#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৭|
“ভাবের দেশে থাকো কন্যা গো, কন্যা,
ভাবের দেশেই থাকো…!”
শান্তিকুঞ্জের সম্মুখাংশে বেজে চলছে বিভিন্ন গ্রাম্য সংগীত, তারই একপাশে রিধিমাকে ঘিরে বসে আছেন এলাকার প্রবীণ রমনীরা। বিভিন্ন গান গাইছেন সবাই মিলে। হাসি-ঠাট্টার সাথে বিভিন্ন মশকরাও করছেন তাঁরা। রিধিমা ক্ষণে ক্ষণে লাজে মরছে। বোনেরা তা দেখে মজা নিতে ভুলছে না। প্রবীণদের আরও সুযোগ তুলে দিচ্ছে লজ্জা দেওয়ার। রিধিমার কঠোর দৃষ্টি তাদের দিকে পড়তে এলেই মিইয়ে যাচ্ছে লজ্জায়।
বাড়ির বউয়েরা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছে না, কর্তারা ব্যস্ত অতিথিদের আতিথিয়েতায়। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শুভ্র এসব কিছুতে একবার নজর বুলিয়ে দৌড় লাগাল সিঁড়িঘর বরাবর। পরনে তার সফেদ রঙা কটনের পাজামা-পাঞ্জাবি। শরতের রুমের সামনে এসে সে থামে। শরৎ চুল সেট করার জেলটা খুঁজছিল। ওমনিই শুভ্র ডেকে ওঠে,
-“ব্রোওওও! কী করছ?”
শরৎ পিছে ঘুরে শুভ্রর দিকে তাকায়, তারপর আবার আয়নায় নিজেকে দেখে। বাহ! ম্যাচিং ম্যাচিং! আবারও শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কপিক্যাট কোথাকার!”
শুভ্র খিলখিল করে হেসে ওঠে,
-“এট্টু!”
শরৎ হেসে শুভ্রকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে পিঠে ক’টা চাপড় মেরে বলে,
-“নট ব্যাড।”
-“এহে ব্রো, ছাড়ো ছাড়ো। কোলের বয়স নেই আমার। আ’ম নাইন নাও।”
-“তাই না?”
-“ইয়েস!”
শরৎ এবার ওকে পাজাকোলের ভঙ্গিমায় এনে বলল,
-“ফেলে দিই!”
-“এএএ না!”
শরৎ ওকে নামিয়ে দেয়। শুভ্র শরতের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আহ্লাদ করে বলে ওঠে,
-“ব্রো, নিড ভাবি।”
-“জয়া আর শুভ্রা ভাবি আছে না? চলছে না ওতে?”
-“খেলব না। প্রতিবার কথা কাটিয়ে নাও। আই হেটিউ।”
-“লাভ ইউ ঠু।”
চোখ ঘুরিয়ে শুভ্র বলে,
-“হেট ইউ বলেছি।”
-“আমি তো লাভ ইউ শুনেছি।”
-“ব্রোওওওও!”
-“কীইইইই?”
-“প্লিজ একটা ভাবি এনে দাও না। প্রমিস তোমার সব কথা শুনব। তোমার শার্টগুলো নিয়ে আর ঢং করব না। সারাক্ষণ বিরক্ত করব না। তোমাকে জ্বালানোটা ওদিকে ট্রান্সফার করব।”
শরৎ শুভ্রর কাঁধে হাত রেখে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে,
-“সময়মতো সব পেয়ে যাবি। এর আগে এত চাস না। আমার ভালো লাগে না।”
গাল ফোলাল শুভ্র,
-“আচ্ছা, বলব না আর।”
কথাটি বলে শরতের দিকে তাকাল সে। দেখতে পেল আচমকা শরতের অধর প্রসারিত হলো। এদিক-ওদিক ক্রমান্বয়ে ঘূর্ণায়মান দৃষ্টিটি একটি নির্দিষ্ট দিকে এসে স্থির হয়েছে। বাতাসের ঝাপটা এসে শান্তিকুঞ্জের দোতলার করিডোরে তান্ডব মাতানো শুরু করল। পূর্বে মুখ করা সাউন্ড বক্সে বাচ্চারা গান বাজাচ্ছে। একটা হিন্দি গান। গানটির প্রতিটি বিট এই হৃদ-তান্ডবে এসে যোগদান করল।
ᴅᴇᴋʜᴀ ᴛᴇɴᴜ ᴘᴇʜʟɪ ᴘᴇʜʟɪ ʙᴀᴀʀ ᴠᴇ
ʜᴏɴᴇ ʟᴀɢᴀ ᴅɪʟ ʙᴇᴋᴀʀᴀʀ ᴠᴇ
ʜᴀᴀʏᴇ ᴍᴀɪɴᴜ ᴋɪ ʜᴏ ɢᴀʏᴀ
ᴅɪʟ ᴊᴀɴɪʏᴇ ʜᴀᴀʏᴇ ᴍᴀɪɴᴜ ᴋɪ ʜᴏ ɢᴀʏᴀ…
ꜱᴜɴ ᴋᴇ ᴛᴇʀɪ ʙᴀᴛᴇɪɴ ꜱᴏɴᴇ ʏᴀᴀʀ ᴠᴇ
ᴍᴀʜɪ ᴍᴀɪɴᴜ ᴛᴇʀᴇ ɴᴀᴀʟ ᴘʏᴀʀ ᴠᴇ
ʜᴀᴀʏᴇ ᴍᴀɪɴ ᴍᴀʀ ᴊᴀᴠᴀ
ᴅɪʟ ᴊᴀɴɪʏᴇ ʜᴀᴀʏᴇ ᴍᴀɪɴ ᴍᴀʀ ᴊᴀᴠᴀ…
শরতের ওমন প্রজ্জ্বলিত মুখের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দেখে শুভ্র শুধাল,
-“হোয়াট হ্যাপেন, ব্রো?”
-“ডোন্ট নো!”
-“আর ইউ লস্ট?”
-“মে-বি ইয়েস।”
শুভ্র অবাক হয়,
-“কোথায়?”
চোখের ইশারায় শরৎ জানায়,
-“ওখানে।”
শুভ্র শরতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছে তাকায়। দেখতে পায় এক সুশ্রী রমনীকে। পরনে তার ল্যাভেন্ডার জামদানী আটপৌরে করা, লম্বা চুলগুলো মাঝসিঁথি করে পিঠ ছাড়ানো। সেই চুলে একটা গাঁদাফুলের মালা সজ্জিত। দুটো মালা দু-হাতের কব্জিতেও জায়গা করে নিয়েছে। সম্পূর্ণ প্রিয়শ্রীকেই যেন সদ্য প্রস্ফুটিত একটি ফুল লাগছে। অনেক খুঁজেও গায়ে আর কোনো অলংকার খুঁজে পাওয়া গেল না।
শরৎ মিনমিনে স্বরে শুধাল শুভ্রকে,
-“ভালো?”
বিমুগ্ধ শুভ্র হা হয়ে ছিল, সেভাবেই বলল,
-“খু–ব!”
শুভ্রর কোঁকড়াচুলগুলো হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে এলোমেলো করে দিলো শরৎ। এগিয়ে গেল প্রিয়শ্রীর দিকে। পথরোধ করে দাঁড়াল। আঁড়চোখে প্রিয় শরতের দিকে এক নজর তাকাল। সদ্য শাওয়ার নেওয়া ভেজা চুলগুলো শরতের কপালে এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে, সাদা পাঞ্জাবিটাও সুঠাম দেহের সাথে আঁটসাঁট বাঁধা আছে। ভ্রু কুঁচকে প্রিয় শুধাল,
-“কী হচ্ছে?”
শরৎ পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
-“কী হবে?”
প্রিয় বড়ো ভাব নিল,
-“মানলাম আমি সুন্দরী, আজ একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। এর মানে এই না যে আপনি টিপিকাল রোড সাইড রোমিও সেজে টিজ করা শুরু করবেন?”
শরৎ অবাক হওয়ার ঢং করে বলল,
-“আপনার সেন্স অব্ হিউমার এত্ত ফালতু, প্রিয়? ওয়াও! জোস! ফ্যাবিউলাস! দ্যি গ্রেট নীরজ শিকদার কি না টিজ করবে? আপনাকে? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, নীরজ শিকদার ভীষণ রকমের রুচিশীল মানুষ। এ জীবনে সে রুচির অধঃপতন হবে না। আপনাকে টিজও করা হবে না।”
এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে এতগুলো কথা বলে শরৎ থামল। প্রিয় বড়ো বড়ো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
-“আঙুর ফল টক।”
শরৎ হাসে, ভেজা চুলগুলোয় ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলে,
-“বেশি বোঝেন।”
প্রিয় নিজের চুলগুলো পিছে উড়িয়ে বলল,
-“নীরজ ভাই, আপনি বহুত ঢং জানেন।”
-“আপনার চেয়ে কম।”
প্রিয়র হাতের ফুলমালাটা খুলে গেল। ‘ইশশশ্’ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করে সে তা ঠিক করতে লাগল, কিন্তু বাঁধতে পারছিল না। শরৎ বলল,
-“এদিকে দিন, দেখি।”
প্রিয় হাত বাড়িয়ে দিলো। শরৎ সুতোয় সাবধানে গিট দিতে লাগল। সেই ক্ষণে আরও একবার নজর গেল প্রিয়র হাতের এই কাঁটাছেড়ার দাগগুলোতে। গা শিরশির করে উঠল তার। চোখ বুঁজে এলো ত্বরিতে। পরপর তাকাল প্রিয়র চোখের দিকে। প্রিয় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। শরৎ চোখে চোখ রেখে শুধাল,
-“নিজেকে এত আঘাত কেন, প্রিয়?”
প্রিয়র চোখ পড়ল নিজের হাতের দাগগুলোতে। অপ্রস্তুত হলো সে। কথা কাটানোর শব্দ পেল না। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। তবে উত্তর দিলো সামান্য হেসে,
-“সহ্যশক্তি প্রচণ্ড আমার। কিন্তু যন্ত্রণারা ছিল সীমাহীন। যেমনটা আমার ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে সর্বোচ্চতে পৌঁছে গিয়েছিল। এইটুকু চিহ্ন থাকা আবশ্যক ব্যাপার।”
শরৎ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
-“নিজেকে কষ্ট দেওয়ার পেছনের যুক্তি?”
-“শরীরের এই যন্ত্রণা ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাকে মরণযন্ত্রণা থেকে রক্ষা করেছিল।”
শরৎ হাতটা উলটে-পালটে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখল। দেখতে দেখতে বলল,
-“দাগগুলো কীসের?”
শরৎ আরও খানিকটা এগোল, পেছাল প্রিয়। পিলারের সাথে প্রিয়র পিঠ ঠেকে গেল। বাম হাতটা শরতের হাতে। ডান হাতটা রেলিংয়ের ওপর রাখল। ডানের ঘন জঙ্গলের দিকটায় তাকাল। শুষ্ক গলায় রসিকতার সুরে বলল,
-“ও কিছু না। কান্না আটকাতে হাত কামড়ে ধরতাম, রাগ দমাতে খামচে ধরতাম। এসবেরই দাগ।”
চোয়াল শক্ত হলো শরতের। চাহনি হলো দৃঢ়, গলার স্বর তারও অধিক কঠোর,
-“বাড়িতে জানে এসব?”
-“ভাই জানে, মা আংশিক জানে। বাবা কিছু জানে না।”
প্রিয় তাকায় ওর দিকে। আবারও বলে,
-“আপনি কতটা জানেন?”
-“যতটা বুবুজানকে আপনি বলেছেন।”
-“ওহ! তার মানে সবটাই জানেন। কবে জেনেছেন?”
-“প্রথমদিনই।”
প্রিয় হাসে,
-“সহানুভূতি দেখাতে এসেছেন তবে?”
প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল শরৎ নিজের প্রশ্নের দ্বারা,
-“নতুন সম্পর্কে যাননি, প্রিয়?”
-“যাইনি।”
স্বকীয় ধারণাকে ১৮০° এঙ্গেলে উলটে যেতে দেখে শরতের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,
-“কেন?”
-“কেন আবার?”
-“আমার ধারণা ছিল আপনি আরেকবার আরেকটি সম্পর্কে জড়াবেন, জাস্ট নিজেকে সামলানোর জন্য। প্রেমেও পড়ে যাবেন আস্তে-ধীরে। অনেক মানুষ দেখেছি এমন। প্রথম সম্পর্কে গভীর থেকে গভীরভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সে একা হয়ে যায়। একাকিত্ব অভিশাপ! সে তাই আরেকজন পুরুষের ধারে যায়। বন্ধুত্বের দোহায় দিয়েই হোক কিংবা টেম্পারারি রিলেশনে গিয়ে। আপনার থেকেও এমনটাই আশা করেছিলাম, প্রিয়।”
প্রিয়র গায়ে কথাটা সূচের মতো লেগে, অপমানে মুখ হয় থমথমে। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বলে,
-“দেবদাস হওয়া কেবল পুরুষদেরই সাজে।
পার্বতীকে ভুলতে গিয়ে রোজ রাতে চন্দ্রমূখীতে মজে।
আর আমরা নারী,
আমরা মানতেও পারি, মানাতেও পারি।”
শরৎ হাসে,
-“এজন্য মেয়েরা মায়ের জাত। ছোট থেকেই তাদেরকে সম্মান করি।”
কথাটা প্রিয়র ভালো লাগল। এরই মধ্যে শরৎ আরেকবার বলে উঠল,
-“প্রিয়, আরেকবার প্রেমে পড়ার সাহস দেখাবেন?”
-“আপনি আমাকে আরেকবার প্রেম শেখাতে চাইছেন, নীরজ ভাই?”
-“চাইছি।”
-“আপনি কি আরও একবার আমাকে দুঃখ চেনাতে চাইছেন?”
-“কিঞ্চিৎ চাইছি।”
-“ইতোমধ্যে আমি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, আর কত অসুখ আসবে?”
-“এবার সুখ পাবেন।”
-“ট্রাস্ট ইস্যু আছে আমার।”
প্রিয় হাসতে লাগে পাগলের মতো। শরতের হাতের গ্রিপ শক্ত হয়, কব্জিতে চাপ লাগে প্রিয়র। হাসি থেমে যায় তৎক্ষণাৎ। তাকায় শরতের চোখের দিকে। শরতের সেই অনমনীয় নজরে তাকাতেই সহসা সে থমকে যায়। ভারিক্কি গলায় শরৎ আবারও জানায়,
-“ট্রাস্ট করুন এবার।”
প্রিয় চোখে হেসে বলে,
-“যার কাছে নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করলাম, সে-ই ভেঙে ফেলে চলে গেল। আর বিশ্বাস করি কাকে?”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৮|
প্রিয় চোখে হেসে বলে,
-“যার কাছে নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করলাম, সে-ই ভেঙে ফেলে চলে গেল। আর বিশ্বাস করি কাকে?”
শরৎ কদম দুয়েক এগিয়ে আসে। মুঠো করে নেয় প্রিয়র হাতটা, তাকিয়ে থাকে প্রিয়র কাজল দৃষ্টির অতলে। প্রিয় পলক ঝাপটিয়ে তার দিকে তাকায়। শরৎ বলে,
-“আপনার একটা মানুষ আসুক, একটা নিজের মানুষ।”
-“চাই না।”
শরৎ চোখে হাসে,
-“আচ্ছা প্রিয়, বিষণ্ণ সন্ধ্যেতে কারো বুকে মুখ লুকোনোর ইচ্ছে জাগে না? রাত্রিপ্রিয়া, এত নির্ঘুম রাত কি আপনায় আফসোস উপহার দেয় না একটা নিজস্ব পুরুষালি কাঁধের? একাকী রাস্তাগুলো কারো হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল গুঁজে দেওয়ার খোয়াইশ জাগায় না? প্রিয়, হুটহাট কারো জন্য সাজতে ইচ্ছে করে না? কারো থেকে প্রশংসাবাক্য শুনে লজ্জায় লাল হতে ইচ্ছে করে না? প্রকৃতি আপনায় একটা মানুষ দিক। একাকিত্ব দূর হোক, আপনি আমার শখের কামিনীফুল হয়ে ফুটে উঠুন।”
প্রিয়র চোখ তখন জ্বলছে, লাল রক্ত জমাট বেঁধেছে সাদা অংশে। ভয়ানক সে দৃষ্টিতে প্রিয় শরতের দিকে তাকায়। নিখুঁত আকৃতির ঠোঁটদুটো বিরবির করে উঠল, অথচ শব্দ হলো না। ঠোঁটের নড়চড়ে ভাব দেখে শরৎ উচ্চারণকৃত শব্দ টের পেল,
-“কিচ্ছু চাই না।”
শরৎ বুঝে উঠতেই বলে ফেলে,
-“তবে প্রকৃতি আপনায় এমন সব চাওয়াগুলোই দিক।”
প্রিয় তাকিয়ে থাকে শরতের দিকে অনেকটা সময় নিয়ে। সে লক্ষ্য করে শরতের চোখের মণিটা কালো নয়, কিঞ্চিৎ ঘোলাটে। প্রিয় বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আচমকা অবাক হয়ে যায়, শরতের চোখ অসম্ভব সুন্দর লাগতে লাগে তার কাছে। দৃষ্টি সরায়। ওষ্ঠে আনে হাসির রেখা। প্রসঙ্গক্রমে বলে ওঠে,
-“তা আপনার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে কিছু বলুন, শুনি।”
-“আমার গার্লফ্রেন্ড?”
শরতের কণ্ঠে প্রশ্ন। মাথা নাড়ায় প্রিয়। হুট করে সেদিনের ট্রুথের কথা মনে করে শরৎ বলে ওঠে,
-“আমার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে শুনবেন?”
-“জি।”
শরৎ হাত ছাড়ে প্রিয়র। বিপরীতের পিলারে নিজে হেলান দেয়। বুকে হাত বেঁধে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কল্পনায় সুখ কুড়িয়েছেন, প্রিয়?”
প্রিয়র মনে পড়ে তার প্রাণের কথা। চোখ দুটো বুঁজে আসে। কল্পপুরুষ তার কানের নিকট অতি যত্নে যেন ফু দিলো, প্রিয় শিউরে উঠল ভেতর ভেতর। একই সাথে আবারও প্রিয় তার কল্পপুরুষের দ্বারা শুনতে পেল, ‘ফুল, আমার রাজকন্যা! তুমি এক ভীষণ সুন্দর সুখপাখি।’
প্রিয় চোখ খুলে ফেলল ত্বরিতে। প্রতিমুখে শরৎকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে প্রিয় আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-“আপনার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ আমি এদিকে।”
শরৎ শুধায়,
-“কল্পপুরুষ আছে, প্রিয়?”
-“আছে।”
-“কেমন সে?”
-“আব্..”
-“দেখেননি?”
-“দেখেছি।”
-“তবে?”
-“তার মুখের অবয়ব আমার কাছে কখনও পরিষ্কার হয়নি। সে দেখতে ভীষণ সুদর্শন। আমি যতবার তাকে দেখি, ততবারই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। এতটা মনের মতন কেউ কীভাবে হয়? তবে আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য আমার জানা নেই। আমি বলতে পারি না।”
-“এক বাক্যে বলুন।”
-“আমার মনের মতো।”
-“বাহ্যিকতায়?”
-“সবরূপে, সবভাবে সে আমার মনের মতোই।”
-“কল্পপুরুষকে তবে প্রেমিক বলতে পারছেন না কেন, প্রিয়?”
-“লোকে আমায় পাগল বলবে..”
-“প্রেমের সর্বোচ্চটা হচ্ছে পাগলামি। প্রেম করবেন আর পাগল হবেন না, তা হয়?”
প্রিয় অদ্ভুতভাবে তাকায়,
-“তো বলছেন, সবাইকে বলে বেড়াতে যে আমার একটা কাল্পনিক প্রেমিক-পুরুষ আছে?”
শরৎ হাসে,
-“না থাক, বলা লাগবে না।”
প্রিয় শুধায়,
-“জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে। এড়িয়ে গেলেন?”
-“মানুষের সামনে পাগল সাজতে চাই না..”
প্রিয় বড়ো বড়ো চোখে তাকায়,
-“সিরিয়াসলি? আপনারও কাল্পনিক প্রেমিকা আছে?”
-“আজ্ঞে না। আমার মনে মনে সংসার আছে।”
-“মনে মনে সংসার?”
-“মানে একটা মেয়েকে পছন্দ করি। তারপর তাকে নিয়ে মনে মনে সংসার করি। মনে মনে জড়িয়ে ধরি, মনে মনে টপাটপ পাঁচ-দশটা চুমু খেয়ে ফেলি।”
-“ছি! অশ্লীল!”
-“এখানে অশ্লীলতার কী আছে? গোপনে প্রিয়, তুমিও খুব একটা সাধু নও। ভেতরের কথা বের করতে গেলে জানতে পারব, কাল্পনিক পুরুষের সাথে তুমি বাচ্চা-টাচ্চা জন্ম দিয়ে ফেলেছ।”
-“ইছছিইইহ! আপনি তো দেখছি অশ্লীলতার চূড়ান্তে চলে গেছেন, নীরজ ভাই।”
প্রিয় নাক সিটকাচ্ছে। শরৎ বাচ্চাদের মতো অভিমানে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে খানিকটা ফুলকো গালে বলে উঠল,
-“হ্যাঁ, সেটাই। তোমরা করলে দোষ নেই, আমি বললেই দোষ।”
আচমকা প্রিয় হাসতে লাগে। হাসতে হাসতে বলে,
-“গাল ফোলালে আপনাকে যা লাগে না, নীরজ ভাই! কাছে আসেন। একটু টেনে দিই।”
-“ছি প্রিয়, দিন দিন চরম ফাজিল হয়ে যাচ্ছ তুমি। এভাবে একা পেয়ে একটা ছেলেকে টিজ করতে তোমার বাঁধছে না? ঘরে বাপ-ভাই নাই?”
প্রিয় হেসে সত্যি সত্যি শরতের ডান গালটা টেনে বলে,
-“বাপ-ভাই আছে, তোমার মতো একটা টসটসে মাল নেই কেবল।”
-“নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ! মুখের ভাষার কী শ্রী!”
প্রিয় চোখ মেরে বলে,
-“এটা প্রাইমারি লেভেলের, আপনি চাইলে খাঁটি বাংলাতেও কিছু শুনিয়ে দিতে পারি। ওয়ানা হিয়ার?”
-“নোপ প্রিয়, তুমি সাংঘাতিক মেয়ে।”
প্রিয় হাসি চেপে অন্যদিকে তাকায়। ডান গালের গর্তটা কী গভীর দেখাচ্ছে! শরৎ ডিম্পলটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তোমাকে দেখলে এখন আর ঝগড়া পায় না। অন্য কিছু পায়। আশ্চর্যজনক কিছু পায়।”
প্রিয় শুধায়,
-“কী পায়?”
তা আর শরতের বলা হয় না। হলুদের আনুষ্ঠানিকতায় রাত অবধি ব্যস্ত থাকে।
____
রাতের ১১টা। ধানমণ্ডির এক সরু রাস্তা হয়ে অসম্ভব আকর্ষণীয় এক তরুণী খটখটে শব্দ তুলে হেঁটে চলেছে। পরনে ঢোলাঢোলা এক টপ্স আর ব্যাগি জিন্স। চোখে বরাবরের মতো লেন্স নেই, আছে মাইনাস পাওয়ারের গ্লাস। খড়খড়ে ফেঁটে যাওয়া ঠোঁটে দৃষ্টিধাঁধানো রঙ নেই। কেমন যেন নিজস্ব রূপ এটা! কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। আর গলায় স্কার্ফ।
চাঁদের আলো অপরিচ্ছন্ন, মৃদু স্ট্রিটলাইটই রাস্তাটিকে দৃশ্যমান করতে সহায়তা করছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা গেলে, রাস্তাটিতে জনমানবশূন্য মনে হবে। কিন্তু মেয়েটি দেখতে পাচ্ছে ভিন্ন কিছু। একাকী রাস্তাটিতে চাঁদ তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে, তবে নিজেকে নিঃসঙ্গ সে ভাবে কী করে?
কুহক হাসে সামান্য। ব্যাগ থেকে চিপ্সের প্যাকেট বের করে খেতে থাকে। এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন এক পথ হাঁটতে থাকে। শহরের রাস্তায় মেয়ে মানুষের একা বের হওয়াটা বেশ নির্বোধ একটা কাজ। যে-কোনো সময়, যে-কোনো কিছু হতেই পারে। এদিকে কুহক কিছুটা ভিন্ন। সে নিজেকে প্রতিটি সিচুয়েশনের জন্য প্রস্তুত রাখে। সেল্ফডিফেন্সটা তার জানা আছে।
কল আসে তার ফোনে। পকেট হাঁতড়ে ফোনটা বের করে কলার আইডি দেখে। স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করছে কিছু লেটার, ‘LOVE’
কল রিসিভ করে সে। মৃদু হেসে শুধায়,
-“আমাকেও আপনার মনে পড়ে তবে?”
ওপাশের লোকটার গলা মারাত্মক গম্ভীর,
-“বাজে কথা ছাড়ো।”
-“আচ্ছা, ছাড়লাম। বলুন।”
-“কাজ কদ্দূর হলো?”
-“আর কাজ! এরকম মানুষ কাউকে ভালোবাসতে পারে না।”
-“আমি জানতে চেয়েছি কতদূর অবধি কাজ হয়েছে।”
ওপাশের কণ্ঠ শুনে কুহক মলিন হাসল। বলল,
-“সামান্য। পুরুষ মানুষ দুই জায়গায় আটকায়। মায়ায় আর আকর্ষণে। এর বাইরে তারা অতি গোপনে কৌতুহলী কদম এগিয়ে জানতে এসে আরও বাজেভাবে আটকে যায়। আপাতত শ্রেয়ান আমার ব্যাপারে ভীষণ কৌতুহলী।”
-“ওয়েলডান।”
কুহক হুট করেই শব্দ করে হেসে ওঠে, এ-পাশের লোকের ভ্রু কুঁচকে যায়। শুধায়,
-“হাসছ কেন পাগলের মতো?”
মেয়েটা হাসি থামায় না। রোড সাইডে বসে পড়ে। গভীর এক শ্বাস ফেলে বলে,
-“যাকে ভালোবাসলাম, তাকে পেলাম না। অথচ আরেকজনকে ভালোবাসার জালে আটকাতে এলাম। বিনিময়ে কি আমি নিজের ভালোবাসা পেতে পারি?”
কণ্ঠ খানিকটা কাঁপছিল কুহকের। ওপাশের লোকটি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। পার্ফেক্ট এক্সেন্টে বলে উঠল,
-“তুমি নিজ থেকেই করতে চেয়েছ, কুহক। আই ডিডেন্ট আস্ক ইউ টু ডু দিজ।”
-“হুম। আই ওয়োন্ট এক্সপেক্ট আ লি’ল থিং ফ্রম ইউ, লাভ। ভালোবাসা ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ না সেখানে এক্সপেক্টেশন নামে কোনো শব্দ চলে আসে।”
কুহক হেসে হেসে আবার বলে,
-“আমি আপনায় ভালোবাসি নিঃসঙ্গ প্রতিটি রাতের মতো। ক্ষত দেবেন? তবে দিন। আমরা তো ভালোবাসিই যন্ত্রণা পাওয়ার জন্য। কুহকের ভালোবাসা আপনি পরিমাপ করতে পারবেন না, যন্ত্রণা তবে ছোট্ট আকাশের সমানই দিন।”
পুরুষালি কণ্ঠটা সময় নিয়ে বলে উঠল,
-“প্রচুর রিস্ক এখানে। তুমি প্লিজ সরে যাও, আমি অন্য উপায়ে ম্যানেজ করে নেব।”
কুহক হাত-পা ছড়িয়ে ধুলো মাখানো রাস্তায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। গুনগুনিয়ে গান ধরল,
-একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে
আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোণে
সবুজ বনে নীলচে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন ভেজা মাটিতে পা ফেলে
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে…
গান শেষে কুহক ওই চাঁদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। রিনরিনে স্বরে বলে ওঠে কিছু ভারি বাক্য,
-“খেলোয়াড়ের হেরে যাওয়া অবধি খেলাটা চলবে। শুরুটা আপনার কথামতো হলেও, শেষটা আমি ভিন্নভাবে সাজিয়েছি। আপনাকে চাওয়া বাদে আমার মনের প্রতিটি চাওয়া আমি পূরণ করেছি, করে যাচ্ছি। কুহকিনী বড়ো অদ্ভুত, মিস্টার! আপনি হারালেন চমৎকার কিছু। আই ওয়োন্ট মাইন্ড! আমার ভাগ্যে অবশ্যই আপনার চেয়েও বেটার কিছু আছে।”
এই পর্যায়ে গম্ভীর লোকটার আওয়াজ কোমল হয়,
-“পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত পুরুষটি তোমার হোক।”
_____
মেহেদী লাগিয়ে প্রিয় ছাদে উঠে এলো। অদূরে শরৎ আর প্রহরকে দেখতে পেল কিছু একটা নিয়ে বেশ কঠিন মুখে আলোচনা করতে। প্রিয় দাঁড়িয়ে পড়ে। না চাইতেও কিছু বাক্য তার কানে চলে আসে।
শরৎ বলছে,
-“আবার যোগাযোগের চেষ্টা করবে ও।”
-“সাধ্যে থাকলে একটা খুন করতাম।”
-“ইচ্ছে তো তাই করে রে, প্রহর।”
-“তাহলে দেরি কীসের, ভাইয়া? একটা খুনই তো। চলো করি।”
শরৎ প্রহরের পিঠ চাপড়ে বলে,
-“এভাবে না! মৃত্যু সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে না।”
-“হুম..”
-“মন খারাপ করিস না। আর কয়েকটা মাস অপেক্ষা কর। আমাদের কলিজার টুকরোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি ওর রুহ কাঁপানো শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।”
প্রিয় এগিয়ে গিয়ে শুধায়,
-“কী নিয়ে কথা বলছ?”
দুটো পুরুষই অপ্রস্তুত হয়ে উঠল একই সঙ্গে।
চলবে…