা বললো না। আমি তার অনুমতি না নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। হালিমের বাটিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

— নাও গরম গরম খেয়ে নাও।

— আমি কিছু খাবো না।

— সে কি কথা! তোমার জন্য এত কষ্ট করে রান্না করলাম আর তুমিই খাবে না। এটা তো ঠিক নয়।

— কি কাজের জন্য আমার পছন্দের খাবার রান্না করেছিস তাই বল।

আমি ধরা পরে যাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা চুলকালাম। মায়েদের সাথে কখনও চালাকি করে পারা যায় না। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে আমাদের মতলব কি,কেন এসেছি। মুখ দেখেই সব বুঝে ফেলে। এদিক সেদিক তাকিয়ে আব্বুকে খুজলাম। কোথাও দেখতে না পেয়ে খেয়াল হলো এশারের নামাজ পরতে মসজিদে গেছে। আম্মুর পায়ের কাছে বসতোই আম্মু কড়া গলায় বললো,

— এনাজের বিষয় আমি তোর আব্বুকে কিছু বলতে পারবো না। তোর আব্বু যা বলেছে তাই হবে।

— এটা কেমন কথা আম্মু? তুমি না বললে কে বলবে?

— আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান না করে যা বলার তোর আব্বুকে বল। সে যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাই মেনে নিবো।

— তুমি তো জানো আমি সরাসরি আব্বুকে কিছু বলতে পারি না। আমার ভয় করে। যা বলার তোমাকে দিয়ে বলাই৷ আজ এমন কথা বলছো কেন?

— তোর বিষয় নিয়ে যা করার সব তোর আব্বু করবে। আমি কিছু বললেই বলে, “তুমি চুপ থাকো বড় মেয়ের সবকিছু দেখার জন্য আমি আছি।” তাহলে আমি কি বলবো বল তো? কিছু বললেও রাগ হয়ে যায়। তোর আব্বুর রাগ তো তুই জানিসই। তাই আমাকে কিছু না বলে তুই সরাসরি তোর আব্বুর সাথে কথা বল। এখন কিছু বলিস না। তার মতিগতি আমি বুঝতে পারছি না। সামনের সপ্তাহে যখন আসবো তখন বলিস।

আমি কিছুটা হাফ ছাড়লাম। আম্মুর রাগ তাহলে কমেছে। রেগে থাকলে মাদার বাংলাদেশ আমার পুরো রণমুর্তি ধারন করে। আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম,

— আচ্ছা তাহলে তাই হবে। তুমি হালিম খেয়ে নাও। আমার ওপর আর রেগে থেকো না।

— আর শোন।

— হুম বলো।

— তায়াং, এনাজ দুজনকেই আমার পছন্দ। তায়াং যেহেতু নূরকে ভালোবাসে তাই আমি চাই নূরের সাথেই ওর বিয়ে হোক। এবার তোর ভাগ্যে এনাজ আছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। এনাজের আচার,ব্যবহার আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তবুও তোর আব্বুকে খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে বলবো।

— ঠিক আছে। তোমরা যেটা ভালো মনে করো তাই করো। তবে এমন কিছু করো না যার জন্য আমার ভেতরের আমি সত্ত্বাটা মরে যায়।

কথা না বাড়িয়ে দ্রুত রুমের বাইরে চলে এলাম। আম্মুকে নিয়ে কোন টেনশন নেই আর।এখন আব্বুকে রাজী করাতে পারলেই আমাদের বিয়েটা কনফার্ম।

ফ্লাশব্যাক এন্ড……

— এই নোভাপু হারিয়েছো কোন দেশে?

তন্বী দুই বাহু ঝাঁকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতেই আমি ভাবনা থেকে ফিরে এলাম। চমকে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে?

— থাকো কোথায় আজকাল? কখন থেকে ডাকছি কিন্তু তোমার কোন রেসপন্স নেই। ধাক্কা দিতেই হুশ ফিরলো তোমার। কি ভাবছিলে এতে মনোযোগ দিয়ে?

— কিছু না।

— কিছু তো ভাবছিলে।

— ছাড় তো। কেন ডেকেছিস তাই বল।

— ইমরান ভাইয়াকে কেন আসতে বলেছো? ভাইয়া সেই কখন থেকে এসে বসে আছে। তোমাকে ডাকতে ডাকতে আমার গলা ভেঙে গেলো।

— ওহ হ্যাঁ, ভাইয়াকে কল করে আমি আসতে বলেছিলাম। এনাজের জন্য একটু পায়েস রান্না করেছিলাম। সেট টিফিন বক্স করে ওর জন্য পাঠাতে।

তন্বী শয়তানি হাসি দিয়ে নিজের কাঁধ দিয়ে আমার কাঁধে জোরে একটা ধাক্কা মেরে সুর দিয়ে টেনে টেনে বললো,
— বাহ বাহ কি ভালোবাসা!

— বেশি কথা বলিস না। এমনি একটু রান্না করতে মন চাইলো। তার পছন্দ তাই আরকি।

— হু হু সবই বুঝি।

— হইছে সব বুঝে উল্টায় ফেলছো। যা সর।

তন্বীকে সাইড কাটিয়ে কিচেনে চলে গেলাম। ইমরান ভাইয়াকে টিফিন বক্স দিয়ে ফিরে এলাম। পায়েসে মিষ্টি একটু বেশি হয়েছে। এনাজের জন্য ঠিক আছে। উনি আবার মিষ্টি একটু বেশি পছন্দ। কিন্তু আমার পায়েসে মিষ্টি কম পছন্দ। তায়াং ভাইয়া আজকে ফিরবে না। কি একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। তার গাজরের হালুয়া বানিয়ে ডিপ ফ্রীজে রেখে দিয়েছি। হালুয়া ঠান্ডা হওয়ার পরপরই আন্টিকে দিয়ে এসেছি। তারও যখন পছন্দ তাহলে দিতে তো হয়। ভাইয়া আগামীকাল এলে ওকে ঠান্ডাটাই খাওয়াবো।

রাতে…..

— আপনি যেই নাম্বারে কল করছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। আপনি যদি বাংলালিংকের গ্রাহক হোন তাহলে অনুগ্রহ করে এখুনি ডায়াল করুন ★★★★ এই নাম্বারে। ধন্যবাদ।

অপরপাশ থেকে টুট টুট করে কলটা কেটে গেলো।বিষন্ন মনে কানের থেকে মোবাইলটা সরালাম।সন্ধ্যা থেকে এনাজের নাম্বারে ট্রাই করে যাচ্ছি। বারবার একই কথা বলছে। বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেলো। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে রাত দশটায় ছুঁয়েছে। দূরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতেই চোখের কোণের পানি মুছে পেছনে তাকালাম। তন্বী মুখ শুকনো করে বললো,

— ঘুমাবে না?

— হুম চল।

তন্বীর সাথে বারান্দা থেকে ভেতরে চলে এলাম। আমি বিছানায় শুতেই তন্বী লাইট অফ করে আমার পাশে শুয়ে পরলো। তন্বী কিছু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পরবে। কিন্তু আমি জানি আমার ঘুম আসতে দেরী আছে। গত তিনদিন ধরে সারারাত বিছানার এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত তিনটে বাজে চোখ লাগে। ফেসবুক আমার এতো পছন্দ। এখন সেই যোগাযোগ মাধ্যমটাও ইদানীং বিরক্ত লাগে। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না। হঠাৎ তন্বীর ঝাঁকানিতে পিট পিট করে চোখ খুলে তাকালাম। তন্বীর চোখে পানি। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললো,

— নোভাপু উঠো, আর কত ঘুমাইবা? এদিকে দেখো কি অঘটন ঘটে গেছে।

— কি হয়েছে?

— কিছু শুনো নাই? পুরো দালানের মানুষ উঠে গেছে। কান্নাকাটি পরে গেছে। আর তোমার ঘুমই ভাঙে না।

— বলবি তো কি হয়েছে?

—ইফাতের আম্মু মারা গেছে।

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_60
#Writer_NOVA

— ইফাতের আম্মু মারা গেছে।

চমকে ঘুম থেকে জেগে গেলাম। কি ছিলো এটা? বুকে ফুঁ দিয়ে মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে দেখি তন্বী আমার পাশে ঘুমাচ্ছে। সময় দেখলাম তিনটা বেজে সাইত্রিশ মিনিট। এতখন স্বপ্ন দেখছিলাম আমি! না একে শুধু স্বপ্ন বলা যায় না। ভয়ানক একটা দুঃস্বপ্ন। মাথাটা পুরো হ্যাং হয়ে আছে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলাম। পানির পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু ঠান্ডায় উঠতে ইচ্ছে করছে না। পানি খেতে হলে এখন কাঁথা ছেড়ে উঠতে হবে। আলসেমির দরুন উঠলাম না। বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম। কিন্তু আর ঘুম এলো না। মাথার মধ্যে ঘুরেফিরে স্বপ্নটাই আসছে। বাকি রাতটা নির্ঘুম কেটে গেলো। ফজরের নামাজ পরে ছাদে চলে গেলাম। ইফাতের আম্মুকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এত সকালে কারো বাসায় যাওয়া উচিত নয়। ছাদ থেকে এসে খালামণির সাথে রান্নায় সাহায্য করতে লাগলাম।খালামণি আমাকে দেখে বললো,

— কিরে নোভা আজ নামাজ পরে ঘুমাসনি? রাতে কি ঘুম হয়েছিলো? চোখ, মুখের এই অবস্থা কেন?

— কেন কি হয়েছে?

— মুখ, চোখের কি অবস্থা আর বলছে কি হয়েছে।

— ও কিছু না। এমনি ভালো লাগছিলো না তাই আর ঘুমালাম না। কি রান্না করবা আজকে খালামণি?

— রুটি বানাবো। সাথে আলুভাজি ও ডিম ভাজা। শরীরটা ভালো লাগছে না।

— তাহলে সরো আমি করি।

— তুই একা এতকিছু পারবি?

— ইস, এভাবে বলছো যেন আমি কিছু পারি না।

— না তা বলিনি। একা একা তো সমস্যা হবে।

— কোন সমস্যা নেই। অনেক সময় বাকি আছে। আমি ধীরে-সুস্থে সবকিছু গুছিয়ে নিবো। যাও তুমি গিয়ে একটু ঘুমাও। শরীরটা ভালো লাগবে।

— তন্বী কি ঘুমায়?

— হুম।

— ওকে ডেকে দেই?

— না, থাক দরকার নেই। দাদী কি ঘুমে?

— না, ফজরের নামাজের পর কোরাআন শরীফ পড়লো। এখন বোধহয় তবজি নিয়ে বসেছে। তার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে যাবো।

— আলু কোথায়?

— ফ্রীজের ড্রয়ারে দেখ।

— তুমি চা বানিয়ে নিয়ে যাও। আমি বাকি সবকিছু সামলে নিবো।

খালামণি দ্বিমত করলো না। চায়ের পানি চুলোয় বসিয়ে দিলো। আমি আলু বের করে খোসা ছাড়াতে বসে পরলাম। গত কয়েকদিন ধরে রান্না করতে বেশ লাগে। আমি খেয়াল করেছি রান্না করতে আসলে আমি বাকি সবকিছু ভুলে যাই। নিজেকে ব্যস্ত রাখার উপায় পেয়ে গেছি। তাই এটাই বিভোর থাকি। খালামণি আমার জন্য এক কাপ চা রেখে তাদের দুজনেরটা নিয়ে চলে গেল। আমি আলু কুচি করার ফাঁকে ফাঁকে চা-টুকু শেষ করলাম। আলু কুচি করার পর পেঁয়াজ কুচি করে নিলাম। ভাজির জন্য লম্বা করে, ডিম ভাজার জন্য গোল করে মরিচ কেটে নিলাম। চুলোয় রুটির জন্য পানি দিয়ে ভাজির আলু ধুয়ে নিলাম। প্রায় এক ঘন্টা যুদ্ধ করার পর সব কিছু বানানো শেষ হলো। সবকিছু ধুয়ে, গুছিয়ে সময় দেখলাম আটটা বেজে দশ মিনিট। এখন আন্টিকে দেখতে যাওয়া যায়।

কোলিং বেল বাজতেই দরজা খুললো ইফাতের দাদী। আমি তাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলাম।

— আসসালামু আলাইকুম দাদী। কেমন আছেন?

— আরে বড় নাতবউ যে! ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

—আজকে এত সকালে কি মনে করে?

— কেন আসতে পারি না?

— না তা বলি নাই। তোমাকে তো এত সকালে পাওয়া যায় না। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— ভেতরে কি ঢুকতে দিবেন না নাকি😒?

— আসো আসো।

— আন্টি কোথায়? ঘুমের থেকে উঠেনি?

— না ছোট বউমা তো এখনো উঠেনি।রাতে একটু ব্যাথা উঠছিলো। সারারাতে ঘুমাতে পারেনি। সকালে ফজরের পর ঘুমালো।কোন দরকার নাতবউ?

— না এমনি আন্টিকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম। দাদা কোথায়?

— ফজরের নামাজ পরে এখনো আসেনি।

— কি করছিলেন আপনি?

— সকালের জন্য রুটি বেলতে বসছিলাম। তখুনি তুমি কোলিং বেল বাজালে।

— আমাদেরও সকালে আজ রুটি। মাত্র বানিয়ে আসলাম। আপনার রুটি বানানো কি শেষ?

— না মাত্র দুটো রুটি বেলছি।

— চলেন আমি আপনাকে রুটি বানিয়ে দেই। আপনার এতে তাড়াতাড়ি হবে।

— না আমি পারবো।

— হু আমি জানি পারবেন। চলেন তবুও আমি হেল্প করি। কত সময় হয়ে গেছে। দাদা এসে তো রুটি বলে চেচিয়ে উঠবে।

— তুমি আমাদের অনেক সাহায্য করো। আমি এই জেনারেশনে তোমার মতো খুব কম মেয়ে দেখেছি নাতবউ।

আমি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললাম,
— আপনারা আমাকে যতটা ভালো মনে করেন ততটা ভালো আমি নই দাদী🥴। আমার যাকে ভালো লাগে তার জন্য আমি সব করতে পারি। কিন্তু যাকে আমার ভালো লাগে না, তার কোন সমস্যা হলে তার দিকে ফিরেও তাকাই না। এসব কথা পরে হবে।চলেন রুটি বানাই।

উনার সাথে কিচেনে চলে গেলাম। কথা বলতে বলতে দুজন কাজ করতে লাগলাম। ইদানীং একা থাকতে ইচ্ছে হয় না। নিজেকে ঠিক রাখতে সবার সাথে মেশার চেষ্টা করি। রুটি ভাজার শেষ পর্যায়ে আন্টি উঠে গেলো। তাকে নিজ হাতে রুটি খাইয়ে দিলাম। উনি তো প্রথমে খেতেই চাইছিলেন না। এক প্রকার জোর করে তাকে খাইয়ে দিলাম। খাবার খাওয়ানোর পর ঔষধ খাইয়ে তার সাথে কিছু সময় গল্প করে বাসায় চলে এলাম। আজ কলেজ যেতে হবে। তার জন্য এখন তৈরি হতে হবে।

💖💖💖

দুপুরে…….

ফ্রীজ থেকে হালুয়ার বক্সটা আগেই বের করে রেখেছিলাম। সেখান থেকে বেশি অর্ধেক হালুয়া পিরিচে নিয়ে রওনা দিলাম তায়াং ভাইয়ার রুমের দিকে। ভাইয়া সকাল এগারোটার দিকে বাসায় এসেছে। ওর রুমের সামনে গিয়ে দরজায় কয়েকটা টোকা দিলাম। মুখে কিছু বললাম না। তায়াং ভাইয়া দরজার দিকে না তাকিয়ে বললো,

— আসতে পারেন।

আমি রুমে ঢুকে ওর সামনে হালুয়ার পিরিচটা রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাইয়া মনোযোগ সহকারে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। মেবি ইংরেজি মুভি কিংবা ওয়েব সিরিজ হবে।আমার দিকে না ফিরে মোবাইলের দিকে চোখ রেখে বললো,

— কিছু বলবি?

— 😶😶

— বলার হলে বলতে পারিস।

— তোর জন্য গতকাল গাজরের হালুয়া করেছিলাম৷ কিন্তু তুই তো কালকে ছিলি না। তাই এখন নিয়ে এলাম।

ভাইয়া মোবাইল রেখে প্রথমে আমার দিকে তাকালো। তারপর পিরিচের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেলো। পিরিচ হাতে নিয়ে একের পর এক (পিস করে কাটা) হালুয়া মুখে পুরতে লাগলো। দুটো শেষ করে তৃতীয়টা মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে বললো,

— বেশ বানিয়েছিস তো। অনেকদিন পর। এটা দেখলে আমার হুশ থাকে না। সরি বোন তোর সাথে শেয়ার করতে পারলাম না। আমি খাই তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখ। নজর-টজর দিস না আবার। পেট ব্যাথা করবে।

— বয়েই গেছে নজর দিতে। মন চাইলে আমিই সব খেয়ে ফেলতাম। তোর জন্য বানাতাম না। আস্তে খা ভাই। কেউ তোরটা নিয়ে যাবে না। কেমন হয়েছে?

ভাইয়া আরেকটা মুখে দিয়ে নানারকম অঙ্গিভঙ্গি করে নিরাশ কন্ঠে বললো,

— চলে কোনরকম। লবণ বেশি হয়েছে। একটুও খাওয়া যাচ্ছে না। কোনরকম চাবিয়ে গিলছি। তোর জন্য যে আমাকে কত অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে হবেরে শাঁকচুন্নি।

— কে বলেছে তোকে খেতে? দে আমার হালুয়া দে😤।

— তুই খেতে পারবি না। তোর পেট ব্যাথা করবে। আমি ভাই হয়ে কি তোর পেট ব্যাথা হতে দিতে পারি বল?

— একটু আগে যে বললি বেশ বানিয়েছি। এখন আবার কথা ঘুরিয়ে ফেলছিস।

— ঐটা মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছিলো। এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। একটুও মজা হয়নি।

— এসব বললি না, দেখিস আমি আর কখনো তোর জন্য হালুয়া বানাবো না।

— এই না না। তুই বানাস। খাওয়া তো যায়। যতই খাওয়ার অযোগ্য হোক আমি খেয়ে নিবো।

আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওর দিকে একটা রাগী লুক দিলাম। তারপর এগিয়ে গিয়ে ওর চুল টানতে লাগলাম। এই শয়তান কখনো আমার রান্নার তারিফ করে না। ভাগ্যক্রমে আজ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো “বেশ বানিয়েছি”। সেটাই আমার জন্য অনেক।ভাই-বোনগুলো এরকমি হয়। কখনো মুখে স্বীকার করে না ভালো হয়েছে। ওদের মুখে “চলে” শব্দটা শুনলেই ধরে নিতে হবে ভালো হয়েছে। আমি ওকে ছেড়ে বললাম,

— তায়াং ভাইয়া তোর সাথে আমার বিয়ে না হলে তোর দাদী অসুস্থ হয়ে যাবে। তা বুড়ি তো দেখছি এখনো ভালো আছে। কিছুই তো হলো না। তোর দাদীকে তো সেরা কুটনি বুড়ি পুরস্কার দিতে হয়। যদি পুরস্কারটা থাকতো তাহলে আমিই দিতাম। তাকে এখানে রেখেছিস কেন? সিরিয়ালে দিয়ে দে। ভালো কুটনামি করতে পারবে। কোন সিরিয়ালের ডিরেক্টর যদি তার খবর পেতো তাহলে নিজ দায়িত্বে নিয়ে যেতো।

ভাইয়া হালুয়া খাওয়া রেখে চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
— উনি তোর বড়। কথাবার্তা সাবধানে বলিস।

— আমি কিছু ভুল বলেনি। উনি যেই খেলটা দেখালো। সব ভেজালের মূল তিনি। যত ভেজাল সব সে লাগিয়েছে। উনি যদি প্যাচটা না লাগাতো তাহলে আজ এত কাহিনি হতো না।

তায়াং ভাইয়া আমার কথার তোয়াক্কা না করে চেঁছেপুঁছে হালুয়া খেতে মনোযোগ দিলো। আমি নিজের কপালে একটা চাপর মেরে ওর দিকে রাগী লুকে তাকিয়ে রইলাম।

বিকালে….

খালামণির রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এনাজের কণ্ঠ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কত দিন পর তার কন্ঠ শুনলাম। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি জানি কারো কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে নেই। কিন্তু এনাজের কন্ঠ পেয়ে সেখানে দাঁড়াতে মন চাইলো। এনাজ দাদীকে তায়াং ভাইয়ার বিয়ের জন্য রাজী করাচ্ছে। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে দেখলাম এনাজ দাদীর হাত ধরে বলছে,

— দাদী প্লিজ রাজী হয়ে যাও বিয়েতে। নূর আপি অনেক ভালো মেয়ে। তোমার নাতি যেহেতু পছন্দ করে তার সাথেই বিয়ে হয়ে যেতে দাও। তুমি হয়তো মনে করতে পারো নোভাকে আমি পছন্দ করি বলে এসব বলছি কিন্তু না। নোভা, তায়াং দুজন দুজনকে ভাই-বোনের চোখে দেখে। যদি ওদের মধ্যে কেউ একজন অপরকে ভালোবাসতো তাহলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিয়ে দিতাম। এখন যেহেতু তায়াং বা নোভা কেউ অপরকে ভালোবাসে না তাহলে আপনার রেগে থাকা কোন মানে হয় বলেন? আপনার অনুমতি ছাড়া তায়াং অবশ্যই বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু ও সবার দোয়া নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছে। আপনি যদি ওদের দোয়া না দেন তাহলে কি ওরা নতুন জীবনে সুখী হতে পারবে বলেন তো?

দাদী কিছু সময় চুপ করে থাকলো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,

— তুমি যেহেতু এতকরে বলছো তাহলে তো রাজী হতেই হয়। আমার দুই নাম্বার জামাই এত সুন্দর করে আমাকে বুঝালো আমি কি না বুঝে থাকতে পারি। কই গো তানভীরের মা বিয়ের সানাই বাজাও। আগামী সপ্তাহেই আমার বড় নাতির বিয়ে।

দাদী এত সহজে রাজী হয়ে গেলো তা দেখে আমি অবাক। এই মহিলাকে কেউ রাজী করাতে পারলো না। আর এই ছেলে কয়েক কথা বলায় রাজী হয়ে গেলো। কিন্তু আমাদের বিষয় নিয়ে তখন একটা কথাও বললো না। এর খবর আছে। মাথার মধ্যে চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো। পর্দা ছেড়ে সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। এনাজ বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো। আবারো ইগনোর😤।

💖💖💖

— কি দেখছো টিডি পোকা?

ছাদে দাঁড়িয়ে দূর আকাশ দেখছিলাম। এনাজের কন্ঠস্বর পেয়েও পেছনে তাকালাম না। তার সাথে অভিমান জমেছে আমার। সে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— অভিমান জমেছে আমার ওপর।

কথাটা শুনে চমকে উঠলাম।সে কি করে বুঝলো আমি অভিমান করেছি। তাকে বুঝতে না দিয়ে আমি সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখলাম।সে কিছুটা জোরে বলে উঠলো,

— আভিমান হয়েছি আমি জানি। তাই তো অভিমান ভাঙাতে চলে এলাম৷ অভিমান বেশি দিন থাকলে অভিযোগ হয়ে যায়। অভিযোগ থেকে দূরত্ব। দূরত্ব থেকে সম্পর্ক নষ্ট।

আমি মুখ ভেংচি দিয়ে তার দিক থেকে সরে যেতে নিলেই সে হাত ধরে আটকে বললো,

— কথা বলছো না কেন?

আমি হাত তার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করে বললাম,
— হাত ছাড়ুন।

— ছাড়বো না কি করবে?

— জোরে চেঁচাবো।

— যতখুশি চেচাও। আমার কিছু করা নেই।

— এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে, হাত ছাড়ুন আমার।

— উপর দিক দিয়ে রাগ দেখালেও তুমি যে ভেতরে খুশি হচ্ছো তা কিন্তু আমি জানি।

— কেন খুশি হবো?

— আমি হাত ধরেছি তাই।

কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
— বয়েই গেছে আমার। হাত ছাড়ুন। আপনি আমাকে ইগনোর করছেন।

— আল্লাহ, কখনোই না। আমি তোমাকে ইগনোর করিনি।

— তাহলে গত চারদিন ধরে আপনাকে কলের ওপর কল দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু সিম বন্ধ কেন বলছে?

— আসলে সেদিন এই বাসা থেকে যাওয়ার পর রাগের বশে মোবাইল আছাড় মেরেছিলাম। মোবাইল পুরো চার টুকরো হয়ে গেছে। সিমও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। আমি তো বড়লোক ছেলে নই যে আজ একটা ভাঙবো কাল একটা কিনে নিবো। দুই সপ্তাহ পর নতুন মোবাইল কিনবো। এখন কোনরকম একটা বাটন মোবাইল চালাচ্ছি। এই যে দেখো। এটাই শেষ সম্বল। সকালে সিম কিনে আনলাম।

উনি পকেট থেকে একটা বাটন মোবাইল বের করে দেখালো।আমি ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাত কোমড়ে রেখে রাগী গলায় বললাম,

— মোবাইল যখন সাথে সাথে কিনতে পারবেন না তাহলে ভেঙেছেন কেন? আমি তো রাগ হলে আর যাই করি, কখনো মোবাইলের ওপর রাগ দেখায় না।

— আমিও দেখাই না। তবে সেদিন কেন মোবাইলটা আছাড় মারলাম কে জানে! ভাঙার পর নিজেই আফসোস করছি।

— হু হু ভালো করছেন সরেন এবার।

— তুমি যে আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারো না তাও কিন্তু জানি আমি।

তার কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। আমি তার সাথে রাগ করে থাকতেই পারি না। সে নিজ থেকে এসে আমার সাথে কথা বললেই আমার রাগ, অভিমান সব ফুস করে উড়ে যায়। আমি মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললাম। সে দুই আঙুলে আমার থুঁতনি ধরে তার দিকে আমার মুখ ঘুরালো। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

— আর কোন অভিমান বা অভিযোগ আছে? নাকি এই একটাই ছিলো?

— আছে।

— তাহলে বলে ফেলো।

— বলবো না।

— না বললে ভাঙাবো কি করে?

— ভাঙাতে হবে না।

— বাহ বাহ কি অভিমান! জলদী বলে ফেলো।

— সেদিন কলেজে আমি অনেকবার আপনাকে ডেকেছিলাম। কিন্তু আপনি শুনেননি।

— কোনদিন?

— রওনককে যেদিন আমার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন পেছন থেকে অনেক ডেকেছি।

এনাজ জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার দিকে অপরাধী ভঙ্গিতে তাকালো। তারপর দুই কানে হাত দিয়ে বললো,

— সরি সরি। আমি তোমার ডাক শুনতে পাইনি। তওহিদের মোবাইল, এয়ারফোন আমার কাছে ছিলো। রওনকের সাথে কথা বলা শেষ করে দুই কানে এয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে কলেজ থেকে বের হয়ে গেছি। তাই তোমার ডাক শুনতে পাইনি।

— আপনার সাথে আর কোন কথা নেই😤।

— সরি টিডি পোকা। আসলে এই কয়দিন আমি ইচ্ছে করে তোমার থেকে দূরে থেকেছি। আমার খুব রাগ হচ্ছিলো নিজের ওপর। কোন কারণ ছাড়াই। তাছাড়া তোমার বাবার বিষয়টা নিয়েও আমি অনেক চিন্তিত ছিলাম। তাই তোমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখেছি। আমার ভয় হয়েছে যদি রাগের বশে তোমার সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করে ফেলি কিংবা তোমাকে কোনভাবে মনে আঘাত দিয়ে ফেলি তাই। তাহলে তো তুমি আমায় ভুল বুঝবে। আর সারাজীবনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তাই এই দূরত্ব। আমি আবার মাফ চেয়ে নিচ্ছি তার জন্য। আই এম রিয়েলি সরি।

— থাকেন আপনি আপনার রাগ নিয়ে আমি গেলাম।

— একটা সুসংবাদ আছে। সেটা তো শুনে যাও।

— কিছু শুনবো না আমি।

— আমি খুব শীঘ্রই তোমার বাবার কথামতো পাঁচজন নিয়ে হাজির হচ্ছি। এই কয়দিনে সব ভেবে, ব্যবস্থা করে ফেলেছি আমি।

— কোন দরকার নেই। থাকেন আপনি আপনার রাগ নিয়ে। কিচ্ছু লাগবে না।

দ্রুত ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম। এর ওপর আমার এখন একটু বেশি অভিমান হচ্ছে। বলবো না তো কোন কথা। থাকুক সে তার রাগ নিয়ে। এতকিছু হয়ে গেছে সে আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি। যা খুশি তা করুক। আমি কিচ্ছু বলবো না।

#চলবে