শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-৩৭+৩৮

0
322

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৭|

সাপ্তাহিক ছুটি। প্রিয় ঘুম থেকে উঠেই হাতের কাজগুলো সেরে নিল। তারপর একটা লং শাওয়ার নিয়ে সাদা চুড়িদার পরল। ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে চুলগুলো বিনুনি করল। এরপর প্রহরকে নিয়ে বেরোল। প্রহর ড্রাইভ করছে। পাশে প্রিয় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে প্রহরকে জিজ্ঞেস করল,
-“আয়াত কখন আসবে?”

প্রহর ড্রাইভ করতে করতে বলল,
-“ওকে কলেজ রোড থেকে পিক করতে হবে।”
-“আচ্ছা, আর তোর প্রিয় অভিভাবক?”

কিঞ্চিৎ হাসল প্রহর,
-“ভাইয়া এসে যাবে সময়মতো।”

প্রিয় আর কিছু বলল না। মৃদু ভলিউমে গান ছেড়ে দিলো। বিনুনি ভেদ করে বেরিয়ে আসা চুলগুলো টুকিটাকি গুছিয়ে নিতে নিতে গাড়ির বাইরের দৃশ্যে দৃষ্টি স্থাপন করল।

প্রিয় যখন সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি বিলাসে মত্ত৷ এমন সময় তার ফোনে ম্যাসেজ আসে। প্রিয় ফোনস্ক্রিন অন করে নোটিফিকেশন প্যানেলে দেখতে পেল—শ্রেয়ানের ম্যাসেজ। হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি পাঠিয়েছে। প্রিয় ছবিগুলো ওপেন করল। দেখতে পেল ওদের পুরোনো মুহূর্তের কিছু ক্যাপচার। সবগুলোতেই একে-অপরের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ অবস্থায় লেগে আছে। ছবির গল্পগুলোতে অতকিছু না হলেও, আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে লাগবে দু’জনের অন্তরঙ্গতা। একটা ছবিতে প্রিয় চোখ বন্ধ করে হাসছে আর শ্রেয়ান তার কানের নিচে, গলার কাছটায় চুমু খাচ্ছে। অন্যটাতে মিরর পিক, বেশ কাছাকাছি অবস্থায়। আরেকটাতে প্রিয় ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এরকম কিছু ছবি।
আবার কিছু ছবিতে প্রিয় হাসছে আর শ্রেয়ান গালে হাত দিয়ে দেখছে। প্রিয় এটা সেটা বলছে, শ্রেয়ান তাতেও কেমনভাবে প্রিয়কে দেখে যাচ্ছে। এই ছবিগুলো ব্যাকক্যামেরায় তোলা। শ্রেয়ানের কোনো বন্ধু তুলেছিল হয়তো।

প্রিয়র বুকে কেমন অদ্ভুত ব্যথা হলো। এসব দিয়ে সে কী প্রমাণ করতে চাইছে? ভেতরটা কেমন তিতকুটে হয়ে এলো। তখন সে শ্রেয়ানের পাঠানো ম্যাসেজটা পড়ল। লেখা আছে,
-“আ’ম মিসিং দ্যো’জ ডেইজ, সোনা!”

প্রিয় সিটে সপাটে গা এলিয়ে দিয়ে লম্বা শ্বাস টানল। বিষয়টা প্রহর লক্ষ করে দক্ষ হাতে গাড়িটা তৎক্ষনাৎ সাইডে থামিয়ে নিয়ে প্রিয়র দিকে তাকাল,
-“আর ইউ ওকে?”

প্রিয় মাথা নাড়ায়,
-“আ’ম ওকে।”
-“লাগছে না। কোনো সমস্যা, আপু?”
-“উঁহু।”

প্রিয় যেহেতু বলতে চাইছে না, প্রহরও আর জিজ্ঞেস করল না। পানির বোতলটা নিয়ে প্রিয়র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“পানি খা।”

প্রিয় বিনাবাক্যব্যয়ে পানির বোতল নিয়ে গটগট করে আধখানা শেষ করে বোতল ফিরিয়ে দিলো। প্রলম্বিত আরও একটা শ্বাস টেনে নিজেকে স্থির করল। প্রহর সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা মুখের ভাব তার। গোপনে অন্য হাত দিয়ে দক্ষ হাতে কাকে যেন ম্যাসেজ করল,
-“মুড অফ হয়ে গেছে ওর।”

প্রিয় আবার ফোন হাতে নিল। শ্রেয়ানের ম্যাসেজটা পড়ে ফের লিখল,
-“এসব ছবি এখনও রেখেছ?”

সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ এলো,
-“রাখব না?”
-“না।”
-“তুমি কি ভাবছ প্রিয়শ্রী, আমি তোমায় ব্ল্যাকমেইল করব?”
-“ভাবাটা অস্বাভাবিক?”

শ্রেয়ান হাহা ইমোজি দিলো একটা। তারপর লিখল,
-“আমার করে ধরে রাখতে সর্বোচ্চটা করব।”

প্রিয় সিন করে রেখে দিলো। এর সাথে কথা বলে এখন এত সুন্দর দিনটা ঈর নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। তারপর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লগ ইন করল। শরতের আইডি থেকে আর ম্যাসেজ আসেনি দুদিনে। প্রিয় তার টাইমলাইনে চলে গেল। শরৎ দুদিন আগে পোস্ট করেছিল ব্রিজের ওখান থেকে চাঁদের ছবি। ঠিক চাঁদের নিচে ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে একটা আবছা ছায়ামূর্তি। শরৎ ক্যাপশনে লিখেছে,
-“উজ্জ্বল চাঁদের নিচে আঁধারিয়া দাঁড়িয়ে। আমি চাঁদকে দেখার অবকাশ পাচ্ছি না, আঁধারিয়াকে কি তবে আমি ব্ল্যাকহোল নাম দেবো?”

শতাধিক রিয়্যাক্ট-কমেন্ট। প্রিয় চুপটি করে কমেন্ট বক্সে ঢুকে পড়ল। একটা ছেলে কমেন্ট করেছে,
-“বড়ভাই, গোপনে বিয়ে-টিয়ে করে ফেললেননি?”

আরেকজন কমেন্ট করেছে,
-“ভাই, আপনার ব্ল্যাকহোলকে সামনে আনেন এবার। আর কতকাল আমরা দেবরজাতি ভাবিহীনা থাকব?”

রিধিমা কমেন্ট করেছে,
-“দাদাভাই, তুমি সেরা। তলে তলে বহুদূর?”

আরও অনেকে অনেক ধরনের কমেন্ট। শরৎ রিপ্লাই দেয়নি, কেবল লাভ-রিয়্যাক্ট মেরে রেখে দিয়েছি। হঠাৎ করে নোটিফিকেশন এলো শরতের নতুন পোস্টের। প্রিয় দেখল, শরৎ একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। জাস্ট একটা শব্দ, “কামিনীফুল!”

শরৎ সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে নিজে একটা কমেন্ট রেখে গেল, “কামিনীফুল থেকে আজ সুখঘ্রাণের বদলে দুঃখঘ্রাণ পাচ্ছি। তাই দুঃখ মেটাতে এক মুঠো কামিনীফুল আমি আপনাকে দিলাম..”

কখন যে প্রিয়র উদাসী ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ধরা দিলো, সে টেরও পেল না। খেয়াল করল প্রহর। অদৃশ্য এক মুচকি হাসি প্রহরের ঠোঁটেও ধরা পড়ল। পুনরায় গোপনীয়তার সাথে একজনকে ম্যাসেজ করল, “থ্যাংক্স, ভাই।”

প্রিয় বেখেয়ালি চিত্তে বাইরে চেয়ে রইল। প্রহর কলেজ রোডে এসে গেছে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আয়াতকে কল দিলো। আয়াত রিসিভ করতে সময় নিল। কিছু বললও না ফোন কান তুলে। প্রহর ব্যাপারটা ধরতে পেরে শুধাল,
-“সাওদাহ্?”

আয়াত চোখ বুঁজে নিল। তার পুরো নাম মেহেরিন আয়াত সাওদাহ্। দাদাজান মেহেরবিবি বলে ডাকেন। আর বাকিসবাই আয়াত। তার ‘সাওদাহ্’ নামটায় কেউ তাকে ডাকে না বলে মনের মাঝে তার ভীষণ দুঃখ। এই দুঃখ কাউকে বলতে পারে না সে। তারপর হুট করেই একদিন লক্ষ করল, প্রহর তাকে নাম ধরে ডেকেছে। প্রহর এই অবধি তাকে ৮ বার নাম ধরে ডেকেছে। এটা নবমবার। আর সে এই সাওদাহ্ নামটাতেই তাকে ডাকে। আস্তে করে ডাকসূচক জবাব নিল আয়াত,
-“হু-উম?”
-“কোথায়?”
-“বাড়িতে।”
-“আসবি না?”
-“আসব।”
-“আয়।”
-“তুই?”
-“তোর বাড়ির নিচে।”

আয়াত ত্বরিতে চোখ খোলে। প্রথমে ভেবেছিল প্রহর নিশ্চয়ই মজা করেছে, আসবে না, এমনিই বলেছে। কিন্তু? আয়াত দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় ছুটল। প্রহরের গাড়ি দেখতে পেল। প্রহর জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে বাইরে তাকাল। এরকম জ্বলজ্বলে দৃষ্টিকে আয়াত কখনও উপেক্ষা করতে পারে না। কী যেন হলো তার। ওমনিই ফোন কানে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহরের ঠোঁট কিঞ্চিৎ বায়ে প্রসারিত হলো। কল এখনও কাটেনি। কানে রাখা ফোনটির মাধ্যমে আয়াতকে বলল,
-“দু’মিনিটে না এলে তোকে রেখেই চলে যাব।”

আয়াত এতটাই সম্মোহিত হয়ে আছে যে প্রহরের কণ্ঠের রসিকতার আভাস সে পেল না। কথাটাকে ভীষণ সিরিয়াসভাবে নিয়ে বলল,
-“না না না প্লিজ, এই তো আসছি আমি। একটু ওয়েট। প্লিজ প্লিজ।”

আয়াত দৌড়ে রুমে ছুটল। প্রহর ফিক করে হেসে ফেলল। প্রিয় তখন ওর দিকে তাকাল। ওকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“কী?”

প্রহর বলল,
-“আয়াত ভেবেছে আমি আসব না।”

প্রিয় ভ্রু-কুঁচকে বলল,
-“তুই কি এর আগেও আসবি বলে আসিসনি?”
-“এক্সাক্টলি।”

প্রহর মিটিমিটি হাসছে। তারপর আবার বলা শুরু করল,
-“হিমু হুটহাট রূপাকে বলত নীলশাড়ি পরে সেজেগুজে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। সে কণ্ঠ ভীষণ সিরিয়াস করে বলত, সে আসবে। সে আসত না। রূপা জানত সে আসবে না, তবুও খুব যত্ন করে সাজত। বিষয়টা আমার কাছে ভীষণ ইন্ট্রেস্টিং লাগে।”

প্রিয় চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“আর তুই এটা আয়াতের সাথে এপ্লাই করেছিস?”

প্রহর হাসি চেপে রেখে বলে,
-“কয়েকবার। প্রথম যেদিন আমি নিজ থেকে বললাম, দেখা করব। ওর বাড়ির সামনে আসব। ও তখন কী খুশি। তারপর সাজগোজ করল। আমি ফোন অফ করে রেখে দিলাম। ফোন অন করলাম রাত ১১টার পর। আর তখনই ওর কল আসে। মেবি টানা কল দিয়েই যাচ্ছিল। খুব অভিমান করেছিল আর অনেক অভিযোগ। আমি চুপ হয়ে শুনে গেছি। এরপর আবারও এরকম করেছি, সেদিনও অভিমানে গাল ফুলিয়েছিল, অভিযোগ করেছিল। চতুর্থবার অভিমানও করেনি, অভিযোগও না। তবে সেজেছিল। সপ্তমবার থেকে বিশ্বাস করা বন্ধ করেছে। তবুও বার বার সেজেছে। সেজে অনেক অনেক ছবি তুলে আমার ইনবক্স ভর্তি করে ফেলেছে। তাই আজকে ওর ধারণা ছিল, আমি আসব না। আর আমি এসে কী দারুণভাবেই না চমকে দিলাম!”

প্রিয় দৃঢ়তা নিয়ে প্রহরকে বলল,
-“ভাই, শোন। একটা কথা বলি। যেই কাজটা তুই করেছিস, সেটা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে দেখা গেলে ভীষণ ইন্ট্রেস্টিং একটা ব্যাপার। কিন্তু তুই মন ভেঙেছিস, একাধিকবার। যেই মেয়েটা তোকে এত ভালোবাসে, সেই মেয়েটার মন এভাবে আর ভাঙিস না।”

প্রহর প্রিয়র হাতটা ধরে বলল,
-“ওকে আমি সহস্রবার কষ্ট দেবো, তারপর জানাব সুখ কত সুন্দর। সববারই যদি সুখ দিয়ে যাই, ও এর মূল্য বুঝবে না, সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। ওর এক্সপেক্টেশন আরও বেড়ে যাবে। এক্সপেক্টেশন জিনিসটা মারাত্মক বাজে। আমি চাই না এমন কিছু হোক।”

প্রিয় এমনভাবে তাকাল যেন দারুণ কিছু শুনেছে। পুরুষ মানুষের দুটো চমৎকার ক্ষমতা আছে; প্রথমত নারীকে সম্মোহন করার, দ্বিতীয়ত তাকে কষ্ট দেওয়ার।
আয়াত এলো তখন। আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। এসে পেছনের সিটে বসে প্রিয়কে বলল,
-“আ-রে, আপু! কেমন আছ?”
-“ভালো, তুমি?”
-“ভালো।”
-“এই প্রহরটা আমাকে জানায়নি তুমিও আসবে।”

প্রিয় প্রহরের বাহুতে মেরে বলল,
-“ওকে উঠতে বসতে মারা উচিত, আয়াত। নেহাতই তুমি ভীষণ লক্ষ্মীমন্ত একটা মেয়ে। নাহলে এই হারামিকে টলারেট করে কে?”

প্রহর কেশে উঠল। আয়াত মেকি হাসছে প্রিয়র কথা শুনে। ব্যাপারটা কী ফানি! সে আর লক্ষ্মীমন্ত? প্রিয় বিশেষণ খুঁজে পেল না আর?

রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন ঘড়িতে বাজে আড়াইটার এদিক-ওদিক। আয়াত জানালা ঘেঁসে চেয়ারে বসল। বিপরীতে মুখোমুখি প্রহর। আয়াতের পাশে প্রিয় বসেছে। শরৎ এলে ওকেও প্রহরের পাশে, প্রিয়র মুখোমুখি বসতে হবে। বিষয়টা ভেবে প্রিয়র কেমন অদ্ভুত অনুভূত হলো। প্রহর শরৎকে কল দিলো। রিসিভ হতেই স্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“ভাইয়া, কোথায়?”

শরতের গম্ভীর গলা পাওয়া যায়,
-“অন দ্য ওয়ে।”
-“আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?”
-“থ্রী মিনিটস।”

গুনে গুনে তিন মিনিটের মাথায় শরৎ ভেতরে প্রবেশ করল। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা প্রিয়দের টেবিলের দিকে হাঁটা দিলো। প্রিয় লক্ষ করল। শরতের পরনে সাদা শার্টের ওপর নেভীব্লু ব্লেজার। বাঁ হাতে ওয়াচ। চুলগুলো বেশ দারুণভাবে সেট করা। চোখে মাইনাস পাওয়ারের গ্লাস। ভাবলেশহীন মুখটায় হাসি নেই। শরৎকে দেখে প্রহর উঠে দাঁড়াল। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে শরতের সাথে হ্যান্ডশেক করে একবার আলতো হাতে একে-অপরকে দুজন জড়িয়ে ধরল। শরৎ জিজ্ঞেস করল,
-“অ্যাম আই ঠু লেইট?”
-“নোপ..”
-“একটা মিটিংয়ে আটকে গেছিলাম অ্যাকচুয়ালি।”

এর মাঝে শরৎ একবারও প্রিয়র দিকে তাকায়নি। প্রহর নিজের জায়গায় বসে পড়লে, শরৎ সোজা এসে প্রিয়র প্রতিমুখে রাখা ফাঁকা চেয়ারটিতে বসে পড়ল। আর ঠিক তখন প্রিয়র দিকে তাকাল। প্রিয় সেই কখন থেকে শরতের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ফেরানোর নাম নেই। শরৎ সামান্য কেশে মনোযোগ আকর্ষণ করল।

প্রিয় থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। শরৎ ওকে আরও খানিকটা অপ্রস্তুত করে দিতে বলে উঠল,
-“কেমন আছেন, ম্যাডাম? লং টাইম, নো সী..হু?”

যাহ! কী বলে এসব? কাল দিন আগেই না গোটা এক সন্ধ্যে কাটাল? গোটারাত বকবক করল। প্রিয় বিরবির করে বলল,
-“ছাই।”

শরৎ শুনতে পেল, আর জোরে-শোরেই বলে উঠল,
-“কী? ভালো নেই? ছাই আছেন?”

প্রিয়ও আওয়াজ উঁচুতে তুলে বলল,
-“না, আপনার মাথা আছি। ব্যাঙের ছাতা। ছাতার মাথা।”

প্রহর আর আয়াত ওদের দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। শরৎ প্রিয়র রাগকে আরও দু’ধাপ বাড়িয়ে দিতে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল তখন।

চলবে..

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৮|

-“কী? ভালো নেই? ছাই আছেন?”

প্রিয়ও আওয়াজ উঁচুতে তুলে বলল,
-“না, আপনার মাথা আছি। ব্যাঙের ছাতা। ছাতার মাথা।”

প্রহর আর আয়াত ওদের দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। শরৎ প্রিয়র রাগকে আরও দু’ধাপ বাড়িয়ে দিতে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল তখন। প্রিয় চেতে উঠল,
-“আশ্চর্য! আপনি এত ত্যাড়ামি করছেন কেন, নীরজ ভাই?”

নীরজ দু’কাঁধ উঁচিয়ে শুধাল,
-“কই?”
-“উফফ!”

প্রিয় অতিষ্ঠ। আর কিছু বলল না। শরৎও আর ওকে জ্বালালো না। ওয়েটার এলে ওরা খাবার অর্ডার দিয়ে ফেলে। এর ফাঁকে প্রিয়র ফোনে ম্যাসেজ আসে। প্রিয় দেখতে পায়, ওটা শরতের ম্যাসেজ,
-“সাদা পরেছেন কেন, প্রিয়?”

প্রিয় চোখ তুলে শরৎকে বড়ো স্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে দেখে দাঁত কিড়িমিড়ি করে লিখল,
-“আমার ইচ্ছে।”
-“আমিও হোয়াইট। ডোন্ট ইউ নোটিস দ্যাট কাপল লাগছে?”

প্রিয় খেয়াল করল। আসলেই লাগছে। প্রিয়র চুড়িদারটা সাদা রঙের, ওড়নাটা নেভিব্লু। ইশ! কী বাজে ব্যাপার। প্রিয় অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগল। শরৎ ফের ম্যাসেজ করল,
-“মন্দ হলো না। বিষয়টা সুন্দর।”
-“কচু সুন্দর।”
-“লাঞ্চে কচু খাবেন, প্রিয়? অর্ডার দেবো?”
-“আপনার মাথা খেতে ইচ্ছুক আমি। প্লিজ অর্ডার করুন।”
-“ওটা তো সারাক্ষণই খাচ্ছেন, ম্যাডাম। ট্রাই সামথিং নিউ।”
-“ছাই।”
-“ছাই দিয়ে কচু খাবেন?”
-“না ছাই দিয়ে মাথা খাব।”
-“এত মাথা খেতে হয় না। আসেন, ভাত খাই।”
-“নাহ, মজ্জা নাই লাইফে।”
-“ইউ নিড?”
-“কী?”
-“মজ্জা।”

প্রিয় ভাবল না, লিখে ফেলল,
-“ব্যাডলি নিড।”
-“ওকে ম্যাডাম। আজকের দিনটা তবে আপনার।”

প্রিয় আর কিছু বলার আগেই, শরৎ “ওয়েট, আসছি” বলে ওখান থেকে সরে এলো। রেস্টুরেন্টের পাশের ফ্লোর থেকে সিলিং অবধি কাঁচের গ্লাস। শরৎ সে গ্লাস স্লাইড করে করিডরে চলে এলো। এখানটায় রেলিং দিয়ে ছোট ছোট টবে বিভিন্ন রঙিন ফুল ঝুলিয়ে রাখা। শরৎ পকেট থেকে ফোন বের করে দক্ষ হাতে একটা নম্বরে ম্যাসেজ পাঠাল।
-“মিস্টার তায়েফকে বলে দেবেন আজ সন্ধ্যের মিটিংটা ডিলে হবে। নেক্সট ডেইট জানিয়ে দেবো।”

তারপর মেইডকে কল দিয়ে দিলো। বলল,
-“খালা, আজ রাতে কিছু বানানো লাগবে না। আমার ফিরতে দেরি হবে।”

আর সবশেষে গিয়ে কল দিলো নাহারাকে। কল রিসিভ করতেই সালাম দিলো শরৎ। নাহারা সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-“ভালো আছ, বাবা?”
-“হ্যাঁ, আন্টি। আপনি ভালো আছেন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ।”
-“প্রিয় আর প্রহর আজকে আমার সাথে ঘুরতে এসেছে, জানেন?”
-“হ্যাঁ, প্রহর বলেছিল। তোমরা একসাথে না?”
-“জি, আন্টি।”
-“আচ্ছা। কল দিলে যে? কিছু বলার ছিল? মনে তো হচ্ছে কিছু বলতে চাইছ!”
-“জি।”
-“বলো।”
-“বিশেষ কিছু নয়৷ আসলে ওদের ফিরতে আজ একটু দেরি হবে। এটা জানাতেই কল দিলাম।”
-“ওরা বড়ো হয়েছে তো, বাবা। ঘুরতে গিয়েছে। এখনও কি আগের মতো বলতে পারি, সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে?”

শরৎ হাসল,
-“আপনি ভীষণ সুইট, আন্টি।”
-“তুমিও শুরু করলে? ছেলে-মেয়ে দুইটা তো এই কথা ডেইলি উঠতে বসতে বলে।”
-“হ্যাঁ, সত্য কথা দিনে চোদ্দবার বলা যায়।”
-“পাগল ছেলে!”

শরৎ হেসে ফেলল। নাহারা বলল,
-“আচ্ছা, এনজয় দ্য ডে!”
-“থ্যাংক ইউ!”

কল কেটে নিশ্চিন্ত হয়ে শরৎ ব্যাক করল। প্রিয়র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিজের ফোনের দিকে নজর দিলো। ম্যাসেজ টাইপ করল,
-“একত্রে অনুভূতি চেনার যাত্রায় সর্ব প্রথম আমি আপনাকে স্ট্রিট লাইটের ধারে চা খাইয়েছি, আজ বরঞ্চ অন্য কিছু করি। বি রেডি।”

প্রিয় ম্যাসেজটা পেতেই ভ্রু-কুটি করে ফেলল। শুধাল,
-“কী করতে চাইছেন, নীরজ ভাই?”
-“আপনাকে আমার।”
-“যদি আমাকে আপনার করতে না দিই?”
-“তবে নিজেকে আপনার করে দেবো।”

প্রিয় বলার মতো কিছু পেল না। কিছুক্ষণের মাঝে ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করলে তারা খাওয়ায় মন দেয়। শরৎ বারে বারে আঁড়চোখে প্রিয়কে লক্ষ করে যাচ্ছে। বিষয়টা ধরতে পেরে প্রিয়র খাওয়া বন্ধ। প্রিয় অপ্রস্তুত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। প্রহরকে দেখছে। প্রহর আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে, ওদিকে খাওয়া ভুলে আয়াত সোজাসুজিভাবে প্রহরের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতেই পেয়েই প্রিয় বিষম খেল। শরৎ পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। প্রিয় পানি খেয়ে ওর দিকে তাকাল। শরৎ বাঁকাভাবে হেসে নিজের প্লেটে নজর দিলো।

খাওয়ার পালা শেষ হতেই প্রহর বলল,
-“ভাইয়া, আয়াত বলছিল ওর সাথে একটু বেরোতে হবে। তুমি কি আপুর সাথে থাকবে? কিংবা বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসতে পারবে?”

প্রশস্ত হেসে শরৎ বলল,
-“শিওর!”

আয়াত তখনই বলে উঠল,
-“আমি কখন বেরোতে বললাম…”

আয়াতের কথা শেষ করতে দিলো না প্রহর,
-“চল, আমরা বের হই। ভাইয়া, আপু! থাকো তোমরা।”

শেষ বাক্যটা শরৎ ও প্রিয়কে উদ্দেশ্য করে বলল। প্রহর ওদিক দিয়ে আয়াতের হাত ধরে বের হওয়ার তাড়া দিলো। আয়াতও কিছু বলল না আর। বের হয়ে গেইটের সামনে গিয়ে বলল,
-“এই বলদা, কই রে? আমি কখন তোকে বললাম বাইরে যাব?”

প্রহর ঠোঁট চেপে কোঁচকানো কপালে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল,
-“এত প্রশ্ন করতে নেই। কোথাও ঘুরবি আমার সাথে?”
-“কেন প্রশ্ন করব না?”
-“তুই কি চাস না আমার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে?”

আয়াত থতমত খেয়ে গেল। আমতাআমতা করতে লাগল। প্রহর হেসে বলল,
-“চল।”
-“কোথায় যাবি?”
-“রবীন্দ্র সরোবরে।”

___
প্রহর আর আয়াত চলে গেলেই প্রিয় কুঞ্চিত চোখে শরৎকে দেখে বলল,
-“এটা কী হলো, নীরজ ভাই?”

শরৎ বিল পে করে উঠে দাঁড়াল। সামান্য কেশে বলল,
-“ট্রিক্সস।”
-“বুঝিয়ে বলুন।”
-“কেন? আপনি কচি খুকি? বোঝেন না?”
-“এই নীরজ ভাই? এই! মুখ সামলান।”
-“না-হয় কী করবেন, প্রিয়?”
-“ছাই!”
-“ছাই দিয়ে মুখ খাবেন? ওয়াও! ঠু মাচ সুশীল!”
-“ধ্যাৎ!”

প্রিয় মুখ ফিরিয়ে নিল। শরৎ মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর পর প্রিয় দেখতে পেল আজ শরৎ বাইক আনেনি, কার এনেছে। শরৎ ফ্রন্ট সিটের ডোর খুলে ভেতরে প্রিয়কে উঠতে বসতে বলল। প্রিয় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
-“বাইক আনেননি কেন?”

শরৎ উলটো দিকে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলে,
-“সন্ধ্যেয় একটা মিটিংয়ের জন্য গাজিপুর যাওয়ার কথা ছিল। তাই ভাবলাম, ড্রাইভারসহ বের হই। গাড়িতে কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়া যাবে।”

প্রিয় মিররে নিজেকে দেখে বলল,
-“ড্রাইভার কই?”
-“আপাতত তার ছুটি দিয়েছি। তবে আপনার জন্য ড্রাইভার-রূপে স্বয়ং আমি নিজেই আছি।”

শরৎ লুকিং গ্লাসটা ঠিক করল। এখন তার কাছ থেকে প্রিয়কে দেখা যাচ্ছে, আর প্রিয় তাকালেই দু’জনের চোখাচোখি হচ্ছে। প্রিয় কেশে উঠল। জিজ্ঞেস করল,
-“আমাকে বাসায় ড্রপ করে দেবেন।”
-“জি না।”
-“কেন না?”
-“রাত হবে।”
-“এহ না! মা টেনশন করবে।”
-“পারমিশন নেওয়া আছে।”

প্রিয় কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-“কখন নিলেন?”
-“কোনো এক সময়।”
-“উফফ!”
-“হালকা ভলিউমে সফট গান ছাড়ুন, আরামসে বসুন।”

প্রিয় গান ছেড়ে গা এলিয়ে বসল। শরৎ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
-“আপনাকে শুনতে ইচ্ছে করছে, কথা বলুন।”
-“কী বলব?”
-“যা ইচ্ছে।”

প্রিয় কিছু বলছে না। সে ভাবছে, ঠিক কী বলবে। প্রিয়র ভাবুক চেহারা দেখে শরৎ মজা উড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কবিতা পারেন? হাট্টিমা টিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাড়া দুটো শিং। পারেন? এটাই শোনান।”
-“নীরজ ভাইইইই!”

প্রিয়র হুট করেই চিল্লিয়ে ওঠাতে শরৎ হেসে ফেলে বলল,
-“এভাবে তো আপনার মা আমাকে ছেলে, আপনার ভাই আমাকে বড়ো ভাই বানিয়ে ফেলেছে। এখন আপনিও কি কিছু-মিছু বানাতে চাইছেন?”

প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
-“নাহ। আমার আপনার মতো ভাইয়ের প্রয়োজন নেই।”
-“তো? আমার মতো কীসের প্রয়োজন? নিড বেটার হাফ?”
-“নিড নাত্থিং!”

প্রিয় গাল ফুলিয়ে বসল। শরৎ তখন হাতিরঝিলে চলে এসেছে। লো স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। একহাত স্টেয়ারিংয়ে, অন্যহাতে ফোন আনলক করে নোটপ্যাড বের করে প্রিয়র হাতে তুলে বলল,
-“এই কবিতাটা আবৃত্তি করুন। আপনার ভয়েসে শুনতে ইচ্ছে করছে।”

প্রিয় নরম হলো। শরতের ফোনটা নিজের হাতে তুলে নিল। আকাশে শীতল সমীর। গোধুলির নরম আলোয় প্রিয় একবার রাস্তার বাইরে তাকাল। ফের ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে পড়তে শুরু করল,

“এই শহরের অলিতে-গলিতে অসংখ্য হাহাকারের গল্প আছে। সন্ধ্যা নামলেই, স্ট্রিট লাইটের সাথে তা জ্বেলে ওঠে।
ওরা আকাশ দেখে,
ওরা উল্লাস দেখে,
ওরা সুখ দেখে,
ওরা যন্ত্রণা দেখে,
ওরা হেসে-খেলে রিকশায় ঘুরতে থাকা কপোত-কপোতীদের চোখে তৃপ্তি দেখে,
ওরা পথের ধারে বসে এক যুবকের বিচ্ছেদের নীরব অভিযোগ দেখে,
ওরা ও বাড়ির বারান্দায় গভীর রাত অবধি এক মেয়েকে ফোন কানে গুঁজে কখনও হাহা-হিহি করতে, তো কখনও লজ্জায় নুইয়ে পড়তেও দেখে,
ওরা এক মেয়েকে নিশ্চুপতায় অশ্রু বাহাতে দেখে,
ওরা বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে বেশি লাজুক, বাধ্য, পড়াকু ছেলেটার ঠোঁট হতে বের হওয়া নিকোটিনের ধোঁয়াও দেখে,
ওরা অসম্ভব চঞ্চল ছেলেটিকে রাত করে চুপ হয়ে যেতে দেখে,
ওরা বিশ্বাস ভাঙতে দেখে,
ওরা সবসময় ভুল মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখে,
আড়ালে নিঃসঙ্গতায় কাউকে গুমরে কাঁদতে দেখে,
ওরা আরও অনেক কিছু দেখে।
এই শহরের স্ট্রিটলাইট অসংখ্য গল্প জানে..
ওরা দীর্ঘশ্বাস জানে, ওরা সাক্ষী…”

অতঃপর হুট করেই প্রিয়র গলায় কাঠিন্য চলে এলো। হিম হয়ে এলো দৃষ্টি। চকিতে তাকাল শরতের দিকে। ওর আবৃত্তি শেষ হতেই অন্যদিকে তাকিয়ে শরৎ বলল,
-“ওরা আপনার গল্পটাও জানে।”

প্রিয় প্রশ্ন করে,
-“আর আপনার?”
-“আমার কী?”

শরৎ হাসে। প্রিয় সুক্ষ্ম নজরে ওকে দেখে শুধায়,
-“আপনি ভালো আছেন, নীরজ ভাই?”

শরৎ পালটা প্রশ্ন করে,
-“আপনি ভালো আছেন, প্রিয়?”

প্রিয় জবাব না দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল, অতঃপর সামান্য হাসল। একইভাবে শরৎও হেসে বলল,
-“আমিও।”

চলবে…গল্পের