শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-৪১+৪২

0
441

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪১|

-“ডাইনিংয়ের চেয়ারের ওপর দশ বছরের অভুক্ত বাচ্চার মতো ছটিয়ে ছিটিয়ে খাবার খেতে থাকা মেয়েটার চোখে কি আমি ইনভিজিবল? একবার এসে সালামটাও দিলো না। কী অভদ্র!”

শরতের গলায় নাহারা রসিকতার আভাস পেলেন। ঠোঁট চেপে হেসে প্রস্থান ঘটালেন। প্রিয় তবুও এদিকে তাকাল না। খেতে খেতে বিরবির করল,
-“বেয়াদ্দব ব্যাটালোক!”

শরৎ ফিক করে হেসে ফেলল। প্রহর হাসি চেপে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। শরৎ ধীরপায়ে কয়েক কদম ফেলে প্রিয়র পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
-“এদিকে তাকান, ম্যাডাম। একটু ভালোভাবে দেখি আপনাকে।”

প্রিয়র খাবার গলায় আটকে গেল ততৎক্ষণাৎ। শরৎ পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। প্রিয় সামান্য ঝুঁকে পানিটা হাতে নিল। গটগট করে পুরোটা খেয়ে শরতের দিকে তাকাল। দেখতে পেল, শরৎ এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুমে ফুলো চোখ-মুখ, চুলগুলো এলোমেলোভাবে হাতখোঁপা করা, সামনে কিছু চুল ছড়িয়ে আছে। পরনে হাফ হাতার ছাই রঙা টিশার্ট আর ঢিলা পালাজ্জো, গলায় স্কার্ফ। শুভ্র শরীরটা কেমন গোলাপি আভা ছড়াচ্ছে। গালদুটো লালচে হয়ে আছে। ফুলে থাকা চোখ, ঠোঁট, গাল! শরৎ চোখ ফেরাতে পারছে না। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
-“প্রস্ফুটিত ফুল!”

প্রিয় শুনতে পেল না ঠিক, পালটা শুধাল,
-“হুঁ?”

কথার প্রসঙ্গটা ভারি চমৎকারভাবে শরৎ এড়িয়ে গেল আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা দ্বারা,
-“শ্রেয়ানের চ্যাপ্টার ক্লোজড?”
-“মেবি।”
-“ইয়েস অর নো?”
-“মেবি ইয়েস।”
-“সামনে থেকে মেবি রিমুভ করুন।”
-“ক্লোজড।”

শরৎ প্রশস্ত হাসল,
-“এবার কী সিদ্ধান্ত?”

চামচে খাবার তুলতে তুলতে প্রিয় বলল,
-“মা বিয়ের কথা তুলেছে, সেটাই ভাবছি।”
-“পজিটিভ কিছু?”
-“হুঁ।”

শরৎ আর কিছু বলল না। প্রিয়-ও খাওয়া শেষে নিজের রুমে চলে যায়। নাহারা এরপর অনেকটা সময় নিয়ে শ্রেয়ানের ব্যাপারে বিভিন্ন কথা-বার্তা বললেন শরতের সাথে। শরৎ নাহারাকে নিশ্চিত করল, সে সবটা দেখে নেবে। ছেলেটার নিশ্চিতকরণ গুটি কয়েক বাক্যেই নাহারার মন থেকে সকল দুঃশ্চিন্তা দূর হলো।
প্রিয় আর ঘর থেকে বের হয়নি। শরৎও নাহারাকে আরও ক’বার আশ্বস্ত করে চলে গেল।

___
এরপরের মাসেই বাড়িতে প্রবেশ হলো মনোহরা শিকদার, সানোয়ার শিকদার, শাহানাজ, নীহিন, নিশান ও শরৎ এর। প্রিয়র সকালে একটা জব ইন্টারভিউ ছিল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর তখন। দরজা খুলল মেইড। ক্লান্ত শরীরে ভেতরে বাড়িতে প্রবেশ করে বসার ঘরে নসিরুদ্দীন সাহেবের পাশে বসে খোশমেজাজে গল্প করতে থাকা সানোয়ার সাহেবকে দেখে প্রিয় কিঞ্চিৎ অবাক হলো। আচমকা তার দিকে সানোয়ার সাহেব তাকাতেই তড়িঘড়ি করে সম্বোধনসহ সালাম দিয়ে উঠল। সানোয়ার সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আম্মু। কেমন আছ?”
-“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ।”
-“আঙ্কেল, কখন এলেন?”
-“এই তো, ঘন্টা ২-৩ হয়েছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর কথা হবে।”

ব্যাপারটা বুঝতে না পেরেও প্রিয় মাথা নেড়ে ইতিবাচকতা প্রকাশ করল। এরপরই তাকাল ডানদিকের কিচেন বরাবর জায়গাটিতে। নাহারার সাথে হেসে হেসে গল্প করছেন এবং রান্না করছেন শাহানাজ। প্রিয় আরেকটু অবাক হলো। এগিয়ে যেতেই শাহানাজ মুচকি হেসে বললেন,
-“আ-রে! এসে গেছ, আম্মু?”
-“জি। ভালো আছেন, আন্টি?”
-“হ্যাঁ। তুমি?”
-“ভালো।”

প্রিয় আঁড়চোখে ওর মায়ের দিকে তাকাতেই নাহারা চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। প্রিয় শান্ত রইল। জিজ্ঞেস করল, কে কে এসেছেন। নাহারা প্রশ্নের উত্তর দিতেই প্রিয় নাহারার রুমে গিয়ে মনোহরার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। এরপর নিজের রুমে গিয়ে নীহিনকে একা একা বসে বসে ফোন টিপতে দেখেই বলল,
-“ফ্রেশ হয়ে আসি, পাঁচ মিনিট। তুমি রেডি হতে থাকো আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে।”

ফিক করে হেসে বলে নীহিন,
-“আচ্ছা, প্রিয়দি।”

প্রিয় ফ্রেশ হয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আরেক হাতে নীহিনের হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসাল, এরপর নিজে বসল পাশে। উত্তেজিত চিত্তে শুধাল,
-“কাহিনি কী, কখন এসেছ? হঠাৎ?”

নীহিন কোমল গলায় বলে,
-“গতকাল আমি, মা আর ছোটদাভাই এসে দাদাভাইয়ের এপার্টমেন্টে উঠেছি। প্ল্যানিং এক মাস আগে থেকে ছিল। পরে আজ বাবা আর দিদা সকালে এসেছে দাদাভাইয়ের বাসায়। ওখান থেকে গোছগাছ করে ১১টার দিকে আমরা এখানে এসেছি। এসে দেখলাম তুমি নেই, তাই অপেক্ষা করছি। দাদাভাইয়েরা প্রহর ভাইয়ার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।”

প্রিয় নীহিনের হাত শক্ত করে চেপে ধরল,
-“উদ্দেশ্য কী আসার?”

নীহিন সরু চোখে তাকায়,
-“জানো না?”
-“কী?”
-“তোমার বিয়ের কথা চলছে।”

প্রিয় কিঞ্চিৎ ভড়কাল। অস্বাভাবিক বিষয় তো নয়। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে নিশ্চিতকরণ প্রশ্ন বলল,
-“তোমার দাদাভাইয়ের সাথে?”

নীহিন ঠোঁট উলটে বলল,
-“তা নয় তো আর কার সাথে?”

প্রিয় গা ছেড়ে বসে রইল। থমথমে আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,
-“ফ্যামিলি জানে কবে থেকে?”

নীহিন ভ্রু কোঁচকালো, সেভাবেই বলল,
-“ফ্যামিলিই তো এরেঞ্জ করল। মা রিধিমাদির মায়ের সাথে তোমার ব্যাপারে অনেক আগেই কথা বলে রেখেছিল। সেভাবে এগোয়নি বিষয়টা। এরপর সেবার তোমরা এলে না বাড়িতে? রিধিমাদির বিয়ের আগেই নাহারা আন্টিকে দিদা সরাসরি প্রপোজাল দেন। আন্টি তখনই রাজি হয়ে যান। কিন্তু তুমি নাকি তখন বিয়ে করতে চাইতে না, তাই আর জানানো হয়নি। এর আগেও দিদা একবার পাকা কথা বলতে তোমাদের বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। দাদাভাই জানাল, কী একটা নাকি ঝামেলা হয়েছে এ বাড়িতে, তাই আর আসা হয়নি।”

প্রিয় থেমে থেমে বলল,
-“ওয়াও! নাইস!”

প্রিয়র বলার ভঙ্গিমায় নীহিন হেসে ফেলল। প্রিয় ওর দিকে তাকিয়ে শুধাল,
-“তারমানে সব পারিবারিক? তোমার দাদাভাইয়ের দিক থেকে কচুটিও নেই?”
-“আছে না! অবশ্যই আছে। নয়তো প্রিয়দির সোশ্যাল একাউন্টের বায়োতে ‘কামিনী ফুল’ লেখা আর দাদাভাইয়ের কভারে একগুচ্ছ কামিনী ফুলের ছবি কেন থাকবে?”

প্রিয় কেশে উঠল,
-“অতদিকে নজর কেন যায়? হু?”

নীহিন হেসে প্রিয়র হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“ও রুমে সব ছেলে। আমার একা যেতে লজ্জা লাগছিল। চলো যাই।”

প্রিয় ‘লজ্জা লাগা’ বলতে নীহিনের জন্য প্রহরের উপস্থিতি ছাড়া কিছুই পেল না। নীহিনের টানতে থাকা হাতটা ধরে থামিয়ে ফেলল প্রিয়। নীহিন পিছে তাকাতেই সে মলিন গলায় আবৃত্তি করে উঠল,

-“যারে তুমি পাবে না,
তার তরেতে মন হারিয়ো না।
তারে তুমি পাবে না, যারে পাওয়ার অভিপ্রায়ে
দুনিয়া হারিয়ে ফেলতে পারো একটি পলকেই…
তারে পাবে না,
যারে পেতে বরণ করেছ কষ্ট-যন্ত্রণা-ব্যথা-বিষ আমরণ!
একজীবন, একমরন—কেবল একজনাকেই দাও।
যেজন তোমার জন্য যোজন মুগ্ধ-চোখে ঘুরবে সা-রা-টা জীবন।”

নীহিন থমকে গেল। ব্যথাটা কোথায় লেগেছ, তার বহিঃপ্রকাশ সে ঘটাল না। একরাশ মুগ্ধ গলায় বরঞ্চ বলল,
-“ও-মা প্রিয়দি! কী সুন্দর আবৃত্তি জানো গো!”

প্রিয় তাকিয়ে রইল। নীহিন মুচকি হেসে বলল,
-“টের পেয়েছিলে কিছু, প্রিয়দি?”

প্রিয় ইতিবাচক ভঙ্গিমায় মাথা নাড়লে নীহিন বলে,
-“আর ছোট্টটি নেই। কাকিমণি বলেছে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। ক’টা বছর পর নিজের সংসার হবে, বাচ্চা-কাচ্চা সামলাতে হবে। এখনও কি বাচ্চাদের মতো কোনো কিছুর প্রতি জেদ দেখিয়ে চাইতে পারব নাকি? টেনশন নিয়ো না। কিচ্ছু চাই না আমার।”

প্রিয় নীহিনের বাহুতে হাত রাখে। ব্যথাটা সে নিজে অনুভব করতে পারে। খুব করে পারে। সে এখন বুঝতে পারছে নীহিনের কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটা কী সুন্দর হাসছে! প্রকাশ করছে না কিছুই! এমন শক্ত মেয়েও হয়? নীহিনকে প্রিয় খুব নাজুক মনে করেছিল। নীহিন নিজেকে দেখিয়ে দিলো। হেসে হেসে বলল,
-“চলো যাই।”

প্রিয় আর নীহিন মিলে প্রহরের রুমে যেতেই, নিশান লাফিয়ে এদিকে চলে এলো। প্রিয়র পাশে দাঁড়িয়ে শরৎকে বলল,
-“ব্রো, কেমন মানাচ্ছে?”

শরৎ আইব্রো উঁচিয়ে বলল,
-“জোস! তবে পাশেরটা বেশি জোস!”

নিশান হেহে করে হেসে বলল,
-“দেখতে হবে না কার ভাবি?”

প্রিয় গিয়ে সোজা শরতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। শরৎ শুধাল,
-“কী?”
-“কথা আছে, উঠুন।”

পাশ থেকে নিশান আর নীহিন ঠোঁট চেপে হাসতে লাগল। প্রহর এদিকে একবারও তাকাচ্ছে না। ফোনে ডুবে আছে। একফাঁকে কানে হেডফোনও লাগিয়ে ফেলল। শরৎ না উঠলে প্রিয় ওর হাত ধরে টেনে ওঠায়। নিশান বলে,
-“আরে ভাবি, করছেন কী? ওটাকে তো আজীবনের জন্য বুকড করে দেবো। এখন আমাদেরও সুযোগ দিন।”

প্রিয় নিশানকে বলল,
-“কচু দেবো তোমায়। এই চুল এত বড়ো করেছ কেন? কী বিশ্রী দেখাচ্ছে! কালই কাটবে। এরপর সামনে আসবে।”
-“আরেহ, কিউটিপাই! সেদিন না ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার দিলে বড়ো চুলওয়ালা ছেলেদের তোমার পছন্দ? তাই তো আমি আর দাদাভাই মিলে চুল বড়ো করার মিশনে নেমেছি। এদিকে খেয়াল দিলে, ওদিকে দিলে না? তবে কি ধরে নেব, ভাবি? হু হু?”

নিশানের শেষ কথাগুলোর রসিকতা মাত্রাতিরিক্ত। প্রিয় মুখ গম্ভীর করে বলল,
-“ঢং করবে না, তোমাকে মোটেও সুন্দর লাগে না ঢং করলে। পুরো জংলী দেখাচ্ছে বড়ো চুলে, বুঝেছ? তোমাকেও, তোমার দাদাভাইকেও।”

নিশানের কিছু বলার আগেই প্রিয় শরৎকে বলে উঠল,
-“এই যে, নিশান-নীহিনের দাদাভাই, আপনি কি আমার সাথে আসবেন? নাকি এখানেই কথা কন্টিনিউ করব? বুঝবেন কিন্তু ব্যাপারটা। আমি যে-কোনো কথাই বলতে পারি এখানে।”

নিশান বলল,
-“অভিয়েসলি ভাবি, এখানেই বলো।”

শরৎ কেশে উঠল,
-“না, প্রিয়। চলুন আমরা অন্য জায়গায় যাই।”

উঠে দাঁড়াল শরৎ। নিশান আর কিছু বলতে গেলে শরৎ কড়া চাহনি দিয়ে ওর দিকে তাকায়, কাঠখোট্টা আওয়াজে বলে,
-“প্রাইভেসি দে, ব্যাটা। নইলে তোর বেলায় আমাদের বাচ্চাকে তোর আর তোর বউয়ের মাঝে রেখে আমি আর আমার বউ মিলে চিল করব।”

ভয় পেল নিশান,
-“নাহ, তোমরা যাও। হ্যাভ অ্যা জোস প্রাইভেট মিটিং।”

_____
শরৎ আর প্রিয় মুখোমুখি প্রিয়র বারান্দায় বসে আছে। শরৎ বাম হাতের ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাল। বিগত ১৩ মিনিট ধরে তারা এখানে বসে আছে, আর প্রিয় ১১ মিনিট ধরে নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। অধর বাঁকিয়ে সামান্য হাসল শরৎ,
-“কী, ম্যাডাম? কিছু বলবেন নাকি শুধু দেখবেন? অপশন টু চ্যুজ করলে আমিও সেভাবে দেখানোর জন্য প্রস্তুত হব।”

প্রিয় নির্বিকারত্ব নিয়ে বলল,
-“আপনি বিয়ে করবেন, নীরজ ভাই?”
-“কাকে?”
-“আমাকে।”
-“মনে তো তাই হয়।”

প্রিয়র গলার আওয়াজ আরও কঠিন হয়ে এলো,
-“মজা করছি না।”

এ পর্যায়ে শরৎ প্রিয়র চোখে চোখ রেখে নির্বিকার মুখে বলল,
-“আপনাকে বিয়ে করতে চাই, প্রিয়। আপনি রাজি?”

প্রিয়র বুকের ভেতরে কোথাও একটা কিছু হলো, সে টের পেল, অথচ কিছু বলতে পারল না। শরৎ নিজেও আর কিছু বলল না। ঘড়ির কাটায় আরও ৫টা মিনিট এগোতেই প্রিয় বলে উঠল,
-“আমার সময় চাই।”
-“বিয়ের পর এনাফ সময় দেবো।”
-“একাকিত্ব চাই।”
-“শত চাওয়াতেও তা দিতে পারব না।”
-“কেন?”
-“আপনাকে এক মুহূর্তের জন্যও একা রাখা সম্ভব নয় আর। আমি প্রোফেশনাল লাইফে কনসেন্ট্রেট করতে পারি না। মনে হয়, আমার একাংশ এখানে, বাকি অংশ কোথায় একটা পড়ে আছে।”

প্রিয় বড়ো করে শ্বাস টানল,
-“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।”
-“কারণ?”
-“সেটেল হতে চাই। জব হোক।”
-“এরপর বিয়ে?”
-“এরপর আরও ছয় মাস চাই নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। তারপর।”
-“এখন করতে সমস্যা কী?”
-“সমস্যা না, মন টানছে না। আমি চাইছি না মনের বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিই।”

শরৎ এখানে থামল। তারপর বলল,
-“আমাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি?”

প্রিয় বিনাবাক্যব্যয়ে বলল,
-“না। নিঃসন্দেহে আপনার চেয়ে যোগ্য কাউকে আমি পাব না। তবে আমি চাই, এই কয়মাস আপনি আমার সাথে কোনো রকমের যোগাযোগ রাখবেন না। কেউ-কাউকে দেখব না, শুনব না—অনুভূতিটা কি গাঢ় হয় নাকি মুছে যায়, এটা আমার দেখার আছে।”

শরৎ কিঞ্চিৎ হাসল,
-“ঠিক আছে। তাই হবে। তবে এর আগে বিয়ে পড়ানো হবে আজ, এই মুহূর্তে। আনুষ্ঠানিকতা পরে হবে। তৈরি হয়ে নিন মিসেস নীরজ শিকদার হতে।”

প্রিয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শরৎও দাঁড়াল। দু-হাত দূরত্ব মাঝে রেখে বলল,
-“এসেছিলাম পাকাকথা বলতে। আপনাকে দেখে বিয়ে করার ইচ্ছে জেগে উঠল। আপনি বহুত শেয়ানা, প্রিয়। কখন বেঁকে বসবেন, বুঝতে পারব না। এদিকে আপনাকে পাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি আর একটি মুহূর্তও কাটাতে পারব না। দোষটা কি আমার? নাকি আপনার? যে আমাকে প্রতিটি ক্ষণে হারানোর ভয় দেখায়!”

প্রিয় অস্ফুটে বলল,
-“নীরজ ভাই!”

শরৎ তৎক্ষনাৎ থামাল ওকে,
-“শশশ্! আপনি যদি বলতেন আমি অযোগ্য, তবুও বিয়েটা আমাকেই করতে হতো। সবাই যোগ্য কাউকে পায় না, আপনিও পেতেন না। যেহেতু আমাকে পছন্দ আপনার, কবুল বলার জন্য তৈরি হন, প্রিয় সুখ।”

চলবে..

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪২|

ঘরোয়াভাবে বিয়ে পড়ানো হলো প্রিয়র। প্রিয় পুরোটা সময়ই চুপ ছিল, অনুত্তেজিত ছিল। শরৎ লক্ষ করেছে সবটা। বিয়ে পড়ানো শেষে এক ফাঁকে এসে বলল,
-“লিখিতভাবে আপনার সুখ-দুঃখের ভাগ নিলাম, প্রিয়।”

প্রিয় তাকাল না শরতের দিকে। শরৎ হেসে ফেলল,
-“রাগ?”

প্রিয় ছোট্ট করে জবাব নিল,
-“উঁহু।”
-“তবে?”
-“মনে হচ্ছে, লাইফটা হুট করেই পালটে যাচ্ছে।”
-“অস্বাভাবিক নয়।”
-“ভালো লাগছে না।”
-“মন খারাপ?”
-“সম্ভবত।”
-“আচ্ছা।”
-“কী?”
-“আমি তো মন ভালো করার দায়িত্বটাও নিয়েছি।”

প্রিয় চকিতে তাকাল শরতের দিকে। শরৎ ফোনে কাকে যেন ম্যাসেজ করল। তারপর বলল,
-“এগোতে থাকুন, ফুল। চলতি পথটার কাটা সরিয়ে দিয়ে ফুল বিছানোর জন্য আমি ২৪/৭ আপনার একান্ত মানুষ হয়ে আছি।”

প্রিয় উদ্বেগপূর্ণ গলায় শুধাল,
-“কী করতে চাইছেন, নীরজ ভাই?”

শরৎ হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। সেকেন্ডের কাটা ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে একই স্থানে ফিরে আসছে। পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াটিতে নজর স্থির রেখে সে প্রিয়কে বলল,
-“হারানো সবকিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। যা হারিয়েছ, তার চেয়েও দারুণ কিছু এনে দিতে চাই। শুরুটা আজ হোক। শেষটা আমার মৃত্যুক্ষণ হোক।”

এর ঠিক ঘন্টাখানেক পর শরৎ একটু কাজের বাহানায় বাড়ি থেকে বেরোল, সঙ্গে প্রহরও এলো। অপজিটের রোডে দুইজনে দাঁড়াতেই বাইকে করে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। হেলমেট খুলে সামনে শরৎকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল, প্রহরকে দেখে কোঁচকানো ভ্রু শিথিল হলো। হেসে জড়িয়ে ধরল প্রহরকে। জিজ্ঞেয করল,
-“কী-রে ব্যাটা! এত ইমার্জেন্সি ডাকলি? কলে তেমন কিছু জানাসওনি।”

প্রহর পরিচয় করিয়ে দিলো,
-“ভাইয়া, আসলে নীরজ ভাইয়া বলেছিল তোমাদেরকে কল দিতে।”
-“আমাদেরকে? আর নীরজ ভাই মানে?”

প্রহর কিছু বলার আগেই শরৎ এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“আমি নীরজ। প্রিয়র সদ্য বিয়ে করা বর।”

চমকে উঠল শাওন,
-“ও না অন্য কারো সাথে সম্পর্কে ছিল? যার জন্য আমাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করল!”

শরৎ হেসে বলল,
-“একটা টক্সিক রিলেশনের স্থায়িত্ব খুব একটা বেশিদিন থাকে না। তুমি কি খুশি নও?”

শাওন হাত এগিয়ে শরতের সাথে হ্যান্ডশেক করে লম্বা একটা হাসি ফেলে বলল,
-“খুশি না মানে? ব্রেকাপ কবে হইছে, দুলাভাই?”
-“সম্পর্ক খারাপ হয়েছে বছর ২-৩ আগে থেকেই। অফিশ্যিয়ালি ব্রেকাপ হলো একমাস আগে।”

শাওন হাতটা বুকে ছুঁইয়ে বলল,
-“কী যে খুশির একটা খবর দিলেন না, দুলাভাই? শান্তিতে কাউকে ধরে দুইটা চুম্মা খাইতে ইচ্ছা করতেছে। বাট আ’ম স্টিল সিংগেল নাও। এই প্রহইর‍্যা! একটু এদিকে আয় তো, চুম্মা দিই।”

প্রহর দু’কদম পিছিয়ে বলল,
-“উঁহু ব্রো, আই হ্যাভ মাই গার্লফ্রেন্ড! সে আবার ফ্রেশ জিনিস পছন্দ করে।”

শাওন এগিয়ে গিয়ে প্রহরের কাঁধ জড়িয়ে বলল,
-“আরেহ শালা, প্রেম করে ফেলছিস? বড়ো ভাইদের আগে ক্যামনে করলি? কলিজা কাঁপল না? দেখি তো তোর কলিজাটা! কয় হাতের বানাইছোস।”

কেশে উঠল শরৎ,
-“শাওন, শোনো!”

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শাওন,
-“জি দুলাভাই, বলেন।”

ইতস্তত করতে করতে শরৎ বলল,
-“প্রহরকে শালা বোলো না। ওর একমাত্র বোনের সাথে একটু আগেই আমার বিয়ে হয়েছে।”

শাওন খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল,
-“স্যরি দুলাভাই! গালতি সে মিস্টেক!”

নতমুখী হয়ে হাসল শরৎ। কিছুক্ষণের মধ্যে তমা আর দিশাও চলে এলো। দিশা কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছিল, সেখান থেকে দৌড়ে চলে এসেছে। আর তমা ঘুমাচ্ছিল। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কেবল জামাটাই চেঞ্জ করে চলে এসেছে। ওদের এই অবস্থা দেখে শাওন সবার আগে দশ মিনিট হেসে নিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসল। চোখ বন্ধ করে এক হাত পেটে অন্য হাতের তর্জনী ওদের দিকে তুলে হো হো করে হাসল। আবার ফুটপাথের উঁচু জায়গাটায় বসে পড়ে হাসল। ওর হাসি চলতে থাকা অবস্থায় শরৎ আর প্রহর মিলে তমা আর দিশাকে পুরো ঘটনাটা এক্সপ্লেইন করল। শেষে এ-ও বলল, প্রিয় প্রতিমুহূর্তে নিজের ভুলের জন্য আফসোস করে, সবচেয়ে বেশি মিস করে তার বন্ধুমহলটা!

তখন সবার একটাই প্রশ্ন। যদি এতই মিস করেছে, তাহলে একটা ম্যাসেজ অবধি দিয়ে কেন জানায়নি? দূরত্ব তো শ্রেয়ানের জন্যই মাঝে দেয়াল করেছিল, তবে শ্রেয়ান যাওয়ার পর কেন এমুখো একবার হয়নি?

জবাবে নিশ্চল আওয়াজে শরৎ বলল,
-“ওই যে? সংকোচের দেয়াল তৈরি হয়ে গিয়েছিল।”

বিপরীতে সবাই চুপ। শরৎ সবাইকে সবটা ভালোমতো বোঝাল। সেই সাথে জানাল, শ্রেয়ান বিষয়ক কোনো প্রশ্ন যাতে না করা হয়। সবাই তাতে রাজি।

_____
গেস্ট রুমে মনোহরার সাথে প্রিয় বসে বসে কথা বলছিল। প্রিয়র পরনে নাহারার একটি গাঢ় নীল রঙের বেনারসি কাতান। সে শাড়ির আঁচল সামলাচ্ছে। আজ নাহারা পরিয়ে দিয়েছিল। তাই কেমন যেন হয়ে আছে। ঠিক করতে করতে খেয়াল করল কেমন আওয়াজ আসছে। চেনা আওয়াজ, পরিচিত আওয়াজ। ভীষণ রকমের!

প্রিয় উঠে দাঁড়ায়, ধীরে পায়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই তমা, দিশা ও শাওনসহ প্রহর ও শরৎও এসে ওখানে দাঁড়ায়। প্রিয়র পা জমে যায়। মুখটা হা হয়ে যায় প্রিয় তিন বন্ধুদের একসাথে দেখে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিমায় এক হাত দিয়ে অন্য হাতের পিঠে চিমটি কেটে এর সত্যতা প্রমাণ করল।

প্রিয়কে এভাবে দেখেই তমা এগিয়ে আসে,
-“কী রে, বন্ধু? দিশার সাথে দেখি তুমিও বিয়ে করে ফেললে? সিঙ্গেল কি আমি আর শাওন্যাই রইলাম?”

শাওনও এগিয়ে এলো,
-“মামা, দাওয়াত দিলা না? এই তুমি বন্ধুশিপ করছিলা আমাদের সাথে? দোস্ত যেমন-তেমন। দুলাভাইটা মনের মতন। কাচ্চির দাওয়াত বঞ্চিত করা থেকে রক্ষে করল। এই খুশিতে তোর জন্য এক্সট্রা দোয়া। ডজনে ডজনে বাবুর আম্মু হ।”

দিশা এগিয়ে এসে একপাশে জড়িয়ে ধরল প্রিয়কে। জড়ানো আওয়াজে বলল,
-“আই মিস ইউ, প্রিয়।”

তমা আর শাওনও নরম হলো। একত্রে বলল,
-“উই মিস ইউ মোর, আওয়ার হার্ট!”

প্রিয়র চোখ জলে ছলছল করছে। কিঞ্চিৎ হা হয়ে থাকা মুখটা এখনও সেভাবেই। বিশ্বাস হচ্ছে এখনও। চরম অবিশ্বাস নিয়ে যখন শরতের দিকে তাকাল, দেখতে পেল ওপাশের দেয়ালে দেলান দিয়ে দু-হাত বুকে গুঁজে শরৎ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা শার্ট, চোখে মাইনাস পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের গ্লাস, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সামান্য বড়ো চুল কপালে উঠে আছে। প্রিয়কে নিজের দিকে তাকাতে দেখে শরৎ হাসল, চোখের পলক ঝাপটিয়ে আশ্বাস দিলো,
-“আপনার সুখের দিন আসছে, প্রিয়। এখন আর দুঃখ আপনায় ছুঁতে পারবে না। ছুঁবে কেবল সুখ আর আমি।”

____
চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে প্রিয় আলাদা ডেকে নিয়ে শরতের সামনে কিছু কন্ডিশন রাখে। তন্মধ্যে সবচেয়ে ওপরে ছিল,
-“নীরজ ভাই, আগামী ছ’মাস আপনি আমার সাথে কোনো ধরনের কন্ট্যাক্ট রাখবেন না।”

নির্বিকার ভঙ্গিমায় শরৎ তাকিয়ে রইল। নরমভাবে শুধাল,
-“আপনি বলবেন আর আমি তা মেনে নেব? আমাকে আমার বউয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে বলার মতো আপনি কোন মনিষী?”

প্রিয় থতমত খেয়ে গেল। একটু আগেই তো, বিয়ের আগেই শরৎ প্রিয়র সব শর্ত মেনে নিল। এখন আবার পল্টি খাচ্ছে কেন? প্রিয়র অমন চাহনি দেখে শরৎ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-“দেখা-সাক্ষাৎ, আহ্লাদ, এসব করব না ঠিক আছে। বাট নিয়ম করে রাতে অফিস থেকে ফিরে কল দেবো। পিক করতে এক মিনিট দেরি হলে, সোজা তুলে নিয়ে বাসায় চলে আসব।”

প্রিয় মুখ কুঁচকে ফেলল, রেগে গিয়ে বলল,
-“এই! আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন কেন? এটা তো কথা ছিল না!”

বাঁকা হেসে শরৎ বলল,
-“বউয়ের খোঁজ রাখার একটা দায়িত্ব আছে না?”
-“লাগবে না এত খোঁজ।”
-“সেটা আমি বুঝে নেব।”
-“নীরজ ভাই!”
-“বিয়ে করা বর আমি, ভাই ডাকো কোন সুখে?”

প্রিয় দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-“ভালো হবেন না আপনি?”
-“ইহজন্মে না। আর আপনিও আমার সব কথা মেনে চলবেন, বুঝেছেন?”

হাপিত্যেশ করে প্রিয় বলল,
-“এইজন্য বিয়ে করতে চাইনি। বিয়ের পর সবার বিহেভিয়ার ঠিক এভাবেই চেঞ্জ হয়ে যায়। এভাবেই! আপনিও বদলে গেলেন, নীরজ ভাই। এমন তো ছিলেন না।”

শরৎ দু-কদম এগিয়ে প্রিয়র দু-বাহু ধরে সোজা করে ওকে দাঁড় করায়। প্রিয়র ফরসা মুখটিতে আতঙ্কের গাঢ় লাল প্রলেপ। শরৎ প্রিয়র গাঢ় বাদামী জ্বলজ্বলে চোখটিতে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
-“আমি আপনার, প্রিয়। ইউ ক্যান ইউজ মি এভরি সিঙ্গেল ওয়ে, ইউ লাইক। একবার ট্রাই করেই দেখুন। আপনার অধিকার আদায় করে নিতে জানতে হবে। আর রইল ভালোবাসা? আমাদের মাঝে তা কোনো অংশেই কম নেই।”

প্রিয় থমকানো নজরে তাকায়। শরৎ মাঝের দূরত্ব আরও খানিকটা ঘুচিয়ে ফেলে। প্রিয়র এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে, কপালে লম্বা করে একটা চুমু খায়। ঠোঁট কপালে ঠেকিয়ে প্রলম্বিত একটি শ্বাস টানে। পরপর মুচকি হেসে বলে,
-“আজ আসি, বিবিজান? আমাদের পরের দেখাটাও শীঘ্রই হবে। অপেক্ষা করুন।”

চলবে…