#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৫|
-“তুমি ফোন এডিক্টেড। আগামী ২৪ ঘন্টা তাই নিজের ফোন থেকে দূরে থাকবে। তোমার ডেয়ার এটাই, তোমার ফোনটা আমার কাছে আগামী ২৪ ঘন্টা জিম্মি থাকবে।”
সবাই একত্রে “হোওওওও” বলে চিল্লিয়ে উঠল। প্রিয়র রাগ লাগল। ফোন হচ্ছে ব্যক্তিগত জিনিস। ফোন নিয়ে কেন কথা উঠবে। এ নিয়ে কিছু বলতে চেয়েও প্রিয় থেমে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে হাতের ফোনটা উলটো দিকে প্রায় খানিকটা ছুঁড়েই মারল। হেসে উঠল শরতের গাঢ় বাদামি দৃষ্টি। সেই হাসি প্রিয়র রাগ আরও বাড়িয়ে তুলল। ত্বরিতে সেখান থেকে উঠে গটগট করে চলে যেতে লাগল।
সবার হাসি-তামাশা শেষে আবারও বোতল ঘোরানো হলো। এবার এলো আরহার দিকে। আরহাকে ট্রুথ দেওয়া হলো, নিজের একটা সিক্রেট রিভিল করতে। ও ইতস্তত করে বলল,
-“কাল রান্না ঘর থেকে উধাও হওয়া নাড়ুর বৈয়াম দুটো আমাদের রুমে। আমি নীহিন আর রূপা শেষ করেছি।”
আশরিফা জয়াকে ঘুম পাড়িয়ে ওদের জন্য শরবত নিয়ে এসেছিল। মেয়ের মুখ থেকে নাড়ু চুরির ঘটনা শুনে বিচলিত হয়ে বলে উঠল,
-“তো আসল চোর আপনারা?”
আরহা ভড়কে গিয়ে পিছে ঘোরে। মা’কে দেখে “ও মা গো” বলে দৌড় দেয়।
______
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আকাশে হানা দিচ্ছে বিষণ্ণ মেঘেরা। চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে মেঘের চাদরে। সব যখন আঁধারে তলিয়ে, ধানমন্ডির একটি অ্যাপার্টমেন্টের এইটথ ফ্লোরের বেডরুমের লাইটগুলো তখন জ্বলজ্বল করছে। ওয়াশরুমে পানির শব্দ হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে।
একটা মেয়ে কিছুক্ষণ আগেই এখানে এসেছে। পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা চকচক করছে। আধুনিকতার সাথে গায়ের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে প্রদর্শিত হচ্ছে কামুকতা। মেয়েটি পায়ের ওপর পা তুলে কাউচে গা এলিয়ে বসে আছে। হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস। চেহারায় আকর্ষণ। যেকোনো পুরুষের মাথা খারাপ হয়ে যেতে বাধ্য। মেয়েটির নাম কুহক।
ওয়াশরুমের দরজাটা ফট করেই খুলে গেল। সেকেন্ডের ব্যবধানে ধীর পায়ে বের হলো সুঠাম দেহের আকর্ষণীয় পুরুষটি। পরনে কেবল টাওয়াল। গায়ে বিন্দু বিন্দু জল। কুহক বাঁকা নজরে একবার তীব্র পছন্দের পুরুষটিকে দেখে সামান্য হাসল। আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।
শ্রেয়ান ওকে দেখেও না-দেখা করে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রেসিং মিররের সামনে দাঁড়াল। মিররে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। একবারও তাকাচ্ছে না ওর দিকে। শ্রেয়ান কপাল কোঁচকাল। দৃষ্টি প্রতিবিম্বে স্থির রেখে শুধাল,
-“দেখার জিনিস, না দেখলে পাপ হবে। এদিকে তাকাও।”
কুহক তাকায়। চোখে লাজের নূন্যতম আভা নেই। শ্রেয়ান আজ অবধি যত মেয়েদের সাথে ডেট করেছে, সবাই যতই বোল্ড হোক না কেন, কিছু না কিছু সময়ে, অল্পক্ষণের জন্য হলেও লজ্জায় বুদ হয়েছেই। কিন্তু এই মেয়েটা? কেমন অদ্ভুত! সম্মোহনী! কুহকিনী!
কুহকের দৃষ্টি তার হাতের গ্লাসে। সেন্টার টেবিলের ওপর বোতল আর গ্লাস রাখা। সে নিজের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বলল,
-“ওয়ানা ড্রিংক, বেইবি?”
শ্রেয়ান ততক্ষণে ওর দিকে এগিয়ে এসেছে। একপা দু’পা করে একদম কাছে। বিপরীতে রাখা সোফাটিতে বসে পড়েছে। কুহক ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,
-“হু?”
শ্রেয়ানের ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে। কুহকের ভেজা ঠোঁটে আঙ্গুল স্লাইড করে বলে,
-“আই ওয়ানা ইট..”
থামে সে, তার কথা, তার চোখ এই লাল রঙা ঠোঁটের ওপর স্থির হয়। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লিপ্সটিকটা ছড়িয়ে দিয়ে নিজের অসমাপ্ত কথাটি সম্পূর্ণ করল,
-“ইউ!”
মেয়েটি সেভাবেই হাসে। গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ায়। শ্রেয়ান হাত বাড়িয়ে তার কোমর চেপে নিজের সাথে লাগোয়া করে। কুহক এক হাতে শ্রেয়ানের চুলগুলো মুঠো করে মাথাটা উঁচু করে ধরে, অন্য হাতটি শ্রেয়ানের গলায় স্লাইড করছে। একে-অপরের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস দুজনেই অনুভব করছে। কুহক ওর ঠোঁটের খুব কাছে। অথচ চুমু খাচ্ছে না, ছুঁইছে না। নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বাড়ছে ক্রমেই। টান লাগছে চুলে, শক্ত হচ্ছে কুহকের হাত। আজ অবধি তার কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাহস হয়নি তাকে ছুঁয়ে দেখার, তার ওপর অধিকার ফলানো। সে যা চাইত, তা-ই হতো। কিন্তু কুহকের বেলায় তার সবকিছু এপিঠ-ওপিঠ হয়ে গেছে। মেয়েটা রীতিমতো তাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে! এই যে! এখন জ্বালাচ্ছে! উফফ!
শ্রেয়ান কোমরে চাপ প্রয়োগ করল। মুখ উঁচিয়ে ছুঁতে গেলে, মেয়েটা আরও দূরে সরে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণাটা কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়েছে কুহকের। হাসল কি? শ্রেয়ানের রাগ লাগে। খামচে ধরে কোমর। ‘আহ’ শব্দ উচ্চারণ করে কুহক হেসে বলে,
-“মাই বয়!”
শ্রেয়ান উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ওকে নিজের উরুতে বসিয়ে ফেলে ওর ঠোঁটে, চিবুকে, গলায়, বুকে চোখ বোলাতে থাকে। লো নেকের ক্রপটপে তার ক্লিভেজ দৃশ্যমান। শ্রেয়ান বলে,
-“তুমি খুব সুন্দর, কুহকিনী!”
কুহক কামড়ে ধরল শ্রেয়ানের ঠোঁট। শ্রেয়ান পাগলের মতো কুহকের স্পর্শকাতর জায়গাসমূহে হাত বোলাতে লাগে। পরনের ক্রপটপটির স্লিভ কাঁধ গলিয়ে নামিয়ে ফেলল। ঠোঁট ছুঁয়ে যায় কুহকের গলা থেকে বুকের বিভাজিকায়। কুহক হুট করেই নিজেকে শ্রেয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিল। হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে হাসল।
শ্রেয়ান এগোতে গেলে কুহক হাতের তালু সামনে তুলে তাকে সেখানেই থামিয়ে দিলো। আবেদনময়ী গলায় বলে উঠল,
-“আমি ভীড় পছন্দ করি না, বেইবি..”
সহসা শ্রেয়ান থমকে গেল। সে-ও প্রিয়কে এই কথাটা বলেছিল! শিট ম্যান! এই মেয়েকে ছাড়া দু’দণ্ড স্বস্তিতে কেন থাকতে পারে না? আর পারল না কুহকের সামনে থাকতে। উঠে চলে গেল অন্য রুমে।
কুহক কাপড় ঠিক করে কাউচে গা এলিয়ে গ্লাসটা হাতে তুলে নিল, সেই সাথে তার ওষ্ঠ বাঁকানো অসম্ভব সুন্দর হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁট, গাল হয়ে চোখে…
_____
আজ ফোন নেই, চোখে ঘুমও নেই। রাত নামতেই প্রিয় বিলপাড়ে চলে আসে। শুষ্ক পাতাগুলোর মাঝে সোজা শুয়ে পড়ে, চাঁদ দেখে। তারপর চোখ বন্ধ করে নেয়। সে টের পায় কামিনী ফুলের মিষ্টি সৌরভ। মুচকি হাসি ওষ্ঠে লেপটে যায়। টের পায় ঠিক পাশেই কাল্পনিক প্রিয় পুরুষের অস্তিত্ব। প্রিয় শুধায়,
-“কেমন আছ, প্রাণ?”
কল্পনায় প্রিয় তার কল্পপুরুষকে প্রাণ সম্বোধন করে। এই লোকটার চেহারার আকৃতি প্রিয় বোঝে না, তার কণ্ঠস্বরও চেনে না। কেমন ধাঁচের তা-ও বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব চেনা এই লোকটা। অথচ প্রিয় চিনতেই পারছে না।
প্রাণ তাকে বলে,
-“ভালো আছি। তুমি ভালো আছ, ফুল?”
-“তুমি পাশে থাকলে খুব ভালো থাকি।”
-“আমি তো সবসময়ই আছি।”
-“তবে সবসময় দেখা দাও না কেন?”
-“তুমি ভাবলেই আমার উপস্থিতি টের পাবে। যতটা ভাববে, ততটাই। অথচ তুমি আমায় ভাবো না।”
প্রিয় আঁতকে ওঠে,
-“কী বলো? তোমায় ভাবি না?”
-“কম।”
প্রিয় অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলে,
-“এটা বলতে পারলে?”
-“পারলাম।”
-“তুমি পাষণ্ড হয়ে যাচ্ছ, প্রাণ!”
-“না, ফুল। তুমি আমাকে নিজেই তা বানাচ্ছ। আমার হাতে আমার কিছুই নেই। তুমি যেমনিভাবে আমায় চাইবে, তেমনিভাবেই পাবে।”
-“ভালোবাসি বলো!”
-“আমি তো তোমায় ভালোবাসি না, ফুল। মিথ্যা বলব?”
-“হ্যাঁ, মিথ্যা বলো।”
-“কামিনীফুলকে ভালোবাসি।”
প্রিয় খিলখিল করে হেসে ওঠে,
-“প্রাণ, ভালোবাসি।”
প্রাণ মুচকি হাসে। প্রিয় বলতে লাগে,
-“জানো? তুমি থাকলে বড়ো শান্তি লাগে। কেন লাগে বলো তো?”
-“কারণ তুমি মনে করো আমি থাকলে শান্তি পাও, তাই।”
-“হ্যাঁ। একমাত্র তোমার কাছে এসেই আমি নিজের মর্জির মালিক হই। যা চাই, সব পাই। স–ব..”
-“হুঁ।”
প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধায়,
-“প্রাণ, যা চাই, তা পাই না। যা পাই, তা কখনও চাই-ও না। কেন?”
-“এটাই নিয়ম, ফুল। আমরা যাকে মনে-প্রাণে চাই। তাকেই মনের মতো পাই না।”
-“কী সুন্দর নিয়ম তোমার পৃথিবীর!”
-“পৃথিবীটা যদি আমার হতো, তবে অন্যরকম হতো।”
-“খুব সুন্দর হতো..”
_____
রাত তখন দেরটার কাছাকাছি। শরৎ বিছানায় বসে বসে বই পড়ছিল। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। এই রিংটন তার ফোনের নয়। ফোনটা যে প্রিয়র, তা বুঝতে সময় লাগল না। সাইডবক্স থেকে ফোন বের করল। একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করা কি উচিত হবে? যদি এটা প্রিয়র বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকে? থাক, রিসিভ না করাটাই ভালো।
শরৎ ফোন সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো। অথচ বার বার বেজেই যাচ্ছে। ডিস্প্লে লাইট যতবার অন হচ্ছে, ততবারই শরতের চোখ সেদিকে যাচ্ছে। শেষমেশ আর পারল না নিজেকে আটকাতে। কল রিসিভ করে নিল।
-“প্রিয়শ্রী, আই মিসড্ ইউ ব্যাডলি.. এরকম করছ কেন? আর কতবার সরি বলব বলো তো? কানে ধরব? লেট’স মিট, কিউটিপাই। সব রাগ ভুলিয়ে দেবো..”
-“তো তুই-ই সেই বাস্টার্ড?”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৬|
-“প্রিয়শ্রী, আই মিসড্ ইউ ব্যাডলি.. এরকম করছ কেন? আর কতবার সরি বলব বলো তো? কানে ধরব? লেট’স মিট, কিউটিপাই। সব রাগ ভুলিয়ে দেবো..”
-“তো তুই-ই সেই বাস্টার্ড?”
-“মানে!”
থতমত খেয়ে গেল শ্রেয়ান। ফোন সম্মুখে তুলে ডায়ালকৃত নম্বরটিতে আরও একবার নজর বুলিয়ে নিল। নাহ! প্রিয়র নম্বরই এটা। তবে পুরুষালি কণ্ঠ? প্রহরের? না, তার জানামতে প্রহর বড়ো নাজুক স্বভাবের। এই লোকটা কে? আর তাকে গালিই বা দিচ্ছে কেন?
আকাশে শুক্লা ষষ্ঠীর চাঁদ মেঘের আড়ালে গা ঢেকেছে। মেঘেরা বৃষ্টির আগমনীর গান গাইছে, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তীব্র হাওয়ায় কাঠের জানালাগুলো বাড়ি খাচ্ছে, শব্দ করছে সজোরে। সফেদরঙা পর্দাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। শরৎ সপাট করে জানালার পাল্লা আটকে ফেলে বলল,
-“কল করেছিস কেন?”
-“হু দ্য হেল আর ইউ আস্কিং মি দ্যিজ কুয়েশ্চন?”
শ্রেয়ানের কণ্ঠে রাগের আভাস। তার প্রিয়শ্রীর ফোন অন্য ছেলের কাছে কী করে? প্রিয় কি তবে নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে নাকি? না, এটা কীভাবে হয়? অসম্ভব! শ্রেয়ান মানতে পারছে না, মানতে চাইছেও না।
শরৎ বাঁকা হাসে,
-“যাকে কল করেছিস, তার ফিউচার আমি।”
তৎক্ষনাৎ ওপাশ থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দ পায় শরৎ, সেই সাথে কলটাও কেটে যায়। সবে তো শুরু! সে হাসে।
শ্রেয়ান ফোনটা ছুড়ে মেরেছে ড্রেসিং মিরর বরাবর। সম্পূর্ণ গ্লাস ভেঙে ফ্লোরে ছিটিয়ে আছে। শ্রেয়ান সেই ভাঙা আয়নায় নিজেকে দেখে। বিরবির করে,
-“পাখা গজিয়েছে? পাখা? তুই শেষ, প্রিয়শ্রী! তুই শেষ। মাথায় তুলে রেখেছিলাম, তোর সহ্য হয়নি?”
_____
বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। মুখের ওপর এক ফোটা জল পড়তেই প্রিয় মুচকি হাসে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে। ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত হয়ে যায় আশপাশ। প্রিয় হাসে। পরক্ষণে মনটা হু হু করে ওঠে। বৃষ্টির সময় নাকি সব দোয়া কবুল হয়! প্রিয় হাত বাড়ায়। চোখ বন্ধ করে বিরবির করে,
-“আমি নিজেকে ভালোবাসতে চাই। আমি স্বার্থপর হতে চাই।”
অনেকটা সময় পর প্রিয় ফিরে আসে নিজের রুমে। চেঞ্জ করে ওষুধ গিলে বৃষ্টি দেখতে থাকে।
পরদিন সে নিজের ফোনটা পেয়ে যায়। সে খেয়াল করে, শরৎ তার থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে চলছে। কথা বলছে না অপ্রয়োজনীয় একটাও। সে নিজেও আর এগোল না। শুধু শুধু এভাবে ঝগড়ায় তেমন কিছুই হচ্ছে না। ঝগড়া দুটো ক্ষেত্রেই কেবল হয়। অতি ঘৃণায়, সীমাহীন ভালোবাসায়। প্রিয়র মনে শরতের জন্য ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা, কোনোটাই নেই। কাজেই ঝগড়ারও প্রশ্ন আসে না।
এগোল আরও ক’টা দিন। উৎসবে আমেজে বাড়ির প্রতিটি কোণা তখন ভীষণ ব্যস্ত। প্রিয় এখন প্রতি রাতেই বিলের ধারে কাটাতে পছন্দ করে। প্রহরেরও একই রকম চলছে। রাতের বারোটার দিকে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। হাতে ফোন, কলে আছে আয়াত। সে নন্সটপ বকবক করেই যাচ্ছে। প্রহর শুনছে। শ্রোতা হিসেবে সে অসম্ভব সুন্দর কিছু।
আয়াত বলল,
-“কী রে? আছিস না-কি ঘুম?”
-“আছি।”
-“ব্রো, ভাল্লাগে না। চল একটা টেম্পারারি বিয়ে করে ফেলি। বর তুই, কনে আমি। ৭ দিনের ফাংশন হবে। বউভাতের পর আবার তুই-আমি দুইজনেই সিঙ্গেল। বিয়াত্যা হওয়ার প্যারা নিতে পারব না। কিছু ফোটোশ্যুট, শাড়ি-ল্যাহেঙ্গা, অর্নামেন্টস আর পুরো ফ্যামিলির ইম্পর্টেন্স পাওয়ার একমাত্র উপায় এখন বিয়ে। ব্রো, আয় বিয়ে করি। আই প্রমিস, আমি শুধু কাচ্চিটাই টেস্ট করব, তোকে না। ভয় পাস না ওসবে। আমার কন্ট্রোল চরম! তুই জাস্ট বিয়েটা করে নে।”
প্রহর ঠোঁট চেপে হাসে, স্বাভাবিকতায় শুধায়,
-“তারপর?”
-“তারপর চিল হপ্পে, মাম্মা! বহুত গিফট পাব দুজন। ক্যাশ যা আসবে, তা দিয়ে একমাসের মাল হয়ে যাবে। রাতে খুব গিলব, সকালে টাল হয়ে দুজন পড়ে থাকব। উফফ! জোস!”
-“উঁহু।”
-“কী উঁহু?”
-“আমি ওসব টেস্ট করব না।”
-“ওহ হো! তুই তো ননভেজ। আচ্ছা, তোর জন্য ফিডার রাখব। টেনশন নট, ব্রো! তোর সুবিধে-অসুবিধের একটা দায়িত্ব নিয়ে রেখেছি না? ম্যে হুঁ না? মেহেরিন আয়াত সাওদাহ্ ইজ অলয়েজ হেয়ার ফর ইউ, বেইবি।”
প্রহর হাসে, তার এখন দুষ্ট কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে যদি এখন বলে ওঠে, ‘আই ওয়ানা টেস্ট ইউ’, তবে আয়াতের রিয়্যাকশন কী হবে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে প্রহরের। কিন্তু তা জিজ্ঞেস করল না আর। আয়াত বলতে লাগল,
-“শোন না, বেইবি।”
-“বল।”
-“ফিরবি কবে? তোকে ছাড়া ভালো লাগে না আমার। অনেকদিন দেখি না..”
-“পরশু বিয়ে, এরপর ফিরব। হু?”
প্রিয়তমাকে শান্ত করার জন্য যতটা কোমল আওয়াজ হতে হয়, তার থেকে নমনীয়তা এই স্বরে খানিকটা বেশিই ছিল। আয়াত প্রসন্ন হাসে। পাশ থেকে কুশনটা বিছানায় ফেলে রেখে উবু হয়ে শুয়ে পড়ে। জড়ানো আওয়াজে বলে,
-“তুই কিছুই করছিস না, অথচ আমি পাগল হচ্ছি। প্রতিমুহূর্তে, প্রতিবার, বার বার আমি তোর জন্য পাগল হচ্ছি। আমার পাগলামি করতে মারাত্মক ইচ্ছে করে। আমার আকাঙ্খারাও দিন দিন আকাশ ছুঁইছে। প্রহর?”
-“হুঁ?”
-“তোর নির্বিকারত্ব আমার ছটফটানোর একমাত্র কারণ। তোর খামোশি আমার চাঞ্চল্যকে ফুটিয়ে তোলে। আগুন আর জল! আমি আগুনের মতো উদ্দীপিত, তুই জলের মতোই সুধীর। আমাকে তুই ছাড়া কেউ সামলাতে পারবে না, প্রহর।”
প্রহর চুপ থাকে। সে ব্যাপারটা হারে হারে টের পায়। দুটো বিপরীত স্বভাবের মানুষ যদি কখনও পাশাপাশি থাকে, তারা প্রেমে পড়তে বাধ্য। আয়াত শুধায়,
-“প্রহর, একটা সত্য বলি?”
-“বল।”
-“বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে আমার আজন্ম তোকে চাই। ওরা বলে না? ফ্রেন্ডশিপ ইজ দ্য ফার্স্ট স্টেপ অব্ লাভ? মানিস তা?”
-“মানি।”
-“আরেকটা সত্যি বলি?”
-“বল”
-“ভালোবাসি।”
প্রহরের শ্বাস আটকে গেল সেই ক্ষণে। বছর কতগুলো আগে থেকে এই সত্য সে জানে। কিন্তু মুখোমুখি হতে হলো এই প্রথম। নিজেকে সামলে নিল পরমুহূর্তেই। নরম গলায় ডাকে,
-“সাওদাহ্?”
কল কেটে দেয় আয়াত তৎক্ষণাৎ। চোখ বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে মুচকি মুচকি হাসতে লাগে। বিরবির করতে লাগে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি…”
____
কফির কাপটা নিয়ে প্রিয় করিডোরে এসে রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কফি খেতে খেতে আকাশ দেখছে। প্রিয়র মনে পড়ছে এরকমই হাজারো রাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে শ্রেয়ানের সাথে ফোনালাপে মত্ত হতো। শ্রেয়ানের কী মিষ্টি মিষ্টি কথা! তার প্রতিটা সম্বোধন প্রিয়র লোমকূপ অবধি কাঁপিয়ে তুলত। এত মিষ্টি অনুভূতি ছিল সে-সব! এখন তা কল্পনামাত্র।
প্রিয় মুচকি হেসে কাপে চুমুক দেয়। রুম থেকে বেরিয়েছিল শরৎও। প্রিয়কে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে চলে যেতে নেয়। প্রিয় দেখে ফেলে। শব্দ তুলে ডেকে ওঠে,
-“নীরজ ডাকব না-কি শরৎ?”
শরৎ ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে, প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল,
-“দুটোই আমার নাম, তবে ডাকার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।”
প্রিয় হাসে,
-“নীরজ ভাই, আমাকে এড়িয়ে চলছেন কেন?”
-“এড়িয়ে চলছি?”
-“হুঁ।”
-“আচ্ছা বেশ।”
-“কী বেশ?”
-“এড়িয়ে চলছি।”
প্রিয় কফির কাপটা রেলিংয়ের ওপর রেখে এগিয়ে গেল শরতের দিকে,
-“মেয়েদের সাথে এরকম করতে নেই।”
-“কীরকম?”
-“যে-রকমটা আপনি করছেন।”
-“কী করছি?”
-“পাত্তা দিচ্ছেন না।”
-“পাত্তা চাইছ, প্রিয়?”
প্রিয় নেতিবাচকতা প্রকাশ করে,
-“না। তবে, প্রতিটা মেয়েই চায় তার বিপরীতের ছেলেটি তার আগে-পিছে ঘুরুক। সবসময় তার সাথেই লেগে থাকুক। সবসময় ফ্লার্ট করুক, পটানোর চেষ্টা করুক।”
শরৎ হেসে ওঠে। তার সামান্য ওষ্ঠ বাঁকানো হাসিটা প্রিয়র গা জ্বালিয়ে দেয়। লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,
-“আমার ওসব চাওয়া নেই। তবুও আপনার এভয়েড করে বেরানোটা চোখে লাগছে।”
শরৎ এগোল খানিকটা, চোখে চোখ রাখল প্রগাঢ় দৃষ্টিতে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে দৃঢ় আওয়াজে শুধাল,
-“কী চাইছ, প্রিয়?”
প্রিয় খানিকটা ভড়কায়। সে কী চাইছে, তা নিজেও জানে না। ইতস্তত করতে করতে এদিক-ওদিক তাকায়। শরৎ হাসে,
-“আমাদের দূরত্ব বাড়ানো উচিত, আই থিংক। উই আর কম্পলিটলি ডিফরেন্ট। বুঝতে পারছ?”
প্রিয়র গায়ে কথাটা সুচের মতো বিঁধে যায়। আশ্চর্য তো! সে কি প্রেম করতে চাইছে নাকি? প্রপোজ করেছে? কই? কখন? কীভাবে? না তো! তবে এভাবে বলছে কেন লোকটা?
প্রিয়র মনের কথা যেন শরৎ শুনতে পেল। প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
-“চাইছ না, চাইতে দেরিও নেই। পৃথিবীটা বড়ো অদ্ভুত প্রিয়। যা কখনও ভাবতেও পারবে না, তাই একসময় চেয়ে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।”
-“সম্ভব নয়..”
-“তোমার চোখ অন্য কিছু বলছে, প্রিয়।”
প্রিয় ত্বরিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,
-“প্রেমে ব্যর্থ রমনী দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ার সাহস পায় না।”
-“অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম প্রেম ভুল বয়সে অথবা ভুল সময়ে কিংবা ভুল মানুষের সাথে হয়ে থাকে। এর মানে কি এ-ই—তারা দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ে না? প্রিয়, আমার দিকে তাকাও।”
প্রিয় তাকাতে চায় না। বিক্ষিপ্ত নজর এদিক-ওদিক ঘুরে কীভাবে যেন তার ওপরই এসে পড়ে। চোখ চোখ পড়তেই শরৎ বলে,
-“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, খুব জলদিই আনএক্সপেক্টেড কিছু ঘটবে।”
প্রিয় আঁতকে ওঠে,
-“ন..না! না হোক!”
-“তবে দূরে থাকো।”
-“কেউ আমাকে অ্যাভয়েড করে চললে তা প্রচণ্ড মানসিক অশান্তি দেয়। এখানে কী করতে পারি?”
শরৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
-“তবে ইন ফিউচার, আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”
-“নিজের ওপর বিশ্বাস আছে।”
-“তোমার বিশ্বাস ভেঙে যাবে, প্রিয়।”
শরতের চোখের দৃষ্টি প্রচণ্ড নরম, গলার স্বর তার অধিক। প্রিয় অধীর হয়ে বলে,
-“দেখা যাক..”
শরৎ হাসে,
-“সাবধান করেছিলাম, শুনলে না। সর্বনাশের দায়ভার তবে তোমাকেই নিতে হবে…”
চলবে..