#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২২|
প্রিয় মেকি রাগ দেখিয়ে তাকে বলল,
-“অপেক্ষা করাতে ভালো লাগে খুব, না? আসতে দেরি করলে কেন এত? কথা বলব না তোমার সাথে।”
সাদা শার্ট পরিহিত পুরুষটির প্রিয়র চোখে চোখ রেখে হাসে। প্রিয় কড়া চোখে তাকায়,
-“এই হাসি দিয়েই তো ফাঁসিয়েছ! একদম হাসবে না। রেগে আছি আমি, আমার রাগ ভাঙাও।”
ছেলেটা তাতেও হাসে। প্রিয় অত্যন্ত দুঃখিত গলায় বলে,
-“একটু রেগেও থাকতে দেবে না? এভাবেই হেসে হেসে মন কেড়ে নিয়ে কী মজা পাও, বলতে পারো?”
-“ভালো আছ, কামিনী ফুল?”
প্রিয়র কথার প্রেক্ষিতে খুবই কোমল আওয়াজে প্রশ্নটা এলো। প্রিয় চোখ বুজে নেয়, মুচকি হেসে বলে,
-“তুমি থাকতে খারাপ থাকি কী করে?”
-“আমার কামিনী ফুলের আজ এই অবস্থা হলো কেন?”
-“কোন অবস্থা?”
-“প্যানিক অ্যাটাক…”
প্রিয় হাসে,
-“তুমি আসোনি বিগত দুইদিন। তুমি না থাকলে ভালো থাকি? এতক্ষণ ভালো ছিলাম না তাই। এই যে এলে, এখন ভালো আছি।”
প্রিয়র আওয়াজ জড়িয়ে যায়। প্রিয় খেয়াল করে, ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাতে প্রিয় আরও হাসে। সে অবাক হয়ে যায় প্রিয়র হাসি দেখে,
-“হাসছ কেন?”
-“কারণ আমাকে হাসলে সুন্দর লাগে।”
-“তোমাকে সবভাবেই সুন্দর লাগে, ফুল। তোমার চোখ সুন্দর, তোমার ঠোঁট সুন্দর, তোমার নাক সুন্দর, গালের টোলটা, তোমার চিবুকের ভাঁজটা.. সব সুন্দর..”
সে থামে, প্রিয় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-“আর?”
-“তোমার বিউটিবোন! আমার নেশা। তোমার গায়ের স্মেল, কড়া ডোজের ড্রাগকে হারিয়ে দেয়। তোমার কাজল চোখের দৃষ্টি..”
-“হুঁ?”
-“আমার জনম সার্থক।”
প্রিয় হো হো করে হেসে ওঠে,
-“মিথ্যুক!”
-“আমি গোটাটাই মিথ্যা, তুমি জানোই..”
প্রিয়র চোখ ছলছল করে ওঠে। বন্ধ করে ফেলে সেই চোখ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কামিনীর সুঘ্রাণ, আওয়াজে ঝিঁঝিঁর ডাক আর অক্ষিপটে পুরোনো স্মৃতি। সেই অতীতের স্মৃতিতে শ্রেয়ান তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, বলছে,
-“প্রিয়শ্রী, ভালোবাসি।” প্রিয় ত্বরিতে চোখ খুলে ফেলে।
আমি হাঁটতে গিয়ে পাশে তাকাই
তোমায় আবছায়া দেখতে পাই
একটুখানি ছুঁতে চাই
তৃষ্ণাদগ্ধ হাত বাড়াই
আশ্চর্য! কোথাও তুমি নাই…
ক্লান্ত আমি, ক্লান্তি নিয়ে
সামনে ঘুরে, সামনে এগিয়ে
ভালোবাসা খুঁজে যাই।
আরও একবার..
____
প্রিয় রুমে ফিরেছে ভোরের পর পর। বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ঘুমোল। ঘুমোনোর আগে নীহিনকে একটা ম্যাসেজ করে দিলো, কেউ যাতে তাকে সকালে খেতে না ডাকে। সে উঠে খেয়ে নেবে। আবার প্রহরকেও ম্যাসেজ দিয়ে রাখল, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ শপ থেকে আনিয়ে নিতে।
প্রিয়র ঘুম ভাঙল দশটায়। উঠে শাওয়ার নিয়ে একটা সাদা রঙের গোলজামার সাথে সাদা চুড়িদার পরল। ভেজা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। তারপর বিছানায় বসে ফেসবুকিং করতে লাগল। এর মধ্যে একটা অচেনা অ্যাকাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে।
প্রিয় সেই অ্যাকাউন্ট ওপেন করলে মিউচুয়ালে সবার আগে নীহিনকে দেখতে পেল। ইংরেজি অক্ষরে অ্যাকাউন্টটির নাম, “নীরজ শিকদার”
পাশে নিকনেমে ব্র্যাকেটে শরৎ লেখা। প্রোফাইলের ছবিটি পাহাড়ি এক জায়গার। কোনো এক পাথরের ওপর শরৎ গিটার কোলে তুলে বসে আছে। পরনে সাদা হুডি। প্রিয় স্ক্রল করল তার টাইমলাইন। তারপর রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করে নিল।
ঠিক তখনই ম্যাসেজ রিকুয়েস্টটি প্রিয়র নজরে এলো। শরতের ম্যাসেজ। সে লিখেছে,
-“ঘুমাচ্ছ এখনও?”
-“শরীর খারাপ?”
-“মা’কে কিংবা নীহিনকে পাঠাব?”
-“উঠছ না কেন?”
-“নীহিনকে পাঠাচ্ছি।”
-“পাঠাব?”
-“আমি আসব?”
লাস্ট ম্যাসেজটা ৫ মিনিট আগের। আর প্রতিটি ম্যাসেজের অন্তর ৫ মিনিট করে। প্রিয়র ধারণা ঠিক থাকলে, এখনই আরেকটা ম্যাসেজ আসবে। আর ঠিক তখনই ম্যাসেজটা এলো,
-“দরজা খুলো।”
প্রিয় বিছানা থেকে গাঢ় নীল রঙের ওড়নাটা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে দরজা খুলল। সামনে শরৎ দাঁড়িয়ে আছে। কপালের দুশ্চিন্তার রেখাটা আস্তে-ধীরে বিলীন হয়ে গেল। সেইখানে এসে যোগ হলো আশ্চর্যের চিহ্ন। প্রিয় কেশে উঠে সরে দাঁড়াল।
শরৎ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-“এভাবে সেজে-গুজে কার চল্লিশায় যাচ্ছেন?”
প্রিয় চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-“চল্লিশায় যাব কেন?”
-“কালকে না মরা-কান্না কাঁদছিলেন?”
প্রিয়র মনে পড়ছে না, কান্না করছিল কখন? কালকে? হ্যাঁ কালকেই তো কান্না করছিল। কিন্তু শরৎ কখন দেখল? লুকিয়ে লুকিয়ে নজর-টজর রাখছে নাকি, আশ্চর্য! প্রিয়র চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। শরৎ ততক্ষণে রুমের ভেতর চলে এসেছে। গোছানো রুমটায় নজর বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“খাবার খেয়েছেন? না-কি কথা খেয়েই পেট ভরিয়েছেন?”
প্রিয় কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
-“আপনার মাথা খাব বলে উপোসে আছি। ভেজে দেবেন?”
-“সাংঘাতিক চাওয়া আপনার! দুনিয়াতে এত কিছু আছে, সব ফেলে চাইলেন আমার মাথা।”
-“আমার রুমে আসছেন কেন?”
হো হো করে শরৎ হেসে ওঠে,
-“ফর ইওয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, বাড়িটার দোতলার এই অংশটা মালিকানা সূত্রে আমি পেয়েছি আর আপনি ‘আমার নামে লিখে রাখা’ জায়গাটাতে স্ট্যান্ড করছেন। আমি চাইলেই আপনার থেকে স্ট্যান্ডিং রেট পার আওয়ার নিতে পারি।”
প্রিয় যেন জোক শুনল, এভাবে হেসে বলল,
-“ওহ রিয়েলি?”
-“ইয়েপ..”
-“শিকদার বংশের এই জেনারেশনের যে ব্যাংকে ব্যালেন্সের সাথে সাথে ব্যবহারে ভদ্রতা ও মস্তিষ্কে বুদ্ধি-সুদ্ধিরও চরম অভাব পড়েছে, তা কি বুবুজান জানেন? মেহমানদের সাথে এটা কোন ধরনের ব্যবহার?”
প্রিয় শেষবাক্যটা বিরক্তির সাথে বলল। শরৎ এগিয়ে গিয়ে বলে,
-“মেহমান যদি হয় আপনার মতো, আমি হয়ে উঠব পৃথিবীর চরম অভদ্র ছেলে। ইউ ক্যান কল মি ‘বেয়াদব’, আমি মাইন্ড করব না প্রমিস।”
প্রিয় পিছিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
-“হুশ হুশ! দূরে গিয়ে মরেন।”
-“আপনি আসেন, একা মরতে মজা লাগবে না।”
-“আপনি মরতে যান, আমি পেছন থেকে ধাক্কা দেবো। চলেন।”
শরৎ গোপনে হাসল। প্রকাশ্যে তাকে বলল,
-“কারো বাড়িতে এসে অবশ্যই এরকম হিল্লিদিল্লি করে ঘোরা উচিত নয়। সামান্য ভদ্রতা রাখুন।”
প্রিয় মুখ ভেঙচাল,
-“বয়েই গেছে।”
শরৎ চলে যেতে নিয়েও একবার ফিরে এলো। প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“আবার কী?”
-“সাদাতে আপনাকে বিশ্রী লাগে।”
প্রিয় রেগে উঠল,
-“আর আপনাকে খুব সুশ্রী লাগে?”
-“আপনি অস্বীকার করবেন?”
-“একশবার করব। যান তো এখান থেকে! সকাল সকাল মুখদর্শন দিয়ে আমার দিনটাকে করলা বানিয়ে দিলেন। কালুবিল্লু কোথাকার!”
শরৎ সব ভুলে লাস্ট বিশেষ্যতে গিয়ে আটকাল,
-“হোয়াট ইজ কালুবিল্লু?”
-“আপনি। আপনি একটা কালুবিল্লু। সাদা পরেন দেখে কিউট করে কালুবিল্লু বললাম। নইলে কালাবিলাই বলতাম।”
শরৎ দু-ধারে মাথা নেড়ে প্রস্থান ঘটাল। প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে প্রিয় বিছানায় বসতেই শরৎ আবারও এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আর আপনি বেঙাচি।”
চলে গেল তৎক্ষনাৎ। প্রিয়র রাগ তখন তুঙ্গে। রাগের প্রকাশে কিছু করতে যাবে, ওমনি ফোনে ম্যাসেজ এলো। শ্রেয়ানের ম্যাসেজ…
____
উঠোনের একদম মাঝখানে একটা মোড়ায় প্রহর বসে আছে। তাকে ঘিরে চারপাশে বসে আছে রিধিমা, নিধি, আরুশি, রূপা, আরহা, সৌরভ, আসিফ, শুভ্র, সৌরভ-আসিফের বউ রিমঝিম ও কলি আর ফুপাতো ভাই-বোনেরা। একেকজন প্রহরকে ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে।
নীহিন আর শাহানাজ হাতে চায়ের ট্রে আর কিছু স্ন্যাকস এনে পাশে রাখল। শাহানাজ চলে যেতেই নীহিনও পাশে বসে পড়ল।
আরহা জিজ্ঞেস করল,
-“প্রহর ভাইয়া, আপনার এইচএসসি রেজাল্ট কত ছিল?”
অপ্রস্তুত হয়ে প্রহর গলা ঝেড়ে নিল। তাকে কেউ তার পড়ালেখার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতে তার ভালোই লাগে, কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। তবুও জবাবে বলল,
-“৯৪%..”
রূপা প্রশ্ন করল,
-“ডিসিপ্লিনে?”
-“এ প্লাস।”
আরুশি জিজ্ঞেস করল,
-“ক্লিনলিনাসে?”
-“এ প্লাস।”
নিধি জিজ্ঞেস করল,
-“হ্যান্ড রাইটিংয়ে?”
-“এ প্লাস।”
সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছে। নীহিন তখন জিজ্ঞেস করল,
-“স্পর্টসে?”
কেশে উঠল প্রহর। লজ্জাজনক বিষয় এটা। এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারল না। মিনমিনে স্বরে বলল,
-“বি..”
বিস্মিত চোখে সবাই একবার নীহিন আরেকবার প্রহরের দিকে তাকাল। নীহিন আবার জিজ্ঞেস করল,
-“কো-কারিকুলার এক্টিভিটিস?”
প্রহরের আওয়াজ আরও দেবে গেল,
-“সি..”
দূর্বল জায়গায় লেগে গেল। পড়াশোনায় খুব ভালো হলেও, এসব দিক দিয়ে প্রহর লবডঙ্কা। দীর্ঘশ্বাস বেরোল গোপনে। বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি-তামাশা হওয়ার পর সবাই মিলে প্ল্যান করল ট্রুথ & ডেয়ার খেলবে। শরৎও এর মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। রিধিমা নীহিনকে বলল, প্রিয়কে ডেকে আনতে।
চলবে…