শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-১৬+১৭

0
412

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৬|

তন্মধ্যে কিছু আঁচ করতে পেরে হুট করেই প্রিয়র কান খাঁড়া হয়ে এলো। কাঠের দরজা কেউ খট করে বন্ধ করে দিতেই সে ত্বরিতে পিছে মুড়ল। রুমের দরজা বন্ধ, আর ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটা। গম্ভীর মুখোভাব দেখে প্রিয়র ভেতরের সত্তায় ভয় জেগে উঠল।

ক্রাচের খট খট শব্দটা মেঝেতে প্রতিফলিত হতে হতে বিপরীত ব্যক্তিটি এগিয়ে আসতে লাগল বেশ রাজকীয় কায়দায়। প্রিয়র চোখ স্থির রইল তার প্রতিমুখে অবস্থান করতে থাকা আশি বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীটির ওপর। পরনের সাদা জমিনে কালো সূক্ষ্ম নকশা করা সুতির শাড়ি, নূন্যতম কিছু অলংকার, আর চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমাটি তাকে বাহ্যিকতায় দৃঢ় প্রত্যয়ী এক নারী সরূপে প্রকাশ করছে। ভালো লাগায় প্রিয়র ভেতরটা ছেয়ে যাচ্ছে। কী নেই এই বৃদ্ধার? বার্ধক্য তার সৌখিনতায়, বিলাসীতায় আর সর্বোপরিভাবে মানসিকতায়—নূন্যতম আঁচ ফেলতে পারেনি। যতবার প্রিয় তাকে দেখে, ততবারই মুগ্ধ হয়ে থাকে।

শেষবার সামনা-সামনি দেখেছিল, যখন মাধ্যমিকের ছুটি কাটানো শেষে এ-বাড়ি থেকে ফেরার সময় গাড়িতে উঠে শান্তিকুঞ্জের পশ্চিমের দোতলায় তাকিয়েছিল, তখন করিডোরের দোলনায় বসে পান চিবোচ্ছিলেন তিনি। ফেরার পর ফোনে কথা হতে লাগল, অসংখ্যবার, অসংখ্যবার!
সেই লাগাটাও মাত্র আড়াই বছরের ছিল। প্রিয়র দূরত্ব তো এরপর নিজের থেকেই বেড়ে গিয়েছিল, এঁদের সাথে সংযোগ থাকার চিন্তা করাটাও যেন তখনকার জন্য অবাঞ্ছিত।

প্রিয় হতাশার শ্বাস ফেলে পুনরায় তাকাল। মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,
-“আসসালামু আলাইকুম, বুবুজান।”

মনোহরা বিরবির করে সালামের জবাব নিয়ে, এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন প্রিয়র। আপাদমস্তক তীর্যক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। ডাঁটিয়াল কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
-“বয়স তখন ষোলো ছিল, এখন তেইশ। গতরটাও আগের চেয়ে ভরেছে। চুল কোমর ছুঁয়েছে। উচ্চতাও দু ইঞ্চি বেড়েছে। উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে সুন্দর লাগছে।”

প্রিয় লজ্জা পেয়ে গেল,
-“ধন্যবাদ, বুবুজান। ভালো আছেন?”

মনোহরা বোধহয় আরও খানিকটা কঠোর হয়ে উঠলেন, পালটা প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়,
-“সেসবকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আপনার বিষণ্ণতা। সুন্দর লাগলেও ভালো লাগছে না। সুন্দর আর ভালোর পার্থক্য বোঝেন না, প্রিয়শ্রী?”

প্রিয় দু’ধারে মাথা নেড়ে নেতিবাচকতা প্রকাশ করে। মনোহরা বলতে লাগলেন,
-“বাহ্যিকতায় মোড়ানো চোখ ধাঁধানো রূপটি সুন্দর, অভ্যন্তরে লুকোনো সুপ্ত রূপটি ভালো। ওরা সর্বদা সুন্দরকে বেছে নেয়। আমি আপনাকে ছয় বছর আগে শিখিয়েছিলাম ভালোটাকে বেছে নিতে। আপনি ভুলে গেলেন কী করে?”

শেষবাক্যটায় অসন্তোষ প্রকাশ পেল। প্রিয় নতমুখী হয়ে হেসে বলল,
-“আমার আপনাকে অনেক কিছু জানানোর আছে, বুবুজান। অনেক কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে।”

মনোহরা বলেন,
-“ঘটাটাই বরঞ্চ স্বাভাবিক। জীবন সর্বদা একরূপে থাকে না। কেবল তো বড়ো হচ্ছেন, আস্তে আস্তে আরও ঘটবে, আরও জানবেন। কখনও সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করবে, কখনও বা ভয়ে আঁতকে উঠবেন। এসবকে অস্বাভাবিকভাবে নেবেন না, দেখবেন আর খারাপ লাগছে না, সব ভালো লেগে যাচ্ছে।”

প্রিয় আরও কিছু বলতে গেলেই মনোহরা বলে উঠলেন,
-“সবে এসেছেন, বিকেলের সাক্ষাতে ছাদে বসে শুনব। খেয়ে আসুন।”
-“জি, আচ্ছা।”

প্রিয় খুব মান্য করে তাঁকে। মান্য না করে থাকতেই পারে না। মানুষটাকে প্রিয় অত্যাধিক পছন্দ করে। ছোটোবেলায় যতবারই এসেছে, ততবারই বুবুজানের আঁচল ধরে ঘুরেছে। বড়ো হওয়ার পর তাকে অনুকরণের চেষ্টা করে এসেছে।

___
খাবার ঘরের লম্বাটে টেবিলটির একপাশে বসে আছে প্রিয়, আর তার পাশে প্রহর। শাহানাজ আর আশরিফা মিলে তাদের পরিশনে ব্যস্ত। বাকি সবাই আত্মীয়দের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত।
প্রহরের প্লেটের ভাজাটা শেষ হতেই, আশরিফা শাহানাজকে ডেকে উঠলেন,
-“ও ভাবি! প্রহরকে একটু কুমড়ো ভাজাটা দাও না। দেখো, প্লেট খালি।”

প্রহর ত্বরিতে প্রিয়র দিকে তাকায়। প্রিয় ঠোঁট চেপে হাসে ওর অবস্থা দেখে। শাহানাজ ভাজা দিতে গেলেই প্রহর আঁতকে ওঠে,
-“দেবেন না, বড়ো মা। আর পারব না।”

শাহানাজ মিষ্টি করে হেসে বলেন,
-“এটুকু খেলে চলবে কী করে? তোমার বয়সে থাকতে তোমাদের বড়ো বাবা একাই কুড়ি জনের খাবার খেতে পারতেন।”

তাল মেলালেন আশরিফা,
-“সে-ই তো। আরেকটু ভাত দিই, বাবা?”
-“না, প্লিজ!”

অসহায় লাগছে প্রহরকে। প্রিয় এবার শব্দ করেই হেসে ওঠে। তারপর আশরিফাকে বলে,
-“ছোটমা, আর দিয়ো না। খেতে পারবে না।”
-“তা বললে হয়? তোমাদের বয়সই তো খাওয়া-দাওয়ার। এই বয়সেই তো খাবে!”
-“আচ্ছা, খাব। কিন্তু একেবারে এত খেলে কী করে হবে বলো তো? রিধি আপুর সাথে বাগান ঘুরতে ঘুরতে ফলও খাওয়া লাগবে। তাছাড়া বুবুজানের সাথেও আমার বিকেলে একটা স্পেশ্যাল আড্ডা আছে। সেখানেও ভোজ হবে। এত পারব না এখন।”

আশরিফা সব শুনে বললেন,
-“বেশি না, আরেকটু খাও।”

প্রহর এবার মানা করতে পারছে না, খেতেও পারছে না। চোখের ইশারায় প্রিয়কে বোঝাল, বাঁচিয়ে দিতে। প্রিয় যেন পাত্তাই দিলো না তাকে। তার চেহারায় এতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে হাসল। সেই সময় ঘরের দরজার ওপাশে কিছু একটা লক্ষ করল। আরেকটু খেয়াল করার পর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মেয়ের উপস্থিতি আন্দাজ করে ফেলল। হাসি আরও চওড়া হলো। সে কোনো রকমে খাওয়া শেষ দিয়ে উঠে যেতে পারলেও, প্রহর ছাড় পেল না।

খাবার ঘরের দুটো দরজা। একটা রান্নাঘর বরাবর, অন্যটা বের হওয়ার। প্রিয় রান্না ঘর দিয়ে বেরিয়ে ফের মূল দ্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। যা ভেবেছিল তাই। তিনটে কিশোরী খুব মনোযোগ দিয়ে দরজার ওপাশের পুরুষটির নাজেহাল হয়ে খাওয়া লক্ষ করে যাচ্ছে। কেশে উঠল প্রিয়।
সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল মেয়ে তিনটি। একজন তো বুকে ফু দিলো। বাকি দু’জন ভড়কে যাওয়া নজরে প্রিয়র দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয় বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মেয়ে তিনটিকে দেখে মনে হচ্ছে, তাদের বয়স ষোলোর ভেতর হবে। তবে চিনতে পারছে না সে। তাই জিজ্ঞেস করে উঠল,
-“পরিচয় দাও ফটাফট। নাম, বয়স, শ্রেণী।”

তাদের বাড়িতে এসে, তাদের কাছেই পরিচয় চাইছে! মেয়েগুলো প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়ে বলে উঠল,
-“আমি রূপা। বয়স চোদ্দ, নবম শ্রেণী।”

দ্বিতীয়জন বলল,
-“আমি নীহিন। বয়স ষোলো, মাধ্যমিক দিয়েছি।”

তৃতীয়জন বলল,
-“আমি আরহা। বয়স ষোলো, মাধ্যমিক দিয়েছি।”

প্রিয় জহুরি চোখে আরেকবার পরখ করে বলল,
-“আরহা আর রূপা ছোটমার মেয়ে, আর নীহিন বড়োমার। তাই-না?”

ইতিবাচক জবাব এলো। তারপরই জিজ্ঞেস করল প্রিয়,
-“এখানে কী করছিলে?”
-“কিছু না।”
-“কেন কিছু না?”

থতমত খেয়ে যায় ওরা। নীহিন বলে,
-“আসলে দেখছিলাম তোমাদের কিছু লাগে কি না।”

প্রিয় হুট করেই হেসে দেয়,
-“ভয় পেয়ো না। আর ওদিকে নজর দিয়ে লাভ নেই, মিস্টার বুকড। বুঝেছ?”

বুঝতে সময় লাগেনি কারোরই। ওরা প্রস্থান ঘটানোর উদ্দেশ্যে চলে যেতে গেলেই, প্রিয় মাঝে থেকে নীহিনকে আটকে নেয়। ওর হাত ধরে সিঁড়িঘরের দিকে নিয়ে আসে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে প্রিয় বলতে লাগে,
-“চিনেছ আমায়?”

নীহিন অতিভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। সে চিনেছে। ছোটোবেলার আবছা স্মৃতির মধ্যে প্রিয়কে তার ভালোই মনে আছে। তাছাড়া বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, পুরোপুরি অচেনা কেউ-ই নয়। নীহিন প্রায়শই রিধিমাকে দেখে প্রিয়র সাথে কথা বলতে, প্রিয়কে ট্যাগ করে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিতে। সে থেকে মাঝে মধ্যেই প্রিয়র সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে ঢু মারত। কিন্তু লক করা বিধায় ভেতরে দেখা যেত না।

প্রিয় ওকে দেখে বলে,
-“তোমাকেও আমার খুব মনে আছে। তুমি কী ভীষণ মিশুক আর লাজুক ছিলে ছোটোবেলায়! আমার কী যে ভালো লাগত। তখন বয়স কত হবে তোমার? উম.. নয় বা দশ! তোমাকে নিয়ে এলাকা চষে বেড়িয়েছি। ভালোই মনে আছে। কিন্তু ফেইস ভুলে গেছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আছ? ফেসবুকে আছ?”

নীহিন জানায়,
-“আছি।”
-“কী নামে?”
-“নীহিন শিকদার। প্রোফাইলে বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছের সাথে আমার আর দাদাভাইয়ের ছবি।”
-“আচ্ছা। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দেবো রাতে, আমি প্রিয়শ্রী মর্তুজা নামে আছি।”

নীহিন মাথা নাড়ায়। প্রিয় বলে,
-“তুমি বরাবরই কম কথা বলো নাকি? আগে এত চুপচাপ ছিলে না।”
-“মা বলেছে, বড়ো হচ্ছি। এখন কথা মেপে মেপে বলা উচিত।”
-“তোমার মা ঠিক বলেছে..”

প্রিয় থেমে আবার বলে,
-“কিন্তু অতটাও ঠিক না। মানুষভেদে কম-বেশি কথা বলবে। আমার সাথে এত কার্টেসির প্রয়োজন নেই। আমরা আমরাই। টেক ইট ইজি।”
-“ঠিক আছে, প্রিয়দি।”
-“বাহ! মনে আছে, আগেও আমাকে প্রিয়দি ডাকতে?”

নীহিন হাসে,
-“মনে আছে। তোমাকেও খুব মনে আছে। সেই ৬-৭ বছর আগে এসেছিলে। এর মধ্যে তোমার সাথে আর দেখা হয়নি। এটা কি ঠিক করেছ?”
-“মোটেও ঠিক করিনি। কিন্তু আমার তো নিজের মামাবাড়ি, বাবার গ্রামের বাড়িই যাওয়া হয় না। এখানে এসেছি, এই কত!”
-“কেন যাও না?”
-“ভালো লাগে না।”
-“প্রিয়দি, তুমি না আগে মানুষদের সাথে মিশতে পছন্দ করতে?”
-“মানুষ খুব সুন্দরভাবে পালটায়, নীহিন।”

নীহিন পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। ওরা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে এখন। প্রিয় গিয়ে মাঝখানের দোলনাটিতে বসে পড়ে। তারপর নীহিনকে জানায়,
-“তোমাদের বাড়িটা আমার খুব পছন্দের।”
-“আমারও।”
-“আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয়, থেকে যাই।”
-“থেকে যাও।”

প্রিয় ঠোঁট টিপে হাসে,
-“যাহ! তা হয় নাকি?”
-“চেষ্টা করলেই হয়।”
-“তা কীভাবে?”
-“বলব না, প্রিয়দি। এতদিন আমাকে ভুলে থাকার জন্য এটা তোমার পানিশমেন্ট।”
-“বাপ্রেহ! বাচ্চাটার অভিমান আছে দেখছি!”
-“তো তুমি কী ভেবেছ? হুহ?”

মুখ ঘুরিয়ে ফেলে নীহিন। প্রিয় হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
-“তোমাদের বাড়িতে অনেক মানুষ। আমাকে একটু বলবে কে কে আছে, আমার ঠিক খেয়াল নেই।”

নীহিন বলতে লাগে,
-“দিদার তিন ছেলে দুই মেয়ে—আমার বাবা-মা, মেজমা-মেজআব্বু, ছোটমা-কাকাই আর মামনি, ফুপিমণি। মামনি এসেছে, ফুপিমণি আমেরিকা থাকে তাই আসতে পারেনি। ছোটদাদুর চারজন মেয়ে ছিল, তাদের সংসার একেকজনের একেক এলাকায়। রিধিমাদির বিয়ে উপলক্ষে তিনজন এসেছে। আর চ্যালাপ্যালা আছে অনেকগুলো। আমরা তিন ভাই-বোন। দাদাভাই, ছোটদাভাই, আমি; দাদাভাই কিন্তু আমাদের কাজিন গোষ্ঠীর সবার বড়ো৷ বুঝেছ? রিধিমাদিরা তিন বোন, এক ভাই; রিধিমাদি, নিধিদি, আরুশিদি আর কিউট বাচ্চা শুভ্র। আর কাকাইয়ের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। সৌরভ ভাইয়া, আসিফ ভাইয়া, আরহা আর রূপা। সৌরভ ভাইয়া আর আসিফ ভাইয়া পিঠাপিঠি, দাদাভাইয়ের চেয়ে দুই আর চার বছরের ছোট। আমার দাদাভাই সন্ন্যাসী লাইফ লিড করছে, আর তারা বিয়ে করে নিয়েছে। বড়োবৌ জয়া উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। আর ছোটবৌ শুভ্রা আমার সমান। বড়োবৌ কিন্তু প্রেগন্যান্ট, চার মাসের। এই তো, আর ৫-৬ মাসের মধ্যে নেক্সট জেনারেশনও ডাউনলোড হয়ে যাবে। তারপর..”

প্রিয়র মাথা ঘোরাতে লাগল। সে নীহিনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই থামো থামো! কী বলে গেলে এসব? কিছুই মাথায় ঢুকল না। পরিবারে কে কে থাকে জিজ্ঞেস করেছি, তুমি পুরো কুন্ডলী বলে গেলে বোধহয়। থাক, আর শোনা লাগবে না। যা জানি, তা-ও মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।”

প্রিয়র কথা শুনে নীহিন হেসে উঠল। হাসি থামে না তার। প্রিয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ততক্ষণে ছাদে আগমন হয় রিধিমা আর নিধির। প্রিয়কে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কত বছর পর দেখলাম! সাপের গর্তে লুকিয়ে ছিলি কার ভয়ে? ঢাকা বেড়াতে গিয়েও তোর খোঁজ মিলত না!”

প্রিয় আমোদিত হয়ে বলে ওঠে,
-“মিস করেছি খুব, আপু।”
-“আমরাও।”

কিছুক্ষণ গল্প-স্বল্প করল ওরা। এরই মধ্যে হঠাৎ অন্দরে হইচই শুরু হয়ে গেল। নীহিন রেলিংয়ে ঝুঁকে মূল ফটকের সামনে দাঁড় করানো কালো রঙের গাড়িটা দেখতে পেয়েই মুখে হাত চেপে চিল্লিয়ে উঠল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে প্রিয়র মস্তিষ্ক তা ধরতে পারল না। তন্মধ্যে নীহিনও দৌড় দিয়েছে বাড়ির ভেতরে। রিধিমা আর নিধিও দাঁড়িয়ে নেই। রিধিমা প্রিয়র হাত ধরে এগোতে লাগল, নীহিনের মতো দৌড়ে নয় অবশ্য, তবে ওরাও গতিশীল পায়ে এগোচ্ছে।

প্রিয় বিস্মিত হয়ে পা ফেলছে। প্রতিটি কদমের সাথে তার মনের ভেতর কিছু একটা ঘটছে। কিছু একটা অদ্ভুত! কিছু একটা অভূতপূর্ব! ব্যাপারটা ভালো লাগার না-কি খারাপ লাগার, তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক হয়ে উঠল প্রিয়র জন্য। ভেতরটা ছটফট করতে লাগল অজানা শঙ্কায়।

চলবে…

শব্দসংখ্যা: ১৮২১

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৭|
[কপি নিষিদ্ধ]

বসার ঘরের নরম গদিতে একজন ছেলে বসে আছে, আর তাকে ঘিরে সবার যত উল্লাস! পড়াশোনার সুবাদে ছোটো থেকেই ঢাকায় থাকা হয়েছে তার। এরপর কী মনে করে যেন সেখানেই বশত গেড়েছে। বাড়িমুখো হয় অবশ্য, ওই মাসে কিছুদিনের নামে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে কেউ এখন আর তাকে কিছু বলে না। কিছু বললে, মাস চার-পাঁচের নামে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা তার আছেই।

প্রিয়র বুদ্ধি হওয়ার পর সে ছেলেটাকে দেখেনি, অথবা দেখেছে। ছোটবেলার সব স্মৃতি তো আর মাথায় থাকে না। প্রিয়র মনে একদমই নেই। তবে দেখা হয়েছিল, সেই নয় সনে। প্রিয় তখন হাঁটুর ওপর অবধি ফ্রক পরে ঘুরতে থাকা দশম বর্ষের কন্যা, ছেলেটা তখন ম্যাট্রিকের প্রিপারেশন নিয়ে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দেওয়া অবস্থায় থাকা তেজদীপ্ত কিশোর।

মনোহরা ভীড় অপছন্দ করলেও এগিয়ে গেলেন সেদিকে। সবাই চকিতে শান্ত হয়ে গেল। এতক্ষণের হইহট্টগোল এক নিমিষেই থমকে গেল। মনোহরা নরম গদিতে ছেলেটার পাশেই বসলেন, কণ্ঠে অমায়িক কোমলতার ছোঁয়া তার,
-“ভালো আছেন, শরৎ?”

শরৎ ভদ্রতাসূচক হেসে বলল,
-“জি, বুবুজান। আপনার শরীর ভালো?”
-“ভালো। হাত-মুখ ধুয়ে নিন। সবার সাথে পরেও কথা বলা যাবে।”
-“আচ্ছা।”

শরৎ উঠে পড়ল সেখান থেকে। সিঁড়িঘরের সামনে প্রিয় দাঁড়িয়ে আছে, একা। শরৎ শার্টটের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিঁড়িঘরের দিকে এগোচ্ছে। প্রিয়কে ক্রস করে এক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার দু-কদম পিছিয়ে এলো। প্রিয় তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। শরৎ তাকে বেশ কিছু সেকেন্ড লক্ষ করল। পরক্ষণেই শুধাল,
-“প্রিয়?”

যেন সে নিশ্চিত নয়, এই মেয়েটি প্রিয় কি না। প্রিয় বিস্মিত ভঙ্গিমায় মাথা ওপর-নিচ নাড়ে। চিনল কী করে? জিজ্ঞেস করতে যাবে তা, ওমনিই শরৎ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। যাওয়ার পূর্বে তার ঠোঁটের কোণঘেঁষা হাসিটা প্রিয়র নজরটা কীভাবে কীভাবে যেন এড়িয়ে গেল।

____
বিকেল হতে হতেই প্রিয় মনোহরার রুমে চলে এলো। দরজায় নক করে বলল,
-“বুবুজান, আসব?”

ক্ষণকাল ব্যয়ের পর ওপাশ থেকে ক্ষীণ আওয়াজ আসে,
-“আসুন।”

প্রিয় ভিড়িয়ে দেওয়া দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেই, দেখতে পেল খাটে বুবুজান আর তার সামনে চেয়ার টেনে শরৎ বসে আছে। মনোহরা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ওকে ভেতরে আসতে ইশারা করলেন। প্রিয় বলে উঠল,
-“আপনারা বোধহয় কথা বলছিলেন, আমি পরে আসি।”

বিরোধ করল একত্রে মনোহরা এবং শরৎ দুজনই,
-“ভেতরে আসুন।”

থতমত খেয়ে প্রিয় ভেতরের দিকে পা বাড়াল। এরপর কী করবে বুঝতে পারছে না। মনোহরা প্রিয় নাতির সাথে খানিকক্ষণ আগের কথোপকথন চলমান করলেন,
-“ক’দিনের ছুটিতে এসেছেন?”
-“দশদিনের ছুটি নিয়েছি।”
-“বিয়ের পরই ফিরছেন তবে?”
-“জি।”
-“আপনার পুরো পরিবারই এখানে আছে, থেকে গেলে হয় না?”
-“মন টানে না।”
-“বিয়ে-শাদির বন্দবস্ত করব কি?”

শরৎ মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। মনোহরাও হাসলেন,
-“রাজি?”
-“এখনও না।”
-“হ্যাঁ-সূচক জবাবের আশাটা সত্যিই আমার ছিল না।”

শরৎ কিছু বলে না। মনোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধান,
-“ছোটটাকেও কি সাথে নিয়ে ওড়াল দেওয়ার পরিকল্পনা আছে?”
-“না, বুবুজান। ও এখানেই আনন্দ পায়।”
-“আর আপনি?”
-“আপাতত নিজের কাজে।”
-“ঠিক আছে। যতদিন আছেন ঘুরে-ফিরে আনন্দ করুন। বাড়ি ঘেঁষেই থাকবেন। আপনার মা খুশি হবে।”
-“আচ্ছা, বুবুজান।”
-“এরপরের কোনো পরিকল্পনা আছে?”

শরৎ চোখে হাসে,
-“পরিকল্পনাহীন লাইফ লিড করতে শিখিয়েছেন আপনি আমায়। ভাগ্যে যা আছে, তা হবেই। আপনি বলেছিলেন সৎ থাকতে, আদর্শবান হতে। আল্লাহ ভরসা, তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

সন্তুষ্ট হন মনোহরা। বলতে লাগেন,
-“কাল বিকেল করে উত্তরপাড়ায় যাবেন। পানি উঠেছে ওখানে, নৌকা নিয়ে ঘুরতে ভালো লাগবে। ঠিক আপনার পছন্দমতো পরিবেশ যেন।”
-“ঠিক আছে, বুবুজান।”
-“কাউকে নিয়ে যাবেন?”

প্রিয় দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে বুঝতে পারছে না। শুধু শুধু এই অসময়ে এখানে আসা হলো! না এলে কি মরে যেত? ধ্যাত!

শরৎ একবার ওর দিকে আঁড়চোখে তাকাল। ওর হাবভাব লক্ষ করে মনোহরাকে বলল,
-“দেখি।”
-“আচ্ছা।”
-“বুবুজান, আমি আসি তবে। থার্ড পার্সনের সামনে তো খোলাখুলি সব বলা যায় না। পরে বলব।”

মনোহরা মুচকি হেসে বললেন,
-“আসুন।”

শরৎ যেতে যেতেও বাঁকা চোখে প্রিয়কে দেখে গেল। প্রিয়র মস্তিষ্ক এখনও আটকে আছে শরতের ওই “থার্ড পার্সন” সম্বোধনে। বাই এনি চান্স, সে কি ওকে উদ্দেশ্য করে বলল কথাটি? বাই এনি চান্স না, আসলেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। ব্যাপারটি ধরতেই প্রিয়র ছোট্ট সাইজের গোলাকৃত মুখটি হা হয়ে এলো।

মনোহরা ওকে ডাকল তখন,
-“বলুন, প্রিয়শ্রী।”

প্রিয় এগিয়ে গিয়ে মনোহরার পাশটায় জায়গা করে নিল। পা তুলে বসে বলল,
-“বুবুজান, আসুন একটু সিরিয়াস আলাপ করি।”
-“আসুন, করি।”
-“চরম সিরিয়াস। সুখ-দুঃখের গল্প, বুঝলেন?”
-“বুঝলাম।”
-“আপনি নির্বিকার থাকতে পারবেন না। বিভিন্ন এক্সপ্রেশন দেবেন।”
-“যেমন?”
-“এই ধরুন, আমি হাসির কিছু বললে আপনি হাসবেন। বিরক্তিকর কিছু বললে ভ্রু কুঁচকাবেন। কষ্টের কিছু বললে ব্যথিত হবেন। এসব আর কি।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

___
সন্ধ্যার দিকে প্রিয় নিজের রুমের সামনের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে বাড়ির পেছনের ফল বাগানের দিকটা দেখা যাচ্ছে। প্রিয়র চোখ যতদূর যাচ্ছে, তাতে সে বুঝতে পারছে বাগানের সীমানাটার পর সব ঘন গাছগাছালি দিয়ে বেশ অনেকটা রাস্তা পরিপূর্ণ। বাচ্চাকালে এত কিছু খেয়াল করেনি। এখন সবকিছুতেই নজর যাচ্ছে।
প্রিয়র হুট করেই একবার ইচ্ছে করল, ভেতরে যেতে। কিন্তু ভয় লাগছে। আবার ভয়কেও ছাপিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যজাতির আদিম স্বভাববিশিষ্ট অদম্য কৌতুহলটি।

হুট করেই সেখানে নীহিনের আওয়াজ আস্তে আস্তে করে এগিয়ে এলো,
-“প্রিয়দি, তুমি এখানে? আমি তোমাকে রুমে না পেয়ে ওদিক দিয়ে খুঁজে হয়রান!”

প্রিয় পিছে ঘুরে ওর দিকে তাকায়। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
-“খুঁজছিলে কেন?”

নীহিন জানায়,
-“সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দেবো। চলো।”

প্রিয় কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর শুধায়,
-“কতক্ষণের আড্ডা ডিউরেশন?”
-“সারারাত, সারারাত।”

নীহিন মুচকি হেসে আবারও বলল,
-“বহুদিন পর সবাই একসাথে হয়েছি, আজ কাউকে ছাড়ব না। আসো।”
-“কতজন আছে?”
-“ছোটদাভাই, সৌরভ ভাইয়া, আসিফ ভাইয়া, রিধিমাদি, নিধিদি, আরুশিদি, আরহা, রূপা আর ফুপাতো বোনেরা আর রিধিমাদির কিছু ফ্রেন্ডস..”
-“তোমার দাদাভাই?”
-“ওর কিছু কল এটেন্ড করার ছিল, শেষ দিয়ে আসবে বোধহয়। আবার রাতের খাওয়া শেষেও আসতে পারে। ওর ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না।”

প্রিয় হাসে। নীহিন বলে,
-“চলো যাই।”

প্রিয়র উপায়ন্তর না পেয়ে জানিয়েই দেয়,
-“যেতে ইচ্ছে করছে না..”

নীহিন চার আলিফ সমান টেনে জিজ্ঞেস করে,
-“কেনওওও?”
-“এমনি।”
-“প্রিয়দি, কোনো সমস্যা হচ্ছে? বলো আমায়।”

প্রিয় নীহিনের গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-“সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু ওখানে অনেক মানুষ। এত মানুষের মাঝে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“একা থাকবে?”
-“হু।”
-“ভালো লাগবে একা থাকতে?”
-“হু।”
-“আমি থাকি সাথে?”

কী আদুরে আবদার! প্রিয়র হাসি পেয়ে গেল। মুচকি হেসে বলল,
-“তুমি ওদের সাথে এনজয় করো। আমি কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাব।”
-“আচ্ছা, শোনো। আমি তোমাকে মেসেঞ্জারে নক দিয়েছি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে একটা ম্যাসেজ বা কল দিয়ে দেবে। ঠিক আছে, প্রিয়দি?”
-“ঠিক আছে।”
-“প্রিয়দি, যাই তবে।”

প্রিয় ঢের বুঝতে পারছে, মেয়েটা থেকে যেতে চাইছে। ভালো লাগল তার খুব। কিছুক্ষণ রেখে দেওয়ার ইচ্ছেও জাগল। এখন সে নিজের ইচ্ছের কথা শোনে। তাই তো বলে উঠল,
-“না, পরে যেয়ো।”

ভীষণ চওড়া একটা হাসি নীহিনের ছোট্ট মুখটায় ঢেউ খেলে গেল। প্রিয় তা দেখে হাসল। বলল,
-“রাতে ঘুরতে বেরোব।”
-“কই যাবে, প্রিয়দি?”
-“আমি একা নই, তুমিও যাবে।”
-“আমি? রাতে?”

নীহিনের ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর। প্রিয় ভ্রু-কুঁচকে শুধাল,
-“সমস্যা?”
-“অন্ধকারে ভয় লাগে।”
-“কীসের ভয়?”
-“ভূতের।”

প্রিয় হো হো করে হেসে উঠল,
-“তার মানে আমার সাথে যাবে না?”

নীহিনের রাত করে ওয়াশরুমে যেতেও ভয় লাগে, সেখানে বের হওয়াটা! কিন্তু বেরোলে অনেকটা সময় সে প্রিয়র সান্নিধ্যে থাকতে পারবে। ছোটবেলা থেকেই ওর প্রিয়কে ভালো লাগে, প্রিয়র সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। এখনও লাগছে। প্রিয়র সাথে সময় কাটানোর একটা সুযোগও সে হাতছাড়া করতে চায় না। কী মিষ্টি একটা মেয়ে তার প্রিয়দি! কী সুন্দর করে কথা বলে! নীহিনের কেবল শুনেই যেতে ইচ্ছে করে। তাই তো সব ভয়কে সাইডে ফেলে বলে উঠল,
-“যাব। কিন্তু কোথায়?”
-“পরে বলব।”
-“আচ্ছা, প্রিয়দি।”
-“তোমার সম্পর্কে কিছু বলো। বয়ফ্রেন্ড আছে?”

নীহিনের মুখটায় ভয় ছেয়ে গেল,
-“না, প্রিয়দি। এ-বাড়িতে মেয়েদের ছেলেমানুষের সাথে মেশার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে।”
-“স্কুলে বন্ধু ছিল না?”
-“ছেলে বন্ধু ছিল না। শিকদার বাড়ির মেয়ে শুনলেই ছেলেরা দশ হাত দূরে দৌড় দেয়।”
-“রাস্তা-ঘাটে কেউ টিজ করেনি কখনও?”

প্রিয় বিস্মিত কণ্ঠস্বর। নীহিন জানায়,
-“রিধিমাদিকে স্কুলে পড়াকালীন পূবপাড়ার এক ছেলে কেবল সিটি বাজিয়েছিল। দাদাভাই সেই ছেলেটার এমন দশা করেছিল, শুধু আমাদের গ্রাম না, আশে-পাশের দশ গ্রাম অবধি এখন আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভয় পায়।”

প্রিয়র মনে জানার অসীম ইচ্ছে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল ‘কী করেছিল’। কিন্তু তা করল না। অনেকটা সময় হলো মেয়েটা ওর সাথে আছে। এখন ওর যাওয়া উচিত। তাই বলল,
-“এখন তুমি যাও।”
-“আরেকটু থাকি?”

বাচ্চা মেয়েটির মলিন আওয়াজ শুনে প্রিয় মুচকি হেসে বলল,
-“রাতে জম্পেশ আড্ডা হবে, ওকে?”
-“ঠিক আছে, প্রিয়দি।”

নীহিন চলে গেল। প্রিয় সেখানেই অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক।ধীর পায়ে হাঁটছে, মাঝে সাঝে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হাতের ফোনটা কখনও বা ঘাটছে। ফেসবুকে ঢোকা হয়নি আজ। পরে ঢুকবে। সে সোশ্যাল মিডিয়ায় এডিক্টেড, একবার ঢুকলে আর বেরোতে পারবে না। এত সুন্দর সাঁঝরাতটি সে এভাবে পার করতে চাইছে না।

গুনগুন করতে করতে প্রিয় রেলিংয়ে হাত দু-হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল। গান গাইতে লাগল,
-“অতীতের ছবি আঁকা হয়ে গেলে
চারিদিকে এই চোখ দুটি মেলে
পলাতক আমি কোথা যেন যাই
আঁধারের রিদন শুনে…”

আকাশে শুক্লা চতুর্থীর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। প্রিয়র চোখ বন্ধ, গোলমুখের ছোট্ট ঠোঁটদুটো সেই বাঁকা চাঁদটির মতো করে হেসে যাচ্ছে। বাতাসের সাথে ভেজা মাটির গন্ধটা তার মন মাতিয়ে তুলছে। এই হাসি থামবার নয়। অথচ থেমে গেল চকিতেই। কামিনী ফুলের ঘ্রাণে প্রিয়র কপাল কুঁচকে এলো, আশে-পাশে কোনো কামিনীফুলের গাছ নেই। কী আশ্চর্যকর ঘটনা! স্মেলটা সে অনেকক্ষণ ধরেই পাচ্ছে, তবে খেয়াল করল এই মাত্র।

তার পরই একটা পুরুষালি দাম্ভিক কণ্ঠ সে শুনতে পেল,
-“গানটা সুন্দর, তবে আওয়াজটা নয়। কাইন্ডলি এর মতো আর কোনো গানকে খেয়ে দেবেন না।”

চলবে..