#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৪|
দীর্ঘদিন নিজেকে রুমবন্দী করে ফেললেও আজ প্রয়োজনের তাগিদে ক্যাম্পাসে ছুটে যেতে হচ্ছে প্রিয়র। আকাশের অবস্থা ভালো না। কাঠফাটা রোদের মধ্যেও পশ্চিমে আঁধার। হুট করেই বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা। অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে প্রিয় গাড়ি থেকে ক্যাম্পাসের ঠিক সামনে নেমে ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন শ্রেয়ান এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রিয় রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেও রাগ প্রকাশ করতে পারল না। শ্রেয়ানের অবস্থা শোচনীয়। স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে, চোখের নিচে এক ইঞ্জি পুরু কালো দাগ জমেছে, দাড়ি কাটে না অনেকদিন। প্রিয় একবার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলেও, গেল না। অগোচরে দু’বার শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলে শুধাল,
-“এই অবস্থা কেন?”
-“তুমি বুঝতে পারছ না? এভাবে কেউ যোগাযোগ বন্ধ করে? পাগল তুমি?”
শ্রেয়ানের কণ্ঠ অত্যন্ত চাপা, তবুও তাতে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আলগোছে হাসল প্রিয়! যাক, রাগটা কমেনি এখনও। স্বভাববশত, অভ্যেসবশত, সবার ঊর্ধ্বে গিয়ে অধিকারবশত শ্রেয়ান প্রিয়র হাত ধরে বলল,
-“একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলি। রাগ-ক্ষোভ সব ঝাড়ো। নেক্সট মান্থে বিয়ে করব।”
-“তোমাকে আমি বিয়ে করব না, শ্রেয়ান।”
প্রিয় সাবধানে নিজের হাতটা শ্রেয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিল। শ্রেয়ান স্তব্ধ বনে দাঁড়িয়ে গেল। কথাটা মানতে পারছে না। এভাবে কীভাবে মেয়েটা এই কথা বলে ফেলল? এতটাই ঠুনকো হয়ে গেছে সে? কয়দিন আগেও না বিয়ের জন্য কান্নাকাটি করে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শরীর খারাপ করে ফেলল? সেই মেয়েটা আজ এত সাবলীলভাবে এই কঠিন কথাটা বলল কীভাবে? শ্রেয়ান মনে করল—সে ভুল শুনেছে। পরমুহূর্তে বাস্তবতা বুঝে গিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল,
-“রাগের মাথায় মানুষ অনেক কথাই বলে, সেগুলোকে আমলে নেওয়ার চেয়ে বোকামি আর হয় না, প্রিয়শ্রী। চলো। বসে কথা বলি।”
শ্রেয়ান আবার হাত ধরতে গেলে প্রিয় তাকে আটকায়,
-“চলো।”
শ্রেয়ান আর ঘাটাল না। পাশেই একটা কফিশপ আছে, ওখানে গিয়ে বসল। প্রিয় ফোনের স্ক্রিন অন করে টাইম দেখল। তারপর সোজা শ্রেয়ানের চোখ চোখ রেখে বলল,
-“আমার হাতে আধ ঘন্টা আছে। তোমাকে পঁচিশ মিনিট দিলাম। বলো।”
শ্রেয়ান অবাক হয়ে বলল,
-“সময়জ্ঞানহীন মেয়েটা সময়ের এত হিসেব করছে কেন?”
-“মেয়েটার বুঝ হয়েছে।”
-“আচ্ছা? শুনি তবে, ম্যাডামের কী কী কুবুদ্ধি উদয় হলো।”
-“সময় অপচয় করছ, শ্রেয়ান। যা বলার বলে ফেলো।”
শ্রেয়ান খেয়াল করল—যেই মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকাতে লজ্জায়-দ্বিধায় মরে যেত, সেই মেয়েটা পুরোটা কথা শ্রেয়ানের চোখে চোখ রেখে বলেছে, বলছে। ক’দিন আগে অভিমানে আপনি সম্বোধনে এসেছিল, এখন যেন সেই কণ্ঠে অভিমানটা আর নেই, তুমি করে বলছে; যেন সব স্বাভাবিক। কী আশ্চর্য! অভিমানটাও নেই? প্রেমের মূলনীতিতে অভিমান থাকা তো বাধ্যতামূলক।
দু-তিনটা মাস আগেও তো এই প্রিয় বারে বারে লজ্জায় রেঙে যেত, ক্ষণে ক্ষণে চোখ ছলছল করত অভিমানে, ঠোঁটের ভাঁজে ছিল কতশত অভিযোগ! অথচ আজ কিছুই নেই, কিচ্ছু না..
শ্রেয়ানের চোখ যায় প্রিয়র ঠোঁটের দিকে। গলা শুকিয়ে আসে। মাথায় আসে উলটোপালটা অসংখ্য ভাবনা। প্রেমিকা সে। তাকে নিয়ে এসব ভাবনা আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টা প্রিয় স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না। গা গুলিয়ে উঠল। ঠোঁট ছুঁয়ে গেল তাচ্ছিল্যের হাসি, খুবই সামান্যভাবে। শ্রেয়ান তা লক্ষ করল কি? হয়তো করেছে বলেই তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি এসে স্থির হলো প্রিয়র চোখের বাদামি রঙের আইবলে। সে দেখতে পেল, প্রিয়র চোখ দুটোও নিজের লক্ষ্য পরিবর্তন করে অন্যদিকে তাকিয়েছে। আনমনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শ্রেয়ান। সবকিছু হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রায়। এভাবে চললে চলবে কী করে? এরকম তো সে চায়নি। সে প্রিয়কে চেয়েছে, সবভাবে প্রিয়কে চেয়েছে। আর ক’টা বছর পর বিয়েও করে নিত। কিন্তু মেয়েটা এখনই এত জ্বালাচ্ছে! তাই বাধ্য হয়ে এক মাসের মাথাতেই বিয়ে করে নেব। সে প্রিয়কে অসম্ভব ভালোবাসে।
প্রিয় কফির কাপটিতে চুমুক দিয়ে বলল পনেরো মিনিট আছে। শ্রেয়ান ভড়কে উঠল। প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কেমন আছ, সোনা?”
-“ভালো আছি।”
-“আমাকে জিজ্ঞেস করবে না?”
-“স্বার্থপররা ভালো থাকে, শ্রেয়ান। তুমিও ভালো আছ।”
-“আমি স্বার্থপর?”
শ্রেয়ানের কণ্ঠে প্রচণ্ড বিস্ময়। এমন কোনো কথা সে প্রিয়র মুখ থেকে শুনবে বলে কখনই আশা করেনি। সে তড়িঘড়ি করে টেবিলের ওপর ফেলে রাখা প্রিয়র হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
-“এক্সট্রেমলি সরি, সোনা। ব্যস্ততা অনেক বাজে জিনিস, আমি আর এসবের অভিযোগ আসতে দেবো না।”
প্রিয় ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকাল। তারপর শ্রেয়ানের দিকে তাকাল। অন্য হাত দিয়ে শ্রেয়ানের হাতটা সরিয়ে দিলো, ঠিক উচ্ছিষ্টের ন্যায়। এতে শ্রেয়ানের আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। চাপা আওয়াজে খানিকটা গর্জে উঠল,
-“বেশি আহ্লাদ করছি বলে যা ইচ্ছে করবে আর আমি তোষামোদি করব, এরকমটে ভেবো না। এতক্ষণ যা করলে, এতদিন যা করলে, সব মেনে নিয়েছি। আমি অনুতপ্ত হয়েছি, আমি সরি অবধি বলেছি। এখন কি তুমি চাইছ আমি তোমার পায়ে পড়ি? এত দেমাগ কীসের?”
প্রিয় ত্বরিতে হেসে উঠল। শব্দ করে হাসতে লাগল। আশে-পাশের মানুষজন মাথা ঘুরিয়ে একবার ওকে দেখে পুনরায় নিজ কাজে মন দিলো। বাহ্যিকতায় দেখা গেলে বোঝা যায়—প্রিয় কোনো জোক শুনে হাসছে। অথচ সেই হাসির ভেতরের গল্পটা শ্রেয়ান ধরতে পারল। আশ্চর্যের বিষয়, শ্রেয়ানের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।
প্রিয় হাসি থামাতে সময় নিল না। মুখভাব অত্যন্ত স্বাভাবিক। নরম কণ্ঠে বলল,
-“এই তোমার অনুতপ্ততা?”
শ্রেয়ান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
-“সরি, সোনা।”
-“ঠিক কোন ভুলের জন্য তোমায় ক্ষমা করব, বলতে পারো?”
-“আসলে..আমার রাগটা একটু বেশি, জানোই তো। তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে। একটু মানিয়ে নিলেই সব হবে। আমাদের সুখের নীড় হবে, ছোট্ট একটা দুজনার ঘর হবে। ভাগাভাগির সংসার হবে, প্রিয়শ্রী।”
প্রিয় চোখে হেসে বলল,
-“কিচ্ছু হবে না, শ্রেয়ান।”
-“এরকম কেন করছ? নতুন কাউকে পেয়েছ, প্রিয়শ্রী? মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, সোনা। প্লিজ আমাকে আর ঘাটিয়ো না।”
-“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না, শ্রেয়ান।”
-“রিজন কী?”
-“তুমি।”
শ্রেয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রিয় তা দেখে বলল,
-“ঠিক কোন ভুলগুলোর জন্য তোমায় মাফ করব বলতে পারো? আমাকে রোজ কাঁদানোর জন্য? আমাকে খেলনা বানিয়ে খেলার জন্য? আমার থেকে আমার পরিবারের দূরত্ব বাড়ানোর জন্য? আমার বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের জন্য? আমাকে একা করে দেওয়ার জন্য? আমার থেকে আমার নিজস্বতা কেড়ে নেওয়ার জন্য? আমাকে প্রচণ্ডভাবে তোমার ওপর নির্ভরশীল বানিয়ে দেওয়ার জন্য? আমাকে..আমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা চেনানোর জন্য? বলো? ঠিক কোন ভুলগুলোর জন্য মাফ করব?”
প্রিয়র আওয়াজ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলেও সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তাকিয়ে রয়েছে শ্রেয়ানের মুখপানে। সব শুনে শ্রেয়ানের অবিচল আওয়াজ,
-“আমি তোমাকে চাই।”
যেন সে এসবে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। প্রিয় হাসল,
-“যাও। এই একটি কথার জন্য এসব কিছু মাফ করে দিলাম।”
শ্রেয়ানের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু এক ঝটকায় পেয়ে যাওয়ার জন্য। খুশি হয়ে যখনই কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রিয় আবারও বলে ওঠে,
-“শ্রেয়ান, মনে আছে? বিগত আড়াই বছরে.. এই অবধি রেগে গিয়ে তুমি চারবার আমায় থাপ্পড় মেরেছ। আমি সেসবের যন্ত্রণা ভুলেছি, কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য মুহুর্তগুলো ভুলতে পারিনি। আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। মানতেই চাইতাম না, তুমি আমাকে মারতে পারো। সরি টু স্যে, বাট তুমি রেগে গেলে জানোয়ার হয়ে যাও, শ্রেয়ান।”
কথাগুলো শ্রেয়ানের মস্তিষ্কে আঘাত করল বাজেভাবে। মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা এসব বলছে কেন? কী সমস্যা তার? কী চায়? প্রিয় শ্রেয়ানের চোখের দৃষ্টি বুঝে ফেলে বলল,
-“তুমি যতবার ক্ষমা চাইবে, ততবারই না-হয় আমি আপোষে আসব। এরপর একদিন তুমি রাগের বশে আমাকে খুন করে বসলে..”
-“ছি! এসব বোলো না। আমি কখনও এসব ভাবতে পারব না, প্রিয়। তোমাকে খুন করব ভাবার আগে আমার মৃত্যু হোক।”
শ্রেয়ানকে থামিয়ে প্রিয় বলল,
-“আহা! আমি বলছি, শোনো।”
শ্রেয়ান থামল। প্রিয় বলতে লাগল,
-“তোমার রাগ মারাত্মক, শ্রেয়ান। আমি ভয় পাই। রেগে গেলে তুমি মানুষ দেখো না, পরিবেশ দেখো না। থাপ্পড় মারতে পেরেছ, গায়ে মারতে কতক্ষণ? এভাবে চললে কখন রেগে গিয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবে, তুমি নিজেও টের পাবে না। তুমি বুঝতেই পারবে না, তুমি খুন করেছ। তোমার মধ্যে তখন তুমি থাকো না, শ্রেয়ান। বললাম না? জানোয়ার হয়ে যাও। হুশে ফিরতে ফিরতে আমি নিজের প্রাণ হারাব। স্বাভাবিক। হতেই পারে। তোমার দ্বারা অসম্ভব নয়। আর তারপর তুমি কার কাছে সরি বলবে? আমার লাশের কাছে? আমি না হয় রোজ মাফ করে দেবো। আমার লাশ মাফ করবে তোমায়?”
প্রিয়র পুরো কথা শুনে শ্রেয়ান হতবাক হয়ে এলো। বিশ্বাস হতে চাইল না, এটাই সেই প্রিয় যাকে সে ৩ মাস আগে দেখেছিল। এতটা পরিবর্তন? সে জানে মানুষ পরিবর্তনশীল। কিন্তু কখনই ভাবেনি, প্রিয় বদলাবে। সে চায়নি প্রিয় বদলাক। বোকা মেয়েটা চালাক হয়ে উঠছে। বোকা মেয়েটা নিজের ভালো বুঝতে শিখছে। সুযোগটা করে দিয়েছে শ্রেয়ান নিজেই। নিজের ওপর নিজেরই এখন চরম রাগ আসছে।
শ্রেয়ান তবুও হারল মানল না। অস্থিরতা প্রকাশ করে বলতে লাগল,
-“আরেকটা সু্যোগ দাও।”
-“আমি স্বার্থপর হতে চাই, শ্রেয়ান। নিজেকে ভালোবাসতে চাই।”
-“সেই স্বার্থপরতায় আমি থাকতে চাই।”
-“তোমার টাইম শেষ হয়ে গেছে। শেষ সুযোগ দিচ্ছি। আর কিছু বলবে?”
আর কোনো উপায় না পেয়ে শ্রেয়ান হুট করেই বলে উঠল,
-“তোমাকে ছাড়া বাঁচব না আমি, প্রিয়।”
-“ব্যাপার না। মানুষ মরণশীল। সেই তো দুদিন পর এমনিতেও মরবে। আগে-পরে হবে, এই-যা..”
ভীষণ রকমের আশ্চর্য হয়ে শ্রেয়ান জিজ্ঞেস করে বসে,
-“তোমার কষ্ট হচ্ছে না এসব বলতে?”
প্রিয় হাসে,
-“সত্যি বলব?”
-“হুঁ।”
-“তোমার সাথে থাকতে গেলে এর চেয়েও বেশি কষ্ট হতো শ্রেয়ান, বিশ্বাস করো। নিজের প্রতি অনেক অবহেলা করেছি। আর চাইছি না।”
-“আমি তোমায় ভালোবাসি।”
-“আমিও ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। আমার ভালোবাসায় মায়া ছিল, আর তোমারটায় জুলুম। একটু ভেবে দেখো, ভালোবাসা আর জিদের সঙ্গা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স তোমার।”
শ্রেয়ান এবার আর না রেগে পারে না,
-“প্রিয়, তুমি আমার জেদ। তুমি আসলেই আমার জেদ। আমি আমার জেদকে যতটা ভালোবাসি, ততটা অন্য কিছুকে নয়।”
-“জানি, তুমি তোমার জেদকে ভালোবাসো। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”
-“প্রিয়, অনেক হয়েছে। আর পারছি না তোমার এসব ছেলেমানুষী নিতে। এত ওড়া ভালো নয়। ভালোয় ভালোয় বলছি, ফিরে আসতে। আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকবে না।”
প্রিয় উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলে,
-“ফ্যান্টাসির বয়স অনেক আগেই পেরিয়েছে। তুমি ম্যানুপুলেট করে রেখেছিলে বলে আমি টের পাইনি। নয়তো তোমাকে ছেড়ে আমি খারাপ নেই। ভালো থাকাটা খুব একটা জরুরিও নয়।”
শ্রেয়ান আর ডাকতে পারল না। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল, তাকিয়ে রইল প্রিয়র চলে যাওয়ার দিকে। সে লক্ষ করল ক্যাফের শেষমাথায় গিয়ে প্রিয় হুট করেই একটা ফাঁকা টেবিলের ওপর নিজের ব্যাগটা রাখল। ব্যাগ থেকে একটা মিনি নোটবুক বের করল, তাতে কিছু একটা লিখল। তারপর কাগজটি ছিঁড়ে একজন ওয়েটারকে ডেকে তার হাতে দিলো। প্রিয় আস্তে আস্তে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। এই প্রিয় সেই প্রিয় নয়। এই প্রিয় কথায় কথায় কেঁদে ওঠা মেয়েটি নয়। এই প্রিয়র চোখ আজ এক মুহূর্তের জন্য জলে ভাসেনি, কণ্ঠ কাঁপেনি একটি শব্দ উচ্চারণেও। প্রিয়র কথাগুলোর চেয়ে তার ব্যবহারটা শ্রেয়ানকে বেশি চমকে দিয়েছে। ভেবেছিল, প্রিয়কে সে যে-কোনোভাবে মানিয়ে ফিরিয়ে নিতে পারবে। ভাবনাটা ভুল। এত সহজ হবে না। মিষ্টি মেয়েটা লবঙ্গ হয়ে উঠেছে। কী ঝাঁজ! শ্রেয়ান আনমনেই হেসে উঠল। মেয়েটার এই রূপটাও মন্দ নয়।
এরই মাঝে ওয়েটারের কথায় শ্রেয়ান ভাবনা থেকে বেরোল। ওয়েটার শ্রেয়ানকে একটা কাগজ দিয়ে চলে গেল। শ্রেয়ান খেয়াল করল, এটা সেই মিনি নোটবুকের একটা কাগজ। প্রিয়র হাতের লেখায় গুটিগুটি অক্ষরে লেখা আছে,
-“বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে তোমাকে আমার আর চাই না, শ্রেয়ান। আমাদের ছোট্ট একটা জীবন, ভীষণ ছোট..আমি বাঁচতে চাই। আমি নিজেকে ভালো রাখতে চাই। আর..
হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যি বলছি। এই কথাটি যেমন মিথ্যে নয়, ঠিক তেমনই আমি মেনে নিয়েছি—তুমি আমার নও। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে, আমি কখনও ভুলব না। আমি ভুলতে পারব না। তুমি আমার প্রেমিক ছিলে। জানো? আমাদের চমৎকার একটা প্রেম হয়েছিল। শ্রেয়ান, বিশ্বাস করো। আমি বিচ্ছেদ চাইনি। আমি সুন্দর করে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
আফসোস.. দুটো যেন নদীর দু’কূল!
অনেক ভাবলাম। আর তারপর? তারপর আমি নিজের শান্তিটা বেছে নিলাম। তোমাকে অপশনে রেখে বিচ্ছেদকে আপন করার জন্য আমি দুঃখিত। আল্লাহ তোমায় সুখে রাখুক। আবার দেখা হবে একদিন। একই শহরের তো? দেখা হবে এরকমই কোনো ক্যাফেতে, কিংবা রাজধানীর ভীষণ রকমের জ্যামে। সেদিন আমরা দু’জনই পূর্ণ থাকব.. পরিপূর্ণ থাকব। কীভাবে? বলব না। তুমি মিলিয়ে নিয়ো…”
শ্রেয়ান পুনরায় একবার ক্যাফের বাইরে তাকাল। প্রিয় একটা রিকশায় উঠে বসেছে। রিকশা চলতে শুরু করার আগমুহূর্তে প্রিয় আরেকবার শ্রেয়ানের দিকে তাকাল। শ্রেয়ান দূর হতে লক্ষ করল, প্রিয়র ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসিটা। বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠল তার। নাহ.. এটা সে হতে দেবে না। এই হাসির একচ্ছত্র আধিপত্য কেবল তার। বিচ্ছেদ সুখের নয়, প্রিয়কে তা বোঝাতে হবে। বোঝাতে থাকবে শেষ অবধি। বোকা প্রিয় বুঝবে, অবশ্যই বুঝবে! শ্রেয়ান বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা করতে লাগল। তারপর আবার চিরকুটের দিকে তাকাল। একবার, দু’বার, অসংখ্যবার পড়ল…
চলবে…
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৫|
রিকশা কিছুটা এগিয়ে যেতেই এক ফোটা দু-ফোটা করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরতে লাগল। প্রিয় রিকশাওয়ালাকে একটা ছাউনি দেখে সাইডে দাঁড়াতে বলল। তারপর ভাড়াটাও দিয়ে দিলো। এক পা দু-পা করে বাস স্টপেজের ছাউনিতে গিয়ে বসে পড়ল। বৃষ্টির তেজ বাড়তে লাগল। সেই সাথে বেড়িয়ে আসতে লাগল এতক্ষণ বুকের ভেতরে চেপে রাখা সব যন্ত্রণা। প্রিয় আদতে এত শক্ত মেয়ে নয়, যতটা সে খানিকক্ষণ আগে দেখিয়েছে। তার প্রতিটা কথা বলার সাথে সাথে চেপে রাখা কান্না বের হতে চাইত। সে কতটা কষ্টে যে নিজেকে কঠিন বানিয়ে রেখেছিল, সে জানে না।
প্রিয় আকাশপানে তাকায়। ভার্সিটির উদ্দেশ্যে এলেও, যাওয়া হয়নি। হবেও না আজ, দেহে আর শক্তি নেই। মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রিয় খেয়াল করে, আকাশটা অন্ধকার হয়ে এসেছিল খুব। আশে-পাশের কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছিল না। বৃষ্টির সাথে সাথে আস্তে-ধীরে গুমোট বাঁধা মেঘগুলো আকাশকে বিদায় জানাচ্ছিল। পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা আঁধারিয়া পূর্বে বিলীন হতে লাগল ক্রমশ। প্রিয় অবাক হয়ে আকাশকে পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতে দেখতে লাগল। অঝোরে বৃষ্টি বইছে। এখন সব কী পরিষ্কার, ঝকঝকে!
ছোটোবেলায় তার আব্বু তাকে একটা কথা বলেছিল। খুব বেশি ছোটো ছিল না অবশ্য, বয়স তখন ৮-১০ ওর মতো। তবুও প্রিয়র স্পষ্ট মনে আছে। নাসিরুদ্দিন সাহেব চমকপ্রদভাবে হেসে প্রিয়কে বলেছিলেন, “প্রকৃতির সাথে জীবনের দারুণ যোগসূত্র আছে। যখনই জীবনের কোনো দ্বিধায় তুমি কূল হারাও, তখন প্রকৃতিতে দৃষ্টি দাও। সলিউশন পাবে। পেতে বাধ্য।”
প্রিয় সে কথা ভোলেনি, কখনও ভুলবে না।
সে হুট করে ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো। নরম পায়ে ফুটপাথ বেয়ে এগোতে লাগল। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা গায়ে লাগতেই সে শিউরে উঠছে। অসম্ভব ঠান্ডা জল। মন-প্রাণ সব জুড়িয়ে যেতে লাগল। বুকের ব্যথাটাও কমছে, কাঁপনও স্থির হচ্ছে। তার ভালো লাগছে। মুখটা আকাশপানে রাখল। বৃষ্টি এখন তার কপাল, চোখ, গাল, ঠোঁট, গলা—সব কী আবেদনময়ী ভঙ্গিতে ছুঁয়ে যেতে লাগল!
চোখ দুটো বন্ধ করল সে। কার্নিশ বেয়ে ফোটা ফোটা জল বারিধারার সাথে মিশে গেল ধরনীতলে। সে বুঝতে পারল, পৃথিবীটা আসলেই সুন্দর। মরে যাওয়ার মতো কিছুই হয়নি। কিচ্ছু না। ওরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য কত কী করে! সেখানে প্রিয় এই সামান্যতে কী করে নিজের মৃত্যু কামনা করছে? নাহ! আর করবে না। সে বাঁচবে। সে সুন্দর করে বাঁচবে। যেই ছেলেটা তাকে ভালোবাসা শেখাল, যন্ত্রণা চেনাল, সেই ছেলেটার জন্য মন থেকে দোয়া রইল। প্রিয় বৃষ্টি গায়ে মেখে দোয়া করতে লাগল,
-“জেদি ছেলে শ্রেয়ান, তোমার জন্য ভালোবাসা ছিল, আছে.. কিন্তু ভবিষ্যতে থাকবে না। ভবিষ্যতে তোমার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন প্রিয়শ্রীর মনে তোমার জন্য কোনো অনুভূতিই থাকবে না। তবে দোয়া থাকবে। খুব খুব দোয়া থাকবে। তুমিও একদিন ভালোবাসা শিখবে। আমার প্রতি হোক কিংবা অন্য কারো প্রতি, তীব্রভাবে ভালোবাসাটা তুমিও একদিন টের পাবে। আশফিক রহমান শ্রেয়ান, তুমিও একদিন একজনকে ভীষণ রকমের ভালোবাসবে। ভালোবাসা শিখলে যন্ত্রণা চিনতেই হয়, এক্ষেত্রে আমার দোয়ায় আমি তোমার ভালো থাকাটা রাখতে পারব না।”
প্রিয়র কান্না বৃষ্টির সাথে ধুয়ে গেলেও, হুট করে ঠোঁট, গাল বেয়ে চোখ ছুঁয়ে যাওয়া হাসিটা মুছল না; এটা বোধহয় থেকে যাবে শেষ অবধি..
______
প্রিয়র সাথে শ্রেয়ানের এরপর দেখা হলো আবার পরের সপ্তাহে। শ্রেয়ান রোজ তার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিয় ইচ্ছা করে এড়িয়ে যায়। আর প্রতিবারই গাড়িতে ওঠার পর লুকিং গ্লাসে শ্রেয়ানের হতাশ দৃষ্টি দেখতে পায়। প্রিয় তখন কিছুই দেখেনি ভঙ্গিমায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। একটা কথা আছে। মায়া বাড়িয়ে লাভ না হলে মায়া কাটাতে জানতে হয়।
তবে প্রিয় আজ আর এড়িয়ে গেল না। সোজা শ্রেয়ানের দিকে এগিয়ে এলো। শ্রেয়ান যেন চাঁদ হাতে পেল। কিছু বলতে উদ্যত হওয়ার আগেই প্রিয় হাসি ঠোঁটের কোণে সাজিয়ে বলল,
-“ভালো আছ?”
শ্রেয়ান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়কে সম্পূর্ণভাবে অবলোকন করে নিয়ে বলে,
-“তোমাকে ছাড়া ভালো নেই।”
প্রিয় হাসে,
-“কেউ কাউকে ছাড়া খুব বেশিদিন খারাপ থাকে না। তুমিও থাকবে না।”
-“আমাকে তো খুব বুঝতে তুমি, এখন কেন বুঝতে পারছ না?”
-“বুঝতে চাইছি না আসলে।”
-“কেন?”
-“কারণ তুমি। তুমি হচ্ছ আমার অতীত। অতীতের ভীষণ গভীর এক ক্ষত। আমার ক্ষত এখনও সারেনি। এভাবে খোঁচাতে লাগলে যন্ত্রণা আরও বাড়বে।”
শ্রেয়ান প্রিয়র হাত ধরে ফেলল ত্বরিতে,
-“প্লিজ, আরেকটা সুযোগ দাও।”
প্রিয় হাত ছাড়িয়ে নেয়,
-“ছোঁয়াছুঁয়ি আর ভালো লাগে না, শ্রেয়ান। আর সুযোগ? মন মানছে না। কী করি বলো?”
-“মানবে। কিছুদিন আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করো। আমি সব ঠিক করে দেবো।”
প্রিয় মুচকি হেসে বলে,
-“যেই মুহূর্তে আমি তোমাকে অনুভব করিয়েছি—তোমাকে ছাড়া আমি অচল। সেই মুহূর্ত থেকে আমার অনুভূতির কোনো দাম আমি তোমার কাছ থেকে পাইনি।”
শ্রেয়ান ছটফট করতে থাকে,
-“আর হবে না এরকম।”
-“শ্রেয়ান, আমি তোমাকে আর চাই না।”
-“নতুন কাউকে পেয়েছ?”
শ্রেয়ানের কণ্ঠে অজান্তেই প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ। প্রিয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসে। শ্রেয়ান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“এজন্য আমাকে ছাড়ছিস?”
প্রিয় কিছু বলে না। শ্রেয়ান ক্ষেপে যায়। ওর একবাহু চেপে ধরে বলে ওঠে,
-“সমস্যা কী? কথা বলতে কী সমস্যা হচ্ছে?”
প্রিয় কথা বলে,
-“আমি এগিয়ে গেছি, শ্রেয়ান। রিলেশনে গেলেই বা কী?”
শ্রেয়ান যেন বিশ্বাসই করতে পারে না,
-“মজা করছ, প্রিয়?”
প্রিয় এবারও চুপ হয়ে থাকে। সে নতুন সম্পর্কে জড়ায়নি। রিলেশনশিপ নিয়ে অনেক বাজে একটা অভিজ্ঞতা তার হয়েছে, দ্বিতীয়বার জড়ানোর স্পর্ধা নেই। তাই বলে যে ভবিষ্যতে একা থাকবে, এমন পরিকল্পনাও তার নেই। বিয়ে-শাদি করে সেটেল হবে, তবে এখন না। ওর সময় লাগবে। নিজেকে সময় দেবে। নিজেকে তৈরি করবে।
শ্রেয়ান প্রিয়কে আবার চুপ হয়ে যেতে দেখে দু’কদম পিছিয়ে যায়। কণ্ঠে কী ভীষণ রাগ,
-“তোমার থেকে এটা আশা করিনি, প্রিয়শ্রী।”
প্রিয়র খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “অথচ শ্রেয়ান, তোমার থেকে আমার অনেক অনেক এক্সপেকটেশন ছিল।”
প্রিয় তা বলল না। মিহি হেসে অন্য টপিকে গিয়ে বলল,
-“এভাবে আর এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমার অস্বস্তি হয়। শেষ চাওয়া ধরে নাও…”
আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে চলে যায়। এতে শ্রেয়ান কী ভেবেছে না-ভেবেছে, ওর জানা নেই। তবে কাজ হয়েছে খুব। শ্রেয়ানকে এরপর আর আশে-পাশে দেখা যায়নি। হয়তো রাগে-ক্ষোভে গা ঢেকেছে, কিংবা ওর সেই তথাকথিত ব্যস্ততা ওকে আবারও নিজের জালে আটকে নিয়েছে।
_______
রিধিমার বিয়ে কয়দিন পর। এজন্য এক সপ্তাহ আগেই বিয়ে উপলক্ষে নাহারা ছেলে-মেয়েকে নিজের বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। নাসিরুদ্দিন সাহেব ছুটি নিলে বিয়ের আগেরদিন সে সময়মতো চলে আসবে।
দীর্ঘ জ্যামেপড়া সাড়ে পাঁচ ঘন্টার জার্নির পর প্রহর আর প্রিয়র গাড়িটা গিয়ে থামল ভীষণ রকমের পুরোনো অথচ রাজকীয় ধরনের বাড়িটির সামনে। মেইন গেইটের বাইরে স্বর্ণাভ নেমপ্লেটে লেখা আছে “শান্তিকুঞ্জ”। নেমপ্লেটটার চারপাশটায় দেয়াল ঘেঁষে লেগে থাকা শেওলাটাও যেন এত সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাড়িটা বেশ পুরোনো আমলের। প্রিয় চোখ জানালা ভেদ করে বড়োসড়ো একটা জায়গা নিয়ে স্থাপিত এই অসম্ভব মনোমুগ্ধকর বাড়িটার দিকে স্থির হয়ে আছে। দোতলা বাড়িটাকে দেখলে রাজবাড়ি শব্দটাই সবার আগে মুখে চলে আসবে।
সে এর আগেও শান্তিকুঞ্জে আরও চারবার এসেছে। ছোটোবেলায় দুবার, হাইস্কুল লাইফে একবার আর এসএসসির পর একবার।
শেষবার খালার থেকে শুনেছে, তার শ্বশুরের পরদাদার আমলের বাড়ি এটা। তিনি তখন এখানকার জমিদার ছিলেন। এরপর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেল, পরবর্তী প্রজন্ম বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।
তারপর যখন এই জায়গাটার ভাগবন্টনের কথা আসে, তখন তার দাদাশ্বশুর পশ্চিমাঞ্চলের জমিগুলো তার ভাইদের দিয়ে এই এলাকাটা নিজের জন্য রাখেন। পুরোনো ভঙ্গুর অংশগুলো মেরামত করে আবারও বসবাস উপযুক্ত করে তোলেন। দাদাশ্বশুর মারা গেছেন বহুত আগে। তবে ভেঙে নতুন করে বানানোর সাহসটা কেউ করেনি। তাঁর কঠোর আদেশ ছিল, এই বাড়িটা এই কাঠামোতেই থাকবে।
প্রহর ড্রাইভে ছিল। গার্ড সদর দরজা খুলে দিতেই প্রহর দক্ষ হাতে ড্রাইভ করে গাড়িটা সোজা উঠোনের মাঝে নিয়ে এসে থামাল। প্রিয় ধীরপায়ে নেমে গেল। প্রহর স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে পার্কিংয়ে চলে গেল।
প্রিয় নামতেই জেসমিন তটস্থ পায়ে এগিয়ে এলেন। সেই সাথে তার বড়ো জা-ও এলেন। সবার ভীষণ আদরের মেয়ে প্রিয়। যেই চারবার এসেছে, প্রতিবারই মাথায় তুলে রেখেছেন সবাই। মিষ্টি আর বাধ্য ধরনের হওয়ায় প্রিয়র কেবল ছোটোদের সাথেই নয়, বড়োদের সাথেও বেশ জমে। বাড়ির সবচেয়ে বয়ঃজ্যোষ্ঠা হচ্ছেন জেসমিনের শাশুড়ি, মনোহরা শিকদার। মানুষটা বেশ গম্ভীর। বয়স আশির ঘরে চলছে। অথচ এখনও তার দাম্ভিকতার কাছে সবাই নত হয়ে থাকে। প্রিয় নেমে নিয়ে সবার আগে তাকেই খুঁজল। বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় তাকে এখানে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর বটে। হাঁফ ছাড়ল প্রিয়। মনোহরা ভীড় পছন্দ করেন না মোটেও।
সামনে জেসমিন আর তার বড়ো জা শাহানাজ এগিয়ে এসেছেন। জেসমিন শুধালেন,
-“এসে গেছিস, আম্মু। ইশ! অনেক জ্যাম ছিল না?”
প্রিয় ভদ্রতাসূচক হাসে,
-“হ্যাঁ।”
পঞ্চাশোর্ধ শাহানাজ প্রিয়র মাথায় হাত বোলালেন। প্রিয় তাকে লক্ষ করল। গায়ে জামদানী শাড়ি ফুল হাতার ব্লাউজের সাথে আটপৌরে করে পরা, গলায় একটা সীতাহার, কানে গোল ধরনের কানপাশা, হাতে মোটা বালা আর নাকফুল। চেহারায় বয়সের ছোপ নেই। প্রথম দেখায় কেউই সঠিক আন্দাজে বলতে পারবে না তার বিয়ের বয়স ৩০ পেরিয়েছে অনেক বছর আগেই। প্রিয় মাঝে মাঝেই রিধিমার সাথে ভিডিয়ো কলে থাকাকালীন শাহানাজকে দেখে। কয়েকবার তো রিধিমাকে জিজ্ঞেসও করে ফেলেছে,
-“রিধি আপু, তোমার বড়োমায়ের স্কিনকেয়ার রুটিনটা দিয়ো তো আমাকে। মানে একটা মানুষ এত ওয়াও কেমনে থাকে?”
রিধিমা তা শুনে কেবল হেসেই যায়। প্রিয় সত্যি বলতে যতবার শাহানাজকে দেখে, ততবারই মুগ্ধ হয়। সে বলতে বাধ্য—জমিদারি না থাকলেও, রাজকীয়তায় কোনো অংশে কমতি নেই এই পরিবারে। সহায় সম্পত্তি যা আছে, তাতে রাজ পরিবারই বলা যেতে পারে।
প্রিয়কে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহানাজ মুচকি হেসে বললেন,
-“কত বড়ো হয় গিয়েছ, মাশাআল্লাহ! সেই দেখেছিলাম যখন স্কুলে ছিলে। এদিকে তো আসোই না। আমাদেরও বাড়ি থেকে বের হওয়া হয় না।”
প্রিয় হেসে নিয়ে বলে,
-“পড়াশোনার ব্যস্ততা বড়ো আম্মু, রাগ কোরো না।”
সেই একই নম্রতা, একই শিষ্টাচার। আপ্লুত হলেন ভীষণ,
-“হাত মুখ ধুয়ে নাও। খিদে লেগেছে না? এসো।”
এরই মধ্যে প্রহরও গাড়ি পার্ক করে চলে এলো। জেসমিন ছেলেটার দিকে এগিয়ে বলেন,
-“আব্বু, ভালো আছ?”
প্রহর জবাবে বলে,
-“জি, খালামণি। তুমি ভালো আছ?”
-“আলহামদুলিল্লাহ। আসো, ফ্রেশ হয়ে নেও।”
প্রিয় আর প্রহরকে নিয়ে গিয়ে জেসমিন দোতলার দিকের দুটো রুম দেখিয়ে দিলেন। প্রিয় রুমে ঢুকে হালকা খোলা জানালা দিয়ে দেখল, এটা পেছন মুখী একটা ঘর। ভেতর দিয়ে আসার একটা দরজা, আর বারান্দামুখো আরেকটা দরজা। বারান্দাটা একটা প্যাসেজওয়ে বলা যেতে পারে। আশেপাশের সব ঘরগুলোর সাথে লাগোয়া। বারান্দা বেয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করা যায়। দরজা-জানালা সব কাঠের। প্রিয় বারান্দার দিকের কাঠের দরজাটা খুলে ফেলল। পেছনে জঙ্গল। শীতল বাতাস প্রিয়র গা ছুঁয়ে গেল। গতরাতে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ। প্রিয়র ভালো লাগল খুব। এক নিমিষেই মনে হলো, সপ্তাহ থাকার জন্য এলেও, আরও অনেকটা বেশি সময় এই বাড়ি তাকে আটকে রাখবে। থেকে গেলে অবশ্য মন্দ হয় না। প্রিয় হেসে ওঠে। এরপর এদিক-ওদিক দেখতে লাগল।
তন্মধ্যে কিছু আঁচ করতে পেরে হুট করেই প্রিয়র কান খাঁড়া হয়ে এলো। কাঠের দরজা কেউ খট করে বন্ধ করে দিতেই সে ত্বরিতে পিছে মুড়ল। রুমের দরজা বন্ধ, আর ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটা। গম্ভীর মুখোভাব দেখে প্রিয়র ভেতরের সত্তায় ভয় জেগে উঠল।
চলবে..